প্রেমতৃষা পর্ব ৫
ইশরাত জাহান জেরিন
বড় বটগাছটার সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে তৃষাকে। আজকে না জানি তার কপালে কী লেখা আছে। ভার্সিটি আসতে না আসতেই একটা মগা ছেলের সঙ্গে শত্রুতা বেঁধে গেল। গাছের সঙ্গে সে একা বাধা অবস্থায় নেই বরং অংকুরকেও বেঁধে রাখা হয়েছে। প্রেম তাকে লুঙ্গি পড়িয়ে নিচে পিঁপড়া ছেড়ে দিয়েছে। তাও যে-সে পিঁপড়া নয়। একেবারে বিষ পিঁপড়া। বেচারার সমানে চুলকাচ্ছে। কিন্তু সে চুলকাতেও পারছে না। হাত বেঁধে রাখা। এত বড় শাস্তি তো ইংরেজরাও সিরাজুদ্দৌলাকে দেয়নি। অংকুর কাঁদো কাঁদো করে বলল, ‘ভাই পিঁপড়া সিরিয়াস জায়গায় কামড়েছে, ইয়ে মানে যদি একটু চুলকে দিতেন।’
এতক্ষণ তৃষা চুপই ছিল। কিন্তু অংকুরের কথা শুনে দাঁত কেলিয়ে বলল, ‘কই দেখি।’
সঙ্গে সঙ্গে অংকুর বলে উঠল, ‘নাউজুবিল্লাহ পুরুষ বলে কী আমার কোনো পুরুষত্ব নেই? দেখুন এসব আমার বউয়ের জন্য তুলে রাখা। কাউকে দেখাতে পারব না। কিন্তু আমার সঙ্গে প্রেম করলে অন্য বিষয়। দেখতে হলে করতে হবে। মানে প্রেম।’
তৃষা মুখ ভেংচি কেটে বলল, ‘আসছে আমার পুদিনার চাটনি। আমি ওই প্রেম-টেম করি না। এক্কেরে ভালোবাসি।’
প্রেম সঙ্গে সঙ্গে তৃষাকে একটা ধমক দিয়ে বলল, ‘ওকে তো পিঁপড়ার কামড় খাইয়েছি। তোমার বুঝি সাপের কামড় চাই? এখন বলো তোমাকে কোন স্তরের শাস্তি দেব?’
তৃষা গলা উঁচু করে, নির্ভীক ভঙ্গিতে বলল,’দেন যেটা মন চায় দেন।’
প্রেম কাছে এগিয়ে এসে বলল, ‘ লিপ ফিলার করবে?’
‘টাকা দেন করি।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘ ওকে ঠিক আছে।’ বলেই প্রেম পকেট থেকে একটা সিসি বের করল। একটু আগেই একটা ছেলেকে দিয়ে সিসিটা আনিয়েছে। তৃষা প্রেমকে বলল, ‘এই প্রেম ভাই এখানে অনেক গরম। ঘামিয়ে যাচ্ছি। একটু বাতাসের ব্যবস্থা করেন।’
‘আমার আন্ডা করব তোর জন্য শালী। বেশি কথা বলিস তুই।’
‘এই আন্ডাটা আমায় সিদ্ধ করে দিয়েন। বুঝেনই তো ডাইটে আছি।’
প্রেম ভুরু কুঁচকে বলল, ‘তার নমুনা তো দেখতেই পাচ্ছি। খাসি একটা।’
তৃষা তির্যক হাসি দিয়ে বলল, ‘খাসি চিনেন? ইয়ে কেটে ফেলা ছাগলকে খাসি বলে। এখন বলুন এখানে খাসি কে? আপনি নাকি আমি?’
‘আমি মানে? আমি কোনো খাসি না।’
‘ওমা তাই নাকি?’ তৃষা পাশে বাঁধা অংকুরকে ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এত বড় ছেলের খৎনা করা হয়নি। কী লজ্জার বিষয় বলুন তো।’ তৃষা ফের প্রেমের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ চিন্তা নেই মাইরি। ওই সামনের গাছটায় একটা খৎনার বিজ্ঞাপন দেওয়া। আমি আপনার হয়ে কথা বলে আসব। একেবারে জব্বর সার্ভিস দেবে।’
‘তুই আগে সার্ভিস নে ট্যাবলেট। আর আমি কী করেছি, কী করিনি সেটা জানতে হবে না তোকে? যেদিন ধরব না সেদিন বুঝবি কে খাসি আর কে পাঠা।’
‘তেল মেখে আসব গায়ে। ধরতে গেলেই বাইং মাছের মতো ফুরুৎ।’ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল।
‘ছাই দিয়ে নেব। ফসকাবে না।’
তৃষা চুপসে যায়। তার আর এখানে ভালো লাগছে না। ওদিকে শিমলাটা সেই কখন থেকে প্রেমকে রিকুয়েষ্ট করছে তৃষাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। প্রেম চোখ গরম করে জানিয়ে দিয়েছে আরেকবার মুখ থেকে সাউন্ড বের হলে তাকেও নাকি বাঁধবে। তাই ভয়ে মেয়েটি আপাতত চুপসে আছে।
‘এই ভাই, ও মোর সিনিয়র ভাইয়া ঠ্যাং ব্যথা হয়ে গেছে তো। এবার ছাড়ুন।’
‘ধরলাম কই?’
প্রেম ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে তৃষার সামনে এসে সিসিটা ধরতেই তৃষা বলল, ‘এটা কী?’
‘তোমার বাল।’ প্রেম গম্ভীর গলায় জবাব দিল।
‘আর প্রেম ভাই একটা হেব্বি মাল।
‘তোমায় থাপড়িয়ে গাল করে দেব লাল।’
তৃষা ঠোঁট বাঁকিয়ে ভেংচি কাটতে যাবে তার আগেই প্রেম সিসি খুলে সেখান থেকে মধু বের করে বলল, ‘মধু খা শালী। তারপর যদি মুখের ভাষা মধুময় হয়। সিনিয়রদের সঙ্গে কেমন করে কথা বলতে হয় তা তো শিখিসনি। ‘
‘আপনিও তো জুনিয়রদের সঙ্গে ভালো করে কথা বলেন না। তাদেরকে ভালোবাসেন না।’
‘হলের রুমে দেখা করো ট্যাবলেট। ভালোবাসা দেবনি, ঝোলা ভর্তি করে নিও।’
‘যাব না। আপনি কাজ করান খালি।’
‘আর করাব না। জাস্ট অংকুরের সাত মাস না ধোঁয়া জাঙ্গিয়াটা একবার ধুয়ে দিলেই হবে।’
সে কথা শুনে অংকুর ফের বলে উঠল, ‘ভাই এসব না বলে মেরে ফেললেই তো পারেন আমায়।’
প্রেম সেই কথার পাত্তা দিল না। তৃষাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই তৃষা বলল, ‘সমস্যা নেই আমিও আপনাকে সেই জাঙ্গিয়া ধোঁয়া পানি যদি চিপরে শরবত করে না খাইয়েছি তবে আমার নামও তৃষা নুজায়াত নয়।’
প্রেম এগিয়ে এসে জোর করে তৃষার ঠোঁট সহ ঠোঁটের আশপাশে মধু লাগিয়ে দিয়ে পকেট থেকে আরেকটা বাক্স বের করল। তৃষা সেখানে তাকাতেই ভয়ে চিৎকার করে উঠল। এমা মৌমাছি? এই লোক তাকে শেষ পর্যন্ত মৌমাছির কামড় খাওয়াবে?
‘এই ভাই দেখেন। ছোট মানুষ তো, একটু না হয় ভুল হয়েছে। তাই বলে মৌমাছির চুমু চাই না। প্লিজ আপনার ইয়ে মানে পা ধরি এই যাত্রায় ছেড়ে দেন।’
প্রেম বিরক্ত গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘ইয়ে ইয়ে ছাড়া কথা বলতে পারো না? খাটাশ মেয়ে।’
‘সরি সরি,ক্ষমা করে দেন। চুমু খেতে চাই না।’
‘চুমু তো তোমায় খেতেই হবে সোনা। কারণ এখন যে তোমায় চুমু খাওয়ানোর ভীষণ ফিল পাচ্ছে।’
যুবরাজ চেয়ারে পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে। পিস্তলটা পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে সামনে বসে থাকা তৃষার মা-বাবাকে বলল,’জলদি বলুন আপনার মেয়ে কোথায় গিয়েছে? নইলে কিন্তু মাথা উড়িয়ে দিব।’
তৈমুর তখনো ফোনে গেমস খেলছে। সে যে কিডন্যাপ হয়েছে সে খেয়াল কী তার আছে? যুবরাজ রাফসানকে বলল, ‘এই শালার ফোনটা নে তো। কিডন্যাপ করেও দাম পেলাম না। মন চাইছে ফোনটা ওর পেছন দিয়ে ঢুকাই।’
‘ভাই পরে কিন্তু অপারেশনের খরচা আপনাকেই বহন করতে হবে।’
‘হ্যাঁ তাও ঠিক।’ হঠাৎ তৃষার মা চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘এই কোনো সবজি আছে? এখন আমার সবজির শরবত খাওয়ার সময়। ডাইটে আছি তো।’
যুবরাজের খুব করে বলতে ইচ্ছে করছে, ‘শরবত নয় আপনাকে হিশু করে দেওয়া সুইমিং পুলের পানি গুলিয়ে খাওয়াতে ইচ্ছে করছে।’ তবে সে বলল না। হবু শশুর-শাশুড়ি হয় তো। যুবরাজ তৃষার বাবাকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই সে বলে উঠল, ‘এই বাবা এই কিডন্যাপ করে কোথায় নিয়ে এসেছো? কী গরম এখানে? এত টাকা কামিয়ে কী লাভ যদি জনগণের জন্য একটা এসি না লাগাতে পারো? এভাবে কেউ কিডন্যাপ করে? একটা টিভিও নেই। এখন আমি খবর দেখব কী করে? সন্ধ্যা সাতটার খবর শুরু হতে চলল।’
লোকটিকে থামিয়ে তৃষার মা আবার বলে উঠল, ‘ এই বুড়া চুপ থাকো। আমার এখন জি বাংলার নাটক দেখতে হবে। গতকালের পর্বে দেখলাম রাধা ছাদ থেকে পড়ে যাচ্ছিল। এখনো আকাশেই ঝুলে আছে নাকি রিক লন্ডন থেকে এসে তাকে ক্যাচ করেছে সেটা দেখতে হবে না?’
মাকে থামিয়ে আবার তৈমুর চুপ যায় নাকি? সেও ফোনে ফ্রি-ফায়ার খেলতেই হবে, তারও ফোন চাই বলে আন্দোলন শুরু করল। শেষে যুবরাজের মাথা পুনরায় গরম গেল। কেমন জানি চক্কর চক্কর দিচ্ছে। সে রাফসানকে দ্রুত বলল, ‘গবেট এদের বিদায় করে বাড়ি পাঠিয়ে দে। এদের কিডন্যাপ করে আমি নিজেই এখন পাগলপ্রায়।’
রাফসান মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘আগেই বলেছিলাম এই পাগলের পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক কইরেন না। শুনলেন তো না। এখন ভুগতে থাকেন। আবার তো বিয়ে করতে চান আরেক পাগলকে। ছ্যাহ!
অন্ধকার কক্ষটির অস্তিত্ব মৃত্যুর অন্তঃস্থল থেকে উঠে আসার সংকেত জানান দিচ্ছে। আলো এখানে ঢোকে না, ঢুকতেও চায় না। ভারি, কালচে পর্দা জানালাকে গিলে খেয়েছে। বাতাসে জমাট বাঁধা রক্তের গন্ধ। কেমন যেন শ্বাসরুদ্ধকর সব। দেয়ালজুড়ে ঝুলছে বিকৃত সব প্রতিচ্ছবি। কোথাও চোখ উপড়ে ফেলা মুখ, কোথাও ভস্মীভূত অঙ্গ, আবার কোথাও হাহাকার মিশে থাকা অস্পষ্ট মানুষের চেহারা। ছবিগুলো যেন আর ছবি নয়, একেবারে মৃত আত্মাদের বন্দি আর্তনাদ। এক কোণে স্তূপ হয়ে পড়ে আছে ছুরি, করাত, ও নানা রকম অচেনা যন্ত্র। প্রত্যেকটির ধারকণা এখনও কারও চামড়ার স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছে। ধাতব গায়ে শুকনো দাগ, কিন্তু সেই দাগ থেকে উঠে আসে ধোঁয়া-মেশানো কাঁচা রক্তের গন্ধ।
সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দৃশ্যটি অপেক্ষা করছে দেয়ালের গায়ে গায়ে। সারি সারি পুতুল। যাদের মাথা জোর করে নেড়া করে ফেলা হয়েছে। শূন্য কাঁচের চোখগুলো স্থির তাকিয়ে আছে দর্শকের দিকে। অথচ চোখের ভিতর নেই কোনো প্রাণ। কিছু পুতুলের গলায় কাটা চিহ্ন, কিছুতে কালি, সেলাই করা, কিছু আবার হেসে আছে ভাঙা দাঁতের মতো বিকৃত এক ভঙ্গিতে। কালো হুডি পড়া লোকটার মুখে একটা কালো মাস্ক। সে ঘরে ঢুকতেই হাতের ব্যাগটা থেকে একটা নতুন পুতুল বের করল। টেবিলের ওপর থেকে একটা চাকু তুলে ইচ্ছে মতো আঘাত করতে থাকল পুতুলের চোখের ওপর। যতক্ষণ না মনের শান্তি মিটল ঠিক ততক্ষণ পর্যন্ত। স্বাদ মেটার পর সেই বিকৃত পুতুলটিকে আরো বিকৃত করতে কেঁচি দিয়ে সব চুল কেটে একেবারে নেড়া করে দিল।
প্রেমতৃষা পর্ব ৪
তারপর কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল পুতুলটির দিকে। ঠোঁটের কোণ বেঁকে যায়। পরক্ষণেই ভেসে ওঠে এক বিকট হাসি। যা মানুষের নয়, পশুরও নয়। যেন অর্ধেক মৃত, অর্ধেক জীবিত কোনো দুঃস্বপ্নের গলা ফেটে বেরিয়ে আসা আওয়াজ। হাসির প্রতিধ্বনি দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তেই মনে হয়, সারি সারি নেড়া মাথার পুতুলরা কেঁপে উঠল, আর তাদের শূন্য চোখে লেগে গেল মৃত্যুর আতঙ্ক। লোকটি এবার পুতুলটিকে জড়িয়ে ধরে তার গন্ধ শুকলো। তারপর বলল, ‘তোমার জন্য নতুন চুল চাই তো? তোমার জন্য চুল এনে দিব। তুমি রাগ করো না প্লিজ।’ বলেই সে পুনরায় আগের মতো হাসল। এবারের হাসির শব্দ আগের থেকেও শতগুণ বেশি ভয়ংকর মনে হলো।