সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৭

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৭
Jannatul Firdaus Mithila

“ একমাত্র মৃত্যু ছাড়া তোকে আমার কাছ থেকে আর কেউ আলাদা করতে পারবেনা সানশাইন। কেউ না! এমনকি তুই নিজে থেকে চাইলেও না!”
অরিন ককিয়ে উঠে মৃদু ব্যাথায়।ছলছল চোখে তাকায় রৌদ্রের দিকে। রৌদ্রের হুট করেই কি হলো জানে! সে মেয়েটার ছলছল চোখজোড়া দেখতে পেয়েই তৎক্ষনাৎ ঘাড় ছেড়ে দিলো মেয়েটার। অপরাধী সুরে পরপর অস্থির হয়ে বলতে লাগলো,

“ সরি! সরি জানবাচ্চা।আমি..আসলে..!”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে পারলোনা রৌদ্র। হয়তো গলার কাছটায় কথাগুলো আঁটকে গিয়েছে কোনরকমে। অরিন মৃদু নাক টানে। গাল ফুলিয়ে বলে,
“ আপনি ভিষণ পঁচা ডাক্তার সাহেব! আজ আমার গায়ে হলুদ, তবুও আপনি আমায় ব্যাথা দিলেন?”
এইবার যেন অপরাধবোধে বিদ্ধ হয়ে যাচ্ছে রৌদ্র। তার চোখদুটোতেও যে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে তা।রৌদ্র কিছুটা সময় নিয়ে অরিনের ছোট্ট দেহখানা নিজের সঙ্গে চেপে ধরলো।মেয়েটার মাথায় পরপর কয়েকটা শুকনো চুমু খেয়ে নরম কন্ঠে শুধালো,

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“ সরি না জানবাচ্চা! আর হবে না।প্রমিস!”
অরিন আলতো হাসলো। রৌদ্রের বুক থেকে মাথা উঠিয়ে তাকালো ছেলেটার চোখের দিকে। মিষ্টি হেসে বললো সে,
“ নিচে যাবেন না?”
রৌদ্র ডানে-বামে মাথা নাড়ায়। অরিন ভ্রু কুঁচকায় তা দেখে। রৌদ্র কিছুক্ষণ নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে রইলো মেয়েটার দিকে। অরিনের গালের ওপর এসে আছড়ে পড়া অবাধ্য চুলগুলো যেন বড্ড অমায়িক ঠেকছে এমুহূর্তে। রৌদ্র আলতো করে আঙুল ছুঁইয়ে দিলো অরিনের মসৃণ গালে। তারপর ধীরে ধীরে অবাধ্য চুলগুলোকে আলগোছে গুঁজে দিলো মেয়েটার কানের পিঠে। অরিন মুচকি হাসছে। দৃষ্টি তার নত হয়ে এসেছে সে-ই কবে! রৌদ্র এবার সময় নিয়ে ধীর কন্ঠে আওড়ালো,

“ আগে তোকে সাজিয়ে দেই বউজান! তারপর আমার বউজানকে আমি নিজে নিয়ে যাবো নিচে।কেমন?”
অরিন যেন ভিষণ অবাক হলো এরূপ বাক্যে।সে হতবাক নয়নে রৌদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। হতবাক কন্ঠ ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো,
“ আপনি আমায় সাজাবেন? আপনি পারেন সাজাতে?”
রৌদ্র হাসলো ঠোঁট কামড়ে। মেয়েটার নরম গোলাপি অধরজোড়ার দিকে বেসামাল চোখে তাকিয়ে থেকে হাস্কি স্বরে বললো,

“ একবার পরিক্ষা করে দেখতে পারিস বউজান।”
অরিন ধীরে ধীরে নিজের মাথাটা পেছনে নিচ্ছে। রৌদ্রের মুখটা যেভাবে তার দিকে এগোচ্ছে এতে যেকোনো সময় যা কিছু হয়ে যেতে পারে,এ নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই মেয়েটার।এদিকে অরিনকে এভাবে পেছাতে দেখে ভ্রু দ্বয়ের মাঝে গোটাকয়েক ভাজঁ পড়লো রৌদ্রের।সে তৎক্ষনাৎ খেঁকিয়ে বলতে লাগলো,
“ সমস্যা কি তোর? এভাবে পেছাচ্ছিস কেনো?”
অরিন তৎক্ষনাৎ নিজেকে ছাড়িয়ে নেয় রৌদ্রের বাহুডোর থেকে। দু-কদম পিছিয়ে যেতে যেতে অনুনয়ের সুরে বলে,
“ এখন এসব না প্লিজ!”

রৌদ্র শুনলো না সেই কথা।মেয়েটার কথাগুলোকে একপ্রকার চুলোয় চড়িয়ে সে এগিয়ে আসতে লাগলো কদম বাড়িয়ে।রৌদ্র যত এগোচ্ছে, ততই পেছাচ্ছে অরিন। মেয়েটার এহেন হাবভাবে ভিষণ বিরক্ত হলো রৌদ্র। সে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের বিগড়ে যাওয়া মেজাজটা ধরে রাখলো কোনরকম। কোমরের ওপর দু’হাত চেপে অরিনের দিকে তাকালো শক্ত চোখে। অরিন ক্ষনে ক্ষনে শুকনো ঢোক গিলছে। রৌদ্র তখন মনে মনে হয়তো ভাবলো কিছু একটা। পরমুহূর্তেই তার ঠোঁটের কোণে স্পষ্ট দেখা মিললো এক চিলতে বাঁকা হাসির। সে আগের ন্যায় গম্ভীর মুখভঙ্গি ধরে রেখে সন্দিষ্ট কন্ঠে বললো,

“ কাছে আসবি না তুই?”
অরিন দু’ধারে মাথা নাড়ায়। তা দেখে যদিওবা চটে যাওয়ার কথা রৌদ্রের তবুও আশ্চর্যজনকভাবে ছেলেটা মোটেও চটলোনা।বরঞ্চ মেয়েটার দিকে তাকিয়ে একটা ঠান্ডা হাসি দিয়ে বললো,
“ ওকে ফাইন! আয় তোকে রেডি করে দেই।”
অতপর খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে অরিন কাঁপা কাঁপা পায়ে গিয়ে বসলো বিছানার ওপর। দু’পা তার নিচে ঝুলিয়ে রাখা। রৌদ্র মিনিট খানেকের মতো মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। তারপর কোনরূপ বলা কওয়া ছাড়াই নিজের পরনের শার্টের বোতামগুলো খুলতে লাগলো একেক করে।অরিন তা দেখামাত্রই চমকে উঠে। বসা ছেড়ে দাঁড়িয়ে ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে বলে ওঠে,

“ আপনি শার্ট খুলছেন কেনো?”
রৌদ্র নিশ্চুপ! তার ব্যস্ত হাত ইতোমধ্যেই খুলে ফেলেছে শার্টের সবক’টা বোতাম। মুহুর্তেই অরিনের সম্মুখে উম্মুক্ত হলো রৌদ্রের লোমহীন পেটানো দেহখানা। অরিন ভ্যাবলার মতো একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রৌদ্রের পেটে দৃশ্যমান হয়ে থাকা ছয়টি পেশিবহুল ভাঁজের দিকে। মেয়েটা দিনকে দিন কেমন নির্লজ্জ হয়ে যাচ্ছে! তার তো উচিৎ এমুহূর্তে নিজের দৃষ্টিকে একপ্রকার টেনেহিঁচড়ে হলেও সরিয়ে ফেলা রৌদ্রের দেহ থেকে, কিন্তু নাহ! মেয়েটার বেহায়া চোখদুটো যেন আরও কয়েকধাপ বেহায়া হবার প্রতিযোগিতায় নেমেছে এখন।রৌদ্র মেয়েটার দৃষ্টি দেখে বাঁকা হাসলো। হাত বাড়িয়ে গা থেকে আলগোছে খুলে ফেললো সম্পূর্ণ শার্টটা।

পরক্ষণেই উম্মুক্ত হলো রৌদ্রের চওড়া কাঁধ এবং কাঁধ বেয়ে নেমে যাওয়া পেশিবহুল বাহুদ্বয়। রৌদ্র তার হাতের শার্টটা বিছানার ওপর ছুড়ে ফেলে। মেয়েটাকে দেখিয়ে ইচ্ছে করে নিজের লোমহীন চওড়া বক্ষে হাত বুলাতে থাকে। অরিন ভীষনভাবে চাইছে তার চোখদুটো সরিয়ে আনতে ছেলেটার ওপর থেকে কিন্তু নাহ! তার নির্লজ্জ চোখদুটো আজ যেন আর কোনো বাঁধাই মানছে না। রৌদ্র এবার ঘটালো আরেক কান্ড। সে ইচ্ছে করে নিজের পরনের ঢিলেঢালা ঘিয়ে রঙা ট্রাউজারটা নামিয়ে দিলো নাভি থেকে প্রায় খানিকটা নিচে। অরিনের যেন এমুহূর্তে নিশ্বাস আঁটকে আসার উপক্রম! মেয়েটা বারকয়েক শুকনো ঢোক গিলে ফেলেছে ইতোমধ্যে। রৌদ্র খানিকটা দুষ্ট হেসে কদম বাড়িয়ে এগিয়ে এলো মেয়েটার কাছে। অরিন এখনো তার দিকে চেয়ে আছে নেশালো চোখে।রৌদ্র আলতো করে মেয়েটার গালে হাত ছোঁয়ায়। বাঁকা হেসে বলে ওঠে,

“ একচুয়েলি, কেন যেন ভিষণ গরম লাগছে হানি! তাই শার্টটা খুলে ফেললাম। তোমার কোনো সমস্যা নেই তো?”
অরিনের একবার ইচ্ছে হলো, সে মুখ ঝামটি দিয়ে বলবে — হ্যা! ভিষণ সমস্যা হচ্ছে। আপনি জানেন না সেটা? আপনি বোঝেন না,আপনাকে এভাবে শার্টলেস দেখলে আমার নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগে! না-কি জেনে-বুঝে ইচ্ছে করেই এমনটা করেন?
কিন্তু নাহ।মনের মাঝে উত্থাপিত হওয়া এহেন শক্ত কথাগুলো গলা অব্দি এসেই আঁটকে গেলো তার।মেয়েটা কত করে চাইলো কথাগুলো বলে দিতে কিন্তু পারলোই না! আজ যেন তার কন্ঠটাও তার সঙ্গে গাদ্দারি করে বসেছে একপ্রকার! রৌদ্র কিছুটা সময় নিয়ে বিছানার ওপর পড়ে থাকা শাড়িটা হাতে তুলে নেয়। শাড়িটার ভাজঁ খুলতে খুলতেই অরিনকে বলে বসে,

“ বিছানার ওপর উঠে দাঁড়া!”
অনিক ভড়কে যায় এরূপ বাক্যে।এই লোক কি এখন নিজ হাতে তাকে শাড়ি পড়িয়ে দিতে চাইছে? অরিন নিজের মনে ওঠা প্রশ্নটা ঠোঁটের আগায় নিয়ে এলো তৎক্ষনাৎ। সন্দিহান গলায় বললো,
“ আপনি পড়িয়ে দিবেন শাড়ি?”
রৌদ্র শাড়িটা খুলে নিয়ে আশেপাশে একবার নজর বোলালো। তারপর রাশভারি কন্ঠে বললো,
“ এই ঘরে যেহেতু তুই আর আমি ছাড়া কেউ নেই, সেহেতু শাড়িটা নিশ্চয়ই অন্য কেউ এসে পড়িয়ে দিবেনা।”
এহেন সোজাসাপটা উত্তরে দমে গেলো অরিন। তবুও মেয়েটা রৌদ্রের এরূপ প্রস্তাব একপ্রকার নাকোচ করে দিয়ে, শাড়িটা রৌদ্রের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে বলে,

“ দিন আমি পরে নিচ্ছি!”
রৌদ্র চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। কন্ঠে একপ্রকার শ্লেষাত্মক ভাব ধরে জিজ্ঞেস করে,
“ তুই শাড়ি পড়তে পারিস?”
এপর্যায়ে মিইয়ে গেলো বেচারি অরিন। সত্যি তো! সে কি আর শাড়ি পড়তে জানে? শাড়ি পড়তে গেলেই তো রাজ্যের কষ্ট পোহাতে হয় তার। সেই দুঃখে মেয়েটা কোনোদিন যেচে পড়ে শাড়ি পড়তেই চায়নি! কিন্তু আজ যেন নিজের এহেন কান্ডে বড্ড বিরক্ত অরিন। কি এমন হতো একটু-আধটু শাড়ি পড়া শিখে নিলে? অরিন শাড়িটা হাতে নিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো। রৌদ্র মেয়েটার হাত থেকে শাড়িটা কেঁড়ে নিয়ে দুষ্ট কন্ঠে আওড়ালো,
“ আমি শুধু খুলতে নয়..বরং পড়াতেও জানি হানি!”
এহেন কথায় তৎক্ষনাৎ হতভম্ব চোখে তাকায় অরিন। রৌদ্র আবারও ঠোটঁ কামড়ে ধরলো নিজের। বাঁকা হেসে বললো,
“ শাড়ির কথা বলেছি হানি!”

অরিন এবার হাসফাস করতে লাগলো লজ্জায়। এই লোক আজ তাকে নির্ঘাত পাগল করে ছাড়বে।হয় তার এহেন ডাবল মিনিং কথা দিয়ে নয়তো তার বেসামাল কান্ড-কারখানা দিয়ে। এদিকে অরিন যখন নিজ ভাবনায় নিমগ্ন তখনি রৌদ্র এগিয়ে আসে আরেকটু। হাত বাড়িয়ে মেয়েটার কাঁধের ওপরে পড়ে থাকা আঁচলটা ধরতেই নড়েচড়ে উঠে অরিন।খপ করে চেপে ধরে রৌদ্রের হাত। রৌদ্র স্মিত হাসলো। অরিনের হাতটা নিজের হাতের ওপর থেকে আলগোছে সরিয়ে দিয়ে বলতে লাগলো,
“ অভ্যাস করতে দে সানশাইন! এখন থেকে তো রোজ এমন হবে!”

অরিন ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে।হাতদুটো তার খপ করে চেপে ধরেছে শাড়ির একাংশ। রৌদ্র আর সাত-পাঁচ না ভেবে আলগোছে মেয়েটার কাঁধ হতে শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে দিলো। মুহুর্তেই এক অদ্ভুত লাজুকতা ঘিরে ধরলো মেয়েটাকে। পাদু’টো যেন তার অসার হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। নিশ্বাস ফেলার গতিও যে বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কাঁচা হলুদ রঙের শাড়ির আচঁল সরিয়ে দিতেই যেন উঁকি দিলো নারী দেহের অনাবৃত সৌন্দর্যের এক কোমল আভা। রৌদ্র থমকায়। তার আবেশিত চোখজোড়া যেন আঁটকে গেছে মেয়েটার এহেন অনাবৃত সৌন্দর্যের ভাঁজে। রৌদ্র টের পেলো তার হৃৎস্পন্দনের গতি অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে গিয়েছে। গলাটাও শুকিয়ে কাঠ প্রায়! রৌদ্র ঘামছে কেন যেন! সে কি নিজের হাতে নিজেকে খুন করার অস্ত্র চালালো? সে কি করে ভুলে গেলো?

তার সামনে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা যে কোনো সাধারণ মেয়ে নয়।এ যে তাকে হাসিমুখে মেরে ফেলার একমাত্র অস্ত্র! রৌদ্র বারকয়েক শুকনো ঢোক গিললো পরপর। শুকনো অধরজোড়া জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো খানিকটা। অতঃপর কাঁপা কাঁপা বা-হাতটা তার ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো মেয়েটার মসৃণ উদরের ধারে।সেথায় তার আঙুলের হালকা পরশ লাগতেই কেঁপে ওঠে অরিন।রৌদ্র থামলো একমুহূর্তের জন্য। লম্বা একটা শ্বাস টেনে নিজেকে সামলে নিলো বহুকষ্টে।

তারপর কোনরূপ ভনিতা ছাড়াই মেয়েটার শাড়ির কুঁচিগুলো একটানে খুলে দিলো রৌদ্র। অরিন তৎক্ষনাৎ চোখমুখ কুঁচকে ফেলে। খোলা হাওয়ায় দুলতে থাকা কচি কলমিলতার ন্যায় লজ্জায় টলমল করতে লাগলো মেয়েটা। তার অসাড় হয়ে আসা ক্ষুদ্র বদনখানি কাঁপতে কাঁপতে যেইনা পড়ে যেতে নিবে ওমনি একজোড়া শক্তপোক্ত হাত এসে আগলে নিলো তাকে। রৌদ্রের প্রশস্ত বুকে লজ্জায় মূর্ছা পড়া মেয়েটা কেমন গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে! রৌদ্র আলতো করে মেয়েটাকে বুকে চেপে ধরলো।বেশ কিছুটা সময় একইভাবে দাঁড়িয়ে রইলো দু’জন। পরক্ষণেই রৌদ্র সামান্য মুচকি হেসে বললো,

“ এইভাবে আমার বুকে পড়ে থাকলে আমি কিন্তু নিজেকে খুব একটা কন্ট্রোল করে রাখতে পারবোনা সানশাইন।”
অরিন তৎক্ষনাৎ সরে দাঁড়ায় রৌদ্রের বুক থেকে। মাথাটা নিচু করে রেখেই লজ্জালু কন্ঠে বলে,
“ দয়া করে এসমস্ত কথা বলবেন না প্লিজ!”
রৌদ্র হাসলো খানিকটা।তারপর ফ্লোরে পড়ে থাকা অলিভ রঙের শাড়িটার পাড় ধরে ধীরে ধীরে পড়াতে লাগলো মেয়েটাকে। অরিন মনোযোগ দিয়ে দেখছে রৌদ্রের কান্ড। ছেলেটা কেমন মনোযোগ সহকারে শাড়ি পড়িয়ে দিচ্ছে তাকে। কুঁচিগুলোও দিচ্ছে একদম প্রফেশনালদের মতো। অরিন অবাক হলো বেশ। সে কেমন আশ্চর্যান্বিত কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,

“ আপনি এতো সুন্দর করে শাড়ি পড়াতে জানলেন কীভাবে?”
রৌদ্র শাড়ির কুঁচিগুলো ভাজ করতে করতেই দৃঢ়স্বরে উত্তর দিলো,
“ কাল সারারাত বসে শাড়ি পড়ানো,মেকআপ করানোর টিউটোরিয়াল ভিডিও দেখে শিখেছি।”
এহেন উত্তর পেয়ে অরিন কি হাসবে না-কি কাঁদবে এ নিয়ে পড়ে গেলো মহা বিপাকে। তার প্রতি ছেলেটার পাগলামি যেন দিনকে দিন বেড়েই যাচ্ছে। অরিন মুগ্ধ হাসলো। তার মুখের আদলে হুট করেই ছেয়ে গেলো একরাশ মুগ্ধতা। সে হাত উঠিয়ে আলতো করে রাখলো রৌদ্রের গালের ওপর। রৌদ্র থামলো একমুহূর্তের জন্য।নিজ গালের ওপর মেয়েটার হাতটা খানিক চেপে ধরে মুখের সামনে এনে সেথায় আলতো করে চুমু খেলো ছেলেটা। নরম কন্ঠে বললো,
“ কিছু বলবে?”
অরিন মাথা ঝাকায়। চমৎকার হেসে বলে,
“ ভালোবাসি!”
রৌদ্র মুচকি হাসলো। হুট করে মেয়েটার ঠোঁটের ওপর টুপ করে একটা চুমু বসিয়ে ফিসফিস করে বললো,
“ ভালোবাসি টু!”

শখ করে বউ সাজাতে বসেছে বেচারা রৌদ্র! বেচারা কিভাবে হলো এইতো ভাবনা? রৌদ্র সে-ই কখন থেকে মেয়েটাকে ড্রেসিং টেবিলের আয়নার সামনে বসিয়ে রেখেছে। একবার মাথার সবগুলো চুলে ক্লিপ বেধে খোঁপা বাঁধছে, তো আরেকবার চুলগুলোকে বিনুনি গাঁথছে। তবুও ছেলেটার কোনোটাতেই সন্তুষ্টি মিলছে না। তার এককথা — অরিনকে আজ এতো সুন্দর লাগা যাবেনা! বলাতো যায় না.. মেয়েটার এহেন রুপ দেখে আশেপাশের মানুষজন মনে মনে কি না কি ভেবে বসে! ভুল করেও যদি কোনো ছেলে এসে বলে বসে — বউ তো খুব সুন্দর! তাহলেই তো বিয়ে বাড়িতে বাঁধবে কুরুক্ষেত্র। পাগল ছেলেটা কি আর ছেড়ে কথা বলবে কাউকে?
সুন্দরী বউকে নিয়ে রাজ্যের টেনশন এসে হানা দিচ্ছে রৌদ্রের মাথায়।অবশেষে ছেলেটা হাল ছাড়লো।দ্রুত কদম বাড়িয়ে চলে এলো মেয়েটার সামনে। অরিন মিটমিটিয়ে হাসছে। বেশ হয়েছে! আর সাজাতে আসবে তাকে? হুহ্!
রৌদ্র মেয়েটার পায়ের কাছে হাঁটু মুড়ে বসলো।অরিনের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা নিশ্বাস ফেললো সে। চিন্তিত মুখে অবশেষে বললো,

“ এতো সুন্দর লাগছে কেনো তোকে জানবাচ্চা?”
অরিন এবার খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। কিয়তক্ষন বাদেই মেয়েটা এগিয়ে এসে রৌদ্রের কপাল বরাবর ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে,
“ আপনি এতো ভালোবাসছেন যে তাই!”
রৌদ্র ভ্রু গোটায়। উত্তরে নাখোশ হয়ে বলে,
“ এভাবে তোকে যেতে দিবোনা আমি।”
অরিন চুপচাপ বসে ভাবলো কিছু একটা। পরক্ষণেই কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে ওঠে,
“ একটা কাজ করলে কি-হয়?”
রৌদ্র উদাস মুখেই খামখেয়ালি ভাবে জিজ্ঞেস করে,
“ কি?”

অরিন তৎক্ষনাৎ বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। দৌড়ে চলে যায় নিজের আলমারির কাছে। সেখান থেকে কিছু একটা খুঁজে নিয়ে আবারও চলে আসে রৌদ্রের কাছে। রৌদ্র মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে ফ্লোরে। তার চোখদুটো অরিনের দিকেই নিবদ্ধ। অরিন হাসিমুখে হাত বাড়িয়ে একটা হিজাব দিলো রৌদ্রের কাছে। বললো,
“ শাড়ির সাথে হিজাব পড়ে নেই? তাহলেই তো হলো!”
রৌদ্র কিছুক্ষণ চুপচাপ তাকিয়ে রইলো হিজাবটার দিকে।পরক্ষণেই ঠোঁটের কোণে আলতো হাসির রেশ টেনে বলে,
“ ঠিক আছে। আয় পড়িয়ে দেই।”

“ এখানে দাঁড়িয়ে কি করছিস তোরা? অরি কোথায়? অরিকে সাজাতে যাসনি?”
রাফিয়া বেগমের চোটপাটে দমে গেলো সকলে।এই ভয়টাই তো পাচ্ছিলো সবাই। বাড়ির বড়রা একবার এদিকের খবরা-খবর টের পেলে যে কেলেঙ্কারি ঘটাবে তাতো পূর্বে থেকেই জানা কথা! এদিকে সবাইকে ওমন ভুত দেখার মতো থমথমে হয়ে থাকতে দেখে রাফিয়া বেগম চটলেন খানিকটা। ওদিকে সবাই বসে আছে বউয়ের জন্য, আর এরা কি-না ঢং করছে দাঁড়িয়ে থেকে।রাফিয়া বেগম ভ্রু কুঁচকে কিছু বলতেই যাবেন ওমনি শব্দ এলো অরিনের ঘরের দরজা খোলার। রাফিয়া বেগমসহ সকলেই তাকালেন সেদিকে। পরক্ষণেই অরিনকে দেখতে পেয়ে সবার এতো এতো অপেক্ষার তিক্ততা যেন নিমিষেই মিলিয়ে গেলো হাওয়ায়।

রাফিয়া বেগম যেন কথা হারিয়ে ফেললেন মুহুর্তেই। শুধু কি তিনিই হারিয়ে ফেলেছেন কথা? এদিকে বাদবাকি মানুষগুলোও যেন পলক ফেলতে ভুলে গিয়েছে একপ্রকার। অলিভ রঙের জামদানী শাড়িটা বাঙালি আটপৌরে ধরনে জড়ানো মেয়েটার গায়ে। হাতে শোভা পাচ্ছে সিল্ক সুতোয় বোনা হেন্ডমেড চুরি। সেই সাথে গোলাপের তৈরি গাজরা ঝুলছে দু’হাতে। মাথা চেপেছে সেম কালারের হিজাব। হিজাবের ওপর দিয়েই মাথা বরাবর বসিয়েছে গোলাপ ফুলের ক্রাউন। মুখে তেমন কোনো আলগা প্রসাধনীর ছাপ নেই বললেই চলে। শুধু চোখে পড়েছে কাজলের চিকন রেখা,তারওপর টেনেছে আইলাইনারের সরু রেখা।ঠোঁটে ঘষেছে ন্যুড কালারের লিপস্টিক।মেয়েটার হিজাবের ওপর দিয়েই মাথায় পড়িয়ে রেখেছে চুনরিটা।রাফিয়া বেগম ঘুরে ঘুরে দেখছেন মেয়েকে। কিয়তক্ষন বাদেই তিনি কেমন হতবাক সুরে বললেন,

“ এই শাড়ি কে দিলো তোকে? আর এই চুনরিটাই বা পেলি কোথায়? আর বাকি ফুলের…. ”
“ আমি এনেছি এসব।”
রাফিয়া বেগমের কথার মাঝপথেই অরিনের পেছন থেকে গম্ভীর কন্ঠে কথাটা বলে ওঠে রৌদ্র। রাফিয়া বেগম তড়াক চোখে সেদিকে তাকালেন।রৌদ্রকে অরিনের ঘর থেকে বেরোতে দেখেই একে-একে দুই মিলিয়ে বুঝে ফেললেন অনেককিছু। পরমুহূর্তেই তার চোখেমুখে ছেয়ে গেলো কিছু অপ্রত্যাশিত লজ্জা। তিনি কেমন থমথমে মুখে এলোমেলো দৃষ্টি ফেললেন আশেপাশে। পরক্ষণেই রুহিকে ডেকে বললেন,
“ ওকে নিয়ে আয় মা।আমি নিচে যাচ্ছি!”

কথাটা বলেই রাফিয়া বেগম পারেননা ছুটে পালাতে সেখান থেকে। তিনি যেতেই রুহি এবং বাকি মেয়েরা মিলে অরিনের হাতদুটো ধরে এগোতে লাগলো। অরিন এক-কদম সামনে এগোতেই পরক্ষণে কি যেন একটা ভেবে আবারও পেছনে ফিরলো।দেখলো রৌদ্র কেমন গা হেলিয়ে দু’হাত পকেটে গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে দরজা ঘেঁষে। তার অনিমেষ চোখজোড়া মেয়েটাতেই তাক করে রাখা। অরিন হাসলো একটুখানি। রৌদ্রের কাছে ছুটে এসে বললো,
“ আপনি যাবেন না?”
রৌদ্র মুচকি হাসলো। হাত বাড়িয়ে মেয়েটার ফোলা ফোলা টসটসে ডান গালটা আলতো করে টেনে দিয়ে দুষ্ট হেসে বললো,

“ রেডি না হ’য়ে কিভাবে যাবো হানি? তোমাকে যেমন সুন্দর লাগছে, তোমার হাজবেন্ডকেও তো তোমার মতোই সুন্দর লাগতে হবে তাই-না? নাহলে তো মানুষ মুখ বাকিয়ে বলবে —আহারে! এতো সুন্দর মাইয়াডার কপালে এমন একটা ভোতাঁ জামাই জুটলো!”
রৌদ্রের এহেন নাটকীয় ভঙ্গিতে কথাবলা দেখে খিলখিল করে হেসে ওঠে বাকি মেয়েরা। অরিনও তাই। আহিরা আবারও এগিয়ে এসে অরিনকে নিয়ে হাঁটা ধরলো।অরিনও আর থামলোনা।চলে গেলো সকলের সঙ্গে। এদিকে অরিন যেতেই রৌদ্রের মুখভঙ্গি পরিবর্তন হয়ে গেলো মুহুর্তেই। সে দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ঘাড় ডলতে লাগলো।বিরবির করে কি যেন একটা বলতে লাগলো ছেলেটা। ঠিক তক্ষুনি গটগট পায়ে দোতলায় ছুটে আসে অনিক আর রেহান। অনিক রৌদ্রকে এভাবে শক্ত মুখে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেই হকচকিয়ে ওঠে খানিকটা। অস্থির গলায় বলে,

“ কি হয়েছে ভাইয়া? তুমি হঠাৎ মেসেজ দিয়ে ইমার্জেন্সি আসতে বললে যে।”
রৌদ্র চোখ খুললো। রেহান ভড়কে গেলো ছেলেটার রক্তবর্ণ চোখদুটো দেখে। সে তৎক্ষনাৎ জিজ্ঞেস করে বসে,
“ কি হয়েছে তোর? খুলে বল আমাদের।”
রৌদ্র এহেন কথার প্রতিত্তোরে তেমন কিছু না বলে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে লাগলো,
“ অনিক! স্টে এলার্ট! আজ আমার বউজানের যেভাবে ইচ্ছে ও সেভাবেই আনন্দ ফুর্তি করবে।তুই শুধু খেয়াল রাখবি অনুষ্ঠানে উপস্থিত কোনো মাই’কা লাল যেন আমার বউয়ের দিকে কুদৃষ্টিতে না তাকায়। আর যদি তাকায়ও তাহলে আমাকে জাস্ট ইনফর্ম করবি।বাকিটা আমি সামলে নিবো।”
এরূপ নিরব ধমকিতে চিন্তায় পড়লো রেহান,অনিক।রেহান আগ বাড়িয়ে উপদেশের সুরে বললো,

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৬

“ ভাই মাথা ঠান্ডা কর।আজকের দিন নাহয়…!”
“ তোকে যা বলেছি তা কর।বাকিটা দেখার দায়িত্ব আমার।যা! ”
অগত্যা এহেন কথায় চুপসে যায় রেহান।বলার মতো আর কিছু না পেয়ে চলে গেলো সেখান থেকে।

সঙ্গীন হৃদয়ানুভুতি ২য় খন্ড পর্ব ৬৭ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here