প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২৬
জান্নাত নুসরাত
নিঝুম মেঘ জমেছে পূর্ব আকাশে। মেঘের ঘনঘটা ধীরে ধীরে হেলদোল করছে নিজ জায়গা থেকে,সাথে শব্দ হচ্ছে। রিমঝিম বারিধারা হয়তো ধরণীতে নামবে তাড়াতাড়ি। সামান্য বাতাস বইছে প্রকৃতিতে। আরশ আকাশের দিকে এক পলক চেয়ে নিয়ে সামান্য গ্রীবা বাঁকিয়ে নুসরাতের দিকে ঝুঁকে আসলো। ঠোঁটের নিচে পিষ্ট দন্তপাটি কিড়মিড়িয়ে বলে ওঠল,”কিছু পোড়ার গন্ধ পাচ্ছি মিসেস, আপনি পাচ্ছেন?
নুসরাত আরশকে সুর পাল্টাতে দেখে অবাক হলো। এক ভ্রু উচিয়ে টিস্যু দিয়ে ঘষে ঘষে নাক মুছে নিল। নাক টেনে শুকল। অতঃপর প্রশ্নাতীত চোখে আরশের দিকে চেয়ে, গম্ভীর গলায় বলল,”কোথায়? আমি কেন পাচ্ছি না?
আরশ ঠোঁটের উপর দু-আঙুল রেখে তীর্যক হাসল। সুঠাম দেহি শরীরটা সামান্য বাঁকিয়ে নুসরাতের দিকে ঝুঁকে আসলো। হিসহিসিয়ে বলল,”লেট ইট গো।
নুসরাত আরশের হেয়ালিতে বিরক্ত হলো। নাক থেকে সর্দি ভালো করে টিস্যুতে ঘষে নিয়ে নাক বাড়িয়ে আবারো শুকল। এমন ভাব করল আজ এই পোড়া গন্ধ না পেলে তার পুরো জীবন বৃথা যাবে। আরশ সামান্য বিরক্তি মিশেলে কন্ঠে বলল,”নুসরাত ইউ আর এইটটিন প্লাস, বি ম্যাচিউর!
নুসরাত আরশের দিকে চেয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসল। আকস্মিক নাক সুরসুরি অনুভূতি হতেই হাচ্চি দিয়ে ওঠল। এর পরেরবার দিতে গিয়ে মনে হলো নাক দিয়ে পানি বের হয়ে আসবো। চোখ বড় বড় করে অবিরাম সবদিকে ঘোরাতে লাগল। মনে প্রশ্নের উদ্ভট ঘটল, এখন টিস্যু পাবে কোথায়! হাচ্চি আটকে রাখায় নাকের ব্যথা ওঠল। আর তাতেই ডগমগ করে হাচ্চি আসলো৷ নুসরাত শেষ রক্ষা পাওয়ার জন্য নাক ফুলিয়ে শ্বাস ফেলল। নাক খিঁচিয়ে ওঠতেই, চোখ মুখ জ্বলে ওঠল। হাতের তালু দিয়ে নাক পরিস্কার করার পূর্বেই আরশ নিজের ডান হাত বাড়িয়ে দিল নুসরাতের সামনে। শার্টের হাতার দিকে ইশারা করল। কপালে বিরক্তির রেশ ফুটিয়ে গমগমে স্বরে আওড়াল,”জাস্ট টেইক ইট ইজি, অলরাইট? এন্ড ওয়াইপ ইউ্যের নোজ রাইট হেয়ার। নো নিড টু বি সায়। ডোন্ট বি ইমব্রেইসড, ইট’স টুটালি ফাইন।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
নুসরাত জোরে জোরে শ্বাস ফেলল। তবুও নাক মুছল না আরশের শার্টের হাতায়। আরশ মনে করল লজ্জা পাচ্ছে তাই বিরক্ত হয়ে নুসরাতের মাথা নিজের দিকে টেনে ধরল একহাত দিয়ে। নুসরাতের কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক টানে নিজের শরীরের আড়ালে ঢেকে নিল পুরো মেয়েলি শরীরখানা। তখনো হাত স্থির নুসরাতের চুলের ওপর।
আকস্মিক আরশের এমন কান্ডে নুসরাত থতমত খেল। হকচকিয়ে পিছু সরতে গিয়ে গত দু’দিনের বৃষ্টিতে ভেজা এঁটেল মাটিতে পা পিছলে গেল। মুখ থুবড়ে পড়তে নিল, তার আগেই মাথা চেপে ধরে সামলে নিল আরশ। হুমড়ি খেয়ে নুসরাত এসে পড়ল তার বুকে। শক্ত বুকের পিষ্টনে খাঁড়া নাকে, কপালে ব্যথা পেল মেয়েটা। নাকের ভেতর থাকা সকল বজ্র পদার্থ গিয়ে লাগল আরশের বুকে। যতক্ষণে আরশ দূরে সরে যাবে ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। নুসরাত নিজের এমন বাচ্চামো কান্ডে দাঁত খিঁচে দাঁড়িয়ে রইল। নিজের উপর চূড়ান্ত বিরক্তিতে দূরে সরার কথা প্রায় ভুলে বসল। দু-হাতের মুঠো মুষ্টিবদ্ধ করে মিনমিনিয়ে আওড়াল,”সারছে রে, সারছে কাম সারছে..! শেষ পর্যন্ত বেডার গায়ে তোর নাকের উচ্ছিষ্ট গুলো মুছতে হলো।
আরশ নিজের বুকে ভেজা অনুভব করতেই শব্দ করে শ্বাস ফেলল। নুসরাত চোখ তুলে উপরে তাকাতেই আরশ কপালে ভাঁজ ফেলল। চওড়া কাঁধ টানটান করে নিল মুহুর্তে। দু-আঙুল দিয়ে নুসরাতের কপাল ঠেলে নিজের শরীরের উপর থেকে দূরে সরিয়ে দিল। নিজের বুকের কাছের কাপড়ের দিকে এক পলক চাইতেই আগের বিরক্তিটুকু আরো একটু বাড়ল। চোখ বন্ধ করে প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে রুঢ় আওয়াজে বলে ওঠল,”বেয়াদব, সর এখান থেকে! নাহলে আজ একটা থাপ্পড় মাটিতে পড়বে। মাথামোটা..! সর বেয়াদব।
গ্রোসারি শপে শপিং করতে আসছেন সুফি খাতুন। সময় তখন রাত আটটা বেজে চুয়াল্লিশ মিনিট। গ্রোসারি শপে এসে দেখা হলো নিজাম শিকদারের সাথে। এখনো দু-জন দু-জনের সামনাসামনি হননি কিন্তু সুফি খাতুন দূরে থেকে ঠাওর করতে পারলেন উনিই নিজাম শিকদার। নিজাম শিকদারের সাথে সৌরভি ও আছে। দু-জনেই রান্নার মশলা কিনছেন। আহান সুফি খাতুনকে অনেকক্ষণ যাবত অনুসরণ করছিল। নানিকে বারবার নিজাম শিকদারকে লক্ষ করতে দেখে বলে ওঠল,”নানি..!
সুফি খাতুন ফিরে তাকাতেই আহান ঠোঁট চেপে চোখ দুটোর পাতা ফেলল। সুফি খাতুন বুঝলেন না আহানের এসব করার মানে কী! তাই না ঘাটিয়ে হাঁটতে লাগলেন। আহান তার পিছু ছাড়ল না। এটা সেটা বলতে থাকল। হঠাৎ চোখে পড়ল নিজাম শিকদার শপিং কার্টে কারোর ছবি নিয়ে ঘুরছেন। সুফি খাতুনকে ওখানে দাঁড় করিয়ে রেখে গণে গণে চার-পা সামনে আগাল সে। তখনই দৃষ্টিসীমায় স্পষ্ট হলো শপিং কার্টে থাকা ছবিটা। নিজাম শিকদারের স্ত্রীর ছবি ওইটা। নিজাম শিকদার ছবি দেখছেন আর কথা বলছেন ছবিটার সাথে। যে কেউ দেখলে মনে করবে শপিং করতে তিনি একা আসেননি উনার সাথে অন্যকেউ এসেছে।
কিন্তু অনুরুপক্রমে তিনি ওই ছবিটার সাথে মনোযোগের সাথে কথা বলছেন। আহানকে আর পায় কে,উল্টো পথে ফিরে গেল নানির কাছে। ততক্ষণে নিজাম শিকদার শপিং কার্ট নিয়ে আরো একটু এগিয়েছেন তাদের দিকে কিন্তু খেয়াল করেননি সৈয়দ বাড়ির লোকেরা এখানে আছে। নিজাম শিকদার এগোনোতে সুফি খাতুন যেখানে দাঁড়িয়ে সেখান থেকে স্পষ্ট হলো ছবিটা। আহান নিজের নানির কাছে দাঁড়িয়ে কানে কানে বলে ওঠল,”নানি ওই দেখো, নিজাম দাদু উনার স্ত্রীর ছবি নিয়ে এসেছেন এখানে, তুমি শুধু ভাবো উনার মৃত স্ত্রীর ছবি নিয়ে উনি এভাবে ঘুরছেন তাহলে তুমি উনাকে বিয়ে করে নিলে কীভাবে তোমাকে সাথে নিয়ে ঘুরবেন!
সুফি খাতুন আহানের কথায় ভাবনায় মগ্ন হলেন। আহান আরো উৎসাহ দেওয়ার জন্য বলে ওঠে,”উনি কতটা লয়াল হলে মৃত স্ত্রীর ছবি নিয়ে ঘুরেন, যদি স্ত্রী বেঁচে থাকে তাহলে তো মাথা তুলে ঘুরবেন। শুধু ভাবো, তোমাকে মাথায় তুলে ঘুরছেন। আর তুমি ও নিজাম দাদুর মাথার উপর বসে ডাকডুম ডাকডুম করে তবলা বাজাচ্ছো।
আহান কথাটা শেষ করে মিচকে হাসল। সুফি খাতুন গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। নিজেকে শপিং কার্টে থাকা ছবির জায়গায় ভাবতে বসলেন, ততক্ষণে আহান গ্রোসারি শপের ভেতর থেকে সুফি খাতুনের অগোচরে কয়েকটা জিনিস উঠিয়ে নিয়ে চলে গেল বিল কাউন্টারে। সেখানে গিয়ে বলল,”বিল আমার নানির কাছ থেকে নিয়ে নিবেন, জাস্ট নাও আমার বাড়ি থেকে কল এসেছে। আমার দাদা বর্তমানে ছরখাতে তাই আমাকে এক্ষুনি বাড়িতে যেতে হবে, শেষ মুহুর্তে আমি উনার পাশে থাকতে চাই। আর তো পাশে পাব না, তাই চলে যাচ্ছি। বিলটা কষ্ট করে উনার কাছ থেকে নিয়ে নিবেন।
মন্টুকে উল্টো করে কাঁঠাল গাছের সাথে বেঁধে রাখা। তাকে বাঁধা লোকগুলো নিচে দাঁড়ানো। সকলেই বিরক্তির সাথে উপরে তাকিয়ে আছে। কোমরে এক হাত রেখে অন্য হাতে টর্চ লাইটের আলো সরাসরি মন্টুর চোখের দিকে তাক করে রেখেছে। নুসরাত চূড়ান্ত রেগে গিয়ে নিচ থেকে চিৎকার করে বলে ওঠল,”ওই চুথিয়া, তোর এত উত্তেজনা আসে কোথা থেকে, যে দ্বিতীয় বিয়ে করিস?
ইসরাত মেইন পয়েন্টের দিকে ইশারা করে বলে ওঠল,
“ওখান থেকে আসে।
ইরহাম নিজের মুখের মুখোশ টেনে টুনে ঠিক করে বলল,
“শালা মা’দা’র ফা’কা’র সব কচি কচি মেয়ে বিয়ে করে নিচ্ছে আমি বিয়ে করব কী! আজ পর্যন্ত একটা মেয়ে পটাতে পারলাম না, আর শালা বা”স্টার্ড মাত্র সতেরো বছর বয়সী মেয়ে বিয়ে করে নিল। ভাগ্য ভাগ্য ভাগ্য…! মানুষের ভাগ্য দেখলে মনে হয় ওদেরটা দিন দিন লুঙ্গির মতো খুলছে, আর আমারটা দেখলে মনে হয় প্যান্টের চেইনের মতো আটকে গেছে।
ইরহাম কথাগুলো শেষ করে জিভ কাটল। নুসরাতের সাথে তাল মিলাতে গিয়ে বেমালুম ভুলে বসেছে এখানে ইসরাত আর মমো ও আছে। আহান গালি টালি দিল না। সে ভদ্র ছেলের মতো নিজ জায়গায় দড়ি হাতে দাঁড়িয়ে রইল। দড়ি হাত থেকে ছুটলেই মন্টু ওখান থেকে ধপাস করে পড়বে এটা সে হলফ করে বলতে পারে। তাই ভদ্র বাচ্চার মতো মুখ এটে দেখতে লাগল সকলের কান্ড।
ইসরাত মোটা গলায় কথা বলার চেষ্টা করল, হলোই না। তাই মুখে কাপড়ের টুকরো ঢুকিয়ে খ্যাকখ্যাক করে বলে ওঠল,” শালার পশ্চা’ৎদে’শে কয়েকটা দিলে দ্বিতীয় বিয়ের শখ মিটবে। নাম্বার ফাইভ দড়ি সামান্য লুজ কর!
আহান দড়ি ধীরে ধীরে ছেড়ে দিল। নুসরাত অস্বাভাবিক রাগী কন্ঠে বলে ওঠল,”গো’লা’মের ছাওয়ের কী পশ্চাৎদেশে মারব, সোজা মেইন পয়েন্টে মেরে ওটাই অকেজো করে দেই, না থাকবে বাঁশ, না বাজবে বাঁশুরি।
সকলেই তাল মিলাল। নুসরাত নিজের পকেট থেকে ছুরি বের করে উল্টো করে ঝুলিয়ে রাখা মন্টুকে দেখাল।
অতঃপর ইসরাত বলল,
“নাম্বার ফাইভ ওই লুইচ্ছা ব্যাটাকে আরো নিচে নামাও, নাম্বার টু তুমি ওকে ধরে রাখবে টাইটলি, আর আমি আর নাম্বার থ্রি ওর মেইন পয়েন্টের কাজ তামাম করে দেব।
আহান দড়ি ফরফর করে ছেড়ে দিল হাতের মুঠো থেকে। মন্টু মিয়া জানের ভয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে ওঠলেন। চোখ বন্ধ করে নিজের শেষ মুহুর্তের অপেক্ষা করলেন,কখন সেই মুহুর্ত আসবে। মন্টুর মিয়ার ইচ্ছে অনুযায়ী কিছুই হলো না, তার পূর্বেই মমো দড়ি টেনে ধরল। মমোর মতো রুষ্ট পুষ্ট একজন মানুষ দড়ি টানতে গিয়ে একপ্রকার ঝুলে পড়ল। আহান এসে সাহায্য করতেই চোখ ঘোরাল মমো নুসরাতের দিকে। কিড়মিড়িয়ে বলে ওঠল,”কিতা যে কইতাম, ই মাইলে’নেও’ড়ার যে ওজন। আর হেডা’টার সাথে আমার বিয়ে দিতে চাইছিল ওই ম আকারে মা গ ঈকারে গী। বুঝে নে শালী বেয়াদব..!
নুসরাত এমনি হাসতে হাসতে কাদা মাটিতে একপ্রকার শুয়ে পড়ল কোনো ঘৃণা ছাড়া। সাদা ফরমাল প্যান্ট গড়াগড়ি খেল কাদায়। কন্ঠে কোনো দ্বিধা না রেখে বলে ওঠে,”নাম্বার ফোর, ধর তোর সাথে এই মাদা’রচুদ এর বিয়ে হইগেছে। বিয়ের দিন যদি তোর সাথে ইটিস পিটিস করত, তাহলে এরপরের দিন তোর লাশ আমরা খুঁজে পেতাম। ভালো হইছে তোরে ওই সু’দা’ন্নির ফু’তের সাথে বিয়ে দেই না।
নুসরাত গালি দিতে দিতে আকস্মিক থেমে গেল। দু-হাত গালে রেখে তওবা কাটল। বিড়বিড় করে বলল, “আল্লাহ মাফ করো, মাফ করো, মাদা’র’চুদ’কে গালি দিতে গিয়ে আমার নিজের মুখ খারাপ করে ফেলছি। হায় আল্লাহ, কতদিন না জানি নাপাক থাকে আমার এই পবিত্র মুখখানা।
মন্টু মিয়ার মৃত্যুর ভয়ে মন শঙ্কিত হলো। আরেকটা বিয়ে করার শখ ছিল মনে, এবারের মতো বেঁচে ফিরলে সেই শখ জীবনেও পূরণ করবেন না। আজকের মতো আল্লাহ যেনো তাকে রক্ষা করে। মন্টু মিয়ার মনে মনে করা আহাজারি হয়তো কবুল হলো। এর ঠিক দু-মিনিট পর টর্চের আলো এসে পড়ল নুসরাতেরা যেখানে দাঁড়িয়ে সেখানে। দূর হতে গুরুগম্ভীর পুরুষালি সুরের আওয়াজ ভেসে এলো,”কে ওখানে?
আহানের মুহুর্ত লাগলো না গলা চিনতে। এরকম করে শুধু জায়িন ভাইয়া কথা বলে। হাতের দড়ি ফুস করে ছেড়ে দিয়ে নিজের জান হাতে নিয়ে সোসাইটি থেকে বের হওয়ার রাস্তা ভাগল। মমোকে এক হাতে টেনে নিয়ে যেতে ভুলল না। সেদিকে মমোকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে চিৎকার করে বলে ওঠল,” ভাগো আপ্পি, ভাগো, বড় ভাইয়া আর ছোট ভাইয়া আসছে..!
ইসরাতের চোখ দুটো রসগোল্লার ন্যায় বড় বড় হয়ে গেল। এর মধ্যে ধুপ করে গাছের মাথা থেকে উল্টে পড়লেন মন্টু মিয়া। মাটিতে পড়েই উচ্চ শব্দে কঁকিয়ে উঠলেন। ইসরাত পালাল একদিকে, মমো আহান পাশের সোসাইটির দিকে দৌড়েছে। সবকিছু ঠান্ডা হলে আসবে তারা। ইরহাম আর নুসরাত পালাল সামনের দিকে। দুটো যেতে যেতে ইসরাতকে ধাক্কা দিয়ে বাঁ-দিকে পাঠাল। নুসরাত রাগান্বিত স্বরে হিসহিসিয়ে বলল,”ভাগ শালি, তোর হাড্ডি ভাঙার ডাক্তার আজ আমাদেরই না হাড্ডি ভেঙে দেয়। ভাগ..!
ইসরাতকে বাঁ-দিকে দৌড়াতে দেখে জায়িন পিছু নিল তার। রগরগে গলায় আরশকে আদেশ দিল,”আরশ ওই দুইটার পেছনে যা।
ইসরাতকে নিজের ভাগে পেতে খুব একটা বেগ পোহাতে হলো না জায়িনকে। দৌড়াতে থাকা ইসরাতের কাঁধের কাপড় একহাতে চেপে ধরে অন্য হাতে উদর চেপে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। ইসরাত ছটফট করতেই জায়িন হুমকির সুরে বলল,”আছাড় মেরে দেব, চুপচাপ দাঁড়ান।
ইসরাতের ছটফট করা থেমে গেল। শ্বাস ফেলে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার বৃথা চেষ্টা করল। জায়িন ধীরে ধীরে ইসরাতকে মাটিতে নামিয়ে দিয়ে কাঁধ হতে হাত সরিয়ে নিল। মুখ থেকে মুখোশ খুলতে খুলতে ইসরাতকে বলে ওঠল,”বেয়াদব থাপড়িয়ে গাল ফাটাই ফেলব আপনার! এত রাতে এখানে কী করছিলেন?
ইসরাতের মুখের মুখোশ খুলে দূরে ছুঁড়ে ফেলল জায়িন। রাগে চোখে মুখ লাল হয়ে আছে। ভৎস করে দেওয়ার মতো চাহনি ইসরাতের দিকে নিক্ষেপ করে হিসহিসিয়ে বলে ওঠল,”ধরা পড়লে গণধুলাই খেতেন,এটা কী এই ছোট মাথায় আসেনি?
জায়িন কথাটা শেষ করতে করতে ইসরাতে কপালে তর্জনী আঙুল দিয়ে ধাক্কা দিল। ইসরাত কাচুমাচু ভঙ্গিতে চোখ তুলে একবার জায়িনের পানে তাকিয়ে তা আবার নিচে নামিয়ে নিল। ভদ্র মেয়ের মতো মুখ বানিয়ে চুপচাপ জায়িনের ধমক শুনল, প্রতিবাদ করল না। এর মধ্যে দূর থেকে কেউ একজন হাক ছুঁড়ে জিজ্ঞেস করলেন,”জায়িন হাতের কাছে কাউকে পেলে?
জায়িন ইসরাতের সামনে দাঁড়িয়ে ছোট্ট করে উত্তর করল,” জ্বি না, সবাই পালিয়েছে।
অতঃপর খেপাটে নয়ন ইসরাতের দিকে নিবিষ্ট করে বলে ওঠল,”আপনাকে আমি পরে দেখে নেব। বাসায় যান এখন বেয়াদব।
ইসরাত যখন যেতে নিল জায়িন হাত ধরে থামিয়ে দিল। কন্ঠে কোনো প্রকার নমনীয়তা না এনে কঠোরতার সাথে শুধাল,”এইসব উল্টাপাল্টা কাজ করতে আপনাকে কে উৎসাহ দিয়েছে? খবরদার বলবেন না, ওই পাগল এসব করার বুদ্ধি দিয়েছে!
ইসরাত কাচুমাচু করে বলল,
“জ্বি ওর বুদ্ধিই, আমরা শুধু প্ল্যান মাফিক কাজ করেছি।
জায়িন টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে দু-হাত পকেটে ঢোকাল।৷ ইসরাতের শোনার মতো করে বলে ওঠল,” সবগুলা বেয়াদব..! একটা ভালো হয়নি!
রাত এগারোটা। সোসাইটির বেশিরভাগ বাসার ভেতরে শোরগোল কমে গিয়েছে। এই রাতের বেলা শুকনো পাতার উপর দিয়ে চলাচল করায় মড়মড়ে শব্দ একটু বেশি হচ্ছে। নুসরাত আর ইরহাম প্রাণপণে দৌড়ানোতে খেয়াল করেনি নাছির মঞ্জিলের পেছনের জঙ্গলের দিকে চলে আসছে তারা। অনেকদিন যাবত এই জায়গা পরিস্কার না হওয়ায় সেখানে এত গাছপালার জন্ম হয়েছে মানুষ হাঁটার সামান্য পথটুকু ঢেকে গিয়েছে সবকিছুর আড়ালে। দু-জনের দৌড়ের গতি এতক্ষণে সামান্য কমে এসেছে। ধীরে ধীরে দৌড়ানো থামিয়ে দু-জন হাঁটতে লাগল। হা করে ফেলতে লাগল বড় বড় শ্বাস। বড় শ্বাস ফেলতে পারল কই, তার পূর্বেই তাদের পেছন থেকে বড় গলার স্বর ভেসে এলো,”এই বাস্টার্ড, দাঁড়া!
নুসরাত আর ইরহাম দু-জন দু-জনের দিকে তাকিয়ে আরশকে ভয়ংকর দুটি গালি দিয়ে ওঠল। নুসরাত নিজের মুখোশ খুলেছিল আরশের গলার স্বর শুনতেই তা টেনে নিল মুখে। আবারো দৌড় দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ইরহামকে বলে ওঠল,”আমার বাপ, উল্টো পথ ধর, নাহলে রক্ষে হবে না আজ আর। হেলাইল্লার বাচ্চা পিছু ছাড়েনি। ও আল্লাহ এর উপর একটা কিছু পড়ে যাক। আমাদের মতো বাচ্চাদের পেছনে একে লাগানোর জন্য, এর ঠ্যাংখানা মুচড়ে যাক।
ইরহাম নুসরাতের কথা শুনে গাছের মধ্যে দিয়ে বাঁ-দিকে দৌড়াল। রাতের এই অন্ধকারে নিমেষে উধাও হয়ে গেল আরশের চোখের দৃষ্টিসীমানা থেকে। নুসরাত মনে করল হয়তোবা এই ব্যাটা তার পিছু ছেড়ে ইরহামের পিছু নিবে, কিন্তু তাকে সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণ করে তার পিছনে আসলো। নুসরাত একবার উল্টো চেয়ে আবার সামনে ফিরল। একপ্রকার জান হাতে নিয়ে দৌড়াতে লাগল। মনে মনে আল্লাহর নাম জপ করতে লাগল। শুধু দোয়া করল আজ যেনো আরশ নামক এই বেয়াদব লোকের হাত থেকে রক্ষে পেয়ে যায়। মাথায় এটা নেই আরশের হাত থেকে রক্ষা পেলেও এখানে থাকা বিষাক্ত সাপের হাত থেকে বেঁচে ফিরা মুশকিল হতে পারে।
গত কয়েকদিনের বৃষ্টিতে পানি জমে মাটির অবস্থা স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে।। কোথাও কোথাও শেওলা জমে পিচ্ছিলতা দেখা দিয়েছে। নুসরাত শেওলার উপর দিয়ে দৌড় দিতে গিয়ে স্লিপ কেটে মুখ থুবড়ে উল্টে পড়ল গিয়ে কাদার মধ্যে। চোখে কাদা ঢুকে গেল সেকেন্ডের ভেতর। তবুও দু-হাতে ভর দিয়ে ওঠে দাঁড়াল। মাটিতে উল্টে পড়ায় এক পায়ের স্লিপার পড়ে রইল ওখানে। অন্য পায়ের স্লিপার খুলে তা ছুঁড়ে মারল আরশের দিকে। সেটা উড়ে গিয়ে একদম আরশের মুখের উপর পড়ল। নুসরাত ভাবতে পারেনি তার হাত এত শার্প। নিশানা বরাবর গিয়ে লেগেছে জুতোটা।
আবারো জঙ্গলের মধ্যে দিক বেদিক ভুলে দৌড়াতে গিয়ে হাঁপিয়ে ওঠল। পিছু ফিরে দেখল আরশ এখনো তার পিছু করছে। হাঁপিয়ে ওঠার কোনো লক্ষণ ওই ষাঁড়ের মধ্যে নেই। সামনে ফিরতেই চোখে ভাসল কয়েকটা গাছের বড় বড় ঢাল পড়ে আছে। এতেই মাথায় আগুন ধরে গেল নুসরাতের। প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে আওড়াল,”সকল বালের গজব আজই পড়তে হবে। সাউয়া, ভাগতে গেলেও যত সমস্যা। আল্লাহ জীবনে একটা ভালো কাজ করে থাকলে এই আরশকে তুমি নিজের করে নাও। আমিন আমিন আমিন!
নুসরাত লাফ দিয়ে পড়ে থাকা ঢালগুলো পাড়ি দিতে চাইল, সেই সুযোগে আরশ পেছন থেকে নুসরাতের পেট হাতের সাহায্যে পেঁচিয়ে ধরে শূণ্যে তুলে ধরল। নুসরাত দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ভেতরের রাগটুকু সংবরণ করতে চাইল, হয়তো পারল। মাটি হতে দু-হাত উপরে শূণ্যে ভাসা পা-গুলো ঝাঁকাতে লাগল দ্বিগুণহারে।শক্ত হাতে নিজের পেটের উপর থাকা আরশের হাত খামচে ছাড়াতে চাইল, বলিষ্ঠ হাত দুটো আরো দ্বিগুণ শক্তিতে চেপে ধরল তাকে নিজের সাথে। নুসরাত রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে আরশের গোপাণাঙ্গে লাথি মারতে চাইল, একটুর জন্য মিস হয়ে গেল। তবুও দমে না গিয়ে, নতুন উদ্যোগে পায়ের নিচ দিয়ে আরশের হাঁটুর মধ্যে লাথি মারল।
সেন্সসেটিভ স্থান হওয়ার ধরুণ একটুক্ষণের মধ্যে আরশ কাবু হয়ে গেল। নুসরাতের পেটের কাছে বাঁধা হাত ঢিলে হয়ে আসলো। মেয়েটা ভুলে বসল আরশ তাকে ছেড়ে দিলে এখান থেকে সোজা মাটিতে পড়বে, যতক্ষণে তা মনে হলো ততক্ষণে তার উদর, কপোল, নাক, ঠোঁট গিয়ে ঠেকেছে মাটিতে। অস্বাভাবিক ব্যথায় হাত পা ঝিম ঝিম করে ওঠে অসাড়তায় তা । আরশ এক হাঁটু গেড়ে বসল নুসরাতের কাছে। পিঠের কাছের কাপড় চেপে ধরে একটানে সোজা করে ফেলল নুসরাতের পুরো শরীর। পকেট থেকে ফোন বের করে ফ্ল্যাশলাইট জ্বালিয়ে নিল। অতঃপর একহাত হাঁটুর উপর রেখে অন্যহাতে নুসরাতের মুখের দিকে আলো তাক করল। লহু স্বরে আদেশ দিল,”ওপেন ইউ্যের আই’স!
নুসরাত চোখ খুলে তাকাল না। চোখ খুলে তাকালেই এই ব্যাটা বুঝে নিবে কে সে! এরপর গিয়ে মেদ মা, মেদ মা বলে বিচার দিবে তার মায়ের কাছে।আর তার পিঠের উপর পড়বে নাজমিন বেগমের অতি উচ্চমাত্রার চপ্পল জোড়ার ধুমধামে কয়েকটা বারি। নুসরাত তাই গোড়ামি করে নিভু চোখে আরশকে দেখল, তবুও পুরো চোখ খুলল না।
আরশ হাতের ঘড়ির দিকে চোখ রেখে বলে ওঠল,
“’আই উইল গিভ ইউ থারটি সেকেন্ড’স, নট আ ওয়ার্ড.জাস্ট টেইক অফ দেট মাস্ক—অর আই সোয়ার, আই উইল হেঙ্গ ইউ আপসাইড ডাউন ফ্রম দেট থ্রি মাইসেল্ফ।
নুসরাত এক চোখ খুলে সরাসরি আরশের দিকে তাকাল। সে জানে না নাকি একবার মুখোশ খুলে এই লুইচ্চা তার মুখ দেখলে, সোজা গিয়ে তার মা নামক জল্লাদ মহিলার কাছে নালিশ করবে। তাই চুপ থেকে এখানে আরাম করে শুয়ে থাকা নিজের নিকট অনেক বেশি শ্রেয় মনে হলো।
কিৎকাল অতিবাহিত হওয়ার পর নুসরাত বসতে যাবে আরশ হাত দিয়ে নুসরাতের মাথা চেপে ধরে রাখল মাটির সাথে। চোয়াল শক্ত করে নুসরাতের শোনার মতো করে গণনা করল,”ফাইভ…ফোর….থ্রি….টু….এন্ড ওয়ান। ইউ্যের টাইম ইজ আপ মিস..!
আরশ একহাত নুসরাতের মাথার উপর রেখে অন্যহাতে নুসরাতের মুখের মুখোশ খুলতে নিবে তার পূর্বেই নুসরাত আরশের টাখনুর মধ্যে সর্বশক্তি দিয়ে লাথি মারল। আরশ ঠিকভাবে না বসায় মুখ থুবড়ে গিয়ে পড়ল। যেখানে সেখানে পড়ল না, একদম নুসরাতের গলদেশে পড়ল। কড়া কস্তুরির সুঘ্রাণ আর মাস্কি পুরুষালি কোলনের সুগন্ধিতে দুজনের চারপাশ মো মো করে ওঠল। নুসরাতের সেদিকে ধ্যান নেই, তার বিরক্তি সময়ের সাথে কমার বদলে শুধু বাড়ছে! চোখ বড় বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বিড়বিড় করে আওড়াল,”এটাই বাকি ছিল, নে এবার একটা চুমু খেয়ে সেটাও পূরণ করে দেয়।
আরশ মাথা তুলে গলা খাঁকারি দিল। মোবাইল উড়ে গিয়ে পড়েছে দূরে। আরশ নুসরাতের উপর ঐ অবস্থায় থাকতে থাকতে চাইল মুখ থেকে কাপড় সরাতে নুসরাত আর তা হতে দিল না। আরশকে দু-পা দিয়ে পেঁচিয়ে নিজের উপর থেকে উল্টে ফেলল পাশে। আরশ নুসরাতের এক হাত চেপে ধরে কাবু করার চেষ্টা করতেই, অন্য হাত দিয়ে পকেট হাতড়ে মাঝারি আকারের একটা ছুরি বের করল নুসরাত। সময় ব্যয় না করে তা চেপে ধরল আরশের গলার নরম ত্বকে। গলায় ছুরি চেপে রেখে নাক বন্ধ করে বলে ওঠল,”নেক্সট টাইম মিস্টার।
আরশ চুপচাপ দেখল মাটিতে শুয়ে। সামান্য আলোয় মেয়েলি শরীরের অবয়ব দেখা গেল। আরশ মুখে বিরক্তির রেশ ফুটিয়ে তুলল। সে চাইলেই এই মেয়েকে ধরতে পারবে, কিন্তু ধরল না, দেখতে চাইল কী করে এই মেয়ে! ঘাড় কাত করে চেয়ে রইল এক দৃষ্টিতে। নুসরাত হালকা আমোয় বুঝতে পারল আরশের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি তার দিকে। ওঠে দাঁড়িয়ে কাপড় ঝাড়তে ঝড়তে বলে ওঠল,”এই ফিটফাট শরীর নিয়ে কী করবেন, সামান্য আমাকেই কাবু করতে পারলেন না! ছে্ ছে্ ছ্যাহ..! আমার পিছু নেওয়ার চেষ্টা করবেন না, নাহলে এখানেই মেরে লাশ ফেলে দিব।
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ২৫
নুসরাত কথা শেষ করে দৌড় দিল নাছির মঞ্জিলের পাছিরের দিকে। আরশের হাত থেকে মোবাইল দূরে ছিটকে পড়ায় দূর থেকে আসা আলোর রশ্মিতে সামান্য দেখা গেল মেয়েটার অবয়ব। দেয়াল টপকে যখন ওপাশে যাচ্ছিল তখন সামান্য ঘাড় কাত করে তার দিকে তাকাচ্ছিল সে। মুখের মুখোশ খুলে ফেলায় পাঁছিরে থাকা সাদা বর্ণের লাইটের আলোয়, নাকে পরা সাদা পাথরের নউজ পিন জ্বলজ্বল করে ওঠল। আরশ সেদিকে চোখ রেখে মাটি থেকে উঠে বসতে বসতে বিড়বিড় করল,”বেয়াদব!