সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৩৮+৩৯
Jannatul Firdaus Mithila
রৌদ্র এখনও কান ধরে উঠবস করে যাচ্ছে। এবার কেমন যেন খারাপ লাগছে অরিনের। সে তড়িঘড়ি করে রৌদ্রকে থামিয়ে দিয়ে বলে,
“ এই থামুন আপনি!”
রৌদ্র বাধ্য ছেলের মতো থামলো।কানে হাত রেখেই বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বললো,
“ সরি!”
অরিন হেসে ফেলে রৌদ্রের কথা বলার ভঙ্গি দেখে।মেয়েটার খিলখিল হাসির শব্দ কানে পৌঁছাতেই আপনা-আপনি দেহের সকল ক্লান্তি নিমিষেই উধাও হয়ে যায় রৌদ্রের। ছেলেটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। ঠোঁটের কোণে তার কিঞ্চিৎ হাসি। অরিনের হাসির মাঝেই রৌদ্র শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“ কতটুকু আপন করলে তুই সারাজীবন আমার থাকবি সানশাইন? তোর ঠিক কতটা কাছে থাকলে — তোর সম্পূর্ণ অস্তিত্ব জুড়ে মিশে থাকতে পারবো আমি!”
সহসা হাসি থেমে গেলো অরিনের।মেয়েটা হতবাক চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ হুট করে এমন প্রশ্ন কেনো ডাক্তার সাহেব?”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ জবাব না দিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
মাথার নিচে একহাত রেখে কাত হয়ে মোবাইলটার দিকে তাকালো।অরিন এখনো চেয়ে আছে তার দিকে।হয়তো সে অপেক্ষা করছে রৌদ্রের জবাবের। রৌদ্র কিছুক্ষণ গভীর চোখে তাকিয়ে রইলো অরিনের দিকে। দৃষ্টি তার নিষ্পলক। চোখের সাদা অংশগুলো কেমন যেন মৃদু লালচে হয়ে আছে। রৌদ্রের নির্বাকতা একপ্রকার চিন্তায় ফেলে দিলো মেয়েটাকে। অরিনের মনে ক্ষনে ক্ষনে ধেয়ে উঠছে রাজ্যের সব বাজে চিন্তা। কেনো হুট করে মানুষটা এই কথাগুলো বললো? নাহ, অরিন আর পারলো না চুপ করে বসে থাকতে। সে ফোনটা হাতে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে বলতে লাগে,
“ কি হয়েছে আপনার? কেনো এমন করছেন? আর..আর হুট করে কেনই বা ঐ কথাগুলো বললেন?”
রৌদ্র অরিনের এতো বিচলন দেখে মুচকি হাসে। বলে,
“ এতো ব্যস্ত হতে হবে না সানশাইন! আমার কিছুই হয়নি। আ’ম টোটালি ফিট এন্ড ফাইন। এমনিতেই কথাটা জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করলো তাই করলাম।”
অরিন তবুও সন্দিগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের দিকে।সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করে,
“ সত্যি তো?”
রৌদ্র স্মিত হেসে জবাব দেয়,
“ হুম,তিন সত্যি! আচ্ছা ওসব বাদ দে এখন।তুই শুয়ে পড়! রাত অনেক হয়েছে জানবাচ্চা।আর বেশিক্ষন জেগে থাকলে চোখের নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ে যাবে।এন্ড আমি এটা মোটেও চাই না আমার এতো কিউট একটা বাচ্চা বউয়ের চোখগুলোর নিচে ডার্ক সার্কেল পড়ুক! সো ঘুমিয়ে পড়ো সোনা! আর হ্যা… কাল কিন্তু নবীন বরণ।কি কি বলে এসেছিলাম মনে আছে তো?”
অরিন মাথা ঝাকায়।হ্যা, মনে আছে তার। রৌদ্র ফের বললো,
“ গুড! মনে থাকলেই ভালো। তো ঠিক আছে, এখনি শুয়ে পড় তাহলে!”
অরিন মাথা কাত করে সম্মতি জানিয়ে শুয়ে পড়ে বিছানায়। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলে,
“ গুড নাইট!”
“ গুড নাইট টু ইউ টু জান! এন্ড সুইট ড্রিমস!”
শেষ কথায় মুখ বাঁকালো অরিন।মিনমিনে স্বরে বললো,
“ আমার ঘুম কেড়ে এখন আবার সুইট ড্রিমস বলছে।হুহ্ ঢং!”
মিনমিন করে বললেও কথাটা স্পষ্ট কানে গেলো রৌদ্রের।ছেলেটা কেমন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অথচ সেদিকে কোনো খেয়াল নেই অরির।সে-তো নিজের মতো বিরবির করেই যাচ্ছে। রৌদ্র এ পর্যায়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে। দুষ্ট কন্ঠে বলে,
“ হাহ! ঘুমিয়ে পড়ো বউজান। এমনও তো হতে পারে — রাতে তোমার স্বপ্নের মাঝেই তোমার সঙ্গে রোম্যান্স করতে চলে এলাম। বাস্তবে না হোক এটলিস্ট স্বপ্নে অন্তত রোম্যান্সটা ফুলফিল করে করলাম নাহয়!”
এরূপ কথায় থমকে গেলো অরিন। চোখদুটো তার বিস্ময়ে বড় হয়ে গেছে বহু আগে। লোকটা কি বললো এগুলো? এমন লাগামহীন কথা কেও এতো সহজে বলতে পারে? হ্যা পারে বোধহয়। এই যেমনটা তার ডাক্তার সাহেব পারছে।অরিনকে এভাবে একধ্যানে তাকিয়ে থাকতে দেখে ফোনের সামনে চুটকি বাজায় রৌদ্র। অরিন হকচকিয়ে ওঠে খানিকটা।থতমত চেহারাটা কিছুটা নিচু করে নেয় সাথে সাথে।আহারে বেচারি বুঝি লজ্জা পেয়েছে বরের এমন কথায়। রৌদ্র এবার বাঁকা হাসলো। স্ক্রিনের আরেকটু সামনে মুখটা এনে হাস্কি স্বরে বললো,
“ যত লজ্জা পাবার এখনি পেয়ে নে সানশাইন! কেননা আমি যখন তোর লজ্জা ভাঙাবো তখন কিন্তু কেঁদেও কুল পাবিনা সোনা! সো বি রেডি!”
রৌদ্রের বলা প্রতিটি কথা বুঝি মৃদু ঝংকার তুলে দিলো অরিনের সর্বাঙ্গে। মেয়েটার কানদুটোও কেমন ঝা ঝা করছে লজ্জায়।গালদুটোয় ছেয়ে গেছে ঈষৎ লালাভ আভা। বুকের খাঁচায় বন্দী হৃদয়টা তান্ডব করছে যেন।ইশশ্ মেয়েটা পারছেনা এ মুহুর্তে রৌদ্রের সামনে থেকে ছুটে পালাতে। আর না পারছে কলটা কাটতে। অরিনের লজ্জা রাঙা নতমুখটা দেখে রৌদ্রেরও কেমন কেমন যেন লাগছে। ছেলেটার হার্টবিট ফার্স্ট হয়ে আসছে ক্রমাগত। সে তড়িঘড়ি করে নিজের চোখদুটো বন্ধ করে নেয়। কোনমতে বলে,
“ ঘুমিয়ে পড় সানশাইন! রাখছি।”
বলেই খট করে কলটা কেটে দেয় রৌদ্র। অরিনও বুঝি হাঁফছেড়ে বাচঁলো এতে। সে আর দেরি না করে শুয়ে পড়ে। চোখদুটো বন্ধ করতেই,তখনকার বলা রৌদ্রের কথাগুলো আবারও মনে পড়ে যায় তার। মেয়েটা চোখ বন্ধ রেখেই লাজুক হাসলো।তখনি কেমন টুং করে শব্দ হলো তার ফোনটায়। অরিন চোখ খুলে ফোনটার দিকে তাকায়। কি যেন একটা মেসেজ এসেছে! অরিন ফোনটা হাতে নিয়ে মেসেজটা চেক করতেই দেখতে পায় — রৌদ্র মেসেজ পাঠিয়েছে,
“ তখনও একবার জিজ্ঞেস করেছি তোকে! আবারও জিজ্ঞেস করছি— কতটুকু আপন করলে তুই সারাজীবন আমার থাকবি সানশাইন? তোর ঠিক কতটা কাছে থাকলে — তোর সম্পূর্ণ অস্তিত্ব জুড়ে মিশে থাকতে পারবো আমি?”
অরিন মেসেজটা পড়ে মুচকি হাসলো।তারপর দক্ষ হাতে ফোনে একটা মেসেজ টাইপ করে পাঠিয়ে দিলো রৌদ্রের ফোনে। তারপর অধীর আগ্রহে বসে রইলো রৌদ্রের জবাবের।
ওপাশে রৌদ্র বড্ড অস্থির! সারাদিন যেমন-তেমন, রাত হলেই মেয়েটার কথা বড্ড মনে পড়ে তার।তখন আবার নিজেকে সামলানোটা বেশ দায় হয়ে পড়ে তার জন্য! রৌদ্র যখন চোখ বন্ধ করে নিজের ভাবনায় নিমগ্ন তখনি তার ফোনে মেসেজের শব্দ আসে।রৌদ্র তৎক্ষনাৎ মেসেজটা অন করে। তারপর মেসেজটা পড়ে মুহুর্তেই তার চোখেমুখে ছেয়ে যায় রাজ্যের প্রশান্তির আভাস।অরিন জবাবে লিখেছে,
❝ Jitne Paas paas….
Khwabon Ke Nazar..
Utni paas Tu Rehna Humsafar…
Tu Jo paas ho,
phir kya yeh jahan..
Tere Pyar mein ho jaun Fanaa…❞
রৌদ্র পরপর কয়েকটা চুমু খেলো ফোনটার স্ক্রিনে। তারপর সেটিকে বুকের ওপর নিয়ে পাড়ি জমায় ঘুমের রাজ্যে..
“ এই মেয়ে! নবীন বরণে কেও এভাবে যায়? তুই তো রেগুলার গেটআপ নিয়েছিস দেখছি।যা… উপরে গিয়ে বস, আমি হাতের কাজটা শেষ করে এসে, তোকে একটা সুন্দর শাড়ি পড়িয়ে দিবো।যা..”
মায়ের কথায় চিন্তায় পড়ে গেলো অরিন। কিভাবে বোঝাবে তার মা’কে — সে যদি বোরখা ছাড়া অন্যকিছু পড়ে তাহলে তার কপালে নির্ঘাৎ শনি লাগবে! রৌদ্র সেদিন যেভাবে বারবার করে বলে গিয়েছে বোরখা পড়ে যেতে,সেখানে সে যদি ভুলক্রমেও শাড়ি পড়ে তাহলে তো….
অরিনের ভাবনার মাঝেই আবারও খেঁকিয়ে ওঠে রাফিয়া বেগম,
“ কিরে? এখনও দাঁড়িয়ে আছিস কেন? যা.. রুমে যা।আমি আসছি!”
অরিন এবার ফাঁকা ঢোক গিলে। মা’কে তার যেভাবেই হোক কিছু একটা বলে-কয়ে বোঝাতে হবেই হবে।অরিন আর কিছু না ভেবে চট করে পেছন থেকে মায়ের কোমর জড়িয়ে ধরে। রাফিয়া বেগম মেয়ের এমন হঠাৎ কান্ডে হকচকিয়ে ওঠেন। তার রান্নার কাজে ব্যস্ত হাতগুলো থেমে যায় সঙ্গে সঙ্গে। তিনি ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলেন,
“ কি হলো আবার? খারাপ লাগছে কোনো বিষয়ে?”
অরিন মায়ের পিঠে মাথা রেখেই খানিকটা ডানে-বামে ঘোরায়। বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে বলে ওঠে,
“ আম্মু! আমার না আজকে ভিষণ ইচ্ছে করছে বোরখা পড়ে যেতে… আমিতো সচরাচর বোরখা পড়িনা তেমন।তাই ভাবলাম আজকেই নাহয় পড়ি একটু..”
“ কিন্তু… ”
“ উহু! কোনো কিন্তু না।আমি এটাই পড়ি না… দেখো তো, আমায় কি খুব খারাপ লাগছে? ”
কথাটা বলেই অরিন মায়ের কোমর ছেড়ে সামনে এসে দাঁড়ায়।ঢুলে ঢুলে বিভিন্ন অঙ্গিভঙ্গিমা দেখিয়ে মা’কে বোরখাটা দেখায়।রাফিয়া বেগম মেয়ের বাচ্চামোতে মুচকি হাসলেন। মেয়েটার পরনে নীল রঙের বাটারফ্লাই বোরখাটা,তার সাথে সুন্দর করে সাদা-নীল মিশেলের শিফন হিজাব বাঁধা। অরিনের শুভ্র গোলগাল মুখটা হিজাব বাঁধায় বুঝি আরেকটু গোলগাল হয়ে গেছে। তার ওপর সোনায় সোহাগা হিসেবে মেয়েটার গালদুটোর গর্ত তো আছেই। রাফিয়া বেগম মেয়েকে দেখে মনে মনে কয়েকবার আলগোছে মাশাআল্লাহ পড়ে নিলেন। তারপর কয়েকটা দোয়া পড়ে মেয়েটার মাথায় ফু দিয়ে বললেন,
“ মাশাআল্লাহ! আমার জাদুকে সবকিছুতেই সুন্দর লাগে। তোর যেটা ভালো লাগে তুই সেটাই পড়, কেমন?”
মায়ের কথায় গালভর্তি হাসি দিলো অরিন।যাক অবশেষে চিন্তামুক্ত হলো সে।অরিন মায়ের কাছ থেকে ছুটে চলে আসে ড্রয়িং রুমে। ওদিকে রাফিয়া বেগম মেয়েকে পেছন থেকে সর্তক করছেন,
“ আস্তে যা পড়ে যাবি তো! উফ! মেয়েটাও না….এতোবড় হয়েও বাচ্চামি গেলোনা”
কথাটা বলেই তিনি আবারও নিজের কাজে মনোযোগী হলেন।এদিকে অরিন ছুটে আসে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে থাকা তার বাবা আর বড় আব্বুর কাছে। অরিন এসেই দু’জনের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে,
“ কেমন লাগছে আমায়?”
সাব্বির সাহেব আর কবির সাহেব মিলে অফিসের একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তখনি অরিনের ডাকে সেদিকে ফিরলেন দুজন। সাব্বির সাহেব তো মেয়ের দিকে তাকাতেই তার মুখ থেকে অস্ফুটে বেরিয়ে আসে — মাশাআল্লাহ! কবির সাহেব অরিনকে আপাদমস্তক দেখে গম্ভীর মুখে খানিকটা মিষ্টি হাসলেন।
অরিনের হাতের কব্জি আলতো করে চেপে তাকে নিজের পাশে বসালেন। তারপর মেয়েটার মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন,
“ মাশাআল্লাহ! আমার মামুনিটাকে তো খুব সুন্দর লাগছে। এখন থেকে কোথাও বের হলে এভাবেই বের হইয়ো কেমন?”
অরিন বড়আব্বুর কথায় মাথা কাত করে। তারপর বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,
“ বাবাই! কেমন লাগছে আমায় বললে না যে?”
সাব্বির সাহেব কেমন করে যেন হাসলেন। সেই হাসিতে আনন্দের চাইতে কষ্ট বোধহয় বেশি ছিলো। তিনি উঠে এসে মেয়ের পাশে বসলেন। তারপর মেয়েটার মাথা আলতো করে বুকে চেপে ধরেন।মোটা হয়ে আসা কন্ঠে বললেন,
“ ঠিক আমার মায়ের মতো সুন্দর লাগছে!”
বলেই তিনি চুপ করে গেলেন। হয়তো আরও কিছু বলতে চেয়েছিলেন তিনি কিন্তু গলা ধরে আসায় আর বাকিটা বেরুলো না কন্ঠ ফুঁড়ে। অরিন বুঝি খানিকটা টের পেলো বাবার মনের উচাটন। সে তড়িঘড়ি করে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কোমরে দু’হাত বেঁধে বাবার উদ্দেশ্যে আঙুল উঁচিয়ে শাসানি ছোড়ে,
“ বাবাই! তুমি এমন হুটহাট ইমোশনাল হয়ে যাও কেনো শুনি? তুমি জানোনা? তুমি ইমোশনাল হলে আমিও ইমোশনাল হয়ে যাই! তাহলে কেনো বারবার ইমোশনাল হও শুনি? কালকেই কতবড় একটা সর্বনাশ করলে নিজের।আবার আজও শুরু হয়ে গেলে? শোনো…”
বলেই সে এগিয়ে এসে দু’হাত দিয়ে বাবার ছলছল হয়ে আসা চোখদুটো আলতো করে মুছে দেয়। তারপর বাবার কপাল বরাবর ঠোঁট ছুঁইয়ে আবারও বলে ওঠে,
“ একদম লক্ষ্মী ছেলের মতো থাকবে কেমন? দুপুরের ঔষধটা মনে করে খেয়ে নিও। আর হ্যা… আর মন খারাপ করবে না।আমি কিন্তু তোমায় ছেড়ে কোত্থাও যাবোনা।সত্যি বলছি!”
সাব্বির সাহেব মেয়ের কথায় ভেজা চোখে হাসলেন। মাথা নাড়িয়ে বললেন,
“ ঠিক আছে আম্মা! আপনি যা বলবেন তাই।”
অরিন মুচকি হাসলো। তারপর সেখান থেকে আবারও ছুটে চলে গেলো নিজের রুমের দিকে। এদিকে মেয়ের যাওয়ার পথে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন সাব্বির সাহেব। পাশে বসা কবির সাহেব হয়তো বুঝলেন ভাইয়ের দীর্ঘ নিশ্বাসের কারণ।তিনি ভাইয়ের কাঁধ চাপড়ালেন। গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
“ শক্ত হ ভাই!”
“ ও ভাইয়া!! ভাইয়া গো…. ভাইয়াআআআ!”
অনিকের ঘরের দরজায় একের পর এক করাঘাত করে ডেকেই যাচ্ছে অরিন।অথচ অনিকটার বের হবার কোনো নাম-গন্ধও নেই। আর থাকবেই বা কিভাবে? ছেলেটা আবার অফডে গুলোতে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। আজকেও হয়তো তাই করছে।অরিন থামলো। তারপর আবারও জোরেসোরে করাঘাত চালায় দরজায়।এবার বুঝি টনক নড়লো অনিকের। ছেলেটা ঘুমঘুম চোখে একবার দরজার দিকে তাকায়। অরিনের কন্ঠ পেয়ে সাধের ঘুমটা ছেড়ে ধীরে ধীরে শোয়া ছেড়ে উঠে বসে। হাত দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে দরজাটা খুলে দেয়। অরিন একাধারে করাঘাত করতে করতে বেশ হাঁপিয়ে উঠেছে।তাই মেয়েটা দরজায় হেলান দিয়ে ভাইকে ডাকছিলো এতক্ষণ। আর তখনি হুট করে দরজা খুলে দেওয়ায় মেয়েটা অনিকের গায়ে হেলে পড়ে।অনিক ভড়কে যায়। হুট করেই চোখের ঘুমগুলো ঠুস করে উড়ে গেলো তার।বোনকে শক্ত হাতে বাহুডোরে আটকে ধরে ছেলেটা।বিচলিত হয়ে বলে,
“ বনু! তুই ঠিক আছিস তো? কোথাও লাগেনি তো?”
অরিন ভাইয়ের এহেন কথার জবাব না দিয়ে, ভাইয়ের কাছ থেকে উঠে দাঁড়ায়। চোখেমুখে বিরক্তি লেপ্টে ঝাঁঝ নিয়ে বলে,
“ এতক্ষণ লাগে দরজা খুলতে? বলি ক’দিনের জন্য ঘুমুচ্ছিলে ভাইয়া? তোমায় ডাকতে ডাকতে আমার হাতের অবস্থা একেবারেই খারাপ! ধূর… এখন কেমন ব্যাথা করছে! ”
ব্যাথার কথা শুনে আরেকদফা বিচলিত হলো অনিক।বোনের হাতদুটো চট করে চেপে ধরে সামনে এনে উল্টিয়ে – পাল্টিয়ে দেখতে দেখতে ব্যস্ত গলায় বলে,
“ কই লেগেছে বনু! ইশশ… তুই কেনো কষ্ট করে দরজায় নক করতে গেলি? তুই জাস্ট একটা কল দিতি বাচ্চা! আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়তাম।”
অরিন ভাইয়ের কথায় মুখ বাঁকালো। মুখে ঝামটি দিয়ে বলে ওঠলো,
“ ঘরের দরজায় বুলডোজার চালালেও তোমার ঘুম ভাঙবে কি-না সন্দেহ, সেখানে তোমায় একটা কল দিতাম — আর ওমনি তুমি উঠে পড়তে? সিরিয়াসলি ভাই?”
অরিনের কথায় মুখটা কাচুমাচু করতে লাগলো অনিকের। বনুতো কথাটা একেবারেই ভুল বলেনি।ছেলেটা মাথা চুলকে ফোকলা হাসলো।অপরাধী স্বরে বললো,
“ সরি! আজকের মতো ক্ষমা করে দে বাচ্চা! প্রমিস নেক্সট টাইম এমন করবো না!”
অরিন ফিক করে হেসে ওঠে। তাকে হাসতে দেখে অনিকও হাসে।হাসার একপর্যায়ে অনিক থেমে গেলো।চোখ দুটো বড়সড় করে বললো,
“ ওহ মাই! বনু… আমিতো এতক্ষণ একটুও খেয়াল করলাম না।তোকে তো মাশাআল্লাহ খুব কিউট লাগছে।”
“ জানি! সবাই বলেছে অলরেডি।” — অরিন মুখের সামনে হাত নেড়ে নেড়ে বললো কথাটা। তারপর অনিককে তাড়া দিয়ে বলে ওঠে,
“ ভাইয়া! আ’ম গেটিং লেট।তুমি তারাতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাশতা করো।আমাদের বেরোতে হবে তো।”
অনিকের এতক্ষণে মনে পড়লো আজকে বনুর নবীন বরণ। যাহ! ছেলেটা সব ভুলে এভাবে নাক টেনে ঘুমুচ্ছিলো? রোদ ভাই জানলে নির্ঘাত দুটো গাল ঝামটি দেবে তাকে।অনিক তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে কাবার্ড থেকে টাওয়েল বের করে কাঁধে নিলো।তারপর অরিনের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ গিমমি জাস্ট টেন মিনিটস বনু।”
“ আমি নিজেও তো রেডি হতে এতো সময় নেই না।সে যাকগে তারাতাড়ি এসো কিন্তু? ”
অনিক মাথা নাড়িয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে।অরিনও আর দাঁড়িয়ে না থেকে চলে যায় নিজের রুমে।রুমের দরজা লক করে সে এসে বসলো বিছানায়। তারপর ফোনটা বের করে কল লাগায় রৌদ্রের ফোনে। একবার -দুবার রিং হতেই কলটা কেটে দেয় রৌদ্র। অরিন থমকে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। কি হলো এটা? কলটা কেটে দিলো এরমভাবে! অরিন গাল ফুলিয়ে বসে।পরক্ষণেই মনে মনে ভাবে, — মানুষটা হয়তো ভিষণ ব্যস্ত!
অরিন আর কিছু না ভেবে ঝটপট নিজের তিন-চারটে ছবি তুলে পাঠিয়ে দেয় রৌদ্রের কাছে।তারপর হয়তো মিনিট খানেক পেরুলো।এরই মাঝে রৌদ্র কল দেয় তাকে।এবার আর অডিও কল নয়,একেবারে ভিডিও কল।অরিন মুচকি হেসে কলটা রিসিভ করে। মুখ খুলে যেই না কিছু বলতে যাবে তার আগেই কানে আসে রৌদ্রের ভরাট কন্ঠ!
“ বউজান! এই বউজান! তোকে আমি বোরখা পড়তে বলেছি কি এই কারণে? কেন পড়েছিস এটা তুই? এতো সুন্দর লাগছে কেন? এই মেয়ে! আমি কাছে নাই তারপরও এতো সুন্দর লাগতে হবে কেনো তোকে? আল্লাহ গোওওও…. আমি এখন কি করবো মাবুদ! এই… এই তারাতাড়ি এটা পাল্টা বউ। তোকে এই রুপে কেউ দেখে ফেললে আমি শেষ…. আল্লাহ.. আমার তো এসব ভাবতেই প্রেসার বেড়ে যাবে রে।”
অরিন হতবিহ্বল হয়ে যায় রৌদ্রের কথাবার্তায়। কি বলছে লোকটা? সে-ই তো তাকে বলেছিল বোরখা পড়তে। এখন আবার কি বলছে দেখো! অরিন ভ্রু কুঁচকে বলে বসে,
“ এখন পাল্টালে দেরি হয়ে যাবে ডাক্তার সাহেব! আর আমি কিন্তু সবচেয়ে নরমাল বোরখাটাই পড়েছি।তারপরও এতো সমস্যা হলে আমি কি করবো বলুন!”
রৌদ্র এবার সরু চোখে তাকায় অরিনের দিকে। মনে মনে কিছু একটা ভেবে বলে ওঠে,
“ পাল্টাবি না তাহলে?”
অরিন নিশ্চুপ! মাথা নুইয়ে রাখা তার।রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,
“ ঠিক আছে! এই লুকেই যা।”
তড়িৎ মাথা উঠায় অরিন।বলে,
“ সত্যি?”
“ হু।” — রৌদ্র ছোট্ট করে উত্তর দিলো।ছেলেটা আবার কি যেন একটা লিখছে বসে বসে।হয়তো ডিউটির মাঝখানেই সময় বের করে কল দিয়েছে অরিনকে।অরিন কি যেন একটা ভেবে দুষ্ট হাসলো। রৌদ্রকে ডেকে বললো,
“ ডাক্তার সাহেব! ও ডাক্তার সাহেব!”
“ হু!” — এবারেও ছোট উত্তর রৌদ্রের।অরিন নিজের ফোনটা স্ক্রিনের সামনে ধরে। কিছুক্ষণ আগের তোলা ছবিগুলো রৌদ্রকে দেখিয়ে বলে,
“ দেখুন না ডাক্তার সাহেব! ছবিগুলোতে আমায় কি সুন্দর লাগছে… এগুলো আমি ফেসবুকে পোস্ট করি?”
অরিনের কথাগুলো কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই থেমে গেলো রৌদ্রের হাত।দৃঢ় চোয়ালটা শক্ত হয়ে এলো খানিকটা। সে ভ্রু উঁচিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায় অরিনের দিকে। এহেন দৃষ্টিতে ভড়কে যায় অরিন।মেয়েটা ফাঁকা ঢোক গিললো।মুখ খুলবে তার আগেই কানে এলো রৌদ্রের অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে ছোড়া হুমকি..
“ আপনার যেমনটা ইচ্ছে, তেমনটাই করুন বউজান। কিন্তু এর আগে একটা কথা কান খুলে শুনে রাখুন! ”
থামলো রৌদ্র। গলাটা আরেকটু নিচু নামিয়ে, হাতের কলমটা সজোরে হাতের মাঝে চেপে ধরে দাঁত কিড়মিড় করে বলতে লাগলো,
“ আমি বাদে, আপনার দিকে অন্য যেই চোখগুলো উঠবে — সেসব চোখের মালিকদের কপালে ঠিক কি কি দূর্গতি লাগবে,এমনকি তাদের দেহের খাঁচায় পরানটা আদৌও থাকবে কি-না, তা নিয়ে আমি কোনো গ্যারান্টি দিতে পারবোনা। সো আশা করি ব্যাপারটা মাথায় রাখবেন।”
এহেন কথায় নাকেমুখে উঠে যায় অরিনের।কাশঁতে কাশঁতে যাচ্ছে তা-ই অবস্থা মেয়েটার।রৌদ্র বাঁকা হেসে বললো,
“ পানি খেয়ে নিন বউজান! আর ছবি না বলে ছাড়বেন? যান না… ছাড়ুন গিয়ে।”
অরিন তড়িঘড়ি করে মাথা ডানে-বামে ঘোরায়। বুকে হাত রেখে বলে,
“ এই না না! আমার ঘাট হয়েছে এসব বলে।জীবনে আক্কেল থাকলে আর কোনোদিন মুখেও আনবো না এ কথা।প্লিজ আপনি এমনটা করবেন না!”
রৌদ্র চোখে হাসলো।বসার চেয়ারে গা এলিয়ে বললো,
“ তুই ঠিক থাকলে আমিও ঠিক। সো কিছু করার কিংবা বলার আগে ভেবে চিন্তে বলবি ওকে?”
অরিন মাথা কাত করে। রৌদ্র আবারও বলে,
“ হুম।রাখছি তাহলে।গুড গার্লের মতো যাবি,খুব একটা হাসবিনা।কোনো ছেলে সেধে বসে কথা বলতে চাইলেও তুই বলবিনা। পারলে মুখে মাস্ক পড়ে থাকবি।আর হ্যা… অনিকের সাথে সাথে থাকবি।”
অরিন এবারেও বাধ্য মেয়ের মতো মাথা কাত করে। রৌদ্র মুচকি হেসে ইশারায় চুমু দিয়ে ফোনটা কেটে দেয়। অরিনও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে চলে যায় ভাইয়ের কাছে।
এদিকে রৌদ্র অরিনের কলটা কেটেই কল লাগায় আরেক জায়গায়। ওপাশের মানুষটা কল রিসিভ করতেই রৌদ্র গম্ভীর কন্ঠে হুকুম ছোড়ে,
“ শাহজাহান! আমার সানশাইনের দিকে দূর থেকে খেয়াল রাখবি।ওর আশেপাশে যেন একটা অপরিচিত মাছিও ভনভন করতে না পারে।মনে থাকবে?”
শাহজাহান আজ্ঞাকারীর ন্যায় সম্মতি জানায়।রৌদ্রও কলটা কেটে দেয়। তারপর সে টেবিলের ওপর পড়ে থাকা বেলে রিং বাজিয়ে জোর গলায় বলে,
“ নেক্সট!”
বিভিন্ন বর্নীল আয়োজনে ঢাবির ক্যাম্পাস সুসজ্জিত। অরিন অনিকের হাত ধরে ঘুরে ঘুরে দেখছে সবটা। ইতোমধ্যেই তার অনেকগুলো মেয়ে বান্ধবীও হয়েছে বটে।এসে থেকেই এর সাথে ওর সাথে কথা বলতে হচ্ছে তার।যেহেতু একই ডিপার্ট্মেন্টের ক্লাসমেট তাই কথা না বলে কি আর থাকা যায়? প্রায় অনেক্ক্ষণ হাটাহাটির পর অরিনের তেষ্টা পেলো।সে অনিকের হাত ঝাকিয়ে বললো,
“ ভাইয়া! গলা শুকিয়ে গেছে।”
অনিক তক্ষুনি ব্যস্ত হয়ে পড়লো বোনকে নিয়ে। বোনের হাত ধরে একটা দোকানের সামনে চলে আসে।কিন্তু দোকানভর্তি মানুষ হওয়ায় অরিনকে দোকানের কাছ থেকে খানিকটা দূরে দাড় করিয়ে বললো,
“ একটু ওয়েট কর সোনা।আমি এই যাবো আর আসবো।”
অরিন মাথা ঝাকিয়ে দাঁড়িয়ে রইলো ছায়ার আড়ালে।অনিক চলে গেলো দোকানে। অরিনকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা দু’জন ছেলে ফিসফিস করে কি যেন বললো একটা। তারা অরিনের দিকে আসতে নিলেই লম্বা -চওড়া বলিষ্ঠ দেহী একজন তাদের পথ আঁটকে দাঁড়ায়।যুবক দ্বয় ভড়কে যায়।তারা জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে রইলো আগন্তুকের দিকে।তখনি আগন্তুক গম্ভীর কন্ঠে বললো,
“ জানের মায়া থাকলে ঐদিকে যাবার দুঃসাহসও করবেন না।কেননা আমরা শুধু আলটিমেটাম দেই,কিন্তু ঐ ফুলের মালিক কোনরূপ আগাম আলটিমেটাম ছাড়াই অবস্থা কাহিল করে ছাড়ে।তাই সাবধান!”
যুবকদ্বয় কি বুঝলো কে জানে।তারা কিছুক্ষণ নিজেদের মাঝে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে কেটে পড়লো সেখান থেকে। আগন্তুকও তাদের দেখে বাঁকা হেসে কাকে যেন কল লাগালো।বললো,
“ এলার্ট থাকিস তোরা! মাছিরা কিন্তু অলরেডি ভনভন করা শুরু করে দিসে।”
★কিছুক্ষন একই জায়গায় দাড়িয়ে থাকায় ভিষণ বোর হলো অরিন। মেয়েটা নিজ থেকে একটু সামনে এসে দাঁড়ায়।তখনি তার চোখ পড়ে অদূরে দাঁড়িয়ে থাকা একটা আইসক্রিম ভ্যানের দিকে। এমনিতেই গলা শুকিয়ে কাঠ মেয়েটার তার ওপর চোখের সামনে আইসক্রিম। অরিন আর নিজের লোভ সামলাতে পারলোনা। সে ধীরে ধীরে হেঁটে গেলো ভ্যানের কাছে।ভ্যানটার চারপাশ ঘিরে স্টুডেন্টদের ভিড়।অরিন কোনমতে ঠেলেঠুলে দাড়ালো এক জায়গায়। তারপর ভ্যানের গায়ে আটকে রাখা ম্যানু দেখে নিজের পছন্দের ভ্যানিলা আর চকলেট মিক্স করে একটা আইসক্রিম অর্ডার দিলো। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আইসক্রিম ওয়ালা জানালো— দুঃখীত আপু! মাত্রই এই দুটো ফ্লেভার শেষ হয়ে গিয়েছে। আপনি চাইলে আমি অন্য একটা বানিয়ে দিতে পারি!”
সহসাই মনটা খারাপ হয়ে আসে অরিনের।সে মাথা নাড়িয়ে না জানিয়ে সেখান থেকে চলে আসে আগের জায়গায়। সেখানে আগে থেকেই অনিক হন্যে হয়ে খুঁজছে তাকে। অরিনকে আসতে দেখে অনিক বুঝি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো।দৌড়ে এসে বোনের কাছে এসে ব্যাকুল হয়ে বলতে লাগলো,
“ কোথায় গিয়েছিলি বনু? আমিতো ভিষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম বাচ্চা।একটাবার বলে তো যাবি! ”
ভাইয়ের ব্যাকুলতা দেখে অরিনের ছোট্ট মন খারাপগুলো কোথায় যে ছুটে পালালো, তার আর খোঁজ মিললো না। অনিক এবার তারাতাড়ি হাতের পলি ব্যাগ থেকে একটা কোন আইসক্রিম তুলে দেয় অরিনের হাতে।অরিন আইসক্রিমটা দেখে বেশ অবাক হলো।এটাতো তার ভিষণ পছন্দের। সে অবাক হয়ে ভাইকে জিজ্ঞেস করলো,
“ তুমি কি করে বুঝলে, এ মুহুর্তে একটা আইসক্রিমই চাচ্ছিলাম আমি!”
অনিক বোনের কথায় মৃদু হাসলো।আইসক্রিমটা খুলে দিয়ে বললো,
“ রক্তের একটা টান আছে না?”
অরিন হেসে দিলো। আইসক্রিমটা খেতে খেতে ভাইয়ের বাহু ধরে আবারও হাঁটা ধরলো।
নবীন বরণ অনুষ্ঠান শেষ হলো মাত্রই।বেশ জমকালো আয়োজনের মধ্য দিয়েই শেষ হলো অনুষ্ঠানটা।অরিন তো ভিষণ ইনজয় করেছে ভাইয়ের সাথে। মেয়েটা খুশিমনে ভাইয়ের সঙ্গে গাড়ির দিকেই হেঁটে যাচ্ছে। কিছুটা পথ এগোতেই শাহজাহান কোত্থেকে যেন দৌড়ে এসে তাদের পথ আঁটকালো।হাতে তার বড় বড় উচুঁ দুটো বক্স।অরিন তো ভয় পেয়ে যায় খানিকটা। সে সাথে সাথে ভাইয়ের পিছে আড়াল হয়ে দাঁড়ায়।যেহেতু অনিক শাহজাহানকে চেনে তাই সে তেমন ভ্রুক্ষেপ করলো না।শুধু ভরাট গলায় বললো,
“ কিছু বলবেন? ”
শাহজাহান মাথা নাড়িয়ে হাতের বক্স দুটো অনিকের হাতে দেয়।বলে,
“ বস দিতে বলেছে।”
অনিক ভ্রু কুঁচকে তাকায় বক্স দুটোর দিকে।হয়তো ভাবছে কি আছে বক্স দুটোয়! অনিক নিজ থেকেি জিজ্ঞেস করলো,
“ কি আছে এগুলোতে?”
“ আইসক্রিম!”
“ কিহ!” — ভড়কে যায় অনিক এবং অরিন দুজনেই। অনিক তো বলেই বসে,
“ আইসক্রিম মানে? হুট করে এতোগুলা আইসক্রিম কেনো? কার জন্য এসব?”
শাহজাহান ভিষণ আন্তরিকতার সহিত জবাব দিলো,
“ ভাবিমা’র জন্য! তার না-কি খেতে ইচ্ছে করছে তাই ভাই ফোন করে ইমিডিয়েট আনালেন সবগুলো। নিন, তারাতাড়ি। নাহলে তো গলে যাবে।”
অনিক এবার বাঁকা চোখে তাকায় অরিনের দিকে। ফিসফিসিয়ে বলে,
“ কাহিনি কি বনু?”
অরিন মাথা নিচু করে মিনমিনে স্বরে বলে ওঠে,
“ আমি নিজেও জানিনা ভাইয়া।”
তারপর সে তখনকার ঘটনা পুরোটাই বললো অনিকের কাছে। সবটা শুনে অনিক মুখ টিপে হাসলো।কিয়তক্ষন বাদেই হাসি মুখে বললো,
“ ওরে বনু! ভাগ্য ভালো ভাইয়া নেই এখানে।এখন তো শুধু দু’টো বক্সই পাঠিয়েছে,সে থাকলে মেবি পুরো ভ্যানটাই নিয়ে আসতো। যাইহোক, ধন্যবাদ আপনাকে ভাই।”
বলেই অনিক হাসিমুখে শাহজাহানের কাছ থেকে বক্স দুটো নিয়ে নেয়।এদিকে অরিন এখনো হতবিহ্বল। সে ভেবেই পাচ্ছে না, মানুষটা কিভাবে জানলো তার আইসক্রিম না পাওয়ার ব্যাপারটা! আচ্ছা সে কি তাকে স্টক করছে? অরিনের এতসব ভাবনার মাঝে টুং করে শব্দ তুলে তার ফোনে একটা মেসেজ আসে।অরিন কালবিলম্ব না করে মেসেজটা ওপেন করে। রৌদ্র পাঠিয়েছে মেসেজটা।
“ প্রিয় আদুরে সানশাইন!
তোর যখন যেটা লাগবে জাস্ট একবার মুখ ফুটে বলিস জানবাচ্চা।আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা তোর সামনে হাজির করে ছাড়বো। তাই বলে কিছু না পাওয়ার আফসোস যেন কখনোই তোর মুখের হাসি কেড়ে না নেয়, সেদিকে খেয়াল রাখবি কিন্তু! আর হ্যা, দিনে দুটোর বেশি আইসক্রিম খেয়ো না কেমন? নাহলে কিন্তু ঠান্ডা লেগে যাবে। ওহ! মোস্ট ইম্পর্ট্যান্ট কথাতো বলতেই ভুলে গেছি!
ভালোবাসি আমার বউজানকে!!!”
অরিন মুচকি হেসে ফোনটা পার্সে রেখে দিলো।
মানুষটার এমন পাগলামি গুলোর জন্য এখন কেমন নিজেকে ভাগ্যবতী ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে তার। অরিন ভাইয়ের হাত থেকে একটা আইসক্রিম নিয়ে খেতে শুরু করে দেদারসে।
রাত সাড়ে আটটা!
বহুদিন পর নতুন বইয়ের সুঘ্রাণ নিলো অরিন। নবীন বরণ শেষ, এবার থেকে তো ক্লাসও শুরু হবে তার।পড়াশোনা তো কিছুটা হলেও করতে হবে নাকি! তাইতো সন্ধ্যার পর থেকেই প্রায় ২ ঘন্টা একনাগাড়ে পড়ে মাত্রই টেবিল ছেড়ে উঠলো মেয়েটা। হুট করেই ডাক্তার সাহেবকে মনে পড়ছে তার। তাই অরিন ফোনটা হাতে নিয়ে সরাসরি কল না দিয়ে একটা মেসেজ পাঠায় রৌদ্রকে!
“ মিস ইউ!”
মেসেজটা পাঠানোর পর সে অধির আগ্রহে বসে রইলো রৌদ্রের সিন করা নিয়ে। প্রায় দু’মিনিট পর রৌদ্র সিন করলো তার মেসেজ। এরপর নিজে থেকেই কল দিলো সে।ভিডিও কল।অরিনও খুশিমনে রিসিভ করে নেয় কলটা।মেয়েটা কিছু বলবে তার আগেই রৌদ্র ফোনটা তার দিকে ঘুরিয়ে রেখে হাতের ইশারায় চুপ থাকতে বললো।অরিনও বুঝে নিলো হয়তো পেশেন্ট আছে তার সামনে। তাই অরিন তেমন কিছু না বলে শুধু অপলক দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো তার প্রিয় মানুষটাকে।
রৌদ্র হাত বাড়িয়ে তার ইয়ারপড গুলো কানে গুঁজে নেয়।যাতে মেয়েটার কথাগুলো শুনতে পারে ঠিকঠাক মতো। রৌদ্র এবার প্রশ্ন করলো পেশেন্টকে!
“ কি সমস্যা বলুন!”
মধ্যবয়স্ক লোকটা পান খাওয়া লালচে দাঁতগুলো বের করে হাসলেন একটুখানি। কষ্ট নিয়ে বললেন,
“ আর বইলেন না ডাক্তার সাব! বুকটায় বড় ব্যাদনা!”
“ আচ্ছা! তা বুকের কোন অংশে ব্যাথা?”
লোকটা বুকের বাঁ-পাশে হাত রেখে বললো,
“ এই জায়গাডাত! বহুত ব্যাদনা!”
রৌদ্র বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। লোকটার কাছে এসে ব্যাথা অংশটায় হালকা হাতে চাপ দিয়ে কিছু একটা পরিক্ষা করে আবারও চলে আসে নিজ জায়গায়। পেসক্রিপশনে পরিক্ষা লিখে লোকটাকে জিজ্ঞেস করে,
“ কোনো কিছু নিয়ে টেনশন করেন আপনি? ”
লোকটা এবার আর্তনাদ করে ওঠলো।বললো,
“ আর কইয়েন না ডাক্তার সাব! বহুত টেনশনেত থাহি আমি।”
“ কি টেনশন?”
“ পোলাপানের!”
রৌদ্র লেখার একফাঁকে ফের জিজ্ঞেস করলো,
“ ওহ! বাচ্চা -কাচ্চা হচ্ছে না তাই-নিয়ে টেনশনে থাকছেন?”
লোকটা তড়িৎ মাথা নাড়িয়ে না জানায়।রৌদ্রকে শুধরে দিয়ে বলে ওঠে,
“ আরে না, আমার পোলাপান আছে তো!এইতো বেশি না, আল্লাহর মাল ৮ জন।আরেকজন আইতাছে!”
লোকটার কথাটা শুনে হাতদুটো থেমে গেলো রৌদ্রের।ওপাশে অরিনও যে শুনলো সবটা! মেয়েটা হা হয়ে গেছে এহেন কথায়। রৌদ্র এবার লেখা ছেড়ে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলো।লোকটার দিকে সরু চোখে তাকিয়ে বললো,
“ আসলেই বেশি না। কম হয়ে গিয়েছে। আপনি আরও কয়েকটা নিতে পারতেন।”
লোকটা কেমন লাজুক হাসলো।তা দেখে রৌদ্র মৃদু কাশলো।লোকটা মিনমিনে স্বরে বললো,
“ ধূর ডাক্তার সাব! কি যে কন না… এগুলান ছাড়াও তো আমার বহুত কাম কাইজ আছে।”
রৌদ্র নড়েচড়ে বসে এবার।কলমটা হাতে নিয়ে বিরবিরিয়ে বললো,
“ কাজ কাম দেখে তো মনে হচ্ছে এটাই একমাত্র কাজ!”
“ য্যাহ? কিছু কইলেন আমারে?”
“ না না…ইয়ে বলছিলাম.. কি কাজ করেন আপনি? ”
লোকটা সগৌরবে হাসলো।বুক ফুলিয়ে বললো,
“ বাজারোত একটা ফার্মেসীর দোকান আছে আমার।আমি ঐডার মালিক!”
রৌদ্র এবার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে লোকটার ওপর! খানিকটা অবাক হয়েই বলে,
“ মেডিসিনের দোকান চালিয়েও এই হাল?”
“ এ্যাহ?”
“ না বলছিলাম.. আপনার কথা শুনে আমি ধরেই নিয়েছিলাম, এই গ্রামে আশেপাশে তেমন কোনো ডিসপেনসারি শপ নেই! যাইহোক, নিন পেসক্রিপশনটা।এখানে দুটো পরিক্ষা লিখে দিয়েছি।আপনি কাল এগুলো করিয়ে, রিপোর্ট এনে জমা দিবেন।ওকে?”
“ যে ঠিক আছে! আসি তাইলে। আসসালামু আলাইকুম!”
“ ওয়ালাইকুমুসসালাম!”
লোকটা চলে গেলো ধীরে ধীরে। সে যেতেই রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে হাসতে লাগলো।ওদিকে অরিনও হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে বিছানায়। রৌদ্র অরিনকে থামাতে বললো,
“ এতো হাসেন কেন বউজান?”
অরিন হাসি থামিয়ে কোনমতে বললো,
“ লোকটার ৯ টা বাচ্চা তাও না-কি বেশি না! মানে…ভাবা যায়!”
রৌদ্র এবার দুষ্ট হাসলো। দুষ্টুমি ভরা কন্ঠে বললো,
“ কেনো? ভাবা যাবে না কেন? সে তো তাও কমই বলেছে।আমিতো এরচেয়েও বেশি নিবো।গুনে গুনে ১১ টা বাচ্চা নিবো আমি! তুই রাজি থাকলে, পুরো একটা ক্রিকেট টিম বানাবো ইনশাআল্লাহ!”
কথাটা শোনামাত্রই নাকেমুখে উঠে যায় অরিনের।রৌদ্র বাঁকা হেসে চোখ মেরে বলে,
“পানি খা সানশাইন! তাছাড়া এখনি এই হাল হলে পরে কি হবে সানশাইন? তোকে শক্ত থাকতে হবে তো! নাহলে আমার ক্রিকেট টিম বানানোর স্বপ্ন যে স্বপ্নই থেকে যাবে!”
এবার অরিনের কাশিটাও থেমে গেলো।মেয়েটার গালদুটো লজ্জায় লাল টুকটুকে রং ধরেছে।সে চোখেমুখে কপট ভাব দেখিয়ে বলে,
“ কিসব বলছেন আপনি! আপনি জানেন না? ছেলে হোক,মেয়ে হোক দুটো সন্তানই যথেষ্ট!”
অরিনের কথায় রৌদ্র মাছি তাড়াবার নয়ায় হাত নেড়ে বললো,
“ হু কেয়ারস এবাউট দেট ফাকিং বুলশিট হানি! তোর আর আমার ভালোবাসা বেশি থাকলে দু’টোতে পোষাবে না আমার!”
“ ভালোবাসা বেশি থাকলেই হবে? ”
রৌদ্র এবার ঠোঁট কামড়ে হাসে। চোখেমুখে দুষ্ট ভাব টেনে বলে,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৩৬+৩৭
“ হু,হবে তো! ভালোবাসায় খানিকটা জোর থাকলেই হবে!”
রৌদ্রের কথার ভাবার্থ বুঝতে না পেরে অরিন অবুঝ গলায় প্রশ্ন করলো — মানে?
রৌদ্র খানিকটা নিচু কন্ঠে প্রতিত্তোরে বললো,
“ সেটা সামনা-সামনি এলে বোঝাবো হানি! তাও আবার রাতের আধারে প্র্যাক্টিক্যালি বোঝাবো!”