প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৩৫
জান্নাত নুসরাত
নুসরাত আর ইরহাম এক-পাশে চোখ-মুখ চোরের মতো করে দাঁড়িয়ে আছে। আরশ বিরক্ত হলো নিজের উপর কেন সে একবার তাকাল না কেবিনের দিকে। উফফ এই দুই বাচালের সামনে থাকে রিজেক্ট হতে হলো। হাতের তালু দিয়ে কপাল ঘষল আরশ। নুসরাতের দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাল। আজই আসতে হলো এই মেয়েকে। নুসরাতের কথা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে রুবাকে তীব্র বিতৃষ্ণা নিয়ে জিজ্ঞেস করল আরশ,”আপনি আগে বলেননি কেন আপনি বিবাহিত? আর সবাই আপনাকে কেন মিস বলে বা ডাকে।
নুসরাত নিজের হাসি কোনো রকম আটকে রেখে আছে। এখন কোন কথা বললেই তার হাসির বিস্ফোরণ ঘটবে। আরশের কথায় নুসরাত আর ইরহাম উপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে সহমত পোষণ করল।
” স্যার আপনি কখনো জিজ্ঞেস করেননি আমি বিবাহিত কিনা অবিবাহিত? আপনি কাজের বাহিরে এই পর্যন্ত কতবার কথা বলছেন আমার সাথে। সবসময় তো কাজ নিয়ে কথা বলেন।
“আপনাকে যখন আমি ইসরাতের বিয়েতে দাওয়াত করলাম তখন আপনি বুঝলেন না আমি আপনাকে স্পেশালি কেন দাওয়াত দিয়েছি।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
” স্যার এখানে কোনো কিছু মনে করার কি আছে? আমি এজ আ ইমপ্লোয়ি আপনার বোনের বিয়েতে দাওয়াত পেয়েছি। আমি তো সেটা মনে করে বিয়েতে আর মেহেদিতে গিয়েছিলাম।
নুসরাত মাথা নাড়াল। ইরহাম ও নুসরাতের সাথে মাথা নাড়াল। আরশ রাগী চোখে দু-জনের দিকে তাকাল।
“তোদের দুইটাকে রাখছি এখানে মাথা নাড়ানোর জন্য। যে কথা বলছে তার সাথে মাথা নাড়াচ্ছিস কেন?
ইরহাম আর নুসরাত উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে আবার দু-পাশে মাথা নাড়াল। আরশ নিজেকে বকে উঠল। কোন পাগলদের চক্করে পরেছে সে। এসব পাগলদের কিছু বলাই ভুল।
” আমাকে দেখে কি আপনার একবার মনে হয়নি আমার কোন অনুভূতি আপনার প্রতি আছে?
রুবা কিছু বলতে গিয়ে আটকে গেল। নুসরাত মাথা তুলে রুবাকে মিন মিন করতে দেখে উৎসাহ দিয়ে বলল,”আরে আপু বলে ফেলুন আরশ কিছু বলবে না আই মিন মিন করবেন না। তাই নারে ইরহাম।
ইরহাম নুসরাতের কথায় উপর-নিচ মাথা নাড়াল। আরশ প্রশ্নাতক দৃষ্টিতে তাকাল রুবার দিকে। রুবা নিজে শান্ত করল। যা হওয়ার পরে হবে এখন বলে দিলেই হবে।
“স্যার আপনি তো সবসময় চিৎকার দিয়ে আর গম্ভীর গলায় ছাড়া আমাদের সাথে কথা বলেননি। সবসময় গোমড়া মুখ বানিয়ে কথা বলতেন। তাই আমি বেচারি আপনার ফিলিংস বুঝতে পারিনি।
আরশ কেঁশে উঠল। ইরহাম টেবিলের উপর থেকে পানি এনে এগিয়ে দিল আরশের দিকে। আরশ পানিতে চুমুক মেরে নুসরাতের দিকে তাকাল। যে, তার দিকে চোখ বড় বড় করে এমনভাবে তাকাচ্ছে যেন চোখ দিয়ে সব তথ্য বের করে নিবে।
আরশ গলা পরিস্কার করে বলল,
” আমি বলছি না, আপনাকে আমার ভালো লাগে আপনার প্রতি আমার কোন ফিলিংস আছে সেটা বলিনি।
নুসরাত আর ইরহাম এক সাথে মাথা নাড়াল। আরশ কিছু বলল না। এসব পাগল ছাগলদের কিছু বলে ও লাভ নেই।
“আপনি আজ আসুন। আগামীকাল থেকে বড় স্যারের ওখানে আপনার বসার জায়গা করে দেওয়া হবে। আমার সামনে পরলে আপনার ও অস্বস্তি হবে আর আমার ও। তাই জায়গা বদলে ফেলাই ভালো।
রুবা সালাম দিয়ে কেবিন থেকে বের হয়ে গেল। নুসরাত ইরহামের হাতে থাপ্পড় মেরে বলল,” দেখ ভাই ঠিক সময় আমি যদি ক্যামেরাটা অন না করতাম তাহলে তো আজ এই ক্লাইমেক্স এর ভিডিওটা মিস হয়ে যেত। ধন্যবাদ জানা আজ যদি তোকে নিয়ে আমি না আসতাম তাহলে এতো বড় নাটক দেখতে পারতি।
আরশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করল,
“কীসের ভিডিও আর কীসের নাটক?
নুসরাত থতমত খেয়ে তাকাল আরশের দিকে। ইরহামের কানে কানে বলল,” এই বলে দিয়েছি আমি সত্যি কথা!
“গাঁধী তো পেটের ভিতর কিছু হজম হয় না। যেখানে সেখানে সব বের হয়ে যায়।
আরশ হুংকার দিয়ে বলল,
“কিসের ভিডিও?
” নাথিং ভাইয়া। আসলে রাস্তায় ইরহাম পরে গিয়েছিল আর একটা ছেলে ভিডিও করে ফেবুতে ছেড়ে দিয়েছে।আর ক্যাপশন দিয়েছে আজকালের পোলাপান অনেক অসহায়। ওইটা নিয়ে কথা বলছিলাম।
নুসরাত কথা ঘুরিয়ে ফেলল। আরশের হঠাৎ মাথায় আসলো এরা এখানে কি করছে? নুসরাত আর ইরহামের দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে বলল “তোরা এখানে কি করছিস?
” ভাইয়া আমি কিছু জানি না। নুসরাত আমাকে নিয়ে আসছে।
নুসরাত চোখ দিয়ে ধমকাল ইরহামকে। ইরহাম বোঁকার মতো মুখ বানিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। নুসরাত বোকা হেসে আরশের দিকে তাকিয়ে পকেটে হাত ঢুকাল। কিছু যদি বেঁচে যাওয়ার পথ পেয়ে যায়।
পকেটে সিগারেটের প্যাকেটের উপস্তিতি পেয়ে নুসরাতের দুরন্ত মাথা কিছু একটা ভেবে নিল। বোকা হেসে সিগারেটের প্যাকেটে আরশের দিকে এগিয়ে দিল। আরশ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
“কি?
” ভাইয়া আপনি এটা ড্রয়িং রুমে রেখে এসেছিলেন তাই আমি এটা আপনাকে দিতেই আসলেম। সিগারেট ছাড়া আপনি কিভাবে থাকবেন এইটা ভেবে নিয়ে এসেছি? আমি ভালো কাজ করেছি না। আচ্ছা ভাইয়া প্রশংসা লাগবে না আমি জানি আমি ভালো কাজ করেছি। ধন্যবাদ দিয়ে ছোট করবেন না নিজেকে।
“তোকে ধন্যবাদ দিচ্ছে কে?
” আজ না দিলে না দিলেন। আজ তাহলে আসি বাসায় যেতে হবে। আপনি আপনার সিগারেটে সুখ টান দিন। সিগারেট ছাড়া পুরো দিন খারাপ কেটেছে আমি জানি।
আসছি।
ইরহামকে বোকার মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নুসরাত ইরহামের দুই-হাত চেপে ধরে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। যেতে যেতে শাসালো ইরহামকে,”তোর বাপের মুখ দেখছিলি ওখানে দাঁড়িয়ে শালা। আমি যখন চলে আসছি তুই আমার পিছু পিছু আসবি না। বোকার মতো ওখানে দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে ছিলি কেন? কানের নিচে থাপ্পড় মেরে সোজা করব তোকে। শালা বোকা, বদল কুত্তার দল।
রাতের বেলা,
নুসরাত রাত এগারোটার দিকে রুম থেকে বাহিরে বের হলো। কিচেনে খচখচ শব্দ শুনে সেদিকে এগিয়ে গেল। আরশকে কফি বানাতে দেখে নুসরাত চলে যেতে নিয়ে আবার ফিরে তাকাল। বিকেলের কথা মাথায় আসতেই মনে হলো আরশকে একটু জ্বালানো যায় ওই বিষয় নিয়ে। মনে মনে ভাবল তেমন কিছু হবে না? নুসরাত আরশের পিছনে দাঁড়িয়ে দুপুরে যে ভিডিও করেছিল সেটা ছাড়ল। আরশ নিজের কথা বলার শব্দ শুনে মুখ গম্ভীর করে নুসরাতের দিকে তাকাল। যে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নুসরাতের থেকে চোখ সরিয়ে চোখ গেল নুসরাতের হাতের মোবাইলের দিকে। আরশ ভিডিওটা একবার দেখে নিশ্চুপ নুসরাতের দিকে তাকিয়ে বলল, “ভিডিও ডিলিট কর?
নুসরাত দাঁত কেলিয়ে মোবাইল পকেটে পুরল। আরশের কথা পাত্তা না দিয়ে শেল্ফ থেকে চিপস্ বের করে খেতে শুরু করল।
” তোকে কি বলছি শুনিস নাই, ভিডিও ডিলিট কর।
নুসরাত চিপস্ খেতে খেতে আরশের দিকে তাকিয়ে হেসে দিল। তার আরশকে দেখলেই হাসি আসছে। নুসরাত কে আবার বলল,”ডিলিট করতে বলছি না ওটা, ডিলিট করছিস না কেন? এখানে দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? আমি কথা বলছি, কথা কানে যায় না।
“আমি কেন ডিলিট করতে যাব। এটা প্রমাণ যে কোনো সময় কাজে লাগতে পারে।
আরশ সতর্ক গলায় চিৎকার করল।
” নুসরাত ওটা ডিলিট দে নইলে তোর একদিন কি আমার যতদিন লাগে।
“দিব না ডিলিট আমি সবাইকে দেখাব এটা। বিশেষ করে বড় আম্মুকে দেখাব। তার ছেলে কীভাবে রিজেক্ট হয়েছে?
” তুই আমার মাকে দেখাবি। আরশ নুসরাতকে তাচ্ছিল্য করে হাসল। তোর বিশ্বাস হয় আমার মা তোর কথা বিশ্বাস করবে। আমি যদি বলি এটা তুই এডিট করে এনেছিস আমার মা জীবনে আমাকে রেখে তোকে বিশ্বাস করবেন না। হাসালিরে নুসরাত।
আরশ গ্যাস বন্ধ করে দিয়ে নুসরাতের দিকে এগিয়ে আসলো। নুসরাতের থেকে এক হাত দূরে দাঁড়িয়ে নুসরাত হাতের বাহুতে ধাক্কা দিল। নুসরাত কিছুটা অসাবধানতা বসত পিছনে ছিটকে গেল। নুসরাত কপালে ভাঁজ ফেলে আরশের দিকে তাকাল। এর আবার কি হয়েছে? রুবার শুকে মাল খেয়ে টাল হয়ে গেল নাকি?
“নিজেকে কি মনে করিস তুই?
নুসরাত ঝটপট বলল,
” প্রিন্সেস ডায়না মনে করি।
আরশ আবার তাচ্ছিল্য করে হাসল। এবার একটু জোরে হাসল। নুসরাত এক ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল।
“তোর প্রিন্সেস ডায়নার পায়ের সমান হওয়ার যোগ্যতা আছে ইভেন তোর তো আমার পায়ের সমান হওয়ার যোগ্যতা নেই।
নুসরাত কিছু বলতে নিবে আরশ নুসরাতের মুখ চেপে ধরে রাখল।
” আজকে আমি বলব আর তুই শুনবি। তোর এই রেডিও আমার সামনে অন করবি। তোর কথা শুনলেই মনে হয়, আমার মাথায় কিছু ছিঁড়ে যাচ্ছে। তুই চুপ থাকবি আজ আর আমার কথা শোনবি। এতো যে দেমাগ দেখাস রুপ বলতে কিছু আছে। আচ্ছা মানুষ শ্যামলা হলে ও তাদের মুখে একটা মায়া থাকে যা তাদের সুন্দর করে তোলে কিন্তু তোর মুখে কোন মায়া নেই, নিজের গঠন দেখেছিস কোনদিন তার মধ্যে সবার সাথে বেয়াদবি করিস। তোকে বিয়ে করবে টা কে? তুই তো আইবুড়ি হয়ে মরবি। তোর থেকে ছোটদের বিয়ে হয়ে যাবে তোর হবে না। সারাজীবন আমাদের ঘাড়ে বসে গিলবি।
নুসরাত এতোক্ষণ মুচড়া মুচড়ি করছিল আরশের হাত থেকে ছোটার জন্য কিন্তু আরশের অপমান মূলক কথায় স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল নুসরাত আরশের দিকে। তাকে রুপ নিয়ে খোটা দিল। কোনোদিন তো কেউ বলেনি তার মুখ দেখতে মায়াবী নয়। হ্যাঁ ছোট বেলায় বলত ছেলেদের মতো দেখতে মনে হয়। কিন্তু এখন যে দেখেছে বলেছে শ্যামলা হলেও মুখে মায়া আছে। তাহলে কি সবাই মিথ্যা বলত?
নুসরাতের চিন্তার ব্যাঘাত ঘটল আরশের কথায়,”তুই এতো খারাপ কেন? মানুষের কষ্ট দেখলে তোর খুশি লাগে তাই না। মানুষ এতোটা খারাপ হতে পারে তোকে না দেখলে জানতাম না। তোর তো না আছে সৌন্দর্য না আছে গঠন না আছে মুখে মায়া এতো ভাব কীসের তোর? মানুষ কালো হলে জানতাম তার মন ভালো হয় কিন্তু তুই যেমন কালো তোর মন ও তেমন কালো। তোকে ফাস্ট এন্ড লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি আমার সামনে আর কোনদিন পরবি না। তোর মুখ দেখলেই আমার দিন খারাপ যায়। আমার ভালো মুড নষ্ট হয়ে যায়। দূরে থাকবি আমার থেকে দশ হাত। না হলে তোর এই মুখ ভেঙে দিব।
নুসরাত কথা বলার ভাষা খুঁজে পেল না। সে কি বলবে? সব অপমান ঢোক গিলে হজম করে নিল। আরশ কফি নিয়ে যায়নি। এখানে ফেলে চলে গিয়েছে। কফি খাওয়ার মোড নেই আর। আরশ নিজের রুমে যেতে যেতে শুনল নুসরাতের হালকা হাসির শব্দ। নুসরাত পেছন থেকে আরশের দিকে নিস্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে হাসছে। আরশ পিছন ফিরে তাকাল না। শুধু মনে হলো তাকে তাচ্ছিল্য করে হাসছে নুসরাত। আরশ পিছন ফিরে তাকালে বুঝতে পারত নুসরাতের হাসিটা প্রচুর ভয়ংকর ছিল। যা কোনো কিছু হওয়ার পূর্বাবাস দিচ্ছে। আরশ নিজের রুমে ঢুকে দরজা লাগাতেই নুসরাত হাসি বন্ধ করে দিল। রোবটের মতো আরশের রুমের দরজার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল।
প্রিয় প্রণয়িনী পর্ব ৩৪
নুসরাতের মুখ প্রচুর শান্ত। মুখ দেখে বুঝার উপায় নেই ভিতরে কি ভাবছে বা চলছে? ভাবা শেষে শয়তানের মতো ঠোঁটের কোণ উঁচু করে ফেলল। আরশের থেকে এর শোধ নিবে সে। নুসরাতকে অপমান করা আর তার শাস্তি….. না না… নুসরাতের ভাষায় পুরস্কার না পাওয়া উঁহু কোনো ভাবে সম্ভব না। সে উপহার দিবে আরশকে। অবশ্যই দিবে..ধীরে ধীরে শুধু সময়ের অপেক্ষা। নুসরাত ঘড়ির কাটার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বিড়বিড় করলো, “টিক টিক টিক টিক টিক…..