অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৬ (২)
ইসরাত জাহান ফারিয়া
“ভালোবাসা মাই ফুট! অন্ধের মতো ভালোবাসলে অন্তত একটা পেনিটেন্স থাকতো। বুঝতো আমাকে। তোকে আঘাত করার কথা ভুলেও চিন্তা করতো না। উল্টো এ পর্যন্ত যা যা অন্যায়-অবিচার করেছে তার জন্য ক্ষমা চাইতো। অমানুষটার যা অপরাধ তাতে মাফ চাইলে যদিও ব্যাপারটা তামাশার মতো দেখাবে। ওসব নিয়ে আর না বলি, ঘেন্না হয়…”
ইহসান কটাক্ষ করল। একটুও অনুতাপ নেই ওর মধ্যে।
বাবা নামক লোকটার জন্য যে খারাপ লাগা কাজ করছে না, তা স্পষ্ট। কী অদ্ভুত! যে বাবারা হয় সন্তানদের নির্ভরশীলতা, অনুপ্রেরণার ও গর্বের কারণ, ক্ষেত্রবিশেষে তারাই হয় লজ্জা ও দুর্ভাগ্যের কারণ। অন্ধকার ঘরে ওর অপ্রসন্ন মুখটার পানে সৃজা বিস্মিত ও শীতল চোখে চেয়ে রইল। এতদিনের রাগ-ক্ষোভ সেই শীতলতার কুয়াশা হয়ে মিলিয়ে যেতে লাগল একটু একটু করে। দোদুল্যমান অনুভূতি। ইহসান বড়ো বড়ো শ্বাস ফেলে চোখ বুজে। অস্থিরতা নিয়েই বলে, “একটু আমার পাশে বোস!”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জ্বরে গা তখনো দুর্বল ওর। শরীর নেতিয়ে পড়তে চাচ্ছে। মাথায় ভাবনারা সব এলোমেলো হয়ে জট পাকাতে চাইছে, খুব একটা সেদিকে মনোযোগ দিতে চাইছে না সৃজা। তার সব মনোযোগ এখন স্বামী নামক মানুষটাকে ঘিরে। যে তার বাবাকে জখম করে এসে অনুশোচনাহীন কণ্ঠে তাকে বিবরণ দিচ্ছে, এ লোকটাকে কী করে নিষ্ঠুরতা দেখাবে সে? সৃজা ওর পাশে বসে। নীরবে বসেই থাকে। না বলে কিছু, না
করে কোনো প্রশ্ন৷ অনেকেটা ক্ষণ নীরবতা শেষে ইহসানই বলে, “ আর.এস গার্মেন্টস ছোটোখাটো একটি প্রতিষ্ঠান। কষ্ট আর পরিশ্রমে দাঁড় করিয়েছে। দুই বছর আগে একটি আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড তাদের কাজের মান দেখে মুগ্ধ হয়েছিল। আর.এস গার্মেন্টস-এর সঙ্গে প্রোডাকশন চুক্তি হতে যাচ্ছিল। এমনটা হলে আজিজ শেখের চলমান চুক্তি বাতিল হতো। তার কোম্পানি ফিনানশিয়ালি লসে পড়ত, বাজারে তার নিয়ন্ত্রণ কমে যেত। এতবছর সিন্ডিকেট গড়ে একপাক্ষিক রাজত্ব করেছে, নতুন কাউকে উঠতে দেয়নি। আর.এস-এর সঙ্গে চুক্তি হলে অন্যরাও সাহস পেত নতুন চুক্তি নিতে, যা তার জন্য টাকার ক্ষতির চেয়েও ভয়ংকর। কী ষড়যন্ত্র যে করল বুড়োটা!
আর.এস-এর মালিক ও ব্র্যান্ডের ম্যানেজারের লাশ পাওয়া গেল বুড়িগঙ্গার কালো পানির নিচে। চুক্তি তো দূর, প্রতিষ্ঠানটাই বন্ধ হয়ে গেল। ব্যক্তিজীবন দূষিত ছিল, ব্যবসায়িক জীবনও ছাড়েনি। রাজ্য, রাজত্ব সবই একা চাই। আমি সাধারণ একটা জীবন চেয়েছিলাম, কখনো ওসবে জড়াতে চাইনি, রক্তে হাত ভেজাতে চাইনি, তাই তার বিরুদ্ধে থাকা লোকগুলোকে একটু উষ্কে দিতে হয়েছিল। তারা উঠেপড়ে লেগেছিল তার পেছনে। এটেম্পট টু মার্ডার আর ক্রিমিনাল কন্সপিরেসির মামলা হয়েছে। বিদেশি ব্র্যান্ডের ইমেইল ডকুমেন্টও হাতে এসেছে, অভিযোগ স্পষ্ট। নথি আর সাক্ষীদের স্বীকারোক্তি মিললে আজিজ শেখের পকেটে যত টাকা থাকুক না কেন, একবার আইন ঘুরে দাঁড়ালে তার পালাবার পথ নেই।
এবার ফেঁসে যাচ্ছিল অমানুষটা। ঘাঁটতে গিয়ে আরো কত কী জানলাম…”
কপাল জড়িয়ে তাকাল সৃজা। আজিজ শেখের কুকীর্তি শোনার ইচ্ছে নেই। ওর সব ভাবনা এখন ইহসানকে নিয়ে। গড়গড় করে বাপের অন্যায়ের ফিরিস্তি দিতে থাকা লোকটাকে নিয়ে। একটা পর্যায়ে ও কাঁপা হাতটা রাখল ইহসানের ঠোঁটে, থামানোর ভঙ্গিমা নিয়ে মন্থর কণ্ঠে বলল, “আর বলতে হবে না। আমি শুনতে চাইছি না।”
“শুনবি না কেন? আমি কোন কাপুরুষের রক্ত বইছি জানতে হবে না?”
সৃজা জোরালো গলায় বলল “না, জানতে হবে না। আমি শুধু আমার স্বামীকে জানতে চাই, আমার বাচ্চাদের বাবাকে জানতে চাই। এর বাইরে আর
কিছু নয়, কারো কথা নয়।”
“তোর খারাপ লাগা, ঘেন্না অনুভূতি কী আরো একটু বেড়েছে?”
“বাড়েনি।”
এক শব্দে প্রতুত্তর পেয়ে ইহসান ফের জিজ্ঞেস করে, “আমি তো পাপ করিনি, আমার এটা পাপ নয়। তাই না?”
দেশে আইন আছে। আর আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়া জঘন্যতম অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। এ প্রবাদের উপর আস্থা রাখাটা আজকের দিনে যে কত বড়ো ভুল, সেটা সৃজা বেশ দেরিতেই বুঝেছে। তাই তার জবাবটা হয় এমন, “একটা লোক, যে নিজেকে সর্বেসর্বা মনে করে, হাজারো অন্যায় করে যার মনে অনুশোচনা নেই বরং টাকার জোরে আইনকে পকেটে ভরে যা ইচ্ছে তাই করে বেড়ায়, তাকে আইনের ভয় দেখিয়ে শুধুই শব্দের খরচ করছি ব্যাপারটা ধরতে আমার অনেকটা দেরি হয়ে গেল। এখন বুঝতে পারছি, আইন যখন অন্ধ, ন্যায় পাওয়াটা যখন দুর্বোধ্য হয়ে দাঁড়ায় তখনই মানুষ বাধ্য হয় আইনের বিরুদ্ধে যেতে। আজকের এই কাজটা ছেলে হিসেবে হয়তো তোমার জন্য কঠিন, কিন্তু স্বামী আর বাবা হিসেবে তুমি তোমার সর্বোচ্চ কর্তব্য পালন করেছ।
যা করেছ তাতে খুব একটা পাপ দেখতে পাচ্ছি না। দেখতে পেলেও আমি অন্ধত্ব বরণ করে নিলাম।”
এটাই সে চায়, এখানেই তার মরণ। ঠিক ঠিক সৃজা ওকে বুঝেছে। এই ক’দিন যতোটা কষ্ট ওকে দিয়েছে, নিজে পেয়েছে এতোটা পেতো না যদি সৃজা একবার তাকে সবটা খুলে বলতো। ওকে অন্যমনস্ক দেখায়। সৃজা সেটা খেয়াল করে জ্বরের তাপে জ্বলতে থাকা চোখদুটো দিয়ে। মন্থর গলায় ওকে একবার জিজ্ঞেস করে, “ওদের সঙ্গে দেখা হয়েছে?”
ইহসান বলে, “রক্ত গায়ে ওদের সঙ্গে দেখা করতাম? এলিজ দেয়নি।”
“গোসল করে চেঞ্জ করে এসো। আমি ওদেরকে ওদের বাবার বুকে দিতে চাই। রক্তারক্তি করে আসা ইহসান শেখের বুকে না।”
শার্টের বোতাম খোলার উদ্যোগ নেয় সৃজা। ইহসান ওর কাজ, কথা নির্বিবাদে মেনে নেয়। নিজের বাবার হত্যা চেষ্টাকারী হলেও সন্তানদের জন্য সে মরতেও রাজি। অতএব, সে এতোটাও পাপী নয়। মস্তিষ্ক, মননের অসংলগ্ন চিন্তায় তার ঠোঁটের কোণে অবজ্ঞার হাসি লেপ্টে থাকে। শক্তপোক্ত, উন্মুক্ত পিঠে মেয়েলি হাতের ছোঁয়া তাকে বাস্তবতার বেড়াজালে ফিরিয়ে আনলে সে একবার জিজ্ঞেস করে, “আমি ঠিকঠাক বোঝাতে পেরেছি? না-কি ফাঁকফোকর থেকে গেছে?”
“ঠিকঠাক বোঝাতে পেরেছেন। ফাঁকফোকর নেই। থাকলেও বোধহয় সেটা আর ম্যাটার করে না।”
কুচি আলো ছড়িয়ে পড়া পুরুষালি মুখটাতে স্বস্তির চিহ্ন ফুটে উঠল। বাতাসে ছুঁয়ে গেল তার কপালের ভেজা চুল। রক্তিম মুখ আর পঙ্কিলতাশূন্য চোখের ভাষায় দৃষ্টি মেলাতেই সৃজার কানে কেউ বলে গেল, ‘তোমার জন্য সব করতে পারে ইহসান শেখ।’
ও.টির বাইরে বসে আছে ইমরান শেখ। বাবা নামক লোকটাকে নিয়ে হাসপাতালে। ডাক্তাররা বলেছে, আঘাতটা আজিজ শেখের ঘাড়ের প্লাটিসমা অতিক্রম করে গেছে। কোপটা যদি জায়গামতো পড়তো বাঁচার কোনো উপায় থাকতো না। তবে শেষ মুহূর্তে সরে গিয়ে নিজেকে প্রাণে বাঁচাতে পেরেছিলেন আজিজ শেখ। এখন তার অপারেশন চলছে। বাড়ির কেউ বলতে ইমরান শেখ একাই আছে। যদিও আজিজ শেখের অ্যাসিস্ট্যান্ট আছে, তাতে কী? যেখানে সে বাদে পরিবারের একটা মানুষও এমনকি সালেহা বেগমও নেই, কী মূল্য এই জীবনের? ছেলের হাতে প্রাণ খোয়াতে গিয়েও অবশ্য লোকটার শিক্ষা হয়নি,
জ্ঞান হারানোর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত ক্রোধে ফুঁসছিলেন। কীসের এই জেদ, ক্রোধ ইমরান ভেবে পায় না। এই বয়সে এসে জীবনটাকে এত জটিল করার কোনো মানে হয়?
এমনিতে নিজের জীবন নিয়ে সে আছে বিপর্যস্ত অবস্থায়। দু’দিন আগে মিতু রাগ দেখিয়ে বাড়ি চলে গেছে। এরপর ফোন করে তাকে জানিয়েছে, অনেক সহ্য করেছে। সে আর এই সংসার করবে না। যে স্বামী বাচ্চার বাবা হবার জন্য তাকে চাপ দেয়, কুৎসিত গালি দেয়, তার সঙ্গে সংসার অসম্ভব! ইমরান অবশ্য জানে, মিতু তাকে ভয় দেখাতে চাইছে। যেন সে আবার মিতুর সব কথা মেনে চলে, তার আঁচল ধরে ঘুরঘুর করে, বাচ্চা বাচ্চা না করে। অথচ তার একটা বাচ্চা চাই। বাবা ডাক শোনা চাই। তাই মিতুর এসব নাটক যাতে আর সহ্য করতে হয়, সেজন্য ঠিক করেছে মিতুর জালেই মিতুকে ফাঁসাবে। এই অহংকারী মেয়ের গোমড় সে ভেঙে দেবে। তাছাড়াও এত বড়ো বিপদে আছে জেনেও যে মহিলা তাকে ফোন করে গালাগালি করে, তাকে আর জীবনে দরকার নেই। তাকে সত্য সত্যই ডিভোর্স দেবে সে। তারমধ্যে বাড়ির এই এতো অশান্তি, এক ভাই বাপকে কু পি য়ে বেরিয়ে গেছে, আরেকজন বাপের প্রতি ঘৃণায় জর্জরিত। এ পর্যন্ত পঞ্চাশের উপর ফোন দিয়েছে সে ইজহানকে, কিন্তু সে আসেনি। আর সবকিছুর মূলে যে, তার তো কোনো খোঁজই নেই। নেহাৎই বাবা হয় ইমরানের, কিঞ্চিৎ ভালোওবাসে সে বোধহয় লোকটাকে। তাই এই
বিপদে সে পাশে আছে। ইমরান কল করে ইজহানকে, রিসিভও হয় সেটা। গুরুগম্ভীর কণ্ঠ ভেসে আসে, “আপডেট কী? মরে গেছে তোর বাপ?”
“তোমারও তো বাপ, একা আমার দোষ কেন?”
“তুই মাদার তেরেসার মেইল ভার্সন সাজতে গেছিস যখন তোরই বাপ ওটা। লোকটার বউও তো যায়নি তোর মতো দয়াবান হতে…”
“চোখের সামনে ছটফট করছিল, কী করতাম…”
ইমরান হতাশ হয়ে ভাইকে অনুরোধ করে, “তুমি একবার আসবে না?”
“না, আসব না। আমার কাউকে দেখতে ইচ্ছে করছে না।”
ফোনটা কেটে দেয় ইজহান। সত্যিই ওই লোকটাকে দেখতে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে কাজ করছে না তার মধ্যে। আর দেখতে যাবেও না সে। সে যাবে তার বাচ্চাদের কাছে, যারা শ্যাওড়াপাড়ায় অনেকগুলো দিন ধরে পড়ে আছে, ঐ লোকটার জন্য যারা আজ বাড়িছাড়া!
শাওয়ারের পানির সঙ্গে বয়ে যাওয়া লাল তরলগুলো নিজের জন্মদাতার, উৎকণ্ঠিত হওয়ার কথা, অথচ তারজন্য কোনো চিন্তা হচ্ছে না ইহসানের। বরং শান্তি লাগছে। ঘষে ঘষে নিজের গা থেকে রক্তের দাগ মুছে সময় নিয়ে গোসল সেরে উন্মুক্ত শরীরে বেরিয়ে এসে দেখল, ঘরে খালু, সৃজা নেই। গামছা দিয়ে চুল মুছতে মুছতেই হঠাৎ দেখল দরজার পর্দা সরানোর চেষ্টা করছে দুটো হাত, এরপর মেঝেতে হামাগুড়ি দিয়ে তার কাছে ছুটে আসতে চাইছে তার মেয়েটা। পাপার মুখটা নজরে পড়তেই খলবলিয়ে হাসতে লাগল ছোট্ট দেহটা। আনন্দে চোখদুটো চিকচিক করছে আজওয়ার। হাতের গামছাটা ছুঁড়ে ফেলে ছুটে গিয়ে মেয়েকে দু’হাতে তুলে ঘুরিয়ে এনে নিজের বুকে চেপে ধরে ব্যাকুলচিত্তে বলল ইহসান, “আম্মাজান, আমার আম্মাজান! কেমন আছেন আপনি?”
পাপার বুকে মিইয়ে গিয়ে গো গো শব্দে জবাব দিলো আজওয়া শেহেরীন, সে ভালো নেই৷ পাপাকে ছাড়া একটুও ভালো নেই। শ’খানিক চুমু খেয়ে অভিযোগ মিশ্রিত কণ্ঠে বলে ইহসান, “পাপাকে ছাড়া কীভাবে ছিলেন এতদিন? মিস করেননি একটুও? আমি তো মরে যাচ্ছিলাম মা…”
মিস করেছে, কেঁদেছেও। কিন্তু মাম্মা দেয়নি। কোনোভাবেই পাপার কাছে যেতে দেয়নি আজওয়াকে। ঠোঁট ভেঙে কেঁদে কেঁদে এ জবাবটাই দিতে চাই সে। মেয়ের অপ্রকাশিত কথাটুকু বুঝেই যেন ইহসানের চোখ ভিজে এলো। এমনভাবে ধরে রাখল মেয়েকে, যেন ছেড়ে দিলেই আবার হারিয়ে যাবে।
“আপনাদের ছাড়া কত কষ্টে ছিলাম জানেন আপনারা? আর কখনো এমন কষ্ট দেবেন না। কখনো দূরে যাওয়ার কথাও চিন্তা করবেন না।”
মেয়ের সঙ্গে কথার ঝুড়ি নিয়ে বসল যেন সে। আজওয়ার চোখেও উৎফুল্লতা। অযত্নে বেড়ে উঠা পাপার দাঁড়ি ধরে টানছে সে, চুল ধরতে চাইছে। ইহসানও সহাস্যে মেয়ের আবদার পূরণ করছে। একফাঁকে মেয়েকে রেখে চট করে গায়ে পোশাকও চাপিয়ে নিলো সে। এরপর ঘর থেকে বেরিয়ে বসার ঘরে এলো। ছেলেকে পেল ওখানেই। এলিজের কোলে চেপে আঙুল মুখে পুরে বসে আছে। ইহসানকে দেখে সে অদ্ভুত প্রতিক্রিয়া দেখাল। মুখ ফিরিয়ে নিলো অন্যদিকে। হতভম্ব হলো ইহসান। এটা কী হলো? সে ঘাবড়েও গেল কেন জানি। এলিজ সেটা লক্ষ্য করে ম্লান কণ্ঠে বলল, “পাপাকে বোধহয় ভুলে গেছে।”
ইহসানকে বিভ্রান্ত দেখাল, “এক, দু-সপ্তাহ না দেখলে কেউ ভুলে যায়? তাও আবার আমাকে?”
“তোমার ছেলে তো ভুলে গেছে।”
ইহসান মেয়েকে নিয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইল। কী করবে বুঝে উঠতে না পেরে ডাকলো, “হেই, আযরান শেখ! আমি তোমার পাপা, ডাকছি। শুনছ? তাকাও…”
ছেলে তাকাল না। উল্টো ভয়ে কেঁদে ফেলল তার গুরুগম্ভীর কণ্ঠ শুনে। ইহসান অবাক। নীলু ফুপি এসে সান্ত্বনাসরুপ বললেন, “কয়েকদিন না দেখলে এমনই হয়, চেহারা ছবি ভুলে যায়। বাচ্চা তো। একটু পরই ঠিক হয়ে যাবে। সময় দাও।”
সৃজা রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বাপ-ছেলের কান্ড দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বাবার চেহারা ভুলে গেছে, কণ্ঠ ভুলে গেছে। দায়টা কী সম্পূর্ণই ওর? ও এলিজের থেকে ছেলেকে কোলে নিয়ে পিঠ ঘষে দিতে দিতে কান্না থামানোর চেষ্টা করল, “এটা আযুর পাপা, আযু কেন চিনতে পারছে না? বোন তো ঠিকই পারছে।”
মায়ের কথা শুনে ছেলে কান্না থামাল। আর তাকালও পাপার দিকে। ইহসান হাসলো, ছেলের গাল ছুঁয়ে আদর দিলো। কিন্তু আযরান গেল না ওর কোলে। মায়ের কোল থেকেও নেমে গেল, মেঝেতে বসে হামাগুড়ি মেঝেতে ঘোরাফেরা করতে লাগল। খেলনা বাদ দিয়ে পাপোশ, ঝাড়ু নিয়ে খেলতে লাগল। কেউ থামাতে গেলেই চিৎকার তুলে কান্না। তাই সাহস করে তাকে আর কেউ ঘাঁটাতে চাইল না। আজওয়াকে ভাইয়ের কান্ডে বিরক্ত দেখাল৷ পাপার কোলে ঘাপ্টি মেরে রইল সে। বুকের ভেতর অশান্ত ঝড় বয়ে চলা ইহসান মেয়ের সঙ্গে সঙ্গে আযরানকেও দেখতে থাকল। মূলত ছেলের কান্ডকীর্তি তাকে অবাক করছে। শেখ বাড়িতে এসব করার সুযোগ পায় না সে, মেঝেতে নামানোই হয় না ওদেরকে। আর ইজহান তো পছন্দই করে না ওসব। সে কোলে কোলে, নয়তো বিছানায়ই দেখতে পছন্দ করে ওদেরকে। তাই ওর ছটফটে স্বভাবটা এতদিনে খোলাসা হয়নি। একপর্যায়ে কিছু সময়ের জন্য সবার মনোযোগ ওর উপর থেকে সরতেই দেখা গেল, আযরান সদর দরজার সামনে থাকা তার পাপার জুতার তলা থেকে বালু নিয়ে গায়ে মাখছে, আর পাপোশ উল্টিয়ে গায়ের উপর রেখে দিয়েছে৷ ঝাড়ু থেকে টেনেটুনে ফুল ছিঁড়ে আঁ আঁ শব্দে নিজমনেই কথা বলছে। সৃজার যখন ছেলের উপর নজর পড়ল, হতবিহ্বল হয়ে গেল ও। ইহসান ভ্রুকুটি করে সৃজাকে বলল,
“এটা আমার ছেলে?”
সৃজা রেগে গেল, “না, কুড়িয়ে এনে পেটে ঢুকিয়েছি।”
“তাইতো বলি, মেয়ে আমার গলা শুনেই হুড়মুড় করে যেভাবে ছুটে এসেছে, সেখানে ছেলে আমায় চেনে না কেন!”
রাগে গজগজ করতে করতে উঠে যেতে চাইল সৃজা। ইহসান ওর হাত ধরে আটকে দিলো। আজওয়াকে বুঝিয়ে ওর কোলে দিয়ে বলল, “তোর শরীর ঠিক
নেই, বসে থাক। আমি দেখছি টনাকে।”
উঠে গিয়ে মেঝে থেকে ছোঁ মেরে ছেলেকে নিয়ে ওয়াশরুমে সাফ করানোর কাজে লেগে পড়ল ইহসান।
সৃজা দু-চোখ ভরে দৃশ্যগুলো দেখতে লাগল। মনে হলো, কতদিন পর একটু স্বাভাবিক দেখাচ্ছে সবকিছু! কতদিন পর এভাবে কথাবার্তা বলছে তারা। যেন গহীন অন্ধকারে এক টুকরো আলোর কুচি এসে জীবনটাকে আবার রাঙিয়ে দিতে চাইছে!
এলিজা নিষ্পলক দেখছিল ওদের। দেখছিল তার আপুর ঠোঁটের কোণের হাসিটা, তার চোখ ছাপিয়ে আসা জলটুকু ওড়নার কোণে মুছে নেওয়ার চেষ্টাটা! তার আপুর চাহিদা কম। জীবনে চমকপ্রদ কিছু বলতে ইহসান আর তার বাচ্চাদুটোকেই সে পেয়েছে, এছাড়া আরকিছুই না। অথচ সুখের উৎসটাতে কালিমা লেপন করে দিয়েছে বিবেক বর্জিত পুরুষগুলো। এলিজ অবশ্য মৃত্যু কামনা করে না এদের। মৃত্যু মানুষের জীবনে এক চরম সত্য। তার স্বাদ একটা সময় নশ্বর পৃথিবীর সবাইকেই গ্রহণ করতে হবে। আজিজ শেখকেও, আরসালান শেখকেও। তবে মৃত্যুর আগে যেন তারা দুনিয়াতে নরকের শাস্তির কিছুটাও অনুভব করে যায়, তাহলে যন্ত্রণা না কমলেও কিছু মানুষের সঙ্গে সঙ্গে তার অশান্ত আত্মাটাকেও প্রবোধ দেয়া যেত। ওর চিন্তায় ভাটা পড়ল কলিংবেলের শব্দে। এই অসময়ে কে এল, ভাবতে ভাবতে ডোর-হোলে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতেই চেনা পরিচিত মানুষটাকে দেখে দরজা খুলে দিলো এলিজ। সী গ্রীন রঙের প্রিন্সেস জামা পরিহিত শান্তশিষ্ট, গোলাপি ঠোঁটের, গোলগাল চেহারার পরীর মতো দেখতে মেয়ে কোলে নিয়ে ইজহান অপ্রস্তুত হেসে জিজ্ঞেস করল ওকে, “অনিতা মিসের বেশি বোঝা মেয়েটা কি আজ আমাকে ঢুকতে দেবে?”
এলিজ একটুখানি হেসে ঢোকার জায়গা করে দিয়ে বলল, “অবশ্যই।”
অশ্রুবন্দি পর্ব ৮৬
ইজহান ঢুকল, ঢুকে বসার ঘর অবধি আসতেই চোখ পড়ল সৃজার উপর। শুকিয়ে চেহারার বেহাল দশা হওয়া মেয়েটাকে দেখে সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কিছু বলতে নেবে, তখনই দেখল ওয়াশরুম থেকে ন্যাংটো ছেলেকে কোলে নিয়ে বেরুচ্ছে ইহসান। ইজহান তার টনার অবস্থা দেখে তড়িঘড়ি করে মেয়ের চোখ ঢেকে ফেলে বিড়বিড় করে বলল, “আমার পরীর মতো মেয়ে এই ন্যাংটোকে বিয়ে করবে? খোদা!”