আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১
অরাত্রিকা রহমান
চৌধুরী মেনসনে বলা চলে একপ্রকার ধ্বংসযজ্ঞ চলছে। কিছু সময় পর পর বিভিন্ন জিনিস ভাঙ্গার ও ফেলে দেওয়ার আওয়াজ আসছে। আওয়াজ গুলো চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে “রিভান চৌধুরী রায়ান”-এর রুম থেকে আসছে। রায়ান আজ তার বাবা মার প্রতি ভীষণ রেগে আছে, রেগে থাকার যথেষ্ট কারণও আছে__
তাকে না জানিয়েই আজ তার বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাও ৭ বছরের একটা মেয়ের সাথে যাকে সে চেনেও না।
ফ্ল্যাশব্যাক~
হঠাৎ করেই রামিলা চৌধুরী (রায়ানের মা) রায়ানের রুমে এসে একটি কোর্ট পেপার রায়ানের দিকে এগিয়ে দিয়ে
বলেন –
“রায়ান এই পেপারে সাইন করে দেও।”
রায়ান একটু আশ্চর্য হয়ে তার মার দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রায়হান চৌধুরী (রায়ানের বাবা) রুমে প্রবেশ করে গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন –
“রায়ান ভদ্রতা বজায় রেখে মা যা বলছে তা করো।”
রায়ান এবার আরো আশ্চর্য হলো। তবে সে তার বাবা-মা কে অনেক শ্রদ্ধা করে তাই কিছু না বলেই সে চুপচাপ পেপারে সাইন করে দেয়।
সাইন করা হয়ে গেলে পেপার টা নিয়ে নিলো রায়হান চৌধুরী। বাবা-মায়ের এমন আচরণে রায়ান হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“এটা কিসের পেপার ছিলো বাবা?”
উত্তরে রায়হান চৌধুরী বললেন-
“তোমার ম্যারেজ পেপার , বলতে পারো কাবিননামা।”
বাবার এহেন কথায় রায়ানের চোখ বড় করে প্রশ্ন সূচক ভঙ্গিতে চেঁচিয়ে উঠলো –
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“কি?”
বলেই সে ছিনিয়ে নিল পেপার টা বাবার হাত থেকে। এবং পেপার টা পড়া শুরু করে…. যেখানে লিখা ছিলো-
” রিভান চৌধুরী রায়ান ও মেহেরিন রহমান মিরায়া- এর বিয়ে সম্পন্ন হওয়ার কথা। এবং ছেলে ও মেয়ে উভয় অপ্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার কারণে তাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে তাদের প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর হবে, সেই চুক্তি। তবে তারা দুজন এখন স্বামী-স্ত্রী ।”
এমন কিছু দেখে রায়ান নিজেকে ঠিক রাখতে না পেরে চেঁচিয়ে তার মাকে প্রশ্ন করলো –
“এসবের মানে কি আম্মু আর এই মেয়ে কে? এমনভাবে বিয়ে দেওয়ার মানে কি? আমার কেবল ১৭ বছর।”
রায়ানকে তার মার সাথে চেঁচিয়ে কথা বলতে দেখে রায়হান চৌধুরী রায়ান কে কঠিন গলায় বললেন-
“রায়ান আমার সামনে তুমি আমার স্ত্রীর সাথে এভাবে কথা বলতে পারো না। মার প্রতি সম্মান রাখো। Behave yourself. আর আমরা যা করছি তোমার ভালোর জন্য।
মেয়েটা ভালো পরিবারের মেয়ে। তোমার খালামনির ভাসুর এর মেয়ে। তার মা-বাবা কেউ নেই মারা গেছেন একটা রোড এক্সিডেন্টে। বাবা-মা ছাড়া মেয়ে টা এখন তোমার খালামনি ও খালুর সাথে থাকবে তার ছোট বোনটাকে নিয়ে।”
প্রতি উত্তরে রায়ান রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলে-
“অনাথ বলে কি যাকে তাকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দেবে? আমার মতামত নেওয়ার প্রয়োজন মনে করলে না? এই বিয়ে আমি মানি না , এই মেয়েকে আমি কখনো বউ হিসেবে মানবো না।”
কথাটা বলেই রায়ান পেপার টা ছিঁড়ে ফেলতে যায়, ঠিক সেই সময় রায়হান চৌধুরী রায়ানের হাত থেকে পেপারটা নিয়ে নিলেন এবং কড়া গলায় বললেন –
“মেয়েটাকে একটা পরিবার দিতে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর ছোট মেয়েটাকে তোমার খালামনি লালন পালন করবেন । তোমাকে মানতে হবে। মিরায়া এখন তোমার বউ। বিয়েটা কোনো ছেলে খেলা নয়, মানি না বললেই সব অস্বীকার করা যায় না।”
রায়ান- “মাজা আমি করছি না তোমরা! আমাকে না জানিয়ে আমাকে দিয়ে বিয়ের পেপারস সাইন করিয়ে নেওয়াটা কি ?”
রায়হান-“যা খুশি ভাবতে পারো তবে মিরায়া তোমার বউ এটাই সত্যি আর তোমাকে মানতে হবে ।”
রায়ান: “ওই মেয়ের বয়স কত? নাচতে নাচতে বিয়ে করে নিলো আমাকে না চিনেই। তাও আবার বাবা-মা মারা যাওয়ার পর পর লজ্জা করে না তার?”
রায়হান: “না সে জানে না যে তার বিয়ে হয়ে গেছে। তার কেবল সাত বছর বাবা-মা এর মৃত্যুতে কান্না করা ছাড়া সে কিছু বুঝতে পারছে না এখন। আর না বিয়ে সম্পর্কে কোনো ধারণা আছে। এই কারণেই তোমাদের আনুষ্ঠানিক বিয়ে তোমারা প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর দেওয়া হবে।”
রায়ান অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো । সে মনে মনে ভাবছিল বিয়ে হলো তো হলো তাও ৭ বছরের একটা বাচ্চার সাথে।
ঐ মুহুর্তে রায়ান বাবা-মার সাথে তর্ক না করে চুপচাপ নিজের রুমে রাগ ঝাড়তে থাকে জড় বস্তুর উপর। কারণ, এখন তাদের সাথে তর্ক করে লাভ নাই, তারা বুঝবে না।
মধ্যরাতে রায়ান রাগ ঝেড়ে ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়ল নিজ বিছানায়। নিজের মনে মনেই হঠাৎ বলে উঠলো-
“না, না, না আমার জীবন আমি এভাবে নষ্ট করবো না। আমি আজই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। হ্যাঁ, এটাই ঠিক হবে।”
যেই ভাবনা সেই কাজ রায়ান তখনি তার ব্যাগ পত্র গুছিয়ে বের হয়ে গেল এয়ারপোর্ট এর উদ্দেশ্যে। মনস্থির করলো সে চলে যাবে আমেরিকায় তার আংকেলের কাছে। আর সেই রাতের ফ্লাইটেই তার আংকেলের সাথে কথা বলে আমেরিকায় চলে যায়। তার আংকেল সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেন। রায়ান তাকে কাউকে জানাতে না করার জন্য তিনি কাউকে সে সম্পর্কে আর কিছু বলেন নি। তার বাংলাদেশের এই ঘটনার সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না।
পরদিন সকালে রামিলা চৌধুরী সারা বাড়িতে রায়ানকে খুঁজে না পেয়ে রায়হান চৌধুরীকে জানায়। দুজনই চিন্তিত ছিল এমন সময় রায়হান চৌধুরীর ফোন বেজে উঠে নাম ভাসছিল তার আমেরিকায় থাকা চাচাতো ভাইয়ের। তিনি ফোন রিসিভ করলে অপর পাশ থেকে ভেসে আসে রায়ানের কন্ঠস্বর-
“আমি রায়ান বলছি। আমি আমেরিকায় চলে আসছি। আমার জন্য কোনো চিন্তা করোনা তোমারা। আমি এখানেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবো। আর হ্যাঁ, আমি ওই মেয়েকে বউ হিসেবে মানবো না। আর না দেশে ফিরব কোনো দিন।”
রায়হান চৌধুরী রেগে রি রি করতে করতে বললেন –
“আমেরিকায় চলে গেছ মানে! আমেরিকা কি বাংলাদেশের মধ্যে কোনো জায়গা? যদি কোনো বিপদ হতো? এতো সাহস কি ভাবে হলো তোমার না বলে দেশ ছাড়ার?”
রায়ান- “তোমরাও তো আমাকে না জানিয়ে আমার বিয়ে দিয়ে দিয়েছ। আমার নিজের ভালোর জন্য এর থেকে ভালো উপায় আমার মাথায় আসে নি ঐ মুহুর্তে।”
ফোন স্পিকারে থাকায় রামিলা চৌধুরী কান্না ভরা গলায় বলে উঠলেন –
“বাবা আমার, জেদ করে না। মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি ফিরে এসো দেশে।
মায়ের এমন চেঁচামেচি শুনে রায়ানের ছোট ভাই রুদ্র এসে ফোনের কাছে এসে জোরে বলে-
“ভাইয়া তুমি ফিরে আসো আমি তোমায় অনেক মিস করছি।”
ভাই ও মায়ের কথা শুনে রায়ানের ও খারাপ লাগছিল তবে তার রাগ এখনো কমেনি তাই সে শক্ত গলায় বলল-
” রুদ্র আমার অবর্তমানে আম্মু-আব্বুর খেয়াল রাখিস। আর, আমি ফিরছি না, যতদিন না ওই অনাথ মেয়ের সাথে আমার বিয়ে ভাঙছে। আম্মুকে কান্না করতে না কর। নিজের আব্বুর আর আম্মুর যত্ন নিস।”
এই বলে রায়ান ফোন কেটে দেয়। এই সম্পূর্ণ কথপোকথনে রায়হান চৌধুরী পুরোপুরি নীরব দর্শক এর ভূমিকা পালন করেন। তার অনেক হতাশা অনুভব হচ্ছিলো তার বড় ছেলের প্রতি । তিনি ফোন টা হাত থেকে পকেটে রাখতে রাখতে বলেন-
“এসব বিষয়ে আমি আর কোনো কথা শুনতে চাই না । আর তোমাদের মধ্যে কেউ আমাকে ওর ব্যপারে কিছু বলতে এসো না।”
এই বলে তিনি ওই জায়গা ত্যাগ করেন। সাথে সাথে রামিলা চৌধুরী রুদ্রের বুকে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি ছেলের জন্য যেমন চিন্তা করছিল ঠিক তেমনি ভাবছিল মিরায়ার কথা । মেয়েটা জানালো ও না তার বিয়ে হয়ে গেছে আর বিয়ের দিনেই তার স্বামী তাকে অস্বীকার করে দেশ ছেড়ে চলে গেছে। কি কপাল, যে দিনে বাবা-মা কে হারালো সেই দিনেই বিয়ে হলো আর সে দিনেই স্বামী ছাড়া হয়ে গেলো।
এই দিকে রহমান বাড়িতে রোকেয়া রহমান (রায়ানের খালা, যিনি মিরায়ার চাচি ) ভাসুর ও জা এর মৃত্যুতে শোকাহত । সকালে কিছু সময় আগেই সকল আত্মীয়রা বাড়ি থেকে বের হয়ে নিজের বাড়ির দিকে রওনা দিয়েছে।
এমন সময় রোকেয়া বেগম মিরায়া আর সোরায়া যে রুমে ঘুমাচ্ছিল সেই রুমে যায় তাদের দেখতে। দুজনকে ঘুমাতে দেখে তিনি বিছানায় মিরায়ার পাশে বসেন
তিনি মিরায়ার কান্না করে মলিন হয়ে যাওয়ার চেহারার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন।আর রাতের কথা মনে করতে থাকেন-
“রাতে রামিলা চৌধুরী মিরায়াকে পুত্র বধূ করার প্রস্তাব রাখলে অনাথ মেয়েটার ভবিষ্যতের কথা ভেবে তারা রাজি হয়ে যায় এবং মিরায়ার অজান্তেই তার আঙ্গুলের ছাপ নিয়ে নেয় পেপারে। ৭বছরের মিরায়া বুঝতেও পারলো না তার বিয়ে হয়ে গেছে।”
রোকেয়া বেগমের চিন্তার অবসান ঘটিয়ে তার ফোন টা বেজে উঠে নাম ভেসে উঠে “আপা” (রামিলা চৌধুরীর)। তিনি কল রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে রামিলা চৌধুরী বলে উঠে-
“ক্ষমা করে দিস আমাকে বোন আমি আমার কথা রাখতে পারি নি, মিরায়াকে আগলে রাখার। রায়ান রাতেই রাগ করে চলে গেছে আমেরিকায়।”
এক টানে কথা গুলো বলে রামিলা চৌধুরী হুহু করে কেঁদে উঠেন।
রোকেয়া বেগম কথা গুলো শুনে চুপচাপ ফোন টা রেখে দেয়। অশ্রু চোখে একবার মিরায়ার দিকে দেখে এক ফোঁটা পানি ফেলল তবে আর কিছু বলল না। তিনি অপরাধ বোধে ভুগছিলেন। তাই ঘুমের রাজ্যে থাকা মিরায়ার হাত দুটো নিজের হাতের মাঝে নিয়ে তিনি কাঁদতে কাঁদতে বললেন –
“মাফ করে দে মা তোর ভালো চাইতে গিয়ে তোর অনেক বড় ক্ষতি করে ফেললাম যে।”
কথা গুলো বলে তিনি আবার কেঁদে উঠলেন।
আর এইদিকে ঘুমন্ত নির্বোধ মিরায়া জানতেও পারলো না, যে তার জীবন বাঁধা পরে গেছে এক অজানা বাঁধনে, যা ছিল তার আত্মার অচেনা এক অঙ্গীকার ,আর চিরন্তন সত্য ।
আর অতীত হয়ে পরে রইলো সেই ম্যারেজ পেপারস, আর অস্বীকারকৃত দায়িত্ব- যোগসূত্র হয়ে রয়ে গেলো …..
এভাবে কেটে গেল দীর্ঘ ১০ টি বছর অজানা তেই।
রায়ান আমেরিকাতেই নিজের পড়াশোনা শেষ করে আর্কিটেকচারের উপর আর মিরায়া বড়ো হলো চাচা-চাচির কাছে বাংলাদেশেই।
১০ বছর পর….