চেকমেট পর্ব ৬১

চেকমেট পর্ব ৬১
সারিকা হোসাইন

আজ শুক্রবার, পবিত্র ও মহিমান্বিত এক দিন।শুধু তাই নয় আজ এক বিশেষ দিন ও বটে।আজ সারফরাজ আর রূপকথার বিয়ে।বিভিন্ন চড়াই উৎরাই আর টানাপোড়েন এর ঢেউ মাড়িয়ে আজকের এই পবিত্র দিনে তারা এক হতে চলেছে।মিলিত হতে চলেছে দুটি আত্মার,দেহের।দীর্ঘ যুগের প্রতীক্ষার পর আজ অবসান হলো সমস্ত অপেক্ষার।এবার শুধু হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসবার পালা।একজন আরেকজনকে প্রাণ দিয়ে আগলে নেবার পালা।এবং সব শেষে সমস্ত ভয়ানক অতীত ভুলে সুখের ভুবনে পা ফেলা।

ঢাকা গলফ ক্লাবের সন্ধ্যাটা আজ যেনো একটু অন্যরকম।সবকিছু একেবারে স্বপ্নের মতো। চারদিক জুড়ে নরম আলোর মিটিমিটি সৌন্দর্য। গলফ ক্লাবের গাছ গুলোতে ঝুলছে ক্রিস্টাল লন্ঠন।চারপাশের মোলায়েম শীতল বাতাসে তাজা ফুলের সুবাস ভরে আছে । বিশাল সবুজ মাঠের চারিধারে সারি সারি বাহারি ফেইরি লাইটস জ্বলছে।দূর থেকে এক পলক দেখলেই মনে হচ্ছে যেন আকাশের তারা নেমে এসেছে পৃথিবীর মাটিতে।
গলফ ক্লাবে প্রবেশদ্বারে তৈরি করা হয়েছে সাদা ও রঙিন ফুলে মোড়া একটি রাজকীয় ছাউনি যুক্ত গেট। যার নিচ দিয়ে অতিথিরা প্রবেশ করছেন পরিপাটি পোশাকে হাসি মুখে।আজ সকলের মুখে প্রশস্ত হাসি।ড্রেস কোড অনুযায়ী বয়স্করা পড়েছে ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি আর ইয়ং ছেলে পেলে কালো সুট ভেতরে সাদা শার্ট আর মেরুন নেক টাই।মহিলাদের কোনো ড্রেস কোড নেই।কারন তারা গদ বাধা নিয়মে চলতে নারাজ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সূর্যের আলো ডুবতেই ব্যস্ত ভঙ্গিতে সমস্ত মেহমান নারী,রমণী বাচ্চা সবাই নিজেদের বাহারি রঙা পোশাক গহনা পরে উপস্থিত হলো গলফ ক্লাবের ভেন্যুতে।দূরে নরম সুরে বাজছে ভায়োলিন ও পিয়ানোর সংমিশ্রণ রোমান্টিক সুর।মাঝে মাঝে হালকা ও উচ্চ স্বরের হাসির শব্দ মিশে যাচ্ছে বাতাসে।চারপাশের পরিপাটি ঝা চকচকে আভিজাত্য দেখে মনে হচ্ছে এ যেনো রূপকথার রাজ্য।

ক্লাবের লেকের ধারে সাজানো হয়েছে ক্যান্ডেল আর ফুলে ঘেরা টেবিল।সেখানে সার্ভ করা হচ্ছে ফলের জুস ও ঠান্ডা কফি। মূল মঞ্চের পেছনে ঝুলছে ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি। সাদা ফুলের তোড়ায় ভরা সফেদ সোফা গুলো অতিথিদের জন্য সাজানো। খাবারের টেবিলে কাচ্চি, বোরহানি,ডেজার্ট সহ বাহারি আইটেম সাজানো।ধীরে ধীরে অথিতি সমাগম বাড়তে লাগলো।ছোট ছোট বাচ্চারা এদিক সেদিক ছুটাছুটি করছে।যেনো আনন্দ আর ধরছে না।সাদা শার্টের উপর কালো কটি জড়ানো ওয়াটার গুলো আজ ভীষন ব্যস্ত।এক মুহূর্ত পলক ফেলবার সময় টুকুন ও নেই আজ তাদের।চারপাশে কঠোর নিরাপত্তা।পুলিশ কমিশনার এর একমাত্র মেয়ের বিয়ে বলে কথা।আর বর?তার ক্ষমতার কথা তোলাই থাকুক।

এদিকে সুফিয়ান চৌধুরী আর রেখা হাসি মুখে আগত মেহমান দের আতিথেয়তা করছেন।কারোর মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো নেই।কোনো ব্যস্ততা নেই।সবকিছু সাজানো গুছানো।
সমস্ত মেহমান দের সাথে কুদলাদি বিনিময় শেষে আবির মাহতাব এর সামনে এসে দাড়ালেন সুফিয়ান চৌধুরী।এরপর তপ্ত শ্বাস ফেলে ঠোঁটে চিরচেনা প্রফুল্ল হাসি টেনে পাঞ্জাবির হাত গুটাতে গুটাতে বলে উঠলেন
“বুঝলে আবির আর যাই কিছু হোক,জামাই আমার মনের মতো হয়েছে।কতো জন্ম তপস্যা করলে এমন জামাই মিলে জানো?

মুচকি হেসে আবির উত্তর করলেন
“না স্যার জানিনা।আপনিই বলুন
সুফিয়ান চৌধুরী শব্দ করে হাসলেন।এরপর বললেন
“হাজার জনম আবির।খাঁটি হীরে পেয়েছি আমি।সে আমার মন পড়তে জানে।এর চাইতে বেশি পরের ছেলের থেকে আর কি আশা করা যায়?কিন্তু মনে রেখো আমার মতো লাকি শশুর তুমি কখনোই হতে পারবে না।তবুও তোমার জন্য দোয়া করি।এমন হতচ্ছাড়া তোমার মেয়ের জীবনেও আসুক।
বলেই হাসতে হাসতে প্রস্থান নিলেন সুফিয়ান চৌধুরী।রুপকথা এখনো পার্লার থেকে ফিরেনি।ওই দিকটায় তাকে একটু নজর রাখতে হবে।কোনো ঝামেলা হলো কি না দেখা প্রয়োজন।সুফিয়ান চৌধুরীর যাবার পানে তাকিয়ে আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠলো

“আপনি আজীবন এভাবেই হাসুন স্যার।আপনার হাসিতে পুরো পৃথিবী হাসে।
গলফ ক্লাবের ভেনু বড় বড় উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসার দিয়ে ভরে গেছে।সেই সাথে প্রশাসনের লোকে গিজগিজ করছে চারপাশ।কিন্তু কেউ নিজের প্রফেশনদারি দেখাতে আসেনি আজ।সবাই এসেছে অতিথি হয়ে।আড়ম্বর পূর্ণ এক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে অনুষ্ঠানের মাধুর্য আরো বাড়াতে।

রূপকথাকে নিখুঁত সৌন্দর্যে সাজাচ্ছে পার্লারের সিনিয়ার আর্টিস্ট।
রূপকথা গায়ে জড়িয়েছে অফ হোয়াইট জামদানি।সোনালী সুতার পাড়,আচঁলে আর জমিনে ছোট ছোট কারুকাজ।শাড়িটা পছন্দ করেছে সারফরাজ।পছন্দ করেছে বললে ভুল হবে।একদম নিজে গিয়ে জামদানি কুটির থেকে মনের মাধুরী মিশিয়ে বানিয়ে নিয়ে এসেছে।শাড়িটার সৌন্দর্যে রূপকথা চোখের পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছিলো।নিজের প্রিয়তমা কে নিয়ে কতোটা ভাবলে একটা মানুষ এমন পাগলামি করতে পারে এটাই শুধু ভেবেছে রূপকথা।শাড়ির আচঁলের বর্ডারে সুন্দর করে সারফরাজ এর নাম লিখা।সারফরাজ পই পই করে নিষেধ করেছে যাতে কৃত্তিম প্রসাধনী মেখে রূপকথার অনিন্দ্য সৌন্দর্য ঢেকে দেয়া না হয়।জতুটুক না করলেই নয় ততো টুকুই যেনো হয়।যেই রমণী এমনিতেই স্বর্গের অপ্সরা তার কাছে তো কৃত্তিম প্রসাধনীর সৌন্দর্য ফিকে।

সারফরাজ এর হুমকি মাথায় রেখে ভীত হাতে সাজিয়ে চলেছে আর্টিস্ট।কারন নাম মাত্র স্পেশাল মেকআপ এর জন্য আর্টিস্ট কে মোটা এমাউন্ট দিয়েছে সারফরাজ।শুধু তাই নয়।বউয়ের সৌন্দর্য দেখে বাসরের মোড চলে গেলে আর্টিস্ট কে সারফরাজ হ্যাপি জার্নি উপহার দেবে।এসব ভেবেই তার ঘাম ছুটে যাবার জোগাড়।
রূপকথার ফর্সা মুখে অল্প ফাউন্ডেশন এর প্রলেপ লাগিয়ে নিখুঁত ব্লেন্ডিং করলো ।চোখের পাতায় স্মোকি আইশ্যাডো,মোটা করে কাজল এর প্রলেপ,দীর্ঘ আইলাইনার,ব্লাশন,হাই লাইটার।ঠোঁটে ন্যুড লিপস্টিক আর কপালে ছোট একটা পাথরের টিপ দিয়ে সাজ কমপ্লিট করলো আর্টিস্ট।এরপর অভিনব কায়দায় সাদা গোলাপ গুচ্ছ দিয়ে চুল বেঁধে ভারী ঘোমটা টানলো।
দীর্ঘ কম্পিত তপ্ত শ্বাস ফেলে নেলি সোজা হয়ে দাঁড়ালো।এরপর আর্টিস্ট এর পানে এক গ্লাস পানি এগিয়ে বলে উঠলো

“কলিজা গলায় উঠে গেছে।নিন পানি খান।
ভয়ার্ত চোখে নেলির পানে তাকিয়ে পানি নিলো মেয়েটি।এরপর ঢকঢক করে গলায় চালান করে বলে উঠলো
“হুমকি টা কি সত্যিই ছিলো আপু?
নেলি অল্প দুস্টু হেসে বলে উঠলো
“এই মেয়ের বিষয়ে যা বলবে সব সত্যি।প্রাণাধিক প্রিয় তো।এজন্য কোন কিছুর পরোয়া করে না।আসছি।
রূপকথা নিজেকে খুঁটিয়ে আয়নায় দেখলো।এরপর ঠোঁট টিপে হেসে উঠে দাঁড়ালো।রূপকথার ওড়না,ব্যাগ সব কিছু সামলে রূপকথাকে নিয়ে এগিয়ে চললো নেলি।নীচে তাদের গাড়ি দাঁড়ানো আছে।এমনিতেই অনেক দেরি হয়ে গেছে।বেশি দেরি হয়ে গেলে সুফিয়ান চৌধুরী গালি দিতে দিতে মোড নষ্ট করে ফেলবেন ।

রূপকথার শাড়ির সাথে মিলিয়ে নিজের শেরওয়ানী বানিয়েছে সারফরাজ।সেটা গায়ে জড়াতেই চেহারা কেমন রাজকুমার দের মতো লাগলো।ক্লিন সেভ গাল দুটো আরেকটু চকচকে হলো।বরাবরের ন্যয় স্লিকড ব্যাক চুল গুলো পরিপাটি করে আঁচড়ে গলায় আর হাতে অল্প পারফিউম স্প্রে করে রোলেক্স এর নিউ এডিশন দামি চেইন ওয়ালা ঘড়ি খানা হাতে পরলো।ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে মাথার পাগড়ী খানা হাতে নিয়ে কক্ষ ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে এলো সে।ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছেন মায়া।সিঁড়ি বেয়ে কারো নেমে আসার শব্দে উপরে তাকালেন তিনি।রাজপুত্র তুল্য একমাত্র সন্তান আভিজাত্য চলনে নামছে সিঁড়ি ধরে।ঠিক যেনো গাম্ভীর্য ভরা কর্নেল সাহেব।সারফরাজ কে বর বেশে দেখে চোখের জল ছেড়ে দিলেন তিনি।এরপর দেয়ালে ঝোলানো কর্নেল সাহেবের ছবির পানে তাকিয়ে বিড়বিড় করে আওড়ালেন

“তোমাকে ছাড়াই বউ আনতে যেতে হচ্ছে।অথচ ছেলের বিয়ে, বউ,নাতি,পুতি নিয়ে কতো সুখময় স্বপ্ন ছিলো তোমার।
সারফরাজ ধীরে ধীরে নেমে এসে মায়ার কাঁধে হাত রাখলো।এরপর ডাকলো
“মা!
মায়া ঝটপট চোখের জল মুছে বলে উঠলেন
“চল দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মায়াকে ছেড়ে দরজার পানে দৃষ্টি তাক করলো সারফরাজ।বিমর্ষ মুখে একাকী মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে ইয়ং।সারফরাজ ইয়ংয়ের সামনে এগিয়ে গিয়ে হতাশা মিশ্রিত শ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো
“লুইসকে খুব মনে পড়ছে বুঝি?

নিজেকে আর শক্ত বাঁধনে ধরে রাখতে পারলো না ইয়ং।তার ভাষাহীন ঝাপসা চোখ গড়িয়ে মোটা মোটা জল গড়ালো।অপরাধীর ন্যয় বেদনায় জর্জরিত হয়ে বিষাক্ত ঢোক গিললো সারফরাজ।এরপর বলে উঠলো
“আমাকে কেনো হসপিটালেই মেরে ফেললে না ইয়ং?এই কঠিন অসহনীয় অপরাধবোধ তো আমায় বাচঁতে দিচ্ছে না।প্রতি মুহূর্তে মরছি আমি।এসব দেখার জন্য কেনো বাঁচালে তোমরা আমায়?
“আজকের এই দিনে এসব অলুক্ষণে কথা না বললে তোর যাত্রা শুভ হচ্ছে না নাকি?
আকস্মিক অভিরূপ এর প্রশ্নে সামনে তাকালো সারফরাজ।এরপর নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে বললো
“মিথ্যা কোথায় বলছি?

অভিরূপ তাড়া দেখিয়ে বললো
“এসব অর্থ হীন আলাপ অন্য এক সময় করা যাবে।এখন চল।দেরি হয়ে যাচ্ছে।
সারফরাজ এর সামনে এগিয়ে এসে মায়া ইতস্তত করে বলে উঠলেন
“বলছিলাম কি!
সারফরাজ তাচ্ছিল্য হেসে বলে উঠলো
“আমি জানি মা তুমি কি বলতে চাইছো।ভাইপু’র জন্য মনটা খুব কাঁদছে তাই না?চিন্তা করো না।বিয়েতে অবশ্যই সে উপস্থিত থাকবে।নয়তো কলিজায় আগুন ধরবে কি করে?

কনেপক্ষ গেট ধরার জন্য ফিতা বেঁধে অপেক্ষা করছে।এখনই বর পক্ষ এলো বলে।নেলি একদম গেটের সামনে।দর কষাকষির ক্ষেত্রে তার উপর আর কারোর স্থান নেই।আজ লাখ টাকা আদায় করে তবেই ছাড়বে সে।নয়তো বউ পাবে না সারফরাজ।
অল্প সময়ের মধ্যেই বর যাত্রী এসে গেটের সামনে উপস্থিত হলো।গাড়ি থেকে একে একে নামলো অভিরূপ, ইয়ং,নজরুল।গাড়িতে রইলেন মায়া আর সারফরাজ।কামাল আগেই নেমে গেছেন।
অভি নেলিকে চোখ টিপে বলে উঠলো

“ওই হই,আরে আসমানের হুর জমিনে কি করছে?নাকি আমিই চোখে ভুল দেখছি?ভুল জায়গায় চলে আসিনি তো?রূপের ঝলকে চোখ তো অন্ধ হয়ে যেতে চাইছে হুরপরি।
নিজের বড় বড় চোখ দুটো পলক ঝাপ্টে অভিকে কাঁচকলা দেখালো নেলি।এরপর মিহি স্বরে বলে উঠলো
“এসব মিষ্টি কথায় হচ্ছে না আজ।লাখ টাকা ফেলো তবেই ছাড়া হবে গেট।
টেবিলের উপর থেকে একটা মিষ্টি তুলে নিলো অভি।এরপর সেটা মুখে পুরে বলে উঠলো
“এক লাখ টাকায় কটা শূন্য থাকে এক সেকেন্ড এ বললে এক্ষুনি ক্যাশ দেবো।
নেলি শূন্য গুনতে গিয়ে মেকি রাগ দেখিয়ে বলে উঠলো

“আমার ম্যাথ সেন্স যাচাই করতে এসেছো?
“আরে না তা হবে কেনো?
“তো?
“তো বলো শূন্য কয়টা ?
“শূন্য যে কয়টাই থাকুক।পটাপট টাকা ফেলে ভেতরে ঢুকো।নইলে ওখানেই সারা রাত দাঁড়িয়ে রাত মশার কামড় খাও।
ইয়ং এগিয়ে এসে একটা বক্স দিলো নেলির হাতে।বড্ড ভারী তা।নেলি টেবিলের উপর রেখে সেই বক্স খুললো।বক্স ভর্তি পিন মারা চকচকে টাকা।সন্দিহান চোখে অভিকে একবার পরখ করলো নেলি।কেমন উপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বাকিয়ে রেখেছে অভি।শ্যম বরণ বদ পুরুষ টাকে একদম ভরসা হলো না নেলির।তাই সে উপস্থিত এক মেয়ের হাতে একটা বান্ডেল তুলে দিয়ে বলে উঠলো

“পেট মোটা কালো চশমা ওয়ালা যেই লোকটা খেকখেক করে বসে বসে হাসছে আর দই খাচ্ছে উনি দুদকের চেয়ারম্যান।তাকে নিয়ে এই বান্ডেল দেখিয়ে বলবি এসব আসল না নকল টাকা?যদি বলে নকল তবে এদের সব গুলোকে এরেস্ট এর ব্যবস্থা করবি।পুলিশ নিয়ে তারপর এখানে এসে দাঁড়াবি।বুঝেছিস?
মেয়েটি সম্মতি জানিয়ে দৌড়ে গেলো।মেয়েটি বান্ডেল নিয়ে দৌড়াতেই অভিরূপ পড়িমরি করে বলে উঠলো
“আরে বোকা মেয়ে মজা করেছি।তুমিও না।মাত্র কয়েকটা টাকার জন্য এসব থানা পুলিশের কি দরকার।দাও দাও এসব খেলনা টাকা।দুস্টুমি করেছি তোমার সাথে।তুমিও না।সব কিছুতেই সিরিয়াস।সিলি গার্ল।
বলেই হেহে করে হাসলো।এদিকে অধৈর্য সারফরাজ গাড়িতে আর বসে থাকতে পারলো না।সে গাড়ি থেকে নেমে নেলির সামনে এসে দাড়ালো।এরপর হিসহিস করে বললো

“গেট না ছাড়লে সব গুলোর খুপড়ি উড়িয়ে দেবো বলে দিলাম।এক্ষুনি গেট ছাড়া হোক।
মাছি মারার ভঙ্গিতে নেলি বলে উঠলো
“ওসব মস্তানী আজ এখানে চলছে না দুলাভাই ।হয় লাখ টাকা ঢালুন নয়তো রাত ভর বসে থাকুন।
সারফরাজ অভিরূপ এর পানে তাকিয়ে ঠোঁট দাঁত কামড়ে চোখে চোখে কি যেনো বললো।মানে বুঝতে পেরে নজর সরিয়ে নিলো অভিরূপ।এরপর ফিসফিস করে নেলিকে বলে উঠলো
“তোমাকে মানাতে পারছি না বলে সারফরাজ আমাকে দুর্বল পুরুষ উপাধি দিচ্ছে।নিজের প্রেমিককে ভরা মজলিসে এভাবে বেজ্জতি করতে খুব মজা লাগছে বুঝি?গেট ছেড়ে দাও পাজি মেয়ে!
নেলি ঠোঁট উল্টে বললো

“আমি এসব বুঝি না তুমি টাকা দাও।
বাধ্য হয়ে সারফরাজ নিজের ব্ল্যাক কার্ড নেলির হাতে তুলে দিয়ে বলে উঠলো
“জতো মন চায় ততো খরচ কর বইন।তাতে আমার কোনো আপত্তি নাই।গেটটা ছাড়।বউ কেমন হুরমতি সেজেছে তা দেখার জন্য পরান ধড়ফড় করছে।দেহে প্রাণ থাকছে না।বেশি বেশি করলে কিন্তু সব কিছুতেই আগুন ধরিয়ে দেবো বলে দিলাম।
কার্ড খানা হাতের মুঠোয় চেপে নেলি কেচি এগিয়ে বলে উঠলো
“এসব পচা কথা বলে না দুলাভাই।এই নিন কেঁচি।এক্ষুনি বউয়ের কাছে যান।হায় হায় সময় নাই তো।
সারফরাজ ঘেচাং করে ফিতা কেটে অভিরূপ কে দেখে নেবে এমন শাষিয়ে ভেতরে ঢুকলো।সারফরাজ ঢুকা মাত্র বর বরণে সকলেই দৌড়ে এলো।আর চারপাশে ধ্বনি উঠলো
“বর এসেছে,বর এসেছে।

রজনী গন্ধা, বেলি আর লাল গোলাপের ছাদনা তলায় দুরু দুরু বক্ষে বসে আছে রূপকথা।সমস্ত ভয় আজ বুকের উপর জেঁকে বসেছে।কম্পিত শিহরনে দাঁতের কপাটে কপাটে বাড়ি খেতে চাচ্ছে।হাত পা বরফ তুল্য।চিরচেনা মানুষটা আজ বৈধ ভাবে তার হতে চলেছে।ভালোবাসা মিশ্রিত শিহরনে শরীর অসাড় হতে চাইছে।এই ভয়াল অনুভূতির নাম কি রূপকথা জানে না।সে শুধু জানে একটু পরেই সারফরাজ শুধুই তার একান্ত ব্যাক্তিগত পুরুষ,স্বামী,ভালোবাসার মানুষ,ভরসাকেন্দ্র আর সেভিয়র।
ছাদনা তলার চারপাশ পাতলা সফেদ পর্দা দিয়ে ঘেরা।সামনে ফুলের পর্দা।রূপকথাকে ঘিরে বসেছে নেলি আর তার বন্ধুরা।দাঁড়িয়ে আছেন রেখা,আবিরের স্ত্রী রোজি সেলিনা।
পর্দার এপাশে সারফরাজ অভিরূপ,ইয়ং,নজরুল আর সারফরাজ এর বন্ধু।কাজি কাবিনের কাজ আগে শেষ করলেন।
এরপর বর কনে দুজনেরই স্বাক্ষর নিলেন।
এবার বিয়ে পড়ানোর কাজ শুরু হলো।

রূপকথাকে ফেলে সারফরাজ এর পাশে ভরসার হাত বাড়ালেন সুফিয়ান চৌধুরী।সারফরাজ অবাক চোখে সুফিয়ান চৌধুরী কে নিষ্পলক দেখলো।এরপর শব্দ হীন কেঁদে বলে উঠলো
“আমি কিন্তু ধন্যবাদ দেবো না বলে দিলাম।
সুফিয়ান চৌধুরী সারফরাজ এর পিঠ চাপড়ে বলে উঠলেন
“বাবারা সন্তানের থেকে কখনো ধন্যবাদ প্রত্যাশা করে না।তোর জন্য আমার হাজারো দোয়া।তুই সুখী হ বাবা।
বলেই সারফরাজ কে বুকে টেনে নিলেন সুফিয়ান চৌধুরী।কাজী নিজের সমস্ত কাজ শেষ করে সারফরাজ কে শুধালো
“রামপুরা নিবাসী সুফিয়ান চৌধুরীর একমাত্র কন্যা রূপকথা চৌধুরী কে স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করতে আপনি রাজি আছেন বাবা?থাকলে আলহামদুলিল্লাহ কবুল বলেন।
কাজির কথায় রূপকথা কেঁপে উঠলো।রেখা রূপকথাকে আগলে নিয়ে ভরসা দিলেন।সারফরাজ সময় অপচয় না করে দ্বিতীয় বার না ভেবে সজোড়ে বলে উঠলো

“আলহামদুলিল্লাহ কবুল,কবুল,কবুল।
কাজী সম্মতি পেয়ে রূপকথাকে শুধালো
“সম্মতি থাকলে কবুল বলুন মা।
ভয়ে রূপকথার গলা শুকিয়ে উঠলো।সব কিছু তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে।শরীর জমে যাচ্ছে।চোখ বুজে ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছে।
মায়া রূপকথার মাথায় হাত বুলিয়ে শুধালেন
“আরো সময় লাগবে বাবা?
রূপকথা না বোধক মাথা দোলালো।এরপর বলে উঠলো
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।

মুহূর্তেই হাত তালি আর সিটিতে মুখরিত হলো চারপাশ।সারফরাজ এর বন্ধুরা ভিক্টরী উইন সাইন দেখালো সারফরাজ কে।সামনে থেকে সরানো হলো ফুলের বেড়া।প্রথম বারের মতো বধূ বেশে রূপকথার সৌন্দর্য উপভোগ করলো সারফরাজ।মাথায় লম্বা ঘোমটা টেনে মাথা নিচু করে বসে আছে রূপকথা।ওড়নার ফাক গলিয়ে কম্পিত অধর জোড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে।কাঁপা কাঁপা হাত বাড়িয়ে হালাল অধিকার থেকে রূপকথার ঘোমটা তুললো সারফরাজ।ঘোমটা তুলতেই লজ্জায় আরেকটু আড়ষ্ট হলো রূপকথা।মুদিত পল্লব আর গোলাপ সম ঠোঁট সারফরাজ এর সারা শরীরে শিহরণ জাগালো।এই বুঝি তার মরন হয়।সারফরাজ রুওকথাকে নরম গলায় ডাকলো

“রানী সাহেবা!
কিঞ্চিৎ মাথা তুলে চোখ মেললো সে।এরপর নুইয়ে পড়া লাজুক লতার ন্যয় সারফরাজ এর পানে অনিমেষ তাকালো।রূপকথার কাজল কালো চোখে সারফরাজ খেই হারালো।মুগ্ধ হয়ে বলতে চাইলো অনেক কিছু।কিন্তু কিচ্ছু বেরোলো না লালচে ঠোঁট গলিয়ে।শুধু অস্ফুট স্বরে আওড়ালো
“মাশাআল্লাহ।

রূপকথা আর সারফরাজ কে পাশাপাশি বসানো হলো।নেলি একটা বৃহৎ আয়না এনে সারফরাজ এর হাতে দিলো।আয়নায় দুজনকেই দেখা যাচ্ছে।নেলি দুস্টু হেসে জিজ্ঞেস করলো
“আয়নায় কি দেখা যায় দুলাভাই?

চেকমেট পর্ব ৬০

সারফরাজ আয়না থেকে চোখ তুলে রূপকথার পানে নজর নিবদ্ধ করলো।এরপর রূপকথার কপালে উষ্ণ চুমু একে চোখে চোখ রেখে ঘোর লাগা স্বরে জবাব দিলো
“আমার জীবন, আমার মরণ, আমার জ্বালাতুন্নেসা,আমার রাজ্যের ক্ষমতাধর রানী।

চেকমেট পর্ব ৬২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here