প্রেমতৃষা পর্ব ৩৮
ইশরাত জাহান জেরিন
হেতিজা দুপুরে ভাতের থালা ছুঁয়েও দেখেনি। বুকের ভেতরটা যেন কাঁটার বন। প্রেমা পাশে বসতেই তার চোখের জল আর্তনাদের মতো ফেটে বেরিয়ে এল।একটা শুকনো নদীর বুকে হঠাৎ জলোচ্ছ্বাস। প্রেমা মাকে বুকে টেনে নিল, হয়তো এই বুকেই মা আশ্রয় পাবে। তৃষা চলে যাওয়ার পর থেকে প্রত্যুষ রাতে বাসায় ফিরে না। দিনেও কোথায় খায়, কী করে—খোদা ছাড়া কেউ জানেন না। যে ছেলেটা একসময় সবার গর্ব ছিল, সেই ছেলেটির জীবন এখন হেতিজার চোখের সামনে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হচ্ছে। মায়ের বুকটা হাহাকার করে ওঠে। কেবল কান্নাই আসে। কেন যে ওই মেয়েটিকে ভালোবেসেছিল! এ ভালোবাসা তো জীবনটাকেই গিলে খাচ্ছে, ধ্বংস করে নিঃশেষ করে দিচ্ছে।
‘প্রেমা, একবার কল কর তো তোর ভাইকে,’
হেতিজার গলা শুকনো, কাঁপা।
প্রেমা তাই করল। কিন্তু কল যেতেই স্ক্রিনে সেই একই দৃশ্য—ফোন বন্ধ। আজকাল যেন রিং হওয়ার থেকেও বন্ধ থাকার দৃশ্যটাই পরিচিত হয়ে গেছে। হেতিজার চোখে নিদারুণ ক্লান্তি। এই বাড়ির প্রতিটি জীবনের আলো কি এভাবেই নিভে যাবে? আল্লাহ, এই অভিশপ্ত পরিণতি থেকে কবে মুক্তি মিলবে?
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিসোর্ট থেকে ফিরে আজ অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমেছে ঘরেজুড়ে। দুপুরের রোদে বাড়িটা যেন তন্দ্রাচ্ছন্ন, জানালার পর্দায় আলো-ছায়ার খেলা থেমে গেছে। প্রেম আর তৃষা—দু’জনেই ক্লান্ত, কিন্তু ক্লান্তিরও এক রোমাঞ্চ আছে, যা শরীরের প্রতিটি শিরা টেনে রাখে কোনো এক অজানা টানের ভেতর। তৃষা বই পড়তে পড়তেই ড্রয়িং রুমের সোফায় ঘুমিয়ে পড়ে। নিস্তব্ধ ঘরে শুধু ঘড়ির কাঁটার শব্দ, আর দূরে কিচেন থেকে ভেসে আসে ছুরির সঙ্গে কাঠের টেবিলের ঘষাটানা। হঠাৎ ঘুম ভেঙে যায় তৃষার। চোখের পাতার ফাঁক দিয়ে কিচেনের দিকে তাকাতেই সে মুহূর্তটা থমকে যায়। ওপেন কিচেনের আলোয় দাঁড়িয়ে আছে এক পুরুষ—কালো রঙের ট্রাউজার, আর শরীরের উপরে অন্ধকারের মতো দৃঢ় ছায়া। তার পিঠটা এতটাই চওড়া যে আলোর রেখাটাও সেখানে ভেঙে গেছে।
তৃষা স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে। এই দৃশ্য যেন কোনো মানুষের নয়—বরং এক অনিবার্য মায়ার মতো, যা তাকিয়ে থাকতে বাধ্য করে। ঘুম ভাঙার পর এমন দৃশ্য ক’জন নারীর কপালে জোটে? তার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ভারী হয়ে আসে। পুরুষটি এখনো পেছন ফিরে তাকায়নি তবুও তার উপস্থিতি ঘরের প্রতিটি কোণে গায়ে গায়ে লেগে আছে, এক ধরনের অজানা উষ্ণতা হয়ে। তৃষার মনে হয়, এই মানুষটা যদি এখন ঘুরে তাকায়, তাহলে সে হয়তো নিজের সমস্ত ঘুম, সমস্ত নিঃশ্বাস হারিয়ে ফেলবে সেই চোখের ভেতর। সে ওঠে যায়। এক পা দুই পা করে কিচেনে গিয়ে পেছন থেকে ওঠে জড়িয়ে ধরে প্রেমকে। পিঠে চুমু খেয়ে বলে, ‘আপনাকে অসীম ভালোবাসায় আমি ভালোবাসি।’
প্রেম পেছনে ঘুরে তৃষার নাকে নাক ঘষে ঠোঁট ঠোঁট বুলিয়ে বলল, ‘আমিও মিসেস নেওয়াজ আপনাকে অসীম ভালোবাসি।’
‘কি রান্না করেছেন?’ তৃষা জিজ্ঞেস করল।
প্রেম তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘সব আপনার পছন্দের খাবার। আপনি এগুলো খাবেন আর আমি আপ…..’ পুরোটা বলার আগেই তৃষা প্রেমের ঠোঁটে আঙুল ছুঁইয়ে তাকে থামিয়ে বলল, ‘ইশশশশয়।’
প্রেম আঙুল সরিয়ে নিয়ে বলল, ‘এমন ভাবে থামতে বললে কেন জানি আমার আরো বেশি করে শব্দ করতে ইচ্ছে করে।’
তৃষা হাসল। তারপর বলল, ‘পেটে ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। জলদি খাবার দেন। খাই আগে।’
‘ইদুর দৌড়াচ্ছে? তাহলে তো ইঁদুর মারার বিষ খেতে হবে আপনাকে মিসেস নেওয়াজ। ‘
‘আপনার মুখের যেই কথা। আর বিষ খাওয়ার দরকার নেই।’
‘শালী মিঠা কথা তোমার দরবারে সয়ে না? তোমায় ডিম থেরাপিই দেওয়া উচিত, নট প্রেম থেরাপি।’
পাহাড়ি পথটা বিকেলের আলোয় ধীরে ধীরে গলে যাচ্ছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ছিটকে আসা রোদ ঝিকমিক করছে মাটিতে। যেন কেউ সোনার গুঁড়ো ছড়িয়ে দিয়েছে। আজকে সারাদিন আধিবাসী গ্রামে ঘুরবে তারা। রাতে ক্যাম্পফায়ার করবে। প্রেম আর তৃষা পাথরের সরু পথ ধরে এগোচ্ছে। বাতাসে নরম একটা ঠান্ডা ছোঁয়া। মাটির সোঁদা ঘ্রাণে মন ভরে যাচ্ছে। কোথাও কাছেই হয়তো কারও উঠোনে চাল শুকোচ্ছে, আর তার পাশেই পাথর ঘেঁষে বসে আদিবাসী কিছু লোক গান গাইছে। বাঁশি বাজাচ্ছে।
সেই সুর নেমে এসেছে পাহাড়ের বুক থেকে, মাটির ভেতর দিয়ে সোজা হৃদয়ে গিয়ে লাগে। তৃষা হাঁটা থামিয়ে চারপাশে তাকায়। তার চোখে অনির্বচনীয় বিস্ময়। পাহাড়ের পেছনে লুকোচুরি খেলছে সূর্য। আকাশে কমলা আর গোলাপি রঙের মিশেল। দূরে ধোঁয়া উঠছে রান্নাগুলো থেকে, তার সঙ্গে মিশে আছে পোড়া কাঠ আর পুড়তে থাকা পাটপাতার গন্ধ। তৃষা নরম স্বরে প্রেমকে বলল,
“সবকিছু যেন স্বপ্নের মতো লাগছে, প্রেম… এরা কত সরল, অথচ কত রঙিন! জানেন, এদের মুখে কোনো ক্লান্তি নেই। মনে হয় প্রকৃতি নিজেই হাসছে ওদের সঙ্গে।”
প্রেম থেমে গিয়ে একটু তাকাল তার দিকে। তৃষার চুলের পাশে সূর্যের আলো লেগে ঝলমল করছে। তার চোখে পাহাড়ের প্রতিফলন।
প্রেম মৃদু হেসে বলল, “এদের চোখে শহরের মতো ধোঁয়া নেই, আছে কেবল আলো। আর সেই আলোয় তুমিও আলাদা করে ঝলমল করছো আজ।”
তৃষা কিছু বলতে পারল না। শুধু চুপ করে তাকিয়ে রইল দূরের পাহাড়ের দিকে। বাতাসে দুলছে তার চুল, আর কানে বাজছে ঢোলের সুর। ঠিক তখনই একদল বাচ্চা ছুটে এলো। তাদের হাতে ছোট ছোট ফুলের তোড়া, আর রঙিন পাথর দিয়ে বানানো ব্রেসলেট। তারা হাসতে হাসতে তৃষার সামনে থামল। একটা মেয়ে এগিয়ে এসে তৃষার কব্জিতে পরিয়ে দিল লালচে পাথরের বালা। আরেকটা ছেলে ফুলের মালা গলায় পরিয়ে দিল প্রেমের। তৃষা প্রেমের দিকে তাকাতেই সে বলল, ‘তুমি আমার জীবনের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাই তোমার জন্য সামান্য একটু আয়োজন তো করতেই পারি?’
হঠাৎ গ্রামের কিছু পাহাড়ি মুরুব্বিরা ধীরে ধীরে এগিয়ে এলেন। তাদের গলায় পাটের চাদর। একজন বলে উঠলেন,
“আজ তোমরা অতিথি, আর অতিথি হচ্ছে ইশ্বরের অন্য রূপ। আমাদের গ্রাম আমাদের কাছে সব কিছু। এই গ্রামে সূর্য ডোবে, কিন্তু ভালোবাসা কখনো ডোবে না।”
তৃষা মৃদু গলায় বলল, “প্রেম, মনে হচ্ছে আমি যেন আমার নিজের ঘরেই ফিরে এসেছি।”
প্রেম তার হাতটা ধরল, “হয়তো ভালোবাসা মানেই এমন এক জায়গা— যেখানে অপরিচিতরাও আপন হয়ে যায়, যেখানে প্রতিটা বাতাসে তোমার নামের মিষ্টি প্রতিধ্বনি শোনা যায়। তাই না?
তৃষা কিছুক্ষণ নীরব থাকল। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখো, সূর্যটা কেমন থেমে গেছে আমাদের জন্য।”
প্রেম হেসে বলল, “হয়তো সে-ও দেখছে, আজ শহরের দুই মানুষ মিশে যাচ্ছে পাহাড়ের মাটির সঙ্গে।”
দুজনেই এগিয়ে চলল গ্রামের ভেতর। যাওয়ার সময় তৃষা বলল, ‘আপনি যেই মানুষ এখানে অসভ্যতামি করবেন না কিন্তু। ‘
প্রেম মুখ বাঁকিয়ে বলল,’ দেখা যাক শালীর ঘরের বউ।’
গ্রামের ভেতর ঢুকতেই কিছু মেয়েরা এসে তৃষা আর প্রেমকে আধিবাসীদের পোশাক দিলো। তৃষা তো সেই পোশাক পড়ার জন্য মহা আগ্রহী। তবে প্রেম নাড়িয়ে চাড়িয়ে দেখল একবার। তারপর তৃষার কানের সামনে ফিসফিস করে বলল, ‘এই সোনা তুমি চাইলে আমি পোশাক ছাড়াই থাকতে পারব। দেখবে এই পাহাড়ের থেকেও সুন্দরী প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখিয়ে ওদের মুগ্ধ করে দেব।’
‘ প্রেমের বাচ্চা চুপ থাক।’
‘শালীর ঘরের বউ তুই চুপ থাক।’ বলেই চুল ঠিক করে প্রেম সামনের মেয়ে গুলোর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই গার্লস আমি এসব চাংচুং ড্রেস পড়তে পারি না। সাহায্য করলে প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখাবো। ‘ মেয়ে গুলো সেই কথা বুঝলো কিনা কে জানে। তার আগেই তৃষা তার পায়ের ওপর পাড়া দিয়ে বলল, ‘দেন আমি সাহায্য করছি।’
প্রেমের পোশাকটি হচ্ছে লালচে রঙের লুঙ্গি, সঙ্গে কাপড়ের শার্ট। আর তৃষারটি হচ্ছে অপূর্ব বেগুনি, হলুদ আর সবুজ রঙে বোনা হ্যান্ডলুম জামা, যার কাঁধে ঝুলছে নরম, শাড়ির মতো এক টুকরো কাপড়। সেই কাপড়ে সূক্ষ্ম নকশা— ফুল, পাখি, আর জলের ঢেউয়ের মতো নকশা, যেন প্রকৃতিরই অনুবাদ। তৃষা পোশাকটি পরে বের হতেই বাতাস যেন কিছুক্ষণের জন্য থেমে গেল। জানালার ফাঁক দিয়ে ঢুকে পড়া আলো তার গায়ে পড়তেই সে যেন গ্রামীণ রঙে মিশে গেল একেবারে। চুলের পাশে ছোট্ট ফুল গুঁজে সে হাসল, “এরা কত সুন্দর করে বুনে, প্রতিটা সুতোয় যেন একটা গল্প লুকিয়ে আছে।”
প্রেম তাকিয়ে রইল নিরবতায়, তারপর মৃদু হেসে বলল,
“ এই বউ বলবো না তোমাকে মহা সুন্দরী লাগছে। বাট গড প্রমিস হেব্বি বাসর পাচ্ছে আমার। একটু চিপায় আসো প্লিজ।”
তৃষা চারপাশে তাকিয়ে প্রেমকে চোখ রাঙায়। উফ এই লোকটাও না!
সূর্য ডোবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামের কেন্দ্রস্থলে জ্বলতে শুরু করল অগ্নিকুণ্ড। একটা বড় হারিয়ে যাওয়া আঁচরীর মতো। যা ধুলোকে উড়িয়ে দিয়ে উষ্ণ আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে।বাঁশের ভেতর ভরা ভাত ফুঁপে ফুঁপে ধোঁয়া ছুঁড়ছে আকাশ। মাটির হাঁড়িতে সাজানো খাবারগুলো। বাঁশের মধ্যে রান্না করা মাংস, ঝকঝকে সবজি, ধোঁয়া ওঠা বুনো মুগরির ঝোল, ঝিঁঝির কাঁকড়া সবই আছে। সঙ্গে সিদ্ধ সবজি, সিদোল দিয়ে মরিচ ভর্তা কি নেই তাতে?
আর বাঁশপাতায় মোড়া মিষ্টি পিঠা তার কোনো তুলনা নেই। খাবার শেষে সবাই আগুনের চারপাশে গোল করে বসল। আগুনের ফটকার শব্দ কানে গম্ভীর তাল বেঁধে দিচ্ছে। বৃদ্ধ একটা লোক মাঝে বসা। সেই লোকটি স্বরে-স্বরে বলতে শুরু করল, পাহাড়ের আত্মা, নদীর রাণী, আর হারিয়ে যাওয়া প্রেমের কাহিনি। তৃষা প্রেমের কাঁধে মাথা রেখে সেই গল্প শুনতে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে সে চুপচাপ হেসে উঠছে গল্পের কাতারে মুখ চেপে ধরত। গল্পগুলো ভীতিকর ছিল না বরং তারা ছিল বিশ্বাসোদযাপন, সেই বিশ্বাস যে মানুষকে জোড়া লাগায় প্রকৃতির সঙ্গে। গল্পের এক মুহূর্তে প্রেম বলল, “এদের গল্পে কোনো ভয় নেই, শুধু বিশ্বাস।” তৃষা ধীর করে বলল, “হয়তো এই বিশ্বাসটাই ভালোবাসার প্রথম পাঠ।”
‘তাহলে বাসায় চলো জলদি তোমায় ভালোবাসার দ্বিতীয় পাঠের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেই।’ তৃষা প্রেমের চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। অতঃপর বলল, ‘আমার না প্রেম বিরিয়ানি খেতে মন চাইছে।’
‘মাত্র না তুই মেয়ে নাদানের মতো গিলল? এত খাবার যায় কই?’
‘তোমার নানির পু…’
‘চুপ। কোথায় সই করতে হয় আজকে যাই একবার বাসায় তখন বুঝাবো।’
প্রেমতৃষা পর্ব ৩৭
‘এই যে…’
‘হুম।’
‘বিরিয়ানি খাবো।’
‘তেহারি নাকি কাচ্ছি?’
‘মানুষের মাংসের।’