আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৫
অরাত্রিকা রহমান
রুদ্রর ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময় মিরায়া ঠিকি ছিল তবে হঠাৎ গায়ে অদ্ভুত ভার জমে আসে। চোখে-মুখে অস্থিরতা, ঠোঁট কামড়ে সে করিডোরে পা বাড়াল। করিডোরটা তখন নীরব, দেয়ালের লাইটগুলো হলুদ আলো ফেলে চারপাশে অদ্ভুত এক আবহাওয়া তৈরি করছিল। দূরে কোথাও ঘড়ির টিকটিক শব্দ কানে বাজছিল।
হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎই তার মাথার ভেতরে রায়ানের রুমে ঘটে যাওয়া ঘটনাটা ফিরে এলো— “রায়ানের কাছাকাছি থাকলে তার মনে এমন অপ্রত্যাশিত অনুভূতি, রায়ানের তার প্রতি অধিকার বোধ, তাকে উদ্দেশ্য করে অদ্ভুত নেশাগ্রস্ত কথা” কিছুরই যেন যোগসূত্র খুঁজে পাচ্ছে না মিরায়া।
সেই মুহূর্তটা মনে পড়তেই শরীরের ভেতর হালকা শিরশিরে ভয় বয়ে গেল। মনের ভেতর একটা দ্বিধা তৈরি হলো—সে যদি আবার সামনে এসে পড়ে?
ঠিক সেই সময় করিডোরের অপর দিক থেকে দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসছিল রায়ান। হাঁটার ভঙ্গিটা যেন সৈনিকের মতো—প্রতিটি ধাপে দৃঢ়তা, প্রতিটি শ্বাসে আত্মবিশ্বাস। দূর থেকেই তার উপস্থিতি টের পাওয়া যাচ্ছিল।
চোখাচোখি হলো দু’জনের।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
মিরায়ার পা যেন মাটিতে আটকে গেল। বুকের ভেতর হালকা ধকধক আওয়াজ। চোখে অস্বস্তির ছাপ স্পষ্ট।
রায়ানও থামল। তার কালো চোখে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, কিন্তু ভেতরে কোথাও এক চিলতে অপরাধবোধ ফুটে উঠল। কারণ, রায়ানের চোখে পড়লো মিরায়ার মনের সেই ভীতির ছাপ। —“হয়তো সন্ধ্যার ঘটনার জন্যই এখনো এভাবে অস্বস্তি বোধ করছে সে…”
সে বুঝতে পারছিল মিরায়ার চোখের ভেতর লুকোনো আতঙ্কটা। তবুও নিজের শক্ত অবস্থান ভাঙল না। দৃঢ়তা রেখেই বলল-
“কোথায় গেছিলে?”
মিরায়া রায়ানের প্রশ্নের কারণ বুঝলো না তবে উত্তর করল- ঠিকই –
“রুদ্র ভাইয়া ডেকে ছিল তাই ভাইয়ার সাথে দেখা করতে গেছিলাম।”
রায়ান পাল্টা প্রশ্ন করে-
“রুদ্র তোমাকে কেন ডেকেছে? কিছু কি হয়েছে ?”
মিরায়া স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর দেয় –
“উঁহু, না তো, কিছু হয় নি ভাইয়া আমাকে রিমির খবর নিতে ডেকে ছিল ও বাসায় যাওয়ার পর আর কথা হয়নি তাই ঠিক আছে কি না জানার জন্য।”
মিরায়া রায়ানের চোখে চোখ রাখতে চাইছিল না তাই চোখ নামিয়ে নিল। ঠোঁট হালকা নড়ল, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। কাঁধের উপর খোলা চুল সামান্য উড়ে তার মুখের পাশে পড়ে গেল। রায়ান সেই দৃশ্যের মধ্যে হারিয়ে যেতে যেতে আবার দ্রুত নিজেকে সামলে নিল।
এক মুহূর্ত পরে রায়ান এক পা এগিয়ে এল, হালকা গলা নামিয়ে বলল—
“মাই মিসেস…” — তারপর থেমে গেল। শব্দগুলো যেন কণ্ঠে আটকে গেল।
মিরায়া দ্রুত চোখ তুলে তাকাল, তার ঠোঁটে একটুখানি অস্বস্তিকর ভাব খেলে গেল।- “মিসেস..?” (হালকা গলায় আওড়ালো কিন্তু সে কোনো উত্তর দিল না। কেবল ধীরে ধীরে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে উদ্যত হলো।
রায়ান মিরায়ার ডান হাত ধরে ফেলে পিছন থেকে এবং মৃদু টানে আবার নিজের সামনে নিয়ে আসে। রায়ান ঠোঁটের কোণে হালকা শক্ত হাসি টেনে নিচু গলায় বলল—
“ভয় পেয়েছিলে তখন?”
শব্দটা ছিল ধীর, গম্ভীর, অথচ ভেতরে এক অদ্ভুত নরমতা লুকানো।
মিরায়া এক মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। বুকের ভেতর কেমন একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। চোখ নামিয়ে নিয়ে ঠোঁট সামান্য নড়ল—
“না… মানে… তখন তো হঠাৎ আপনি আসলে…”
কথা শেষ করতে পারল না। গলাটা শুকিয়ে এলো।
রায়ান হালকা হেসে ঠোঁট কামড়াল।
“হঠাৎ নয়, মিসেস।” কণ্ঠে তীক্ষ্ণ আত্মবিশ্বাস। “আমি যা করি ও বলি, সচেতন হয়েই। তা মন গড়া বানোয়াট নয় বরং সত্য।”
মিরায়ার বুক ধক করে উঠল। চোখ তুলতে গিয়েও আবার নিচু করে নিল। শরীরটায় হালকা কাঁপুনি বয়ে গেল। সে বুঝতে পারছিল—লোকটা অন্তত তার জন্য সাধারণ নয়।
কিছুক্ষণ নীরবতা জমে রইল করিডোরে। বাতাস ভারী হয়ে উঠল।
তারপর রায়ানের স্বর হঠাৎ নরম হলো। সে মিরায়ার কানের কাছে মুখ এনে হাসতে হাসতে বলল-
“তবে… যদি তোমার সত্যিই অস্বস্তি হয়ে থাকে, সেটা আমার উদ্দেশ্য ছিল না। তাই বলবো অস্বস্তি অনুভব না করে ফিল করো, হৃদপাখি।
আর নিজের ভালো চেয়ে যদি অস্বস্তি থেকে বের না হয়ে আসো তাহলে সারা জীবন অস্বস্তিতেই থাকতে হবে। বিকোজ, আই এম আ বেড বয়। এন্ড ইউ ওন্ট গেট স্পেয়ারড, মাই হার্ট-বার্ড।”
শব্দটা ছোট হলেও, রায়ানের গভীর গলা কানে ধাক্কা দিয়ে বাজল। মিরায়ার বুকটা কেঁপে উঠল। একদিকে ভয়, অন্যদিকে যেন এক অদ্ভুত নিরাপত্তার অনুভূতিও।
মিরায়া ধীরে উত্তর দিল—
“আমি… আমি তো ভয় পাইনি। শুধু… অদ্ভুত লেগেছিল।”
রায়ানের ঠোঁটে হালকা বাঁকা হাসি ফুটে উঠল।
“অদ্ভুতই তো চাই আমি। সাধারণ কিছুতে যে আমার রুচি মেটে না।”
কথাটা শুনে মিরায়ার বুকের ভেতর অজানা কাঁপন ধরল। শ্বাস আটকে গেল এক মুহূর্তের জন্য। সে কিছু বলতে চাইল, কিন্তু গলা দিয়ে কোনো শব্দ বেরোল না।
রায়ান আর কিছু বলল না। শুধু মিরায়ার টোল পড়া গালটা নিজের হাতের চাপে মৃদু টেনে কঠোর ভঙ্গিতে একপাশ দিয়ে হেঁটে চলে গেল রুদ্রর রুমের দিকে। তবে মিরায়ার কাঁধ ছুঁয়ে এতটাই কাছাকাছি দিয়ে গেল যে তার শরীরের উষ্ণতা মীরার গায়ে গিয়ে লাগল। সেই মুহূর্তে মিরায়ার শরীরের রক্ত যেন হিম হয়ে গেল।
সে স্থির দাঁড়িয়ে রইল করিডোরে। চোখে একরাশ অস্বস্তি, বুকের ভেতর প্রশ্নের ঝড়। অথচ রায়ানের পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে দূরে মিলিয়ে গেল, রেখে গেল কেবল তার শক্তিশালী উপস্থিতির ছাপ আর মিরায়ার অস্থির হৃদস্পন্দন।
রায়ান এক ধাক্কায় দরজা খুলে ঢুকতেই চোখে পড়ল রুদ্র খাটে আধশোয়া। হাতে ফোনটা বুকের কাছে চেপে ধরে আছে, ঠোঁটে মিষ্টি হেসে যাচ্ছে। যেন কোনো কলেজপড়ুয়া ছেলের প্রথম ক্রাশের ফোন এলো মাত্র।
রায়ান ঠোঁটে বাঁকা হাসি টেনে দরজার ফ্রেমে হেলান দিল, কণ্ঠে দুষ্টু ভঙ্গি—
“আরে বাহ! কি রে ভাই, ফোনটাকে কি তোর নয়া বউ ভেবেছিস নাকি? বুকের সাথে এত আঁকড়ে ধরেছিস যে আলাদা করলেই কেঁদে ফেলবে!”
রুদ্র হকচকিয়ে তাড়াহুড়ো করে ফোনটা পাশে টেবিলে ছুঁড়ে রাখল। মুখে বিব্রত হাসি—
“ভাইয়া! এভাবে না ঢুকলে হয় না? অন্তত নক তো করতে পারতে!”
রায়ান এগিয়ে এসে খাটের পায়ার দিকে বসে পড়ল। ঠোঁট কামড়ে কৌতুক মাখা দৃষ্টি ছুঁড়ল রুদ্রর দিকে—
“নক করব ? দুই দিনের ছকড়া আসছে দরজা নক করা শিখাইতে। আমার নিজের ভাইয়ের রুমে ঢুকতে অনুমতি লাগেবে নাকি? নাকি তুই গোপনে ইটিসপিটিস করিস?”
রুদ্র হাত তুলে প্রতিবাদ করল—
“আরে ধুর, একদমই তেমন কিছু না। আমি তো স্রেফ…করে কথা বলছিলাম…মানে.. ”
রায়ান চোখ কুঁচকে ঠাট্টা করল—
“মানেটা কি? ফোনকে বুকের কাছে চাপা দিয়ে লাজুক হাসি দিলে সেটা স্রেফ হয় নাকি? শুন, আমি তোর অনেক বড় আমাকে শেখাতে আসিস না।”
রুদ্র হেসে ফেটে পড়ল। মাথা নেড়ে বলল—
“আরে ভাই, একটু হাসলেই প্রেম হয়ে যায় নাকি? ফোন বুকের কাছে ধরলেই লাজুক ভাব? মিরার ভুত কি তোমাকেও ধরল !”
রায়ান রাগি ভাব নিয়ে বিছানায় থাকা একটা বালিশ হাত দিয়ে তুলে রুদ্রর দিকে ছুড়ে মেরে বলল-
“মিরা না ভাবি ডাক ভাবি লাগে তোর গাধা।”
রুদ্র তার দিকে আসা বালিশ ধরে ফেলে বলল-
” মিরা সোরা দুইজনই আমার ছোট। ওরা আমার বোন। তুমি ভাবি ডাকতে মানা করতে আগে তাই তুই করে ডেকে অভ্যাস হয়ে গেছে। ভাবি ডাকতে ডাকতে আবার এইটা অভ্যাস হয়ে যাবে। কিন্তু সময় তো দিবা।”
রায়ান এবার মুচকি নাটকীয় হাসি হেসে বলে উঠলো-
“তাহলে আমার ভাইয়ের মতো শালা সাহেব, আপনার বোনের মতো ভাবিটাকে আপনার বোন জামাইয়ের মতো বড় ভাইকে দিয়ে দেন। ”
রুদ্র রায়ানের কথা বুঝতে কয়েক মিনিট সময় নেয়। সেই রায়ানের সম্পূর্ণ কথা বোধগম্য হতেই বলল-
“ওমা, আমি কিভাবে দিব। আম্মু আব্বু আর খালামণি-খালুর সাথে কথা বলো। আর তারপর মিরাকে মানে মিরা ভাবিকে মানাও।”
রায়ান বিরক্তি নিয়ে-
“অনেক লম্বা প্রসেস সেটা- আমার বউকে আদর করতে , বাসর সাড়তে, বাচ্চা পয়দা করতে অনেক দেরি হয়ে যাবে। শর্টকাট কিছু বল।”
রায়ানের সোজাসাপ্টা কথাতে রুদ্রর চোখ বড় বড় হয়ে যায় সে ভাবতে পারেনি নিজের গম্ভীর মুখো ভাইয়ের থেকে এমন ঠোঁটকাটা কথা শুনবে।
আশ্চর্যের চূড়ান্ত সীমা থেকেই রাগে রুদ্র বলল-
“তাহলে এক কাজ করো, ভাবির সাথে জোর করে সব করে ফেলো তাহলেই লেটা চুকে যায়।”
রায়ান ভ্রু হালকা নাচিয়ে বলল-
” আইডিয়া খারাপ না অনেক সময় বাঁচবে আমার। তাহলে কি বলিস জোর করে…”
রায়ান নিজের সম্পূর্ণ কথা শেষ করতে পারলো না।
রুদ্র রায়ানের তার রেগে বলা কথা টা সিরিয়াসলি নিবে সে ভাবে নি তাই তার হাতে থাকা বালিশ টা রায়ানের দিকে ছুড়ে মেরে রায়ানকে চুপ করায় আর বলে-
“পাগল নাকি হয়ে গেছ নাকি? কি সব বলছো মিরা ভাবি আমার বোনের মতো আর আমার বোনের সাথে জোর জবরদস্তি আমি মানবো না ।”
রায়ান বিছানা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে রুদ্রর কাঁধে হাত রেখে বলে-
“ওই শালা তোর বোন পরে আগে ওই আমার বউ। আমি আমার বউকে যা ইচ্ছা করবো ।”
রুদ্র কাঁধের থেকে হাত নামিয়ে বলল-
“সেটাই তোমার বউ সে তাই যা ইচ্ছা করো তবে তার অনুমতি নিয়ে তাকে জানিয়ে যে তুমি তার স্বামী।”
রায়ান আবার একইভাবে কাঁধে হাত রেখে বলে-
“ভাই আমার আমি সেটাই করতে চাই আমাকে একটা হেল্প কর। খালি আম্মু কে একটু মেনেজ কর যেন আমি ডিভোর্সের কথা বললে আমাকে আর একবার ভেবে দেখতে বলে। নাইলে মানসম্মান থাকবে না আমার । বাস এই কাজটা করে দে।”
রুদ্র রায়ানের অবস্থা দেখে হেসে উঠে বলে-
“আচ্ছা করবো। তবে আমাকে তোমার সব ডার্ক রোমান্স এর বই দিতে হবে।”
রায়ান চোখ উল্টে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বলে-
“তুই ডার্ক রোমান্স পড়ে কি করবি? ওইগুলো ভালো না, পড়তে হবে না। আর তুই পড়ে ওই গুলো অ্যাপ্লাইড করবি কি তোর তো আর বউ নাই।”
রুদ্র বিরক্ত হয়ে বলল-
“বউ নাই, তবে হবে এক সময় তখন করবো। বউ আছে তাই ভাব নিতেছ, লাগে কতবার মনে হয় বউয়ের সাথে ওমনে রোমান্স করছে, হুঁ।”
রুদ্রর কথার কোনো উত্তর দিতে পারলো না রায়ান। সত্যিই তো এতো কিছু যেনেই বা কি হলো, এ্যাপ্লায় করার জন্য তো বউ থেকেও নেই। রায়ান হতাশ মুখে রুদ্র কে ছেড়ে দিয়ে বলল-
“আচ্ছা ঠিক আছে। দিব সবগুলাই। খুশি? এবার যা আম্মুর কাছে। আম্মু রেগে ফায়ার হয়ে আছে তোর বিকালের আচরণে।”
রুদ্র অবাক স্বরে বলল-
“আমি আবার কি করলাম? আমার উপর রাগ কেন করেছে?”
রায়ান- “তুই খাবার খাসনি তাই। এবার যা, আম্মুর রাগ ভাঙিয়ে ডিভোর্সের কথা তুলে তার পর আম্মু কে বলবি আমি আবার ছাড়াছাড়ির কথা বললে যেন আমাকে আর একবার ভেবে দেখতে বলে। বুঝেছিস?”
রুদ্র কিছু না বলে শুধু মাথা নাড়ালো- ” ঠিক আছে।”
রায়ান রুদ্রর কাঁধে দুইবার ট্যাপ করে বলল –
“এইতো আমার ভাই , বাঘের বাচ্চা। আর হ্যাঁ বেস্ট। ভাইয়ার জন্য ভাবি কনফার্ম করে ফিরবি ওকে?
রুদ্র রায়ানের দিকে তাকিয়ে – “হুঁ, ওকে।”
মিরায়া সোরায়ার রুমে প্রবেশ করতে করতে-
“বনু, আমি এসে গেছি । আয় তোকে অংক বুঝিয়ে দেই।”
মিরায়া এসে দেখে সোরায়া টেবিলের উপরেই মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। আসলে এটা সোরায়ার ছোট বেলার অভ্যাস সে পড়তে পড়তে সব সময় টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে যায় আর পরে মিরায়া ওকে বিছানায় শুইয়ে দেয়।
তবে এমন অসময়ে এমন কখনো হয়নি। রাত হতে না হতেই ঘুমিয়ে গেছে। মিরায়া মিষ্টি হাসি নিয়ে সোরায়ার কাছে আরেকটা চেয়ার নিয়া এসে বসলো। আর সোরায়ার মুখে এসে থাকা চুল গুলোকে কপাল থেকে সরিয়ে নিল। তারপর কপালে একটা চুমু খেয়ে নিল আদর করে। আর বলল-
” আমার সেই ছোট্ট বনটা এখন কলেজে পড়ে ভাবা যায় কত বড় হয়ে গেছে।”
মিরায়ার হাতের ছোঁয়াতে সোরায়ার কাঁচা ঘুম ভেঙ্গে যায়। সোরায়া চোখ খুলে মিরায়ার দিকে তাকিয়ে হেসে তাকে জড়িয়ে ধরে। মিরায়া ও আবেশে সোরায়া কে বুকে জড়িয়ে নিয়ে বলে-
“আমার বনুর কি মন খারাপ?”
সোরায়া মিরায়াকে জড়িয়ে ধরেই মাথা না সূচক নাড়িয়ে বলে-
“উঁহু না তো আপু ।”
মিরায়া আবার প্রশ্ন করে-
“তাহলে আজ এত মন মরা কেন ? পড়ার টেবিলের কি অবস্থা করেছিস।”
সোরায়া হঠাৎ ইচ্ছা করে মুখ ভরে হেঁসে উঠে টেবিলের বই গুছাতে গুছাতে বলল-
“আরে আপু তুমি তো জানোই আমার পড়তে ভালো লাগে না।”
মিরায়া সোরায়ার মাথায় গাট্টা মেরে বলল-
“মুখেই বলিস ভালো লাগে না রেসাল্ট তো মাশাআল্লাহ লেবেল এর।”
সোরায়া আবার হেঁসে বলে-
“আচ্ছা আপু রাত হচ্ছে সময় কম তাড়াতাড়ি অংক গুলো খাওয়াই দেও হজম করতে সময় লাগে আমার অংকের ক্ষেত্রে।”
মিরায়া সোরায়ার কথায় হেসে উঠে তাকে অর্থনীতির চাহিদা
যোগান সমীকরণ অংক বুঝিয়ে দিতে লাগলো।
মিরায়া- “দেখ বনু , কোন জিনিসের দাম যখন কমে তখন সেটা চাহিদা বেড়ে যায়। আবার যখন দাম বেড়ে যায় তখন চাহিদা কমে যায়। যোগানের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্য দাম যখন কমে যায় যোগান তখন কমে যায়। আবার দাম যখন বেড়ে যায় যোগান তখন বেড়ে যায়। বুঝতে পেরেছিল এই লাইন দুটো? এইগুলোই মেইন এটা বুঝতে হবে অংক করতে গেলে।”
সোরায়া মাথা হাত দিয়ে চুলকাতে চুলকাতে মাথা নেড়ে বলল-
“উঁহু বুঝি নি।”
মিরায়া ধৈর্য্য সহকারে বলল-
“আচ্ছা উদাহরণ দিয়ে বুঝাচ্ছি তাহলে বুঝবি। ধর একটা মেয়ে যদি খুব সস্তা মেজাজে থাকে—মানে সব সময় ফোন রিসিভ করে, হাসে, হেলো-হাই করে—
তাহলে ছেলেটা ভাবে, “আরে একে তো অনেক সহজে পাব!” = তখন চাহিদা বাড়ে।
কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ দামি হয়ে গেলে—মানে ফোন ধরে না, উত্তর দিতে দেরি করে, একটু রূঢ় ব্যবহার করে—
ছেলেটা ভাবে, “হুম, অনেক খরচের জিনিস সময় লাগবে, সামর্থ্যে নাই!” = তখন চাহিদা কমে যায়।
আবার একইভাবে ছেলেটা যখন দেখে মেয়েটা তার প্রতি খুব আগ্রহী = সে ফুল, চকলেট, টাইম, সবকিছু বেশি বেশি যোগান দেয়। কিন্তু যদি মেয়েটা মুখ ফেরায় = তখন সে ভাবে, “যত কম দিই, তত কম লোকসান!” = যোগান কমিয়ে ফেলে। এবার বুঝলি?”
সোরায়া উপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে বললো –
“একদম ক্লিয়ার , খাপে খাপ মন্টুর বাপ।”
মিরায়া এর পর এমন মজার ছলে সোরায়াকে সব অংক গুলো বুঝিয়ে দেয়।
পড়া শেষে এক পর্যায়ে সোরায়ার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেলে গেল সে মিরায়া কে জিজ্ঞেস করল-
“এই আপু আমেরিকা ফেরত রায়ান ভাইয়া নেক হেন্ডসাম তাই না বলো?”
মিরায়া সোরায়ার মুখে রায়ানের কথা শুনে একটু অবাক হয়। পরে হাসি মুখে উত্তর দেয়-
“কি জানি, আমি খেয়াল করি নি এখনো। হবে হয় তো। কেন যে তোর ভালো উনাকে হেন্ডসাম মনে হয়েছে?”
সোরায়া উৎসাহ নিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে –
“হ্যাঁ, লেগেছে তো। তোমার সাথে বেশ মানাবে।”
সোরায়ার কথা শুনে মিরায়া তার মাথায় গাট্টা মেরে বলল-
“অংক মাথায় যায় না এসব কিভাবে যায় শুনি। আর শোন উনি আমাদের বড় ভাই ফালতু কথা বলবি না মোটেও। কারো কানে গেলে রক্ষা থাকবে না।”
সোরায়া দুষ্টু হাসি হাসলো তারপর বললো –
“বড় ভাই হয় ঠিক আছে আপনি তো নয়। আজ কাল সৎ ভাই বোনের ও অনেক কিছু হয় তুমি ‘সঙ্গিন প্রণয়াসক্তি’ গল্পটা পড়নি হয়তো।”
মিরায়া এবার রেগে একটু চেঁচিয়ে বলল-
“ওই সব হাতাহাতি ছোয়াছুয়ি গল্প তুই ই পড় । আমার দরকার নেই। আর এমন আজগুবি কথা যেন আর না শুনি বলে দিলাম নাহলে খুব বকবো কিন্তু।”
সোরায়া হাসি থামিয়ে সিরিয়াস ভাবে আনলো মুখে আর বলল-
“আমি তো শুধু একটু মজা করছিলাম। আচ্ছা যাও আর বলবো না। তবে…”
মিরায়া চোখ বাঁকিয়ে বললো –
“তবে কি?”
সোরায়া মুখে হাত চেপে হাসতে হাসতে বলল-
“তবে… রায়ান ভাইয়া সত্যি হেন্ডসাম তোমার সাথে সেই মানাবে।”
মিরায়া এবার রাগ করে টেবিলে হাত দিয়ে শব্দ করে বাডরি দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। আর সোজা নিজের রুমে চলে গেল। সে জানে সোরায়া একবার মজা করা শুরু করলে সেটা চলতেই থাকবে। তাই সে ওই জায়গা ততখনাৎ ত্যাগ করলো।
সোরায়া চুপচাপ মিরায়ার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বলল-
“ইস্! সে নাকি খেয়াল করে নি। যার রুমে গিয়ে পুরো গায়ে উঠা অবস্থায় ছিলো তাকে নাকি খেয়াল করে নি। আমার আপু টা এমন কেন। ধুর ধুর, আমার মতো কেউ নাই।”
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস নিয়ে তার মায়ের রুমের দরজার দিকে এগিয়ে গেল। মায়ের রাগ কিছুটা হলেও ভাঙিয়ে ভাইয়ের সাথে চুক্তি অনুযায়ী কথা বলার। দরজার সামনে এসে সে দ্বিধার সঙ্গে থেমে দাঁড়াল। এক পলকে মনে মনে বলল, “এবার অবশ্যই শান্তভাবে কথা বলবো মা রাগ করেছে, কিন্তু আমি শান্ত করব।”
দরজার ক্লিক করে রুদ্র ধাক্কা দিয়ে খুলে ভেতরে ঢুকল। রামিলা চৌধুরী তখন বিছানার পাশে বসে চুপচাপ, চোখে ক্ষোভের রেখা। তার মুখে ছিল বিরক্তি আর আক্ষেপের মিশ্রণ।
রুদ্র ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে মাথা নীচু করে বলল,
“আম্মু আমি কি আস্তে পারি?
রামিলা চৌধুরী- চুপ থাকলেন কিছুঈ বললেন না।
রুদ্র মায়ের নীরবতি বুঝতে পেরে ধীরে রুমে প্রবেশ করে মায়ের পায়ের কাছে বসে বলল-
“আম্মু, আমি জানি… আজকে খেতে বসিনি, সেটা ঠিক ছিল না। দুঃখিত।”
রামিলা চৌধুরীর চোখ এখনও সরল নয়, কিন্তু তার মুখের আক্রমণশীলতা খানিকটা নরম হতে শুরু করল।
“ভালো করে ভেবে দেখো, তুমি কি সব সময় এমন আচরণ করবে?” তিনি বললেন, অথচ কণ্ঠে ঝড় ছিল না, শুধু অভিযোগের সুর।
রুদ্র একটু হাসি মিশিয়ে উত্তর দিল, “না আম্মু, আমি আর এমন করব না। তোমার সাথে এর বাইরেও আরো কথা ছিল আসলে কিছু বিষয় আছে ।”
রামিলা চৌধুরী চুলকে হালকা বেঁকিয়ে বললেন, “ঠিক আছে, তবে রাত হয়ে গেছে। এখন তোমর কথা বলার সময় হলো?”
রুদ্র দাঁড়িয়ে পড়ল, আর রাতের অন্ধকারেও দুইজনের মাঝে ধীরে ধীরে কথার সুর ভেসে উঠল। রুদ্র শুরুর দিকে ছোটখাটো গল্প, স্মৃতি আর হাস্যকর ঘটনা দিয়ে মায়ের মন কিছুটা হালকা করল। ধীরে ধীরে রাগের চোখে কিছুটা মৃদুতা ফুটে উঠল, রাগের রেখাগুলো ধীরে ধীরে ম্লান হতে লাগল।
কিছুক্ষণ বাদে, রুদ্র বিষয়ে আসল বিষয়টি তুলল—রায়ানের বিয়ের ডিভোর্সের প্রসঙ্গ। “আম্মু, আমি ভাবছিলাম… রায়ান ভাইয়ার সঙ্গে যদি কথা বলতে বিয়ে ভাঙ্গার ব্যাপারে, হয়তো তাকে বোঝানো যাবে। সে হয়তো এখন দ্বিতীয়বার ভেবে দেখার কথা বলা হলে এমন সিদ্ধান্ত নেবে না।”
রামিলা চৌধুরী হেসে, কিন্তু নির্দিষ্ট ও দৃঢ় সুরে বললেন, “রুদ্র, যার যার জীবন, যার যার ইচ্ছা। আমি ভিতরে ঢুকব না। রায়ান কে এর আগেও বলা হয়েছে এই কথা। কিন্তু সে নিজের ইচ্ছে তেই চাইছে এটা, আমি তাকে জোর করব না। ও যা খুশি তাই করুক। যদি বিয়ে ভাঙার হয়, ভেঙে দেবে। আমি কিছুতেই বাধ্য করতে পারব না।”
রুদ্র কিছুটা চুপ থেকে মাথা নাড়ল, বোঝার চেষ্টা করল। এরপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “ঠিক আছে মা, আমি শুধু বললাম আর কি। এবার বললে হয়তো একটু ভেবে দেখবে।”
রামিলা চৌধুরী ধীরে হাসলেন, “রাত্রের জন্য খেতে আয়, আমি সার্ভ করব এখন। সবাইকে খাবার খেতে ডাক। আর রাতে আর কোনো ঝামেলা নয়।”
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৪
রুদ্র মৃদু হাসি দিয়ে বলল, “ঠিক আছে মা, আমি আসছি।”
রাত্রি ঘন হতে হতে, রুদ্র ও রামিলা দুজনের মধ্যে কথোপকথনের ছোঁয়া মনকে শান্তি দিচ্ছিল। রুদ্র অনুভব করল—মা রাগ কমেছে, মনটা কিছুটা হালকা হয়েছে, আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—মায়ের কাছ থেকে সমর্থন না পেলেও তার মা আর তার উপর রেগে নেই।