তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ১১
নীল মণি
“এই তিয়ু , তিয়ু ওঠ আরোহী কল দিয়েছে। এই মেয়েটা না কি যে ঘুমোতে পারে, আরে এই কুম্ভকর্ণ উঠতে পারছিস না।”
তিয়াশা কমফোর্টার টা নিয়ে মোড়ামুড়ি করছে। এই দেখে
বৃষ্টি এবার একটু রেগে গেল, এরপর চেচিয়ে উঠলো —
” এই কুম্ভকর্ণের ফিমেল ভার্সন ওঠ।”
এবার একটু নড়েচড়ে উঠলো তিয়াশা , চোখ ডলতে ডলতে বলল —
“কি হয়েছে আপু, এই সকাল সকাল এত চেঁচাচ্ছিস কেন?”
বৃষ্টি এক হাত কোমরে দিয়ে নাকটা ফুলিয়ে ফোনটা তিয়াশার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল —
“আরোহী কল দিয়েছে তোকে । আর এখন সকাল সকাল ঘড়িতে তাকিয়ে দেখ সাড়ে দশটা বাজে।”
“কিরে ফোনটা ধর”
“ও ও এত বেজে গেছে আপু, দুষ্টুমি হাসি দিয়ে আমি তো টের পাইনি হি হি”
বৃষ্টি নাকটা আরেকটু ফুলিয়ে নিজের বোনের কর্মকাণ্ড দেখে অবাক হচ্ছে
হাই ছাড়তে ছাড়তে তিয়াশা বৃষ্টির হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কানে ধরে বলল–
“বলো বেবি?”
বৃষ্টি ফোনটা দিয়েই রুম থেকে চলে গেল।
“এই হার*****মজাদি কটা বাজে? তুই এখনো ঘুমাচ্ছিস”
“আরে বেবি, রাগ করছিস কেন? ওই রাতে একটু তোর না হওয়া দুলাভাইরে নিয়ে ভাবের দুনিয়ায় ছিলাম ।”
” হমম হমম বুঝলাম, বেবি আমার প্রেমের দুনিয়ায় ছিল।”
“এই অসভ্য মাইয়া চুপ। তো তুই আমাকে ফোন করছিস কি ব্যাপার? তাও আবার আপার ফোনে?”
আরোহী একটু ভাবুক হয়ে কাঁদো কাঁদো সুরে বলল–
” আরে দোস্ত কইস না, কাল যে ইন্টারেস্ট নিয়ে নানুর বাসায় বিকালে চইলা আসছি। সেই ইন্টারেস্টের ঠেলায় আমরা এখন ঢাকা ফিরে যাইতে ইচ্ছা করতেছে।”
তিয়াশা একটু মজার সুরে বলে উঠলো-
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“ও হো কি হইছে আমার বেবিটার ?”
“দোস্ত আমিতো দেবদাসী হয়ে গেছি।”
“কেন রে? কি হয়েছে সেটা বল না। শুধু শুধু ঢং করিস”
“আরে দোস্ত নানুর বাসার পাশে আমার ক্রাশের বাসা।
এসে শুনি তার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে।”
এই বলে আরোহী ভ্যা ভ্যা করে উঠল —
তিয়াশা একটু মাথা চুলকে বলল –
“বেবি তোর কয়টা ক্রাশ, সেদিন ও তো স্কুলের সামনের
পটলার দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলেকে দেখে বললি দোস্ত ক্রাশ খাইছি।”
আরোহী একটু ভাবময় হয়ে নাক টানতে টানতে বলল–
“আরে দোস্ত এইটা একটু বেশিই ক্রাশ ছিল , তাই দোস্ত কি করি বলতো?”
তিয়াশা এবার নিজের ৩২ পাটি দাঁত বের করে বলল–
“ইস রে আমার দোস্ত দেখি সত্যি সত্যি দেবদাসী হয়ে গেছে। আসো বেবি বুকে আসো হী হী হী।”
” দোস্ত তুই কি ইনডাইরেক্টলি আমার মজা ওড়াইতাছোস?”
“একদম না বেবি আমি ডাইরেক্টলি তোমার মজা নিচ্ছি”
“হার*****মজাদি আমি আসি তোরে দেখাবো ডাইরেক্টলি মজা।”
তিয়াশা এবার হাসতে হাসতে আবার বসা থেকে সুয়ে পরল, এবার একটা কিছু ভেবে আরোহী কে জিজ্ঞেস করল –
” আচ্ছা বেবি একটা কথা জিজ্ঞেস করব?”
” না একদম জিজ্ঞেস করবি না , তুই আমায় নিয়ে মজা ওরাস, খেলবো না তোর সঙ্গে।”
” আচ্ছা তোর খেলতে হবে না , কিন্তু শোন না।”
আরোহী আরেকটু নাক টেন বলল —
” হ্যাঁ বেবি বল”
তিয়াশা একটু চুপ করে ধিমি গলায় জিজ্ঞেস করল —
” আচ্ছা তোর ক্রাশ এর বিয়ে হয়েছে , তোর কি বুকের কোথাও ব্যথা করছে? বা কিছু খালি খালি মনে হচ্ছে?”
আরোহী একটু হতবাক হয়ে বলল –
” কেন আমার ক্রাশ কি আমার বুকে মেরেছে যে আমার বুকে ব্যথা হবে, কই আমার হার্টবিট তো ফাইন চলতাছে।
দারা আমার বুকের কাছে ফোন টা নিয়ে তোরে শোনাই।
আর খালি তো লাগতেসে না একটু আগেই এক বাটি পিঠা খায়সি দোস্ত সেই টেস্ট। ”
তিয়াশা মনে মনে বির বির করল —
” পাগল একটা।”
আরোহী জিজ্ঞেস করল —
” আচ্ছা তিয়া তুই এইটা কেন জিজ্ঞেস করলি?”
তিয়াশা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে সামনে এসে পরা কিছু চুল আঙ্গুল দিয়ে মোরাতে মোড়াতে বলল —
” আমার ক্রাশ এর ও তো বিয়ে দোস্ত তাহলে আমার কেন বুক ফেটে যাচ্ছে ? কেন কান্না পাচ্ছে ?
তাকে ছুঁয়ে একবার বলতে ইচ্ছা করছে আমার হাত টা ধরবে।
তার বুকে মাথা রেখে নিজের সব প্রশ্নের উত্তর জানতে ইচ্ছা করছে ।
কখনো কি পারব বলতে এই যে আমার বিচলিত মনে
সে আবেগ এর জোয়ার ভাসিয়ে যাচ্ছে । যার নেই কোন কিনারা , আছে গভীর জলের স্রোত যা আমাকে শুধুই ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ।
আমার গলা দিয়ে কোন খাবার নামছে না রে বেবি ।
সব স্থান কেন আমার শূন্যস্থান লাগছে, বল না ?
আর পারছি না রে ভীষন কষ্ট হচ্ছে আমার । ”
হঠাৎ করে এইসব বলতে বলতে তিয়াশার চোখের কার্নিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে তার হাতে পড়ল ।
আচ্ছা তোর ও এরকম হচ্ছে তাই না।”
আরোহী এবার রাশভারী কন্ঠে তার প্রাণের প্রিয় বন্ধুর অবস্থা বুঝে বলল —
” বেবি তুই ভাইয়ার মায়ার জালে জরিয়েছিস , যখন আমিও তোর মত কারো মায়ার জালে জড়াবো তখন আমারও তোর মতোই অনুভূতি হবে । ”
তিয়াশা জানিস তুই বা আমি আমারা আমাদের বাবা মা পরিবারের ভালোবাসা পেয়ে সময় পার করেছি , কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এক ভিন্ন ভালোবাসার অনুসন্ধান তোর নিজের জীবনে দেখা দেবে , সেটা কখন কোন মুহুর্তে দেখা দেবে তুই নিজেও জানবি না । তোর নিজের খুজতে হবে না সেই ভিন্ন ভালোবাসা তোকে খুঁজে নেবে।
এই বিষয়ে ততটা জানিনা বেবি, কিন্তু এই দেখ না বয়স টা তো বেশি না কিন্তু অনুভূতি আর বয়স দেখে বা সময় দেখে হয় না তাই না ।
তুই ভাইয়ার অনুভূতির ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়েছিস, ভালোবাসিস তুই ভাইয়া কে । তাকে তুই তোর পছন্দের তালিকায় না ,হৃদয়ে জোড়িয়েছিস । বুঝলি পাগলি?”
তিয়াশা তার চোখের জল মুছে বলল —
” ভালবাসা জানিনা আমি শুধু এটুকুই জানি
তাকে পেলে জীবনে আমার আর কিছু চাওয়ার থাকবে না। আচ্ছা বেবি তুই কি করে এসব জানিস ?”
” তোর দিয়ে ১ বছরের বড় তো তাই , তুই কি ভাবিস আমি আমার ক্রাশ এর জন্য তোকে কল দিয়েছি , সে জানি ক্রাশ এর বিয়ে হয়েছে । আমি কল দিয়েছি তোর জন্য আমি জানি তোর মধ্যে কি বয়ে যাচ্ছে । সব সময় পাগলাম করি বলে এই না যে আমি কিছুই বুঝি না।
তিয়াশা চুপ করে রইল
শোন বেবি আমি আজ ঢাকায় ফেরত যাব , কাল তোদের বাসায় যাবো।”
তিয়াশা একটু খুশি হয়ে বলল ” আচ্ছা বেবি প্লিজ আসিস কিন্তু।”
ওদের কল শেষ হওয়ার আগেই বৃষ্টির ফোনে তন্নী নামে সেভ করা একটা কল ঢুকছে ।
তিয়াশা আরোহী কে বলল
“শোন আপু কে তন্নী আপু কল দিচ্ছে বাই দোস্ত ”
এই বলেই নিজেই আরোহীর কল টা কেটে তন্নীর কল টা রিসিভ করতেই বলল _
” হ্যালো আ আপ….”
বলার আগেই কল টা অমনি কেটে গেল । তিয়াশা বৃষ্টির রুমের দিকে পা বাড়াল , করিডোর দিয়ে যেতে যেতে একটু জায়ন এর রুমেও উকি ঝুঁকি দিল । দরজা বন্ধ তাই নিরাশ হয়ে বৃষ্টির রুমের দিকে গেল , বৃষ্টি কে ফোন টা দিয়ে বলল –“আপু তন্নী আপু কল দিসিলো, রিসিভ করতেই কেঁটে গেলো।”
বৃষ্টি একটু যেন ভয় পেল , তৎক্ষনাৎ
বৃষ্টি রেগে বিছানা থেকে উঠে বলল –
” তোকে কে বলেছে কল রিসিভ করতে ? আমি বলেছি?”
তিয়াশা হতবাক হয়ে বলল —
” যা বাবা আমি কি করলাম?”
বৃষ্টি আরো রেগে বিরক্তি স্বরে দাঁত খিচে বলল —
” এই যা তো তুই এখন আমার রুম থেকে।”
তিয়াশা মাথা চুলকে চুলকে ভেবে পাচ্ছে না যে তার আপু এরকম রেগে কেন গেল , সেও ধুর ছাই করে রুম ত্যাগ করল ।
রোদ ঝলসানো চৌধূরী বাড়ির দুপুরটা যেন এক অদ্ভুত মায়াবী স্থিরতা নিয়ে নামে– বাড়ির পুরনো ঘড়ির টিকটিক শব্দ টা তখন স্পষ্ট শোনা যায়, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে পোলাও ইলিশ ভাপার ঘ্রাণ, নিচের ড্রয়িং রুমে বসে আছে বৃষ্টি ও তিয়াশা । রান্নাঘরে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বাড়ির গিন্নিরা , আজ আবার তারা যাবে বৃষ্টি আর জায়নের বিয়ের শপিং করতে। তাই তারা আজ বেশি ব্যস্ততা দেখাচ্ছে।
এদিকে জায়নের হাতের অবস্থা খারাপ বুঝে প্রান্তিক চৌধুরী সাহেব বলে গেছেন তাকে আজ আর অফিস যেতে হবে না । জায়ন এর উপর এখনো অফিসের তেমন কোন দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। কারন সামনেই তাদের বিয়ে এবং তাছাড়া তাদের ইউ. এস. এর প্রজেক্ট এর জন্য পড়াশোনা শেষ হওয়ার পরেও ওখানে ছিল।
এর মধ্যেই রায়ান আর অনু ইস্কুল দিয়ে বাসায় ফিরে আসল —
সুরাইয়া বেগম রান্না ঘর থেকেই বললেন তারাতারি ফ্রেশ হয়ে নিচে আয়।
অনন্যা উত্তর দিল –
” জী আম্মু এখন ই আসছি।”
রায়ান বলল –
” আম্মু একটু আরাম করে যাচ্ছি।”
সুরাইয়া বেগম পোলাও এর বাউল টা টেবিলে রাখতে রাখতে বলল —
” বাবা যা না সবাই বিয়ের কেনা কাটা করতে যাবো। ব্যস্ত সবাই । ”
মেহজাহাবীন বেগম বললেন —
” যা বাবা যা তারাতারি , খেয়েই বেরোবো সবাই ”
রায়ান লাফ দিয়ে উঠে বলল —
” জী বড় আম্মু এক্ষুনি আসছি ।”
রায়ান চলে যেতেই । রুহেনা বেগম হেসে বলল —
” দেখলি ছোট তোর কোথায় কান ও দিল না, আর আপা বলায় বাপ আমাদের এক দৌড়ে লাফিয়ে চলে গেল। ”
সুরাইয়া বেগম বললেন —
” তাই তো বলি মেজ আপা , সব কটা ছেলে মেয়ে বড় আপার প্রাণ প্রিয়।”
মেহজাবীন বেগম একটু মজার শুর বললেন —
” তোদের কি হিংসা হয় বাবারে । ও আল্লাহ দেখ আমার বইন গুলো আমায় হিংসা করে ”
এই হাসি ঠাট্টার মধ্যে জায়ন নিচে এসে ডাইনিং টেবল এর চেয়ার টেনে বলল ” মেজ মা খাবার হয়েছে? ”
এবার মেহজাবীন বেগম বললেন আস্তে আস্তে –
” এই দেখ ছোট আমার এই ছেলে আবার তার মেজ মা এর প্রাণ প্রিয় । দেখবি এবার মেজর দৌড়া দৌড়ি।”
রুহেনা বেগম বললেন —
” হ্যাঁ বাবা বস বস , এক্ষুনি দিচ্ছি। ওই ছোট রায়তা টা টেবিল এ রেখে আয় । ইস আমার ছেলে টার খিদে পেয়েছে ।”
এদিকে মেহজাবীন বেগম আর সুরাইয়া বেগম মুচকি মুচকি হাসছে । সুরাইয়া বেগম বললেন ” জী আপু এক্ষুনি রাখছি।”
এদিকে জায়ন এর নিচে নামা দেখেই , তিয়াশার হৃদস্পন্দন বাড়তে শুরু করল তার শখের পুরুষের কে দেখতেই । এক বাড়িতে থাকা সত্ত্বেও তাদের দেখা সাক্ষাত তেমন হয় না । জায়ন দেশে ফিরেছে আজ প্রায় দেড় মাসের বেশি এর মধ্যে বদলে গেছে কত চাওয়া পাওয়া কত অনুভূতি ।
জায়ন এর পরনে ছিল অফ হোয়াইট ব্যাগি ট্রাউজার, আর লাল রঙ্গা টিশার্ট । চুলগুলো হালকা ভেজা , এই ভেজা চুলের পানির বিন্দু পরিণত হচ্ছে তিয়াশার মনের এক গভীর সমুদ্র । আর এই লাল রং পরিহিত তার শখের পুরুষ যেন আজ অন্য রকম করে রাঙিয়ে যাচ্ছে তার মনে ।
মনে মনে বলল –
” মানুষ এত সুন্দর ও হয়?”
তিয়াশার এর চোখে যেন ঘোর লেগে আসছে । এই চাউনি নজর এড়াতে পারেনি জায়ন এর দৃষ্টি থেকেও । সেও তার লিটল কিটি ক্যাট আর চোখে দেখছিল।
তিয়াশাকে ঘোর থেকে বের করার জন্য জায়ন একটু জোরেই কাশি দিয়ে উঠল ।
অমনি তিয়াশা নড়ে চড়ে বসল, মনে মনে বির বির করল —
” কি ছেচড়া আমি ।”
এদিকে বৃষ্টি টিভি দেখেই যাচ্ছে এদিকে ওর কোন হেলদোল নেই ।
তিয়াশা আবার এক ভাবনার দেশে গিয়ে বলল —
” এই আপু ”
বৃষ্টি টিভির দিকেই তাকিয়ে রেমোর্ট দিয়ে চ্যানেল চেঞ্জ করতে করতে বলল —
” বল।”
জায়ন এর দিকে তাকিয়ে তিয়াশা তার কোলে রাখা কুশান টার উপরে নখ দিয়ে একটা সুতো টানতে টানতে বলল —
” তোর জামাই টা কি সুন্দর রে । ”
বৃষ্টি কি বুঝল কে জানে , চোঁখ তার টিভির দিকেই এখন সে বলে উঠলো —
“মানে ?”
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ১০
তিয়াশার নজর এখনো জায়ন এর খাওয়ার দিকে , সে উত্তর দিল —
” মানে তোর জামাই , মানে জায়ন ভাই ।”
বৃষ্টি এবার একটু হেসে মজা করে বলল —
” তাহলে তুই রেখে দে হি হি হি ।”
তিয়াশা বলল মনে মনে —
” দিয়ে দে না ,খুব যত্নে রাখবো তাকে আমার মনে। ”