আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২০

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২০
অরাত্রিকা রহমান

ক্যাম্পাসের মাঠের বেঞ্চে বসে থাকা মিরায়ার বুকের ভেতর যেন বাজছে ঢাকঢোল। দূরে থেকে রায়ানের চোখে চোখ পড়তেই শিরদাঁড়া বেয়ে এক অদ্ভুত শীতলতা নেমে এল। চারপাশে অসংখ্য ছাত্রছাত্রী, হাসাহাসি, আড্ডা—সব যেন হঠাৎ থমকে গেল। কারও হাসির শব্দ আটকে গেল গলায়, কারও কথার ভাঁজ থেমে গেল।
সবার চোখ শুধু একদিকে—সেই কালো সেডান থেকে নেমে আসা পুরুষটির দিকে।
রায়ানের পায়ের শব্দ যেন পুরো ক্যাম্পাসকে কাঁপিয়ে দিচ্ছে। টক… টক… টক…
সাদা শার্টের হাতা ভাঁজ করা, চোখে দমবন্ধ করা দৃঢ়তা। কপালের শিরাগুলো ফুঁসে উঠেছে, অথচ ঠোঁট অদ্ভুতভাবে বাঁকানো—ভেতরের অগ্নিকে যেন কেবল শক্ত নিয়ন্ত্রণে ধরে রেখেছে।
রিমি অবাক হয়ে ফিসফিস করল,

—“মিরা… ইনি তো কালকের লোকটা যে তোর জন্য মারামারি করল তাই না? তোর ফোনে যে নাম আসছিল?”
মিরায়া কোনো উত্তর দিল না। শুধু ঠোঁট শক্ত করে কামড়ে ধরে বুকের ভেতর দম আটকে রাখল। হাতের তালু ঘেমে গেছে, এক হাতে গলায় থাকা উড়না মুঠো করে ধরেছে, অন্য হাতে রিমির হাত ধরা।
রায়ান এগিয়ে এসে এক ঝলক রিমির দিকে তাকাল। সেই দৃষ্টিতে যেন অদৃশ্য তলোয়ার লুকানো—এক পলকেই স্পষ্ট বোঝা যায়, তার উদ্দেশ্য এই মেয়েটি নয়। তারপর চোখ গিয়ে আটকাল মিরায়ার ওপর।
চারপাশ যেন মুহূর্তেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল। বাতাস থেমে গেল, পাখির ডাক মিলিয়ে গেল। শুধু দৃষ্টির লড়াই—মিরায়ার অভিমানী চোখ বনাম রায়ানের দমবন্ধ করা উন্মাদনা।
কোনো কথা না বলে রায়ান হঠাৎ হাত বাড়িয়ে দিল।
রিমির হাত থেকে মিরায়ার হাতটাকে একটানে টেনে নিল নিজের দিকে। রিমি হতভম্ব হয়ে গেল, কিছু বলার আগেই রায়ান আরেক হাতে মিরায়ার কাঁধ চেপে ধরে সামনে দাঁড় করাল।
মিরায়া বিস্ময়ে চিৎকার করে উঠল,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

—“আপনি এখানে… কি করছেনটা কি? সবাই দেখছে!”
রায়ানের কণ্ঠ নিচু, কিন্তু প্রতিটি শব্দ যেন ছুরি কেটে যাওয়ার মতো ধারালো।
—“আমার পরোয়া নেই কে দেখছে। আমি শুধু তোকে সামনে চাই। কতবার কল করেছি? তুই ফোন ধরিস না কেন? পালিয়ে বেড়াচ্ছিস আমার থেকে? আমি কি তোকে এভাবে ছেড়ে দেব ভেবেছিস?”
মিরায়া ছটফট করে হাত ছাড়াতে চাইলো। তার গলায় আতঙ্ক মিশে রাগ,
—“আপনি সীমা ছাড়াচ্ছেন রায়ান ভাইয়া! ছেড়ে দিন আমার হাত। আমি এখন ভার্সিটিতে আছি।”
রায়ান এক ইঞ্চি কাছে টেনে নিল মিরায়াকে, বুকের সাথে মিশিয়ে। তার ঠোঁট মিরায়ার কানের কাছে নেমে এলো, কণ্ঠস্বর ফিসফিস অথচ হাড় কাঁপানো।

—“চুপ। আর একটা শব্দ বের করলে, আমি এখানেই তোর ঠোঁট সিল করে দেব । তারপর দেখবি, এই ভিড়ের মাঝেও তুই কিভাবে আমার বলে চিহ্নিত হয়ে যাস।”
রায়ান হঠাৎ ঝুঁকে তার কাধে গরম নিঃশ্বাস ছেড়ে দিল, ঠোঁটে বিপজ্জনক এক বাঁকা হাসি—
—“হৃদপাখি। আই গোট ডেম মিন ইট- একটাও শব্দ বের করলে তোর ওই নরম ঠোঁটকে এমনভাবে ব্যস্ত রাখব যে চল্লিশজনের সামনে দাঁড়িয়ে তোকে চোখ তুলতে হবে না।”
মিরায়ার চোখ ভয়ে বড় হয়ে উঠল, তার সাহসে আর কুলালো না। শরীর কেঁপে গেল, কিন্তু ঠোঁট নিঃশব্দে আটকে রইল। চারপাশের ছাত্রছাত্রীরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে—কে কেউ ভিডিও তুলছে, কেউ চোখ মুছে বিশ্বাস করতে পারছে না এই দৃশ্য।
রিমি হতবিহ্বল গলায় বলল,

—“ভাইয়া…! প্লিজ… এভাবে না! সবাই দেখছে—”
রায়ান এক ঝলক তাকাল রিমির দিকে। সেই চোখে এমন এক আগুন ছিল, যেন বলছে—একটা শব্দ বেশি বললেই তুই শেষ।
রিমি স্বতঃস্ফূর্তভাবে চুপ করে গেল, ঠোঁট কামড়ে নিচু করে তাকিয়ে রইল।
মিরায়া এবার ফিসফিস করে বলল দৃঢ় কণ্ঠে,

—“আপনি আমাকে লজ্জায় ফেলছেন… ছেড়ে দিন।”
রায়ানের হাত আরও শক্ত হলো। সে মাথা ঝুঁকিয়ে মিরায়ার কপালে এক ইঞ্চি দূর থেকে ফিসফিস করল,
—“লজ্জা? লজ্জা তো আমি করাইনি, তুই নিজেই আনিস। তুই না খেয়ে আমার বুক পোড়াচ্ছিস, ফোন না ধরে আমাকে উন্মাদ বানাচ্ছিস, আর এখন লজ্জার গল্প করছিস? মনে রাখিস—তোর অভিমান আমি মানতে পারি, কিন্তু তোকে অবহেলা ও অবাধ্যতা করতে দেব না।”
চারপাশে হালকা ফিসফিসানি ছড়াল, কিন্তু রায়ান কিছুই পাত্তা দিল না। বরং মিরায়াকে নিজের বুকের কাছে আরও জোরে টেনে নিল।

—“দেখ, আমি চাইলে তোকে এভাবেই গাড়িতে তুলে নিয়ে যেতে পারি। কিন্তু শেষবার জিজ্ঞেস করছি—চলবি শান্তভাবে, নাকি আমাকে সবার সামনে তোর জেদ ভাঙাতে হবে?”
মিরায়া রাগে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে স্পষ্ট করে বলল-
“এভাবে কেন! কোনো ভাবেই আমি নিজের থেকে আপনার সাথে যাচ্ছি না।”
রায়ান এবার কুটিল হেঁসে উত্তর করল-
“তবে তাই হোক, নিজের ইচ্ছেতে না গেলে, আমার ইচ্ছেতে যাবি আমার সাথে তুই এখনি।”
তারপর এক ঝটকায় মিরায়াকে টেনে নিজের গাড়ির দিকে নিয়ে যেতে লাগল। মিরায়া ছটফট করে প্রতিবাদ করছিল,

—“আপনি এমন কেন করছেন? আমি যেতে চাই না! এভাবে টেনে নিয়ে যাওয়ার কোনো মানে হয় না।”
রায়ান সামান্য ঝুঁকে তার কানে বলল,
—“তুই চাস বা না চাস, তবুও যাবি। কারণ আমি চাইছি তোকে। যত রাগ করিস, যত অভিমান করিস… শেষে তোর সব পথ এসে আমার কাছেই শেষ হবে।”
তার ঠোঁটে একচিলতে বাঁকা হাসি।
চারপাশের দৃষ্টি, ফিসফিসানি, বিস্ময়—সবকিছুকে অগ্রাহ্য করে রায়ান মিরায়াকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরে এক ঝটকায় কলে তুলে নিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করল ।
ক্যাম্পাসে উপস্থিত সকলে অবাক হয়ে দেখছে রায়ান কে। মিরায়াকে এমন ভাবে কোলে তুললে যেন তুলো তুলছে। রিমিও অবাক হলো এমন হঠাৎ ঘটনাতে, তবে বাধা দেওয়ার সাহস করেনি। রায়ানের চোখে এখন কোনো প্রকার কোমলতা নেই।
এদিকে মিরায়া রায়ানের কোলে থেকেই হাত পা ছুড়তে থাকে।

-“কি হচ্ছে টা কে? মানুষ দেখছে। ছাড়ুন আমাকে।”
রায়ানের যেন মিরায়ার কোনো কথা বা এমন অবাধ্য হাত পা ছুড়তে থাকে তে কিছুই যায় আসছে না। সেটা হওয়ার কথাও না কারণ রায়ানের শরীরের চারভাগের দুইভাগও মিরায়ার দেহ কাঠামো নয়।
রায়ান গাড়ির কাছে গিয়ে মিরায়াকে এক হাতেই কোলে রেখেই অন্য হাত দিয়ে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে বসিয়ে দিল মিরায়াকে।
মিরায়ার চোখে জল টলমল করছে। তার বুক ওঠানামা করছে আতঙ্ক আর অভিমানে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে বুঝছে

—এই লোকটার হাতের শক্তি থেকে, দৃষ্টির শাসন থেকে, কণ্ঠের হুমকি থেকে পালানোর কোনো রাস্তা নেই।
রায়ান পাশে এসে বসে দরজা বন্ধ করল। তারপর তার দিকে ঘুরে হালকা ঝুঁকে বলল—
—“এবার তুই যা খুশি কর। রাগ কর, গালি দে, চেঁচা, কাঁদ… কিন্তু আগে উত্তর দে সকালে এমন কেন করলি? না খেয়ে থেকে আমাকে আর এক মুহূর্তও জ্বালাতে পারবি না তুই আমি সহ্য করবো না।”
গাড়ির ভেতর হঠাৎ অদ্ভুত নীরবতা নেমে এল। বাইরে ক্যাম্পাসের ভিড় জমে আছে, কিন্তু ভেতরে কেবল দুজনের নিঃশ্বাসের শব্দ।

মিরায়া চোখ সরিয়ে জানালার বাইরে তাকাল। ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো শব্দ বের হলো না। আর রায়ান—সে জানে, যুদ্ধ শুরু হয়েছে। এই যুদ্ধ অভিমান আর আসক্তির।
গাড়ির দরজা সজোরে বন্ধ করলো রায়ান। গাড়ির দরজা জোরে বন্ধ হতেই পুরো পরিবেশ কেমন ভারী হয়ে গেল। বাইরে ভিড়, ভেতরে দমবন্ধ করা নীরবতা। মিরায়া জানালার বাইরে তাকিয়ে- তার বুক ধুকপুক করতে লাগল। অথচ রায়ান হেলান দিয়ে বসে গাড়ির ড্রাইভিং সিটে। সে একচোখে তাকিয়ে আছে মিরায়ার দিকে—চোখে দুষ্টু শাসন, ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর হঠাৎ ঝুঁকে এসে তার কানের কাছে ফিসফিস করল—

—“এত রাগ করছিস কেন? না কি ইচ্ছে করেই আমাকে জ্বালাচ্ছিস, যেন আমি তোকে জোর করে কাছে নিই?”
মিরায়া তড়াক করে ঘুরে তাকাল, চোখে ক্ষোভ।
—“আপনার হয়েছে টা কি! কি সব বলছেন। মানে কি?”
রায়ান ঠাণ্ডা হাসল, কাঁধ ঝাঁকাল।
—“মানে? এই মানে টাই তো সব নষ্টের মূলে বুজাতেই তো পারছিনা। শুধু এত টুকু বোঝ তোর সব কিছুর মানে আমাতে শুরু আর আমাতেই শেষ।”
মিরায়া বিরক্ত হয়ে ঠোঁট চেপে ধরল দাঁত দিয়ে। রায়ান ধীরে ধীরে এগিয়ে এল, তার কণ্ঠস্বর আরও নিচু হলো—
—“তোকে না খাওয়ানো মানে আমাকে উপোসে রাখা। তুই না ঘুমানো মানে আমার রাত জেগে পাগল হওয়া। আর তুই চুপ থাকা মানে… আমার কানে কেবল একটা শব্দ বাজা—তোকে জোরে ঠোঁটে ঠোঁট চেপে চুপ করানো।”
মিরার শরীর কেঁপে উঠল। সে মুখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকাল, কিন্তু তার লালচে কান দেখে বোঝা যাচ্ছিল কথাগুলো কেমন করে গায়ে বিঁধছে।
মিরায়া চোখ বড় করে তাকাল বাইরের দিকে ও বিরবির করলো—

—” অসভ্যতামির একটা সীমা থাকা উচিত!”
রায়ানের কানে কথাটা অস্পষ্ট হয়েই পৌঁছালো। রায়ান হালকা হেসে মিরায়ার চোয়াল ধরে তার দিকে ফিরিয়ে মিরায়ার ঠোঁটে আঙুল রাখল—
—“চুপ… অসভ্য আমি শুধু তোর জন্যেই। অন্য কেউ এই অসভ্যতামি দেখার অধিকার পায় না। বি প্রাউড , মাই ফাকিং লিটল হার্ট-বার্ড।”
তারপর হঠাৎ আরও কাছে ঝুঁকে এল। মিরায়ার নিঃশ্বাস আটকে গেল। রায়ানের কণ্ঠস্বর ফিসফিস করে নামল তার ঠোঁটের গায়ে—
—“আর একটা কথা শোন, যদি আবার আমার ফোন না ধরিস… তবে মনে রাখিস, যেখানে পাব, সেখানেই তোকে জড়িয়ে ধরব আর তার পর খুব ভালো কিছু করবো এমন ভ্রান্ত ধারণা রাখিস না। সেটা ক্লাসরুম হোক, মাঠ হোক বা এই ক্যাম্পাসের ভিড়ের মাঝেই হোক। নিজেকে সংযত করছি কেবল মাত্র তোর অনুমোদনের অপেক্ষায়। বেশি বাড়াবাড়ি করলে এর বিপরীতে যেতে আমার একটুও বাধবে না। তখন তোর ওই অভিমানী মুখে কী রঙ ফুটে ওঠে, সেটা সবাই দেখবে।”

মিরায়ার শরীর লজ্জায় কুঁকড়ে গেল। বুক কেঁপে উঠল, ঠোঁটে অচেনা কাঁপুনি। অথচ প্রতিবাদ করতে গিয়ে শব্দ আটকে গেল গলায়।
মিরায়ার তিরতির করে কাঁপতে থাকা ঠোঁট দেখে রায়ানের গত রাতের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে উঠে। সে উপলব্ধি করে এই ঠোঁট জোড়ার স্বাদ সে গত রাতে অন্যন্ত তৃপ্তির সাথে আস্বাদন করেছে। কোনো প্রকার বাঁধা ও অনুমতি ছাড়া। তবে আজ পারছে না – ভীতু বলে নয় বরং খুব তাড়াতাড়ি এতো কিছু সামলানো তার ছোট্ট বউটার বেশ কষ্ট হতে পারে সেটা ভেবে।
রায়ান নিজেকে সংযত করল । সে চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত শ্বাস নিল, তারপর আবার হাসল।
—“এক আজব দুনিয়া হয়ে গেছে। তোদের মেয়েদের নির্লজ্জের মতো কথা বলতেই হবে, নইলে তোরা মেয়েরা বুঝবিই না বুকের ভেতর কি চলছে।”
গাড়ির ভেতরটা তখন কেবল দুজনের নিঃশ্বাস আর সেই কথার উত্তাপে ভরে উঠল।

ঘড়ির কাঁটা তখন লাঞ্চ ব্রেকের কাছাকাছি। ক্লাসরুম ভরে আছে ছাত্রছাত্রীদের ক্লান্ত অথচ আগ্রহী মুখে। মাহির সাদা শার্টে, হাতে মার্কার নিয়ে বোর্ডে ইংরেজি গ্রামারের বেসিক টার্ম ব্যাখ্যা করছিলেন। কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, শরীরে এক ধরণের পরিপাটি শৃঙ্খলা—যেন পুরো ক্লাসটাই তাঁর তাল মিলিয়ে চলছে।
ঘণ্টা বাজতেই তিনি হালকা থামলেন, মার্কারটা ডাস্টারের পাশে রাখলেন। তারপর টেবিলের ওপর হেলান দিয়ে চারপাশে তাকালেন।

—“So, any questions? কারো কিছু জানার আছে?”
সেই মুহূর্তে ক্লাসে পিন-ড্রপ সাইলেন্স। সবাই ব্যাগ গোছাচ্ছে, কেউ ফিসফিস করছে।
পিছনের বেঞ্চে বসা সোরায়া আর জুঁই চুপিসারে গাল চাপা দিয়ে কথা বলছিল।
জুঁই কানের কাছে মুখ বাড়িয়ে ফিসফিস করে বলল—
—“শোন সোরা, ভেবে দেখ—আমাদের স্যার তো বিসিএস ক্যাডার। মানে বয়সও অনেকটা হয়েছে। এতো বড় প্রফেশনে আছেন। তাহলে উনি নিশ্চয়ই বিবাহিত। আরে, ওনার যদি বউ থাকে?”
সোরায়ার চোখ কেমন যেন বড় হয়ে গেল। ঠোঁট নড়ে উঠল—
—“আরে না রে! বিয়ে হতে যাবে কেন? দেখলেই বোঝা যায় এখনো বিয়ে হয়নি। উনি একেবারে… নতুনের মতো।”
জুঁই খিলখিলিয়ে হেসে বলল—

—“সে তুই-আমি বুঝব কী করে? থাকলেও তোকে তো এসে বলে যাবে না! প্রশ্ন করলে তবেই জানা যাবে।”
এই নিয়ে তারা ছোট্ট তর্কে মেতে উঠতেই মাহিরের সেই প্রশ্ন—“কেউ কিছু জানতে চাও?”—তাদের কানে পৌঁছাল।
এক মুহূর্ত থমকে গেল সোরায়া। বুকের ভেতর যেন অদ্ভুত কাঁপুনি।
জুঁই খোঁচা দিল—
—“তাহলে হাত তোল! দুনিয়া জানুক। জাতি জানতে চায়।”
সোরায়া দ্বিধাগ্রস্ত হলেও নিজের ভেতরের দ্বন্দ্ব থেকে মুক্তি পেতে হঠাৎ হাত তুলে ফেলল।
মাহির ভ্রু কুঁচকে তাকালেন, তারপর ইশারায় বললেন—

—“Yes, you. দাঁড়াও। বলো, তোমার প্রশ্ন কী?”
ক্লাসের ভেতর সবাই হকচকিয়ে তাকাল। সবার চোখ তখন সোরায়ার দিকে।
সোরায়া দাঁড়াল। বুক ধকধক করছে, কিন্তু ঠোঁট শক্ত করে স্পষ্ট কণ্ঠে বলে উঠল—
—“স্যার, আপনি কি বিবাহিত?”
মুহূর্তেই পুরো ক্লাস একসাথে ফেটে পড়ল হাসিতে।
হাসির গুঞ্জন, খিলখিল, শিস—ক্লাসরুম যেন একেবারে ঝড়ে ভরে গেল।
মাহিরের চোখ বড় হয়ে গেল, মুখে এক হালকা বিব্রত হাসি ফুটল। হাতের ফাইল দিয়ে হালকা গলা পরিষ্কার করে বললেন—

—“এই প্রশ্নটা… আমি একেবারেই আশা করিনি। কিন্তু যেহেতু এসেছে, তাই উত্তরটাও সোজাসাপ্টা দেব।”
তিনি গম্ভীর হতে গিয়েও মজা করলেন, চোখে খেলা করল দুষ্টু হাসি।
—“না, এখনো তেমন কোনো কাগজে সই করার সৌভাগ্য হয়নি। মানে… officially আমি এখনো bachelor।”
হাসির শব্দ আবার নতুন করে গর্জে উঠল। কেউ বলল, “ওহো স্যার!” কেউ আবার হাততালি দিল।
সোরায়া দাঁড়িয়েই লজ্জায় গাল লাল করে ফেলল। বুকের ভেতর যেন ছোট্ট আতশবাজি ফাটল। মনে হচ্ছিল—
“সত্যিই! উনি অবিবাহিত! আল্লাহ, আমি কি তবে…”
তার চোখ চকচক করছিল, ঠোঁটে হালকা এক চুপচাপ হাসি ফুটল। যেন সে পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের খবর পেয়েছে।
মাহির আবার হাত উঁচু করে ক্লাস শান্ত করলেন—

—“Alright, enough. এবার ক্লাস শেষ। সবাই লাঞ্চে যাও।”
তিনি নিজের ফাইল, ডাস্টার, মার্কার গুছিয়ে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলেন। স্বাভাবিক ভঙ্গিতে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। বেরোনোর আগে এক ঝলক হালকা হাসি ছুঁড়ে দিলেন পুরো ক্লাসের দিকে।
ক্লাস ফাঁকা হতে শুরু করল। কিন্তু সোরায়া এখনো বসে আছে, বুকের ভেতর ঢেউ খেলছে। মনে হচ্ছিল—
“আজকের দিনটা আমার জন্য লটারির টিকিটের মতো। স্যার অবিবাহিত! এটাই আমার সবচেয়ে বড় জয়।”
তার চোখে স্বপ্ন, মনে অদ্ভুত খুশি, ঠোঁটে লাজুক হাসি। সে নিজেই বুঝতে পারছিল না—এই খুশিটা লুকাবে কীভাবে।

গাড়ির ভিতরে হাওয়া ঘন — শুধু শরীরেরই নয়, নিঃশ্বাসেরও ঘনত্ব বড়ছে। জানালার বাইরে সূর্যের আলো লড়াই করে ঢুকে পড়ে, কিন্তু কাচের পিছনে সব আলো যেন হালকা পলাশ হয়ে যাচ্ছে; ভেতরে অন্যরকম এক উষ্ণতা জমেছে—বহু স্তরের উত্তাপ, যেটা কথার আগেই অনুভূত হয়।
স্টিয়ারিংয়ে একহাত শক্ত করে রাখা রায়ানের কাঁধে অদ্ভুত এক স্থিরতা দেখা যায়; যেন পৃথিবীর ওঠানামার বিরুদ্ধে সে একাকী ডানা জড়ো করে দাঁড়িয়ে আছে। তার পায়ে পীচগুলোর শক্ত সুর,—সিটের নিচে ইঞ্জিনের কম্পন আর তার ভেতরের ধুকপুক মিশে একটি নিস্তব্ধ সঙ্গীত তৈরি করছে।

গাড়ির ভেতরে যেন এক অদৃশ্য আগুন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে। বাইরের শহরের কোলাহল কাঁচের জানালায় আটকে গেছে, কিন্তু ভেতরের পরিবেশে এমন চাপা উত্তাপ জমেছে যা নিঃশ্বাসকেও ভারী করে তুলছে।
এসি চললেও হাওয়াটা যেন ঘন আর গরম। রায়ান স্টিয়ারিং শক্ত করে ধরে থাকায় মাঝে মাঝে তার আঙুলের নড়াচড়া থেকে বোঝা যায়, ভেতরে কী অস্থিরতা চলছে। চোখের কোণে তীব্রতা, ঠোঁটের কোণে অদৃশ্য রাগ—সব মিলিয়ে যেন আগ্নেয়গিরির ঢাকনা চাপা পড়ে আছে, বিস্ফোরণের অপেক্ষায়।
অন্যদিকে মিরায়া জানালার কাচে তারাই চোখ আটকে রেখেছে—গাছেরা পেছন পেছন হাওয়ায় লড়ছে, বাইরের রাস্তার কোলাহল কেবল ছায়ার মতো ছুটে যাচ্ছে। সে নিজে জানে না কেন এভাবে মুখলজ্জা লুকিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।

মিরায়া তখনো জানালার দিকে মুখ ফেরানো। শহরের গাছ, উড়ালসড়ক, হোর্ডিং সব তার চোখের সামনে দিয়ে বয়ে যাচ্ছে, অথচ সে যেন কিছুই দেখছে না। মনটা ঘোলাটে, বিভ্রান্তিতে ভরা। সে নিজেকেই প্রশ্ন করছে—
“কেন এমন করছে এই মানুষটা? আমি তো তাকে চিনি না… দুই দিন হলো পরিচয় মাত্র। অথচ আচরণগুলো এমন যেন আমি তার পৃথিবীর কেন্দ্রবিন্দু।”
তার বুকের ভেতরে কেমন চাপা না বলা অংশ, আবার একরাশ অজানা ভয়। এমন অধিকার, এমন উন্মাদনা—এটা কি সত্যিই সম্ভব? নাকি …?
ঠিক তখনই রায়ানের ফোনটা বেজে উঠল। মাঝে ফোন কাঁপিয়ে উঠে; রিংটোন কাঁচে কেটে মিশে যায়। রায়ান অবলীলায় ফোন তুলল, গলার স্বরে কোনো হাসি নেই—শুধু উষ্ণ জবাবে এক রেশ কড়া সিদ্ধান্ত।
গভীর কণ্ঠে সে ফোনটা কানে তুলল—

—“হ্যালো?”
ওপাশ থেকে ভেসে এলো ভদ্রলোকের কণ্ঠ, সম্ভবত কোনো রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার—
—“স্যার, আপনার বুকিং কনফার্ম হয়ে গেছে। পুরো রেস্টুরেন্ট আপনার জন্যই রিজার্ভ করা হয়েছে। আপনি ও ম্যাডাম যখন ইচ্ছা আসতে পারেন, আমাদের টিম প্রস্তুত।”
— “স্যার, শেফ কিচেন থেকে বলছেন—আজ এখানে একটি স্পেশাল ট্রি-করসম্যুত মেনু চাইলে আগে জানালে ভালো হবে, কোনো অ্যালার্জি বা স্পেশাল রিকুয়েস্ট আছে কি? আমরা প্রস্তুত থাকতে চাই।”
রায়ানের ঠোঁটে হালকা এক গোপন হাসি খেলে গেল। সে গলা নিচু করে বলল—
—“Good. Everything should be perfect. নিজেদের বেস্ট ডিশ গুলো প্রিপেয়ার করুন। কোনো প্রকার অ্যালার্জিক আইটেম যেন না থাকে । দ্যেয়ার শুড বি নো রিস্ক। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।”
রেস্টুরেন্ট ম্যানেজার –

“ওকে স্যার। উই উইল ডু আওয়ার বেস্ট। থ্যাংক ইউ।”
ফোনটা কেটে রাখতেই গাড়ির ভেতরের উত্তাপ যেন আরও বেড়ে গেল। ফোনটা রেখে দিল রায়ান—কতটা সহজে, নির্ভয়ে। ম্যানেজারের কণ্ঠে কোনো দোল নেই; সে বুঝে গিয়েছিল ভদ্রতা হলো যথেষ্ট। মিরায়ার দিকে রায়ান একবার দেখল—কোনো কথাই বলল না। কোনো সভ্য ভাষায় সে ঘোষণা করল না তার পরিকল্পনার, কোনো অহংকৃত খামখেয়ালিতে জড়াযল না—কিন্তু সিদ্ধান্তটা ঠিক হয়ে গেছে: একমাত্র তার ইচ্ছায় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে, আর সে চায় সব কিছু নিখুঁত হবে।

ফোনের কথপোকথনে বলা কথাগুলো স্পষ্টভাবে মিরায়ার কানে গিয়েছে, কিন্তু সে একটি শব্দও বলল না। চোখ এখনও বাইরের দিকে, মুখে কোনো ভাব প্রকাশ নেই।
রায়ান একপলক তার দিকে তাকিয়ে থাকল আবার। সেই চোখের নীরবতা, মুখের গাম্ভীর্য—রায়ানকে অস্থির করে তুলছিল। মিরায়ার নীরবতা হয়ে উঠেছিল এক কঠিন ফাঁসের সমতুল্য, যা সে নিতে পারছিল না। অথচ এখন সে রাগে নয়, ভিন্ন এক অনুভূতিতে কথা বলতে চাইলো।
সে নীরবতা ভেঙে কোমল সুরে বলল—

—“মিস ঢাবিয়ান, সকালে যে ক্যাম্পাসের দোহাই দিয়ে নাস্তা না করে উঠে এলে কিছু কি খাওয়া হয়েছে?”
মিরায়া কোনো সাড়া দিল না। শুধু জানালার বাইরে তাকিয়েই রইল। তার ভেতরে যুদ্ধ চলছে—কথা বলবে কি না, অভিমান ছাড়বে কি না। তবে আত্মসম্মান যেন ঘিরে ধরলো চারপাশ সে টু শব্দটিও করে না।
রায়ান এবার আরও ধীরে বলল, যেন নিজের ভেতরের রাগ গিলে ফেলছে—
—“রাগ করলে করো, অভিমান করলে করো… কিন্তু না খেয়ে থেকো না। আমার সহ্য হয় না।”
মিরায়ার বুক ধক করে উঠল, কিন্তু ঠোঁট নড়ল না। সে শুধু আরও শক্ত করে ব্যাগের ফিতা চেপে ধরল। এবারের কথার ও কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। কিছুই যেন কানে পৌঁছায় না তার।
রায়ান এবার একটু এগিয়ে এল মিরায়ার দিকে, কণ্ঠে শান্ত আদুরে সুর—

—“হৃদপাখি, তুমি জানো? আমি তোমাকে জোরে করে বাঁধতে চাই না… শুধু চাই তুমি নিজের খেয়াল রাখো।”
এই শব্দগুলোয় এমন এক অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল, যা গাড়ির ভেতরের ভারী হাওয়াটাকেও কোমল করে তুলল। তবুও মিরায়া নিরুত্তর।
তার ভেতরের দ্বন্দ্বটা স্পষ্ট—
“আমি কি আসলেই দুর্বল হয়ে যাচ্ছি? নাকি এই মানুষটা সত্যিই আমার জন্য এতোটা পাগল? কিসের জন্য এই অদ্ভুত পাগলামি?”
গাড়ির ভেতরের নীরবতা যেন আরো দমবন্ধ হয়ে উঠল। বাইরে শহরের ট্রাফিক শব্দ করছে, কিন্তু ভেতরে কেবল দুই হৃদয়ের অদৃশ্য টানাটানি।
রায়ান মৃদু হেসে, হালকা রাগ-ভরা আদুরে গলায় ফিসফিস করে বলল—

—“হৃদপাখি , আমি তোমার এমন নীরবতা দেখার লক্ষ্যে এখনো তেমন কিছুই করি নি। আমাকে তেমন কিছু করতে বাধ্য কোরো না। ”
মিরায়ার চোখের পাতা কেঁপে উঠল। মনে হলো, এই মানুষটা সত্যিই তাকে তার সমস্ত লজ্জা , সংযমতা আর ব্যক্তিত্বের দেয়াল ভেঙে দিতে বাধ্য করবে।
মিরায়া ঠোঁট কামড়ে নিল, কোনো শব্দ নেই। তার গলা যেন ভাঙা সেতু; মানে যেন চলেছে না।
রায়ান দেখল মিরায়ার অস্থিরতা; তার চোখে কোনো কোমলতা ঢলে এলো না—কিন্তু যে যত্ন আছে, ওটা আত্মার অন্তরস্থল থেকেই ভেসে আসছে। রাগ করার শত কারণ থাকতেও যখন রাগ নিজের অস্তিত্ব হারায় হয়তো তখনি ভালোবাসারা ঘর বাঁধে।

সময়- অপরাহ্নের শেষ ভাগ।
গাড়ির কালো কাঁচের ভেতরে জমানো উত্তাপ হঠাৎ থেমে গেল ইঞ্জিন নিভতেই। সোনালি বিকেলের আলো ঝলসে পড়ছে শহরের সবচেয়ে অভিজাত ফাইভ স্টার রেস্টুরেন্টের সামনে। বিশাল দোতলা স্থাপনার কাঁচের দেওয়ালগুলো সূর্যের আলোয় ঝকমক করছে, যেন পুরো বিল্ডিংটাই আলো দিয়ে তৈরি। প্রবেশদ্বারে সাজানো রয়েছে গাঢ় লাল কার্পেট, দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্যুট পরা ভদ্রলোকরা—যেন কোনো রাজকীয় অতিথি আসছে।
কালো লাক্সারি গাড়ি থেমে গেল একেবারে লাল কার্পেটের মাথায়। গাড়ির সামনের ড্রাইভিং সিটের দরজা খুলে ভেতর থেকে নামলো রায়ান—সাদা শার্টে হালকা খোলা গলার বোতাম, চোখে সেই স্বাভাবিক ঠাণ্ডা দৃঢ়তা। তারপর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে গাড়ির অন্য দরজাটা নিজ হাতে খুলে মিরায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন।
রায়ান অত্যন্ত দায়িত্ব বোধ থেকে-

“মাই ডিয়ার হার্ট-বার্ড, কাম আউট বেইবি।”
মিরায়া এমন অদ্ভুত আদুরে ডাকে একটু ইতস্তত বোধ করলেও রায়ানের সেই অটল দৃষ্টির সামনে বাধা দেওয়ার শক্তি পেল না। তাছাড়া বাইরের এত স্টাফদের সামনে কোনো প্রকার সিনক্রেট করার ইচ্ছা তার ছিল না।
মিরায়া আলতো করে তার হাতের উপর নিজের হাত রাখতেই রায়ান তার নরম হাত অতি যত্নের সাথে তবে শক্ত করে ধরে তাকে গাড়ি থেকে নামিয়ে আনল। লাল কার্পেটের উপর মিরায়ার স্যান্ডেল ছোঁয়া মাত্রই, যেন চারপাশের আলো আরও একবার বদলে গেল।
প্রবেশদ্বার থেকে এগিয়ে এলেন রেস্টুরেন্টের ম্যানেজার—মাঝবয়সী ভদ্রলোক, চোখেমুখে ভদ্র হাসি, ভাষায় পরিপক্কতা। তিনি সামনে এসে সামান্য ঝুঁকে বললেন—

—“স্যার, মেম, আপনাদের জন্য আজকের আয়োজন একেবারেই বিশেষ। এই পুরো রেস্টুরেন্ট আজ কেবল আপনাদের দুজনের জন্য রিজার্ভ করা হয়েছে। সত্যি বলতে, এমন ভাগ্যবতী খুব কম মেয়ে আছে—ম্যাডাম, আপনি নিজেকে সত্যিই অনেক ভাগ্যবতী ভাবতে পারেন। স্যার শুধু..”
কথাগুলো শেষ হওয়ার আগেই রায়ান হঠাৎ হাত উঁচু করে ম্যানেজারকে থামিয়ে দিলেন। চোখে ঝলসে ওঠা এক দৃঢ় সতর্কতা—

—“Enough.”
ম্যানেজার একদম থেমে গেলেন, মাথা নিচু করে পিছু সরলেন। পরিবেশে হালকা চাপা টান পড়ল।
মিরায়ার বুক ধক করে উঠল। তার চোখ বড় বড় হয়ে রায়ানের দিকে তাকাল—“পুরো রেস্টুরেন্ট শুধু আমাদের জন্য?! টাকা কি গাছে ধরে আপনার?” মনে হলো ঠোঁট নড়তে চাইছে, কিন্তু কথা আটকে যাচ্ছে। অবশেষে সে একপ্রকার চাপা গলায় ফিসফিস করে প্রশ্ন করল—
—“আপনি… এসব কেন করেছেন? এত কিছুর… প্রয়োজন ছিল না। টাকার অপচয় কেন করেছেন?”
রায়ান মুখে বিরক্তি নিয়ে-

“সাধে বলি, বেডি মানুষ বেশি বুঝে! শোন মেয়ে, টাকার অপচয় না দেখে আমায় দেখ। বেশি কাজে দেবে। মাই ক্রেডিট কার্ড হ্যেজ নো লিমিট, হুয়েন ইট কামস টু ইউর বেইবি।”
মিরায়া কি বলবে কিছুই ভেবে পেলো না । শুধু ফেল ফেল করে চেয়ে রইল রায়ানের দিকে- “এই লোক সত্যিই পাগল। কোনো সন্দেহ নাই।” (মনে মনে)
রায়ান তার দিকে তাকাল মিরায়ার অবাক চেহারা দেখে বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে-
“উফ্! এমন ভাবে তাকালে আমি কিছু একটা করে ফেলব হৃদপাখি। এমন করে তাকিও না।”
মিরায়া সাথে সাথে লজ্জায় পড়ে গিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল।

রায়ান মিরায়ার লজ্জা মাখা মুখ দেখে ঠোঁট কামড়ে হেঁসে চোখ সোজা রেখে শান্ত গলায় মিরায়ার কাছে ঘেষে বলল—
—“প্রয়োজন আর ইচ্ছার পার্থক্য বোঝা যায় না, হৃদপাখি। যা তোমার জন্য সঠিক, সেটাই আমি করব। প্রশ্ন করবে না। বিষয়টা যদি টাকার হয় তাহলে বলে দেই- টাকা অন্য কারো জন্য না হলেও তোমার ক্ষেত্রে আমার টাকা গাছে গজাবে। বুঝেছ?”
তার স্বরটা ছিল একেবারে স্থির—কোনো উত্তেজনা নেই, অথচ অদৃশ্য শক্তি আছে।
মিরায়া তার দিকে এক ঝলক বাঁকা চোখে তাকাল—রাগ? অভিমান? নাকি ভেতরের সেই অদ্ভুত টান? সে নিজেও বুঝতে পারল না।

রায়ান হাঁটতে হাঁটতে মিরায়ার হাত আলতো করে ধরল, তাকে নিয়ে ঢুকল বিশাল হলঘরে। রেস্টুরেন্টের ভেতরটা একেবারে খালি—নরম আলোয় ভরা, লাল গোলাপের সুবাসে ভরপুর। প্রতিটি টেবিলে সাজানো ঝকঝকে ক্রিস্টাল গ্লাস, ঝাড়বাতির আলোয় মেঝেতে সোনালি ছায়া পড়ছে। অথচ পুরো হলঘরে কোনো কোলাহল নেই—শুধু তাদের দুজনের নিঃশ্বাস, আর পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনির মতো ভেসে যাচ্ছে।
একটি টেবিলের সামনে এসে রায়ান নিজ হাতে চেয়ারটা টেনে মিরায়ার দিকে ঘুরিয়ে ধরল—
—“Sit down.”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ১৯

মিরায়া বসলো আর ভেবেছিল রায়ান হয়তো বসবে মুখোমুখি সামনের চেয়ারে । তারপর অবাক হয়ে দেখল—রায়ান নিজের চেয়ারটা সামনের দিক থেকে টেনে আনলো ও ওপর দিক থেকে ঘুরিয়ে এনে তার একেবারে পাশে রাখল।
রায়ান পাশেই বসল, যেন কোনো ফাঁকই নেই।
মিরায়া হঠাৎ এক ঝলক বাঁকা চোখে তাকাল—একটা মিশ্র অনুভূতি, অভিমান, অবিশ্বাস, আবার অজানা এক শিহরণ।
কিন্তু রায়ান কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। সে সোজা সামনে তাকিয়ে কাঁধ সোজা রাখলো, ঠোঁটে সামান্য আত্মবিশ্বাসী হাসি। যেন পুরো পৃথিবীটাই এখন তার নিয়ন্ত্রণে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here