প্রেমতৃষা পর্ব ২৭ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন
আমি আপনারে এমন কইরা হারাইছি, যেমন কইরা শুকনা পাতায় হাওয়ার ঝাপটা আইসা এক নিমিষে উড়াইয়া নেয় দিগন্তের অজানায়। যেমন কইরা রাতের আঁধারে বাতি নিইভা গেলে ঘর অন্ধকারে ডুইবা যায়। আপনি এমন কইরা এই অন্তরে আগুন ধরাইছেন যেমন কইরা খরার তাপে মাঠের ফসল শুকাইয়া যায়, মাটিতে ধুলা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। যেমন কইরা ঝড়ের রাতে বৈঠা ছাড়া নৌকা স্রোতে তলাইয়া যায়। যেমন কইরা মরুভূমির বালু ঝড়ে চোখ-মুখ ঢাইকা দেয়, নিঃশ্বাস পর্যন্ত আটকাইয়া যায়। আপনি আমারে এমন কইরা ফাঁকা কইরা দিলেন, যেমন কইরা মাঘ মাসে খেতের ধান ঠান্ডায় শুকাইয়া সাদা খড় হয়ে যায়। এমন কইরা শূন্য কইরা দিলেন, যেমন কইরা গোরস্থানের মাটিতে নাম লেখা থাকার পরেও সবাই একা রইয়া যায়।
এমন কইরা শেষ করলেন, যেমন কইরা শীতের ভোরে হঠাৎ কুয়াশা নাইমা আইসা পথঘাট ঢাইকা ফেলে, মানুষ পথের দিশা হারায়। এমন কইরা আমারে আপনে ভাঙলেন, যেমন কইরা বর্ষার নদী হঠাৎ বাঁধ ভাঙা স্রোতে জমির সব ফসল ভাসাইয়া নিয়ে যায়। এমন কইরা পোড়াইলেন যেমন কইরা বিদ্যুৎতের শর্টসার্কিটে দোকান ঘর পুড়লে মানুষ বুক চাপড়ায়া শুধু তাকাইয়া নিজের ধ্বংস দেখে। শেষে সব হারানোর পর মানুষ যেমন চুপ কইরা দাঁড়ায়, বুকের ভেতর কান্না ভাতের বলকের মতো উতরাইয়া পড়লেও মুখ থ্যাইকা শব্দ বাইর হয় না। আমি ঠিক তেমন চুপ কইরা গেলাম। আমার ভিতরে ভিতরে আগুন জ্বলে, কিন্তু সেই আগুন নিভানোর পানি আপনি নষ্ট কইরা দিলেন। তবুও হারানোর বেদনা নিয়াও কইবার চাই আমি আপনারে ভালোবাসি। আপনারে না পাইয়াও ভালোবাসি, হারাইয়াও ভালোবাসি, ধ্বংস হইয়াও ভালোবাসি। আপনি পুড়াইলে আমি পুইড়াও আপনারে ভালোবাসি।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই টুকু লিখেই হাতের কলমটা থামিয়ে দিলো তৃষা। আজকে তিনদিন হলো প্রেম তার দিকে ফিরেও তাকায়নি। যেই প্রেম নিজে গিয়ে তৃষাকে ক্লাস রুম থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করত তার জন্য এখন তৃষা ছুটির পরও একইভাবে অপেক্ষা করে। সময় ফুরায় তবে অপেক্ষা যে আর ফুরায় না। তৃষা এখনো বুঝতে পারছে না তার অপরাধ কি? প্রেম ভাই মুখে ভালোবাসি না বললেও তো ভালোবাসত। এই যুগের মেয়ে তৃষা। দুধ-ভাত খায় না। সবই জানা আছে। ক দিয়ে যে মানুষ কলকাতা ঝোঝায় অন্তত তা জানতে বাকি নেই। ওই লোকটা তাকে ভালোবাসে। মুখে ভালোবাসি বললেই ভালোবাসা হয় না। ওইটা মানুষের কর্মে ফুটে ওঠে। তাহলে কি হলো হঠাৎ করে? সব তো ঠিকই ছিলো। মনে হলো একটা কলি ফুটার আগেই কেউ ইচ্ছে করে ছিঁড়ে ফেলেছে। এই তিনটে দিন প্রেম ভাইয়ের থেকে দূরে থেকে মনে হয়েছে দুনিয়াটা ফাঁকা। চারপাশে কিছু একটা নেই। তৃষার একবার শ্বাস কষ্ট উঠেছিল।
সেইবার শ্বাস নিতে একপ্রকার কষ্টই হয়ে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিলো এই তো মারা যাবে। গত তিন দিন তৃষার ঠিক ওই অনুভূতিটাই হয়েছে। এখনো মনে হচ্ছে মৃত্যুর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সে। দরজাটা একটু একটু করে খুলছে। তৃষা সারা রাত জেগে কেঁদে কেটে শেষে চোখের নীচটায় কালো করে ঠিক করল অনেক হয়েছে। আজকে সারা রাত ভিখারির মতো প্রেম ভাইয়ের দুয়ারে বসে থাকবে। প্রেম ভাইয়ের তো উচিত অংকুর ভাইয়ের ঠ্যাং তো বিশেষ পানি খাওয়া। এই যে শিমলার সঙ্গে ক’দিন হলো তার প্রেম হয়েছে এখনই তাঁদের প্রেম একেবারে জমে ক্ষীর। শিমলার মনে হয় বাসা থেকে ছেলে দেখছে। বিয়ের জন্য চাপ দিচ্ছে। বেশি তিরিং বিরিং করলে যে কোনো মুহূর্তে বাড়ি ছেড়ে পালাবে দু’জন। আর প্রেম ভাইকে দেখো প্রেম করা তো দূরে থাক এখন যেমন ভাব দেখাচ্ছে মানুষ তো তার কিং কোবরা এক্সের সঙ্গেও এমন আচরণ করে না।
তৃষা রুম থেকে বের হয়ে সিঁড়ির কাছ দিয়ে নামতেই সিদ্দিক নেওয়াজ আর মোখলেসকে দেখতে পেলো। চিন্তিত মনে হচ্ছে সিদ্দিক নেওয়াজকে। তৃষা একবার জিজ্ঞেস করবে ঠিক করেও করল না। শেষে বাইরে এসে সরাসরি প্রেম নেওয়াজের বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বাড়ির চারপাশে গাছগাছালি। ডান পাশে একটা ফুলের বাগান। সেথায় হরেক রকমই ফুল আছে। তবে যেই ফুলটা বাগানের মূল আর্কষণ তা হচ্ছে প্রিমরোজ। এই প্রিমরোজ নামটা শুনলেই একটা মানুষের কথা মনে পড়ে যায়। সেই প্রিমরোজ ব্র্যান্ডের আঁধার। আঁধার বলেই হয়তো তাকে কেউ দেখেনি। তবে তার গলার স্বরটা একজন মানুষের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে। মাঝে মাঝে অবাক লাগে। দু’জন মানুষ কি কোনো ভাবে আবার এক জনই নয় তো?
সেদিন লুকিয়ে-চুরিয়ে প্রেম ভাইয়ের মেইন ডোরের পাসওয়ার্ডটা দেখেছিলো তৃষা। ওইটা কতবার টিপাটিপি করে এপ্লাই করল তৃষা তবে কাজে দিলো না। গোলামের পুতে পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করেছে। ইশ ঢং দেখলে বাঁচি না। ঘরে ঢাললে বাইরে পরে শালার। পাসওয়ার্ড লক লাগাতে হবে। তালা হলে না হয় ভেঙে ঘরে ঢুকে ওই হারে বজ্জাতের চকলেট আর স্ট্রোবেরি গুলো সব চুরি করত। তখন দেখা যেত কি খায় সে! তৃষা কোনো উপায় না পেয়ে ঠিক করল আজকে সারা রাত দরজার সামনেই অপেক্ষা করবে সে। একসময় না এক সময় তো আসবেই ওই লোক। এবার তার ব্রান্ডের জিনিসে বিলাই চিমটি ঘষে দিবে কিংবা ভেতরে কিছু একটা ছেড়ে দিবে। এখন তৃষা তো প্রেম নেওয়াজের প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পারল না না হয় ওই পোকামাকড়ই দেখুক। ওদের ও তো পোকাধিকার আছে।
রাত তখন অনেক। তৃষা দরজার সামনে অপেক্ষা করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল। সকালে যখন ঘুমটা ভাঙল তখন নিজেকে আবিষ্কার করল নরম বিছানায়। এই বিছানাটা একটু বেশিই শফট। তৃষা হাই তুলে চুল চুলকাতে চুলকাতে হঠাৎ আবিষ্কার করল কাউচের মধ্যে উপুড় হয়ে খালি গায়ে শুয়ে আছে প্রেম ভাই। ওমা সকাল সকাল এমন অতি লোভনীয় দৃশ্য না দেখলেই কি হতো না? এই যৌবন বয়সে যৌবন সামলাতেও তো তৃষার কষ্ট হয় খুব। তবে হঠাৎ তৃষার মনে পড়ে গেল গত তিন দিনের কথা। তার বুকটা কেমন ভার হয়ে এলো। হঠাৎ দেখল প্রেমের পিঠে কিসের যেন দাগ। তা দেখে তৃষার বুকটা আরো ভারি হয়ে উঠল। সে প্রেমের কাছে গিয়ে পিঠে হাত ছোঁয়াতে যাবে তার আগেই হঠাৎ চারপাশে একবার তাকালো। এত এত মদের বোতল চারপাশে। সিগারেটের ছাই, সিগারেটের বাট পড়ে আছে। তৃষা সাহস করে একবার প্রেমের পিঠে হাত রেখে প্রেমকে মৃদু গলায় ডাক দিলো,’ এই প্রেম ভাই! শুনছেন। সকাল হয়েছে। উঠবেন না?’
পরপর কয়েকবার ডাকার পর যখন কাজ হলো না তখন কাছে এসে শ্বাস চলছে কিনা চেক করতেই হঠাৎ প্রেম থাবা দিয়ে তার হাতটা ধরতেই তৃষা ব্যথায় বলে উঠল, ‘প্রেম ভাই কি করছেন? হাতটা ছাড়ুন বলছি। একটু আসতে ধরলে কি হয়?’
প্রেমের চোখ দু’টো কেমন লাল হয়ে আছে। শরীর যে তার ঠিক নেই খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তৃষা। কেমন যেন ভয় ভয় করছে। মনে হচ্ছে একটা অচেনা মানুষ তার সামনে উপস্থিত। এটা সেই মানুষ না যাকে সে চিনে। প্রেম উঠে বসল। তারপর তৃষাকে ঝারি মেরে বলল,’ এখনো যাসনি কেন?’
‘আগে বলুন আপনার কি হয়েছে? আমার সঙ্গে এমন করছেন কেন? আমার অপরাধ কি?’
‘তোর অপরাধ কি সেটা তুই তোর বিবেককে জিজ্ঞেস কর। যাহ বের হ আমার ঘর থেকে। আউট! ‘
‘প…প্রেম ভাই। আপনি তো আমায় ভালোবাসেন। এত নিষ্ঠুর কেন হচ্ছেন? একটু রহম করেন। আমার কি পরিমান কষ্ট হয়েছে যদি আপনাকে বোঝাতে পারতাম!’
প্রেম এবার তৃষার মুখটা চেপে ধরে তাকে ঠেসে ধরল দেয়ারে। তারপর উঁচু গলায় বলল, ‘তোকে একবারও বলেছি ভালোবাসি আমি? আলু আমার পছন্দ না। কারণ কি জানিস? আলু সব তরকারিতে মিশে যায়। তুই হচ্ছিস ওই রকম মানুষ। সবার সঙ্গে মিশে যাস বলেই তোকে জাস্ট ঘৃণা করি। দেখ তোর আর আমার রাস্তা আলাদা। আমরা হলাম দুই পৃথিবী।’ প্রেম তৃষার মুখটা ছেড়ে দিয়ে বলল, ‘যদি তোর এক বাপ হয় তাহলে আর কখনো আমার সামনে আসবি না।’ প্রেম ছাড়তেই তৃষা প্রেমের গালে আচমকা চড় বসিয়ে দেয়। প্রেম কয়েক মুহূর্ত কেবল স্তব্ধ হয়ে রইলো। তবুও কিছু বলে না। চুপ করে রইল। হঠাৎ তৃষা তাকে ধাক্কা দিয়ে কেঁদে উঠল। প্রচন্ড রাগ নিয়ে গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তুমি নেশা করো তবুও তোমাকে আমি মেনে নিয়েছি, তুমি রাতভোর বাইরে আড্ডা দেও তবুও তোমাকে আমি ভালোবেসেছি, তুমি আমাকে মারো, বকো তবুও তোমাকে আমি কিচ্ছু বলি না।
প্রেমতৃষা পর্ব ২৭
তোমার যখন যা মন চায় করো আমার সঙ্গে, তোমার সব ভুল তবুও আমি মেনে নিয়েছি। আরে ব্যাটা আমার ভালোবাসা তোমার কাছে তামাশা লাগে? তামাশা? তোমার সঙ্গে ভালোবাসার খেলা খেলছি? আমি পুতুল? আমার সঙ্গে যখন যা মন চায় করবে। অধিকার খাটাবে আবার বলবি ভালোবাসি না? আসল কথা কি জানো? তোমার তো বাবা-মা নেই। জন্মের ঠিক ঠিকানা আছে তো? কারণ কোনো ভালো ঘরের ছেলে এমন হতে পারে না। তাই তো মানুষ বলে বাবা-মা ছাড়া সন্তান কখনো ভালো হয় ন….’ তৃষা পুরোটা শেষ করার আগেই প্রেম কষিয়ে চড় বসালো তৃষার গালে। শক্তি দিয়ে গলা চেপে ধরে ধমকে বলল, ‘শেষ তৃষা সব কিছু শেষ। আজকে থেকে প্রেম তৃষা নামক কাউকে চিনে না। এই বাড়িতে হয় তুই থাকবি নয়তো আমি। তুই প্রেমকে এখনো চিনিসনি। এখন চিনবি। হয় তুই ধ্বংস হবি নয়তো আমি। আমার মারতে একটুও হাত কাঁপবে না। খুন করে এই বাড়ির মাঝেই কবর খুঁড়ব খোদার কসম।’