না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৩ (২)

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৩ (২)
মাইশা জান্নাত নূরা

গভীর রাত। ঘড়ির কাঁটা ৩টার ঘর ছুঁয়ে নিয়েছে। পিহু আর সারফারাজ এক বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে আছে। দু’জনেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন।
কিয়ৎক্ষণ পর পিহু ঘুমের ঘোরেই কেমন মৃদুভাবে ছটফট করতে শুরু করলো। ওর শরীরের প্রতিটি লোমকূপ দাঁড়িয়ে গিয়েছে অজানা শিহরণে। পিহুর শ্যমরঙা মুখশ্রীতে কুঁচকানো ভাব স্পষ্ট হয়েছে। দু’পাশের চিবুক বেয়ে সূক্ষ্ণ ঘামের কণা গড়িয়ে পড়ছে। পিহুর গলা, কপাল ঘেমে একাকার অবস্থা। পিহুর শ্বাসও ঘন হয়ে এসেছে।
ঘুমের ঘোরেই পিহুর একটা হাত সারফারাজের বুকের উপর এসে পরলে সারফারাজের ঘুম ভেঙে যায়। সারফারাজ চোখ মেলে উঠে বসে পিহুর দিকে তাকাতেই ওর এমন অবস্থা দেখে একহাত পিহুর পিঠের উপর বিচরণ রেখে ওকে শোয়া থেকে উঠিয়ে নিজের বুকের সাথে ওর পিঠ ঠেকিয়ে আরেকহাতে পিহুর গালের আলতো ভাবে বা*রি দিতে দিতে বললো…..

—“বউ! এই বউ, কি হলো তোমার?”
পিহুর ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। ফিসফিস করে কিছু বলছে যেনো। সারফারাজ চোখে-মুখে গভীর উদ্বেগের ছাপ স্পষ্ট হলো। সারফারাজ পিহুর কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো….
_“বউ! চোখ খুলো। আমি এখানেই আছি, দেখো তোমার পাশেই। একদম তোমার কাছাকাছিই। সব ঠিক আছে, বউ। চোখ খুলো তুমি!”
পরপরই পিহু লম্বা শ্বাস টেনে চোখ মেলে তাকালো। ওর চোখগুলোতে ভয় আর বিস্ময়ের ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। দ্রুততার স্বরে পিহু বললো….

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

—“ওরা…ওরা আপনাকে মারছে। এমপি সাহেব, ওরা মারছে। মারছে, আপনাকে। র*ক্তা*ক্ত করে ফেলছে আপনার সর্বশরীর। আমাকে বেঁধে রেখেছে। আমি…আমি পারছি না, ওদের আটকাতে পারছি না আপনি। ওরা আমার সামনে আপনাকে কেমন মে*রে র*ক্তা*ক্ত করে দিচ্ছে।”
পিহুর কথাগুলো শুনে সারফারাজ বুঝতে পারলো সে কোনো দুঃস্বপ্ন দেখেছে। সারফারাজ পিহুকে নিজের দিলে ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের বুকের সাথে পিহুকে বুকে জড়িয়ে নিলো। যেনো এই বুকে মাথা রেখে পিহু ওর মন থেকে সব ভয়কে দূর করতে সক্ষম হয়। সারফারাজ পিহুকে শান্ত করতে বললো….
—“শুউউ, শুউউ। কেউ নেই এখানে। কেউ না। শুনো প্রিটি, কেউ তোমাকে বা আমাকে আঘাত করছে না।দেখো নিজের চারপাশটা একবার। তুমি তোমার এমপি সাহেবের বুকের মধ্যে আছো এখন। একদম নিরাপদ।”
পিহুর সর্ব শরীর এখনও মৃদু ভাবে কাঁপছে। শক্ত করে পিহু সারফারাজের গলা জড়িয়ে ধরেছে একহাতে। সারফারাজের বুকের আরো গহীনে প্রবেশ করার চেষ্টা চালাচ্ছে যেনো পিহু।
সারফারাজ নরম কন্ঠে বললো….

—”ভ*য় পেও না প্রিটি। আমি তোমার সাথে থাকতে কেউ তোমার কিচ্ছু করতে পারবে না। তুমি ঘুমের ভিতর কেবল বা*জে একটা স্বপ্ন দেখেছো। এছাড়া কিছুই না। স্বপ্ন কখনও বাস্তব হয় না। দেখো তোমার ঘুম ভেঙে গিয়েছে তোোমার স্বপ্নও শেষ হয়ে গিয়েছে। বাস্তবে তুমি আমি দু’জনেই একদম ঠিক আছি।”
পিহু কাঁপা কণ্ঠে বললো…
—“ওরা-ওরা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। আপনার ওপর লাইট ধরলো। এমপি সাহেব, আমি-আমি দেখেছি। ওখানে অনেক অনেক র*ক্ত ছিলো। অনেক র*ক্ত।”
পিহুকে কোনো ভাবেই শান্ত করতে পারছিলো না সারফারাজ। পরপরই সারফারাজ পিহুর মাথা নিজের বুকের উপর থেকে সরিয়ে ওর দু’গালে নিজের দু’হাত রেখে ওর ঠোঁটে আলতো করে একবার চুমু খেলো। পরপরই পিহু আবারও বললো….

—”চারপাশটা র*ক্তে ভেসে যাচ্ছিলো। আমি আপনাকে বাঁচাতে ওদের তাড়া করতে চাইলাম কিন্তু আমি পারছিলাম না। আটকে গিয়েছিলাম।”
সারফারাজ আবারও পিহুর ঠোঁটে চুমু খেলো। এবারের চুমুটা প্রথম বারের থেকে আরেকটু গাঢ় ছিলো। পিহু আ*ত*ঙ্কিত স্বরে আবারও বললো….
—”কোনো বাঁধন আমায় আটকে দিয়েছিলো। আমি চিৎকার করছিলাম৷ আমার চিৎকার ওরা শুনছিলো। শুনছিলো ওরা!”
সারফারাজ ৩য় দফায় পিহুর ঠোঁটে গভীর চুমু খেলো। ছাড়লো না এবার আর অল্প সময়ের মধ্যে। মিনিট ২ পর পিহুর ঠোঁট থেকে নিজের ঠোঁট সরিয়ে ওর কপালের সাথে নিজের কপাল ঠেকালো। পিহু এখন আগের থেকে অনেকটা শান্ত হয়ে গিয়েছে। দু’জনের গরম নিঃশ্বাস একে অপরের মুখের উপর আঁছড়ে পড়ছে। পিহুর চোখের কোণে জমে থাকা জল গড়িয়ে পড়লো সারফারাজের হাতের উপর। সারফারাজ স্বযত্নে পিহুর দু’চোখ মুছে দিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললো….

—“শুনো বউ, দুঃস্বপ্নগুলো কেবল আমাদের মনে ভ*য়ের সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে ক*ষ্ট দিতে সক্ষম হয় না। স্বপ্ন হোক বা বাস্তব। আমি উভয় সময়েই ছায়ার মতো তোমার পাশে আছি, থাকবোও।”
পিহু চোখ নামিয়ে ধীরস্বরে বললো….
—“আমি দুঃখিত এমপি সাহেব। আমি, আসলে আমি ভ*য় পেয়ে গিয়েছিলাম অনেক। আর তখন যা হলো! আমি আপনাকে ওমন করে…!”
সারফারাজ ঠোঁ*ট কাঁ*ম*ড়ে হালকা হেসে বললো….

—“অবশ্য তোমার ভ*য় পাওয়াটায় আজ আমার লোকসান কিছু হয় নি বরং লাভই হয়েছে। তোমার ঠোঁটের স্বাদ গ্রহন করতে পেরেছি৷”
সারফারাজের এরূপ কথায় পিহু যেনো লজ্জায় একেবারে মিইয়ে গেলো। পিহু সারফারাজের কাছে থেকে সরে পাশেই শুয়ে পড়লো নিজের লজ্জামাখা মুখটা বালিশে গুঁজলো। সারফারাজ পিহুর দিকে ঝুঁকে আলতো করে ওর চুলগুলো নিজের মুখের পাশ থেকে সরিয়ে দিয়ে ওর কানের কাছে মুখটা এগিয়ে এনে বললো…..
—”আলাদা বালিশে মাথা রেখে ঘুমাতে চেয়েছিলে, দিয়েছিলাম। ফল তো দেখা হলো। ১টা রাতও কাটলো না পুরোপুরি ভাবে। তাই এখন আর কোনো রিস্ক নিবো না। আমার বুকে মাথা রেখে ঘুমাতে হবে তোমায় এখন থেকে প্রতিটি রাতেই।”

এই বলে সারফারাজ পিহুর কানের লতিতে ছোট্ট করে একটা চুমু এঁকে দিয়ে নিজে শুয়ে পিহুর কোমর জড়িয়ে ধরে ওকে নিজের কাছে টেনে নিলো। পিহুর মাথাটা ঠেকলো সারফারাজের বুকের উপর। পিহুর বুকের ভিতরটা ধুকপুক ধুকপুক করছে। পিহু ওর একহাত সারফারাজের বুকের উপর রেখে দু’চোখ বুঁজে নিলো৷ সারফারাজ পিহুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে গুন গুন করে গেয়ে উঠলো…….

❝ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে।
ভালোবাসার নাও ভাসাবো,
ভালোবাসি বলে!
তোমার চুলে হাত বুলাবো,
পূর্ণ চাঁদের তলে।
কৃষ্ণচূড়া মুখে তোমার,
জোসনা পড়ুক কোলে।
ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান,
ঘুমাও আমার কোলে।
ভালোবাসার নাও ভাসাবো,
ভালোবাসি বলে….!❞

সকাল বেলা…….
নির্ঝরের রুমের দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে ইলমা দরজায় টোকা দিকে ওকে ডাকলো…
—”নির্ঝর! শুনছেন? আপনি কি ঘুম থেকে উঠে গিয়েছেন? নির্ঝর!”
ইলমার বারকয়েক ডাক পরতে না পরতেই নির্ঝরের ঘুম ভে*ঙে গেলো। রাতে ওমন বি*শ্রী একটা ঘটনা ঘটার কারণে নির্ঝরের ঘুম পূর্ণ হয় নি তাই এখনও ঘুমিয়ে ছিলো সে। আড়মোড়া ভে*ঙে নির্ঝর জবাব দিলো…..
—”ইলমা! আপনি বাহিরে?”
—”হুম, আমি।”
—”ভিতরে আসুন।”
ইলমা রুমের ভিতর প্রবেশ করলো। নির্ঝর এর ব্যথা এখন অনেকটাই কমেছে। তবে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসে নি। ইলমা বললো….
—”কোমর ব্যথা সারে নি আপনার এখনও!”
—”না, অনুভব তো করছি এখনও অনেকটাই।”
—”কাল তো আমার কথা শুনেন নি। বেখায়াল বশত পাওয়া ব্য*থা*টাকে ছোট বিষয় ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ আপনাকে আমার কথা শুনতেই হবে। আপনার ভাইয়ের সাথে আমার নতুন ঠিকানা খুঁজতে বের হওয়ার আগে আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো আমি।”

—”না না, আপনাকে আমার ঝামেলা টানতে হবে না।আর আমার কোমরের যে অবস্থা জার্নি করে ক্লিনিক পর্যন্ত যাওয়াটা সহজ বিষয় হবে না আমার জন্য। তাই আমি আমাদের ফ্যমিলির পরিচিত ডাক্তার আঙ্কেলকে কল করবো ভাবছি। উনি এসে চেক-আপ করে যাবেন। আর যা ঔষধ লাগে সার্ভেন্টকে দিয়ে আনিয়ে নিবো। আপনি তেজ ভাইয়ের সাথে নির্দ্বিধায় বাহিরে যেতে পারেন।”
—”আপনি আমার অনেক বড় উপকার করেছেন নির্ঝর। সেদিন রাতে যদি আপনি আমায় বিশ্বাস করে নিজেদের বাড়িতে না আনতেন, আমার অতিরিক্ত সন্দেহপ্রবণ আচারণগুলোকে সহ্য না করতেন তাহলে আজ হয়তো আমার জায়গা এমন কোথাও হতো যেখানে আমি সুখের চিহ্নটুকুও খুঁজে পেতাম না। তাই আপনাদের জন্য সামান্য কিছুও যদি করতে পারি আমি সেটাকে মোটেও ঝামেলা বলে মনে করবো না। আমার ভালোলাগা থেকে, মনের তৃপ্তি থেকেই করবো।”
নির্ঝর হালকা হেসে বললো….

—”নতুন জায়গায় যাবেন। সেখানেই থাকবেন ঠিকই। তাই বলে ছাড় দিচ্ছি না আপনাকে। একদিন আমাদের করা এই সব উপকারের হিসেব সুদে-আসলে উশুল করে নিবো।”
ইলমাও হাসলো। আর বললো….
—”অপেক্ষায় থাকবো।”
—”তেজ ভাই উঠেছে কি?”
—”আপনার রুমে আসার সময় তো ওনাকে আশেপাশে দেখলাম না। উঠেন নি হয়তো।”
—”ঠিক আছে। আপনি বরং সকালের নাস্তাটা করে নিন। ভাই উঠে যাবে একটু পরেই। ওর একটু দেড়ি করেই ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস তো!”
ইলমা মাথা নাড়িয়ে নির্ঝরের রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। নির্ঝর শব্দ করে একবার নিঃশ্বাস ফেলে নিজের উপর থেকে কম্বলটা সরাতেই ওর মুখ হা হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে আবারও কম্বল দিয়ে নিজের শরীরের নিম্নাংশ ঢেকে নিলো। ঠোঁট কাঁমড়ে বললো….

—”একি আমার লুঙ্গি কই?”
রাতে ওমন ঘটনার পর নির্ঝরের পোশাক পরিবর্তন করিয়ে দেওয়ার পর আর ট্রাউজার না পড়িয়ে লুঙ্গি পড়িয়ে দিয়েছিলো। ছেলেরা লুঙ্গিতে একটু বেশিই কম্ফোর্টেবল ফিল করে। বিশেষ করে ঘুমানোর সময়। আর আবহাওয়া যদি গরম গরম অনুভব দেয় তখন তো লুঙ্গি ছাড়া কোনো গতিই নেই যেনো বাঙালি ছেলেদের। কিন্তু এক্ষেত্রে নির্ঝরের অভ্যাসটা বড্ড খারাপ। লুঙ্গির গিঁট যতো কড়া করেই বাঁধানো হোক না কেনো ঘুমের মধ্যে ওর তা খুলে যাবেই। আর লুঙ্গিটা কই থেকে কই যাবে তা নির্দিষ্ট ভাবে বলা মুশকিল। নির্ঝর দাঁতে দাঁত চেপে বললো….

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৩

—”কথায় আছে না! হাতি যখন কাঁদায় পড়ে, চা*ম*চিকা তেও লা*থি মা*রে। আমার দশাও হয়েছে তেমনই। নয়তো এসির বাতাসেও কি আমার লুঙ্গি আকাশে উঠে যেতে পারতো…?”
নির্ঝর পারে না তো গলা ছেড়ে কাঁদতে। ওর নাম কেনো যে নির্ঝর রেখেছিলো ওর বাবা-মা! নামের সাথে তো জীবনের কোনো মিল-ই সে কখনই খুঁজে পায় না।

না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here