প্রেমতৃষা পর্ব ২০
ইশরাত জাহান জেরিন
পাক্কা গুনে গুনে সময় নিয়ে যখন দেখল আরেকটু দেরি হলে তৃষা মরেই যাবে ঠিক তখনই প্রেম তাকে ছাড়ল। তৃষা নিজেকে ছাড়িয়ে আঙুল তুলে প্রেমকে শাসিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম তার আঙুল ধরে নিচে নামিয়ে বলল, ‘বিটারহার্ট কুল। আঙুল বেশি উপরে উঠানোর দরকার নেই। কারণ সেই তো নামাতে হবে এই প্রেমের কথাতেই। আর আমি চাই না তৃষা নুজায়াত চার আঙুলে জীবন পার করুক।’
তৃষা ক্ষিপ্ত হয়ে বলল, ‘আপনি কত বড় নির্লজ্জ! আপনি কি মানুষ?’
‘উহু! জানোয়ার। তুমিই না বললে? নইলে তো জানতাম না।’
তৃষা তেতে ওঠে। আরো কিছু বলতে যাবে তার আগেই প্রেম তার মুখটা চেপে ধরে বলল, ‘ শালী তোর ভাতার লাগি না, যে এই রাত বিরেতে তুই রুমের মধ্যে ষাঁড়ের মতো চেঁচাবি আর মহল্লার মানুষ সকালে এসে খুশির সংবাদ তোর কাছ থেকে চাইবে।’
প্রেম মুখটা ছেড়ে বারান্দার দিকে যায়। নিচে মই আছে। সে নিজের ঘরে চলে যাবে। তবে যাওয়ার আগে সে অন্ধকারে মুচকি হেসে বলল,’তোর ঠোঁটে সিল মেরে দেখ আমার ঠোঁটের সতীত্ব নষ্ট হলো। তোর তো বিটারহার্ট আমায় ধন্যবাদ হিসেবে আরেকটা চুমু উপহার দেওয়া উচিত ছিল। মহা হার কিপটে তুই মেয়ে। যাই হোক এখন ঠোঁটে সিল মারলাম। তারপর মনে, আর শেষে না হয় দেহে। দেহের সিলটা কিন্তু নেক্সট টাইমও হতে পারে। বি কেয়ারফুল। ওই ঠোঁট প্রেম নেওয়াজ স্পর্শ করেছে, বান্দির বাচ্চা ভুলেও যদি সেখানে অন্য করো ছোঁয়া পাই তাহলে বিশ্বাস কর তোর ঠোঁট দু’টো কেটে আমি বায়োলজি ডিপার্টমেন্টর ল্যাবে বয়ামবন্দী করব শালীর ঘরের মাইয়া। ‘
থেমে আবার বলল, ‘ভালোটালো তোকে আমি বাসিনা। প্রেম আমার জীবনে নেই। আসবেও না। আর তোকে দেখলে আমার কোনো ফিলটিলও আসে না। আমি জাস্ট পরীক্ষা করে দেখলাম তোর ঠোঁটের ফ্লেভার কেমন। একেবারে চিরতার মতো চ্যাহ! তোর স্বামীর কপালে মহা দুঃখ আছেরে বিটারহার্ট। মার্ক করে রাখ মাইন্ডে, তোকে জাস্ট অসহ্য কর লাগে আমার। প্রেমে ভুলেও পড়বি না। পড়লে এবার চুলগুলো কেটে পুড়াবো।’
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তৃষা হাত দিয়ে ইচ্ছে মতো নিজের হাত ঘষতে থাকে। প্রেম মইয়ে চড়তেই তৃষা ওপর থেকে মই নাড়াতে শুরু করে। এভাবে আরেকটু করলে প্রেম নির্গাত নিচে পড়বে। আর কোমরটা যাবে। সে চেঁচিয়ে দাঁত পিষে মই দিয়ে নামতে নামতে বলল, ‘বিটারহার্ট আমি ওপরে আসলে কিন্তু পালানোর পথ খুঁজে পাবে না। তুমি অন্তত চাও না দশ মাস দশ দিনের একটা দীর্ঘ সফরে প্রেম তোমায় লাথি মেরে ফেলুক?’
তড়িঘড়ি করে তৃষা মই ছেড়ে ভেতরে ঢুকে বারান্দার ট্রাই-গ্লাস লাগাল। তারপর ওয়াশরুমে গিয়ে ঘষে মেজে নিজের ঠোঁট ধুতে লাগল। শেষমেশ ওই ড্যান্ডিখোর প্রেম নেওয়াজ তার পবিত্র ঠোঁট অপবিত্র করে দিল!তৃষার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। হাতটার দিকে তাকালো। লাল হয়ে গেছে। এত শক্ত করে কেউ ধরে? মানুষের তো একটু দয়ামায়া বলেও কিছু থাকে? এই লোকের নেই কেন? এত পাষণ্ড কেউ হয় নাকি? ওই মইটার সঙ্গে প্রেম ভাইকে ফেললে জীবনের কষ্ট একটু হলেও কমতো। তৃষা মেজাজটা বেজাই গরম হচ্ছে। তার চেয়েও বেশি পাচ্ছে লজ্জা। জীবনে এখন পর্যন্ত কেউ যেখানে তাকে চুমু দিলো না সেখানে এই লোকটা কেন দিবে? আর কোন অধিকারে?
ভার্সিটির চত্বরে প্রেম অংকুর সবাই মিলে তখন আড্ডায় মশগুল। সকাল থেকেই তৃষা নজরে এলো না। আসলে তৃষা নিজেই প্রেমের মুখোমুখি হওয়ার সাহস খুঁজে পায়নি। পাবে কেমন করে? ঠোঁটে বিরাট এক সিল মেরে দিয়েছে ওই লোক। কেমন যেন দাগ বসে গেছে। এসব নিয়ে কি তার সামনে যাওয়া যাবে? ভরসা নেই তো! যদি আবার অঘটন ঘটিয়ে ফেলে? তবে তৃষা ভালো করেই জানে হারে বজ্জাত হাইব্রিড করলাটা নিশ্চয়ই তাকে খুঁজে বের করবে। খুঁজে বের করার আগেই কিছু একটা করতে তৃষাকে হবেই। তৃষার মাথায় বিচক্ষণ একটা বুদ্ধি এলো। ভাবতে না ভাবতে সে ব্যাগ থেকে কাগজ কলম বের করে তাতে বড় বড় করে লিখল, ‘ পিও গুন্নমান্য ঠোঁট ধর্ষণকারী আমার সিনিয়র মহাশয়,
পত্রের শুরুতেই জানাই আপনাকে বেগুনি রঙের সালাম। আসসালামু আলাইকুম। আজকে আমি বিশেষ কোষ্ঠকাঠিন্যের কারণে ভার্সিটিতে আসতে পারিনি। তাই খামে ভরে আপনার জন্য সালাম পাঠিয়ে দিলাম। অন্যের ঠোঁট না খেয়ে দয়াকরে সালামটা খেয়ে পেট ভরবেন।
ইতি ভার্সিটির সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে তৃষা, আপনার অত্যাচারে জর্জরিত জুনিয়র।
চিরকুটটি পাঠালো এক মেয়েকে ঘুষ দিয়ে। তাও যেন-তেন ঘুষ নয় এ যে একেবারে প্রেমের ঘুষ। আসলে এই মেয়ে প্রেমকে পছন্দ করে। এখন প্রেমকে প্রায় সে তৃষার সঙ্গে দেখে তো, তাই সেদিন জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুমি কি প্রেম ভাইয়ের প্রেমিকা হও?’
তৃষা মনে মনে মুখ ভেংচি কাটলেও সেদিন মাথায় তার শয়তানি বুদ্ধি চেপেছিল। সে বড় মুখ খুলে মেয়েটিকে বলেছিল, ‘আরে ওইসব প্রেম ভালোবাসা কেন করব? তবে মেয়ে আমি কিন্তু প্রেম ভাইয়ের কাছের মানুষ। আসল কথা কি জানো? আমার ডান হাত ওই প্রেম ভাই। দেখো না খালি ক্লাস থেকে নিয়ে যায়? যাবে না কেন? তার যেকোনো বুদ্ধি কিংবা পরিকল্পনা আমিহীন অসম্পূর্ণ। আমার থেকে তো সে মোটা মোটা বুদ্ধি নেয়। নইলে কি চলতে পারত? এসব অনেক ভেতরের কথা বুঝলে তো? সবাইকে আমরা বলি না তোমাকে ভালো লাগল বিধায় বললাম৷ আর আমি চাই না প্রেম ভাইয়ের আসল খবর সবাই জেনে যাক। বুঝই তো মনটা আমার একটু বেশিই ভালো। অন্যের অপমান আমার সহ্য হয় না। ‘
কথায় কথায় মেয়েটির থেকে জানত পারল প্রেমকে সে পছন্দ করে। তৃষাও সুযোগ নিয়ে বলল, ‘তুমি চাইলে কিন্তু প্রেম ভাইয়ের সঙ্গে আমি তোমার একটা লাইন ফাইন করে দিতে পারি? দেব নাকি? আমার আবার অনেক পাওয়ার! প্রেম ভাই আমার কথায় উঠে বসে ,উঠে বসে।’
মেয়েটির খুশি তখন কে দেখে ? সেদিনের পর থেকে প্রেমের কথা বলে তৃষা মোটামুটি ভালই সুবিধা লুটেছে এই মেয়ের । এই যেমন ক্লাসের সকল নোটস, ক্যান্টিন থেকে খাবার আনা, পাড়ার কাকিমাদের মত কোন ডিপার্টমেন্টে কি চলছে সেই সব খবর জোগাড় সবই এই মেয়েকে দিয়ে করিয়েছে তৃষা।’ বিনিময়ে আবার প্রেমের নাম করে ভুগিচুগি লাভ লেটার লিখে ওই মেয়েকে দিতে হয়েছে। ওমা এসব না করলে হাতে রাখতে পারত বুঝি? বলদ মেয়ে একটা! তবে তৃষা এসব করেছে প্রেম ভাইয়ের অগোচরে। যদি ঘুনাক্ষরে এসব খবর প্রেম ভাইয়ের কানে যায় তবে নিশ্চিত এই দফায় মান্দার গাছের বারি তৃষার পিঠে তালের মতো ফেলবে প্রেম ভাই। কিংবা গরম গরম ডিম থেরাপিও দিতে পারে। থাক বাবা যেই সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে তৃষা সবটা সাজিয়েছে জীবনেও ধরা খাবে না এতটা ভরসা তো নিজের উপর আছেই।
তৃষা আজকে ক্লাসে যায় নি। এখানে সেখানে আড্ডা দিয়েছে। ক্লাসে গেলেই তো প্রেম ভাই গালে একটা চড় বসিয়ে কুত্তার মতো টেনে বাইরে নিয়ে আসবে। হাইব্রিড করলাটা আর পারে কি? তৃষা মেয়েটিকে চিপায় ডেকে ভাঁজ করা চিরকুটটা হাতের মুঠোয় দিয়ে বলল, ‘এটা প্রেম ভাইকে দেবে। আর কতকাল প্রেম ভাই শুধু তোমাকে চিঠি দিয়ে যাবে? তোমারও তো উচিত তাকে দু-চারটে কথা লিখে পাঠানো?’
মেয়েটি সেই চিরকুট খুলে পড়তে গেলেই তৃষা চটজলদি বলল,’আরে বোকা মেয়ে এই চিরকুটের মধ্যে কবিরাজি ফুঁ দেওয়া। এটা কেউ খুলে ফেললে কাজই করবে না। এটা সরাসরি প্রেম ভাইকে দেবে। দিয়ে দেবে এক দৌড় । সেখানে দাঁড়িয়ে থাকলেও কিন্তু এই চিরকুট কাজ করবে না। সেই হিমালয় পর্বতের পাশে অবস্থিত বান্দরবান পাহাড়ের নিচে বসবাস করা হুংচাং লু বাবার বিশেষ টোটকা আছে এতে। এবার দেখবে প্রেম ভাই তোমার জন্য পাগল হয়ে গেছে। আর তোমাদের বিয়ে তো পাক্কা সিউর। সুখী হও। ধন্যবাদ দিয়ে আমায় ডুবিয়ো না। সদা মারা খাও না মানে খুশি থাকো।’
মেয়েটি নাচতে নাচতে সেই চিরকুট নিয়ে হাজির হয় প্রেমের কাছে। তৃষা তার বিষয়ে কিছু বলতে নিষেধ করেছিল। কিন্তু প্রেম ভাইকে দেখলেও তো ভয় লাগে। কাছে গেলে যদি চড়-থাপ্পর কিছু একটা গালে বসিয়ে দেয়? মেয়েটি কি করবে ভাবতে না ভাবতে চিরকুটটিকে ডলা মোচড়া করে প্রেম ভাইয়ের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ফেলে দিলো। এভাবে ফেললে কে দিলো না দিলো দেখতেও পারবে না,ভয়ের কোনো আশঙ্কা নেই আবার টোটকাও কাজ করে যাবে। প্রেম তখন ছেলে-পেলেদের সঙ্গে আড্ডা দিতে ব্যস্ত। মাথাটা গরম হয়ে আছে। তৃষাকে এমনিতে আজকে ক্লাস রুমে পায়নি। এই মেয়েকে ইচ্ছে করছে গাছের সঙ্গে উল্টো করে ঝুলিয়ে উদুম কেলাতে।
মেয়েটি প্রেমের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় এমন ভঙ্গিমা করে কাগজটা ফেলল যেন সে কিছু করেই নি। তবে সে যাওয়ার আগেই বিষয়টি প্রেম লক্ষ করল। পেছন থেকে মেয়েটিকে ডাক দিতেই তার শরীর কেঁপে উঠল। ওমা মন্ত্র কাজ করে গেল নাকি? এত জলদি? মেয়েটি পেছন ফিরতেই প্রেম বলল, ‘এই মেয়ে সিনিয়রের সামনে দিয়ে ক্যাট ওয়ার্ক করে গরুর মতো করে হেঁটে যাচ্ছো কেন? সালাম দিতে হয় জানো না? আর ময়লা আবর্জনা এখানে ফেলছো কেন? তুমি নিজেই তো একটা ডাস্টবিন, নিজের ওপরই ফেলো না।’
মেয়েটি ভয়ে জলদি সালাম দিলো। কাগজটা হাতে তুলে চলে যেতে নেবে তার আগেই প্রেম বলল,’ দেখি কাগজটা দাও।’
‘না থাক ভাইয়া আমি ফেলি দিচ্ছি।’
প্রেম ভ্রু কুঁচকে মেয়েটিকে ধমক দিয়ে বলল, ‘তুই কাগজ দিবি? নাকি ড্রেনের থেকে পানি তুলে এনে এখানে সবার সামনে এই কাগজ তোকে দিয়ে গিলাব?’ ধমকের চোটে জলদি কাগজটা দিতেই প্রেম তা খুলল। পরপর কয়েকবার চোখ বুলাতেই মাথায় চিড় ধরল তার। তার চেহারা দেখেই অংকুরের বুঝতে বাকি রইল না কি হবে। না জানি আজ কার কপালে শনির দশা ঘুরপাক খাচ্ছে। এই তৃষা মেয়েটাও না। প্রেম তবুও শান্ত গলায় মেয়েটিকে বলল, ‘তৃষা কই?’
‘সে তো আসেনি।’
‘সত্যি তো?’
‘হ….হু।’
‘এই চিরকুট তৃষা তোমায় কখন দিয়েছে?’ মেয়েটি অবাক হলো। সে কি করে জানল এই চিরকুট যে তৃষা দিয়েছে? মেয়েটি ভয়ে চুপসে যেতেই প্রেম অংকুরকে বলল,
‘এই অংকুর ড্রেনের পানি আন তো।’ আরো কিছু বলার আগেই মেয়েটি ভয়ে কেঁদে উঠল। বলল, ‘কিছুক্ষণ আগে।’
‘সে ভার্সিটি এসেছে?’
‘হুম।’
‘কই আছে এখন?’
‘ ওই পেছনের চিপায়। ভাইয়া আমি এখন আসি।’
‘না মা জননী। তুমি ডাকপিয়ন এখানেই দাঁড়িয়ে থাকো। তোমার আর আজকে বাসায় যাওয়া লাগবে না। ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে থাক শালী তুই। নড়লে বেটের লাঠি এনে তোমার যৌবনের সঙ্গে এক্কা দোক্কা খেলব আমি।’
মেয়েটি ভয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। প্রেম অংকুরের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আমার পিস্তল লোড না?’
প্রেমতৃষা পর্ব ১৯
অংকুর থতমত খেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘হ্যাঁ কি….ন্তু কেন? এই ভাই তৃষাকে খুন করবি না তো? মেয়েটার দোষ নেই।’
প্রেম উঠে দাঁড়ালো। রাগে গটগট করে বলল, ‘না খুন করব কেন? ওকে ওপরে যাওয়ার ভিসা করে দেব। তুমি ওর হয়ে সাফাই গাইতে এসো না চান্দু। এত ওকালতি আমার পোষায় না। নইলে দেখবে গুলি একটা তোমার ওকালতির পাছা দিয়ে ভরে দেব।’