সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬২
Jannatul Firdaus Mithila
“ সাব্বির, তায়েফ,তাশরিক! বিয়ের ব্যবস্থা কর! পুরো শহর দেখুক — এহসান বাড়ির ছেলে-মেয়েদের বিয়ে!”
এহেন কথায় মুহুর্তেই যেন বাকহারা হয়ে গেলেন সকলে।রাফিয়া বেগম ড্রয়িং এর এক কোণে দাড়িয়ে চোখবুঁজে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলছেন। মানুষটার বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে আলগোছে গড়িয়ে পড়ছে কয়েক ফোঁটা অশ্রু। তাকে ওমন নিঃশব্দে কাঁদতে দেখে পাশে দাঁড়ানো মাইমুনা বেগম খানিকটা এগিয়ে এলেন। হাত বাড়িয়ে আলগোছে রাফিয়া বেগমকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ধরলেন। অতঃপর কন্ঠ খাদে নামিয়ে বলতে লাগলেন,
“ কেঁদো না মেজো বু! এখন আবার কান্না কিসের? সব ঠিক হয়ে যাবে, কেঁদো না তুমি।”
রাফিয়া বেগম শাড়ির আঁচলে আলগোছে ভেজা চোখদুটো খানিক মুছে নিলেন। মাথাটা এখনো নুইয়ে রাখা তার।হয়তো চোখে এসে ভিড় জমানো অশ্রুর ভারে মাথা তুলতে পারছেন না মানুষটা। এদিকে, তায়েফ সাহেব এবং তাশরিক সাহেব যেন হাতে চাঁদ পাবার দশা! তারা কেমন পুলকিত হয়ে উঠেছে বড় ভাইয়ের কথায়।তাশরিক সাহেব তো একের পর এক ঢোক গিলছেন।তিনি বোধহয় এখনো পরিপূর্ণ বিশ্বাস করতে পারছেন না বড় ভাইয়ের কথাগুলো। অন্যদিকে, অনিক এতক্ষণ ড্রয়িং রুমের এককোণে দাঁড়িয়ে থাকলেও এখন ছুটে গিয়েছে সিঁড়ির দিকে। এমন একটা মুহুর্ত কি তার বোনকে ছাড়া শোভা পায়? ছেলেটা একপ্রকার ছুটে যাচ্ছে সিঁড়ি বেয়ে দোতলার দিকে। সাব্বির সাহেব ছেলের ওমন ছুটে যাওয়ার পথে তাকিয়ে ভেজা চোখে হাসলেন একটুখানি। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেও ভুললেন না তিনি।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
জুবাইদা বেগম ছলছল চোখজোড়া নিয়ে স্বামীর দিকে তাকিয়ে আছেন।হঠাৎ করে কি জানি তার আবার কি হলো, তিনি স্তব্ধ চোখে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসেন ছেলের নিকট। ছেলের কনুই চেপে আলতো স্বরে বললেন,
“ এবার তো তোর বাবাও সবটা মেনে নিয়েছে রোদ। এখনও কি তুই চলে যাবি?”
রৌদ্র ঘাড় বাকিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। ছেলেটার মুখের অভিব্যাক্তি দেখে বোঝবার জো নেই, সে আদৌও খুশি হয়েছে কি-না! জুবাইদা বেগম ফের জিজ্ঞেস করলেন ছেলেকে,
“ তুই যাবি না তো রোদ?”
রৌদ্র এবার মাথাটা নিচু করে নিলো।কন্ঠে ব্যাপক গাম্ভীর্যের ছাপ ফুটিয়ে বলে ওঠলো,
“ থেকে কি করবো মা?”
এহেন কথায় যেন মুহুর্তেই আরেকবার চমকালেন সকলে। দূর্বল কবির সাহেবের কোমরের পেছনে বেধেঁ রাখা হাতদুটোও কেমন ঢিলে হয়ে এলো ছেলের এহেন বাক্য শুনে। তিনি ধীরেসুস্থে দু-কদম এগিয়ে আসেন। রৌদ্রের কাঁধে হাত রেখে ভারি কন্ঠে বললেন,
“ থেকে কি করবি মানে? আমিতো সবটা মেনেই নিয়েছি এখন। তাহলে তুই আবার কেনো চলে যেতে চাচ্ছিস?”
রৌদ্র চোখ তুলে বাবার দিকে চাইলো। ঠোঁটের কোণে ক্ষুদ্র তাচ্ছিল্যের হাসি টেনে বলতে লাগলো,
“ কাকে বিয়ে করার কথা বলছো আব্বু? যে কি-না আমায় ভালোই বাসেনা!”
এমন কথায় মুহুর্তেই থমকে যায় অরিনের পদযুগল। মেয়েটা সবেমাত্র সিঁড়িটায় পা রেখেছিলো কোনরকম। কিন্তু হুট করেই রৌদ্রের বলা এরুপ কথায় হতভম্ব হয়ে গেলো মেয়েটা। মনে মনে ভাবছে সে, — কি বলছে এই লোক? অতি আনন্দে কি মাথার স্ক্রুগুলো সব ঢিলে হয়ে গেলো তার? না-কি আবার তার উপর কোনরকম বদলা নিতে চাচ্ছে সে? খানিকক্ষণ বাদেই নিজের সকল ভাবনাগুলো থেকে একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে বেরিয়ে আসে অরিন। মেয়েটার শুভ্র নির্মল মুখখানায় ইতোমধ্যেই লেপ্টে গিয়েছে একরাশ বিরক্তির ছাপ। সে দ্রুত কদমে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে। রৌদ্রের থেকে মাত্র কয়েক হাত দূরে দাড়িয়ে উৎসুক দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো ছেলেটার পিঠের দিকে। এদিকে কবির সাহেব এতক্ষণে মুখ খুললেন। কন্ঠে তার এক আকাশসম হতবাকতা!
“ কি বলছো তুমি? বুঝে বলছো?”
রৌদ্র আবারও তাচ্ছিল্যের হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। সটান হয়ে দাঁড়িয়ে প্যান্টের পকেটে দু’হাত গুঁজে দাঁড়ালো বেশ ভাব নিয়ে। তারপর কেমন শ্লেষাত্মক কন্ঠে বলে ওঠে,
“ হ্যা আব্বু, বুঝেই বলছি। তোমার মনে নেই? সেদিন সকলের সামনে ও কিভাবে আমাকে এবং আমার ভালোবাসাকে অস্বীকার করলো! আমার এতোশত আহাজারিতেও অরি একটাবার মুখ ফুটে বললো না — ও মিথ্যা বলছে! এখন তুমিই বলো, এতোকিছুর পরেও আমি ওকে কিভাবে বিয়ে করবো?”
এমন কথায় মুহুর্তেই কবির সাহেবের মাথাটা আপনা-আপনি কেমন নিচু হয়ে গেলো! তিনি সামান্য ঢোক গিলে কয়েক কদম পিছিয়ে গেলেন। দূর্বল শরীরটা হুট করেই কেমন টলতে লাগলো তার! তিনি টলতে টলতে পেছনের সোফায় গিয়ে বসলেন। কিয়তক্ষনের মধ্যেই তার বুক চিঁড়ে বেরিয়ে আসে এক দীর্ঘ নিশ্বাস। কবির সাহেব মাথা উঠিয়ে ছেলের পানে তাকায়। আশ্চর্য! মানুষটার চোখদুটো ওমন লাল হয়ে গেলো কেনো? সে কি কাঁদতে চাইছে কোনোভাবে? খানিকক্ষণ সময় নিয়ে কবির সাহেব ধরে আসা কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ ওর কোনো দোষ নেই রোদ! ও সবটা আমার কথাতেই করেছে!”
রৌদ্র যেন এতক্ষণ এই কথাটারই অপেক্ষায় ছিলো।ছেলেটা খানিক বাঁকা হাসলো সকলের অলক্ষ্যে। পরক্ষণেই মুখভঙ্গি আগের ন্যায় গম্ভীর করে বললো,
“ মানে?”
কবির সাহেব ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললেন। বার কয়েক শুষ্ক ঢোক গিলে, গলায় উপচে আসা কান্নাগুলো গিলে নিলেন কোনমতে। তারপর কেমন অদ্ভুত শান্ত কন্ঠে বলতে লাগলেন,
“ সেদিন মধ্যরাতে তোমাদের দু’জনকে একসাথে বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলাম আমি। অরিনের সঙ্গে তোমার ওমন ঘনিষ্ঠতা দেখে, বুঝে গিয়েছিলাম তুমি ওকে পছন্দ করো। কিন্তু… কিন্তু তোমাদের এমন সম্পর্ক মেনে নেওয়া যে একপ্রকার অসম্ভব ছিলো আমার জন্য! কেননা আমি যে কোনো একসময় কাওকে কথা দিয়েছিলাম — এহসান বাড়ির ছেলেমেয়েদের মধ্যে প্রনয়ঘটিত কোনো সম্পর্ক হবে না, এমনকি আমিই সেটা হতে দিবো না। তাই সেদিনের পরদিন দুপুরে আমি-ই মির্জা সাহেবকে আমাদের বাড়িতে আসতে বলেছিলাম, অরিনের সম্বন্ধের জন্য। যেহেতু অরিন নিজ থেকে রাজি হবে না তাই আমি গিয়েছিলাম ওর সঙ্গে কথা বলতে,
★ সেদিনকার ঘটনা —
“ অরি!”
অরিন হকচকায়।তড়িঘড়ি করে শোয়া ছেড়ে উঠে বসে বিছানায়। হাত দিয়ে গায়ের ওড়নাটা খানিক ঠিকঠাক করে নিয়ে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কবির সাহেবের দিকে তাকায়। ঠোঁটের কোণে হালকা হাসির রেশ টেনে বলে ওঠে,
“ জ্বি বড় আব্বু! কিছু বলবে?”
কবির সাহেব গম্ভীর মুখে রুমে ঢুকলেন। অরির বিছানার কাছ হতে খানিকটা দূরে দাড়িয়ে রাশভারী কন্ঠে বললেন,
“ তোমার সাথে কিছু কথা আছে!”
অরিন তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে বসলো।উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো,
“ হ্যা,হ্যা বলো কি বলবে!”
এপর্যায়ে কবির সাহেব থামলেন একটুখানি। চোখ তুলে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চাইলেন অরিনের দিকে। তার ওমন দৃষ্টি দেখে ভড়কে গেলো অরিন। বুকটায় কেমন হুট করেই মোচড় দিয়ে ওঠলো খানিকটা। আচ্ছা হঠাৎ করেই এমন একটা অনুভুতি আসছে কেনো তার মধ্যে? এ আবার নতুন কোনো ঝড় আসবার পূর্ব লক্ষণ নয়তো? অরিন মুখে কিছুটা জোরপূর্বক হাসি টানলো।বললো,
“ বড়আব্বু! বললে না যে… ”
এপর্যায়ে কবির সাহেব খানিক মাথা নাড়লেন। কদম বাড়িয়ে বিছানার কাছে এসে অরিনের থেকে দু’হাত দুরত্বে বসলেন। অরিনের বুকটা বুঝি একাধারে ধুকপুক করে যাচ্ছে! মনটা ক্ষনে ক্ষনে কু-গাইছে তার। কবির সাহেব কিছুটা সময় চুপচাপ বসে রইলেন।তারপর হুট করেই বলে বসলেন,
“ আমার ছেলেকে ভালোবাসো?”
থমকায় অরিন। তড়িৎ গতিতে মাথা উঠিয়ে বড় আব্বুর দিকে হতবাক চোখে তাকালো মেয়েটা। তার চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে একরাশ অবাকের ছাপ! কবির সাহেব সরু চোখে তাকালেন। মুখটা তার এমনিতেই গম্ভীর করে রাখা।তিনি ফের জিজ্ঞেস করলেন,
“ ওকে ভালোবাসো?”
অরিন তৎক্ষনাৎ মাথাটা নুইয়ে নিলো। দুরুদুরু বুকে কোনরকমে উপর-নীচ মাথা নাড়িয়ে হ্যা জানালো মেয়েটা। তা দেখে কবির সাহেবের মুখটা কেমন শক্ত হয়ে এলো! তিনি দাঁতে দাঁত চেপে ধরলেন নিঃশব্দে। এদিকে অরিনটাও ফুপিয়ে কাঁদছে এখন। কবির সাহেব খানিকটা সময় নিয়ে মনে মনে কি যেন একটা ছক কষলেন, তারপর বললেন,
“ কবে থেকে ভালোবাসো ওকে?”
অরিন কাঁদতে কাঁদতেই কোনমতে বললো,
“ অনেকদিন!”
“ ভুলে যাও ওকে!”
ব্যস! এহেন কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই সকল কান্নারা যেন ছুটে পালালো মেয়েটার।সে তৎক্ষনাৎ মাথা তুললো।নিজের সিক্ত চোখদুটো কবির সাহেবের দিকে তাক করে অনড় কন্ঠে বললো,
“ সম্ভব না বড় আব্বু! অন্তত আমি বেঁচে থাকতে সম্ভব না!”
এপর্যায়ে কবির সাহেব তাচ্ছিল্যের হাসি টানলেন ঠোঁটের কোণে। তিনি তৎক্ষনাৎ বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।কোমরের পেছনে দু’হাত বেঁধে কাঠকাঠ কন্ঠে বললেন,
“ তাহলে শুনে রাখো, তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে — ওকে আমি সারাজীবনের জন্য ত্যাজ্য করবো! আমি ভুলে যাবো, আমার কোনো ছেলে সন্তান আদৌও ছিলো!”
ভড়কায় অরিন। চোখদুটো যেন জলশূন্য হয়ে গেলো মেয়েটার।কন্ঠ হয়ে গেলো বাকরূদ্ধ! মাথাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে এমুহূর্তে তার! শরীরটাও কেমন অবশ বনে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। অরিন শুষ্ক ঢোক গিললো কয়েকটা। অতঃপর থেমে থেমে বললো,
“ এমনটা করতে পারোনা তুমি বড় আব্বু!”
কবির সাহেব তীক্ষ্ণ নজরে চাইলেন মেয়েটার দিকে।সন্দিহান কন্ঠে বললেন,
“ দেখতে চাও?”
অরিন যেন এবার আর ধরে রাখতে পারলোনা নিজেকে। সে তৎক্ষনাৎ হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো কবির সাহেবের পাদু’টোর নিকটে। হঠাৎ এহেন কান্ডে খানিকটা হকচকিয়ে ওঠেন কবির সাহেব। অথচ বাইরে থেকে সে-ই চিরচেনা গম্ভীর অবয়ব ধরে রাখলেন তিনি। অরিন দু-হাতে চেপে ধরলো কবির সাহেবের পাদু’টো। তারপর কাঁদতে কাঁদতে মেয়েটা কেমন অনুনয়ের সুরে বলতে লাগলো,
“ দয়া করে এমনটা করো না বড়আব্বু! আমি..আমি সত্যি ডাক্তার সাহেবকে ছাড়া বাঁচবো না।”
কবির সাহেব নিজের দৃষ্টি অন্যদিকে ঘোরালেন।কন্ঠে আগের ন্যায় ঝাঁঝ ঢেলে বললেন,
“ উঠে পড়ো!”
অরিন উঠলো না।না থামালো তার কান্না! মেয়েটার ক্ষুদ্র শরীর ক্ষনে ক্ষনে কাঁপছে কান্নার তোড়ে। সে আবারও থেমে থেমে বললো,
“ আমি তোমাদের ভালোবাসি বড়আব্বু,কিন্তু তার চেয়েও বেশি ভালোবাসি আমার ডাক্তার সাহেবকে। বিশ্বাস করো… আমি তাকে যতটুকু ভালোবাসি তারচেয়েও কয়েকগুণ বেশি সে আমায় ভালোবাসে। আমায় চোখে হারায় সে! আমাদের… আমাদের আলাদা করে দিও না বড়আব্বু! দয়া করে মেনে নাও সবটা। আমরা একে-অপরকে ছাড়া মোটেও ভালো থাকবোনা।”
“ এমনটা হয় না অরি! তুমি ওঠো!”
অরিন এবারেও উঠলো না। কবির সাহেব খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে হুট করেই মেয়েটার সামনে হাঁটু ভাজ করে বসলেন। অরিন এখনো কাঁদছে। কবির সাহেব মেয়েটার মাথায় হাত রেখে বললেন,
“ আচ্ছা তুমি সত্যি রোদকে খুব ভালোবাসো?”
অরিন নিজের কান্নাগুলো কোনমতে আঁটকে রেখে পরপর মাথা ঝাকালো। কবির সাহেব আলতো হাসলেন।নিজের দৃষ্টি সরু করে আবারও বললেন,
“ তাহলে তুমি কি চাইবে, তোমার জন্য রোদের অনিষ্ট হোক?”
অরিন হা হয়ে গেলো এহেন কথায়। তার চোখেমুখে স্পষ্ট হতবাকতা। সে শুধু মাথা নাড়িয়ে না জানালো।কবির সাহেব এবার বললেন,
“ শোনাে! তুমি যদি সত্যিই রোদকে ভালোবাসো, তাহলে আমি যেভাবে বলবো সেভাবেই করো।নাহলে, মনে রেখো রোদকে সারাজীবনের জন্য এ পরিবার থেকে দূর করে দেওয়া হবে। এমনকি আমাদের সঙ্গে তার যতপ্রকার সম্পর্ক থাকবে সব ছিন্ন করে দিবো আমি! এখন তুমি বলো তুমি কোনটা চাও?”
অরিনের চোখ বেয়ে নিঃশব্দে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। মেয়েটা তৎক্ষনাৎ নিজের মাথাটা দু’হাতে শক্ত করে চেপে ধরলো।মাথাটায় এতো যন্ত্রণা হচ্ছে না তার… মনে হচ্ছে এই বুঝি ফেটে যাবে মাথাটা!মেয়েটা চারিদিকে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলছে। বুকটা কাঁপছে তার, সেই সাথে কাঁপছে তার ক্ষুদ্র বদনখানি! গলায় নেমেছে অসম্ভব শুষ্কতা! মেয়েটা ক্ষনে ক্ষনে জিভ দিয়ে নিজের শুষ্ক অধরজোড়া কোনমতে ভিজিয়ে নিচ্ছে! নাহ…ঠোঁট দুটো যেন আজ আর ভেজবার নয়! প্রায় মিনিট পাঁচেক পর মেয়েটা মাথা নত রেখে হুট করেই বলে ওঠে,
“ এভাবে না বলে…আমায় তুমি মেরে ফেলো বড় আব্বু! বিশ্বাস করো…তোমার ছেলেকে ভুলে যাওয়ার চাইতে আমি নিসন্দেহে মরে যাওয়াটাকে প্রেফার করবো!”
কবির সাহেব বললেন না কিছু। চুপ করে চেয়ে রইলেন মেয়েটার দিকে। অরিন তখন আবারও বললো,
“ আমায় মেরে ফেলো বড়আব্বু! সত্যি বলছি…আমায় ফেরে ফেলো। আমি…”
অরিনের কথা শেষ হবার আগেই দাঁড়িয়ে পড়লেন কবির সাহেব। অতঃপর শক্ত গলায় বললেন,
“ ঠিক আছে! তোমার ওকে ভুলতে হবে না! তুমি শুধু আজকে যারা তোমায় দেখতে আসবে,তাদের সামনে গিয়ে বসবে।চিন্তা করোনা… তোমার বিয়ে নিয়ে আগাবো না আমি! আমি শুধু চাই,তুমি তাদের সামনে গিয়ে বসবে এবং রোদ আসলে তুমি সবার সামনে বলবে…”
এটুকু বলেই থামলেন কবির সাহেব। অরিন বুঝি আরেকধাপ উৎসুক হয়ে পড়লো বাকিটা শুনতে।সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি বলবো?”
কবির সাহেব মেয়েটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেললেন।বললেন,
“ বলবে তুমি ওকে ভালোবাসো না!”
“ অসম্ভব!”
“ তাহলে ঠিক আছে! প্রস্তুত থাকো! আজ হয় এসপার নাহয় ওসপার!”
বলেই তিনি তৎক্ষনাৎ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে উদ্যোত হলেন। অরিন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎই পেছন থেকে বলে ওঠে,
“ আমি তোমার বলা কথাটা বললে, তুমি আমার ডাক্তার সাহেবকে বাড়ি থেকে বের করে দিবে না তো?”
হঠাৎ বাক্যে থমকালো কবির সাহেবের পাদু’টো। তিনি পেছনে না ফিরেই জবাব দিলেন,
“ না…দিবো না!”
অরিন ভেজা চোখে তাচ্ছিল্যের হাসি টানলো ঠোঁটের কোণে। হাতদুটো দিয়ে নিজের সিক্ত চোখদুটো কোনমতে মুছে নিয়ে বললো,
“ ঠিক আছে! তোমার কথাই রইলো বড়আব্বু! কিন্তু আমারও একটা কথা শুনে রাখো!”
ভ্রু কুঁচকান কবির সাহেব। সন্দিহান গলায় বলে ওঠেন,
“ কি?”
অরিন ফিচেল হেসে বলে ওঠে,
“ আমি এমনটা বললেও তোমার ছেলে মানবে তো? দেখো আবার!আমার জন্য সে কোনো পাগলামি না করে বসে!”
“ এতো বিশ্বাস?”
অরিন এবার পেছনে ঘুরে তাকায়। ভিষণ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলে ওঠে,
“ আছে বৈকি!”
★বর্তমান!
কবির সাহেবের প্রতিটি কথাই যেন একেকটা তীরের ফলার ন্যায় বিঁধছে সকলের মনে! রাফিয়া বেগম শক্ত হয়ে বসে আছেন ফ্লোরে। মানুষটার চোখদুটো একেবারেই শুষ্ক! হয়তো বুক ভরে আসায় চোখদুটো শুষ্ক হয়ে গেছে তার। না-কি সবটা না জেনেই মেয়ের ওপর হাত তোলার অপরাধবোধ তাকে ওমন শক্ত করে ফেলেছে কে জানে! অনিক শক্ত মুখে বোনকে বাহুডোরে আগলে রেখে দাঁড়িয়ে আছে সিঁড়ির কোণে। এদিকে রৌদ্র ঠোঁট কামড়ে ধরে মাথা নিচু করে রেখেছে। ছেলেটার চোখেমুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে রাগান্বিত ভাব। চোখদুটো কেমন রক্তবর্ণ হয়ে গেছে ইতোমধ্যে! হাতদুটো তো সে-ই কখন মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেছে আপনাআপনি!
কবির সাহেব খানিকটা দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললেন। সকলের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে ভেজা চোখে হাসলেন একটুখানি। নরম কন্ঠে বললেন,
“ খুব রাগ হচ্ছে না আমার ওপর? হ্যা… হওয়াটাই স্বাভাবিক! কিন্তু..কিন্তু আমি যে একেবারেই নিরুপায় ছিলাম। যেখানে আমি..এই কবির এহসান, গত ২৪ বছর আগে নিজের আপন বোনকে ভালোবাসার অপরাধে বাড়ি থেকে ত্যাজ্য করে দিয়েছিলাম,সেখানে আজ..নিজের সন্তানদের ভালোবাসা কিভাবে ওতো সহজে মেনে নেই বলোতো? আমার মনে বারেবারে শুধু একটা কথাই আসতো, আমি পাখির সাথে অন্যায় করেছি। ঠিকই তো! বোনটা তো আমার কোনো দোষ করেনি! তবুও কেনো তাকে রাগের মাথায় ওভাবে দূরদূর করে তাড়িয়ে দিলাম? দিলাম তো দিলাম.. পরবর্তীতে একটাবারও কেনো ডেকে আনলাম না তাদের?”
থামলেন কবির সাহেব। হয়তো গলা ধরে এসেছে তার। ভাইয়ের এমন কষ্ট হচ্ছে দেখে সাব্বির সাহেব দৌড়ে চলে এলেন ভাইয়ের কাছে। এসেই দু’হাতে আগলে নিলেন ভাইকে।কবির সাহেব আলতো হাসলেন। সাব্বির সাহেবের পিঠ চাপড়ে বললেন,
“ এই হচ্ছে এক পাগল ছেলে! কিরে ভাই তুই? আমার এতো এতো অন্যায় দেখেও কিভাবে পারলি সবটা মুখ বুঁজে সইতে? যেখানে বাড়ির সবাই আমার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলো সেখানে তুই কেনো ঢাল হয়ে আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলি? কেনো এতোটা অসহায়ের মতো আমার পা ধরে ছেলেমেয়ে দুটোর জন্য ওভাবে কাঁদতে গেলি? তুই কি পারতিস না? একটাবারের জন্য হলেও একটু শক্ত হয়ে বলতে — ভাইজান তুমি ভুল! এইবার তুমি ভুল করছো! কেনো বললি না ভাই? আমার ছোট হয়েও কোত্থেকে পেলি এতো ধৈর্য্য? আরেহ…এতক্ষণে বুঝলাম.. আমার অরিটা এতো ধৈর্য্য কোত্থেকে পেলো!”
কবির সাহেব আবারও থামলেন।সাব্বির সাহেবকে নিজের বুকে টেনে এনে ফের বললেন,
“ তোর রক্ত বইছে না ওর শরীরে! তাই তো বাবার মতোই ধৈর্য্য পেয়েছে মেয়েটা! কিন্তু আমার ছেলেটা আমার মতো হলো না কেনো রে? ও কিভাবে এতো মুখ চোরা হলো? কোত্থেকে পেলো এতো আদর্শ? ও তো পারতো সাব্বির… নিজের ভালোবাসাকে আগলে নিয়ে আমাদের ছেড়ে চলে যেতে! কিন্তু ও কেনো এমনটা করলো না? আমার…আহ!”
কথার মাঝেই হুট করে বুকের ব্যাথায় মৃদুস্বরে ককিয়ে উঠেন কবির সাহেব। বাড়ির সকলে মুহুর্তেই হকচকিয়ে ওঠেন তার ওমন ককিয়ে ওঠা শুনে।রৌদ্র তো ছুটে চলে এসেছে বাবার কাছে। ছেলেটা বাবার পায়ের কাছে একহাঁটু গেড়ে বসে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করতে থাকে,
“ কোথায় ব্যাথা হচ্ছে আব্বু? কোথয় কষ্ট হচ্ছে? আমায় বলো! কি হলো?”
কবির সাহেব ব্যাথাতুর হাসলেন। ছেলের মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বললেন,
“ মাফ করে দে বাপ! তোকে এতোটা কষ্ট দেওয়ার জন্য! কিন্তু আমি কি করবো বল? তোর দিকে তাকালেই আমার পাখির কথা মনে পড়ে বারবার। জানিস?প্রতি মাসে প্রায় দুবার করে আমি দূর থেকে দেখে আসতাম আমার বোনটাকে। তোদের সবার অগোচরে। কেনো যেতাম? জানি নাহ! শুধু জানি,ওদের একপলক দেখে না এলে অস্থির লাগতো আমার! রেহানের বাবা যে শাহানুরের বন্ধু সেটাও আমি আগে থেকেই জানতাম। তবুও সেদিন বোনটাকে দেখে অচেনার মতো ভাব নিয়েছিলাম। রোদ! আমি বহুবার চেয়েছি বাবা…আমার বোনটাকে একটু বুকে টেনে নিতে। বহুবার চেয়েছি তাকে আদর করে পাখি ডাকতে কিন্তু যতবারই নিজেকে প্রস্তুত করতাম এমনটা করবার জন্য ঠিক ততোবার আম্মার মৃত মুখটা ভেসে উঠতো চোখের সামনে! আমি….আমি ভুলতে পারিনা আম্মার চলে যা-ওয়াটা! ভুলতে পারিনা, আম্মার কান্নাগুলো। এখন তুইই বল রোদ.. বোনটার সাথে অন্যায় করে, আমি কিভাবে তোদের সাথে ন্যায় বিচার করি? যেখানে বোনটার কাছেই এখনো নিজের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইতে পারলাম না, সেখানে… ”
বাকিটা আর বলতে পারলেন না দূর্বল কবির সাহেব। মানুষটা বুকে হাত চেপে পেছনের দিকে গা এলিয়ে বসলেন। রৌদ্র ছলছল চোখজোড়া নিয়ে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। সে কিছুটা গলা খাঁকারি দিয়ে বলে ওঠে,
“ ঘরে চলো আব্বু! শরীর খারাপ করছে তোমার!”
চট করে সোজা হয়ে বসলেন কবির সাহেব। সিক্ত চোখদুটো হাতের উল্টো পিঠে কোনমতে মুছে নিয়ে তায়েফ সাহেবকে বললেন,
“ গাড়ি বের কর তায়েফ! যেতে হবে আমাদের!”
তায়েফ সাহেব ভ্রু কুঁচকালেন।সন্দিহান গলায় বলে ওঠেন,
“ এই শরীর নিয়ে আবার কোথায় যাবে? এখন কোত্থাও যেতে হবে না। তুমি বরং অন্যসময়….”
“ তোকে যা বলেছি তা কর! আমি কবির এহসান এখনো যথেষ্ট বলবান! সে নিয়ে কোনো সন্দেহ করিস না। তারাতাড়ি গাড়ি বের কর!”
অগত্যা এমন ধমকে তড়িঘড়ি করে মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলেন তায়েফ সাহেব। কবির সাহেব ধীরে ধীরে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন।সাব্বির সাহেবও ভাইয়ের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। কবির সাহেব আলতো হেসে মানুষটার একহাত চেপে ধরে সামনে এগোলেন। খানিকটা এগিয়ে আসতেই তায়েফ সাহেবের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর মুখে বললেন,
“ তোকে কি আলাদা নিমন্ত্রণ পত্র পাঠাতে হবে না-কি? চল আয়….”
তাশরিক সাহেব মাথা চুলকে মুচকি হাসলেন। তারপর বড় ভাইয়ের একহাত চেপে ধরে এগোতে লাগলেন তালে তাল মিলিয়ে। এদিকে তাদের ওমন চলে যাওয়ার পথে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো বাড়ির সকলে। এতদিনে যেন বাড়িতে জান ফিরে এলো!
বাড়ির কর্তাদের চলে যাওয়ার পরপরই রেহান বেরিয়ে গেলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে।তার বউটা যা অসুস্থ… এমুহূর্তেই হসপিটাল থেকে টেস্টের রিপোর্টগুলো না আনলেই নয়! রুহি দূর্বল শরীরটা নিয়ে কোনমতে হেলেদুলে মায়ের ঘর অবধি গিয়েছে ওমনি তার শরীরটা কেমন টলতে লাগলো। রৌদ্র বোনের এহেন অবস্থা দেখে তৎক্ষনাৎ ছুটে এলো। বোনকে নিজের সঙ্গে আগলে নিয়ে আলতো স্বরে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি হয়েছে তোর? খারাপ লাগছে খুব?”
রুহি চোখবুঁজে পড়ে আছে ভাইয়ের বুকে। ভাইয়ের কথার প্রতিত্তোরে শুধু হু,হা তেই জবাব দিয়ে যাচ্ছে মেয়েটা। রৌদ্র তৎক্ষনাৎ মেয়েটাকে পাঁজা কোলে তুলে নিলো। তারপর এগিয়ে গেলো রুহির ঘরের দিকে। জুবাইদা বেগমসহ বাকিরাও ছুটলেন রৌদ্রের পিছুপিছু।
❝ টিং টং…..টিং টং….❞
একের পর এক কলিং বেল বেজেই চলেছে অথচ কেও এসে গেটটা খুলছেই না! ইকরা এবং ইফতি ড্রয়িং রুমে বসে সে-কি তর্কাতর্কি চালাচ্ছে নিজেদের মধ্যে! মনে হচ্ছে — তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ এই বুঝি তাদের মধ্যেই লাগলো বলে! শাহানুর সাহেব নিজের ঘরে বসে আরামসে পত্রিকা পড়ছেন। তার আর বাইরে কি ঘটছে তা নিয়ে বিলকুল ইন্টারেস্ট নেই! সে-তো নিজের মধ্যেই ব্যস্ত! ওদিকে কলিং বেল যেন থামবার নামই নিচ্ছে না। এহেন অনবরত শব্দে অবশেষে রান্নাঘর থেকে হাঁক ছুড়লেন আমরিন বেগম।
“ ইফতি,ইকরা? তোদের কানে কি তুলো গুঁজে রেখেছিস? সে-ই কখন থেকে কলিং বেলটা বাজছে,গেটটা খুলছিস না কেনো?”
মায়ের ওমন হাঁকা-হাকাঁতিও তেমন কোনো হেলদোল দেখা দিলো না ইফতি কিংবা ইকরার মাঝে।তারা তাদের মধ্যে চলমান যুদ্ধটা খানিক বিরতি দিয়ে একজন অপরজনকে বলছে,
“ যা গেট খোল!”
ইফতির ওমন আদেশবাক্যে নাক-মুখ কুঁচকে তাকায় ইকরা।মুখ ভেংচি কেটে বলে ওঠে,
“ তুই যা..আমি পারবোনা।”
নিজের হাঁটুর বয়সি মেয়ের মুখে ওমন ত্যাড়া ত্যাড়া কথা শুনে গায়ে বুঝি ভারি জ্বলুনি ধরলো ইফতির। সে কেমন দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“ যা তারাতাড়ি! নাহলে আম্মুর কাছে কিন্তু বিচার দিবো আমি!”
ইকরা মুখ বাঁকায়।দৃষ্টি সরিয়ে আনলো ভাইয়ের ওপর থেকে। তারপর নিজ আসনে অনড় হয়ে বসে থেকে ফোঁস ফোঁস করতে করতে বললো,
“ যা মনে চায় কর যা….”
ওদিকে ফের কলিং বেল বেজে উঠলো। এবার যেন ধৈর্য্যের বাধঁ ভেঙে গেলো আমরিন বেগমের।তিনি হাতে খুন্তি নিয়েই ছুটে এলেন রান্নাঘর থেকে। ড্রয়িং এ পা রাখতেই মুখটা শক্ত হয়ে এলো তার। ভাবা যায় — ছেলেমেয়ে দুটো কতটা পাঁজি হয়েছে দিনদিন! সে-ই সঙ্গে ম্যানার্সটাও বুঝি ভুলে বসেছে একপ্রকার! আমরিন বেগম ছেলেমেয়েদের দিকে গরম খুন্তি তাক করে দাতঁ কটমট করতে করতে বললেন,
“ তোদের আজকে খবর আছে দেখবি!”
বলেই তিনি তড়িঘড়ি করে চলে গেলেন সদর দরজার দিকে। একহাতে খুন্তি নিয়েই দরজাটা খুলে দিলেন তিনি।আর পরক্ষণেই দরজার সামনে যাদের দেখলো তাতেই যেন হা হয়ে গেলো মানুষটা! হতবিহ্বলতায় হাতের স্টিলের খুন্তিটাও অবহেলায় গড়িয়ে পড়লো ফ্লোরে। আমরিন বেগম ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে তড়িৎ গতিতে দরজার আড়ালে গিয়ে লুকিয়ে পড়লেন। বুকটা কাঁপছে তার, সেই সাথে বদনেও এসেছে মৃদুমন্দ কম্পন। ইফতি মায়ের এহেন অবস্থা দেখে তৎক্ষনাৎ ছুটে এলো দরজার সামনে। মায়ের দিকে তাকিয়ে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করে বসে,
“ কি হয়েছে তোমার? এভাবে কাঁপছো কেনো?”
আমরিন বেগম কথা বলছেন না। তিনি বুকে হাত চেপে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন একাধারে। খানিকক্ষণ বাদে তিনি কন্ঠ খাদে নামিয়ে ছেলেকে বলে,
“ বাইরে কি সত্যি তারা দাঁড়িয়ে আছে ইফতি? না-কি এটা আমারই বিভ্রম?”
ইফতি এবার বাইরে দৃষ্টি তাক করলো। পরক্ষণেই তার অবাক কন্ঠ ফুড়ে বেরিয়ে এলো —
“ আপনারা?”
দরজার সামনে বুকের কাছে দু’হাত ভাজঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন এহসান পরিবারের চার ভাই! ইফতির কথায় মুচকি হাসলো তায়েফ সাহেব। বললো,
“ মামা বলতে কষ্ট লাগে ব্যাটা?”
ইফতি এবার বেশ অবাক হলো।সেও তো তার মায়ের মতো বিভ্রম নিয়ে তাকিয়ে আছে। হয়তো এখনো তার বিশ্বাস হচ্ছে না পুরো ব্যাপারটা! অবশেষে কবির সাহেব মুখ খুললেন। কোমরের পেছনে দু’হাত বেঁধে ভারিক্কি কন্ঠে বললেন,
“ এখান থেকেই চলে যাবো পাখি? ভাইকে ভেতরে ডাকবি না?”
অগত্যা এমন কথায় তড়িঘড়ি করে আড়াল থেকে বেরিয়ে আসেন আমরিন বেগম। চোখেমুখে একরাশ বিভ্রম লেপ্টে তিনি টলমল পায়ে এগিয়ে আসেন ভাইদের নিকট। তারপর কে জানে কি হলো তার! তিনি আর নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলোনা! হুট করেই বড় ভাইয়ের বুকটা দখল করে নিলেন তিনি। হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন বড় ভাইয়ের পিঠ আঁকড়ে। কবির সাহেব ভেজা চোখে হাসলেন খানিকটা। হাত বাড়িয়ে বোনের মাথায় আলতো করে বুলিয়ে দিতে লাগলেন নিঃশব্দে। না তিনি কিছু বলছেন, আর না বোনকে থামাচ্ছেন।কাঁদতে দিচ্ছেন বোনটাকে।হয়তো জমিয়ে রাখা কান্নাগুলো বেরিয়ে পড়লেই সবটা সহজ হবে তাদের জন্য!
“ হ্যালো স্যার? স্যার শুনছেন?”
হসপিটাল থেকে কল চলে আসায় খানিকটা সময় নিয়ে রিসিভ করে রৌদ্র। রুহিটা এখনো কেমন অসার হয়ে পড়ে আছে বিছানায়। রেহানটাও যে সে-ই কখন বেরুলো রিপোর্ট আনতে,এখনো তো ফেরার নামগন্ধটিও নেই! রৌদ্র ফোনটা রিসিভ করে কানে ঠেকাতেই ওপাশ থেকে একজন নার্স ব্যস্ত হয়ে কথাগুলো বলতে লাগলো রৌদ্রকে। রৌদ্র ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করে,
“ হ্যা শুনছি,কি হয়েছে?”
“ স্যার, আপনার বন্ধু.. কি যেন নাম..”
“ রেহান?”
“ জ্বি স্যার… তিনি! ”
রৌদ্রের গুটিয়ে রাখা ভ্রূদ্বয় আরো খানিকটা কুঁচকে আসে।সে তৎক্ষনাৎ সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“ কি হয়েছে ওর? কোথায় ও?”
“ স্যার আর বলবেন না… আপনার বন্ধু এসেছে তার ওয়াইফের টেস্ট রিপোর্ট নিতে এন্ড রিপোর্ট পজিটিভ আই মিন পেশেন্ট ইজ প্রেগন্যান্ট। ব্যাস এটুকুই বললাম আমরা আর ঠিক তক্ষুনি আপনার বন্ধু খবরটা শোনামাত্রই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে! এখন আমরা কি করবো স্যার?”
এহেন একটা সুখবরে বেচারা রৌদ্র বোনের জন্য খুশি হবে না-কি বন্ধুর অবস্থা শুনে দুঃখী হবে এ নিয়ে পড়লো চরম বিপাকে! ছেলেটা তৎক্ষনাৎ ঠোঁট কামড়ে হাসলো নিঃশব্দে। কপালে খানিকটা আঙুল স্লাইড করতে করতে বললো,
“ ওকে দেখে রাখুন, আমি আসছি!”
“ ওকে স্যার!”
রৌদ্র নিজ থেকে ফোনটা খট করে কেটে দিলো।তারপর বোনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে এগিয়ে গেলো বিছানার কাছে। রুহির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে, কপাল বরাবর আলতো করে চুমু খেয়ে বসলো ছেলেটা। বিরবির করে বললো,
“ কংগ্রেস বুড়ি!”
চোখ বুঁজে রেখেই খানিকটা নড়েচড়ে উঠলো রুহি। মেয়েটাকে নড়তে দেখেই রৌদ্র সর্তক বুলি আউড়ে বললো,
“ উঁহু! টেক রেস্ট বাচ্চা! ভাইয়া আসছি!”
বলেই সে চলে যেতে লাগলো ঘর ছেড়ে। ঠিক তখনি জুবাইদা বেগম আটকালেন ছেলেকে।সন্দিহান কন্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললেন,
“ কি হয়েছে রোদ?এখন আবার কোথায় যাচ্ছিস তুই?”
রৌদ্র ঘাড় বাকিয়ে তাকায় মায়ের দিকে। মুখ টিপে হেসে বলে ওঠে,
“ তোমার মেয়ের জামাইকে আনতে যাচ্ছি!”
এহেন কথায় ফের ভ্রু কুঁচকান জুবাইদা বেগম। বলেন,
“ আনতে যাচ্ছিস মানে? রেহান না হসপিটালে?”
রৌদ্র বাঁকা হাসলো এবার। মায়ের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে বলে ওঠে,
“ হু,হসপিটালে! তাও আবার জ্ঞান হারিয়ে বসে আছে!”
“ কিহ?” — একসঙ্গে প্রায় সকলেই আঁতকে ওঠে বললেন কথাটা। রুহি তো তৎক্ষনাৎ দূর্বল শরীরটা নিয়ে কোনমতে হেলেদুলে উঠতে চাইলো, সে-তো অরিনটা গিয়ে তাকে আগলে নিলো নিজের সঙ্গে! জুবাইদা বেগম অস্থির হয়ে বললেন,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬১
“ জ্ঞান হারিয়েছে মানে? কি হয়েছে ছেলেটার?”
রৌদ্র ফোঁস করে নিশ্বাস ফেললো।মুচকি হেসে বললো
বলে ওঠলো,
“ আমি মামা হচ্ছি মা… মামা…ভেবেছিলাম মিষ্টি এনে তারপরেই কথাটা বলবো কিন্তু..সে যাকগে! তোমার আধপাগল জামাই বউয়ের প্রেগ্ন্যাসির কথা শুনেই জ্ঞান হারিয়েছে।বোধহয় অতিরিক্ত আনন্দে এহেন অবস্থা হয়েছে তার! তাইতো এখন তাকেই আনতে যাচ্ছি।”