প্রেমতৃষা পর্ব ২৮ (২)
ইশরাত জাহান জেরিন
তখন মাসের শেষের দিক। আজকে বিশটা দিন যেই মানুষটিকে তৃষা দেখেনি নিজের চোখে তার নাম হচ্ছে প্রেম নেওয়াজ। দুনিয়া যে কত কঠিন এই বিশটা দিনে প্রেম তাকে হারে হারে বুঝিয়েছে। বুঝিয়েছে শরীরে আঘাত না করেও দূরে সরে গিয়ে কেমন করে মনে আঘাত করতে হয়। সে হারিয়ে গিয়েও তার কথা গুলো রয়ে গেছে। খুঁটির ওপর ঝুলতে থাকা অর্ধেক ব্যথা আজও তৃষাকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। প্রেমকে তৃষা কি করে বোঝাবে? কি করে বলবে? তার একটা ‘কেমন আছো’ শুনতে না পাওয়ার আক্ষেপে সে রাতে কত দুঃখ গিলে।
প্রেমকে কি করে চিৎকার করে বলবে, ‘ভালোবাসা যদি দায়হীন হয়, তবুও দায়িত্ব শেখেন। আমি চাই না পুরো জীবন, শুধু আপনার একটুখানি উপস্থিতি আমায় বার বার হত্যা করুক। মৃত্যু যন্ত্রণা খুব কঠিন, আমায় বারেবার এই যন্ত্রণা আপনি দিয়েন না। আমি সইতে পারব না।’
তৃষা এতদিন ঘর থেকে বের হয়নি। চোখের সামনে নাতির চোখে সিদ্দিক নেওয়াজকে পাগলের মতো বিলাপ করতে দেখেছে। অথচ বলার সাহস নেই তার একটা মাত্র ভুলের কারণে সিদ্দিক নেওয়াজের শেষ সম্বল হারিয়ে গেছে। খোয়া গেছে। তৃষা ঘর বন্দী থাকে। অবস্থা ভালো না দেখে কেউ তাকে কোনো চাপ দেয় না। প্রেমাকে এখন তৃষা পড়াচ্ছেও না। খাওয়া-দাওয়া তো ছেড়েই দিয়েছে। কাজ কর্ম, হাসি সবই তার সঙ্গে হারিয়ে গেছে প্রেম নেওয়াজের শোকে । নিজেকে সবার থেকে দূরে রেখে রোজ এভাবেই শাস্তি দিয়ে যাচ্ছে তৃষা। প্রেম কোথায় গেছে জানা নেই। কতবার অংকুরকে জিজ্ঞেস করল লাভ হলো না। প্রত্যুষ আইনের লোক হয়েও খোঁজ নিলো না। আর নিতে পারছে না তৃষা। একদিন সে সব ছেড়ে পাখি হয়ে অনেক দূরে চলে যাবে। সেদিন প্রেম ভাই এলেও তৃষা আর ফিরবে না। ভালোবাসা এত পোড়াবে জানলে তৃষা কখনো সামনে পা বাড়াতোই না। এই বিশ দিনে অন্তত দিনে দুই-চার বার প্রেম ভাইকে নিয়ে লিখতে বসেছে তৃষা। কত কথা। তবে অগোছালো। বার বার লিখেছে আর বার বার ছিড়ে ফেলেছে। আজ আবার লিখবে বলে ঠিক করেছে। যে কথাগুলো মুখে কখনো বলতে পারবে না তার সাদা কাগজের ভাঁজে লিখে রেখে যাবে। এমনও তো হতে পারে একদিন প্রেম ভাই ফিরবে। তবে সেদিন আর কথাগুলো বলার মতো এই তৃষা নুজায়াত থাকবে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
প্রেম নেওয়াজ,
মাসের শেষের দিক। ঘড়ির কাঁটা যেন দম নেয়া ছেড়ে দিয়েছে। আজ বিশটা দিন হলো তোমাকে নিজের চোখে দেখিনি। বিশটা দিন: সংখ্যাটা কাগজে সামান্য, কিন্তু আমার বুকের মাপে যেন বিরাট এক লোহার খণ্ড। প্রতিটি দিনই আলগা আলগা করে আমার ভিতর থেকে এই খণ্ড কিছু একটা কেড়ে নিচ্ছে। তুমি আমার চক্ষুনজরের সীমানার বাইরে এই টুকুই আমার শরীরে আঘাত না করে সরাসরি মনে আঘাত করার জন্য যথেষ্ট। জানো কি তোমার হারিয়ে যাওয়া ধরে রেখেছে আমার হৃদয়ের অজস্র ক্ষত। তোমার অনুপস্থিতি আমার শরীর অক্ষত রেখে মনে কেমন করে জ্বালাপোড়া দিয়ে যাচ্ছে সেটা তুমি কল্পনাও করতে পারো? তোমার থেকে দূরে থাকা আমার জন্য অচিরেই অসহনীয়। প্রেমের উত্তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে, জ্বরের মতো; থার্মোমিটারের কাঁচের ঘরে পারদকে বেঁধে রাখা যেন খুবই মুশকিল। তুমি কাছে এলে পারদ নেমে আসে, তুমি দূরে গেলে আবার ওঠে—এই ওঠানামাই এখন আমার প্রতিদিনের জীবনচক্র।
আমি কখনো চাইনি রোগ-দলিলের মতো তোমার প্রতি আস্থাহীন হই; তবু তোমার দূরে চলে যাওয়া, তোমার নিয়মহীন ভালোবাসা আমাকে এমন এক অবস্থা দিলো যেখানে ভালোবাসা কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার পায়ে। কত কথা বাকি ছিল আমাদের। সেগুলো যদি পাখি হতো, আমি নিশ্চয়ই তাদের উড়ে যেতে দিতাম। কারণ বুকের ভেতর এত কথা জমিয়ে রেখে এখন আর আমি ভার সহ্য করতে পারছি না। তোমায় বলতে না পারা ছোট্ট বাক্যগুলো বুকের ভেতর জমে জমে কষ্টের পাহাড় গড়ে তুলেছে। পাহাড়গুলো তার চোরা-চোরা মাথার ওপর থেকে শহর কাঁপায়। তুমি কি জানো—একটা ‘ফিরে এসেছি’ শোনার অপেক্ষায় রাতগুলো কষে ওঠে?
তুমি কিচ্ছু জানো না প্রেম ভাই, কিচ্ছুই না। কেবল আমায় একফালি রোদের মতো, ঘোর বর্ষার বৃষ্টির মতো আঘাত করতে জানো। তবুও আমি তোমাকে দোষ দিই না পুরোপুরি। আমি শুধু ক্লান্ত। ক্লান্তি তীব্র আমাকে মাঝে মাঝে এমন এক দূর্বলতায় ফেলে কিন্তু সেখান থেকে উদ্ধারের জন্য আমি নিজেকে আর খুঁজে পাই না। ভালোবাসা যদি রোগও হয়, তবু আমি জানি সেটা আমার একমাত্র উপশম। তাই তোমাকে ছেড়ে দিতে পারি না। তুমি যদি সত্যিই ভালবাসো, নিয়মটা শিখো, ফিরে আসো,সামান্য সময় দাও, চোখে চোখ রেখে বলো, একটু উপস্থিত হও এগুলোই আমার ‘ওষুধ’।
আমি এই চিঠিতে অভিযোগের সঙ্গে ভালোবাসা রেখেছি। তোমার অবহেলার মধ্যেও যা আমার প্রতি ছিল তা কেবলই ভালোবাসা। তাই ভালোবাসা দিতে বিন্দু পরিমাণ দ্বিধা করব না। আমার দুঃখ সমান তোমার সুখ হোক।
তোমার অপেক্ষায় ক্লান্ত,
তৃষা নুজায়াত।
সেই চিঠি ভিজে গেল চোখের নোনা জলে। সেখানেই কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে চোখ – দু’টো বন্ধ হয়ে এলো তৃষার। দরজার পাশে তখন প্রত্যুষ বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে। চেয়ে আছে তৃষার দিকে। হঠাৎ কেউ একজন তার পিঠে হাত রাখতেই সে পেছন ফিরল। চেয়ে দেখল হেতিজা নেওয়াজকে। হেতিজা ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন,’ভালোবাসিস তো ওকে? তাহলে বিয়ের কথাটা বাপজান তুই বলবি নাকি এবার আমি নিজেই বলব?’
তখন সন্ধ্যার আজান দিচ্ছে। বাগানের বেঞ্চেতে পা ঝুলিয়ে বসে আছে তৃষা। একটু আগেই শিমলার কল এলো। কাল রাতে অংকুরের সঙ্গে পালিয়েছে সে৷ ভালোবাসলে ভালোবাসা এমনই হওয়া উচিত। শিমলার বয়স্ক লোকের সঙ্গে বাসা থেকে বিয়ে ঠিক করা হয়েছিল। শেষে অংকুর যখন বলল,’পালিয়ে যাই।’ তখন শিমলার জীবনের সবচাইতে আনন্দের মুহূর্ত ওই দু’টো শব্দের থেকেও বেশি ছিল। তৃষা একটু আগেই কাজ ছেড়ে এসেছে হেতিজাকে বলে। এই বাড়ি থেকে কাল সে চলে যাবে। ভার্সিটিও যাওয়া বন্ধ। তবে এখান থেকে যাওয়ার পর কোন পথে যাবে, থাকবে কোথায় তা জানা নেই। শুধু জানে এখানে এখন থাকার মানে হয় না। অনেক তো অপেক্ষা করেছে। ফেরার হলে কবেই ফিরত। হঠাৎ বেঞ্চেতে তৃষার পাশেই কেউ একজন বসল। তৃষার দেখার মতো আগ্রহ জাগল না। তবে হুট করেই একটা চেনা কণ্ঠ ভেসে এলো। প্রত্যুষ বলল, ‘ভালোবাসা অনেক কাঁদায় তাই না তৃষা? যে যাওয়ার সে চলে যাবেই। তাকে তাবিজ করলেও সে তোমার কখনোই হবে না।’
তৃষা জবাব দিলো না। প্রত্যুষ ফের বলল,’জানো তৃষা, মানুষকে যতই আঁকড়ে ধরো না কেন যদি তার মন তোমার না হয়, সে হাজার ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে যাবে। ভালোবাসা কখনো জোর করে আটকে রাখা যায় না।’
‘ আমি জানি তবুও হৃদয় তো মানতে চায় না। মনে হয়, যদি আরও একবার ডেকে বলতাম তাহলে হয়তো থেকে যেত।’
‘ তুমি হয়তো ভেবেছিলে সেও তোমার মতোই অনুভব করছে, কিন্তু আসলে তার ভেতরে অন্য গল্প চলছিল। ভালোবাসার ভেতরে এমন ভাঙন অচেনা নয়। তার চেয়ে বড় কথা প্রেম তোমাকে মুখে কখনো বলেছে সে তোমায় ভালোবাসে?’
তৃষার কাছে কোনো জবাব নেই। সে চুপ করে যায়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে জবাব দেয়,
‘ আমি হয়তো শুধু স্বপ্নকে সত্যি ভেবে আঁকড়ে ধরেছিলাম।
‘আমরা অনেক সময় ভরসা করি—ভাবি, এ মানুষটা আমায় কখনো ছেড়ে যাবে না। অথচ একদিন দেখি, সেই মানুষটিই চলে গেছে দূরে, এমনভাবে যে ফেরা আর সম্ভব নয়।’
‘সেই দৃশ্যটা আমি চোখের সামনে দেখেছি। বিশ্বাসের ভাঙন কতটা তীব্র হতে পারে, তা এখন আমার হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’
প্রত্যুষ আকাশের দিকে তাকায়। আকাশ মেঘলা। মেঘের গর্জন শোনা যাচ্ছে। সে বলল, ‘ভালোবাসা এক ধরণের মোহও বটে। তুমি যা হারালে, তা হয়তো শুরু থেকেই তোমার ছিল না। আমরা যা পাই তার প্রতি আমার আর্কষণ বেশি থাকে। তা আমাদের অতি প্রিয় হয়ে থাকে।’
‘হয়তো সত্যি তাই, কিন্তু তবুও কেন হারানোটা এত বিষের মতো গায়ে লেগে থাকে বলেন তো?’
‘ ওই বিষ আমাদের পুনরায় বাঁচিয়ে তুলে। মানুষ চলে যায়, কিন্তু তার দিয়ে যাওয়া দাগ আমাদের ভেতরে রয়ে যায়। সেই দাগ একদিন শক্তি হয়ে দাঁড়ায়। আর যখন শক্তি হয়ে দাঁড়ায় তখন আমরা পুনরায় প্রেমে পড়ি। ভালোবাসতে শিখি। তুমি বিষ পান করে শক্ত হতে পারবে না?’
‘ হয়তো একদিন পারব শক্ত হতে, কিন্তু বুকের ভেতরটায় যে ফাঁকা স্থান তৈরি হয়ে গেছে তার?’
‘তুমি ভেবো না তুমি একা। যারা হারিয়েছে, তারাই সবচেয়ে গভীরভাবে ভালোবাসতে শিখে। হয়তো এ কষ্টই তোমায় নতুন করে গড়বে। আরেকটা কথা মনে রেখো যে চলে যায়, সে হয়তো তোমার ছিলই না। কিন্তু তুমি যে ভালোবাসতে শিখেছো, সেটাই তোমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। আর শুনোভালোবাসা আসলে হারায় না, শুধু মানুষ হারিয়ে যায়। ভালোবাসা রয়ে যায় ভেতরে।
হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি নেমে এলো। আকাশের গর্জন যেন তৃষার বুকের গোপন ব্যথার প্রতিধ্বনি হয়ে বাজতে লাগল। তৃষা আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। বৃষ্টির ধারায় ভিজতে ভিজতে সে হঠাৎ ফুঁপিয়ে উঠল, চোখের জল আর বৃষ্টির ফোঁটার ভেতর কোনো তফাৎ থাকল না। বুক চিরে বেরিয়ে এলো তার আক্রোশভরা আর্তনাদ,
“আমি তাকে ভালোবাসি প্রেম! তুমি ভালোবাসো কিংবা নয়, আমার ভালোবাসা অমোঘ! আমার সমস্ত রক্তে, শিরায়, শ্বাসে শুধুই তুমি! তোমায় ভুলতে গেলে আমি নিজেই নিজেকে ভুলে যাব।’
তার কণ্ঠরোধী চিৎকার বৃষ্টির গর্জনের সঙ্গে মিশে বেদনাময় সিম্ফনি হয়ে উঠল। সে হাত ছুঁড়ে বাতাস আঁকড়ে ধরতে চাইল,অথচ শূন্যতা ছাড়া কিছুই তার কাছে এলো না। তৃষার দেহ কাঁপতে লাগল, ভেতরের অগ্নিদাহ তাকে ছিন্নভিন্ন করে ফেলতে চাইছে।
প্রত্যুষ চুপচাপ তাকিয়ে রইল। এই উন্মত্ত যন্ত্রণার মুখোমুখি হতে তার নিজের বুকও ভারী হয়ে উঠল। হঠাৎ সে নিজের কাঁধ থেকে ব্লেজার খুলে তৃষার ভিজে যাওয়া কাঁধে জড়িয়ে দিল। মৃদু কিন্তু দৃঢ় কণ্ঠে ফিসফিস করে বলল, “তৃষা, নিজেকে ছিঁড়ে ফেলার মতো করে কাঁদো না। ভালোবাসা যদি সত্যিই তোমার হয়, সে একদিন অন্য রূপে ফিরে আসবে। আর যদি না-ও আসে, তবুও তোমার ভেতরের এই ভালোবাসাই তোমায় অমর করে রাখবে। শোনো, মানুষ চলে যায়, কিন্তু ভালোবাসা কখনো মরে না আর কতবার বোঝাব? আচ্ছা যতবার তুমি বুঝবে না আমি বুঝিয়ে চলব।’
প্রেমতৃষা পর্ব ২৮
তৃষা কাঁপতে কাঁপতে তার গায়ের উপর মাথা রেখে হাহাকার করল। বৃষ্টির প্রবল স্রোতে তাদের দুজনের শরীর একাকার হয়ে গেল। চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে কেবল ঝড়-বৃষ্টির আওয়াজে ভরে উঠল। সেই মুহূর্তে, তৃষার অন্তর যেন বুঝে নিল ভালোবাসা হারায় না, হারিয়ে যায় কেবল মানুষ।