প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬২
ফিজা সিদ্দিকী
কাঁপা কাঁপা হাতে তুর্জয়ের গাল স্পর্শ করলো নন্দিতা। আর সাথে সাথেই ডুকরে কেঁদে উঠলো। হৃদয় জমিনে আজ তার সুখের ভেলা বইছে। এখন মৃত্যু এলেও আর আফসোস থাকবে না। মুখে একচিলতে হাসি নিয়ে তৃপ্তিতে বলতে পারবে,
“দেখো গো দুনিয়া, আমি আমার স্বামীর কোলে মাথা রেখে বিদায় নিচ্ছি। আর কোনো কষ্ট নেই আমার। নেই কোনো আক্ষেপ।”
কাঁদতে কাঁদতে হাপিয়ে উঠলো নন্দিতা। শ্বাস ফুলে মুখ হা হয়ে গেল তার। ভারী বাতাস থেকে অক্সিজেন পাচ্ছে না। কেউ যেন চেপে ধরেছে তার গলা। আটকে দিয়েছে শ্বাসনালী। তুর্জয় নন্দিতার কোমর জাপটে ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। দুই গালে হাত রেখে নরম কন্ঠে ডাকলো,
“এই! এই! এমন করছো কেন? তোমার কোথায় কষ্ট হচ্ছে? এই জান, তোর কী হয়েছে বল না আমাকে। এমন করিস কেন? আমার কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। দোহাই লাগে তোর, এমন করিস না। কথা বল। দেখ আমাকে। এইতো দেখ, আমি তোর কাছে। আয় না, মিশে যা আমার সাথে। তোর কষ্টগুলো আমাকে দিয়ে দে না জান। একটু কথা বল, তাকা আমার দিকে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তুর্জয়ের করুণ আর্তনাদের পরও নন্দিতা তাকালো না তার দিকে। তাকানো তো দূর, বন্ধ হওয়ার উপক্রম তার চোখ। ক্রমে ফুলে ফেঁপে উঠতে লাগলো বুক। তুর্জয় তৎক্ষণাৎ মেঝেতে শুইয়ে দিলো তাকে। এরপর নিজেও ঝুঁকে পড়লো তার দিকে। দুইহাতে মেঝেতে দাপিয়ে চলেছে নন্দিতা নিঃশ্বাস নিতে না পড়ার যন্ত্রণায়। উল্টে এসেছে চোখ। তুর্জয় আর অপেক্ষা করলো না। নন্দিতার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে নিঃশ্বাস সরবরাহ করতে লাগলো নিজের মুখে দিয়েই। খানিকটা নিঃশ্বাস নিতে পেরে শান্ত হলো নন্দিতা। তবে থামলো না তুর্জয়। মুখ উঠিয়ে একবার করে বাতাস গালে ভরে আবারও একইভাবে নিঃশ্বাস সরবরাহ করতে লাগলো নন্দিতার ফুসফুসে।
স্বাভাবিক হতেই তুর্জয়কে জড়িয়ে ধরলো নন্দিতা। আবারও কাঁদতে শুরু করলে জোরে ধমক দিয়ে ওঠে তুর্জয়। জোরালো কন্ঠে বলে,
“এক থাপ্পর দিয়ে কান্না ছুটিয়ে দেব তোর। কিসের কান্না এতো? মরে গেছি আমি? এতো কাঁদার হলে আমার লাশের সামনে বসে কাঁদবি।”
এই প্রথম তুর্জয় এতো উচ্চকন্ঠে কথা বলেছে নন্দিতার সাথে। ধমক খেয়ে আরও জোরে কান্না পেয়ে গেল নন্দিতার। কিন্তু কোনক্রমে দাঁতে দাঁত চেপে কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করলো সে। এটা দেখে তুর্জয়ের হাসি পেল ভীষণ। নন্দিতাকে বুকে টেনে নিয়ে নরম কন্ঠে বলল,
“তুমি যে একা না, দুটো দুটো মানুষের প্রাণ আটকে তোমার মাঝে। এমন পাগলামী করলে আমাদের দুজনের কী হবে?”
নন্দিতা কাঁদলো না আর। আদুরে ভঙ্গিতে তুর্জয়ের বুকে মুখ ডোবালো শুধু।
একখানা পুরোনো ধূলোজমা কাগজের টুকরো হাতে বসে আছে নওরিন। অজ্ঞাত মেয়েটা পাশেই শুয়ে আছে বিছানায়। অতিরিক্ত ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। গায়ে জড়ানো নওরিনের একটা হালকা রঙের শাড়ি, ঢিলেঢালা ব্লাউজ। মেয়েটার দিকে একপলক তাকিয়ে কাগজের ভাঁজ খুলে পড়তে শুরু করলেন তিনি,
“আমি কথা বলতে পারিনা। ছোটো থেকেই যে পারিনা এমনটা না। আমারও একটা সুন্দর পরিবার ছিলো। বাবা, মা, ছোটো ভাই আর আমি, অনেক সুখের একটা পরিবার ছিলো। কিন্তু এক অমাবস্যার রাতে কালবৈশাখীর ঝড়ের মতো কেউ আগুন লাগিয়ে দিলো আমাদের সুখে। দাউ দাউ করা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেল আমার গোটা পরিবার। সেদিন আমার বাড়ি ফিরতে একটু লেট না হলে সেই আগুনে আমিও শেষ হয়ে যেতাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ ছিলো বলেই হয়তো সেই আগুন আমাকে স্পর্শ করতে পারল না। এই গোটা দুনিয়ায় আমি হয়ে গেলাম একা। জানেন, অনেক চিৎকার করলাম সেদিন। চিৎকার করতে করতে গলা ছিঁড়ে রক্ত বেরিয়ে এলো। তবুও কেউ এলো না সাহায্য করতে। আসবেই বা কিভাবে? আশেপাশে বাড়ি বলতে ছিলো আমার দুই চাচার বাড়ি। যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক থাকলেও আদতে কেউ ছিল না তারা আমাদের। আগুন লাগানো মানুষ কি আর আগুন নেভানোর চিৎকার শুনতে পায়? শুনলেও কানে তুলো গুঁজে বসে মজা নেয়। সম্পত্তির লোভ মানুষকে অমানুষ বানিয়ে দেয়। আপনজন পর হয়ে যায়। লোভ লালসা প্রমাণ করে দেয় সব রক্তের সম্পর্ক আপনজন হয়না।
সেদিনের পর থেকে আমি আমার বাকশক্তি হারিয়েছি। আমার গলা দিয়ে কথা বের হয়না আর। কথা বলতে চাইলে গো গো শব্দ ছাড়া আর কিছু আসে না। আর কি বা হবে কথা বলে! আপনজন, সুখ দুঃখ ভাগ করে নেওয়া মানুষগুলোই তো আর রইলো না।
আমার জীবনের বোঝা আমি আপনাদের উপর চাপিয়ে দিতে চাই না। শুধু আমাকে কয়েকটা দিন এখানে থাকতে দেবেন? সময় হলে আমি নিজে থেকে চলে যাব। কয়েকটা দিন একটু ঠাঁই দেওয়া যাবে আমাকে?”
চিঠিটা ভাঁজ করে টেবিলের উপর রেখে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো নওরিন। এরপর বিছানায় পা উঠিয়ে শুয়ে পড়লো তার পাশে। ওষুধের ঘোরে সারাদিনই ঘুমায় সে। ঘুম ছাড়া আর কাজই বা কী? এ বন্দী জীবনে খাওয়া আর ঘুমই তার একমাত্র সম্বল। মাঝে মাঝে একরত্তি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে ভয়ে ভয়ে। বিছানায় আছড়ে পড়া রোদের মত লুকোচুরি খেলে মানুষের থেকে। মনে মনে দিন গোনে মুক্তির। কিন্তু সেই দিন আসা এতো সহজ না। একমাত্র বন্দী মানুষগুলোই জানে মুক্তির স্বাদ তাদের কাছে অমৃতের চেয়ে কম কিছু না।
খাবার দিতে এসে ধূসর বিছানার দিকে তাকালো। দুজনেই ঘুমাচ্ছে বেঘোরে। তাদেরকে ডাকতে মন চাইলো না আর তার। টেবিলের উপর খাবারটা চাপা দিয়ে রেখে দিলো। আচমকা ফেরার সময় তার চোখ পড়ল একটা ভাঁজ করে রাখা কাগজে। কৌতূহলে কাগজের ভাঁজ খুলতেই ঝরঝরে হাতের লেখা চিঠিটা পড়ে বুক ভার হয়ে এলো তার। চোখ ফিরিয়ে একপলক তাকালো বিছানায় শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে। জীবন কতই না বিচিত্র। যারে দেয় সবটুকু দেয়, আর যারে দেয়না কিচ্ছুটি দেয়না। ভাবনা থেকে বের হয়ে ধূসর সাথে সাথে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে।
গেস্ট হাউজে একসাথে দুজনকে লুকিয়ে রাখা বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। কখনও না কখনও কারোর নজরে এসে যেতে পারে। নওরিনকে আড়ালে রাখা ধূসরের একমাত্র কর্তব্য। তাই সার্ভেন্টকে দিয়ে তার রুমের পাশের রুমটা পরিষ্কার করতে বলে বেরিয়ে গেল সে।
লাইব্রেরী রুমের টেবিলে মুখোমুখি বসে আছে ধূসর আর সেই অজ্ঞাত মেয়েটা। নওরিনের কাছ থেকে জানা গেছে মেয়েটার নাম আলো। মেয়েটা বেশ ইতস্তত ভঙ্গিতে কাঁচুমাচু হয়ে বসে আছে সামনে। ধূসর বেশ সাবলীলভাবে একপলক তাকালো তার দিকে। সাদামাটা পোশাক, চেহারায় সরলতা, আচরণে জড়তা। সাথে সাথে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে কোনপ্রকার ভূমিকা ছাড়াই বলল,
“শিকদার পরিবারের সদস্য না আপনি। তাই এই বাড়ি সম্পর্কে বিশেষ কোনো তথ্য আপনাকে দিতে চাই না। তবে কিছু জিনিস সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন আপনার। আম্মাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আপনাকে এখানে রাখা যাবে না। জ্বলজ্যান্ত দুটো মানুষকে এতগুলো মানুষের চোখের আড়ালে রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমার জীবনের ফার্স্ট প্রায়োরিটি আমার আম্মা। থাকতে হলে আপনাকে শিকদার বাড়িতে সবার সাথে থাকতে হবে।”
আলো কিছু একটা বলতে চাইলো ইশারায়। কিন্তু ধূসরকে বোঝাতে সক্ষম না হয়ে পাশে থাকা নোটপ্যাডটা নিয়ে সেখানে লিখলো,
“কিন্তু আপনার মাকে এভাবে সবার থেকে লুকিয়ে রেখেছেন কেন?”
ধূসর ক্ষুব্ধ চোখে তাকালো আলোর দিকে। ভয় পেয়ে মাথা নামিয়ে নিলো আলো। সাথে সাথে রাশভারী কন্ঠে ধূসর বলে উঠলো,
“আপনাকে আগেই বলেছি আমার পরিবারের কোনো বিষয়ে কথা না বলতে। এখানে থাকতে হলে আমার শর্ত অনুযায়ী চলতে হবে। নইলে আসতে পারেন।”
ধূসরের কাঠকাঠ কন্ঠে ব্যথিত চোখে তাকালো আলো। আতসম্মানে আঘাত দেওয়া মানুষটার সাহায্য নিতে মন চাইছে না তার। কিন্তু আত্মসম্মানের চেয়ে সম্মান বড়ো। সম্মানহীন একটা নারী আর রাস্তার কুকুর দুটোই সমান। একা একটা মেয়ের জন্য এই দুনিয়াটা গিলতে আসা বিশাল এক অজগর সাপের মুখ। কখন কোথায় যে ওত পেতে বসে আছে কেউ জানে না। সামনে পেলেই হিংস্র ভঙ্গিতে খপ করে আক্রমণ করে বসবে।
আনমনা হয়ে বসে থাকা আলোকে দেখে খানিকটা নড়েচড়ে বসলো ধূসর। কিঞ্চিৎ ইতস্তত সুরে বলল,
“আপনাকে অভিনয় করতে হবে। বাড়ির সবার সামনে আপনি আমার প্রেমিকার পরিচয়ে থাকবেন। কিন্তু আমার কাছে আপনি কেউ না, কিছু না।”
“আমাকে সাহায্য করে আপনার লাভ কী?”
আলোর লেখা কাগজের পাতায় চোখ বুলিয়ে ধূসর সরাসরি তাকালো তার দিকে। গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠে বলল,
“পাপমোচন।”
গাড়ির মধ্যে বসে নখ কামড়াচ্ছে তনুজা। মনে মনে খানিকটা ভয়ও পাচ্ছে সে। তাকে এমন শুনশান জায়গায় রেখে নাঈম কী করবে সে জানে না। আর যদি তুর্জয়কে সাথে দেখে তবে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাওয়া থেকে আজ কেউ আটকাতে পারবে না। তার গভীর ভাবনায় ছেদ ঘটলো ফোনের রিংটোনে। সাথে সাথে রিসিভ করে কানে ধরতেই ভেসে আসলো নাঈমের রাশভারী কন্ঠস্বর,
“লোকেশন সেন্ড করুন।”
“যদি না করি?”
প্রেমের ধূলিঝড় পর্ব ৬১
নাঈম রেগে গেল আচমকাই। কোনপ্রকার উত্তর না দিয়ে কেটে দিলো ফোন। তনুজা সাথে সাথে তার লাইভ লোকেশন সেন্ড করলো নাঈমকে। এই মুহূর্তে নাঈম যে কতটুকু রেগে আছে স্পষ্ট টের পেয়েছে সে। তাই তাকে আর ঘটানো সুবিধার লাগলো না তার। সে যে নাঈমের প্রতি দূর্বল, তার মায়ায় পড়েছে। এ কথা অস্বীকার করা যায়না। তবে মায়া আর ভালোবাসা যে এক নয়। কারো সুখের তাগিদে তার সুখ খুঁজে দিতে নিজেকে উজাড় করে দেওয়ার নামই বোধহয় ভালোবাসা। ভালোবাসে যাকে তাকে পাওয়ার সাধ্য নেই আর যার মায়ায় জড়িয়েছে তাকে পাওয়ার সাধ নেই। মাঝে মাঝে তার মনে হয় ভালোবাসার সংজ্ঞা অনুযায়ী তাকে ভালোবাসা বলা যায় না। বলা যায় মন্দবাসা।