একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৬৭
Mousumi Akter
সারাহ’র চোখে মুখে দুষ্টুমি। সে দুষ্টু চোখে রোশান সিদ্দিকীর চোখে চোখ রাখল। মৃদু কন্ঠে বলল,
” যদি কিছু অনর্থ ঘটে তো ঘটুক না। সমস্যা নেই তো। হালাল বউ তো আপনার। বউ তো আর অবৈধ না।”
রোশান সিদ্দিকী আকস্মিক তার বউ এর এত রোমান্টিক কথাবার্তা শুনে কিছুটা অবাক তো হচ্ছেন ই। ভ্রু যুগল কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
” সুবিধার লাগছে না তোমাকে। কি চাও সেটা বলো।”
সারাহ লাজুক চোখে তাকিয়ে বলল,
” জানেন না বউ এর সাথে যত টাইম পাস করবেন তত সওয়াব পাবেন। এসব হাদিস জানেন না বুঝি। আপনার না মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া উচিত। কেন হওয়া উচিত জানেন? কি কি করলে বেশি সওয়াব পাবেন এসব জানার জন্য মাদ্রাসায় ভর্তি হওয়া উচিত। শুধু একাউন্টিং এর সূত্র আপনাকে কেয়ামতে শাস্তির থেকে বাঁচাতে পারবে না। স্ত্রী হিসাবে আমার কিছু দায়িত্ব আপনার ওপর ও আছে। আমি ভাবছি কি জানেন, আপনার জন্য একজন হুজুর রাখব বাসায়। এই হুজুর আপনাকে শুধু বউ এর সাথে কি করলে বেশি সওয়াব হবে সেসব শেখাবে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রোশান সিদ্দিকী না হেসে পারল না। সে সারাহকে একটু শক্তভাবে জড়িয়ে ধরল। সারাহ’র ঠোঁটে চুমু দিয়ে বলল,
” সব আমি জানি। কিন্তু পরে আমাকে সামলাতে পারবে তো মিসেস সিদ্দিকী? এখন যা করছো না রেজাল্ট রাতে পাবে। এখন পরীক্ষা দিচ্ছো দাও। এই পরীক্ষার রেজাল্ট আজ রাতে পাবে। খবর আছে তোমার।”
সারাহ রোশান সিদ্দিকী’র গলায় আঙুল ঘুরাতে ঘুরাতে বলল,
” কয়টার খবর স্যার? থুক্কু বর।”
” আজ তোমার খবর সন্ধ্যা থেকে শুরু হবে আর সারা রাত চলবে। কোনো বিরতি হবেনা।”
সারাহ লাজুক চোখে চেয়ে বলল,
“আপনি এসব কি অসভ্য কথা বলছেন।”
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র দিকে ফ্লায়িং কিস ছুড়ে বলল,
” কোন অসভ্য কথা বলিনি। শিক্ষক মানুষ তোমার পরীক্ষা নিব। আর এটাই আমার কাজ। ”
“আপনার রোমান্টিক অত্যাচারের পরীক্ষা আমি দিতে চাই না। ”
রোশান সিদ্দিকীর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। সে মৃদু হেসে উত্তর দিলো,
“আর তুমি এখন আমাকে যে অত্যাচারটা করছো তার কি হবে?”
সারাহ মাথা নিচু করল। লাজুক কণ্ঠে বলল,
“আমি কীভাবে অত্যাচার করলাম। ”
“এই যে আবেদনময়ী কন্ঠে আমাকে ডাকছো, নিজেকে কন্ট্রোল করতে কষ্ট হচ্ছে। এইযে আঙুল চালাচ্ছো গলায়, এর চেয়ে ছু’রি চালানো কম যন্ত্রণা হত। শুধু এটা অফিস কক্ষ বলে মান সম্মানের ভয়ে বাড়াবাড়ি কিছু করছি না। না হলে কিছু একটা হয়ে যেত।”
সারাহ খিলখিল করে হাসল। হাসতে হাসতে রোশান সিদ্দিকীর ওপর থেকে উঠলো। উঠে বলল,
” আমি আসলে মালদ্বীপ যেতে চাই। নীল পানিতে সাঁতার কাটতে চাই। রাখবেন কি আমার আবদার?”
রোশান সিদ্দিকী এইবার অদ্ভুত চোখে সারাহ’র দিকে চেয়ে বললেন,
” তাইতো বলি, আমার বউ যেচে এসে রোমান্স করছে কাহিনী কী? কিছু তো গড়মিল আছেই। সোজাসাপটা বললেই হত। এত পরিশ্রম করার কি প্রয়োজন ছিলো।”
সারাহ বলল,
” পুরুষ মানুষের থেকে কিছু আদায় করতে হলে আগে কঠিন রোমান্স করতে হয়। রোমান্সে পুরুষ মানুষ জা-ন কু র বান করতেও রাজি থাকে।”
রোশান সিদ্দিকী বললেন,
” তুমি তাকালেই তো আমি কু রবা ন হয়ে যাই। অন্য কিছু করলে তো আর কথাই নেই।”
সারাহ লজ্জা পেল। ভীষণ ভাল ও লাগল। প্রকাশ্য প্রেম প্রকাশ করলে সব নারীর ই এমন ভাল লাগে।
নিজের শাড়িটা ঠিক করতে করতে বলল,
“আমি শাড়ির কুচি ধরেছি, কুচিগুলো ঠিক করে দিন না।”
রোশান সিদ্দিকী বরাবরের মত মুগ্ধ হল। কি আছে সারাহ’র হাসিতে। সে নিজেও জানেনা শুধু জানে তার সারাটা দিন ভাল থাকার জন্য সারাহ’র হাসিই যথেষ্ট। এই হাসির জন্যই সে নিজেকে পৃথিবীর ভাগ্যবান পুরুষ মনে করে। যার বউ এত সুন্দর করে হেসে মন ভাল করে দেয় সে কেন নিজেকে ভাগ্যবান মনে করবে না। ভাল থাকার জন্য মানুষের অনেক কিছুই লাগে কিন্তু রোশান সিদ্দিকীর কাছে এই হাসিটুকুই যথেষ্ট।
সারাহ বলল,
” ঠিকঠাক ধরতে পারবেন তো কুচি গুলো।”
রোশান সিদ্দিকী কুচি গুলো খুব যত্নের সাথে গুছিয়ে ধরে বলল,
“বউ যখন বলেছে অফ কোর্স ঠিকঠাক পারব।”
সারাহ সন্দিহান চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
“আমি বলেছি সেজন্য? না হলে শাড়ির কুচি ধরে দিতেন না?”
” অবশ্যই দিতাম। এত বছরে তোমার শাড়ির কুচি ধরতে ধরতে আমি একজন মেকআপ আর্টিস্ট হয়ে গিয়েছি।”
সারাহ দুষ্টুমি করে বলল,
“আপনার তাহলে শিক্ষকতা আর কোচিং এর পাশাপাশি একটা বিউটি পার্লার খোলা উচিত। ”
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র তালে তাল মিলিয়ে বলল,
” আমার ও তাই মনে হচ্ছে উচিৎ।”
রোশান সিদ্দিকী’র উত্তর শুনে সারাহ কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়ল,
” আপনি কি তাহলে পুরুষদের শাড়ি পরাবেন?”
রোশান সিদ্দিকী পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ল,
” পার্লারে কি পুরুষ রা আসে যে, পুরুষদের শাড়ি পরাবো।”
সারাহ খুব সিরিয়াস কণ্ঠে বলল,
” শাড়ি পরালে অবশ্যই পুরুষদের ই পরাবেন। ভাবলেন কীভাবে আপনাকে আমি মহিলাদের শাড়ি পড়াতে দেবো।”
রোশান সিদ্দিকী ভ্রু যুগল সুঁচালো করে বলল,
“অদ্ভুত আমার তাহলে পার্লার খুলে লাভ কি!”
“লুঙ্গি পরাবেন লুঙ্গিতে কুচি দেয় না ওগুলা দিবেন। দাঁড়ান এক মিনিট।”
রোশান সিদ্দিকী রসিকতা করে বলল,
” বসা ছেড়ে আবার দাঁড়াবো?”
সারাহ বেশ রাগান্বিত কণ্ঠে বলল,
“আমি আপনাকে পার্লার খুলতে বললাম আর আপনি রাজি হয়ে গেলেন কেন? ”
“আমার বউ আমাকে যা বলে আমি তাই শুনি।কারণ আমি বউ এর কথায় উঠি আর বসি।”
“তাই বলে আপনি জানেন যে শাড়ি মেয়েদের পরানো হয় জেনে বুঝে আপনি রাজি হয়ে যাবেন। ”
রোশান সিদ্দিকী সারাহ’র রাগ আরো বাড়িয়ে দিতে বলল,
” বললাম তো বউ এর কথায় উঠবস করা পুরুষ আমি।”
“অদ্ভুত! তাই বলে আমি যা বলব আপনি তাই করবেন? যান সরুণ। কুচি ছাড়ুন। আপনার সাথে কথা ই বলব না। আই হেইট ইউ।”
রোশান সিদ্দিকী উঠে দাঁড়াল। সারাহ’র শাড়ির কুচি গুজে দিয়ে নাভি স্পর্শ করে বলল,
“তুমি জানো আমি তোমার জন্য কত পাগল এমন রাগ অভিমান কেন করো?”
সারাহ আবার হেসে ফেলল। হেসে বলল,
“রাগ না করলে কি আর এত যত্নের সাথে রাগ ভাঙাতেন শ্যামসুন্দর পুরুষ। ”
বলেই হাসতে হাসতে বের হয়ে হল। দরজা খুলতেই সারাহ’র চোখ দুটো আনন্দে কেমন চিকচিক হয়ে গেল। ভরা জোসনার ন্যায় চোখে মুখে আনন্দের রোসনি জ্বলছে। সারাহ যেন বিশ্বাস ই করতে পারছে না। এরই মাঝে রোশান সিদ্দিকী এসে দাঁড়াল। সে রোশান সিদ্দিকীকে অবাক হওয়া কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি আপনিও তাই দেখছেন যা আমি দেখছি।”
রোশান সিদ্দিকী দেখল,মৃন্ময় দ্বীপ তন্ময় পিহু সবাই সেই পুরণো দিনের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
রোশান সিদ্দিকী হাসি মুখে জবাব দিল,
” স্বপ্ন নয়। তুমি যা দেখছো আমিও তাই দেখছি। আর এটাই একদিন না একদিন হওয়ার ছিলো। ”
“না আমি স্বপ্ন দেখছি।এমন স্বপ্ন এর আগেও আমি দেখেছি আর আপনি বলেছেন ওটা তোমার স্বপ্ন। ”
তন্ময় বলল,
” সারাহ ওরা সত্যিই এসেছে। ”
সারাহ তন্ময় হওয়া কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“কীভাবে বুঝলি ওরা সত্যি এসছে?”
“কারণ আমি জানতাম ওরা আসবে আর এই বন্ধুত্ব ভেঙে যাওয়ার মতন নয়। এই বন্ধুত্ব দৃষ্টান্তমূলক একটা উদাহরণ বুঝলি।”
দ্বীপ বলল,
“কি দেখছিস চোখে পানি কেন?”
সারাহ ওদের কাছে ছুটে গেল। ছুটে গিয়ে বলল,
“তোরা দুজন দুজনের সাথে। ”
মৃন্ময় বলল,
“তুই তো ঘুমাতে দিস না এই শালার সাথে কথা না বললে।”
দ্বীপ বলল,
“তুই তো আমাকে ঘুমাতে দিস না। তাই দুই বন্ধু মিলে ভাবলাম মেয়েটা আমাদের দেখলে খুশি হবে। যাই কথা বার্তা বলি আর আধ পা-গ-ল কে খুশী করে আসি।”
সারাহ বলল,
“আমি সত্যিই খুশি হয়েছি। খুশীতে ম’রে যেতে ইচ্ছা করছে।”
রোশান সিদ্দিকী বললেন,
” খুশীর চোটে আমাকে বিধবা বানাতে হবেনা।”
তন্ময় বলল,
“আমি বুঝেছিলাম এদের মিল মোহাব্বত হয়েছে। দু’জনে একসাথে আমাকে ফোন দিয়েছে। দুজনেরই একসাথে ফোন দেখে বুঝে গিয়েছি সুখের সূর্যোদয় আবার উঠতে চলেছে। ”
সারাহ বলল,
“ওদের এখন দুজনের ব্রেকআপ করিয়ে দেবো তন্ময়। ওরা আমাদের এত কষ্ট দিয়েছে এখন দু’জন ঘাড়ে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে। ”
তরী বলল,
“সবকিছুই ঠিক আছে শুধু ছোঁয়া আপু যদি থাকত।।একটা গল্পের পূর্ণতা পেয়ে যেত।”
সারাহ বলল,
” তুমি আমাদের এই মুহূর্তে ওর নাম উচ্চারণ করো না প্লিজ! ওই নামে আমার এবং আমাদের জীবনে কেউ নেই। আমি ভুলে গিয়েছি ওই চ্যাপ্টার। আমার একটাবার ও এত বছরে ওর কথা মনে পড়েনি। ওই তন্ময় তোর কি কখনো মনে পড়ে। ”
তন্ময়ের মনসপটে বারবার ভেসে উঠছে এয়ারপোর্টের ঘটনা ও তন্ময়ের মতো দেখতে ছেলেটি। দেখে মনে হচ্ছিল বাচ্চাটা যেন তন্ময়ের ই। বাচ্চাটার চেহারায় কেমন একটা গম্ভীরতা ঠিক যেন তন্ময়ের মত। কেন যেন তন্ময়ের মনে হচ্ছে বাচ্চাটা তন্ময়ের। তন্ময় যেন একটা ঘোরের মধ্য আছে।
তরী বলল,
“আমি জানি আপু আপনাদের মনে অনেক কষ্ট ছোঁয়া আপুকে নিয়ে। তাও আমার বারংবার মনে হয় অতীতের সব খারাপ স্মৃতি গুলো মিথ্যা হয়ে যেন ছোঁয়া আপু আপনাদের জীবনে ফিরে আসে। আপনাদের সেই বন্ধুত্বটা আমি ভীষণ মিস করি।”
মৃন্ময় বলল,
” তোমাকে আর কতবার বলব ছোঁয়ার নাম উচ্চারণ করবে না।”
দ্বীপ বলল,
” মৃন্ময় আমাকে ঘৃণা করত। তবুও আমি ছোঁয়ার সাথে যোগাযোগ করিনি। একবার এক মেয়ে ছোঁয়ার পরিচয়ে কল দিয়েছিলো। ওর নাম বলতেই ব্লক দিয়েছি। একা থেকেছি তবুও ওই বেঈমান এর নাম উচ্চারণ করিনি।
সারাহ বলল,
” কোনদিন ওর নাম আমাদের সামনে উচ্চারণ করবে না। একমাত্র ছোঁয়ার জন্য আমার স্বামীকে অনেক মেরেছিল। উনি হসপিটালে ভর্তি ছিলেন। ওই রাতটা আমার কাছে অনেক ভয়ংকর ছিলো।ছোঁয়ার জন্যই তন্ময়কে ভেঙে পড়তে দেখেছি। আমাকে অনেক অপমান করেছিলো, বিশ্বাস ভেঙেছে,সবাইকে কষ্ট দিয়েছে, সবার বন্ধুত্বকে কলঙ্কিত করেছে।”
মৃন্ময় বলল,
” আমার ঘৃণা আসে ওর নাম শুনলে। ওর নামের ওপর দশবার বমি করি আমি।”
সারাহ বলল,
” আমি ওকে কতটা ঘৃণা করি তা আমি ছাড়া কেউ জানেনা।”
রোশান সিদ্দিকী বলল,
“চাইলে কি আর ঘৃণা করা যায়। তুমি যদি এতটাই ঘেন্না করবে তাহলে তুমি কেন আজও কোনো ফাস্টফুড খাও না। কেন গরুর মাংস খাওনা। তুমি এমন অনেক কিছুই আছে যা করো না। ছোঁয়া তোমার জীবন থেকে যাওয়ার পরে জীবনের অনেক কিছুই পরিবর্তন করে ফেলেছো সেটা আমি ছাড়া কেউ জানে না। তাহলে কেন তুমি বলছো ছোঁয়াকে ঘৃণা করো। এমন কি তুমি তোমার ফেভারিট সাদা রঙের ড্রেস ও পরোনা। বাহিরে ঘুরতে ও যাওণা।”
“আমি সাদা কালার ড্রেস পরিনা, ফাস্টফুড খাই না, কারণ ওগুলো ওর পছন্দ ছিলো। আমি ওকে এতটাই ঘৃণা করি ওর পছন্দের কোনো জিনিস আমি ব্যবহার করিনা।”
রোশান সিদ্দিকী মৃদু হাসলেন,
একটি নির্জন প্রহর চাই সিজন ২ পর্ব ৬৬
“তুমি আমাকেও ফাঁকি দিতে চাও। ওগুলো তোমাকে কষ্ট দেয়, হইত স্মৃতিগুলো তোমাকে যন্ত্রণা দেয় যন্ত্রণা থেকে পালিয়ে বেড়ানোর জন্যই এসব করো। আমি কি জানিনা তুমি ছোঁয়াকে কত ভালবাসো। তোমার জীবনে অনেক বন্ধুবান্ধব আছে আমার জীবনে কেউ নেই তুমি ছাড়া। তাই তোমাকে আমি খুব ভালোভাবেই পড়তে পারি।”
গল্পের টপিক্স চেঞ্জ হল। ওরা বহুদিন পর মন খুলে আড্ডা দিচ্ছে। সেই পুরণো আড্ডা। তন্ময়ের বুকটা খা খা করছে। শূন্যতায় শূন্যতায় তন্ময়ের বুকে হাহাকার ছাড়া কিচ্ছুই নেই।