তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ১২
নীল মণি
হঠাৎ করেই সূর্যি মামা ঢেকে গেছে কালো মেঘের আড়ালে , বইছে বাতাস তার মাদলের তালে তালে। আসপাশানি নিস্তব্ধ দুপুর ভরিয়ে দিয়েছে গাছেদের দোলানীর ঠান্ডা হওয়ায় । ভেজা গরম থেকে শান্ত হবে এই ব্যাস্ত শহরের ব্যাস্ত মানুষের দোয়ায়।
দুপুরে খাবারের পর্ব শেষ করে বৃষ্টি একটা আমসত্বের
বোয়াম নিয়ে সোফায় বসে ছিল সেখানেই ভাগ বসিয়েছে আমাদের অনন্যা রায়ান এবং তিয়াশা ও।
বাড়ির গিন্নিরা রান্নাঘরের পর্ব মিটিয়ে যে যার রুমে গেছে
শপিংয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে।
হাতে সময় কম তাই এই মেঘলা বাদলেই তারা কেনাকাটা করতে যাবে। তাছাড়াও কথায় আছে না বৃষ্টি বাদলেও মেয়েদের কেনাকাটা কেউ আটকাতে পারে না।
সেটা আজও প্রমাণ করে দিলেন চৌধুরী বাড়ির গিন্নিরা।
জায়ন দুপুরের খাবার খেয়ে আবারো নিজের রুমেই ফিরে গেছে। অবশ্য খাবার সময় মেহজাবিন বেগম অনেকবার জায়ন কে বলেছিলেন তাদের সঙ্গে যাওয়ার জন্য। কিন্তু এই ঘাড় ত্যারা ব্যাটা একবার যখন বলেছে সে যাবে না তারমানে সে যাবেই না, কিন্তু তাও একবার মেহেজাবীন বেগম তার শেষ চেষ্টা করলেন তাও কোন কাজ হলো না।
হঠাৎ সদর দরজার কলিং বেল বাঁচতেই, অনু উঠে গিয়ে দরজাটা খুলতে গেলে, আর মনে মনে বলল এই মেঘলা বাদলে আবার কে আসলো বাবারে…..
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
অনন্যা দরজা খুলতই দেখল সামনে ইউভি আর আকাশ দাড়ানো। অনু তাদের দেখে বলে উঠলো —
“ও ভাইয়া আপনারা, আমি ভাবলা…….”
সম্পূর্ণ কথা বলতেই পারল না তার আগেই আকাশ বলে উঠলো —
“সামনে দিয়ে সর তো, বেশি বকবক করিস না তুই কি ভাবলি না ভাবলি পরে দেখা যাবে।
অনু কোমরে হাত দিয়ে ভুরু কুঁচকে রেগে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল —
“এত বড় দরজাটা সাইডে দিয়ে যেতে পারছ না, যত্তসব।”
আকাশ বলে উঠলো একটু হেসে–
“পুরো দরজাটা তো তুই আটকে রেখেছিস। যাবো কি করে একটু খাওয়া দাওয়া কমাতে তো পারিস পুরো দরজা জুড়েই তো তুই দাঁড়ানো। ”
অনু আর একটু রেগে বলে উঠলো–
“তুমি কি কোন ভাবে আমাকে মোটা বললে? তোমার কি আমাকে দেখে মোটা মনে হচ্ছে। তুমি চোখের ডাক্তার দেখাও ভাইয়া , হু । ”
আকাশ আর কিছু বলল না মুখ টা ভেঙ্গিয়ে চলে গেল ।
এদিকে অনুর দিকে তাকিয়ে যে কেউ তার চোখের তৃষ্ণা মেটাচ্ছে সেদিকে তার খেয়াল পর্যন্ত নেই।
অনুর পরনে ছিল হালকা ব্লু রঙের ঘের আলা স্কার্ট আর
হোয়াইট টপ , ডাগর ডাগর চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে হালকা পিংক লিপ স্টিক , লম্বা কোমড় পর্যন্ত চুল গুলো দুপাশে বেনি করে সামনে রাখা…
ইউভি তার হৃদয় পাখিকে দেখে মনে মনে আওড়ালো–
“এই দূরে থাকার আবেগেও যে একরাশ মিষ্টি টান আর অপেক্ষার অনুভব আছে তা আজ জানতে পারলাম।
দুইদিন বাদে দেখা তোমার মুখ,
চোখে তার ছিল একরাশ সুখ।
আমার চাওয়া তোমার ওই চোখের আলো,
তোমার ঠোঁটের হাসি আমায় করে দিল এলোমেলো।
শব্দ হয়নি ,ডাকেও নি কেউ,
তবু দৃষ্টি রা আলোতে ছুয়ে গেল।
আবেগের পেছনে জমে থাকা ভালোবাসা
এই চাহনিতে বারবার জেগে উঠলো।
তার এই ধ্যান ভাঙলো তার হৃদয়পাখির আওয়াজে —
” এই যে ভাইয়া , আপনি কি ভিতরে ঢুকবেন না?এত বার ডাকছি তাও শোনে না।”
“আরে বাবা তাড়াতাড়ি ভিতরে আসুন না দরজাটা দিতে হবে তো আমায়, কানে কালা নাকি শুনতে পান না ?এদিকে আকাশ ভাই দেখত পায় না আর আপনি শুনতে পান না । কি জ্বালা ”
ইউভি অনুর কথা শুনতেই তার আবেগের ঘোরের থেকে
বেরিয়ে এলো। একটু গলাটা কেশে বলল —
“বেশি ফট ফট করিস না সর সামনে থেকে, ভেতরেই যাচ্ছি । এক গ্লাস পানি দে তো , এত দূরের জার্নি খুব কষ্ট হয়ে গেছে। ”
অনু রেগে ইউভির পিছন পিছন গিয়ে বলল–
” আপনাদের মাথায় কি ডিস্টার্ব আছে, আমি আপনাদের রাস্তা কখন আটকালাম। যত্তসব।
আর আমি কি আপনার কাজের বুয়া যে আপনাকে পানি দিব?”
ইউভি উপরের দিকে যাচ্ছিল অনুর কথা শুনে আবার অনুর দিকে এসে বলে —
“পানি দিলে কাজের বুয়া হয় বুঝি জানা ছিল না রানী সাহেবা। যা পানি নিয়ে আয় । ”
মনে মনে আওড়ালো – ” এই পানি যে তোকেই সারা জীবন দিতে হবে আমায় । ”
অনু মুখ বাঁকিয়ে দুই ভাইয়ের জন্য পানি আনতে চলে গেল।
এদিকে আকাশ বৃষ্টিদের পাশে বসে বলল–
“মামিরা কোথায় আপু, ভীষণ ক্ষুধা লাগছে খেতে হবে এখন।”
বৃষ্টি বলল —
“আমরা সবাই কেনাকাটা করতে যাব তাই আম্মুরা তৈরি হতে গেছে। আর আমরা এই যে তৈরি হয়ে বসে রয়েছি।”
আকাশ মনে মনে ভাবল – ” এই বাজে ওয়েদার এও শপিং করতে হয় এদের। বাবা”
” তোদের খাবার ডাইনিং টেবিলে রাখাই আছে , তোরা ফ্রেশ হয়ে আয় আমি খেতে দিচ্ছি।”
এদিকে ইউভান বলল —
“বৃষ্টি ভাইয়া কোথায় রে? ”
বৃষ্টি বলতে যাবে, তার আগেই তিয়াশা বলল —
” উনি উপরেই আছে ওনার রুমে।”
ইউভি অনুর আনা পানিটা খেয়েই উপরে জায়নের রুমের উদ্দেশ্যে চলে গেল।
এদিকে রায়ান আকাশকে বলল–
” আচ্ছা ভাইয়া এই যে তোমরা ঘুরতে গেলে ,আমাকে নিয়ে গেলে কি হতো?”
আকাশ একটু সোফায় গা এলিয়ে বলল–
” কিছুই হতো না ওই সব সময় এক সমস্যা নিয়ে ঘুরতে হতো।”
এই শুনে রায়ান রেগেমেগে বলল–
“ভাইয়া তুমি এইটা করতে পারলে”।
ওদের কথা শুনে বাকিরাও হেসে লুটিয়ে পড়ল।
জায়ন তার রুমের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছিল। তখনই ইউ ভি এসে দরজায় নক্ দিয়ে
বলল আসবো ভাইয়া ভেতরে?
জায়ন সিগারেট টা নিভিয়ে বলল–
“হ্যাঁ আয়”
“হাতটা কেমন আছে ভাইয়া এখন?”
“সকালেই তো তোকে বললাম মাইনর চোট লেগেছে তেমন কিছু না ঠিক আছে।”
“এটাকে তুমি মাইনর বলছো ভাইয়া?”
“এসব বাদ দে, কখন পৌঁছালি বল।”
“এইতো এক্ষুনি আসলাম ,এসেই তোমার কাছে আসলাম।”
“আরে পাগল ফ্রেশ তো হয়ে আসতে পারতি। এতটা দূরের রাস্তা, ফ্রেশ হয়ে আয় তারপরে না হয় কথা বলবো।”
“না ভাইয়া আমায় এখনই বলো”
“কি বলবো কোথা দিয়ে শুরু করবো নিজেই জানিনা ।
তাই যা ফ্রেশ হয়ে আয়।”
“ভাইয়া আমার মাথায় কাজ করছে না, তুমি প্লিজ বলো, সকাল থেকে যখনই শুনেছি তুমি আমাকে কিছু বলবে তখন থেকে ছটফট করছি।”
“আচ্ছা এদিকে আয় এদিকে এসে বস।”
ইউভি গিয়ে একটা চেয়ার টেনে বসে পরলো । তখন জায়ন একটু ভেবে
বলল —
“তুই অনুর জন্য কি ভাবিস?”
ইউভি একটু ভ্রু কুঁচকে বলল —
” কি হলো ভাইয়া, অনুকে নিয়ে কি কিছু হয়েছে।”
জায়ন তার দুই উড়ুর উপরে কুনুই রেখে একটা হাত দিয়ে কপাল ঘষতে ঘষতে বলল–
“যেটা জিজ্ঞাসা করেছি সেটা বল?”
ইউভি এবার এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল —
” আমার হৃদয় পাখি, আমার ভালোবাসার প্রথম অনুভূতি, আমার রাত জাগা স্বপ্নের সুখের আলো বাতি।”
জায়ন বলে উঠলো —
” এই অনুভূতিগুলো যদি আমার মনেও কারো জন্যে জেগে ওঠে ,তাহলে কি খুব ভুল হবে?”
ইউভি একটু হতবাক হয়ে বলল–
” তুমি কি বৃষ্টিকে নিয়ে কিছু ফিল করছো ভাইয়া, ভালোই তো । সামনেই তোমাদের বিয়ে আর তো গুনে কটা দিন।”
জায়ন বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, দূরে থাকা মেঘলা বাতাসের হাওয়ায় যে গাছগুলো নড়ছিল, সেইদিকে তাকিয়ে বলল–
” যদি বলি না।”
ইউভির মধ্যে হঠাৎ এক ভয়ের দেখা দিল,
ইউভি এবার একটু মুখ কালো করে মাথা নিচু করে বলল —
” ভাইয়া তুমি কি কোন ভাবে অনু……”
সম্পূর্ণ বাক্য বলতে পারল না তার আগেই জায়ন এসে ওর কাধ চেপে বলল–
“তোর কি আমাকে এতটাই নির্দয় মনে হয়, আমি আমার প্রাণের থেকেও প্রিয় ভাইয়ের ভালোবাসাকে নিজের করতে চাইবো, আমি অনুকে নিজের বোন হিসেবেই ভাবি। বুঝলি গাধা , তুই ইডিয়েটে ই থাকবি ।”
ইউভি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলো । তারপর কিছু একটা ভেবে ভ্রূ কুঁচকে বলল–
” তাহলে ভাইয়া তুমি কি আমার বোনকে ধোঁকা দিতে চাইছ, এটা কিন্তু আমি মানবো না ভাইয়া।”
জায়ন একটু হেসে বলল–
“আচ্ছা ইউভি একটা কথা বল আমি কি তোর বোনকে কখনো ভালবাসতে পেরেছি? বৃষ্টি খুবই ভালো মেয়ে নো ডাউট ওর মতন ভদ্র সভ্য মেয়ে আমি আমার চোখে একটাও দেখিনি, আমার ওকে ভালো লাগতো ভেবেছিলাম এইটাই হয়তো ভালোবাসা। ভেবেছিলাম হ্যাঁ পরিবারের সিদ্ধান্তই আমার সিদ্ধান্ত কিন্তু আমি যে কারোর মায়াজালে এইভাবে বেঁধে যাব নিজেই বুঝিনি। তুই কি এখন আমায় খারাপ ভাববি? ”
ইউভি আবারো একটু চমকে উত্তর দিল–
“ভাইয়া তোমায় আমি আমার হৃদয়ের কতখানি জায়গায় রেখেছি সেটা তুমি নিজেও জানো না, আমি তোমায় খারাপ ভাববো কেন আমি তো কখনো ভাবতেই পারব না যে আমার ভাইয়া খারাপ একটা মানুষ। তাকে আমি আমার নিজের থেকেও বেশি চিনি।
তুমি কি বাইরে কোন মেয়েকে…..”
এবার জায়ন এর চোখ লালরঙা হয়ে গেল –
” খবরদার ইউভি বাইরের কোন মেয়ের সঙ্গে আমাকে জড়াবি না।”
ইউভি বুঝতে পারল না তার ভাইয়ার রেগে যাওয়ার কারণ, বুঝতেও পারছে না যে তার ভাইয়া কার কথা বলছে–
“ভাইয়া তুমি রেগে যাচ্ছ কেন? বাইরের যদি কোন মেয়েকে তুমি তোমার অনুভূতিতে না রাখো তাহলে কার কথা বলছো তুমি?”
জায়ন ইউভির থেকে নজর সরিয়ে এক হাত ব্যালকনির রেলিঙে দিয়ে আরেক হাত মাথার পেছনে দিয়ে বলল —
” কেন আমাদের এই চৌধুরী বাড়িতে আর কোন মেয়ে নেই ? ”
কি শুনল এটা ইউভি, কি কি কি? সে কি ঠিক শুনল, সে কি যেটা বুঝতে চাইছে না সেটাই কি তার ভাইয়া চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিল।
ইউভি চমকে উঠল ,বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো মনে হল তার মাথায় বাজ পড়েছে । ইউভির চোঁখ বড় বড় হয়ে গেল সে আর নিজেকে চুপ রাখতে পারল না —
” ভাইয়া তুমি কি রোদকে ….
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ১১
আবারো তার বাক্য সম্পূর্ণ করতে পারল না তার আগেই জায়ন বলে উঠলো —
” হুমম রোদ আমার নিজের পার্সোনাল দুপুরের রোদ , আমার সিদ্ধান্ত কে ভুল প্রমাণ করার চিন্তা , আমার মনের গভীরে নিজের স্থান বানানো রমণী,
আমার দেখা সবথেকে সুন্দর ফুল, আমার প্রতিটি হৃদয়েরস্পন্দন এর বাদ্যযন্ত্র , আমার প্রতিটি রাতের স্বপ্ন, আমার আবেগের প্রথম নারী,আমার পুরো হৃদয় জুড়ে শুধুই তোর ছোট বোন
একান্তই আমার তিয়াশা রোদ ‘my little kitty cat’ …”