সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৬
Jannatul Firdaus Mithila
“ লিপস্টিকটা কি চেরি ফ্লেভারের ছিলো জান?”
থমকায় ইকরা।তড়িৎ দু’হাতে নিজের লজ্জালু মুখটা কোনমতে ঢেকে নেয় বেচারি। অনিক হাসলো ঠোঁট কামড়ে। মেয়েটাকে আলগোছে নিজের বুকের মাঝে লুকিয়ে নিয়ে, দুষ্ট হেসে বলে ওঠে—
“ লজ্জা পেলে তোমায় কিন্তু একদম বউ বউ লাগে মায়াবিনী.. একদম এই ইশতিয়াক এহসান অনিকের বউয়ের মতো লাগে।”
ইকরা মুখ লুকিয়ে রেখেই হাসলো নিঃশব্দে। অনিক বুঝি টের পেলো সেই হাসিখানা। সে তৎক্ষনাৎ মেয়েটাকে নিজের বুক থেকে খানিকটা সরিয়ে এনে দাঁড় করায়।দু’হাতে ইকরার মুখের ওপর থেকে হাতদুটো একপ্রকার টেনে সরিয়ে দেয়। ইকরা লজ্জালু মুখটা নুইয়ে রেখেছে কোনরকমে। মেয়েটার সুশ্রী মুখখানায় ইতোমধ্যেই লেপ্টে গিয়েছে লালাভ আভা। চোখদুটোর পাতাও যেন আর ওপরে উঠবার নয়! অনিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ইকরার পানে। কিয়তক্ষন তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তার চোখদুটোর অবাধ্য দৃষ্টি হঠাৎই গিয়ে ঠেকলো ইকরার কন্ঠদেশের নিচে। যেহেতু অনিক বসে আছে টেবিলের ওপর, সেহেতু মেয়েটা সামান্য ঝুঁকে দাঁড়ানোতে তার গলার গভীর থেকে নেমে আসা ক্লিভেজটি হুট করেই চোখে পড়লো অনিকের। পরমুহূর্তেই ছেলেটার নিশ্বাস যেন আঁটকে যোগাড়! তার বুক কাঁপছে, সে-ই সাথে বুকের মাঝে চলছে এক তুমুল তোলপাড়! অনিক তৎক্ষনাৎ নিজের বুকের বা-পাশে একহাত চেপে ধরলো। সেথায় আলতো করে ডলতে ডলতে ঘনঘন নিশ্বাস ফেলতে লাগলো অনবরত। পরক্ষণেই নিজের দু’হাত সামান্য পেছনে হেলিয়ে, মুখটা সিলিংয়ের দিকে তাক করলো অনিক।কিয়তক্ষনের মধ্যেই কন্ঠে এক ভিন্ন অস্থিরতা লুকিয়ে সে বলে ওঠে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“ আমায় এভাবে পাগল করছো কেনো মায়াবিনী? তুমি কি চাও? বড় ভাইয়ের বিয়ের পাশাপাশি নিজের বিয়েটাও যেন সেরে ফেলি আমি?”
ভড়কায় ইকরা।তড়িৎ চোখদুটো উপরে তুললো সে। হতবাক কন্ঠে বললো,
“ মানে?”
অনিক অস্থির হচ্ছে ধীরে ধীরে। বুকের ওঠানামার গতিও কেমন বেড়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। সে-তো ঘনঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে সামলানোর বৃথা প্রয়াসে মত্ত, অথচ কাজের কাজ কিছু হলে তো! এদিকে তার এহেন অস্থিরতা দেখে চিন্তিত হলো ইকরা। মেয়েটা তৎক্ষনাৎ অনিকের দিকে ফের ঝুঁকে এসে বিচলিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“ কি হয়েছে আপনার? হঠাৎ এমন করছেন কেনো আপনি?”
অনিক নিশ্চুপ। বড় বড় নিশ্বাস ফেলে সে যে-ই না মেয়েটার দিকে তাকাবে ওমনি তার বেহায়া চোখদুটো আবারও গিয়ে ঠেকলো সে-ই একই জায়গায়। অনিক তৎক্ষনাৎ নিজের চোখদুটো কুঁচকে বন্ধ করে নিলো।বুকের ওপর হাত চেপে, টেবিলের ওপর সামান্য গা এলিয়ে দিয়ে আর্তনাদ করে বললো,
“ আল্লাহ গো! এই মেয়ে আজ আমার সর্বনাশ করেই ছাড়বে!”
এহেন বাক্যে ভ্রু কুঁচকায় ইকরা। সে তৎক্ষনাৎ ছেলেটার দিকে সন্দিহান গলায় প্রশ্ন ছুঁড়ে বলে বসে,
“ কি যা-তা বলছেন আপনি? একটা মেয়ে মানুষ হয়ে আমি আবার কিভাবে আপনার সর্বনাশ করবো? আশ্চর্য!”
অনিক বললো না কিছু। শুধু বুকের ওপর হাত ঠেকিয়ে পড়ে রইলো ছেলেটা। এদিকে ইকরা ভেবে-ভেবে অস্থির, হুট করেই লোকটার আবার কি হলো? ইকরা কিছুটা সময় নিয়ে অনিকের বাম হাতের ওপর হাত রাখলো আলগোছে।এহেন স্পর্শ পেয়ে মুহুর্তেই খানিকটা নড়েচড়ে উঠে অনিক। ইকরার হাতটা নিজ হাতের মুঠোয় চেপে ধরে শক্ত করে। অতঃপর মেয়েটার দিকে ঘোলাটে নয়নে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলে —
“ নিজের ভালো চাইলে, এখনি আমার সামনে থেকে চলে যাও মেয়ে।কেননা তুমি যদি আর একমুহূর্তও আমার সামনে থাকো তাহলে এর পরবর্তীতে যা হবে, তাতে আমি মোটেও দুঃখীত হবোনা। এমনকি তুমি হাজারবার কেঁদে-কেটে নিজেকে আমার কাছ থেকে ছাড়াতে চাইলেও আমি অনিক শুনবোনা সে-ই কথা।”
ইকরা কেঁপে ওঠে এমন শক্ত-পোক্ত কথায়। তার ছোট্ট মগজে এহেন কথাগুলোর জ্ঞাতার্থ আদৌও ঢুকলো কি-না কে জানে! সে-তো হতবিহবলের ন্যায় তাকিয়ে আছে অনিকের দিকে। অনিক থামলো একমুহূর্তের জন্য। জিভ দিয়ে নিজের শুষ্ক অধরজোড়া সামান্য ভিজিয়ে নিলো ছেলেটা। তারপর নিঃশব্দে নেমে এলো টেবিলের ওপর থেকে। ইকরা গাল ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তার থেকে একহাত দূরে। গাল তো ফোলাবেই বেচারি! সে-কি আর যেচে পড়ে এখানে আসতে চেয়েছিলো? এই মানুষটাই তো তাকে চিরকুট দিয়ে আনিয়েছে এখানে। এখন আবার কি সুন্দর মুখের ওপর বলে দিচ্ছে চলে যেতে! আশ্চর্য! তার কি কোনো দাম নেই? কথাগুলো মনের মাঝে একনাগাড়ে জপছে ইকরা,আর বাইরে থেকে ক্রমাগত ফুঁসছে রাগে। অনিক আড়চোখে দেখলো তার মায়াবিনীকে। মেয়েটাকে এমুহূর্তে কি যে আদুরে লাগছে না! অনিক তো পারছেনা নিজের সকল ধৈর্য্য, নীতি ভঙ্গ করে মেয়েটাকে একেবারে নিজের করে নিতে। কিন্তু মনের এহেন ভয়ংকর চিন্তাভাবনা গুলোকে একপ্রকার সাইডে রেখে অনিক ধীর পায়ে এগিয়ে আসে মেয়েটার দিকে। ইকরা আড়চোখে তা খেয়াল করেই তৎক্ষনাৎ পিছিয়ে গেলো দু-কদম। অনিক হাসলো ঠোঁট কামড়ে। পরক্ষণেই কোনরূপ আগাম সর্তকবার্তা ছাড়াই, ভদ্র ছেলেটা হুট করেই একহাতে টেনে ধরলো ইকরার মেদহীন কোমর। মেয়েটাকে নিয়ে এলো নিজের একেবারে কাছাকাছি। ইকরা হকচকায়। অবিশ্বাস্য চোখে তাকায় অনিকের দিকে। অনিক আলতো হেসে মেয়েটার কানের কাছে মুখ ঠেকায়।ফিসফিস করে বলে,
“ এটা বিয়ে বাড়ি জান। এভাবে আপনার সুন্দর ক্লিভেজ খানা আমি বাদে যেন অন্য কেউ না দেখে। এক্ষুণি ঘরে গিয়ে ওড়নাটা ঠিকঠাক মতো গায়ে জড়াবেন কেমন? তাছাড়া.. আপনাকে চলে যেতে বলেছি বলে রাগ করেছেন বুঝি? তা বলি কি মেডাম… আপনি কি আমায় লৌহ-মানব মনে করেছেন না-কি? আপনার এসব দেখে নিজেকে সামলে রাখবো ভেবেছেন? উঁহু! শুনে রাখুন মিস আমি অনিক এতোটাও সুপুরুষ নই।যেখানে আপনাকে দেখলেই মাথা ঘুরে যায় আমার,সেখানে আপনার ওসব দেখলে তো কথাই নাই!তাই আপনার ভালোর জন্য বলছি,নেক্সট টাইম নিজেকে একটু সামলে-সুমলে রাখবেন।নাহলে কিন্তু একদম তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়ে-শাদি করে বাসর করে ফেলবো বলে রাখলাম।”
কথাটা বলেই অনিক টুপ করে ছোট্ট একটা চুমু একে দিলো ইকরার কাঁধ বরাবর। ইকরা কেঁপে ওঠে তৎক্ষনাৎ। দু’হাতে খামচে ধরে লেহেঙ্গাটার একাংশ। অনিক পরমুহূর্তেই ইকরাকে ছেড়ে দিয়ে সামান্য দূরে সরে দাঁড়ায়। একদৃষ্টিতে মেয়েটাকে একবার আপাদমস্তক পরোখ করে, দুষ্ট হেসে বলে ওঠে,
“ মেয়ে মানুষের এতো সুন্দর হতে নেই মায়াবিনী! আমার মতো দূর্বল হৃদয়ের মানুষতো ক্ষনে ক্ষনে খেই হারাবে আপনাকে দেখে!”
এবার যেন লজ্জায় মাটিতে মিশে যাবে ইকরা।লোকটা কি ভয়ংকর কথা বলে! অথচ এতোদিন সে ভাবতো,এই মানুষটা বোধহয় বড্ড গম্ভীর এবং চুপচাপ স্বভাবের। কিন্তু বালাইষাট! তার ওমন চিন্তাভাবনায় যেন এক বালতি পানি পড়ে গেলো ইতোমধ্যে! ইকরা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে কোনমতে বলে ওঠে,
“ আমি,যাই!”
অনিক স্মিত হাসলো। এগিয়ে এসে ভিষণ অধিকারবোধের সাথে ইকরার কপাল বরাবর ঠোঁট ছুঁইয়ে বললো,
“ যাই বলতে নেই মায়াবিনী! বলো.. আসি!”
ইকরা ধীরে ধীরে মাথা কাত করলো। থেমে থেমে বললো,
“ আসি!”
অনিক আবারও চমৎকার হাসলো। ইকরার লাল টুকটুক হয়ে আসা গালদুটো আলতো টেনে দিয়ে, সে কেমন মুগ্ধ কন্ঠে বললো,
“ হুম! অবশ্যই। এই ইশতিয়াক এহসান অনিকের হৃদয়মাঝারে আপনাকে সু-স্বাগতম। ধীরেসুস্থে আসবেন কিন্তু, কেননা একবার এই হৃদয়মাঝে চলে এলো আমরণ থাকতে হবে আপনার। মনে থাকবে?”
এপর্যায়ে ইকরাও হেসে দিলো নিজ অজান্তে। মনে মনে বললো সে —আমরণ মনে থাকবে বৈকি!
হলুদের সন্ধ্যা!
এহসান বাড়ির দালানচত্বর জুড়ে হরেকরকমের রঙিন আলো আর ফুলের সুঘ্রাণে মো মো করছে। চারদিক সেজে উঠেছে গাঁদা আর রজনীগন্ধার মালায়। ব্যাকড্রপে ঝুলছে হলুদ-সাদা কাপড়, তার ফাঁক দিয়ে চিকচিক করছে ফেয়ারি লাইট। মঞ্চে রাখা কুশনের ওপরে সোনালি রঙের গদি। এই পুরো সাজসজ্জার থিম ছিলো অনিকের পরিকল্পনা। ছেলেটা কত্ত আশা নিয়ে নিজ হাতে নিজের প্রিয় মানুষ দুটোর জন্য স্টেজ সাজিয়েছে! কাজের ফাঁকে ফাঁকে বাড়ির কর্তারা দুয়েকবার এহেন সাজসজ্জা দেখে আপ্লূতও হয়েছেন বেশ।তাশরিক সাহেব তো এখনো ছুটছেন ডেকোরেশনের লোকেদের সাথে সাথে। কোথায় কতটুকু ফুল লাগবে, কোথাকার সাজটা আরেকটু সুন্দর হবে সবটাই যেন ঘুরে ঘুরে দেখছেন তিনি।তায়েফ সাহেব স্টেজের চারপাশটা ঠিকঠাক মতো দেখছেন। স্টেজের সামনে একগাদা চেয়ার।মানুষজনও তো আসা শুরু করে দিয়েছে ইতোমধ্যে! ওদিকে বাড়ির বড় দু-কর্তা সাব্বির সাহেব এবং কবির সাহেব বাবুর্চিদের সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছেন টুকটাক। এইতো আর ঘন্টা দেড়েক পরেই শুরু হবে হলুদ অনুষ্ঠান, অথচ সকলের ব্যস্ততা যেন আর কাটছেই না!
শুধু কি বাড়ির কর্তারাই ব্যস্ত? উঁহু, মোটেও না।বাড়ির গৃহিণীরাও যে একটুখানি ফুরসত পাচ্ছেন না স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে! জুবাইদা বেগম ব্যস্ত হাতে শরবত গুলিয়ে যাচ্ছেন, রাইসা বেগম সেই শরবত গ্লাসে ঢেলে ড্রয়িং, ডাইনিং ভর্তি মেহমানদের সার্ভ করছেন একে একে। অন্যদিকে, রাফিয়া বেগম ব্যস্ত তার চিরচেনা কাজে! বাড়িতে কোনো টুকটাক কিছু হলেই যেখানে মানুষটার হাতের মিষ্টি খাবার বায়না শুরু হয় সকলের, সেখানে আজ তো কতবড় একটা উৎসবের দিন! আজ কি আর মিষ্টি না বানালে চলবে তার? রাইসা বেগম কড়াই ভর্তি ডুবো তেল থেকে একে একে মিষ্টিগুলো তুলে নিয়ে চিনির সিরায় ঢালছেন। পাশ থেকে মাইমুনা বেগম ধীরে ধীরে খুন্তি দিয়ে নাড়ছেন সেগুলো। প্রায় মিনিট খানেক পর,রান্নাঘরে এসে হাজির হন সিঁথি বেগম এবং রাহেলা বেগম। অরিনের দুই মামি। সিঁথি বেগমতো এসেই বলতে লাগলো,
“ রাফিয়া আপা! তুমি এখনো কাজ করছো? দেখি সরো তুমি, আমি করছি বাকিটা! ইশশ্.. আরেকটু পরেই মেহমান সব চলে আসবে আর তোমরা কি-না এখনো রেডিই হও নি! যাও যাও… তারাতাড়ি গিয়ে রেডি হও।”
কথাটা বলেই সিঁথি বেগম যেচে পড়ে রাফিয়া বেগমের হাত থেকে গরম খুন্তিটা টেনে নিলেন নিজ হাতে। রাফিয়া বেগম নাকচ করতে লাগলেন ভাবির এমন প্রস্তাবে।তিনি একপ্রকার গো ধরে বলতে লাগলেন,
“ আহা! তোমার করতে হবে না।তুমি গিয়ে আম্মার সাথে বসো।এখানে আর কই তেমন কাজ? এটুকু করতে খুব একটা সময় লাগবে না আমার। তুমি ছাড়ো এসব! দাও খুন্তিটা আমার হাতে দাও।”
শুনলেন না সিঁথি বেগম। উল্টো মুখাবয়বে কপট ভাব ধরে বলতে লাগলেন,
“ আরে যাও তো! গিয়ে মেয়েটাকে একবার দেখে এসো যাও। সোহেলী তো বললো,অরি না-কি তোমায় ডেকেছে বারকয়েক!”
তৎক্ষনাৎ নড়েচড়ে দাঁড়ালেন রাফিয়া বেগম। সন্দিগ্ধ কন্ঠে বলে ওঠেন,
“ কি বলিস! সত্যি ডেকেছে?”
এহেন কথার পিঠে রাফিয়া বেগমের পেছন থেকে বেশ অনিহার সুরে রাহেলা বেগম বলে ওঠেন,
“ হ্যা! ডেকেছে। যাও..গিয়ে দেখো, তোমার দুলারির আবার কি-না কি লাগে। যদিওবা তার কিছু লাগবে বলে মনে হয়না,কেননা বিয়ে তো আর বাইরের কারোর সাথে হচ্ছেনা। হবে তো ঘরের লোকের সাথেই।তাও আবার নিজের থেকে একযুগ বড়, বয়স্ক ছেলের সাথে!”
কথাটা বলেই মুখ বাঁকালেন রাহেলা বেগম। এদিকে তার ওমন বাঁকা কথা শুনে মুখাবয়ব হুট করেই শক্ত হয়ে এলো মাইমুনা বেগমের। তার তো ইচ্ছে করছে, এক্ষুণি চুলোর ওপর থেকে গরম তেলটা গায়ে ছুঁড়ে মারতে এই বেয়াদব মহিলার। কিন্তু বয়সে বড় এবং পারিবারিক শালীনতা মাথায় রেখে সবটা একপ্রকার জোর করে হজম করে ফেললেন তিনি। রাফিয়া বেগম গম্ভীর মুখে পেছনে ফিরে তাকালেন। পরক্ষণেই মুখে কুটিল হাসির রেশ টেনে টিপ্পনী কেটে বলে ওঠেন,
“ অথচ এমন একটা বয়স্ক ছেলে পাওয়ার জন্য কত মানুষ কত কিছুই না করে ভাবি! কেউ কেউ তো নিজে থেকেই মেয়ে লেলিয়ে দেয় এমন একটা পারফেক্ট ইলিজেবল ব্যাচেলর ওপস সরি তোমার ভাষ্যমতে বয়স্ক ছেলের পেছনে। সেদিক থেকে বিবেচনা করতে গেলে আমি নিসন্দেহে ভাগ্যবতী। কেননা আমার ওসব কিছুই করতে হয়নি, রোদের মতো একটা ছেলেকে নিজের মেয়ের জামাই বানাতে। তাছাড়া.. রোদের মতো মেয়ের জামাই পাওয়া তো সাত-কপালের ভাগ্য গো ভাবি,যা কি-না সবার চার-আঙুইল্লা কপালে জোটেঁনা। জানো? আমার ঐটুকুন হাঁটুর বয়সী মেয়েটাকে আমাদের রোদ তো একপ্রকার চোখে হারায় গো!এমনকি দুজন যখন একসঙ্গে পাশাপাশি দাঁড়ায়…উফফ! কি যে বলবোনা।মাশাআল্লাহ.. একদম….
“ মেইড ফর ইচ আদার!”
রাফিয়া বেগমের কথার মাঝেই মুচকি হেসে কথাটা বলে ওঠেন মাইমুনা বেগম। রাফিয়া বেগম গালভরে হাসলেন। পাশ থেকে সিঁথি বেগম সায় জানিয়ে বলে ওঠেন,
“ তা যা বলেছো আপা! দুজনকে পাশাপাশি দেখলে কি যে ভালো লাগে! আহা! কারো নজর না লাগুক।”
সকলের এহেন বক্তব্যে রীতিমতো ফুঁসছেন রাহেলা বেগম। তিনি তৎক্ষনাৎ মুখ ঝামটি মেরে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন গটগট পায়ে। তা দেখে রাফিয়া বেগম মিটমিট করে হাসছেন যেন। মাইমুনা বেগম বিরবির করে বলে ওঠেন,
“ ভাগ্যিস নিজে থেকেই চলে গিয়েছে, নইলে আমিই বের করে দিতাম বেয়াদবটাকে!”
জুবাইদা বেগম গায়ে জড়িয়েছেন সর্ষে হলুদ রঙের কাটওয়ার্কের শাড়ি। সে-ই সাথে গলায়,হাতে,কানে জড়িয়েছেন পিচ রঙের জুয়েলারি। মাথায় বেধেঁছেন বড় একটা খোঁপা। খোঁপায় গেঁথেছেন বেলি ফুলের মালা।আজ ঠিক একই ভঙ্গিতে সেজে ওঠেছেন তার বাকি তিন জা’য়েরা। চারজন বিউটিশিয়ান মিলে সাজিয়ে দিচ্ছেন তাদেরকে। বাড়ির ছেলেমেয়েদের কড়া নির্দেশ — আজ যেন সকলেই একই কালারের ড্রেস কোড পড়ে। সেজন্যই সন্ধ্যার পর থেকেই নিজেদেরকে সঙ সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন গৃহিণীরা! যদিওবা তাদের সকলকেই অপরুপা লাগছে তবুও তাদের ভাষ্যমতে, মুখে একগাদাঁ এটা-সেটা মাখাটাকে সঙ সাজানো বলা ছাড়া আর কি’বা বলবে?
ইফতি আর অনিক মিলে স্টেজের সামনে দাঁড়িয়ে কি যেন একটা করছে। আশেপাশের মেয়েগুলো অনিককে যেন একপ্রকার চোখ দিয়েই গিলে খাচ্ছে। তাছাড়া ছেলেটাও তো নিজেকে সাজিয়েছে ওমনভাবে। ফর্সা দেহখানায় জড়িয়েছে বোটল-গ্রীন কালারের সুতোর কাজ করা পাঞ্জাবিতে। সঙ্গে পড়েছে সেম রঙের ধুতি সালোয়ার। গলার ওপর পেচিয়ে একপাশে ঝুলিয়ে রেখেছে হলদে রঙা ওড়নার ন্যায় কিছু একটা। অনিক তো নিজের মতো করে কথা বলেই যাচ্ছে। তার কি আর অন্যদিকে ওতো খেয়াল আছে?
কথা বলার একপর্যায়ে অনিকের চোখ গেলো স্টেজের সামনের ওপরের অংশটা।সেখানটায় ফুলগুলো কেমন খুলে খুলে আসছে যেন! ছেলেটা তৎক্ষনাৎ একজন ডেকোরেশনের লোককে গলা উঁচিয়ে ডাক দেয়।
“ এই যে ভাই! এদিকে আসেন”
তার এহেন ডাক পাওয়া মাত্রই লোকটা তৎক্ষনাৎ এগিয়ে আসে। অনিক তাকে হাতের ইশারায় স্টেজের সামনের অংশটা দেখিয়ে বলে ওঠে,
“ কি লাগিয়েছেন এটা? খুলে আসছে কেনো?”
লোকটা সেদিকে নজর দেয়।নিজেদের খামখেয়ালীর জন্য কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করে তড়িঘড়ি করে ব্যবস্থা নেয় কাজটা ঠিকঠাক মতো করে দেবার। অনিক সেদিকে একপলক তাকিয়ে নিজের দৃষ্টিটা সরিয়ে আনলো অন্যদিকে।ঠিক তখনি তার চোখদুটো যেন বিভ্রমে পড়লো একপ্রকার। সে তৎক্ষনাৎ চোখদুটো বন্ধ করে আবারও খুললো।নাহ! এখনো আগের মতোই দেখছে সবটা। অদূরেই পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছেন তার বাবা-চাচারা।প্রত্যেকের গায়ে জড়ানো সর্ষে হলুদ রঙের পাঞ্জাবি, সঙ্গে পিচ রঙের হাফ-কোট। তার সাথে পড়েছেন একদম সফেদ রঙা লুঙ্গি। প্রত্যেকেই লুঙ্গির এককোণ ধরে রেখেছে হাতে। সবার চোখের ওপর এঁটে রাখা কালো রঙের চশমা। অনিক একপ্রকার হা করে তাকিয়ে রইলো বাবা-চাচাদের এহেন রুপ দেখে। এদিকে ইফতি অনিকের ওমন দৃষ্টি দেখে ভ্রু কুঁচকায়। অনিকের দৃষ্টি লক্ষ্য করে সে-ও তাকায় পেছনের দিকে। ওমনি ছেলেটা কেমন হতবিহ্বল হয়ে গেলো যেন! সামান্য ফাঁকা ঢোক গিলে নিজেকে কোনমতে সামলে বললো,
“ ভাই! যা দেখছি তা-কি সত্যি?”
অনিক শুধু মাথা নাড়লো। পাঞ্জাবির পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে তৎক্ষনাৎ দু-চারটে ছবি তুলে নিলো সকলের। পরক্ষণেই ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে বুঝদারের ন্যায় যুক্তি দাড় করিয়ে বললো,
“ ছবিতে যেহেতু একই জিনিস আসছে,তারমানে সবটাই সত্যি!”
কবির সাহেব দুচোখে শুধু আধার দেখছেন। লোকটার কি আর ওসব রঙচঙে চশমা পড়ার অভ্যেস আছে? তবুও তো আজ পড়লেন ভাইদের একপ্রকার গা-জোরাজুরিতে। এদিকে আশেপাশের লোকজন সকলেই ইতোমধ্যে এসে ভিড় জমিয়েছে তাদের কাছে। আমন্ত্রিত অতিথিরা এসে কুশলাদি বিনিময় করছেন তাদের সঙ্গে। ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট তপন কুমার এগিয়ে আসেন কবির সাহেবের দিকে। নিজে থেকেই হাত বাড়িয়ে দেন তিনি। কবির সাহেবও পরপর চোখ বড়সড় করে মানুষটার সাথে হাত মেলালেন। চশমার আড়াল থেকে একদমই সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটাকে চিনতে পারছেন না তিনি। তবুও কবির সাহেব ঠোঁটের কোণে এক চিলতে জোরপূর্বক হাসি টেনে ধরে রেখেছেন কোনমতে। অবস্থা যখন বেগতিক,তখনি তিনি ধীরে ধীরে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাব্বির সাহেবের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলেন,
“ এটা কে রে সাব্বির?”
সাব্বির সাহেব ফটাফট নিজের চোখ থেকে চশমাটা সামান্য ওপরে তুলে আবারও ঠিকঠাক মতো চোখে পড়লেন। ভাইয়ের মতো করে একই ভঙ্গিমায় ফিসফিস করে বললেন,
“ তোমার বিজনেস পার্টনার। তপন কুমার।”
এদিকে দু’জনের এহেন ফিসফিসানি দেখে গালভর্তি হাসি দিলেন তপন কুমার। বললেন,
“ কি ব্যাপার মিস্টার এহসান? আমায় দেখে এতো ফিসফিস করছেন যে!”
এহেন কথায় মুহুর্তেই সটান হয়ে দাঁড়ালেন কবির সাহেব এবং সাব্বির সাহেব। কবির সাহেব ঠোঁটের কোণে স্মিত হাসি টেনে বলে ওঠেন,
“ আর বলবেন না মিস্টার তপন কুমার! আপনাকে আজকে ভীষণ ইয়াং লাগছে।সেটাই ছোট ভাইকে বলছিলাম আরকি! ভাবলাম আপনার সামনা-সামনি প্রশংসা করলে ব্যাপারটা কেমন রোবটিক লাগবে তাই আরকি…”
এরূপ অনাকাঙ্ক্ষিত প্রশংসা পেয়ে গায়ে যেন উত্তরের বাতাস লেগে গেলো তপন কুমারের।আধঁ-টাক পড়ে যাওয়া,ভুড়িওয়ালা মধ্যবয়স্ক ব্যাক্তিটি এহেন মিথ্যা-বানোয়াট প্রশংসা পেয়ে নির্ঘাত মনে মনে ইতোমধ্যেই নিজেকে শাহরুখের সাথে তুলনা করে বসেছেন। তিনি সামান্য লজ্জালু হাসি দিয়ে নিজের আধঁ-টাক মাথাটায় হাত বুলালেন একটুখানি। হাসিমুখেই বললেন,
“ আসলেই হয়তো দিন দিন ইয়াং হচ্ছি!কেননা ইদানিং অফিসের বেশ-কয়েকজন মেয়ে স্টাফদেরকেও দেখছি,আমায় কেমন আরচোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। ভাবছি এবার নাহয় দুয়েকটা সুগারবেবি….”
এরূপ কথা কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই বুক কাপিয়ে কাশি উঠে গেলো সাব্বির সাহেবের। তপন কুমার আর বাকিটা শেষ করতে পারলেন না।বেচারা নিজের প্রশংসার কথা ছেড়ে দিয়ে মুহুর্তেই চিন্তিত হয়ে পড়লেন সাব্বির সাহেবের অনাকাঙ্ক্ষিত কাশি নিয়ে। এদিকে কবির সাহেব হাসবেন না-কি কাঁদবেন সে নিয়ে পড়লেন মহা-বিপাকে। অবশেষে বেশ কিছুক্ষন ভেবে-টেবে তিনি ভাইয়ের হাত ধরে সেখান থেকে চলে যেতে উদ্যত হলেন। যাওয়ার আগে অবশ্য তপন কুমারকে বলে গেলেন,
“ দুঃখীত মিস্টার! আপনি নাহয় এদিকটা ইনজয় করুন, আমি ওকে নিয়ে যাচ্ছি!”
তপন কুমার মাথা নাড়লেন। আদর্শ ব্যাক্তিত্বের প্রমাণ দিয়ে বললেন,
“ ইয়াহ! আপনি যান।পরবর্তীতে নাহয় আবারও আড্ডা দিবো আমরা।”
কবির সাহেব মুখে হাসলেও মনে মনে বারকয়েক কষিয়ে গালি দিলেন এহেন উজবুক লোককে। বললেন,
“ নিকুচি করেছে তোর আড্ডা দেওয়ার!”
“ ভাইজান! একটা ড্যান্স দিবা আজকে কেমন?”
তাশরিক সাহেবের এহেন কথায় মুহুর্তেই বাকহারা হয়ে পড়লেন তায়েফ সাহেব। বেচারা সবেমাত্র একখানা রসগোল্লা চিপে নিয়ে মুখে ঢুকিয়েছিলেন কিন্তু তাশরিক সাহেবের এহেন কথায় মিষ্টিটা যেন আর চাবানো হলোনা তার। তিনি কোনমতে গালের পাশে রাখা মিষ্টিটা গিলে নিয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালেন।গলায় ঝাঁঝ ঢেলে বললেন,
“ তোর তো দেখছি শরীরে ব্যাপক তেল হয়ে গেছে তশু! বলি… তোর ইচ্ছে হলে তুই একটা কেন,দশটা ড্যান্স দে না।তবুও দোহাই লাগে ভাই, আমারে এসবে টানিস না।”
তাশরিক সাহেব মুখ কুঁচকান। কপাল গুটিয়ে তাকান ভাইয়ের দিকে। বলেন,
“ তুমি সবসময় এমন ব্যাকডেটেড থাকতে চাও কেন সেজো ভাই? আরেহ! কোন জায়গায় আমাদের বাড়ির বড় ছেলের বিয়ে হচ্ছে, নিজে থেকে যেচে পড়ে দুয়েকটা গানে কোমর দুলিয়ে ড্যান্স দিবা তা-না! ধূর! তোমাকে আপডেটেড বানাতে বানাতে আমি-ই দিনকে দিন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি!”
তায়েফ সাহেব এবার বাঁকা হাসলেন। সামনের টেবিলের ওপর থেকে আরেকটা মিষ্টি তুলে মুখে পুরতে পুরতে বললেন,
“ বুড়ো তো হচ্ছিস-ই!এটা কি আবার ঘটা করে বলতে হবে না-কি?”
এহেন কথায় মুহুর্তেই তেতে উঠলেন তাশরিক সাহেব। টেবিলের ওপর দু’হাত ঠেকিয়ে সেজো ভাইকে শুধরে দিয়ে বলতে লাগলেন,
“ এই সেজো ভাই! কিসব আজগুবি কথাবার্তা বলছো তুমি হ্যা? আমাকে কোনদিক থেকে বুড়ো মনে হয় তোমার? তুমি জানো? এখনো ভার্সিটিতে গেলে কলিগ, মেয়ে স্টুডেন্টরা আমার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে। আর তুমি কি-না বলছো আমি বুড়ো? হাহ!”
তায়েফ সাহেব প্রতিত্তোরে কিছু বলতেই যাবেন ঠিক তখনি পেছন থেকে ভেসে আসে রাইসা বেগমের কটমট কন্ঠ!
“ আসলেই? মেয়ে স্টুডেন্ট আর কলিগরাও তাকিয়ে থাকে?”
তৎক্ষনাৎ হুড়মুড় করে পেছনে তাকালেন দুভাই। তাশরিক সাহেবতো ভূত দেখার মতো চমকে ওঠলেন সাথে সাথে। তায়েফ সাহেব সুযোগ বুঝে ভাইয়ের কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
“ তুই থাক ভাই। আমি গেলাম! আজকের মতো বেঁচে গেলে আবারও দেখা হবে নাহয়। গুড লাক!”
কথাটা বলেই তৎক্ষনাৎ গা-গুটিয়ে জায়গা ত্যাগ করলেন তায়েফ সাহেব। এদিকে তাশরিক বেচারা পড়লেন মহাবিপদে। সে কি আর জানতো? তার বউটা যে এভাবে পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।জানলে থোড়াই বাঘিনীর সামনে মুখ খুলতো! তাশরিক সাহেব ভয়ে কাচুমাচু মুখ করে স্ত্রীর দিকে তাকান। রাইসা বেগম কোমরের ওপর দু’হাত ঠেকিয়ে শক্ত মুখে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। তাশরিক সাহেব শুকনো ঢোক গিললেন কয়েকটা। ধীর পায়ে এগিয়ে এসে বউকে মানানোর সুরে বলতে লাগলেন,
“ আমার জান্টুস…আসলে আমি!”
স্বামীর কথার মাঝপথেই হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলেন রাইসা বেগম। দাঁতে দাঁত চেপে তিনি বলতে লাগলেন,
“ শরীরে রং লেগেছে তাই-না? ঠিক আছে আমিও দেখাবো রং কত প্রকার ও কি কি!”
প্রায় ৬জন মিলে সাজাচ্ছে অরিনকে। তবুও তাদের সাজানো যেন শেষই হচ্ছে না আজ! কেউ কেউ আইলাইনারের দাগ মোটা করে ফেলেছে, তো কেউ লিপস্টিকের আউটলাইন ভারি করে ফেলেছে। কেউ আবার শাড়িটা পড়িয়েছে উল্টো! রুহি বেচারি অসুস্থ শরীর নিয়ে সবার সঙ্গে চেচিয়ে যাচ্ছে বেশ কিছুক্ষণ ধরে। অবশেষে শরীরে যখন আর কুলচ্ছে না তখনি মেয়েটা গিয়ে বসলো অরিনের ঘরের কর্নারের সোফাটায়। এদিকে সবার এরূপ উল্টো-পাল্টা কাজে বিরক্ত হবার বদলে ইনজয় করছে অরিন।মেয়েটা ক্ষনে ক্ষনে হাসছে কেন যেন। কুহেলি সাজানোর ফাঁকে ফাঁকেই বারকয়েক তাকিয়ে থাকতো মেয়েটার দিকে। লোকমুখে শুনেছে সে,মেয়েদের বিয়ে ঠিক হয়ে গেলে না-কি আল্লাহ প্রদত্ত তাদের রুপও না-কি বেড়ে যায় কয়েকগুণ। আজ যেন সে-ই কথাটাই সত্যি মনে হচ্ছে কুহেলির কাছে। এ-ই যে অরিনটাকে কি সুন্দর একটা জীবন্ত পুতুলের মতো লাগছে।
মেয়েটার সচরাচর রুপ যেন আজ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। একবার তার দিকে তাকালে চোখ ফিরিয়ে আনাই যেন দায় হয়ে পড়েছে মেয়ে হয়েও। তাহলে রৌদ্র যখন ওকে দেখবে তখন কেমন করবে? মেয়েটার দিকে অপলক তাকিয়ে থাকবে নিশ্চয়ই! নাহ…আর ভাবতে পারলোনা কুহেলি। চোখফেটে কান্না পাচ্ছে তার। বুকটার কোথাও চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে কেন যেন। সে-ও তো স্বপ্ন দেখেছিলো এই দিনটার। স্বপ্ন দেখেছিলো ঐ সুদর্শন যুবকের বউ হবার।কিন্তু ভাগ্য কেনো তার সহায় হলোনা কে জানে! কুহেলি আর ভাবতে পারলোনা এসব।সে তৎক্ষনাৎ উঠে চলে গেলো অরিনের ঘর ছেড়ে। এদিকে অরিন পেছন থেকে বারকয়েক ডেকেছে তাকে কিন্তু মেয়েটা যেন শুনলোই না। সে চলে গেলো নিজের সিক্ত চোখদুটোকে লুকিয়ে।
এরইমধ্যে ঘটলো আরেক কান্ড! অরিনের চোখের ওপর বেশ সর্তকতার সাথে চতুর্থবারের মতো আইলাইনারের রেখা টানছিলো আহিরা। ঠিক তখনি পাশ থেকে সজোরে হাঁচি দিয়ে বসে ছোট্ট রিমি। ঘটনার হতবিহ্বলতায় আহিরার হকচকিয়ে ওঠে খানিকটা। কিন্তু তার হাতের আইলাইনারটা চলে গেলো অরিনের এই চোখ থেকে ঐ চোখ বরাবর। তা দেখামাত্রই রুহির মাথাব্যথা উঠে গেলো হুট করে। সোহেলি ধুম করে কপাল চাপড়ে বসলো শব্দ করে। পাশ থেকে মাহিরা আর্তনাদ করে বলে ওঠলো,
“ আল্লাহ! এই নিয়ে পাঁচবার!”
আহিরা আহত চোখে তাকায় অরিনের বন্ধ নেত্রের পানে।অরিনটা চোখবুঁজে থেকেই মিটমিটিয়ে হাসছে। কিয়তক্ষন বাদে মেয়েটা বোধহয় নিজের পেট ফেটে আসা হাসিগুলোকে আর ধরে রাখতে পারলোনা। সে তৎক্ষনাৎ পেট চেপে হো হো করে হেসে ওঠে।হাসতে হাসতেই গা এলিয়ে দেয় বিছানায়। এদিকে বাকি সবাই বসে আছে চিন্তিত মুখে। প্রায় মিনিট তিনেক পর অরিন কোনমতে নিজের হাসি থামালো। বিছানা থেকে নামতে নামতেই বললো,
“ বসো! আমি মুখ ধুয়ে আসছি।”
এই নিয়ে পঞ্চমবারের মতো ধৈর্য্যের পরিক্ষা দিলো মেয়েটা। সে ধীরপায়ে উঠে চলে গেলো ওয়াশরুমের দিকে। তার চলে যাবার প্রায় মিনিট দুয়েক পরেই ঘরে এসে উপস্থিত হয় রৌদ্র। হাতে একগাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে। সে ঘরের দরজার কাছে গা হেলিয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীর মুখে সকলের উদ্দেশ্যে বললো,
“ বের হ সবাই।”
মুহুর্তেই সকলের চোখ গেলো দরজার দিকে। রুহি তখন ভাইকে দেখে বলে ওঠে,
“ কিন্তু ভাইয়া..অরিকে তো এখনো..”
তার কথা শেষ হবার আগেই হাতের ইশারায় তাকে থামিয়ে দিলো রৌদ্র। গম্ভীর মুখে বললো,
“ আমি সাজাবো ওকে! তোরা বাইরে দাঁড়িয়ে পাহারা দে যেন কেউ ভেতরে না আসে।”
এহেন কথায় মুহুর্তেই চমকে তাকালো সকলে।রৌদ্র ভাই সাজাবে মানে? সে-কি আর বউ সাজাতে পারে? কিভাবে সাজাবে সে? এহেন হাজারো ভাবনা কিলবিল করছে সকলের মাথায়।তবুও কেউ আগ বাড়িয়ে কিছু বলবার সাহস পেলোনা। সকলেই মাথানিচু করে ধীরে ধীরে চলে গেলো ঘরের বাইরে। রৌদ্র তখন ঘরে ঢুকেই দরজাটা ঠাস করে ভেতর থেকে লাগিয়ে দিলো। আর বাইরে পড়ে রইলো হতবিহ্বল মেয়েগুলো!
অরিন ভেজা মুখটা তোয়ালে দিয়ে মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে আসে। কিন্তু ওয়াশরুম থেকে বেরোতেই সে যেন আকাশ থেকে পড়লো! একি ঘরের মানুষজন কোথায়? আর ঘরটা ভেতর থেকেইবা লাগালো কে? অরিন ভ্রু কুঁচকে এগিয়ে আসে বিছানার কাছে।তখনি তার দৃষ্টি গেলো বিছানার ওপর সারিবদ্ধ করে রাখা কতকগুলাে শপিং ব্যাগ! অরিন কপাল কুঁচকে সেগুলো এক এক করে খুলতে লাগলো। প্রথম ব্যাগটা খুলতেই সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটা অলিভ রঙের জামদানী শাড়ি। অরিন আলতো করে হাত ছোঁয়ালো সেই শাড়ির গায়ে। পরক্ষণেই সে হাত বাড়িয়ে খুলে দেখলো ২য় ব্যাগটা।সেখান থেকে বেরিয়ে এলো একটা হলুদ রঙের চুনরি।যার পাড়ে সোনালি কারুকার্যে খোঁচিত লিখে রাখা,
❝ ইফতেখার এহসান রৌদ্রের বউজান❞
লেখাটা পড়তেই আনমনে এক চিলতে হাসি ফুটে ওঠে অরিনের ঠোঁটের কোণে। সে তৎক্ষনাৎ বুকে জড়িয়ে ধরে চুনরিটা। গলা উঁচিয়ে বলে ওঠে,
“ আর লুকিয়ে লাভ কি ডাক্তার সাহেব? সামনে আসুন।”
কথাটা শোনামাত্রই রৌদ্র বেরিয়ে আসে বারান্দা থেকে। বারান্দার দরজায় গা হেলিয়ে দু’হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়ালো ছেলেটা। তার অনিমেষ চোখদুটো অরিনের পানে নিবদ্ধ। অরিন নিজের দৃষ্টি নামিয়ে আনে।বুকের মাঝ হতে চুনরিটা দু’হাতে উঠিয়ে আনে নিজের মাথার ওপর। তারপর রৌদ্রকে দেখিয়ে বলে,
“ কেমন লাগছে আমায়?”
রৌদ্র মুগ্ধ হাসলো। ছেলেটার চোখেমুখে এক অদ্ভুত পরিতৃপ্তির লক্ষ্মণ। সে কিয়তক্ষন একদৃষ্টিতে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে থেকে বললো,
“ আমার সানশাইনের মতো!”
অরিন মেকি গাল ফোলায় তৎক্ষনাৎ। বলে,
“ সানশাইন বেশি সুন্দর? না-কি আমি বেশি সুন্দর!”
রৌদ্র কিছু বললোনা, হাসলো শুধু। সে মুহুর্ত ব্যায়ে কদম বাড়িয়ে এগিয়ে আসে মেয়েটার কাছে। তার হাতদুটো টেনে নিয়ে যায় ড্রেসিং টেবিলের সামনে। তারপর মেয়েটাকে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে পেছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরে, প্রায় বেশ কিছুটা নিচু হয়ে তারই কাঁধে মুখ রাখলো রৌদ্র। ফিসফিসিয়ে বললো,
“ তুমিই দেখে নাও,কে বেশি সুন্দর!”
অরিন আয়নায় চোখ রাখলো।দেখলো তাকে পেছন থেকে জড়িয়ে রাখা মানুষটাকে। মুগ্ধ হেসে বললো,
“ কে বেশি সুন্দর জানিনা,তবে আমার চোখে আমার ডাক্তার সাহেবই সবচেয়ে বেশি সুন্দর!”
কথাটা শুনতে পেয়েই চট করে মেয়েটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলো রৌদ্র। তারপর মেয়েটার কোমর চেপে তাকে নিজের কাছে টেনে এনে হাস্কি স্বরে বললো,
“ ঘন ঘন প্রশংসা করো না বউজান। কেননা তোমার প্রশংসা পেয়ে দিনকে দিন নিজের অন্যরুপ গুলো দেখাতে ভিষণ ইচ্ছে করে।”
অরিন মুচকি হাসলো। রৌদ্রের বুকের ওপর হাত উঠিয়ে আনলো আলতো করে। ধীমী স্বরে বললো,
“ আর তো একটা রাত! এরপর নাহয় আপনাকে সব রুপেই দেখবো আমি!”
রৌদ্র চোখ সরু করলো এবার। কন্ঠ খাদে নামিয়ে বললল,
“ তখন আবার ভয় পাবে নাতো?”
অরিন কিছুক্ষণ চুপ থেকে পরক্ষণেই শান্ত কন্ঠে বলে ওঠে,
“ ভয় পেলে আমার ডাক্তার সাহেবকে বলবো।তারপর তিনি আপনাকে ভয় দেখিয়ে দিবে আমার হয়ে!”
“ সে আমার কি’বা করতে পারবে হানি?”
অরিন ঠোঁট কামড়ে ধরলো নিজের। কিছুক্ষণ কিছু একটা ভেবে আবারও বললো,
“ কিছু করতে পারুক আর বা না পারুক, তার বউজানকে কষ্ট দেবার জন্য আপনাকে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শাস্তিটা দিয়ে দিবে!”
রৌদ্র থামলো একমুহূর্তের জন্য। ভ্রু উঁচিয়ে সন্দিহান গলায় জিজ্ঞেস করলো,
সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৫
“ আর সেটা কি?”
অরিন মাথা রাখলো রৌদ্রের বুকে। ধরে আসা কন্ঠে বললো,
“ তার বউজানকে নিয়ে যাবে আপনার কাছ থেকে।”
এহেন কথা শোনামাত্রই মুখের আদল শক্ত হয়ে গেলো রৌদ্রের।সে তৎক্ষনাৎ শক্ত হাতে চেপে ধরে অরিনের ঘাড়। মেয়েটাকে নিজের বুক থেকে উঠিয়ে রাগে গজগজ করতে করতে সে বলে ওঠে,
“ একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তোকে আমার কাছ থেকে আর কেউ আলাদা করতে পারবেনা সানশাইন। কেউ না! এমনকি তুই নিজে থেকে চাইলেও না!”