আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৬
অরাত্রিকা রহমান
রাত তখন ঠিক নয়টা বাজে।
চারপাশে এক অদ্ভুত শান্তি নেমে এসেছে—বাড়ির আঙিনায় হালকা ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। বড় বাড়িটা যদিও আলোয় ভরা, তবুও ভেতরে যেন এক অদৃশ্য চাপা উত্তেজনা টের পাওয়া যায়।
রান্নাঘরের ভেতর দাঁড়িয়ে আছেন রামিলা চৌধুরী। হাতে এপ্রোন বাঁধা, চুলগুলো খোঁপায় তোলা। তিনি বড় একটা হাঁড়ি চুলার ওপরে বসাচ্ছিলেন।
তার অভ্যাস ছিল—যত রাতই হোক না কেন, ঘরে সবার খাবারটা নিজ হাতে তৈরি করবেন। চাকর-বাকর আছে, কিন্তু নিজের হাতে রান্নার তৃপ্তি, বিশেষ করে সন্তানদের মুখে নিজের রান্না খাওয়ানোর আনন্দ, তিনি কোনো কিছুর সাথেই তুলনা করতে পারতেন না।
কিন্তু অসাবধানতাবশত!
সবজি কাটতে কাটতেই হঠাৎ তার আঙুলে ছুরি লেগে যায়।
“আহ্…”
একটুখানি চিৎকার বেরিয়ে এল তাঁর মুখ থেকে। হাতের আঙুল দিয়ে সাথে সাথেই লাল রক্ত গড়িয়ে পড়ল।
এই আওয়াজটা ড্রয়িংরুম পর্যন্ত ভেসে গেল।
ড্রয়িংরুমে তখন মিরায়া সোরায়ার উদ্ভট ও অকারণে রায়ান আর তাকে জড়িয়ে বলা কথায় বিরক্ত হয়ে বসে ছিল। সোরায়া ছোট মানুষ, হয়তো বুঝে বলেনি যা বলেছে, তবে কথাআ কেন জানি মিরায়ার যুক্তি সংগত মনে হয়নি তাই মিরায়া মুখ গোমড়া করে সোফার কোণে হেলান দিয়ে বসেছিল। কিন্তু রান্নাঘর থেকে আসা ‘আহ্’ শব্দে তার ভ্রু কুঁচকে গেল।
সে এক মুহূর্তে কোনো দেরি না করে ছুটে গেল রান্নাঘরের দিকে।
রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকতেই তার চোখে পড়ল—রামিলা চৌধুরী হাতের আঙুল চেপে ধরে আছেন, আর চুলার ওপর রাখা হাঁড়ি থেকে হালকা ধোঁয়া উঠছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“মামনি!”
—মিরায়ার কণ্ঠ কেঁপে উঠল। ছুটে গিয়ে সে রামিলা চৌধুরীর হাতটা নিজের হাতে নিলো।
“তুমি সবজি কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলেছ? আমাকে বলতে আমি কেটে দিতাম। এই কাটা হাতে আবার রান্না করবে তুমি? না, হবে না! এখনি চলো আমি ড্রেসিং করে দিচ্ছি কাটা জায়গটা।”
রামিলা চৌধুরী স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হালকা হাসি চাপতে চেষ্টা করে বললেন-
“এত বড় কিছু না মিরা মা। সামান্য কেটেছে, একটু পানি দিলেই ঠিক হয়ে যাবে।”
মিরায়া তবুও এক বিন্দু ছাড়লো না। তার কণ্ঠে ছিল জেদ আর মমতার মিশ্রণ—
“না মামনি, আজ আর তুমি একটুও রান্না করবে না। আমি রান্না করব। তুমি এক্ষুনি তোমার রুমে গিয়ে বিশ্রাম নাও। এখন এই হাতে রান্না করার কষ্ট করতে হবে না।”
“আরে সমস্যা হবে মিরা। বললাম তো তেমন কিছু হয় নি,”
—মৃদু বিরক্তির সুরে বললেন রামিলা চৌধুরী।
“তুই তো এসব পারবি না, বড় বড় হাঁড়ি বসানো, মশলা ফোড়ন দেওয়া সহজ কাজ না।”
মিরায়া এবার রামিলা চৌধুরীর হাত শক্ত করে চেপে ধরল। তার চোখ চিকচিক করছে, যেন অভিযোগ ঝরে পড়ছে প্রতিটি কথায়—
“মামনি, তুমি কি আমাকে এতটাই ছোট ভাবো? তুমি না আমাকে তোমার মেয়ে বল। আমি যদি তোমার মেয়ে হই, তবে তোমার জন্য একদিনের রান্না করতে পারব না? তুমি তো সবসময়ই আমাদের জন্য রান্না করো। আজ অন্তত আমাকে করতে দাও।”
রামিলা চৌধুরী একটু থমকালেন। মিরায়ার চোখে এই অদ্ভুত দৃঢ়তা দেখে তিনি চুপ করে গেলেন। তার ভেতরে এক অদ্ভুত আবেগ খেলে গেল।
তবুও তিনি বললেন,
“মিরা, রান্নাঘরের কাজ খেলা নয়। তোর যদি কিছু হয়ে যায়?”
মিরায়া মাথা নেড়ে হালকা হাসল।
“আমার কিছু হবে না মামনি। তুমি শুধু খাবার খেয়ে দেখো, আমি সব সামলে নেব। আর যদি কিছু হয়ও, তাতে কিছু আসে যায় না আমরা মামণি আমাকে সামলে নেবে আমি জানি । তাই না?”
মিরায়ার এই কথায় রামিলা চৌধুরীর বুকটা হঠাৎ ভরে উঠল। তিনি কেমন যেন নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—
“তুই জেদি মেয়েই রয়ে গেলি।”
“হ্যাঁ, আমি তোমার মেয়ে তো মামনি,”—দুষ্টুমি ভরা হাসি দিল মিরায়া।
অবশেষে হার মেনে গেলেন রামিলা চৌধুরী। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন—
“আচ্ছা, ঠিক আছে। তোর যা ইচ্ছে তাই কর। তবে সাবধানে করিস। আমি যাচ্ছি আমার রুমে। প্রয়োজনে ডাকবি কিন্তু।”
মিরায়া মাথা নাড়ায় হ্যাঁসূচক আর বলে-
“ওকে মামণি।”
মিরায়া তাড়াতাড়ি রামিলা চৌধুরীর হাতটা ধুয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। তারপর তার কাঁধে হাত রেখে রুম পর্যন্ত এগিয়ে দিলো। বিদায় নেয়ার সময় মিরার কণ্ঠে নরম আদেশের সুর—
“মামনি, একটুও চিন্তা করো না। আমি সামলে নেব। তুমি শুধু রেস্ট নাও।”
রুমে পাঠিয়ে দিয়ে মিরায়া আবার রান্নাঘরে ফিরে এল।
চুলার আগুন নতুন করে জ্বালালো, হাঁড়িতে পানি দিল, মশলা গুছিয়ে রাখল। এক অদ্ভুত তৃপ্তি তার চোখে-মুখে ভাসছে।
রান্নাঘরের ভেতর ধোঁয়া আর মশলার গন্ধে ভরে উঠল পরিবেশ। মিরায়ার হাতের নড়াচড়ায় প্রতিটি পদক্ষেপে ফুটে উঠছে তার যত্ন আর আন্তরিকতা। আর রান্নাঘরের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো ঢুকে মিশে গেল সেই দৃশ্যে—।
রাত তখন সাড়ে নয়টার দিকে।
রায়ান তার রুমে বসে আছে অনেকক্ষণ ধরে। সারাদিনের টেনশন, মনের ভেতরে জমে থাকা বিরক্তি, মিরায়ার চিন্তা, ধারাবাহিক ঘটনার কারণে কিছু খাওয়া হয়নি। কিন্তু মানুষের শরীর তো ব্যস্ততা বোঝে না।
পেটটা তখন প্রচণ্ড ক্ষুধায় মোচড় দিয়ে উঠতে লাগল।
চোখের সামনে ভেসে উঠছে সুস্বাদু খাবার—যেন মনের ভেতর থেকে শরীর বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে,
“কিছু একটা খেতে হবে।”
রায়ান একসময় দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াল। মনে মনে ভেবেছিল—
“আম্মুই হয়তো রান্নাঘরে রান্না করছে… গিয়ে দেখি কিছু খাওয়া যায় কিনা।”
ধীর পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে লাগল। প্রতিটা ধাপ যেন তার অলসতা আর ক্ষুধার সাথে মিশে যাচ্ছে। সিঁড়ির নিচে নেমেই গন্ধটা প্রথমে টের পেল—ভাজা পেঁয়াজের হালকা ঘ্রাণ, মশলার সুবাস। একেবারে টাটকা গন্ধ।
তার চোখ একটু উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
“হুম, আম্মুই তো রান্না করছে মনে হয়…”
সে রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল। দরজার কাছে এসে থমকালো। ভেতরে হালকা আলোয় সে যে দৃশ্যটা দেখল—তা দেখে রায়ান কয়েক মুহূর্ত অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
চুলার আগুনে হাঁড়ি চাপানো, পাশেই কাটা সবজি গুছানো, আর গায়ে হালকা ক্লান্তির ছাপ নিয়ে মিরায়া রান্না করছে।
চুলের দু’একটা গোছা খোঁপা থেকে বের হয়ে কপালে লেগে গেছে, তবুও সে একাগ্র হয়ে হাঁড়ি নাড়ছে। চোখে মুখে ভীষণ সিরিয়াস একটা ভঙ্গি—যেন এই রান্নাই তার কাছে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব।
রায়ানের মনে অদ্ভুত এক ঝটকা লাগল।
“মিরা? রান্না করছে?!”
তার পা যেন আপনিই ধীরে ধীরে রান্নাঘরের ভেতরে ঢুকে গেল। রায়ান দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চোখের সামনে চুলার আগুনে ব্যস্তভাবে রান্না করছে মিরায়া। হাতের ভঙ্গি দৃঢ়, কিন্তু মুখে একটা একাগ্রতা—যেন ভেবে রেখেছে আজকের রান্না নিখুঁত করবেই।
চুলের খোঁপা একটু এলোমেলো, কপালে ঝরে পড়া কয়েকটা আলগা গোছা ঘাম মাখা মুখে হালকা লেপ্টে আছে। কপালে মুখে জমা ঘাম, বারবার কনুই দিয়ে ঠিক করে নিচ্ছে। তবুও তার চোখেমুখে ভীষণ এক শান্ত সৌন্দর্য—যেটা একদম গৃহিণীর মতো।
রায়ান দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ টের পেল নিজের বুকের ভেতর কেমন জানি অচেনা দোলা লাগছে।
তার চোখে যেন মুহূর্তে একটাই দৃশ্য—
তার বউ, একদম পাক্কা গিন্নির মতো রান্না করছে।
সে মনে মনে অদ্ভুত মুগ্ধতার সাথে ভেবে উঠল—
“উফ্! আমার বউটাকে কি সুন্দর লাগছে! চুল বাঁধা, গরম চুলার সামনে দাঁড়ানো, আর সেই মনোযোগী মুখ… হুমম, একেবারে পারফেক্ট ওয়াইফ মেটেরিয়াল। আগে কখনও এভাবে খেয়াল করিনি যে এ অবস্থায়ও ওকে এতটা সুন্দর লাগতে পারে।”
রায়ান নিজেই নিজের মনে একটু হাসল।
রান্নাঘরের ভেতরে হাঁড়ির ঢাকনা ঠকঠক করে উঠছে। মিরায়া কপালের চুলটা পেছনে সরিয়ে সামনের দিকে মনোযোগ দিয়ে দাঁড়িয়ে রান্না করছে।
হঠাৎ করেই মিরায়ার মনে হল, পেছন থেকে কেউ তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিটা খুব চেনা, যেন গরম দুধের উপর ভাসতে থাকা আস্ত একটা তুলোর টুকরো—নরম অথচ ভয়ানক ভারী!
মিরায়া ভ্রু কুঁচকে হালকা হাসল। তার মনে হল—
“হুম, সোরায়াই বোধহয় এসেছে… একটু আগেই রাগ করে ঘর থেকে বের হয়েছিল, এখন বোধহয় মানাতে এসেছে।”
সে রান্না থামাল না, শুধু চামচ দিয়ে গ্রেভি নাড়তে নাড়তে বলল—
— “থাক হয়েছে। আর রাগ ভাঙাতে হবে না। আমি তো আর রাগ করে নেই। দেখ বনু, আমি রান্না করছি… একবার এদিকে আয়, টেস্ট করে দেখ, সব ঠিকঠাক আছে কিনা?”
পেছনে দাঁড়ানো রায়ান একদম হতভম্ব!
সে ভেবেছিল, হয়তো মিরায়া একটু লজ্জা পাবে, অন্তত তাকিয়ে বলবে, “এই যে, এখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?” কিন্তু না—মিরায়া একেবারে সোজাসাপটা ধরে নিয়েছে সোরায়া এসেছে!
রায়ান ভেতরে ভেতরে দুষ্টু হেসে উঠল, “আরে বাহ! ব্যাপারটা তো আরও জমে গেল।”
ধীর পায়ে সে মিরায়ার ঠিক পিছনে এসে দাঁড়াল। মিরায়া বুঝতেও পারল না যে যাকে সে সোরায়া ভেবে কথা বলছে, সেটা আসলে তার স্বামীই।
মিরায়া চামচে ভরে হাঁড়ি থেকে একটু গ্রেভি বের করে নিজের আঙুলে ছুঁইয়ে ফু দিয়ে নিয়ে পিছন ফিরল না, সোজা হাত বাড়িয়ে দিল পেছনে—
— “দেখতো, কেমন হয়েছে? ঠিক আছে তো?”
রায়ানের চোখ চকচক করে উঠল। এ সুযোগ মিস করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না!
সে মিরায়ার বাড়ানো আঙুলটা আলতো করে নিজের ঠোঁটের ভেতর নিয়ে চেটে খেল গ্রেভি। মোলায়েম মশলার স্বাদ মুখে মিশে গেল, কিন্তু তার থেকেও বেশি মাতাল করা ছিল মিরায়ার স্পর্শ।
মিরায়া নিশ্চিন্ত গলায় বলল—
— “ বনু ? কেমন লাগল?”
তারপর নিজেই আঙুলটা সরিয়ে এনে আবার হাঁড়ি থেকে একটু গ্রেভি তুলল একই আঙুলে, এবার নিজেই টেস্ট করে বলল—
— “হুমম… সব তো ঠিকই লাগছে। কি বলিস?”
ঠিক তখনই পিছন থেকে রায়ান দুষ্টু গলায় ফিসফিস করে উঠল—
— “জব্বর টেস্ট হয়েছে, মাই মিসেস…পারফেক্টলি ফাইন জাস্ট লাইক ইউ।”
মিরায়া প্রথমে জমে গেল বরফের মতো। তারপর তার চোখ একেবারে কপালে উঠে গেল!
সে ঘুরে দাঁড়াতেই দেখে রায়ান দাঁড়িয়ে আছে, ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি, চোখে টলমলে মজা আর মুগ্ধতা।
মিরায়ার মুখ লাল হয়ে গেল রাগে না লজ্জায় বোঝা মুশকিল।
সে হাঁ করে তাকিয়ে রইল, তারপর গম্ভীর গলায় বলল—
— “আপনি??? আমি তো ভেবেছিলাম সোরায়া…এটা কি হলো? কি করলেন এটা?”
রায়ান কাঁধ ঝাঁকালো, একদম ঠান্ডা মেজাজে—
— “কি করলাম? তোমার হাতের রান্নার টেস্ট করলাম। খাওয়া-দাওয়ার ব্যাপারে আমি খুব সিরিয়াস, জানো তো।”
মিরায়া রেগে রায়ানের চেটে খাওয়া আঙ্গুল সামনে এনে বললো –
“তাই বলে আপনি আমার আঙ্গুল চাট…।”
সম্পূর্ণ কথা শেষ করল না হঠাৎ চুপ করে গিয়ে আঙ্গুল টা নামিয়ে নিল।
রায়ান স্বাভাবিক মুখে উত্তর করল-
“বাহ রে! নিজেই আঙ্গুল এগিয়ে দিয়ে এখন বলছে আঙ্গুল চেটেছি কেন।”
তারপর একটু থেমে ঠোঁটের কোণে আরও এক চিলতে হাসি এনে যোগ করল—
— “আর হ্যাঁ, টেস্টটা শুধু গ্রেভির না…তোমার টেস্টও জব্বর লেগেছে। জানো তোমাকে একেবারে আসল গিন্নি লাগছে। কিচেনে তোমাকে দেখে আমার তো বুকেই আগুন জ্বলছে।”
মিরায়া রাগ দেখাতে চাইলেও নিজের মুখের কোণে ছোট্ট একটা লজ্জার রেখা ফুটে উঠল।
সে চামচ দিয়ে হাঁড়ির ভেতর ঠকঠক শব্দ করে বলল—
— “চুপ করুন! বেশি বকোবেন না। যান এখান থেকে, বসে থাকুন। রান্না শেষ হলে খাবার পাবেন।”
রায়ান তখনও তার দিকেই তাকিয়ে রইল—যেন হাঁড়ির ভেতরের খাবারের চেয়েও মিরায়ার সেই লাজুক মুখটা বেশি সুস্বাদু!
রায়ান নিজের ভিতরের মনভাব আটকাতে না পেরে বলে উঠে-
“looking yummy!”
মিরায়া চোখ ছোট ছোট করে রায়ানের দিকে তাকাতেই দেখলো রায়ান তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
মিরায়া- “আপনি কি কথাটা আমার উদ্দেশ্যে বললেন?”
রায়ান মাথা হ্যাঁসূচক নেড়ে আবার নাসূচক নাড়লো-
“আই ওয়াজ টকিং অ্যাবাউট দ্যা ফুড, হার্ট-বার্ড। বি পজিটিভ বেইব।”
মিরায়া প্রশ্ন করে-
“বেইব?”
রায়ান পিছন দিকে ফিরে রান্নাঘর ত্যাগ করতে করতে বলে-
“বেইব ইজ আ শর্টকাট অফ সেইং বেইবি , বেইব।”
রায়ান কথার উত্তর করে নির্বিকার চিত্তে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। এদিকে মিরায়া অবাক রায়ানের কথা শুনে।
দরজার দিকে তাকিয়ে মিরায়া দেখল, সে সিঁড়ি বেয়ে ধীর পায়ে উঠে যাচ্ছে।
মিরায়ার হাত থেমে গেল হাঁড়ি নাড়ার মাঝপথে। বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত এক চাপা অনুভূতি জেগে উঠল।
“লোকটা আমার সাথে এমন করে কেন?”—মনের ভেতর প্রশ্নটা হঠাৎ গজিয়ে উঠল।
মিরায়ার মনে একে একে ভেসে উঠতে লাগল সেই শব্দগুলো—
“বেইব…”
“হৃদপাখি…”
“মাই মিসেস…”
তারপর হঠাৎ করে সেই চোখাচোখি মুহূর্তগুলো, যখন রায়ান নির্লিপ্তভাবে তাকিয়ে থেকেছে, আবার মজা করে পাশ কাটিয়ে গেছে। মিরায়ার ঠোঁট শুকিয়ে এল, সে হালকা নিঃশ্বাস ফেলল।
“এটা কি শুধু মজা? নাকি সত্যিই কিছু আছে ওনার ভেতরে?”
চামচটা হাত থেকে সরিয়ে টেবিলের ওপর রাখল মিরায়া। জানালার কাঁচে নিজের অস্পষ্ট প্রতিবিম্ব দেখল—ক্লান্ত কিন্তু অদ্ভুতভাবে আলোকিত মুখ।
তার ভেতর আবার এক ধরণের দ্বিধা কাজ করল।
“রায়ান ভাইয়া যদি সত্যিই আমাকে পছন্দ করত, তাহলে এমন কেন করে মাঝে মাঝে নাকি ইচ্ছে করেই সব আড়াল করে রাখছে… সেই শক্ত, কঠিন মানুষটার মুখোশের ভেতরে?”
মিরায়ার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। অজান্তেই তার ঠোঁটে এক ফোঁটা হাসি ফুটে উঠল, আবার মুহূর্তেই মিলিয়ে গেল।
সে নিজের মনে ধীরে ধীরে বলল—
—“না, আমি বোধহয় বাড়াবাড়ি করছি। কিন্তু… কেন জানি মনে হচ্ছে, রায়ান ভাইয়া সত্যিই আমার দিকে টানছে। উনি কেনইবা বারবার আমাকে ‘মাই মিসেস’ বলে ডাকবে?”
তারপর চুপ করে দাঁড়িয়ে গেল। চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস নিল গভীরভাবে। রান্নাঘরের ভাপের মধ্যে, সেই প্রশ্নটাই আবার ঘুরে ফিরে বাজল মাথায়—
রাত তখন প্রায় দশটা বাজতে চলল। রান্নাঘরের ভেতর থেকে ভাতের ধোঁয়া, মাংসের ঝোল আর মশলার গন্ধ মিলেমিশে ছড়িয়ে পড়েছে পুরো চৌধুরী বাড়িতে। মিরায়া রান্না শেষ করে হাঁড়িগুলো এক এক করে সাজিয়ে রাখল ডাইনিং টেবিলের পাশে। পরিহিত ওড়না দিয়ে ঘেমে যাওয়া কপাল মুছতে মুছতে সে হালকা নিঃশ্বাস ফেলল।
তারপর ভেতরের গলা নামিয়ে ডাকল—
—”মামণি, ভাইয়া, সোরায়া… সবাই খেতে আসো রান্না হয়ে গেছে।”
মিরায়ার ডাকে একে একে সবাই নেমে এল নিচে। প্রথমে রামিলা চৌধুরী, মুখে একরকম ক্লান্তির ছাপ। তারপর সিঁড়ি দিয়ে নামল সোরায়া, তার পর রুদ্র, আর সবার শেষে ধীর পায়ে এল রায়ান।
ডাইনিং টেবিল সাজানো দেখে রামিলা চৌধুরী অবাক হলেন।
—“তুইই রান্না করেছিস এত কিছু?”
মিরায়া মাথা উচু করে হেসে উত্তর দিল—“হ্যাঁ মামনি।”
কথা শেষ না হতেই রুদ্র হেসে উঠল,
—“মিরার হাতে বানানো খাবার,আজ প্রথমবার খাব। কিরে মিরা খাওয়া যাবে তো?”
মিরা হাসিমুখে সবাইকে একে একে বসাল, তারপর নিজেই থালা সাজিয়ে খাবার পরিবেশন শুরু করল। সে একবার ভাত দিচ্ছে, একবার মাংসের ঝোল তুলে দিচ্ছে, আবার সবজি ভাগ করে রাখছে। প্রতিটি কাজের ভেতরে তার যত্ন আর আন্তরিকতা যেন ফুটে উঠছিল।
কিন্তু টেবিলে বসে থাকা রায়ানের চোখ যেন অন্য কোথাও আটকে গেছে। সে মুগ্ধ দৃষ্টিতে মিরায়ার প্রতিটি অঙ্গভঙ্গি লক্ষ্য করছে—চুল খোঁপায় বেঁধে রাখা, ঘামে ভেজা কপালে ঝুলে থাকা একগুচ্ছ চুল, আর খাবার পরিবেশনের সময় তার মৃদু হাসি।
এমন মুহূর্তটা হঠাৎ করে রামিলা চৌধুরীর চোখে ধরা পড়ল। তিনি একবার ছেলের মুখের দিকে তাকালেন, আবার মিরায়ার দিকে। ভেতরে ভেতরে কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি বয়ে গেল।
সোরায়াও থেমে থেমে রায়ানের সেই গভীর দৃষ্টি লক্ষ্য করছিল। আর রুদ্র তো স্পষ্টই খেয়াল করে ফেলল ভাইয়ের মনোযোগের কেন্দ্র কোথায়। একসময় হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে উঠল—
—“খাঁহ্ খাঁহ্…”
হঠাৎ শব্দে রায়ান চমকে উঠল, চোখ মিরায়ার থেকে সরিয়ে নিল। আর মিরায়াও যেন অস্বস্তি থেকে মুক্তি পেল। তার গাল হালকা লাল হয়ে উঠল, কিন্তু সে কিছু বলল না, শুধু হাঁড়ি থেকে আবার ভাত তুলে দিতে লাগল।
খাওয়া শুরু করতে গিয়েই রুদ্র পাশের চেয়ারটা টেনে আনল। রায়ানের ঠিক পাশে বসতে যাচ্ছিল। রায়ান চোখের ভ্রু নাড়িয়ে হালকা ইশারা করল—“ওখানে বসিস না।”
কিন্তু রুদ্র কিছুই বুঝল না। বরং উল্টা চিৎকার করে উঠল—
—“ভাইয়া, চেয়ার ছাড়ো বসব তো! কি ইশারা দিচ্ছো?”
রায়ান হকচকিয়ে গেল। মুখে একটু ভ্যাবাচেকা ভাব নিয়ে বলল—
—“কই… আমি কবে ইশারা করলাম? তুই বোস, যেখানে খুশি।”
তার গলায় অপ্রস্তুত আমতা-আমতা ভাব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। মনে মনে – “গাধার বংশধর রে, তোর ভাবির জায়গা এটা অন্য কোথাও বোস।”
এবার সোরায়া রায়ানের ইশারা ঠিকই বুঝতে পেরেছিল তাই সে হেসে হেসে বলল—
—“আরে রুদ্র ভাইয়া, এদিকে হাওয়া বেশি আসে। তুমি আমার পাশের চেয়ারটায় বসো। এখানে বসলে তোমার ভালো লাগবে।”
রুদ্র একটু গোঁ গোঁ করলেও শেষে রাজি হল। সোরায়ার পাশে বসে খাওয়া শুরু করল।
রায়ান হাফ ছেড়ে বাঁচার মতো নিঃশ্বাস নিয়ে সোরায়ার দিকে কৃতজ্ঞতার দৃষ্টি তে তাকালো । মনে মনে-
“মানুষ ঠিকই বলে আপনের চেয়ে পর ভালো। ভাই গাধা হলেই কি শালি তো মাশাআল্লাহ লেবেল এর বুদ্ধিমতী। থ্যাংক ইউ চড়ুই পাখি। পরের বার সেভয় এর ডিসকোণ আইসক্রিম খাওয়াবো।”
সোরায়াও রায়ানের কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করে চোখ টিপ দিল।
এখন টেবিলে রয়ে গেল রায়ানের পাশের ফাঁকা দুটো চেয়ার। আসলে সেই চেয়ার গুলোর একটা চেয়ার বিশেষ, কারণ সেটাই ছিল চৌধুরী বাড়ির কর্তা রায়হান চৌধুরীর আসন। আজ রায়হানও টেবিলে ছিলেন না, তাও খালিই ছিল । তার সম্মানেই সেই আসনটায় আর কেউ কখনো বসত না।
মিরায়ার সামনে তখন দ্বিধা। সে একবার তাকাল রায়ানের পাশের খালি চেয়ারটার দিকে, আবার তাকাল রায়ানের দিকে। দেখল, রায়ান তার দিকে তাকিয়ে আছেন, ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। যেন চোখে ইঙ্গিত— “হৃদপাখি, এবার তো বধ্য হয়ে আমার পাশেই বসতে হবে।”
মিরায়ার বুকের ভেতর ধড়ফড় শুরু হল। অবশেষে সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল রায়ানের পাশের চেয়ারে। কিন্তু বসার সময় ইচ্ছে করেই চেয়ারটা খানিকটা দূরে সরিয়ে নিল, যেন এক অদৃশ্য সীমারেখা তৈরি করে রাখল নিজের আর রায়ানের মাঝে।
মিরায়া যখন ইচ্ছে করেই রায়ানের পাশ থেকে চেয়ারটা খানিকটা সরিয়ে দূরে বসেছিল, তখনই রায়ানের চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ ফুটে উঠল। তার মনে হচ্ছিল, মিরায়া যেন ইচ্ছে করে তার কাছ থেকে দূরত্ব রাখতে চাইছে। আর সেটা রায়ান মোটেও মেনে নিতে পারছিল না।
হঠাৎ করেই রায়ান হাত বাড়িয়ে দিল মিরায়ার দিকে। সবাই অবাক হয়ে দেখল—সে চেয়ারের এক পাশের পায়ায় শক্ত করে ধরে এক টানে মিরায়াকে তার নিজের চেয়ারের একেবারে কাছে টেনে আনল- যেন সে কোনো ভারী কিছু নয় বরং হালকা তুলোর বস্তা টানলো। এত কাছে যে, দুইটা চেয়ার প্রায় একে অপরের সাথে লেগে গেল।
ঘটনাটা এত আকস্মিকভাবে ঘটল যে পুরো টেবিল নিস্তব্ধ হয়ে গেল। রুদ্র, সোরায়া, এমনকি রামিলা চৌধুরী পর্যন্ত চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল।
রামিলার মুখ হা হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল তিনি কিছু বলবেন, কিন্তু শব্দ বের হল না। রুদ্র চোখ গোল গোল করে তাকিয়ে আছে। সোরায়া ঠোঁটে হাত চেপে হাসি চেপে ধরার চেষ্টা করছিল, কিন্তু চোখের দৃষ্টিতে অবাক আর মজার মিশ্রণ।
মিরায়ার অবস্থা যেন কেঁপে ওঠা পাতার মতো। এভাবে সবার সামনে হঠাৎ টেনে নেওয়ায় তার বুক কাঁপছিল। গাল দুটো লাল হয়ে উঠল, মাথা নিচু করে ফেলল লজ্জা আর অস্বস্তিতে।
রায়ান একবার সবার দিকে তাকাল, তারপর ঠাণ্ডা অথচ রাগ মেশানো গলায় মিরায়ার দিকে বলল—
—“এই মেয়ে, আমি কি কোনো ভাইরাস, যে আমার থেকে দূরে চেয়ার নিয়ে বসছো? মেনারস নাই? নাকি ইচ্ছা করে অপমান করছো আমাকে? চুপচাপ পাশে বসে খাও।”
তার গলায় কড়া সুর, কিন্তু আসলেই সেটা একধরনের অভিনয়। যেন বোঝাতে চাইছে—এমন দূরে চেয়ার টেনে বসা তাকে অপমান করেছে, তাই সে বাধ্য করেছে মিরায়াকে পাশে বসতে।
মিরায়া মাথা নিচু করে থাকল, কিছু বলতে পারল না। তার হাতের ভাতের কণা পর্যন্ত যেন কাঁপছিল।
রায়ান আবার সবার দিকে তাকিয়ে জোর গলায় বলল—
—“কি দেখছো? তোমরা খাচ্ছো না কেন? খাওয়া শেষ করো।”
এই কথার পর যেন জমাটবাঁধা পরিবেশ ভাঙল। রামিলা, রুদ্র, সোরায়া—সকলেই চুপচাপ খাওয়ায় মন দিল। তবে প্রত্যেকের দৃষ্টিতেই একরকম অস্বস্তি থেকে গেল। রামিলা চৌধুরী রায়ানের মতিগতি বুঝতে চাইছিলেন তিনি রায়ানের হঠাৎ পরিবর্তনে অবাক হলেও খুশি ছিলেন।
মিরায়ার পক্ষে খাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। রায়ান বারবার তার দিকে তাকাচ্ছিল, এক এক সময় মিরায়ার সামনে ও প্লেটে মাংসের বোল এগিয়ে দিয়ে বলল—
—“নাও, এটা খাও।”
মিরায়া কোনো উত্তর দিল না, মাথা নিচু করে অল্প একটু খেল। তার খাওয়ার রুচিই হচ্ছিল না। বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত চাপা লজ্জা আর কাঁপুনি কাজ করছিল। শেষে হাত গুটিয়ে চুপচাপ উঠে দাঁড়াল।
—“আমার খাওয়া শেষ। পেট ভরে গেছে আমার। আমি রুমে গেলাম মামণি।”
বলে শান্ত তবে দ্রুত পায়ে সবার চোখ এড়িয়ে সোজা নিজের রুমের দিকে চলে গেল।
তার পিছনটা দেখতে দেখতে রায়ানের ঠোঁটে হালকা হাসি ফুটল। সে বুঝতে পেরেছিল—মিরায়ার এই অনীহা আসলে লজ্জার কারণে, রাগের কারণে নয়।
মনে মনে বলল, “আমার হৃদপাখি… লজ্জা পেয়ে পালাচ্ছে। তবে কত দিন?”
রায়ান বাকিদের উদ্দেশ্যে আবার বলল-
“তোমরা খাওয়া শেষ করো।”
পরে একে একে বাকিরাও খাওয়া শেষ করে উঠে গেল। রুদ্র নিজের ঘরে, সোরায়া তার রুমে, আর রামিলা চৌধুরীও শান্তভাবে চলে গেলেন। ডাইনিং টেবিলে কিছুক্ষণ বসে থেকে রায়ান শেষে উঠে দাঁড়াল, মুখে এখনও সেই রহস্যময় হালকা হাসি।
আজ তার মনে হলো যেন কত দিন পর তৃপ্তি নিয়ে খেয়েছে।সে সন্তুষ্টি নিয়ে বলল-
“আলহামদুলিল্লাহ, বউ আমার রান্না ও করে। তাও এত ভালো। আর কি লাগে জীবনে। বউকে খাবো, বউয়ের হাতের রান্না খাবো- লাইফ জিঙ্গালালা।”
তবে মিরায়া যত দূরে যেতে চাইছে, তার মন যেন ততটাই কাছে টানছে।
—
রাত অনেক গভীর। পুরো চৌধুরী বাড়ি নিস্তব্ধতায় ডুবে গেছে। শুধু কোথাও কোথাও দূরে রাতের পাখির ডাক, আর ঘড়ির টিকটিক শব্দ।
মিরায়া সারাদিনের ধকল, খাওয়া না খাওয়া, রান্না-বান্না আর মানসিক অস্বস্তির ক্লান্তিতে বিছানায় শুয়ে পড়েছিল। প্রথমে তার চোখে ঘুম আসছিল না, পেটে ক্ষুধার জ্বালা কুরে কুরে খাচ্ছিল। কিন্তু শরীর এত ক্লান্ত ছিল যে এক পর্যায়ে খালি পেট নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ল।
অপরদিকে রায়ান তার নিজের রুমে শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে। বিছানার চাদর একবার মাথায় দেয়, আবার টেনে ফেলে দেয়। বালিশটাকে পেটের নিচে দেয়, আবার এক ঝটকায় ছুঁড়ে দেয়।
যতবার চোখ বন্ধ করতে যাচ্ছে, ততবারই মাথায় ভেসে উঠছে মিরায়ার মুখটা—নিচু চোখ, লাল গাল, লজ্জা মাখা অবস্থা, আর হঠাৎ টেনে আনা চেয়ারের পর তার অস্বস্তি।
হঠাৎই রায়ান নিজের মাথা চাপড়ে বলে উঠল—
—“উফ্! ধুর… বউকে লজ্জায় ফেলতে গিয়ে বউটাকে তো খেতেই দিলাম না একটু!”
মাথা চুলকাতে চুলকাতে বিছানায় উঠে বসল সে।
—“সারাটা দিনে কিছু খায়নি, দুপুরেও বলল খায়নি, রাতেও আবার কিছুই খাওয়া হলো না। খালি পেটে ঘুম হবে ওর? ইশ্… কি এক জ্বালা! আগে জানতাম না বউ না খেলেও এত চিন্তা হয়।”
রায়ান একবার লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল, তারপর আবার বালিশ কোলের ভেতর জড়িয়ে ধরল।
কিন্তু শান্তি নেই। মিনিট না যেতেই আবার পা নাড়াতে শুরু করল।
—“ধুর… আমি কি করলাম! এত বেশি বাড়াবাড়ি করা উচিত হয়নি। শান্তিতে খেতে দেওয়া উচিত ছিল। ও তো ছোট্ট মেয়ে, এখন বুঝি খিদের জ্বালায় কাতরাচ্ছে।”
নিজের সাথে নিজেই কথা বলছে রায়ান, যেন কেউ শুনছে না। একসময় গম্ভীর মুখ করে ফিসফিস করে বলল—
—“আমি কি একবার গিয়ে দেখে আসব? ঘুমিয়েছে কিনা… নাকি খিদের জন্য এপাশ ওপাশ করছে।”
তারপর আবার থেমে মাথা নাড়াল—
—“না না, এটা তো একদম সিনেমার মতো হবে! মাঝরাতে নায়ক বউয়ের ঘরে গিয়ে চেক করছে… উফ্, ধুর মগজটা কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে।”
হঠাৎই নিজের কপালে হালকা চাপড় দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে হেসে ফেলল-
—“এই আমি রায়ান চৌধুরী, যার মাথায় কোনোদিন কারও জন্য এত চিন্তা আসেনি, এখন এক বউ না খেয়ে শুয়েছে তাই ঘুমোতে পারছি না। মাথায় ঢুকছে না আমি কি সত্যিই পত্নী নিষ্ঠ স্বামী হয়ে গেছি!”
কথা বলতে বলতে সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল, কিছুক্ষণ দরজার সামনে এদিক-ওদিক হাঁটাহাঁটি করল।
একবার মনে হলো দরজা খুলে বেরিয়ে যায়, একবার মনে হলো আবার শুয়ে পড়ে।
—“ধুর… যাব কি যাব না? যদি ঘুমিয়ে থাকে, আবার যদি ধরা খাই, কি লজ্জায় পরবো! কিন্তু যদি না খেয়ে কষ্টে শুয়ে থাকে, আমারই তো ঘুম হবে না। হায় আল্লাহ! কি করি।”
বলতে বলতে রায়ান আবার মাথা চুলকাল, মুখে হালকা বিরক্তি, কিন্তু চোখে স্পষ্ট মমতা।
অবশেষে দ্বিধার পর সে ঠিক করল—একবার দেখেই আসবে।
চুপিচুপি মিরায়ার রুমের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে নক করল না, শুধু আস্তে চাপ দিল। কিন্তু দরজা লক করা।
এক মুহূর্ত থমকে দাঁড়াল সে।
—“এখন কী করি?”
হঠাৎ মনে পড়ল, এই রুম তো একসময় তার রিডিং রুম ছিল। মানে… স্পেয়ার কী তার কাছেই আছে!
চোখেমুখে এক অদ্ভুত উত্তেজনা ফুটে উঠল। দৌড়ে নিজের রুমে ফিরে গিয়ে সাইড টেবিলের ড্রয়ার খুলল। সত্যিই, পুরনো সেই চাবিটা এখনও ঠিক আগের জায়গায় আছে।
চাবি হাতে নিয়ে মৃদু হাসি ফুটল তার মুখে।
—“বউয়ের কাছে যেতে ভাগ্যও পথ দেখায় বুঝি।”
অতি সতর্কে দরজা খুলল সে। এক মুহূর্ত নিঃশ্বাস আটকে গেল, যেন কোনও নিষিদ্ধ জায়গায় ঢুকে পড়েছে।
ঘরে প্রবেশ করতেই তার চোখ আটকে গেল বিছানার দিকে।
মিরায়া গভীর ঘুমে। হালকা আলোয় তার মুখটা অদ্ভুত শান্ত, যেন শিশুর মত, একটা ঘুমন্ত পরীর ন্যায় ঘুমাচ্ছে।
এলোমেলো চুলগুলো গাল বেয়ে নেমে এসেছে মুখে তবে তা নিয়ে মিরায়ার মুখে যেন কোনো বিরক্তি নেই। গোলাপি ঠোঁট জোড়া সামান্য আধখোলা, নিঃশ্বাসের ওঠানামা বুঝা যাচ্ছে।
রায়ান ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে এগিয়ে এল। বিছানার কাছে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল মিরায়ার মুখ বরাবর। চোখের পলক যেন পরতেই চাইছে না রায়ানের মুগ্ধ দৃষ্টিতে মিরায়ার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে চলেছে।
তার চোখ বারবার মিরায়ার মুখ থেকে গলার দিকে চলে যাচ্ছিল। পাতলা টি-শার্টে ঘুমানোর কারণে তার শরীরের রেখাগুলো হালকা দৃশ্যমান। বিশেষ করে, একটু বড় গলার কাটায় বক্ষভাঁজের আভাস পাওয়া যাচ্ছিল।
রায়ানের বুকের ভেতর কেমন যেন ধুকপুক শুরু হয়ে গেল সেই মোহনীয় দৃশ্য অবলোকন হতেই। গলা শুকিয়ে আসতে লাগল। মনে হচ্ছিল সে যতই সামলাতে চায়, শরীর আর মন দুটোই নিজের নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে।
“ইস্…এই বউটা তো একদম পাগল করে দিচ্ছে আমাকে…। পণ করে নিয়েছে আমাকে কন্ট্রোললেস স্বামীর খেতাব দিতে। কিভাবে সামলাব নিজেকে হৃদপাখি? এই উত্তর টা নিজের দেহ দেখিয়ে আমাকে পাগল করার আগে বলে দে বউজান।”
তার হাত ধীরে ধীরে বাড়ল মিরায়ার পানে। মিরায়ার কপালে ঝুলে থাকা একগুচ্ছ চুল সরিয়ে কানের পেছনে গুঁজে দিল। মিরায়ার স্পর্শের সঙ্গে সঙ্গেই রায়ানের শরীর শিহরিত হল।
চোখ বন্ধ করে গভীর নিঃশ্বাস নিল।
রায়ান ঘুমন্ত মিরায়ার উদ্দেশ্যে- “হৃদপাখি? এখন যদি তোমায় না বলে তোমার কাছে আসি তাহলে কি তুমি রাগ করবে? একটু আদরে কি তুমি ব্যাথা পাবে? আমার কি ..!”
রায়ান আর নিজেকে সামলাতে পারল না। কথা বলা বন্ধ করল-
তারপর ঝুঁকে গিয়ে নিঃশ্বাস আটকে, মিরায়ার কপালে এক কোমল চুমু রাখল। চুমুটা এতটাই ধীর, এতটাই আবেগমাখা যে মনে হচ্ছিল—সারা পৃথিবীর সবটুকু ভালোবাসা এই একটি মুহূর্তেই গলে মিশে গেছে। চুমুর ভেতরে যেন সমস্ত ভালোবাসা জমে ছিল।
কপালের পর তার ঠোঁট নামল মিরায়ার নাকে—হালকা ছোঁয়া, তবুও যেন আগুন জ্বালানোর মত। তারপর গালে… ডান গালে, আবার বাম গালে। প্রতিটা চুমুর পর তার বুকের ভেতর অস্থিরতা আরও বাড়তে লাগল অনুভূতি গুলো আরো লাগাম ছাড়া হলো কামনা বাসনার তাড়নায় যেন টেকা মুশকিল হলো।
ঘর হঠাৎই ভারী হয়ে উঠল। বাতাসের তাপ যেন বাড়ছে। ঠিক তখনই জানালা দিয়ে এক ধমকা ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে পড়ল।
মিরায়ার শরীর হালকা কেঁপে উঠল। তার গোলাপি ঠোঁট কাঁপতে লাগল ঠান্ডা হাওয়ার ছোঁয়ায়। যা রায়ানকে আরো উন্মাদ করে দিল।
রায়ানের চোখে অদ্ভুত এক ঈর্ষা জ্বলে উঠল।
সে মনে মনে গজরাল—
“কি অবস্থা! এই হাওয়াটাও ছুঁতে পারে আমার বউকে, কিন্তু আমি পারি না? এই ঠান্ডা বাতাস তার ঠোঁট কাঁপাতে পারে, কিন্তু আমার ঠোঁট পারছে না?”
তার চোখে হাহাকার ফুটে উঠল, আবার ঠোঁটে অভিমানী হাসি।
তার বুকের ভেতর ঝড় বইছিল—
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৫
“এই মেয়েটা… আমার বউ, আমার হৃদপাখি… ওকে কি সত্যিই ছুঁয়ে দেখা যায় না? আরও বেশি করে নিজের করে নিতে ইচ্ছে করছে তো আমার। আরো একটু ছুঁই তোমাকে জান পাখি…?”
ঘরের নিস্তব্ধতা, রাতের হিমেল হাওয়া আর মিরায়ার ঘুমন্ত মুখ মিলে পরিবেশটা অদ্ভুত উত্তপ্ত হয়ে উঠল।