আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১১

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১১
অরাত্রিকা রহমান

মিরায়া আশ্চর্য হয়ে বলল-
“কিহ্!”
রায়ান মিরায়ার রিঅ্যাকশন দেখে কথা ঘুরিয়ে নিজের এয়ারপোডস হাত দিয়ে বলল-
“ওহ্ সোরি। কানে গান বাজছিল তাই মুখে চলে এসেছে। কি বলেছ শুনি নি।”
মিরায়া মুখ বাঁকা করে-
“তেমন কিছু বলি নি ভাইয়া গান শুনুন আপনি।”
গাড়ির ভেতরটা এক অদ্ভুত নীরবতায় ভরে ছিল। রাস্তায় আলো, চারপাশে যানবাহনের হর্ন, বাতাসের ভেতরে ঢাকার শহরের ভিড়ভাট্টার গন্ধ… সবকিছু মিলিয়ে দৃশ্যটা ছিল ঠিক যেমনটা এক বিকেলের শহরে হওয়া উচিত। কিন্তু গাড়ির ভেতরে যেন অন্যরকম চাপা পরিবেশ।

রায়ান দুই হাতে স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরেছিল। তার চোয়াল শক্ত, চোখের দৃষ্টি সামনে রাস্তায় আটকে রাখা, ঠোঁট বন্ধ। ভেতরে ভেতরে ওর রাগ তখনও জ্বলে উঠছে—মাত্র কয়েক মিনিট আগেই মিরাকে রক্ষা করতে গিয়ে দুষ্টু ছেলেদের সাথে হাতাহাতি করতে হয়েছে। সেই উত্তেজনা আর দমিয়ে রাখা রাগ এখনো পুরোপুরি কমেনি।
মিরা আসনে একপাশে চুপচাপ বসে ছিল। গাড়ির জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকার ভান করলেও মনে হচ্ছিল, আসলে সে বুঝতে পারছে রায়ান এখনো প্রচণ্ড রেগে আছে। মাঝে মাঝে সাহস করে মুখ ফেরাতে চাইছিল, কিন্তু আবার দমে যাচ্ছিল। রায়ানকে এমন ভয়ংকর চুপচাপ দেখে সে নিজেও স্বাভাবিক থাকতে পারছিল না।
ঠিক তখনই হঠাৎ মিরার ফোনটা কেঁপে উঠলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সে চমকে উঠে স্ক্রিনের দিকে তাকালো। নামটা দেখেই গা টান টান হয়ে গেল—চট্টগ্রামের রাইডিং কমিউনিটির এক সিনিয়র ভাই, আরিফ। রায়ানের পাশে বসে আছে ভেবে, মিরার বুক ধকধক করে উঠলো। কিন্তু কলটা কেটে দেওয়াও ঠিক হবে না। দ্বিধার মধ্যে রিসিভ করল।
আরিফ— “হ্যালো মিরা, কেমন আছিস? খবরটা শুনেছিস?” ওপ্রান্ত থেকে ভেসে এল উচ্ছ্বাসভরা কণ্ঠ।
মিরা সাবধানে চোখের কোণে রায়ানের দিকে তাকাল—সে গম্ভীর মুখে সামনের দিকে তাকিয়েই আছে। তারপর নিচু স্বরে বলল,

— “হ্যাঁ ভাইয়া, কেমন আছেন?”
আরিফ— “আমি একদম ভালো। দেখ, তোকে একটা বড় খবর দিচ্ছি। আগামী মাসে ঢাকায় যে বাইক রেসটা হচ্ছে, সেখানে তোর নাম ফাইনালি লিস্টেড হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে আমরা তিনজন যাচ্ছি, আর তুই আমাদের লিড লেইডি রাইডার হিসেবে সিলেক্টেড হয়েছিস। তোর গত কয়েকটা পারফরম্যান্স দেখেই সবাই এক্সাইটেড। কনগ্র্যাচুলেশনস!”
এই কথা শুনে মিরায়ার চোখ চকচক করে উঠল। তার বুকের ভেতর আনন্দের ঢেউ ছুটে গেল। এতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে রাইড করা, এত প্র্যাকটিস, এত সংগ্রাম… অবশেষে এমন একটা সুযোগ! সে আসলে চিৎকার করে খুশি প্রকাশ করতে চাইছিল। কিন্তু রায়ান পাশে আছে—যে জানেই না সে বাইক চালায়, সেটাও গোপন।
সে গলা শুকিয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করল।

— “ওহ আচ্ছা… ধন্যবাদ ভাইয়া।
কিন্তু এখনই…? মানে, আমি তো ঢাকায় আছি আমার এক আত্মীয়ের বাড়িতে, কীভাবে ম্যানেজ করি?”
আরিফ — “দেখ মিরা এইটা অনেক বড় একটা সুযোগ হবে তোর জন্য। তুই ভালো করেই জানিস এই সুযোগটা পাওয়ার জন্য কতজন মুখিয়ে আছে। তুই নিজের যোগ্যতায় এই সুযোগটা পেয়েছিস ‌। আমার মতামত অনুযায়ী এই সুযোগটা হাতছাড়া করা তোর জন্য বোকামো হবে। বাকি তোর ইচ্ছা।আমি সব ডিটেইলস তোকে পাঠিয়ে দেবো। তুই না থাকলে টিমটাই অসম্পূর্ণ।”
মিরা ছোট্ট হেসে বলল,
— “আমি জানি ভাইয়া সুযোগটা অনেক বড়।
আচ্ছা ভাইয়া, পরে কথা হবে। এখন একটু ব্যস্ত আছি।”
আরিফ— “ঠিক আছে মিরা, বাই। পরে কথা হবে”
কল কেটে দিয়ে সে তাড়াতাড়ি ফোনটা ব্যাগে ঢুকিয়ে দিল। ঠোঁটের কোণে দমিয়ে রাখা এক চিলতে হাসি, চোখে ঝলক… কিন্তু একই সঙ্গে অস্বস্তি। কারণ রায়ান পাশে বসে নিশ্চুপ গাড়ি চালাচ্ছে।
কিছুক্ষণ ভেতরে চাপা নীরবতা চললো। তারপরই হঠাৎ রায়ানের গলা কানে বাজলো—শীতল, ভারী, রাগ চেপে রাখা সুরে:

— “কে ফোন করেছিল?”
মিরায়া আঁতকে উঠল। সে একটু হকচকিয়ে বলল,
— “আ… আমার একটা বন্ধু।”
রায়ানের কণ্ঠ এবার কিছুটা তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল।
— “কেমন বন্ধু? ছেলে নাকি মেয়ে?”
মিরা ইতস্তত বোধ করল। জানে, সত্যি বললে বিপদ। কিন্তু মিথ্যে বলাও ঠিক হবে না।
— “হ্যাঁ…মানে, একজন ছেলে ভাইয়ের মতো। পুরোনো বন্ধু।”
রায়ান ভ্রু কুঁচকালো, তার ঠোঁট শক্ত হয়ে এলো। এক হাতে স্টিয়ারিং চেপে ধরে, অন্য হাত দিয়ে হালকা ঝাঁকুনি দিল গিয়ার শিফটে।
— “সব ছেলেই কি শুধু ভাই?” (মনে মনে)
রায়ান চোখ সরু করে তাকাল, যেন মনের ভেতর ঢুকে সত্যটা বের করে আনতে চাচ্ছে।
রায়ান:
—“ফ্রেন্ড? এ কেমন ফ্রেন্ড যে তোকে এমন সময় ফোন দেয়? নামও কি?”

মিরার বুকের ভেতর কাঁপুনি ছুটল। মাথা নিচু করে বলল—
মিরা (কিছুটা দ্বিধায়):
—“আ…আসিফ। আমার পুরনো এক বন্ধু।”
রায়ানের ঠোঁটে হালকা কটমটানো হাসি ফুটল। সে আবার সামনে তাকাল, গাড়ি সামনের রাস্তা ধরে এগোচ্ছে, কিন্তু তার গলার টান বেড়ে গেছে।
রায়ান (ব্যঙ্গ মেশানো স্বরে):
—“আরিফ… হুম। খুব ঘনিষ্ঠ মনে হয়। এমন সময় ফোন দেয়, এত উৎসাহ নিয়ে কথা বলে…”
মিরা একটু নার্ভাস হলেও স্বাভাবিক থাকার ভান করল। চোখ নামিয়ে ঠাণ্ডা গলায় বলল—
মিরা:
—“না, তেমন কিছু না। সে আসলে আমাদের এক স্কুলে পড়াশোনা করত। মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়, শুধু বন্ধু হিসেবেই।”
রায়ান হালকা গর্জে উঠল।
রায়ান:
—“বন্ধু? তুই মনে হয় বন্ধুত্বের সংজ্ঞাটা অন্যরকম জানিস। একটা ছেলে আর মেয়ে কখনো বন্ধু হয়?”
তার কণ্ঠে চাপা ঈর্ষার সুর স্পষ্ট। মিরা বুঝতে পারছে, কিছু একটা তাকে ভেতরে কুরে কুরে খাচ্ছে। কিন্তু সে চায় না পরিস্থিতি আরও খারাপ হোক। তাই দ্রুত ব্যাখ্যা দিল।
মিরা (শান্তভাবে):

—“আপনি ভুল বুঝছেন। আসিফ খুব সাধারণ ছেলে। ওনার নিজেরও কাজকর্ম আছে, অনেক দিন ধরে কথা হয় নি তাই কল দিয়েছিল। আমি ওকে কেবল ভাইয়ের মতোই দেখি। এর বেশি কিছু নয়।”
রায়ান কিছুক্ষণ চুপ রইল। কিন্তু তার চোখে সেই আগুনমাখা ঝিলিক রয়ে গেল। স্টিয়ারিংয়ে আঙুলগুলো ক্রমাগত শক্ত করে ধরা। বাইরের লাইটগুলো মুখে পড়ে তার কঠোর ছায়া আরও স্পষ্ট করে তুলছে।
গাড়ির ভেতর আবার নিস্তব্ধতা। শুধু ইঞ্জিনের গর্জন আর রাস্তায় চাকার শব্দ।
মিরায়া বোঝে—আসিফের নাম শোনার পর থেকে রায়ানের ভেতরে হিংসার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিটা শ্বাস যেন ভারী হয়ে উঠেছে। কিন্তু কেন?- তার উত্তর জানা নেই।
মিরায়া ঠোঁট চেপে এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করল। ভেতরে ভেতরে সে একটা স্বস্তি পেল—
আসিফের ফোনটা বড় খবর নিয়ে এসেছিল, কিন্তু সেটা ধামাচাপা পড়ে গেছে। বাইক রেসের কথা এড়ানো গেছে। অন্তত আপাতত রায়ান সেটা জানতে পারল না।
গাড়ি একসময় শহরের ভিড় পেরিয়ে শান্ত রাস্তা ধরে বাড়ির দিকে ফিরছে। রাস্তায় বিকালের আলো গাড়ির ভেতরে পড়ে অদ্ভুত আবহাওয়া তৈরি করেছে।

রায়ান একদম চুপ। তার শ্বাসের শব্দও যেন ভারী। চোখ সামনে, কিন্তু মনে হচ্ছে ভেতরে ভেতরে অনেক কিছু ঘুরছে।
মিরায়া পাশে বসে অস্বস্তিতে। সেও কিছু বলছে না। মাঝে মাঝে চুপি চুপি তাকাচ্ছে রায়ানের দিকে। তার মুখে সেই কঠোরতা, চোয়ালের টান, ঠোঁট চেপে ধরা—সবকিছু দেখে মিরায়ার বুক কেঁপে উঠছে।
হঠাৎ রায়ান গাড়ি থামায়। ইঞ্জিন বন্ধ করার পরও রায়ান সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ শুধু সিটে বসে থাকল, মাথা নিচু, হাত স্টিয়ারিংয়ে রাখা।
তারপর আস্তে গলায় বলল—
রায়ান (চাপা স্বরে):

—“মিরা…তোকে আমার কিছু বলার আছে। তবে এখন বলব না পরে, আপাতত একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নে। আমি তোর জীবনের বাইরে না। তুই কাদের সাথে ঘুরিস, কারা ফোন দেয়—সবকিছু আমার জানার অধিকার আছে। তোর অন্য ছেলেদের সাথে কথা বলা বারোন।”
রায়ান আবার বলল, এবার গলার স্বর খানিকটা ভাঙা, তবু রাগের আঁচে ভরা,
— “আমি চাই না তুই অন্য কোনো ছেলের সাথে এতটুকুও ঘনিষ্ঠ হ। তুই যদি ভেবে থাকিস চৌধুরী বাড়িতে এসব আমি মেনে নেবো—ভুল করছিস।”
কণ্ঠের প্রতিটা শব্দে সেই অধিকারবোধ, সেই হিংসা আর ভালোবাসা একসাথে মিশে আছে।
মিরায়ার চোখ বড় হয়ে গেল। বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি। সে আস্তে মাথা নিচু করে শুধু বলল—
মিরায়া (নরম স্বরে):

—“জ্বি… বুঝেছি।”
মিরায়া চুপ মেরে গেল। মাথা নিচু করে জানালার বাইরে তাকাল। বুকের ভেতর দম আটকে এলো। সে বোঝাতে চাইছিল, ব্যাপারটা আসলে অন্যরকম, কিন্তু রায়ানের কণ্ঠে এত তীব্র রাগ, এত অধিকারবোধ—সে সাহস পেল না।
গাড়ি এসে থামল চৌধুরী বাড়ির গেটের সামনে। বাতাসে হালকা ঠাণ্ডা ভাব, বাড়িটার উঁচু লোহার গেট ধীরে ধীরে খুলে গেল। গাড়ির ভেতরে তখনো চাপা উত্তেজনা আর নীরবতা ভাসছে।
রায়ান প্রথমে দরজা খুলে নামল। তার চোখে এখনো লেগে আছে কিছুটা রাগ, কিছুটা অভিমান। কিন্তু তারপরও সে এগিয়ে গেল গাড়ির অপর পাশে। নিঃশব্দে মিরায়ার দরজাটা খুলে দাঁড়িয়ে রইল।
মিরায়া ভেতর থেকে ধীরে ধীরে বের হলো। চোখ নামানো, ঠোঁট শক্ত, যেন কোনো কথা বলতে চাইছে না। রায়ান তার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ নীরব থাকল—তারপর এক অদৃশ্য টান তাকে না বলা কথার দিকে ঠেলে দিল।
তারা দু’জন পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল। বড় হলঘরের ঝাড়বাতির আলো চারপাশ ভরে তুলল, কিন্তু ভেতরের অস্বস্তিটা যেন কাটল না।

হঠাৎ মিরায়া কোনোকিছু না বলে সিঁড়ির দিকে ছুটে গেল। পাতলা ওড়না পেছনে উড়ে উঠল, পায়ের শব্দ একটার পর একটা ধাপ বেয়ে ওপরে উঠতে লাগল।
রায়ান দাঁড়িয়ে রইল নিচে। তার চোখ স্থির হয়ে গেল মেয়েটার ভীত–অভিমানী ছুটে যাওয়ার ভঙ্গির দিকে। ঠোঁটের কোণে দমিয়ে রাখা আকুলতা ভেসে উঠল।
গলায় ভারী আবেগ নিয়ে হঠাৎ বলে উঠল—

— “আস্তে উঠো মীরা…লেগে যাবে তোমার । হোঁচট খেলে আমি সহ্য করতে পারব না।”
শব্দগুলো ভারী, অথচ কোমল। যেন সমস্ত রাগ, জেদ, অভিমান ভেদ করে বেরিয়ে এলো এক নিঃশব্দ মোহ।
কিন্তু মিরা একবারও পেছনে ফিরল না। তার চুলগুলো দুলতে দুলতে অদৃশ্য হলো সিঁড়ির মোড় ঘুরতেই।
রায়ান স্থির দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তার চোখে তখনো লেগে থাকা এক ধরনের অস্থিরতা—যেন মেয়েটাকে ছুঁয়ে ধরে বলতে চায় কতটা টান তার ভেতরে। কিন্তু সে কিছুই করতে পারল না।
অবশেষে গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সে নিজের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ করার আগে শেষবারের মতো সিঁড়ির দিকে তাকাল… যেন মিরায়ার ছুটে যাওয়া ছায়াটাই এখনো বাতাসে ভাসছে।

সেদিন দুপুরে কলেজ থেকে ফিরে সোরায়া যেন অন্য এক মানুষ। গরম পানিতে গোসল সেরে শরীরটা ঝরঝরে করলেও মাথার ভেতরটা অস্থিরই রয়ে গেল। রামিলা চৌধুরীর ডাকে ডাইনিং টেবিলে বসে ভাত খেয়ে ছিল, কিন্তু প্রতিটা কাঁটা–চামচের শব্দ যেন দূরের কোনো অচেনা জায়গা থেকে আসছিল। খাবারের স্বাদ পর্যন্ত যেন বোঝাই গেল না।
খাওয়া শেষ হতেই সোজা নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে দিয়ে বসে আছে।
ঘরটা নিঃশব্দ—শুধু জানলার বাইরে রোদের আলো আর হালকা বাতাসের ঝাপটা। কিন্তু সোরায়ার ভেতরটা একেবারে তোলপাড়।

তার চোখ বন্ধ করলে ভেসে উঠছে মাহিরের চেহারা। সেই দুপুরবেলার মারামারির দৃশ্য—যেভাবে তিনজন ছেলেকে নির্দ্বিধায় ঘায়েল করা দৃশ্য , সেই দৃঢ়তা, সেই কণ্ঠের জোর—সবই তাকে অবাক করে দিয়ে গেছে। তার মনে হচ্ছিল যেন কোনো সিনেমার হিরোকে সামনাসামনি দেখছে সে।
হঠাৎ বুকের ভেতরটা কেমন যেন কাঁপতে লাগল। মনে হচ্ছিল প্রথমবারের মতো জীবনে কারও দিকে এতটা টান অনুভব করছে।
টেবিল থেকে বই টেনে নিল, খাতাটা খুলল, কলম হাতে নিল। পড়ার চেষ্টা করল—কিন্তু চোখে লেখা পড়ছে, মাথায় কেবল মাহিরের মুখ ভাসছে। প্রতিটা পাতার শব্দ মিলিয়ে যাচ্ছে, আর তার জায়গায় ভেসে উঠছে মাহিরের ভঙ্গি, তার চওড়া কাঁধ, তীক্ষ্ণ চোখের দৃষ্টি।
তারপরই থেমে গেল। চমকে উঠে কলমটা ফেলে দিল। হালকা লজ্জা আর অদ্ভুত উত্তেজনা মিলেমিশে তার ভেতরটা ভরে গেল।

বিছানায় শুয়ে একবার ছাদে তাকাল, আবার জানলার বাইরে। কিন্তু মনটা যেন কোথাওই নেই। কেবল মনে হচ্ছে মাহিরের কণ্ঠস্বর কানে বাজছে—
“এইটা করা উচিত ছিল?”
এই একটা সংলাপ যেন বারবার ভেসে উঠছে। প্রতিবার মনে করে তার ঠোঁটে অজান্তেই মৃদু হাসি খেলে যাচ্ছে।
কিন্তু হাসির আড়ালে বুকের ভেতরে এক ঝড়। নতুন এক অনুভূতি, নাম না জানা এক টান। সোরায়া যেন নিজের ভেতরে ডুবে যাচ্ছিল। সে হঠাৎই আয়নার সামনে গিয়ে আপন মনে নিজের লম্বা চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে গান গাইতে লাগলো-
“লাল বাজারে গলির মোড়ে ,
পান দোকানের খরিদ্দার ।
বাকের আলীর আদুরে মেয়ে ,
নাম ছিল তার গুলবাহার।”
হঠাৎ এই পিছন থেকে মিরায়া সোরায়ার গানের ব্যঙ্গ করে একই গানের সুরে গায়ে উঠলো-

“পরীক্ষাতে যদি তুমি ,
ফেল করো আরেকবার।
মামণিকে বলে মার খাওয়াব,
গান তো গাওয়া হবে না আর।”
সোয়ারা আশ্চর্য ও বিরক্ত হয়ে মিরায়ার দিকে তাকায়।
মিরায়ার কণ্ঠ শুনেই সোরায়ার মন অন্যদিকে ঘুরল। মিরায়া একেবারে ঝড়ের মতো ভেতরে ঢুকে পড়ল। মুখভর্তি খুশির হাসি, চোখে অদ্ভুত উচ্ছ্বাস।
— “তোকে একটা বিশাল খবর দেই… জানিস? আমি… আমি ঢাকার বড় বাইক রেসের জন্য সিলেক্টেড হয়েছি!”
কথাটা বলে মিরায়া লাফিয়ে উঠল প্রায়। তার কণ্ঠে এত আনন্দ, এত গর্ব—যেন পৃথিবীর সেরা পুরস্কার সে পেয়ে গেছে।
সোরায়া এক মুহূর্ত হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইল বোনের দিকে।

— “কি… সত্যি? তুই… তুই সিলেক্টেড?!”
— “হ্যাঁ! আজকে কল আসছিল, ওরা আমার নাম লিস্টে দিয়েছে। মানে ভাবতে পারছিস, পুরো ঢাকার এত বড় রেসে চট্টগ্রাম থেকে আমিই সিলেক্টেড হয়েছি! এটা আমার লাইফের সবচেয়ে বড় সুযোগ সোরা! বনু যে আমি তো বিশাল খুশি।”
মিরায়ার চোখে ঝিলিক খেল। সে যেন নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিল না। উত্তেজনায় হাত-পা নাড়ছিল, বিছানার উপর বসে এক নিঃশ্বাসে সব বলেই যাচ্ছিল—কোথায় রেস হবে, কবে হবে, কারা অংশ নেবে।
সোরায়া ধীরে ধীরে হাসল। তার ভেতরে তখনও মাহিরের ছায়া ঘুরছিল, কিন্তু বোনের এত বড় খবর শুনে সে নিজের চিন্তাগুলো সামলে নিয়ে বলল—

— “আমি তোকে নিয়ে কত গর্ব আপু! কিন্তু… সেটা প্রকাশ করতে পারি না কারো সামনে?”
মিরায়া হঠাৎ থেমে গেল। চোখের ঝিলিক মুহূর্তেই গম্ভীরতায় ঢাকা পড়ল।
— “তুই জানিস তো, চাচা-চাচি কখনো মানবে না। আর…” সে একটু থেমে নিঃশ্বাস নিল, মনে মনে- “…রায়ান ভাইয়া আজ যেন রূপ দেখালো যদি জানতে পারে, কেমন রিঅ্যাক্ট করবে কে জানে।”
এই বলে মিরায়া ঠোঁট কামড়াল। উচ্ছ্বাসের ভেতর একটা ইতস্তত ভাব ফুটে উঠল।
সোরায়া মিরায়ার দিকে তাকিয়ে বলল—

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১০

— “চিন্তা করিস না। তুই এখন শুধু নিজের ড্রিমটার দিকে মন দে। বাকিটা আমরা ম্যানেজ করব।”
মিরায়া এক লাফে সোরায়াকে জড়িয়ে ধরল। তার চোখে তখনও আনন্দের ঝিলিক, কিন্তু কোথাও একটা চাপা ভয় কাজ করছিল। তবু সেই মুহূর্তে সে শুধু খুশিটুকুই ভাগ করে নিতে চাইল বোনের সাথে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here