লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২১
Fatima Fariyal
রিদিতা নিজের রুমে এসে প্রায় হাঁপিয়ে গেছে। বুক ওঠানামা করছে দ্রুত, নিশ্বাসের সাথে শরীরে জমে থাকা এক অদ্ভুত উত্তাপ ছড়িয়ে পড়ছে। আহাদের হাতের ছোঁয়া যেন এখনও তার গায়ে লেগে আছে, ত্বকের ভেতর কেমন যেন অদ্ভুত শিহরণ। নিজের ভেতরের এই অচেনা অনুভূতিকে সামলাতে না পেরে সে এক ঝটকায় দৌড়ে বারান্দার দিকে চলে গেলো। বারান্দার লোহার গ্রিলে কপাল ঠেকিয়ে নিচে তাকাতেই দেখলো, আহাদের গাড়িটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তায় লাইটপোস্টের আলো মিলেমিশে আধোঅন্ধকার একটা আবহ তৈরি করেছে। গাড়ির হেডলাইটগুলো শান্ত হয়ে আছে। রিদি তাকাতেই গাড়িটা ধীরে ধীরে গতি নিলো, অতঃপর অন্ধকারের ভেতরে মিলিয়ে গেলো। মনে হলো, তাকে এক ঝলক দেখার অপেক্ষাতেই ছিলো এতক্ষণ।
রিদির ঠোঁটের কোণে একটুখানি হাসি ফুটে উঠলো। এক অদ্ভুত প্রশান্তি ভর করলো তার ভেতরে। ধীরে ধীরে ঘরে ফিরে এসে ধপাস করে বিছানায় শুয়ে পড়লো। নরম গদি যেন তাকে আপন করে টেনে নিলো। হাতটা সামনে এনে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখতে থাকে আহাদ রাজার পরিয়ে দেয়া সেই রংধনুর মত ঝিলিক ছড়ানো ঝকঝকে ব্রেসলেটটা। আঙুল বুলিয়ে দিয়ে সেই হাতটা আবার বুকে চেপে ধরে রাখে। যেন বুকের গভীরে জমে থাকা উত্তাল ঢেউগুলো শান্ত হয়ে আসছে। এইতো কিছুক্ষণ আগেও সে ছটফট করছিলো, অস্থির হচ্ছিলো প্রতিটা মুহূর্তে। অথচ এখন মনে হচ্ছে, বুকের ভেতরে এক অচেনা শান্তির সমুদ্র নেমে এসেছে। চোখ বন্ধ করতেই ঘুম তাকে টেনে নিয়ে গেলো স্বপ্নের রাজ্যে। বাইরে দূরে কোথাও ফজরের আজান ভেসে এলো, কিন্তু রিদি ততক্ষণে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আহিয়া সিঁড়ি বেয়ে একরকম দৌড়াতে দৌড়াতে নামছে। পায়ের শব্দ গমগম করছে মীর হাউজের ভেতরটা। আজকে কিভাবে কিভাবে দেরি হয়ে গেল বুঝতেই পারেনি। ডাইনিং টেবিলে এসে তাড়াহুড়ো করে একটা ব্রেড তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিলো। কাঠবিড়ালের মত তার গালের ভেতর গোল হয়ে ফুলে উঠলো। এক হাতে ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে অন্য হাতে পানির বোতল নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলো। এমন সময় হঠাৎ করেই সামনে থেকে আসা আদনানের সাথে ধাক্কা খেলো। আহিয়ার শরীর কাঁপতে কাঁপতে পেছনে হেলে গেলো, তখনই আদনান তার দৃঢ় দু’হাতে তাকে সামলে নিলো। আঁতকে উঠে চোখ তুলে তাকাতেই স্থির হয়ে গেলো আহিয়া। আশ্চর্যের শ্বাসরুদ্ধ শব্দ বের হলো আহিয়ার ঠোঁট থেকে,
“আদনান ভাই!”
মুখে খাবার থাকায় কথা অস্পষ্ট শোনালো, গালের ভেতর এখনো ফুলে আছে। তার মুখ থেকে যেনো এক অদ্ভুত সরলতা ঝরে পড়ছে। আদনান থমকে দাঁড়িয়ে রইলো, তার কালো গভীর চোখে একধরনের অস্থিরতা খেলা করছে। যে অস্থিরতা সে লুকিয়ে রাখতে চেয়েছিলো বহুদিন, আজ যেনো আর সামলাতে পারলো না। বুকের ভেতরে জমে থাকা অগ্নিঝড় যেনো জ্বলে উঠলো এক মুহূর্তে।
“কবে বুঝবি বল? আমি আর সামলাতে পারছি না, আহি…!”
কথাগুলো মুখ ফসকে বেরিয়ে গেলো। এতদিন বুকের ভেতর লুকানো, গোপনে রাখা স্বীকারোক্তি এক নিমিষে ভেসে উঠলো তার ঠোঁটে। আহিয়া স্তব্ধ। কানের ভেতর যেনো গুঞ্জন করছে শব্দগুলো। কিন্তু এই কথার গভীরতা সে বুঝলো কি না কে জানে। সে নিজেকে তাড়াতাড়ি ছাড়িয়ে নিলো আদনানের কাছ থেকে। জ্বিব দিয়ে ঠোঁট সামান্য ভিজিয়ে নিয়ে বললো,
“সরি, আমি আপনাকে দেখতে পাইনি।”
আদনান ভ্রু কুঁচকালো। তার চোখে রাগ, অভিমান আর অস্থিরতা সব মিলেমিশে তীব্র হয়ে উঠেছে। আহিয়া তার চোখের সেই গভীরতা না বোঝার ভান করে দ্রুত প্রশ্ন ছুড়ে দিলো,
“আদনান ভাই, আপনি না চলে গেছিলেন? তাহলে আবার ফিরে এলেন যে?”
আদনান কিছুটা গম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমার ওয়ালেট ফেলে গেছি ভুলে। সেটা নিতে এসেছি।”
“ওহ।”
আহিয়া মাথা নেড়ে ছোট্ট গলায় বললো, অতঃপর আর কিছু না বলে ঘুরে চলে যেতে নেয়। সেই সময় পিছন থেকে আদনানের কণ্ঠ থামিয়ে দিলো তাকে,
“আহি!”
আহিয়া পা থেমে গেলো, মাথা ঘুরিয়ে উত্তর দিলো,
“হুঁ?”
আদনানের চোখে তখন এক অদ্ভুত ঝড়। সে গম্ভীর গলায় বললো,
“গাড়িতে গিয়ে বস। আমি ওয়ালেট নিয়ে আসছি।”
আহিয়া হ্যাঁ, না, কিছুই বললো না। শুধু নিরবতায় ভরিয়ে রাখলো চারপাশ। তার চোখে একরকম আতঙ্ক মিশ্রিত দ্বিধা খেলা করছে। আদনান দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলো। বুকের ভেতর ধুকপুক ধ্বনি বাজছে তার। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওয়ালেট নিয়ে ফিরে এলো। কিন্তু নেমেই দেখলো আহিয়া নেই। তার বুকের ভেতর হাহাকার জেগে উঠলো। মুখ শক্ত হয়ে গেলো, দাঁত কিড়মিড় করে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। ঠোঁট কেঁপে উঠলো রাগে, গলা ভারী করে বললো,
“আমার সাথে গেলে কি আমি তোকে খেয়ে ফেলতাম, আহি? একটু অপেক্ষা করতে পারলি না! তোর এতো তাড়া, ঠিক আছে। আমিও দেখি আর কত উপেক্ষা করতে পারিস আমাকে।”
চোখের দৃষ্টিতে ক্রোধ আর অপার অভিমান জমে উঠলো। আর কোনো কথা না বলে আদনান গাড়িতে উঠে বসলো। ইঞ্জিনের গর্জন ভেসে উঠলো মীর হাউজের প্রাচীর কাঁপিয়ে। মুহূর্তের মধ্যেই তার সাদা গাড়িটা গেট পেরিয়ে উধাও হয়ে গেলো।
এদিকে সূর্যের আলো তখন অনেকটাই চড়ে গেছে। রোদের তাপও বেড়ে গেছে। এখন এপ্রিল মাস তাই গরমও পরছে ভরপুর, তার উপর রিদির মাথার উপর ফ্যানটাও চলছে না। রিদির শরীর ঘেমে চিটচিটে হয়ে গেছে। ঘুমের ভেতরেই বিরক্তিতে কপাল কুঁচকে গেলো। হঠাৎ করেই বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে অর্ধ ঘুমে চিৎকার করে উঠলো,
“উফফ! ফ্যান অফ করছে কে?”
বলেই দুই হাত দিয়ে চুল ঠিক করে উঠে বসে পড়লো। চোখ আধবোজা, বিরক্তিতে গুমরে উঠছে। কয়েক মুহূর্ত পর কোন রকমে চোখ খুলে তাকায় দেয়ালের ঘড়ির দিকে। সাথে সাথেই চোখ বড় বড় হয়ে গেলো। ঘড়ির কাঁটা তখন নয়টা বিশে দাঁড়িয়ে। ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,
“হায় আল্লাহ! আজ তো শেষ!”
চমকে উঠে বিছানা ছেড়ে দৌড়ে ওয়াশরুমের দিকে ছুটলো। ধুমধাম শব্দ হলো রুমজুড়ে। আধ ঘন্টার মধ্যেই পুরোপুরি রেডি হয়ে গেলো, গাঢ় নীল কুর্তি আর সাদা ওড়না গায় জড়িয়ে নিলো। চুল দ্রুত ক্লিপ দিয়ে আটকে নিয়েছে। ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করতে করতে ঈশানীর দিকে রাগি চোখে তাকিয়ে বললো,
“আমাকে আরেকটু আগে ডাকবা না? কত দেরি হয়ে গেলো। এখন প্রথম ক্লাসটা মিস করলাম।”
ঈশানী টেবিলে বসে সবজি কাটছিল, রিদির দিকে না তাকিয়েই ঠোঁট উল্টে উত্তর দিলো,
“কতবার ডাকছি তোরে! মরার মত ঘুমাইছিলি। যেই আম্মুর টেকনিক খাটিয়ে ফ্যান অফ করে দিলাম। তারপরই উঠছিস।”
কথাটা শুনে রিদি থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। চোখ ছোট করে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বোনকে দেখলো। গাল দুটো ফুলিয়ে রাগি ভঙ্গিতে ঠোঁট কামড়ে ধরলো। কিন্তু কোনো উত্তর দিলো না। এবার দরজাটা ঠাস করে বন্ধ করে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলো। বাইরে তখন তপ্ত রোদ ঝলমল করছে। কোলাহলমুখর রাস্তায় এসে, একটা রিকশা নিয়ে শহরের ভিড়ে ঢুকে গেলো রিদিতা।
ক্লাস শেষ হতেই চারজন একসাথে হেঁটে এল ক্যান্টিনের সামনে। আকাশে তখন রোদের ঝলকানি, তবে ক্যান্টিনের উঠোনে ছাতার নিচে রাখা গোল টেবিলগুলোয় বসার মতো পরিবেশ বেশ আরামদায়ক। রিদি, আহিয়া, আনিকা আর নীলা অনেক দিন পর একসাথে হলো। যেনো জমে থাকা গল্পের পাহাড় ভাঙার জন্য চারজনই প্রস্তুত। তারা ছাতার নিচে একটি টেবিলে বসতেই আনিকা শুরু করলো তার অঝোর বকবক। আনিকার মুখে যেন ব্রেকই নেই। এর জন্য ক্লাসে দুবার বকাও খেতে হয়েছে তাদের, তবুও সে চুপ হয়নি। রিদিরা জানে, আনিকা ছাড়া তাদের আড্ডা কখনো পূর্ণতা পায় না। তার মুখে যখন গল্প ঝরে, বাকিদের শুধু শোনারই দায়িত্ব থাকে। এদিকে কখন থেকে নীলা গাল ফুলিয়ে চুপচাপ বসে আছে। না হাসছে, না কথা বলছে। আহিয়া খেয়াল করলো বিষয়টা, হালকা ঝুঁকে এসে এক টোকা দিলো নীলার কপালে।
“কিরে, তোর সমস্যা কি? এমন ফুলে বসে আছিস কেনো?”
নীলা ধীরে ধীরে চোখ তুললো, মুখে কোনো কথা নেই। কেবল মাথা নেড়ে জানালো কিছু হয়নি। রিদি সে দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
“তাহলে চুপ করে আছিস কেনো?”
“ভালো লাগছে না।”
“সেটাই তো, কেনো ভালোলাগছে না? বলবি তো!”
নীলা নিঃশ্বাস ফেলে গম্ভীরভাবে বললো,
“এমনই।”
আনিকা হঠাৎ হাত তুলে সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বললো,
“আচ্ছা বাদ দে এইসব। এখন এটা বল, তামিমের খবর শুনসিস তোরা?”
একসাথে তিনজনই মাথা নাড়লো,
“না, কী খবর?”
আনিকা এবার আরও ঝুঁকে এলো টেবিলের মাঝখানে। তাদের চারজনের মাথা এক হয়ে গেলো। চারপাশের ভিড়ের মধ্যে যেন তারা নিজেদের আলাদা জগৎ তৈরি করলো। আনিকা চাপা কন্ঠে বললো,
“শুনিস নাই? তামিমকে নাকি এই ভার্সিটি থেকে ট্রান্সফার করে চট্টগ্রামে পাঠিয়ে দিয়েছে।”
কথাটা শুনে রিদির বুকটা হালকা কেঁপে উঠলো। টেবিলে বসা ভঙ্গি বদলে সোজা হয়ে বসল। তামিমের বদলির পেছনে একটা অদৃশ্য হাত আছে। আর সেই হাতটা সে ভালো করেই চেনে, আহাদ রাজা। মুহূর্তে রিদির মনে অদ্ভুত এক শূন্যতা তৈরি হলো। মন খারাপ হলো তার, তবে একই সাথে তামিমের উপর রাগও হলো। সে তো তামিমকে শুধু বন্ধু ভেবেছিলো। অথচ বন্ধুত্বের আড়ালে তামিমের এমন ভিন্ন নজর ছিলো, যা সে কল্পনাও করেনি। ভাবনার জগতে ডুবে থাকা রিদিকে দেখে আহিয়া কৌতূহল নিয়ে বললো,
“কিরে, কি এতো ভাবছিস?”
রিদি ধীরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে বললো,
“শেক্সপিয়র ঠিকই বলেছেন, একজন ছেলে কখনো একজন মেয়ের বন্ধু হতে পারে না। আমি তামিমকে বন্ধু ভাবলেও, তার চোখে আমি ছিলাম অন্য কিছু। যা আমি কখনো কল্পনাও করতে পারিনি।”
আহিয়া মুখ টিপে হেসে বললো,
“এটাই স্বাভাবিক। আমার খাট্টাস ভাই যদি তোর প্রেমে পড়তে পারে, তাহলে তামিম কী জিনিস!”
কথাটা শুনে রিদির গাল হালকা লাল হয়ে উঠলো। লজ্জায় মাথা নামিয়ে ফেললো সে। আনিকা আর আহিয়া একসাথে হো হো করে হেসে উঠলো। তাদের হাসির শব্দে ক্যান্টিনের ভিড়ের কয়েকজন ঘুরে তাকালো অবাক হয়ে। ঠিক তখনই আনিকার চোখে পড়লো রিদির হাতে ঝলমল করা ব্রেসলেটটা। হাত বাড়িয়ে সেটা ধরে বললো,
“ওয়াও! সুন্দর তো। কোথায় পেলি এটা?”
রিদির ঠোঁটের কোণে লাজুক একটা হাসি ফুটলো। খুব শান্ত গলায় উত্তর দিলো,
“গিফট পেয়েছি।”
আনিকা চোখ কুঁচকে তাকালো, কিন্তু আর কোনো প্রশ্ন করলো না। হয়তো বুঝতে পেরেছে কিছুটা। তাদের আড্ডা চললো আরও কিছুক্ষণ। অবশেষে যখন আড্ডা শেষের পথে, তখন পরিকল্পনা হলো, একসাথে একটু শপিং করবে। আহিয়ার প্রস্তাবে বাকিরাও রাজি হলো। রিদি জানালো, সে ফোন কিনবে। হাসি আর কোলাহলের মাঝে চারজনই উঠে ভার্সিটির গেট পেরিয়ে বেরিয়ে যায়। তবে শাহবাগের কাছাকাছি আসতেই পরিস্থিতি বদলে গেল। শহরের রঙ বদলে গিয়ে এক গভীর অচেনা হট্টগোল ধারণ করলো সবকিছু। চৌরাস্তায় নির্বাচনী প্রচারের ঢেউয়ে মিছিল সমাবেশ চলছে। সব কিছু মিলেমিশে এক বিশ্রী কোলাহল তৈরি করছে। ঠিক তখনই, হঠাৎ করে বিরোধী দলের কিছু গুপ্তচর ভীড়ে ঢুকে পড়লো আর তারপরই শুরু হলো গোলাগুলি। রিদি আর তার বান্ধবীরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লো, ড্রাইভার সামনে যেতে সাহস পাচ্ছে না, পিছনে বা সামনে কোথাও নিরাপদ নেই। চারপাশে লোকজন চিৎকার করে ছোটাছুটি করতে শুরু করে। আক্রোশ আর ভয় সব কিছু মিলিয়ে শাহবাগ চত্ত্বরে এক অদ্ভুত অরাজকতা, যেন পুরো শহর কাঁপছে।
উঁচু মঞ্চ থেকে অহরহ বক্তৃতা চালিয়ে যাচ্ছিলো আহাদ রাজা। সে কণ্ঠে লাহান চেষ্টা, সবাইকে শান্ত রাখার আহ্বান জানাচ্ছে কিন্তু পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তার পাশেই রহস্যময়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিল শাহীন, নাদিম, শাওন আর আহাদের ঘনিষ্ঠ নিরাপত্তা দল। আহাদের কানে হঠাৎ শাহীন ফিসফিস করে বললো,
“ভাই, আপনার বোন আহিয়া আর উনিরা এখানে কি করছে?”
আহাদ ঝট করে ঘুরে তাকালো, চক্ষু জোড়া আতঙ্কে বড় হয়ে গেলো। শাহীন চোখের ইশারায় রিদির দিকে মুখসর করে দেখালো। চারজন গুটিশুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, ছোটাছুটোর মোকাবেলায় একে অপরকে ধরে রেখেছে।মাঝে মাঝে ভিড়ের ধাক্কায় একে অপরের কাছ থেকে সরে যাচ্ছিলো। হঠাৎ একজনের ধাক্কায় আহিয়া রাস্তায় পড়ে যায়। হাতের কজ্বিতে লেগে কিছুটা কেটেও গেছে, ফিনিক দিয়ে র’ক্ত বেড়িয়ে আসে। আনিকা আর রিদি তৎক্ষণাৎ ছুটে গিয়ে তাকে ধরে তোললো। আহাদের ঠোঁট শক্ত হয়ে গেলো, চোখে অন্ধকার আর ক্রোধ। সে শহীন ও নাদিমকে কঠোর কণ্ঠে আদেশ দিলো,
“ওরা এখানে কি করছে? যত দ্রুত সম্ভব ওদের এই ভীড় থেকে বের করে আন, কুইক!”
শহীনর জবাবের ভেতরের কণ্ঠে দাঁড়াল ভয় আর দায়বদ্ধতার টান, শাহীন গলা গম্ভীর করে বললো,
“কিন্তু ভাই, আপনার কাছে থাকাটাও তো জরুরি। আপনাকে একা ফেলে আমরা কি করে যাবো?”
আহাদ তীক্ষ্ণ চোখো তাকালো, গলার স্বর রুক্ষ করে বললো,
“শাহীন, আমি নিজেকে এবং নিজের জনগণের হেফাজত করতে পারবো। তুই শুধু আমার পরিবারকে হেফাজত কর। আমার জন্য এতোটুকু করতে পারবি না?”
শাহীনের চোখে অদম্য প্রবল ভক্তি, সাহস ভরে সে উত্তর দিলো,
“আপনার জন্য আমাদের জান কোরবান, ভাই। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে হলেও তাদের রক্ষা করবো।”
এই কথা বলেই শাহীন, নাদিম ও শাওন একসঙ্গে ছড়িয়ে পড়লো ভীরের মধ্যে। কিন্তু পরিস্থিতি মূহুর্তেই হিংস্র রূপ নেয়, গাড়ি ভাঙচুর, কোথাও কোথাও আগুন ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে। ধোঁয়ায় চারপাশ অন্ধকার হয়ে গেছে। সবাই একে অপরকে সামলে থাকার চেষ্টায় ব্যস্ত, কিন্তু অন্ধকার ও ধোঁয়ার কারণে কিছুই ঠিকঠাক দেখা যাচ্ছে না। লোকের চিৎকার আর প্ল্যাশ সব মিলিয়ে অশান্ত এক কোলাহল। রিদি ও তার বান্ধবীরা হাত ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, যেনো ভীড়ের ভেতর তারা ছিন্ন না হয়। কিন্তু হঠাৎ এক ধাক্কায় রিদির হাত ছুটে যায়, ভীরের ঢেউয়ের সঙ্গে আলাদা হয়ে খানিকটা দূরে সরে যায়। আনিকা, আহিয়া ও নীলা একে অপরের দিকে তাকায়, হাত পা কাঁপছে তাদের।রিদিকে খুঁজতে লাগলো, ভয়ে তাদের সব পরিকল্পনা ছিন্ন হয়, কী করবে তারা কিছুই বুঝতে পারছে না। তারা ভাবতেই পারেনি এখানে এসে এমন বিপদের সম্মুখীন হবে তারা। হঠাৎ করে কেউ একজন পাথর ছুড়ে মারে তাদের দিকে, শাহীন ঝট করে এসে আনিকাকে নিজের পিঠে ঢেকে আচ্ছাদন করে নেয়। আনিকা চিৎকার করে মুখ চেপে ধরে শাহীনের বুকে। আর সেই পাথর এসে আঘাত করে শাহীনের পিঠে। শাহীন ব্যাথায় মুখ কুচঁকে নেয় তবুও তাদের আড়াল করে রাখে নিজের শরীর দ্বারা। আনিকার বুক কেঁপে উঠলো, ভয়ের সাথে অপরাধবোধও মিশে গেলো, যেনো সে তার অপরিণত সিদ্ধান্তের জন্য দায়ী। শাহীন বহু কষ্টে তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“আ.. আ আপনি ঠিক আছেন?”
আনিকা কেবল মাথা নেড়ে উত্তর দিলো, কিছু বলার মত পরিস্থিতি ছিলো না তখন। শেষমেশ শাহীন আঙ্কুশহীন কষ্ট করে তাদের নিরাপদ পথে বের করে গাড়িতে তুলে দিলো। যদিও তারা রিদিকে রেখে যেতে চায়ছিলো না, শাহীন বহু কষ্টে বুঝিয়ে শুনিয়ে তবেই পাঠিয়েছে। এরপর রিদির খোঁজে তারা সর্বত্র ছুটে বেড়ায় কিন্তু কোথাও রিদি চিহ্ন পেলো না। সবশেষে ব্যার্থ হয়ে আহাদের কাছে ফিরে এসে মাথা নিচু করে দাঁড়ালো অপরাধীর মতো। আহাদ তাদের ওপর চোখ রেখে বুঝে নিল কিছু একটা ঘটেছে। তার কণ্ঠে চরম রাগ, সে ঝট করে আগুন ঝরা কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,
“ওরা কোথায়? ওদের খুঁজে পেয়েছিস?”
শাহীন মাথা নিচু করে অপরাধী কণ্ঠে বললো,
“ভাই, সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। কিন্তু..”
“কিন্তু কি শাহীন?”
“মিস রিদিতাকে খু্ঁজে পায়নি। আমার মনে হয় উনি বাসায়…”
কথা শেষ করার আগেই সপাটে এক থাপ্পড় এসে পরলো শাহীনের গালে। থাপ্পড়টি এত জোরে ছিলো, যে শাহীন একদিকে ছিটকে গেল। গালে হাত রেখে সে ক্ষুদ্রতরভাবে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখে লজ্জা ও বেদনার মিলিজুলি। নাদিম ও শাওন স্তব্ধভাবে ওর পাশে দাঁড়িয়ে রইলো। আহাদের কণ্ঠ সিংহের মতো গর্জে উঠে,
“তোদের এখনও মনে হয়? সামান্য একটা কাজ ঠিকঠাক করতে পারিস না তোরা। গর্দভ কোথাকার.!”
আহাদ নিজের চুলগুলো টেনে ধরে দু হাত দিয়ে। চারদিকে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করলো। বুকের ভেতর অজানা ভ’য় কাজ করছে। চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত পিষে বললো,
“আই সু’অ্যার শাহীন, আমার প্রেয়সীর যদি কিছু হয়। তাহলে আমি তোকে সহ গোটা পৃথীবি জ্বালিয়ে দিবো।”
অপার্থিব সেই হুশিয়ারি যেন মুহূর্তেই চারপাশ থমকে দিলো। ধোঁয়ার ফাঁকফোকরেও যেন শব্দগুলো বিস্ফোরণের মত ছড়িয়ে পড়লো। আহাদ রাজা নিজের পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে নেয়। শরীর ঘামছে দরদর করে, যেনো চারদিকের উত্তেজনা ও গরম বাতাস তার শিরায় শিরায় প্রবাহিত হচ্ছে। কী করবে? কোথায় খুঁজবে তার প্রেয়সীকে? পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। একজন ভবিষ্যৎ মন্ত্রী হিসেবে জনগণের দায়িত্ব তার কাঁধে, কিন্তু একই সাথে হৃদয়ের গহীনে এক ভ’য়া’ন’ক শূন্যতা চেপে বসেছে, তার প্রেয়সী কোথায়? সে ঠিক আছে তো? এক সেকেন্ডের জন্য চোখ বন্ধ করে নিলো আহাদ। বুকের ভেতরে ভারী ঢাকের মতো বাজছে হৃদস্পন্দন। হঠাৎ করেই কানে এলো এক কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর, যেনো মৃ’ত্যু’র অন্ধকারে আলো জ্বলে উঠলো,
“এই যে শুনছেন…”
আহাদের বুক ধক করে উঠলো। তড়াক করে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো সামনেই দাঁড়িয়ে আছে রিদিতা। তার চোখ ম্লান, তবুও শরীর সুস্থ সবল মনে হচ্ছে। শাহীন নাদিম শাওনও ঘুরে তাকালো। তারা যেনো প্রাণ ফিরে পেলো এক মুহূর্তেই। আহাদ এক সেকেন্ডও দেরি না করে এক লাফে নিচে নেমে এলো। রিদির সামনে এসে দাঁড়িয়ে বুক ভরে এক দীর্ঘ স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলো। তার খুব করে ইচ্ছে করছিলো রিদিকে একটু বক্ষপিঞ্জরে জড়িয়ে নিতে, কিন্তু সেটা সম্ভব না। তার মুখমুখি দাঁড়িয়ে শুকনো ঢোক গিলে সরল গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“মিস জানু! কোথায় ছিলে তুমি? তুমি ঠিক আছো তো!হুঁহ?”
রিদিতার চোখ ছলছল করছে, মনে হলো যে কোনো সময়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়বে। ঠোঁট ফুলিয়ে, গলা কাঁপিয়ে সে বললো,
“আমি ঠিক আছি… কিন্তু আহিয়া আর আনিকা, নীলাদের খুঁজে পাচ্ছি না।”
আহাদের বুকটা কেমন করে উঠলো, নরম স্বরে শান্তনা দিলো,
“হেই রিল্যাক্স। আহিয়ারা ঠিক আছে। ওদের আমি আগেই বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি।”
কথাটা শুনে রিদি কিছুটা নিশ্চুপ হলো। তার অস্থিরতা যেনো খানিকটা থেমে গেছে। সে লুকিয়ে হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে নিলো। তবে আহাদের চোখ সেটা এড়িয়ে গেলো না। আহাদ সেদিকে গভীরভাবে তাকিয়ে থেকে বললো,
“এখানে কেনো এসেছো তোমরা? এখন পরিস্থিতি খুব খারাপ। বাইরে আসার কি দরকার ছিলো?”
রিদির কণ্ঠে অভিমান ও অসহায়তা মিশে গেলো,
“আমরা কি জানতাম যে এমন কিছু ঘটবে?”
আহাদ আর কিছু বলতে পারলো না। শুধু সেই করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলো। চারদিকে একবার চোখ বুলালো সে, পরিস্থিতি কিছুটা শান্ত, তার লোকেরা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। আহাদ আরেক কদম এগিয়ে এসে রিদির সামনে দাঁড়ালো। মুখ খুলে কিছু একটা বলবে ঠিক তখনই, হঠাৎ করে রিদি আতঙ্কিত চিৎকার করে উঠলো,
“সরে যান!”
এক ধাক্কায় আহাদকে সরিয়ে দিলো পাশে। আহাদ কিছু বুঝে ওঠার আগেই সামনে থেকে ছুটে আসা একটা বু’লে’ট শোঁ শোঁ করে এসে রিদির গা ঘেঁষে গেলো। সঙ্গে সঙ্গে ধপ করে লুটিয়ে পড়লো রিদিতা। আহাদের দুনিয়া থমকে গেলো, পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত সে শুধু স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো সেই নিস্তেজ মুখটার দিকে। এমন শক্তো পোক্ত মানুষটারও হাটু কাঁপছে, বুক দুলছে, মূহুর্তেই শরীর থেকে সব শক্তি যেনো হারিয়ে গেলো। কাঁপা হাঁটু নিয়ে ধীরে ধীরে বসে পড়লো প্রেয়সীর মাথার কাছে। শাহীন আর গার্ডরা দ্রুত ঘিরে ফেললো চারপাশ। আহাদ কাঁপা কাঁপা হাতে রিদির মাথা তুলে নিলো নিজের উরুর ওপর। নিশ্বাস ভেঙে আসছে তার। এলোমেলো চুলগুলো সরিয়ে ভঙ্গুর কণ্ঠে ডাকলো,
“রিদি..! জানু, চোখ খোলো। একবার তাকাও আমার দিকে। এই তাকাও বলছি।”
আঙুলগুলো অস্বাভাবিকভাবে কাঁপছে তার। সে আবারও ডাকলো,
“এই আল্লাহর বান্দি এই, তাকাতে বলেছি তো আমি! তাকাও আমার দিকে! আমি কিন্তু দ্বিতীয়বার বলবো না রিদি!”
কোনো সাড়া নেই। আহাদের চোখে আগুন ঝড়ছে, কণ্ঠে জমে থাকা রাগ চিৎকার হয়ে বের হলো,
“জানু তাকা বলছি। এবার কিন্তু থাপ্পড়ায়া চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো! আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিস না… তাকা আমার দিকে। আচ্ছা কিছু বলবো না, প্লিজ তাকাও না একবার।”
তখন শাহীন এসে আহাদের কাঁধে হাত রাখলো। নরম গলায় বললো,
“ভাই, উনি ঠিক আছেন। জাস্ট অজ্ঞান হয়ে গেছে। এটা রাবার বুলেট ছিলো, উনির গা ঘেঁষে গেছে কিন্তু লাগে নাই। উনি আতঙ্কে জ্ঞান হারিয়েছে, চিন্তার কিছু নেই।”
আহাদের বুকের ভার কিছুটা নামলো। তবুও চোখে লেলিহান আগুন জ্বলছে। সে শক্ত করে রিদিকে কোলে তুলে নিলো। দাঁত চেপে শাহীনের দিকে তাকিয়ে কাঠিন্য ভরা কণ্ঠে নির্দেশ দিলো,
“শাহীন, তোরা এদিকটা সামলা। চাচু কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে। আমি ওকে নিয়ে হাসপাতালে যাচ্ছি। ও সুস্থ হলে আমি আবার ফিরবো। ততক্ষণ পর্যন্ত সব তোর হাতে।”
“ঠিক আছে ভাই।”
শাহীন সম্মান জানিয়ে মাথা নত করলো। গার্ডরা দ্রুত আহাদকে ঘিরে রক্ষা বলয় তৈরি করলো। গুলির শব্দ, ধোঁয়ার গন্ধ পেছনে ফেলে তারা দ্রুত হাসপাতালের দিকে ছুটে যায়। হাসপাতালে পৌঁছাতেই হুলস্থুল পড়ে গেলো। ডাক্তার, নার্স, স্টাফ সবাই ছুটোছুটি করছে। সব শেষে প্রায় এক ঘণ্টা পর জ্ঞান ফেরলো রিদির। কিন্তু ভয় এখনও কাটেনি। নিচের দিকে তাকিয়ে সেই কখন থেকো ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আহাদ চুপচাপ সামনের সোফায় বসে চিবুকে হাত রেখে দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ভেতরে ভেতরে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, না, আর কোনো রিস্ক নেওয়া যাবে না। নির্বাচন শেষ না হওয়া পর্যন্ত রিদিকে দূরে রাখতে হবে। তা না হলে শত্রুরা এবার সরাসরি তাকে টার্গেট করবে। আর তার পজিশন ছিনিয়ে নিবে খুব সহজেই।
এসব ভাবনার মাঝে একজন নার্স এসে হাতে একটি প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে গেলো। আহাদ কাগজটা টেবিলে রেখে ধীরে রিদির সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়ে বসল। রিদি চমকে তাকালো, নিজের সামনে আহাদ রাজাকে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে দেখে বুকের ভেতর কেমন যেন নড়ে উঠলো। কান্না থেমে গেল তার। আহাদ তার চোখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
“এখনো ভয় পাচ্ছো? ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি আছি তো, তোমার কিছু হবে না।”
রিদি প্যাচপ্যাচ করে নাক টেনে বললো,
“আমি তো ভেবেছিলাম ওরা আপনাকে গু’লি করেছে। কি দরকার জীবনের এতো ঝুঁকি নিয়ে এই রাজনীতির খেলায় নামার?”
আহাদ তার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। চোখে ঝলসে উঠলো প্রশ্রয়। সে স্পষ্ট বুঝতে পারলো, তার প্রেয়সী তাকে হারানোর ভ’য় করছে। অথচ সে খুশি হতে পারলো না। কারণ সে জানে, তার জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত এখন ঝুঁকির, মৃত্যু হাতছানি দিচ্ছে। অথচ তাদের প্রেমের অধ্যায় এখনো শুরুই হয়নি। একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে, পকেট থেকে একটা সাদা রুমাল বের করে রিদির হাতে দিলো। রিদি বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে নাক চেপে হ্যাত হ্যাত করে পরিষ্কার করলো। আহাদ মুখ কুঁচকে তাকালো তার দিকে। রিদি হাস্যকর ভঙ্গিতে আবার রুমালটা এগিয়ে দিলো আহাদের দিকে। আহাদ এক আঙুল দিয়ে রিদির ঠেলে হাতটা সরিয়ে, হালকা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বললো,
“এটা তোমার কাছেই রাখো, তোমার প্রয়োজন আছে এটার।”
রিদি আবার রুমালটা নাকে চেপে শব্দ করলো। রিদির এমন কান্ডে আহাদ মুখে হাত রেখে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে হেসে উঠলো। ঠিক তখনই দরজার ফাঁক দিয়ে এই মিষ্টি মুহূর্তটা আদনানের চোখে স্পষ্ট ধরা দিলো। সে ইমারজেন্সি ওয়ার্ডের দিকে যাচ্ছিলো, কিন্তু কেবিনের খোলা দরজা দিয়ে ভেতরের দৃশ্য অবেচেতনভাবে চোখে পড়লো তার। ভেতরে ভেতরে বুঝলো রিদি আর আহাদের সম্পর্কটা কোন দিকে যাচ্ছে। একটু থেমে, তীক্ষ্ণ চোখে পর্যবেক্ষণ করলো সবকিছু। তারপর ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে ফোন বের করে কল করলো। ওপাশে আফরোজা শেখের কণ্ঠ ভেসে আসতেই আদনান ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ় স্বরে বললো,
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২০
“ছোট আম্মা, আমি আপনার প্রস্তাবে রাজি। আপনি বিয়ের ব্যবস্থা করতে পারেন।”
কথাটা আহাদ আর রিদির দিকে তাকিয়েই বললো। অতঃপর ফোন কেটে ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে দ্রুত সরে গেলো সেখান থেকে। ফোনের অপর প্রান্তে আফরোজা শেখ একটা হাসি দিলেন, যেটা ছিলো তার বিজয়ের হাসি।