সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৪

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৪
Jannatul Firdaus Mithila

কুচকুচে কালো রঙের গাড়িটা ধীরে ধীরে এসে ভিড়লো এহসান বাড়ির আঙিনায়। কিয়তক্ষন বাদেই সেখান থেকে নিজের ক্লান্ত দেহটা কোনমতে টেনে-টুনে বের করে আনে রৌদ্র। ছেলেটা ধীরে ধীরে বাড়িতে প্রবেশ করে।
পাদু’টো যেন আর চলছেই না তার।শরীরটাও কেমন যেন আসাড় হয়ে আসছে ক্রমাগত।রৌদ্র ড্রয়িং-এ পা রাখতেই জুবাইদা বেগম দূর্বল শরীরটা নিয়ে এগিয়ে এলেন। দূর্বল মানুষটার হাত ধরে ঢাল হিসেবে দাড়িয়ে আছেন রাফিয়া বেগম। রৌদ্র একবার আড়চোখে তাকালো মায়ের দিকে। সন্দিষ্ট কন্ঠে বললো,

“ কিছু বলবে?”
জুবাইদা বেগম ধীর পায়ে আরেকটু এগিয়ে আসেন ছেলের দিকে। রৌদ্রের হাতের কব্জি চেপে দূর্বল কন্ঠে থেমে থেমে বললেন,
“ খাবার বাড়বো বাবা?”
রৌদ্র চোখে হাসলো মায়ের কথায়। মায়ের দিকে সরু চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“ তুমি ফ্রেশ হয়েছো? খাবার খেয়েছো?”
জুবাইদা বেগম ডানে-বামে মাথা নাড়লেন। বললেন,
“ ফ্রেশ হয়েছি কিন্তু খাইনি এখনো। আগে তুই আয়,তারপর একসঙ্গে খাবো।”
রৌদ্র আর কিছু না বলে ফিচেল হাসলো খানিকটা।তারপর মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাফিয়া বেগমের দিকে তাকিয়ে ফের বলে ওঠে,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ তুমি খেয়েছো তো?”
রাফিয়া বেগমও মাথা নাড়িয়ে না জানালেন। রৌদ্র তখন ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো।সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে পেছনে না ফিরেই বললো —
“আমার জন্য এভাবে আর অপেক্ষা করে থেকো না! বলা তো যায় না, এই অপেক্ষা আবার নতুন করে কোন কষ্ট বয়ে আনে।সে যাকগে… খাবার বাড়ো।আমি আসছি!”
রৌদ্র চলে গেলো সিড়ি বেয়ে। অথচ তার চলে যাওয়ার পথে দুটো মানুষ যে বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে আছে সে খবর কি আর আছে তার? থাকবেই বা কি করে? ছেলেটা যে আর একটাবারও পেছন ফিরে চাইলো না।পেছন ফিরে চাইলে হয়তো দেখতে পেতো, মা এবং চাচীর হতবাক নয়ন দুটি।

রাত ১০ টা বেজে ১৭ মিনিট!
রৌদ্র লম্বা একটা গোসল সেরে মাত্রই বেরিয়ে এলো ওয়াশরুম থেকে।ছেলেটার উম্মুক্ত চওড়া কাধের ওপর থেকে লোমহীন বুকটায় এখনো চুইয়ে পড়ছে পানির কনা।উম্মুক্ত পেটানো দেহখানায় বিন্দু বিন্দু পানির কনাগুলো যেন একেকটা মুক্তোর মতো ফুটে উঠেছে। রৌদ্র একহাতে তোয়ালে দিয়ে চুলগুলো মুছতে মুছতে বিছানার পাশে এসে দাঁড়ায়।এতক্ষণে শরীরটা বোধহয় খানিকটা স্বস্তি পেলো তার। রৌদ্র চুলগুলো মোছা শেষে তোয়ালেটা বিছানার পাশের স্ট্যান্ডে কোনমতে ঝুলিয়ে রাখে।পরক্ষণেই লম্বা একটা হামি টেনে, মাথাটা এদিক ওদিক ঘুরিয়ে খানিকটা ঘাড় ফুটিয়ে নেয়।এ মুহুর্তে তার ইচ্ছে করছে হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিতে।কিন্তু এখন কি আর সম্ভব এটা? নিচে যে তার মা এবং চাচী অপেক্ষা করছে। রৌদ্র নিজের মনের একরাশ ইচ্ছেটাকে একপ্রকার ধামাচাপা দিয়ে বিছানার ওপর আগে থেকেই বের করে রাখা সফেদ রঙা টি-শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নেয়।তারপর গটগট পায়ে বেরিয়ে আসে রুম ছেড়ে।

রাফিয়া বেগম একে একে সবগুলো খাবার এনে রাখলেন টেবিলের ওপর। রাইসা বেগম এবং মাইমুনা বেগম সে-ই কখন খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়েছেন। এমন না যে তারা অপেক্ষা করেনি বাকিদের জন্য! আসলে রাফিয়া বেগম নিজেই তাদের জোর করে আগেভাগেই খাইয়ে দিয়েছেন। সারাদিন তো আর কম খাটাখাটুনি করেননি মানুষ দুটো!
এদিকে,জুবাইদা বেগম আকুল হয়ে অপেক্ষা করছেন ছেলের জন্য।কিয়তক্ষন বাদেই রৌদ্র এসে হাজির হয় ডাইনিং এ। জুবাইদা বেগম ছেলেকে দেখে খানিকটা নড়েচড়ে বসলেন। রৌদ্র আলগোছে চেয়ার টেনে মায়ের পাশে বসলো।রাফিয়া বেগম রৌদ্রের সামনে প্লেট এগিয়ে দিলেন। তারপর প্লেটে খাবার বেড়ে দিতে নিলেই তার হাত চেপে ধরে রৌদ্র। রাফিয়া বেগম হতবাক চোখে তাকালেন রৌদ্রের দিকে। রৌদ্র তখন গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,

“ আমি বেড়ে নিচ্ছি! তুমি এসে বসো আমার পাশে!”
ছেলেটার এহেন কথায় রাফিয়া বেগম স্মিত হাসলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বসলেন রৌদ্রের পাশের চেয়ারটায়। রৌদ্র নিজ হাতে দু’জনের প্লেটে খাবার বেড়ে দিলো।তারপর নিজের প্লেটেও নিলো। জুবাইদা বেগম ছেলের এরূপ কার্যক্রমে মুগ্ধ হাসলেন। মা’কে ওভাবে হাসতে দেখে রৌদ্র আড়চোখে তাকালো একবার। প্লেটে খাবার বাড়তে বাড়তেই সন্দিহান গলায় বলে,

“ কি ব্যাপার? এভাবে হাসছো কেনো?”
জুবাইদা বেগম কিছু না বলে মাথা নাড়ালেন খানিকটা।
তিনি খাবারভর্তি প্লেটে আঙুল চালাচ্ছেন শুধু। ওপাশে বসা রাফিয়া বেগমও যে তা-ই করছেন। রৌদ্র দু’জনার এহেন কান্ডে ভ্রু কুঁচকায়।গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“ খাবার মুখে তোলার জন্য কি কোনো শুভক্ষণ খুঁজছো তোমরা?”
অগত্যা এমন কথায় ভড়কে যান জুবাইদা বেগম ও রাফিয়া বেগম। দু’জনেই তৎক্ষনাৎ রৌদ্রের দিকে তাকালেন। দেখলেন, ছেলেটা কেমন সরু চোখে তাদের দুজনের দিকে তাকিয়ে আছে! রাফিয়া বেগম তড়িঘড়ি করে খানিকটা খাবার মেখে মুখে তুলে নিলেন। তারপর রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে হালকা হাসি টানলেন ঠোঁটের কোণে। তা দেখে রৌদ্র মুচকি হাসলো, এরপর সে নিজের সরু দৃষ্টি ঘুরিয়ে আনলো মায়ের ওপর। জুবাইদা বেগম ছেলের এহেন দৃষ্টি দেখেই তড়িৎ গতিতে প্লেটে হাত চালিয়ে বলে ওঠেন,

“ ইয়ে… মানে খাচ্ছি.. খাচ্ছি!”
বলেই তিনি এক লোকমা খাবার মুখে তুলে নিলেন।রৌদ্র আর কিছু না বলে নিজের খাবারের দিকে মনোযোগ টানলো এবার। ভালোমতো খানিকটা খাবার মেখে নিয়ে যেই না মুখে তুলবে ওমনি তার মনে পড়ে যায় অরিনের কথা।ছেলেটা তৎক্ষনাৎ নিজের হাত থামিয়ে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করে,
“ অরি খেয়েছে?”
এহেন কথায় মুহুর্তেই থমকে যান বাকি দুজনে।রাফিয়া বেগম তো খাওয়া ভুলে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলেন। অন্যদিকে জুবাইদা বেগম একেবারেই নির্বিকার। খানিকটা সময় পেরোনোর পরও নিজের কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নের জবাব না পেয়ে রৌদ্র ফের বলে ওঠে,

“ কি হলো? কি জিজ্ঞেস করলাম? অরি কি খেয়েছে?”
রাফিয়া বেগম মুখের খাবারটা কোনমতে গিলে নিলেন।তারপর কেমন গম্ভীর মুখে বললেন,
“ নাহ! অনিকও অনেকবার চেষ্টা করেছে ওকে খাওয়ানোর কিন্তু ও বরাবরই না করে দিয়েছে। বলেছে — ওর নাকি খিদে নেই!”
সম্পূর্ন কথাটা কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই মুখের আদল শক্ত হয়ে এলো রৌদ্রের।ছেলেটা হাতে তুলে রাখা খাবার প্লেটে রেখেই উঠে দাঁড়ায়। এহেন কান্ডে জুবাইদা বেগম অস্থির হয়ে ছেলের উদ্দেশ্যে বলে ওঠেন,

“ আহা! খাবার রেখে উঠতে গেলি কেনো বাবা? তুই বস….আগে খাবারটা খেয়ে তারপর নাহয়….”
জুবাইদা বেগমের কথাটা শেষ হবার আগেই রৌদ্র মাঝে দিয়ে হুট করেই গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠে,
“ ও যেখানে না খেয়ে আছে, সেখানে তোমরা ভাবলে কিভাবে? আমার গলা দিয়ে খাবার নামবে!”
বলেই রৌদ্র চলে গেলো সেখান থেকে। আর তার চলে যাওয়ার পথে ছলছল চোখজোড়া নিয়ে তাকিয়ে রইলেন জুবাইদা বেগম। রাফিয়া বেগম খাবার রেখে মাথানিচু করে বসে আছেন। ভাবছেন —ছেলেটা এতো কেনো ভালোবাসলো তার মেয়েকে? কেনো এতোকিছুর পরও তার জন্য এতো ভাবছে ছেলেটা? আল্লাহ ওর মাঝে এতো ধৈর্য্য দিলেন কেনো?

রৌদ্র গটগট পায়ে এগিয়ে আসে অরিনের ঘরের সামনে। বন্ধ দরজার গায়ে একাধারে করাঘাত করে হাঁক ছেড়ে ডাকতে থাকে,
“ এই গেট খোল!”
পরপর এতোগুলো করাঘাতে একপ্রকার অতিষ্ঠ হয়ে যায় অরিন। মেয়েটার এতো সাধের ঘুমে কার এতো ব্যাঘাত ঘটানোর শখ হলো কে জানে! অরিন ঘুম ঘুম চোখে শোয়া ছেড়ে উঠে বসে। ঘুমন্ত মস্তিষ্ক এখনো ঠিকঠাক মতো সচল হয়ে উঠেনি তার।তাইতো সে চিনতে পারছে না দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে হাঁক ছুড়তে থাকা ব্যাক্তিকে। অরিন বিরক্তি নিয়ে লম্বা একটা হামি টানলো। ঠিক তখনি দরজার কাছ থেকে ফের ভেসে আসে রৌদ্রের কর্কশ কন্ঠ!

“ অরি? এই অরি? গেট খোল তারাতাড়ি! নইলে এবার কিন্তু দরজাটাই ভেঙে ফেলবো আমি!”
অগ্যতা এমন ধমকিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেলে অরিন।মেয়েটা চোখেমুখে একরাশ বিরক্তিভাব নিয়ে দরজার কাছে এগিয়ে আসে।দরজাটা না খুলেই খানিকটা জোর গলায় বলে ওঠে,
“ এতো চিৎকার করছেন কেনো? কি দরকার এখন?”
ওপাশে রৌদ্র দাঁতে দাঁত চেপে ধরলো।সে দরজার গায়ে আরেকটা থাপ্পড় দিয়ে কাঠকাঠ কন্ঠে বললো —
“ এই তুই দরজা খুলে কথা বল! আমি কারো মুখ না দেখে কথা বলিনা!”
অরিন তৎক্ষনাৎ ভ্রু কুঁচকে ফেলে। বিরক্তভরা কন্ঠে বলে,
“ দেখুন! অনেক রাত হয়েছে। প্লিজ এভাবে চেঁচাবেন না!”
রৌদ্র বুঝি নিজের মেজাজ হারালো এবার।ছেলেটা আবারও ভারি কন্ঠে বললো,

“ শেষবারের মতো বলছি — গেট খোল! আদারওয়াইজ, আই সয়্যার! আমি এক্ষুণি দরজাটা ভেঙে ফেলবো!তাছাড়া একবার যদি গেটটা ভেঙে ফেলি তাহলে তোর কপালে কিন্তু শনি লাগিয়ে ছাড়বো।মাইন্ড ইট!”
এমন কথায় মুহুর্তেই চুপসে যায় অরিন।মনে একরাশ অনিচ্ছা থাকা স্বত্বেও অবশেষে খুলে দিলো গেটটা।দরজাটা খুলতেই মেয়েটা তৎক্ষনাৎ পিছিয়ে যায় দু-কদম। কেননা,দরজার দু-ধারে হাত ঠেকিয়ে খানিকটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে রৌদ্র। তার রক্তবর্ণ হয়ে আসা চোখদুটো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অরিনের দিকে। অরিন খানিকটা ঢোক গিললো রৌদ্রের এরূপ দৃষ্টি দেখে। কিয়তক্ষন বাদে রৌদ্র ধীর পায়ে এগিয়ে আসে অরিনের নিকট।ছেলেটা একপা এগোতেই দু’পা পিছিয়ে যায় অরিন। হয়তো ভয়ে,নয়তো নিজের খোলস উম্মুক্ত হবার আতঙ্কে। রৌদ্র অরিনের কাছ হতে কিছুটা দূরে দাড়িয়ে ভরাট কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“ খাবার খাস নি কেনো?”
অরিন পরপর শুকনো ঢোক গিললো কয়েকটা। অতঃপর বলতে লাগলো —
“ ইয়ে… আসলে…”
কথাটা সম্পূর্ণ হবার আগেই রৌদ্র আঙুল উঁচিয়ে তুলে অরিনের মুখের সামনে। শাসানির সুরে হিসহিসিয়ে বলে,
“ কোনো ধরনের এক্সকিউজ শুনতে চাচ্ছি না আমি।জাস্ট একচুয়াল রিজনটা বল!”
অরিন ভড়কায় এবার। রৌদ্রের এহেন কথার সুরে ইতোমধ্যেই বুকটা কাপছে তার। অরিন দুরুদুরু বুকে কোনমতে বলতে থাকে,
“ আসলে… খিদে নেই তাই!”
অগত্যা এমন কথা শুনে কপালে দু-তিনেক ভাঁজ পড়লো রৌদ্রের।ছেলেটা হঠাৎই সন্দিহান গলায় বলে ওঠে,
“ তোর পেটে কি ব্যাঙ ঢুকছে?”
তড়িৎ মাথা তুলে অরিন।চকিত দৃষ্টি ফেলে রৌদ্রের ওপর। কি বললো এই লোক? সে কি ভুল শুনলো কিছু? তার পেটে ব্যাঙ ঢুকছে মানে?
নিজের এমন ভাবনাগুলোকে একপ্রকার চুলোয় চড়িয়ে অরিন মুখ কুঁচকে বলে ওঠে,

“ মানে? এসব আবার কি কথা? আমার পেটে ব্যাঙই বা ঢুকবে কেনো?”
রৌদ্র নিজের মুখাবয়ব আগের ন্যায় গম্ভীর রেখে কাঁধ উঁচিয়ে বললো,
“ তাহলে তুই কেনো বললি,খিদে নেই তোর?”
“ সে-তো সন্ধ্যে করে খাবার খেয়েছিলাম বিধায় খুদা লাগেনি আর।”
রৌদ্র এবার খামখেয়ালি ছাড়লো।গম্ভীর মুখে অরিনকে বললো,
“ নিচে চল।খাবার খাবি!”
“ না আমি যাবো না।খুদা নেই আমার!”
এহেন কথায় মেজাজ খারাপ হলো রৌদ্রের।ছেলেটা দাঁত কিড়মিড় করে বলে ওঠে,

“ এই ঘাড়ত্যাড়া এই! আমার সাথে ঘাড়ত্যাড়ামি করবি না! তোর কাছে শুনতে চাইনি,তুই কি করতে চাস, বা না চাস।তোকে নিচে যেতে বলছি ব্যাস যাবি! এ নিয়ে আরেকবারও ত্যাড়ামি করবিনা!”
অরিন এহেন ধমকে চুপসে গেলেও দমলো না যেন।মেয়েটা আবারও নাকচ করে ওঠে রৌদ্রের কথার পিঠে। রৌদ্র এবার দ্বিগুণ কর্কশ কন্ঠে খেঁকিয়ে ওঠে,
“ আরেকবার শুধু না বল,থাপড়ায়া কানের নিচ গরম করে ফেলবো বেয়াদব! বেশি নরম হয়ে গেছি বিধায় মাথায় চড়ে বসেছিস? এক্কেবারে মাথা থেকে নামিয়ে তুলে আছাড় মারবো একটা।এমনিতেই তোর কিন্তু মা’র পাওনা আছে! তুই অসুস্থ বিধায় তখন ছেড়ে দিয়েছি বলে, এখনও যে ছেড়ে দিবো এটা ভাবিস না কিন্তু। মাথাটায় ইতোমধ্যেই আগুন জ্বলছে আমার।তাই দয়া করে আগুনে আর ঘি ঢালিস না।বিশ্বাস কর, এবার কিন্তু সত্যিই নিজের সকল সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে ফেলবো আমি।”

অরিন দুরুদুরু বুকে মাথানিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ার্ত চোখদুটো তার ফ্লোরের উপর তাক করে রাখা।পা’দুটো বুঝি জমে গিয়েছে একজায়গায়। মেয়েটা পারছেনা একবিন্দুও নড়তে। সম্পূর্ণ শরীর জুড়ে বইছে মৃদুমন্দ কম্পন।রৌদ্র কিয়তক্ষন কোমরের ওপর হাত চেপে ঘনঘন নিশ্বাস ফেললো।নাহ! রাগ কমছে না তার।মেয়েটা এতো অবাধ্য হয়েছে না…. একে এখন উচিৎ একটা শিক্ষা দিতে না পারলে মাথাটা ঠান্ডা হবে না তার। রৌদ্র কোমর থেকে হাত সরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে কিছু একটা খুজতে লাগলো। পরক্ষণেই অরিনের পড়ার টেবিলের ওপর পড়ে থাকা রাবারের স্কেলটা দেখতে পেয়ে সেদিকে ছুটে গেলো সে। অরিন আড়চোখে তাকিয়ে দেখলো সবটা। অতঃপর রৌদ্রকে স্কেলটা হাতে নিতে দেখেই আঁতকে ওঠে সে।ভয়ার্ত কন্ঠে হকচকিয়ে বলতে লাগলো —
“ ও আল্লাহ গো! ভাই…ভাই..মাফ করেন..আমি যাচ্ছি!”

কথাটা বলে নিজেই নিজের দাঁতে জিভ কাটলো অরিন।যাহ….লোকটাকে আরেকধাপ চটিয়ে দিলো সে।এমনিতেই ওর মুখে ভাই ডাকটা শুনতে পারেনা রৌদ্র।তারওপর এই কান্ড! একেই হয়তো বলে— সোনায় সোহাগা! অরিন ভয়ার্ত চোখে রৌদ্রের দিকে তাকালো। রৌদ্রের দৃঢ় চোয়ালখানা কেমন শক্ত হয়ে ফুটে উঠেছে। লাল হয়ে যাওয়া চোখদুটো তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। অরিন ভয়ার্ত ঢোক গিলে একপা একপা করে পেছাতে লাগলো।রৌদ্র হাতের স্কেলটা নিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে আসতে বলতে লাগলো,

“ আমি তোর ভাই লাগি?”
অরিন ভয়ে ভয়ে ভুলক্রমে হ্যা-সূচক মাথা নাড়াতে গিয়েও থেমে গেলো যেন।পরক্ষণেই নিজেকে শুধরে নিয়ে পরপর ডানে-বামে মাথা নাড়িয়ে বললো,
“ না… না… ”
বাকিটা বলার মতো আর ধৈর্য্যে কুলালো না অরিনের। মেয়েটা ব্যান্ডেজ হাতেই দৌড়ে বেরিয়ে গেলো রুম ছেড়ে। রৌদ্র পেছন পেছন ছুটে আসে তার। ছেলেটা পেছন থেকে সর্তক বানী ছুড়ে বলে ওঠে,
“ আস্তে দৌড়া সানশাইন! পড়ে যাবি কিন্তু…. ”
কে শোনে কার কথা! অরিনটা তো জান হাতে নিয়ে ছুটছে একপ্রকার। ভাব এমন — একটু থেমে গেলেই রৌদ্র এসে খপ করে ধরে ফেলবে তাকে।

দেখতে দেখতে কেটে গেলো মাঝের একটিদিন! আজকে রাতেই হবে কবির সাহেবের অপারেশন। এহসান বাড়ির পরিবেশ আপাতত থমথমে। গতকালই রৌদ্র বাড়ির সবাইকে জানিয়েছে অপারেশনের কথা।যা শোনামাত্রই বাড়িতে যেন একপ্রকার হাউমাউ শুরু হয়ে গিয়েছিল। জুবাইদা বেগম তো কাঁদতে কাঁদতে জ্ঞান হারিয়েছিলেন দু’বার। মানুষটা স্বামীর জন্য পুরোই দিকবিদিকশুন্য হয়ে পড়েছিলেন।মাইমুনা বেগম আর রাইসা বেগম শত চেষ্টা করেও দূর্বল জুবাইদা বেগমকে শান্ত করতে বরাবরই ব্যর্থ হয়েছেন। অবশেষে রৌদ্র যখন মায়ের কাছে এসে, মা’কে বুকে জড়িয়ে বিভিন্ন ভাবে বুঝিয়েছে, তখন গিয়ে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছেন জুবাইদা বেগম।
সাব্বির সাহেবও তো এমনিতেই দূর্বল হয়ে পড়েছিলেন, তারওপর ভাইয়ের ওমন অপারেশনের কথা শুনেই মানুষটা বিছানা ধরে ফেললেন। সেই গতকাল বিকেল থেকে জ্বর নিয়ে পড়ে আছেন লোকটা। ক্ষনে ক্ষনেই দূর্বল শরীরটা নিয়ে ছুটে যেতে চান ভাইয়ের কাছে। রাফিয়া বেগম,তায়েফ সাহেব আর অনিক মিলেই তো সামলাচ্ছেন তাকে। রুহিও গতকাল এ বাড়িতে চলে এসেছে। রেহানও এসেছে বৈকি! রুহির তো কাঁদতে কাঁদতে বেহাল দশা! মেয়েটা আবার খানিকটা নাজুক ধাঁচের কি-না! তাকে অবশ্য সামলাচ্ছে রেহান-ই।

এছাড়াও বাড়ির অন্যান্য সদস্যদের মধ্যে রয়েছে একপ্রকার উৎকন্ঠা! তাশরিক সাহেব গত তিনটে দিন যাবত এদিক-ওদিক ছুটোছুটি করেই যাচ্ছেন। বড় ভাই দুজনেই তো অসুস্থ হয়ে পড়েছে, তাদের ব্যাবসা -বানিজ্যের কার্যক্রম যে এক কথায় লাঠে উঠেছে। সে-তো তাশরিক সাহেব বিষিয়ে যাওয়া মনে খানিকটা কাজ নেড়েচেড়ে দেখছেন। অফিসের সকল স্টাফদের আপাতত কোনরকমে কাজের ওপরে বরাদ্দ রেখেছেন। তিনি তো আর ব্যাবসা সম্বন্ধে ওতো কিছু বোঝেন না।তবুও যতটুকু পেরেছেন ততটুকু করছেন আরকি!

এরইমধ্যে মেহরিনও স্বপরিবারে গতকাল এসে হাজির হয়েছে এহসান বাড়িতে। মানুষটাতো এমনিতেই নরম স্বভাবের, তারওপর ভাইয়ের এহেন করুন অবস্থায় একেবারেই যেন মূর্ছাপ্রায় তিনি। জুবায়ের সাহেব আর্জেন্ট ছুটি নিয়ে এসেছেন। একজন সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা তো আর ওতো সহজে ছুটি পায় না! জুবায়ের সাহেব গতকাল একবার দেখে এসেছেন কবির সাহেবকে। তখন অবশ্য কবির সাহেবের সঙ্গে সরাসরি দেখা করবার অনুমতি ছিলোনা। তাই তিনি দূর থেকেই দেখে এসেছেন মানুষটাকে।
আরেকদিকে, বাড়ির ছোটো সদস্যরা সকলেই অরিনের দেখভালে নিয়োজিত হয়ে আছে।মেয়েটা আবার
হাত নাড়িয়ে কোন কাজ করতে পারে না যে! তাই তার ছোট ভাই-বোনরা মিলে তার দেখভালে সচেষ্ট থাকছে।তাছাড়া গতকাল থেকেই কেন যেন গোমড়ামুখো হয়ে আছে সে।স্নিগ্ধ মুখখানায় স্পষ্ট লেপ্টে আছে উদ্বিগ্নতার ভার। হয়তো বাড়ির চলমান পরিস্থিতিই দায়ী এসবের জন্য!

সকাল পেরিয়ে বিকেল হতে চললো তবুও এহসান বাড়ির মানুষগুলোর পেটে দানাপানি পড়েনি। আর পড়বেই বা কিভাবে? আর কিছুক্ষণ পরেই তো বাড়ির মূখ্য মানুষটার অপারেশন। রৌদ্রের কড়া নির্দেশ — কেউ যেন হসপিটালে না আসে। বিশেষ করে মহিলা মানুষ। সে কথানুযায়ী বাড়ির সকলেই ভার হয়ে আসা হৃদয়ে বসে আছেন বাড়িতেই। শুধুমাত্র তাশরিক সাহেব আর রেহান এরা দুজনেই গিয়েছে হসপিটালে।
জুবাইদা বেগম সে-ই দুপুর থেকে জায়নামাজে বসে আছেন। হয়তো তিনি রবের দুয়ারে প্রার্থনা করছেন স্বামীর জন্য।

রৌদ্র ব্যস্ত পায়ে নিজের কেবিনে এসে ঢুকলো। হাতে তার একগাদা কাগজপত্র! আজ রাত ৮ টার দিকেই বাবার অপারেশন করবে সে।এ নিয়ে মনে মনে দুশ্চিন্তার শেষ নেই ছেলেটার! রৌদ্র কেবিন ঢুকে আশেপাশে না তাকিয়েই সোজা গিয়ে বসলো নিজের চেয়ারে। কিয়তক্ষন বাদেই তার কর্ণকুহরে পৌঁছালো একজনের রাশভারী কন্ঠ!
“ রোদ!”
রৌদ্র তার হাতের ফাইলগুলো থেকে দৃষ্টি সরায় আলগোছে। ডাকের উৎসের দিকে তাকাতেই দেখতে পায় — অদূরের সোফায় গা এলিয়ে বসে আছে রেহান।রৌদ্র ভ্রু গোটায়। গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“ তুই কখন এলি?”
রেহান প্রতিত্তোরে মৃদু হাসলো।বসা ছেড়ে উঠে এলো রৌদ্রের কাছে। বললো—

“ ওতো মনোযোগ দিয়ে কি ভাবছিলি? যার জন্য ঘরে কেও আছে কি-না নেই,তা-ই দেখতে পেলি না!”
এমন কথায় রৌদ্র খানিকটা নড়েচড়ে বসলো। টেবিলের ওপর দু’হাতের কনুই ঠেকিয়ে, মাথাটা রাখলো হাতের ওপর। কিয়তক্ষন সময় নিয়ে চুপ করে রইলো ছেলেটা। পরক্ষনেই কেমন ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলো —
“ ভিষণ টেনশন হচ্ছে রেহান! আমি… আমি পারবো তো সবটা?”
রেহান হালকা হেসে রৌদ্রের কাঁধ চেপে ধরলো।খানিকটা ঝাঁকিয়ে ভিষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে লাগলো,
“ চিন্তা করিস না।আই নো ইউ ক্যান ডু ইট!”
রৌদ্র গম্ভীর মুখেই মাথা ঝাকালো। পরক্ষণেই মনে মনে ভাবতে লাগলো, — আদৌও সবটা ঠিক মতো হবে তো?

“ ড.রৌদ্র! প্রেসিডেন্ট ইজ কলিং ইউ!প্লিজ কাম ফাস্ট!”
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসা রেসিডেন্ট ডক্টরের কথায় মৃদু সুরে উত্তর দিলো রৌদ্র,
“ ইয়াহ! আ’ম কামিং”
বলেই সে কলটা কেটে দেয়। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ভাবতে থাকে পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে। ইতোমধ্যে সে বুঝে গিয়েছে কেনো তাকা ডাকা হচ্ছে। হয়তো তার ক্যারিয়ার অথবা বাবা দু’টোর মধ্যে যেকোনো একটাকে বেছে নেওয়ার সময় এসে গেছে। রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। তারপর আর কোনোদিক না তাকিয়ে সোজা বেরিয়ে যায় কেবিন থেকে।

মেডিক্যাল বোর্ড রুমে উপস্থিত সকলেই। সবাই বুঝি ভিষণ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে ড. রৌদ্রের জন্য। কিয়তক্ষন বাদেই, বোর্ড রুমে বুক টানটান করে প্রবেশ করে রৌদ্র। ছেলেটার মুখাবয়ব একেবারে গম্ভীর। চোখে এঁটে থাকা চিকন নীল ফ্রেমের চশমাটি আড়াল করে রেখেছে এই দাম্ভিক পুরুষের গাম্ভীর্যে ভরা বিড়াল চোখদুটো। রৌদ্র এসেই সকলের উদ্দেশ্যে সালাম জানায়।প্রেসিডেন্ট গম্ভীর মুখে মাথা নেড়ে উত্তর করলেন সালামের। অতঃপর তিনি তার গম্ভীর মুখে রৌদ্রের উদ্দেশ্যে বললেন,
“ ড.রৌদ্র! আশা করি আপনি জানেন, আপনাকে এখানে কেনো ডেকে নিয়ে আসা হয়েছে।”
রৌদ্র মাথা নাড়ায়। রাশভারী কন্ঠে বলে ওঠে,

“ জ্বি স্যার! আমি জানি!”
“ ওহ! দ্যান ইটস কুয়াইট ইজি ফর আস! সো, ড.রৌদ্র, আপনি কি এখনো চাচ্ছেন এই অপারেশনটা করতে?”
রৌদ্র তৎক্ষনাৎ জবাব দিলো —
“ জ্বি স্যার।আমি চাচ্ছি!”
প্রেসিডেন্ট সরু চোখে তাকিয়ে রইলেন রৌদ্রের দিকে। লোকটার চোখেমুখে কেনো যেন অসন্তোষ্টির ছাপ স্পষ্ট লেপ্টে আছে। হয়তো তিনি রৌদ্রের এহেন জবাবে খুশি হতে পারেননি! প্রেসিডেন্ট গম্ভীর মুখে চেয়ারে গা এলিয়ে বসলেন। কিছুক্ষণ সময় নিয়ে বললেন,
“ ঠিক আছে তাহলে, আপনি এগ্রিমেন্টটায় সাইন করে দিন! এজ উই ডিসাইডেড, আপনার অপারেশনে বিন্দুমাত্র হেরফের হলে, সবটার জন্য কেবল মাত্র আপনিই দায়ী থাকবেন।”

রৌদ্র সটান হয়ে দাঁড়িয়ে মাথা নাড়লো। এগিয়ে এসে টেবিলের ওপর এগ্রিমেন্টের কাগজের পাশে পড়ে থাকা কলমটা হাতে তুলে নিলো। তারপর এগ্রিমেন্টটার দিকে তাকাতেই, রৌদ্রের কল্পনায় সেথায় ফুটে ওঠলো তার সাধের ডক্টরের এপ্রনটা।যাকে পাওয়ার জন্য তার শত শত রাত গিয়েছে অক্লান্ত পরিশ্রমে। একমুহূর্তের জন্য রৌদ্রের হাতটা কেনো যেন অজান্তেই কেঁপে ওঠলো খানিকটা। পাশে বসে থাকা প্রেসিডেন্ট তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখলেন সেই ক্ষুদ্র কম্পন। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ চোখ বন্ধ করে ফেলে।কিয়তক্ষন বাদে চোখ মেলে আবারও পেপারের দিকে তাকাতেই এবার সেথায় ফুটে ওঠে তার বাবার হাসি মুখটা!

রৌদ্র একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো সেই প্রানবন্ত চমৎকার হাসির দিকে।মনের অন্তস্থলে বয়ে যাওয়া এতক্ষণের সকল দ্বিধা দ্বন্দ্বই যেন মুহুর্তের মধ্যে উধাও হয়ে গেলো তার।কিছুটা সময় পেরোনোর পর রৌদ্র হাসিমুখে এগ্রিমেন্টের কাগজে সই করে দেয়।তারপর সেই কাগজটা প্রেসিডেন্টের দিকে মৃদু ঠেলে দিয়ে চমৎকার হাসলো ছেলেটা। প্রেসিডেন্ট অবাক হয়ে দেখলেন সেই হাসি। হয়তো তিনি ভাবছেন — নিজের সম্পূর্ণ ক্যারিয়ারকে ঝুলন্ত রাখার শোকে কি পাগল হয়ে গেলো ছেলেটা?
রৌদ্র হাসিমুখেই বললো সকলের উদ্দেশ্যে,

“ আমি তাহলে গিয়ে প্রস্তুত হই অপারেশনের জন্য! আপনারা সবাই দোয়া করবেন আমার আব্বুর জন্য। আসছি!”
বলেই সে কোনরূপ কালবিলম্ব না করে চলে গেলো বোর্ড রুম থেকে। এদিকে, তার চলে যাওয়ার পথে তাকিয়ে থেকে ড.আহমেদ ব্যাঙ্গ করে বলে ওঠেন,
“ সাচ আ ফুলিশ ডিসিশন!”
তার ওমন কথা কর্ণগোচর হওয়া মাত্রই শ্লেষাত্মক হাসলেন প্রেসিডেন্ট। লোকটা বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ান নিজ দাম্ভিকতার সাথে।তারপর ডান পকেটে হাত গুজেঁ বেশ ভাব নিয়ে বলতে লাগলো,
“ সে যে কতোবড় সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা বুঝতে হলে আপনাকে আরও কিছুটা মস্তিষ্ক খাটাতে হবে। টিল দেট, ওয়েট এন্ড ওয়াচ!”
অগত্যা এমন কথায় আবারও সেদিনের মতো হাসিমুখটা থমথমে হয়ে গেলো ড.আহমেদের। তিনি মনে মনে বলতে থাকেন, — ধূর! একটা কথা বলেও শান্তি নেই এখানে।ড.রৌদ্রের বিরুদ্ধে কিছু বললেই যেন ফোঁসকা পড়ে প্রেসিডেন্টের গায়ে।যত্তসব!

বিকেল সাড়ে পাঁচটা!
দূর্বল কবির সাহেব ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালেন। সারাদিন ধরে অক্সিজেন চলেছে নাকে ক্যানোলা দিয়ে। একজন নার্স এসে বেশ খানিকটা সময় নিয়ে ওনার ব্লাড প্রেসার, হার্টবিট, অক্সিজেন স্যাচুরেশন সব মেপে নিলেন। কবির সাহেবকে গতকাল রাতেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছে আজকের সার্জারীর ব্যাপারে।মানুষটার মানসিক একটা প্রস্তুতির ব্যাপারও তো থাকে। তাছাড়া রৌদ্র সকালে এসেই কবির সাহেবের ইকোকার্ডিওগ্রাম, এনজিওগ্রাম এবং ব্লাড রিপোর্ট দেখে নিশ্চিত হয়েছে যে, — বাইপাস ছাড়া আর কোনও উপায় নেই! তাই সবশেষে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত এই যে — আজ কবির সাহেবের বাইপাস সার্জারি হবে।

আধঘন্টা সময় পেরোতেই শুরু হয় কবির সাহেবের অপারেশনের চূড়ান্ত পূর্বপ্রস্তুতি! সারাদিন ধরে একফোঁটা পানিও খেতে দেওয়া হয়নি মানুষটাকে। কেননা নিল পার অরাল (NPO)নির্দেশ ছিলো। কারণ এনেস্থিসিয়ার সময় পেট ফাঁকা থাকা আবশ্যক।
কবির সাহেবের ইন্ট্রোভেনাস প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। একজন নার্স এসে IV লাইনে ফ্লুইড দিচ্ছে। আরেকটা হাতে সেন্ট্রাল লাইন বসানো হয়েছে। যেখান দিয়ে প্রয়োজন হলে জরুরি ঔষধ যাবে। অপরদিকে, একজন পুরুষ নার্স এসে কবির সাহেবের বুকের এবং পায়ের যে অংশগুলো কাটা হবে সেখানটায় পরিষ্কার করে শেভ করে দিচ্ছে। শেভ করা শেষে জায়গাগুলোতে অ্যাসেপটিক লোশন দিয়ে জীবাণুমুক্ত করে দিলো।

রৌদ্র গম্ভীর মুখে নিজের চেয়ারে বসে আছে। সামনের টেবিলেই পড়ে আছে “ অপারেশনের সম্মতি ফর্ম”।ছেলে হিসেবে এটা যে তাকেই সই করতে হবে। রৌদ্রের মুখোমুখি চেয়ার দুটোতে বসে আছে তাশরিক সাহেব এবং রেহান।রৌদ্র কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কাগজটার দিকে।তারপর ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলে, কলমদানি থেকে একটা কলম তুলে সই করে দিলো কাগজটায়। অতঃপর অপর দু’জনের উদ্দেশ্যে বললো,
“ আজকে আমার পরিক্ষা বুঝলে! যেই পরিক্ষার একটা মাত্রই মটো — ডু অর ডাই!”
তাশরিক সাহেব লাল হয়ে আসা চোখদুটো নিয়ে তাকালেন রৌদ্রের দিকে।আচ্ছা, লোকটা কি কাঁদতে চাইছে? না-কি নিজের চোখের অশ্রুকণাগুলো লুকাতে চাইছে? রৌদ্র একপলক তাকালো চাচার দিকে। পরক্ষণেই নিজের চোখদুটো সরিয়ে এনে গম্ভীর কন্ঠে বললো,

“ বড় হয়ে গেলাম চাচ্চু! বড্ড বড় হয়ে গেলাম। এই দেখোনা, নিজের এই হাতদুটো দিয়ে আজকে নিজের বাবার জীবনের সবচেয়ে বড় ফয়সালাটা করে ফেললাম! চাচ্চু……”
এপর্যায়ে কন্ঠ মোটা হয়ে আসলো রৌদ্রের।ছেলেটা খানিক ঢোক গিলে বলতে লাগলো,
“ আব্বুর কিছু হবে না তো চাচ্চু! আমি খুনি হয়ে যাবো না তো? ”
এবার বুঝি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলোনা তাশরিক সাহেব। লোকটা চেয়ারে বসেই ঝুঁকে পড়লো সামনের দিকে। তারপর শরীরটা মৃদু দুলিয়ে কেঁদে ওঠেন
মানুষটা।কান্নার তোড়ে থেমে থেমে বললেন,
“ আল্লাহ মালিক বাবা! আল্লাহ মালিক!”

সন্ধ্যা সাতটা!
কবির সাহেবকে ট্রলিতে চাপিয়ে থিয়েটারের সামনে নিয়ে আসে নার্সরা। থিয়েটারের সামনে আসতেই স্টিলের দরজাটা হা করে খুলে যায় দু’দিকে।নার্স ধীরেসুস্থে ট্রলিটা থিয়েটারের দিকে ঠেলে নিয়ে যেতে লাগলেন।আর মুহুর্তেই এক তীব্র ঠান্ডা এসে বারি খেলো কবির সাহেবের গায়ে।পুরো অপারেশন থিয়েটারটা আলোয় ঝলমল করছে।কবির সাহেব একবার দূর্বল চোখদুটো মেলে আশেপাশে তাকালেন।পুরো থিয়েটার জুড়ে কয়েকজন ডাক্তার।সকলের গায়েই এপ্রন,মুখে মাস্ক, মাথায় ক্যাপ। এর মধ্যে কোনটা তার ছেলে তা আর বুঝতে পারছেন না নেতিয়ে যাওয়া কবির সাহেব।
নার্স ধীরে ধীরে কবির সাহেবকে বেডে বসালেন। তারপর একজন দক্ষ এনেস্থেশিস্ট কাছে এসে বললেন,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৩

“ স্যার! এবার নাহয় আল্লাহকে স্মরণ করে ঘুমিয়ে পড়ুন।”
কথাটা ব’লেই তিনি হাতে থাকা এনেস্থেসিয়াটা খুব দক্ষতার সাথে কবির সাহেবের শরীরে পুশ করে দিলেন।ইনজেকশনের ছোঁয়া পেতেই, চোখের সামনে চারপাশটা ঝাপসা হয়ে আসে কবির সাহেবের। শরীরটা হয়ে আসে অবশ! আর তারপর…. কিচ্ছু টের পেলেন না মানুষটা।

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৫৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here