আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১২
অরাত্রিকা রহমান
বিকেলের প্রায় তিনটার কিছু পর রুদ্র গাড়ি চালানো শুরু করেছিল- রায়ানের আদেশ অনুযায়ী রিমিকে তার বাড়িতে পৌঁছে দিতে । শহরের রাস্তা তখনও ভিড়ে ঠাসা, তবে দুপুরের তেজ কমে আসায় বাতাসে এক ধরনের শীতলতা ঢুকে পড়েছিল। গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের আলো-ছায়া খেলা করছিল।
রিমি পাশের সিটে চুপচাপ বসেছিল। জানালার কাঁচ নামানো ছিল, কিন্তু সে বাইরে তাকিয়ে থাকলেও তার মুখে কোনো স্বাভাবিক স্বস্তি নেই। ঠোঁটগুলো একসাথে চেপে রেখেছে, আঙুল দিয়ে বারবার চুল গুটাচ্ছে, আবার ফেলে দিচ্ছে। চোখে-মুখে সেই দুষ্টুমি ভরা কৌতুকপূর্ণ হাসি নেই, বরং অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট।
রুদ্র তাকে তার ঠিকানা জিজ্ঞেস রাতে সে কোনো উত্তর না দিয়ে প্রথমদিকে শুধু রুদ্রকে বলে দিচ্ছিল—“এখানে বাঁ দিকে যান”, “ওইখানে সোজা যান”—কিন্তু কণ্ঠে একরকম দ্বিধা ভরা সুর ছিল। যেন ঠিক কীভাবে রাস্তাটা বুঝিয়ে দেবে সেটা নিয়েই অনিশ্চিত। মাঝে মাঝে চুপ করে যাচ্ছিল, আবার একটু পরে বলছিল অন্যদিকে ঘুরতে।
রুদ্র প্রথমে ভাবল, হয়তো এলাকা জটিল, তাই রিমি একটু কনফিউজড। কিন্তু এক ঘণ্টা পার হয়ে গেলেও গন্তব্যে না পৌঁছাতে গিয়ে তার ধৈর্য্য ভাঙতে শুরু করল। গাড়ির ভেতরে তখন নিস্তব্ধতা, শুধু ইঞ্জিনের শব্দ আর বাইরের যানবাহনের হর্ন ভেসে আসছিল।
প্রায় চারটার দিকে, বিরক্তি চেপে রাখা আর সম্ভব হলো না রুদ্রর।
সে ভ্রু কুঁচকে কিছুটা শক্ত সুরে বলল—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “আমরা এক ঘণ্টা ধরে গাড়িতে ঘুরছি। কিন্তু এখনো আপনার বাসা খুঁজে পাচ্ছি না। আপনি যদি কাইন্ডলি সঠিকভাবে ঠিকানাটা বলে দেন, তাহলে আমার জন্যও সহজ হয়।”
রিমি হঠাৎ একটু চমকে উঠল, যেন রুদ্রর কণ্ঠে ধরা সেই বিরক্তি তাকে আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিল। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল, কিন্তু চোখে-মুখে শান্তি নেই। হালকা ভ্রু কুঁচকে গেল, ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশ্বাস ফেলল।
তারপর বললো – সামনে কামরাঙ্গীরচর বলে যে এলাকা আছে সেখানে আমার বাড়ি ।
রুদ্র রিমির কথায় সেই দিকে গাড়ি নিয়ে গেল। একটা এলাকায় ঢুকতেই রিমি সরু একটা রাস্তার দিকে আঙ্গুল নির্দেশ করে সেটার ভেতরে যেতে বলল। রুদ্র রিমির দেখানো শুরু রাস্তা ধরে এগোতে থাকে। রাস্তাটা এতই ছোট ছিল যে পরবর্তীতে গাড়ি ঘোরানো সম্ভব হবে কিনা সেটা নিয়ে রুদ্র খানিকটা চিন্তায় পড়ে গেল।
এলাকাটা ছিল নিস্তব্ধ, ময়লা আবর্জনা ধারা আচ্ছাদিত যেটার থেকে খুব বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে। রুদ্র সামান্য আশ্চর্য হলো যে রিমির মত একটা মেয়ে এমন একটা পরিবেশে থাকে। তবে যেহেতু সে রিমি কে চেনে না তাই তোয়াক্কা করলো না।
হঠাৎ পুরোনো একটা টিন সেট বাড়ির কাছা কাজি এসে রিমি রুদ্রকে আস্তে বলল,
— “এসে গেছি। আরেকটু সামনে গেলেই হবে।এখানে নামিয়ে দিন আমি চলে যাবো। ধন্যবাদ আপনাকে এতদূর আসার জন্য।”
তার কথার ভেতরে কোনো উচ্ছ্বাস নেই, বরং এমন শোনাল যেন সে চাইছে না রুদ্রর চোখে তার বাসার চারপাশ ধরা দিক। রুদ্র লক্ষ্য করল, ওর কণ্ঠে একরকম টানটান টেনশন আছে। চোখে যেন ভাসছে একধরনের ইতস্তত, ভয়, আর ভেতরে ভেতরে লুকানো অস্বস্তি।
রুদ্র একটু দায়িত্ববোধ থেকে বলল-
“এত দূর যেহেতু আস্তে পেরেছি আর একটু সামনে এগিয়ে আপনাকে বাড়ির সামনে নামিয়ে দিতে আমার কষ্ট হবে না।”
রুদ্র তার কথা শেষ করে গাড়িটা সরু গলির ভেতরে ঢুকিয়ে ওই পুরোনো টিন সেট বাড়ির সামনে যেতে থাকলো, রিমি তখন আরও অস্থির হয়ে উঠল। হাত দিয়ে চুল ঠিক করছে, বারবার আঙুল মুঠো করে আবার ছাড়ছে। তার দেহভঙ্গিতে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, সে চাইছে না রুদ্র একেবারে তার বাসার গেট পর্যন্ত নিয়ে যাক।
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপ করে ওর দিকেই তাকাল পাশ থেকে। মনে হচ্ছিল, রিমির আচরণে যেন কোনো অজানা রহস্য আছে। বাইরে বিকেলের আলো ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে আসছে, দোকানগুলোতে লাইট জ্বলে উঠেছে, আকাশে সূর্যের সোনালি রঙ মিলিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু গাড়ির ভেতরে তখনও অস্বস্তির এক চাপা পরিবেশ টের পাওয়া যাচ্ছিল।
রিমি ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে জানালার বাইরে তাকিয়ে বলল,
— “কাছেই এসে গেছি। একটু সামনে নামিয়ে দিলেই হবে।”
তার কণ্ঠ এবার আরও নিচু, আরও দ্বিধায় ভরা। যেন সে মরিয়া হয়ে চাইছে না রুদ্রর চোখ তার বাসার আঙিনা বা তার পারিপার্শ্বিক পরিবেশে পৌঁছে যাক।
রুদ্র কিছুক্ষণ নীরব রইল। চোখে স্পষ্ট বিরক্তি, তবে মনের ভেতরে এক প্রশ্নও জেগে উঠল—রিমি এত ইতস্তত করছে কেন? কী এমন আছে ওর বাসার আশেপাশে, যা সে কাউকে দেখাতে চায় না?
রুদ্র রিমির কথা তোয়াক্কা না করে সোজা সেই বাড়ির সামনে দিয়ে থামলো।
গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গেই রিমি যেন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর প্রায় হকচকিয়েই দরজার লক খুলে ফেলল। তাড়াহুড়ো করে গাড়ির দরজা ঠেলে নেমে গেল। তার নড়াচড়ায় বোঝা যাচ্ছিল, যেন সে আর এক মুহূর্তও ভেতরে বসে থাকতে চায় না।
রুদ্র অবাক হয়ে তাকাল। এত তাড়াহুড়োর কী আছে? সে দরজা খুলে নেমে আসার আগেই রিমি দুই পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। তারপর একটু অস্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাত জোড় করে হালকা হাসির ভেতরে বলল—
— “অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। সত্যিই কষ্ট করেছেন আমাকে পৌঁছে দিতে। এখানে নেমেই ঠিক আছি আমি… আপনি আর বিরক্ত হবেন না, প্লিজ। চলে যান।”
কথাগুলো বলতে বলতে তার চোখ এদিক-ওদিক ছুটছিল, যেন ভেতরের অস্বস্তি চেপে রাখার চেষ্টা করছে। তার গলায় কৃতজ্ঞতার সুর থাকলেও আচরণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল, রিমি মরিয়া হয়ে চাইছে রুদ্র এক মুহূর্তও আর দাঁড়িয়ে না থাকুক।
রুদ্র ধীরপায়ে গাড়ি থেকে নামল। ঠান্ডা গলির বাতাসে শার্টের কলার দুলে উঠল। সে অবাক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ধীর কণ্ঠে বলল—
— “আপনার কিছু তো হচ্ছে না তো? আপনি এমন কেন করছেন? আমি তো যাচ্ছিই।”
তার গলায় কোনো রাগ নেই, বরং মিশে আছে এক অদ্ভুত কৌতূহল আর সামান্য বিস্ময়।
রিমি মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল, উত্তর দিল না। শুধু হাত দিয়ে ইশারা করল—“চলে যান।” যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর উপস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে চাইছে।
রুদ্র রিমির সাদা চেহারার দিকে তাকালো যেনো এক ফোঁটা রক্ত ও নেই। তার পর প্রথম বারের মতো রিমির সর্বাঙ্গে চোখ বুলিয়ে নিল- শীর্ণ দেহ , ফেকাশে সাদা রং যেন শরীরে রক্ত নেই, চুল গুলো পিঠ পর্যন্ত তাও যেন বহু অযত্নে রয়েছে। রুদ্র রিমিকে এক নজর দেখেই চোখ সড়িয়ে নিল।
রুদ্র এক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে থেকে চুপচাপ মাথা নাড়ল রিমিকে এই ইঙ্গিত করে যে- সে চলে যাচ্ছে।
রুদ্র গাড়ির দিকে এগতেই হঠাৎ কর্কশ একটা গলার আওয়াজ কানে এলো।
— “এই মা*গী! এখন বাড়ি ফিরলি? সারাদিন কোথায় ছিলি তুই? রাস্তায় রাস্তার নষ্টামি করছ, কার গাড়িতে ঘুরে বেড়াস?”
রুদ্র অবাক হয়ে তাকাল। টিনের ঘরের দরজা ঠেলে বাইরে বেরিয়ে এসেছে এক যুবক—চেহারায় রুক্ষ ভাব, চুল এলোমেলো, চোখ লালচে। দূর থেকে দেখলেই বোঝা যায় মদের নেশায় টলছে। মুখ থেকে বাজে গন্ধ ছড়াচ্ছে।
রিমি স্থির দাঁড়িয়ে গেল, ভয়ে কেঁপে উঠল শরীরটা। তবু ঠোঁট কামড়ে সাহস নিয়ে বলল—
— “ভাইয়া, এভাবে কথা বলো না। আমার দেরি হয়ে গেছে, তাই বলে—”
কথা শেষ করার আগেই ছেলেটা আরও খারাপভাবে চেঁচিয়ে উঠল।
— “চুপ! বে*শ্যা মা*গী! সারাদিন পুরুষমানুষের সাথে ঘুরে বেড়াস, আর বাড়ি এসে আমাকে জ্ঞান দিস? কার গাড়িতে ঘুরে আসলি তুই? ওই যে দাঁড়ায়ে আছে ওকেই ধরেছিস? হ্যাঁ?”
তার চোখ এবার সরাসরি গিয়ে পড়ল রুদ্রর ওপর। ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।
— “এই যে সাহেব, আপনি তো খুব ভদ্র মুখ করে দাঁড়াইছেন। জানেন নাকি, এই মেয়ে মানুষের আসল চরিত্র কী? সারাদিন রাস্তায় পুরুষ বদলায়!”
রিমি তীব্র কণ্ঠে কেঁপে উঠল—
— “ভাইয়া, চুপ করো! এসব বাজে কথা বলবে না। একজন অপরিচিত মানুষের সামনে আমাকে অপমান কোরো না।”
কিন্তু তার ভাই আরও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল।
— “তোর মত নষ্ট মায়ের মেয়েকে আর কীভাবে বলব? তুই যদি আমাদের বাড়ির মান রাখতি, তাহলে আজকে পুরুষের গাড়ি থেকে নামতি না।”
এরপর আচমকাই হাত উঠিয়ে দিল। এক থাপ্পড় সজোরে এসে পড়ল রিমির গালে।
“চরিত্রহীন মেয়ে মানুষ!”
রিমির মাথা ঝাঁকুনি খেয়ে গেল, শরীরটা ভারসাম্য হারিয়ে পাশের দিকে হেলে পড়ল। ঠিক তখনই রুদ্র এগিয়ে এসে তাকে শক্ত হাতে ধরে ফেলল। রিমির মাথা এসে ঠেকল রুদ্রর বুকের ওপর। বুকের ভেতর দমকা ধুকপুকানির শব্দ যেন কানে বাজতে লাগল।
রিমির চোখে জল গড়িয়ে পড়ছে, সে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে কাঁপা গলায় বলল—
— “প্লিজ… আপনি এখান থেকে চলে যান। আমার জন্য আর নিজের ঝামেলায় জড়াবেন না। আমি সামলে নেব। চলে যান।”
রুদ্র গভীর শ্বাস নিয়ে মাথা নাড়ল নাসূচক, গলায় দৃঢ়তা—
— “আপনি কি বলছেন এসব, রিমি। এভাবে আপনার সঙ্গে আচরণ করার কোনো অধিকার ওনার নেই। আমি অন্যায় দেখে প্রতিবাদ না করে কিভাবে আপনাকে এইভাবে রেখে যাব?”
তার গলায় ভদ্র অথচ স্পষ্ট প্রতিবাদের সুর। সে “আপনি” বলেই সম্বোধন করল, যেন বোঝাতে চাইছে—সম্মানের জায়গা থেকে কথা বলছে।
কিন্তু রিমির ভাই ততক্ষণে আরও ক্ষেপে উঠেছে। চোখ লাল করে চেঁচিয়ে উঠল—
— “তুই কি রে আমার বোনের দালালি করবি? হেঁ? তুই আবার কে রে যে আমাকে শেখাবি?”
অকথ্য গালি ছুঁড়ে দিল রুদ্রর দিকে। তার হাত মুঠো পাকিয়ে এগিয়ে আসছিল, যেন মারতে উদ্যত।
রিমি শক্ত হয়ে ততক্ষনাৎ রুদ্র কে নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে তার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে-
“যা বলার আমাকে বলো। উনি ভদ্র লোক আমাকে সাহায্য করতে এখানে নামিয়ে দিতে এসেছেন। উনাকে কিছু কোরো না।”
রুদ্র রিমির পিছন থেকে বলল তাচ্ছিল করে হেঁসে-
“এর মতো মাতাল আমাকে কি করবে? দাঁড়িয়ে আছি এখানেই কি করবে করতে বলুন।”
রিমি এবার ভেঙে পড়ল। সে রুদ্রর হাত শক্ত করে চেপে ধরল, কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে কান্নার ভেতরেই চিৎকার করল—
— “না! প্লিজ, আপনি যান। আমি বলছি, চলে যান এখান থেকে। আমি চাই না আপনার জন্য আমার দাদা আরও কিছু করে বসুক। প্লিজ, চলে যান!”
রুদ্র অসহায় হয়ে অসহায় রিমির কান্না ভেজা চোখে তাকিয়ে বলল-
“রিমি আপনি…!”
রুদ্র সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলো না রিমির ভেজা চোখের আকুতি, কাঁপা ঠোঁট আর মরিয়া অনুরোধ রুদ্রকে থামিয়ে দিল। সে দাঁড়িয়ে রইল এক মুহূর্ত, বুক ভরা রাগ দমিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে মাথা নিচু করে গাড়ির দিকে ফিরে গেল।
রিমি দাঁড়িয়ে রইল ফাটা গলির আলো-আঁধারিতে, ভেজা চোখে তাকিয়ে রইল দূরে চলে যাওয়া রুদ্রর পেছনের দিকে। আর ভেতরে তার বুকটা কেঁপে কেঁপে উঠছিল—দুঃখে, ভয়ে আর অদ্ভুত এক অপরাধবোধে।
রিমির ভাই রিমিকে ঐ কান্নারত অবস্থায় রেখে তার ব্যাগটা ছিনিয়ে নিয়ে ব্যাগ থেকে সব টাকা নিয়ে বাড়ি থেকে চলে গেল।
বিকেলটা ধীরে ধীরে গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে এগোচ্ছে। আকাশের রঙ তখন গাঢ় কমলা, চারদিকের পরিবেশে হালকা শীতলতা নামতে শুরু করেছে। বাড়ির ভেতরে নরম বাতাস ঢুকছে খোলা জানালা দিয়ে।
মিরায়া বিকেলটা তার রুমেই কাটিয়েছিল সোরায়ার সাথে। বাইক রেসের খবরটা শেয়ার করার পর দু’জনেই অনেকক্ষণ উচ্ছ্বাসে কাটিয়েছে। তবে একসময় সোরায়া নিজের পড়াশোনায় ব্যস্ত হয়ে গেলে মিরায়ার মনে পড়ল নিচের ফ্রিজে ফল আর জুস রাখা আছে। সারাদিন প্রায় কিছু খাওয়া হয়নি, তাই একটু কিছু আনতে নামা দরকার বলে সে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নামতে লাগল।
ড্রয়িংরুমে তখন রামিলা চৌধুরী সোফায় হেলান দিয়ে বসে ছিলেন। হাতে একটা বই, পাশে চা-টা সাজানো টেবিলে। মিরায়াকে সিঁড়ি দিয়ে নামতে দেখে তিনি অবাক হলেন। মুখটা খানিক বিস্ময়ে ভরে উঠল।
মিরায়াকে দেখেই রামিলা হালকা বিস্ময় নিয়ে বললেন—
– “মিরা মা ! তুই ঢাবি থেকে কখন ফিরলি?”
মিরায়ার মুখে হালকা হাসি। সে ধীরে ধীরে রামিলার দিকে তাকিয়ে বলল—
– “এই তো মামনি দুপুরের পরই বিকালের দিকে এসেছি।
রামিল চৌধুরী- “কই দেখলাম না যে তোকে আসতে। কিভাবে এসেছিস? কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
মিরায়া রায়ানের তার উপর সেই অধিকার বোধ প্রকাশের অদ্ভুত কথা গুলো মনে করল। একবার ভাবলো – সে কি রামিলা চৌধুরীকে বলবে সেসব?
তবে মন সায় দেয়নি বলে সে কিছু না বলে কেবল বলল-
“না মামণি কোনো সমস্যা হয় নি রায়ান ভাইয়া আমাকে নিয়ে এসেছে ফেরার পথে।”
রামিলা চৌধুরী- “কি! রায়ান নিয়ে এসেছে?”
মিরায়া উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে বলল-
“হুঁ, রায়ান ভাইয়া।”
রামিলা চৌধুরী আর কথা বাড়ালেন না । কারণ তিনি ভেবেই নিয়েছেন এবার রায়ান আর মিরায়া দুজনকেই মুক্ত করে দেবেন সেই অজানা বন্ধন থেকে। সেই ব্যাপারে তার স্বামী (রায়হান চৌধুরীর) সাথে ও কথা হয়েছে। তারা মিরায়ার চাচা চাচির সাথেও এ ব্যাপারে কথা বলবেন বলে ঠিক করেছেন।
রামিলা কথা ঘুরিয়ে একটু এগিয়ে বসলেন, চোখে কৌতূহল আর সন্তুষ্টির মিশ্রণ—
– “ভর্তি কার্যক্রম কেমন হলো? ক্যাম্পাসটা দেখেছিস তো?”
মিরায়ার চোখে আনন্দ আর হালকা অবাক ভাব, ধীরে ধীরে বলল—
– “হ্যাঁ মামনি, সব কাজ ঠিকমতো শেষ হয়েছে। আমি এখন ঢাবিয়ান। আর ক্যাম্পাসটা অনেক বড়, সবুজ আর শান্ত। ভিডিও যে যেমন লাগে তার থেকেও অনেক সুন্দর।আমি তো আমার ক্যাম্পাসের নতুন বান্ধবকে নিয়ে অনেক ঘুরেছি।”
রামিলা হেসে বললেন,“জাক সব ভালো হলেই ভালো। ভালো করেছিস ঘুরে। নিজের জন্যও কিছু সময় নিচ্ছিস, সেটা দেখেই ভালো লাগছে। আচ্ছা রায়ানের সাথে কি রুদ্র ও ছিল। রুদ্র তো রায়ানের সাথেই দেখা করতে গিয়ে ছিলো।”
মিরায়ার মনে পড়ে ক্যাম্পাসের ঝগড়ার কথা। আর রায়ান তাকে ওই জায়গা থেকে নিয়ে আসার সময় রুদ্র কে রিমির বাড়িতে রিমিকে পৌঁছে দিতে বলেছিল সেই কথা।
কিন্তু মিরায়া ঝগড়ার কথা বললে রামিলা চৌধুরী চিন্তায় পড়ে যাবেন বলে সেই সম্পর্কে কিছু না বলে কেবল বলল-
“হ্যাঁ মামণি, রুদ্র ভাইয়া ও সাথে ছিলো। আসলে দেরি হয়ে গেছিল তাই রায়ান ভাইয়া আমাকে নিয়ে এসেছে আর রুদ্র ভাইয়াকে আমার বান্ধবী রিমিকে পৌঁছে দিতে বলেছিল। হয়তো রুদ্র ভাইয়া রিমিকে পৌঁছে দিয়ে বাড়িতে ফিরছে এখন। চলে আসার কথা।”
রুদ্রর চোখে যেন আগুন জ্বলছিল। গাড়ি চালানোর সময় তার দু’হাত স্টিয়ারিং চেপে ধরেছিল এত জোরে যে আঙুলের গাঁট সাদা হয়ে উঠেছিল। শ্বাস ভারি হয়ে আসছিল, আর প্রতিবার শ্বাস নিতে নিতে বুকের ভেতর জমা হচ্ছিল একরাশ ক্রোধ। হঠাৎ সে স্টিয়ারিংয়ে প্রচণ্ড জোরে এক ঘুষি মারল—“ঠাস!” শব্দে গাড়ির ভেতর প্রতিধ্বনি হয়ে উঠল।
গাড়ির স্পিড বেড়ে গেল দ্বিগুণ। শহরের রাস্তাগুলো ঝাপসা হয়ে পেছনে ছুটে যাচ্ছিল। হর্ন, হেডলাইট, মানুষের ভিড়—কোনো কিছুই যেন আর চোখে পড়ছিল না। শুধু বুকের ভেতর দপদপ করে উঠছিল রাগ, অপমান আর একটা অদ্ভুত অস্থিরতা।
শেষমেশ এক ঝটকায় গাড়িটা চৌধুরী বাড়ির গেট পার হয়ে ঢুকল। ব্রেক কষতেই টায়ারের ঘর্ষণে কিঞ্চিৎ ধোঁয়া উঠল। সে গাড়ির দরজা জোরে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে এলো, পা চালাচ্ছিল যেন যুদ্ধ করতে যাচ্ছে।
বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই ড্রইংরুমে আলো জ্বলছিল। ভেতরে রামিলা চৌধুরী আর মিরায়া সোফায় বসে ছিল। দুজনেই মেয়েলি কোনো কথোপকথনে মগ্ন, হাসছিল হালকা করে।
রুদ্র হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকতেই রামিলা চৌধুরী মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। চোখে একটুখানি অবাক ভাব—
— “রুদ্র, এতক্ষণ কোথায় ছিলি? তোকে কোথাও খুঁজে পাচ্ছিলাম না।”
রুদ্র দাঁড়িয়ে রইল, তার দম নেওয়া ভারি হচ্ছিল, কপালে ঘাম জমে আছে। কিন্তু কোনো উত্তর দিল না। শুধু ঠোঁট শক্ত করে চেপে ধরল, যেন একটাও শব্দ বের হলে বিস্ফোরণ ঘটবে।
রামিলা চৌধুরী প্রথমে খানিকটা বিরক্ত হলেন, কিন্তু মুহূর্ত পরেই গলাটা নরম করলেন।
— “আচ্ছা, যাই হোক… যেখানেই ছিলি থাক। এখন ফ্রেশ হয়ে আয়। খাবার বাড়ছি খেয়ে নে।”
রুদ্র ধীরে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে মায়ের দিকে তাকাল, চোখে তখনও ঝড়। গম্ভীর, ভারি কণ্ঠে বলল—
— “আমার খিদে নেই। আমি এখন খাব না।”
এই বলে সে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেল। প্রতিটা পা যেন ভারি হয়ে যাচ্ছিল, তবু দ্রুত উঠতে লাগল। সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে হঠাৎ পিছন ফিরে তাকাল মীরার দিকে।
— “মিরা… আর এক ঘণ্টা পর আমার রুমে আসিস। তোর সাথে আমার তোর বান্ধবী কে নিয়ে কিছু কথা আছে।”
মীরা অবাক হয়ে গেল। তার চোখে কৌতূহল আর অল্প ভয়ের ছাপ ফুটে উঠল।
মিরায়া- “কেন ভাইয়া? রিমিকে নিয়ে আবার কি হলো?”
রুদ্র একটুও থামল না, কোনো ব্যাখ্যাও দিল না। সোজা উপরে উঠে গেল, যেন দুনিয়ার সব ভার তার কাঁধে চেপে বসেছে।
রুদ্র রাগের উত্তাপে দ্রুত, গটগট করে সিঁড়ি দিয়ে উপরের দিকে উঠছিল। ঠিক সেই সময়, রায়ান তার রুম থেকে ফ্রেশ হয়ে নামছিল। কালো টি-শার্ট আর আরামদায়ক ট্রাউজার তার ফিটনেস আর শরীরের আকৃতি সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলছিল।
সিঁড়িতে এক মুহূর্তে দুইজনের কাঁধের সঙ্গে হালকা সংঘর্ষ হয়। রায়ান ক্ষীণভাবে হেসে, হালকা অবাক চোখে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলে, “কিরে! কোত্থেকে এলি? এত দেরি হল, কোথায় ছিলিস?”
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১১
রুদ্র কিছু বলার আগে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। তার চোখে কোনো বিরক্তি নেই, শুধু দ্রুত যাওয়ার ইচ্ছা। রায়ান কিছুক্ষণের জন্য স্থির হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে বুঝতে পারে, ধাক্কা শুধু এক আকস্মিক ঘটনা, আর রুদ্রের অভ্যন্তরীণ মনোভাবের কোনো প্রভাব নেই।
রায়ানের মুখে হালকা বিস্ময় আর নীরবতা—এক ধরনের “ওর আবার কী হলো হঠাৎ” (মনে মনে) ভাব ফুটে ওঠে।