লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৪
Fatima Fariyal
সেই দুপুরের পর থেকেই নিজেকে ঘরবন্দী করে রেখেছে রিদিতা। জানালার পর্দা টানা, ঘরের বাতাস ভারী আর নিস্তব্ধ। ঘড়ির টিকটিক শব্দটা ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। কান্না করতে করতে ক্লান্ত হয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল, সে নিজেও জানে না। হঠাৎ দরজায় ঠকঠক শব্দে ঘুম ভাঙলো তার। প্রথমে বুঝতেই পারলো না কোথায় আছে, কী হচ্ছে। ধড়ফড় করে উঠে বসলো। চোখ ঘষে কিছুটা সময় নিলো নিজেকে ঠিক করতে। মাথা ঝাঁকিয়ে নিলো কয়েকবার, তারপর দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো সাড়ে পাঁচটা বাজে।
বাইরে দিনের আলো মলিন হয়ে এসেছে, জানালার ফাঁক গলে কমলা রঙের আলো ঘরে ঢুকে তার ক্লান্ত মুখে পড়ছে। টেবিলে পড়ে থাকা ফোনের জলন্ত স্ক্রিনে চোখ পড়তেই মনে পড়ে দুপুরের ঘটে যাওয়া সবকিছু। বুকের ভিতরটা আবারো টনটন করে উঠলো, ঠোঁট শক্ত হয়ে গেলো, চোখ জোড়া ছলছল করছে। ঠিক তখনই দরজায় আবার ঠক ঠক শব্দ। রিদি ভারী শরীরটা টেনে নিয়ে দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই ঈশানী ঢুকে পড়লো তড়িঘড়ি করে, হাতে কয়েকটা শাড়ি। বিছানার উপর শাড়িগুলো এক এক করে ছড়িয়ে দিলো। অতঃপর রিদির দিকে তাকিয়ে কাঁপা গলায় বললো,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“এগুলার মধ্যে একটা পছন্দ কর, আব্বু বলছে দ্রুত রেডি হইতে। ফ্রেস হয়ে আয় আমি শাড়ি পরিয়ে দিচ্ছি।”
রিদি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুধু তাকিয়ে রইলো। তার চোখে কোনো চাহনি নেই, যেন পুরো পৃথিবীর প্রতি অরুচি। তবুও ধীরে ধীরে ঠোঁট নেড়ে বললো,
“আমি কোথাও যাবো না, শাড়িও পরবো না।”
ঈশানী একটু থেমে বিছানায় বসলো বোনের মুখোমুখি হয়ে। অতঃপর কোমল কণ্ঠে বললো,
“রিদি, কেনো পাগলামো করছিস! আবেগে গা ভাসিয়ে দিলে পরে কষ্ট তোরই হবে। তুই ভালো করেই জানিস, আব্বু কখনোই আহাদ রাজার সাথে তোর সম্পর্ক মেনে নিবে না। বরং আরও ঝামেলা হবে এসব নিয়ে।”
রিদির চোখ জ্বলে উঠলো। কণ্ঠে রাগ আর কষ্টের মিশ্র সুর,
“তাহলে কি করতে বলছো আমাকে?”
ঈশানী হালকা নিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“আমি কিছুই বলছি না। তবে আমার মনে হয়, ওই উগ্র, বদমেজাজি, লাগামহীন আহাদ রাজার চেয়ে আদনান মীর অনেক ভালো। একজন ডাক্তার, শান্ত-শিষ্ট, পরিপাটি, সব দিক দিয়ে পারফেক্ট!”
রিদি এবার ঠোঁট শক্ত করে ফেললো। চোখে আগুন, গলায় এক রকম জেদ মিশিয়ে বললো,
“আমার পারফেক্টের দরকার নাই। আমার ওই বদমেজাজি, লাগামহীন শ্যামবর্ণের উগ্র আহাদ রাজাকেই লাগবে। আমি আদনান মীরকে কিছুতেই বিয়ে করবো না।”
ঈশানীর মুখের রঙ ফ্যাকাসে হয়ে গেলো। সে বুঝতে পারছে, তার বোন কাঁটা বিছানো পথে হাটছে। তবুও সে বোনকে বোঝানোর চেষ্টা করলো,
“দেখ রিদি, তুই এখন আবেগের বশে এসব বলছিস। কিন্তু ভেবে দেখ, আহাদ রাজার নিজের জীবনেরই কোন নিশ্চয়তা নাই। সে তোর খেয়াল কী রাখবে? আর সব থেকে বড় কথা, তুই কি জানিস আহাদ রাজা তোকে ভালবাসে কি না?”
প্রশ্নটা বিদ্যুতের মতো বিঁধলো রিদির মনে। সত্যিই তো! আহাদ রাজা তো কখনোই বলেনি, তাকে ভালোবাসে!
তাহলে সে কেনো এতো পাগলামি করছে তার জন্য।
আজকে তো সে অনেকবার কলও দিয়েছে। কই, সে তো রিসিভ করলো না! আর কল ব্যাকও তো করলো না।
আর যদি ভালো নাই বাসে, তাহলে এতোদিন যে তার পিছু পিছু ঘুরেছে, তাকে জানু বলে সম্বোদন করেছে, সেগুলো কি ছিলো? তার গভীর ভাবনার মাঝে ঈশানী আবারও প্রশ্ন করলো,
“কি হলো, এখন চুপ করে আছিস কেনো? আহাদ রাজা তোকে ভালোবাসে?”
রিদি জ্বিব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিলো, আমতা আমতা করে বললো,
“ব… বাসে মনে হয়।”
ঈশানী তাছিল্যের হাসি দিয়ে বললো,
“মনে হয়? মানে তুই জানিস না! আহাদ রাজা তোকে ভালোবাসে কিনা সেটাই জানিস না। অথচ তার জন্য পাগলামি করছিস?”
রিদি সরাসরি বোনের চোখ দৃষ্টি গেঁথে দিয় অদ্ভুত গলায় বললো,
“পাগল না হলে কি ভালোবাসা যায়?”
“কিন্তু আহাদ রাজা তো তোকে ভালোবাসে না!”
“বললাম তো বাসে!”
রিদি এবার গলায় জেদ মিশিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো। কথাটা বলেই সে মুখ ফিরিয়ে নিলো, চোখে পানি জমেছে, বুকটা অদ্ভুত ভাবে ভারী লাগছে। ঈশানী কপাল গুছিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে আবার শান্ত কন্ঠে বললো,
“এসব ভাঁওতাবাজি কথাবার্তা আমার সাথে বলবি না। জীবন সিনেমা না রিদি। যা হয়েছে, ভুলে যা। আদনানকে বিয়ে করে নে, আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যাবে।”
রিদি ঠোঁট বাঁকিয়ে হালকা হাসলো, কিন্তু সেই হাসি বিষাদমাখা। চোখে চোখ রেখে বললো,
“ভুলে যাবো? ভুলে যাওয়া কি এতই সহজ? যদি তাই হয়, তাহলে তুমি জোবান ভাইকে এখনো ভুলতে পারলে না কেনো?”
ঈশানী মূহুর্তেই পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখ দুটো ছলছল করে উঠলো। রিদি তার বুকের সবচেয়ে গভীর ক্ষতটা ছুঁয়ে দিয়েছে। কিন্তু রিদির মুখে কোনো অনুশোচনার ছাঁপ নেই। শুধু নীরব জেদ। ঈশানী ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নিয়ে ভারী ঢোক গিলে দৃঢ় কন্ঠে বললো,
“আমি আমার অতীত ভুলে গেছি, রিদি। সেগুলো খুঁচিয়ে সামনে আনার চেষ্টা করিস না। তুই বড় হয়েছিস, ভালো-মন্দ বোঝার বয়স হয়েছে। নিজের ভালো চাইলে আব্বু-আম্মুর পছন্দ মতো আদনানকে বিয়ে করে নে।”
রিদি নিজের সিদ্ধান্তে অটল রইল, ঠোঁট চেপে বললো,
“আমি কিছুতেই আদনানকে বিয়ে করবো না।”
ঈশানীর এবার রেগে গেলো, এক রকম জোরেই বললো,
“কোন ধাতু দিয়ে গড়া তুই? এতক্ষণ কি বুঝিয়েছি তোকে আমি?”
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বললো,
“ঠিক আছে, তুই বিয়ে করতে না চাইলে আব্বুকে গিয়ে বল। আমি আর এসবের মধ্যে নাই।”
ঈশানীর চিৎকারে দরজায় এসে উঁকি দিলেন তারেক রায়ান। চোখেমুখে একটু বিরক্তি, তবুও শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন,
“কি হয়েছে তোমাদের? চেঁচামেচি করছো কেনো?”
রিদি তখন বিছানায় বসে আছে নিথর হয়ে। চুল এলোমেলো, ঠোঁট কামড়ে ধরে রেখেছে যেন নিজেকে সংযত করছে। ঈশানী একপলক বোনের দিকে তাকিয়ে আবার বাবার দিকে ফিরে একটু বিরক্তি মেশানো স্বরে বললো,
“তোমার মেয়ে শাড়ি পরতে চাইছে না।”
তারেক রায়ান রিদির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বললেন,
“ঠিক আছে ও পরতে না চাইলে দরকার নেই। ওর যেটা কমফোর্টেবল, ওটা-ই পরুক। শাড়িই পরতে হবে এমন তো না।”
এই বলে তিনি ধীরে দরজা টেনে চলে যায়, আর তখনই ঘরে ঢোকে তানভীর। এক লাফে বিছানার উপর উঠে হালকা কাত হয়ে বসে। শাড়িগুলোকে নেড়েচেড়ে রিদির দিকে তাকিয়ে ঠাট্টার স্বরে বললো,
“ঈশানীপু, কেনো ওরে জোর করছিস শাড়ি পরতে? পেত্নীরা কী কখোনো শাড়ি পরে? শাড়ি তো পরে নারীরা, ও তো আস্ত একটা পেত্নী। এজন্যই তো শাড়ি পরতে চাইছে না।”
রিদি তানভীরের দিকে কটমট করে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,
“তানভীররর! আমার চোখের সামনে থেকে যা! তা না হলে থাপ্পড়ায়া তোর চেহারার নকশা পাল্টায়া দিবো!”
তানভীর ধড়ফড় করে উঠে রিদির সামনে এসে গাল পেতে দিলো,
“তাহলে দেনা না! অনেকদিন ধরে একটা মেয়েকে পটানোর চেষ্টা করতেছি, পটতছে না। বলে সাদা হলেও নাকি আমার চেহারা খারাপ। সার্জারি করতে তো অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার আছে। একটু চেহারাটা পাল্টায়া দে না বইন।”
রিদির চোখ রাগে জ্বলে উঠলো। কোনো আগাম ইঙ্গিত ছাড়াই সপাটে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো তানভীরের গালে। তানভীরের মুখ থেকে অবচেতনভাবে বেরিয়ে আসলো চাপা আর্তনাদের শব্দ,
“আহহহহ!”
ঘরে মুহূর্তেই নিস্তব্ধতা নেমে এলো। তানভীর টলমল করে একটু কাত হয়ে গেলো, গালে হাত দিয়ে চোখে বড় বড় তাকিয়ে রইলো। ঈশানীও বিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। মজার ছলে বলেছে বলে রিদি এমনটা করবে তারা কল্পনাও করেনি। তানভীর মুখ বাঁকিয়ে গালে হাত ঘষে কাঁদো কাঁদো গলায় বললো,
“ঈশানীপু! তোর বোন নাকি ভাত খায় না? এতো শক্তি কী শুধু বাতাস খেয়েই বানাইছে! আউউচ… আমার দাঁত নড়ে গেছে মনে হয়।”
রিদি তীক্ষ্ণ চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে। অতঃপর বিছানা থেকে একটা নেভি ব্লুর উপর রুপালী সুতোর কাজের শাড়ি তুলে নিয়ে ধপধপ করে পা ফেলে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো। দরজাটা এমনভাবে বন্ধ করলো, যেন সেই শব্দে জমে থাকা রাগ গলে বেরিয়ে আসছে। তানভীর মুখ বাঁকিয়ে ঈশানীর দিকে তাকিয়ে মৃদু গলায় বললো,
“তোর বোন আসলেই একটা পেত্নী। আমি যাই, না হলে এবার সত্যি সত্যি আমার চেহারা পাল্টায়া দিবে।”
এই বলে গাল ঘষতে ঘষতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো।
ঈশানী তখনও থ মেরে বসে আছে, কারন সে জানে রিদি একা শাড়ি পরতে পারবে না। আর হলোও তাই, কিছুক্ষণ পরই ওয়াশরুমের দরজা খুলে এলোমেলো শাড়ির আঁচল পেঁচিয়ে বেরিয়ে এলো। মুখে গভীর অস্থিরতা। ঈশানী দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীরে ধীরে তার কাছে গিয়ে যায়। কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে শাড়িটা ঠিক করে দিলো, পিঠের পিনগুলো লাগিয়ে, চুল ঠিক করে দিলো। তারপর হালকা মেকআপ করে সাজিয়ে দেয়। রিদি ঘুরে আয়নার নিজের প্রতিবিম্বের দিকে তাকিয়ে একটা ভাড়ী নিশ্বাষ ছাড়ে। ঈশানী সেদিকে তাকিয়ে নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তুই তো বললি, শাড়ি পরবি না, যাবি না। তাহলে হঠাৎ কি মনে করে রাজি হলি?”
রিদি আয়নার ভেতরেই বোনের দিকে তাকায়, ঠোঁটের কোণে একরাশ রহস্যময় হাসি ফুটে উঠলো। মুখে কিছুই বললো না। ঈশানী তার বোনের সেই হাসিটা দেখেই বুঝে গেলো তার মনে কিছু একটা চলছে, খুব গভীর কিছু। কিন্তু সেও আর কিছু বললো না। শুধু মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। রিদি তখনও আয়নায় নিজের চোখের দিকে তাকিয়ে রইলো। ঠোঁটে মৃদু ব্যথার ছোঁয়া, চোখে জেদ, মনে অদ্ভুত এক দৃঢ়তা নিয়ে বিড়বিড় করে বললো,
“আমিও তো দেখি, আমার বিয়ের খবরে আপনার উপর কেমন আঁচড় পরে মন্ত্রী ম শা ই!”
সন্ধ্যা নামতেই শহরের বুক জুড়ে ল্যাম্পপোস্টের আলো যেন নক্ষত্রের মতো ঝলমল করে জ্বলে উঠলো। ঢাকার রাস্তাগুলো তখনো ব্যস্ত, তবু একটা ক্লান্তির ছাঁয়া নেমে এসেছে শহরের বাতাসে। সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত সন্ধ্যা। এই সময়েই সংসদ ভবনের উঁচু গেট দিয়ে বেরিয়ে এলেন আমজাদ মীর আর তার পাশে আহাদ রাজা। সভার আলোচনায় ক্লান্ত মুখ, তবু দুজনের পদক্ষেপ দৃঢ়। বাইরে পা রাখতেই ফ্ল্যাশলাইটের ঝলকানিতে চোখ প্রায় ঝলসে গেল আহাদের। সাংবাদিকদের ক্যামেরার লাইট চারদিকে দিনের মতো আলোকিত করে দিলো। তাদের একটার পর একটা প্রশ্ন, আমজাদ মীর ঠান্ডা মাথায় অভ্যস্ত ভঙ্গিতে সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছেন। পাশেই আহাদ চোখে হালকা বিরক্তি আর অবসন্ন ক্লান্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সাংবাদিকদের আলোয় চোখ ঢেকে ফেলতে কালো চশমাটা পরে নিলো সে। গার্ডরা এসে ভিড় ঠেলে দুজনকে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। গাড়ির দরজা খোলার মুহূর্তে, আহাদ অচেতনভাবে ফোনটা হাতে নিতেই চোখে পরলো রিদিতার সাতটা মিসড কল, সাথে আসফাক মীরের দুইটা মিসড কল। আহাদ এক সেকেন্ডের জন্য থমকে গেল। দু’আঙুলে একটু কপাল চুলকে নিয়ে ঘাড় টাকে দু দিকে ঘুড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করলো বিড়বিড় করে,
“মিস জানু এতোগুলো কল দিয়েছে কেনো?”
ফোনের দিকে তাকিয়ে একরাশ ভাবনায় ডুবে যায় আহাদ। এক অদ্ভুত উদ্বেগের ঢেউ বয়ে গেলো বুকের ভেতর। কিন্তুু হঠাৎ কাঁধে স্পর্শ পেতেই চমকে উঠে ভাবনার জগত থেকে ফিরে আসে বাস্তবতায়। আবারও সাংবাদিকরা তাদের ঘিরে কিছু প্রশ্ন করে, আর আহাদ মুখে নির্লিপ্ত ভঙ্গি এনে সরাসরি সব প্রশ্নের উওর দেয়। এমন সময় হাতে থাক ফোনটা কেঁপে উঠলো, আহাদ কথা বন্ধ করে ফোনের দিকে তাকাতেই দেখে আসফাক মীরের কল। সে আঙুল দিয়ে সামনে থাকা সাংবাদিকদের ইশারা করে একটু সরে আসে। ফোন রিসিভ করতেই ওপাস থেকে আসফাক মীরের কড়া কন্ঠ স্বর ভেসে আসলো,
“কোথায় তুই? কতবার কল দিছি, রিসিভ করিস নাই কেনো?”
আহাদ ঠোঁট চেপে, সুরে হালকা তির্যকতা এনে বললো,
“হানিমুনে ছিলাম তো! কিভাবে রিসিভ করবো?”
“ফালতু কথা বন্ধ কর, আহাদ! এখনই বাসায় আয়, তা না হলে হানিমুনে যাওয়ার টিকেট হাত ফসকে যাবে।”
আহাদ হতভম্ব হয়ে বললো,
“মানে! কি বলছো তুমি? বুঝিয়ে বলো!”
“এতো কিছু বলার সময় নাই। দ্রুত বাসায় আয়!”
এরপরই লাইন কেটে গেল। আহাদ স্থির দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, এরপর ফুঁ দেয়ার মতো করে একটা নিশ্বাষ ছেড়ে এগিয়ে যায়। বাবার কানে কানে কিছু একটা বলে দ্রুত সেখান থেকে বেড়িয়ে আসে। সময় তখন আনুমানিক সাতটা পঁয়তাল্লিশ। মীর হাউজের সামনে এসে গাড়ি থামতেই আহাদ গাড়ি থেকে গটগট শব্দ করে ভেতরে ঢুকলো। মূল দরজার কাছে চাচাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার পা ধীর হয়ে আসে। কাছে গিয়ে ভ্রু কুচঁকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি ব্যাপার মুখটা এমন পোটকা মাছের মতো করে রেখেছো কেনো?
আসফাক মীর একটু অপ্রস্তুত হয়ে দু’বার গলা খাঁকড়ি দিয়ে চোখের ইশারা করলেন ড্রইংরুমের দিকে। আহাদ চাচার দৃষ্টি লক্ষ্য করে কপাল গুছিয়ে নিয়ে তাকায় সেদিকে। এক মূহুর্তে তার রুপ পরিবর্তন হয়ে গেলো। সেখানে একই সোফায় পাশাপাশি বসে আছে আদনান আর রিদিতা। যদিও তাদের মাঝখানে বেশ ভালোই দূরুত্ব আছে। তবুও এই দৃশ্য সহ্য হলো না আহাদের, যেনো বিষাক্ত কাঁটার মতো বিধঁলো চোখে। তার ভেতরে র’ক্ত যেনো টগবগ করে ফুঁটে উঠলো। দেহের প্রতেকটা শিড়া ভেসে উঠেছে, হাত শক্ত করে মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিলো। চোখ দু’টো যেনো শয়ং অগ্নি শিখা। তার এই রুপ দেখে আসফাক মীর অজানা ভ’য়ে কেঁপে উঠলো। চারপাশে কারা আছে বা কি হচ্ছে সেটার কোন পরোয়া করলো না আহাদ। ঝড়ের বেগে সেদিকে এগিয়ে যায়। আহাদকে দেখে আদনানের মুখে একটা বাঁকা হাসি ফুঁটে উঠলো।
রিদি তখনও আহাদকে খেয়াল করেনি, নিচের দিকে তাকিয়ে আঙুলে আঙুল গুঁজে ধরে বসে আছে। কিন্তু হঠাৎ তার সামনে একজোড়া পা দেখে চমকে মাথা তোলে। আর তখনই দৃষ্টি পরে আহাদের জলন্ত চোখের দিকে। তার চোখের দৃষ্টি এতোটাই তীক্ষ্ণ আর ভ’য়ং’ক’র ছিলো, যে রিদির গলা শুকিয়ে আসে। একটা ঢোক গিলতে নিয়েও পারলো না, গলা খুশ খুশ করে কেঁশে উঠলো। আদনান এক গ্লাস শরবত নিয়ে রিদির দিকে বাড়িয়ে ধরে, রিদি অবেচেতন ভাবেই হাত বাড়িয়ে সেটা নিতে যায়। আর তখনই আহাদ এক ঝটকায় গ্লাসটা নিয়ে ছুড়ে মারে মেঝেতে। চূর্ণবিচূর্ণ কাঁচের শব্দে হলঘরের সবাই চমকে উঠলো। রিদি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে পরে, তার সমস্ত শরীর বরফের ন্যায় ঠাণ্ডা হয়ে গেলো। হাত পা অনবরত কাঁপছে। আহাদ এক কদম তার দিকে এগিয়ে আসতেই, মাঝখানে আদনান বাধ সেজে দাঁড়ায় রিদিকে আড়াল করে। এতে আহাদ আরো ক্ষীপ্ত হয়ে যায়। চোয়াল শক্ত করে রিদির তাকিয়ে কর্কশ গলায় বললো,
“রিদিইইই… সামনে আসো!”
আদনান কিছুই বললো না, কেবল স্থির হয়ে রিদিকে তার পিঠের আড়াল করে দাঁড়িয়ে রইলো। আহাদ এবার সিংহের মতো গর্জে উঠলো,
“আদনান, সরে যা আমার সামনে থেকে!”
তার কণ্ঠ এমন তীব্র ছিল যে, দেয়াল পর্যন্ত কেঁপে উঠলো।
কিন্তু আদনান নড়লো না বরং ঠোঁটে একটুকরো হাসি খেলে গেল। সেই হাসিটাই যেন আগুনে ঘি ঢেলে দিলো আহাদের ভিতরে। সে এক ঝটকায় আদনানের কলার ধরে টেনে এনে ঘু’ষি বসিয়ে দিলো মুখ বরাবর। সাথে সাথে হল ঘরে বসে থাকা রিদির পুরো পরিবার দাঁড়িয়ে যায়। আহিয়া আর ঈশানী একটু দৌড়ে এগিয়ে যায় রিদিতার কাছে। রিদি তখনো কাঁপছে। আহাদ আবারো হাত তোলে, তখনই আসফাক মীর এসে বাধা দেয় তাকে। আহাদ ঝটকা মেরে তাকে সরিয়ে দিয়ে আবারও এক ঘু’ষি বসিয়ে দেয়। রিদির চোখের সামনে সব কেমন ঝাপসা হয়ে গেল। তার কান ঝিমঝিম করছে, নিঃশ্বাস আটকে যাচ্ছে। আফরোজা শেখ চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে ধমকে উঠলেন,
“এসব কী তামাশা করছো? এটা বাড়ি, তোমার রাজনীতির এটা মাঠ না। মারামরি করতে হলে বাড়ির বাইরে গিয়ে করো।”
আহাদ দাঁতে দাঁত চেপে কটমট করে মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওরে এখানেই জ্যান্ত পুতে দিব আমি, আম্মাআআ!”
“কেনো? ওর অপরাধ কী? কি করেছে ও? তোমার কোন সূতা ধরে টান দিয়েছে।”
“সূতা না আম্মা…, ও আমার কলিজা ধরে টান দিছে!”
এই কথা শুনে পুরো ঘরে এক অদ্ভুত নিস্তব্ধতা নেমে এলো।
সবাই তাকিয়ে আছে আহাদের দিকে, তার চোখে রাগ আর যন্ত্রণা একসাথে। আফরোজা শেখ আবারও ধমকে উঠলেন,
“কি যা তা বলছো? ছাড়ো আদনানকে।”
আদনান ঝটকা মেরে আহাদের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। তার ঠোঁটে তখনও বাঁকা হাসি লেগে আছে, হাতের উল্টোপিঠ দ্বারা নিজের ঠোঁটের র’ক্ত মুছে নেয়। আহাদ এবার ঘাড় কাত করে তাকায় রিদির দিকে। আহাদের ভয়ার্ত দৃষ্টি দেখে আতঙ্কে এক পা পিছিয়ে যায় রিদি। আর আহাদ কয়েক পা এগিয়ে আসে তার দিকে। রিদির নাজুক শরীর কাঁপছে, হাতের তালু ঘামছে, আহাদ আরো এক পা এগোতেই রিদির আর তার সামনে বাদ সেজে দাঁড়ায় তারেক রায়ান। আহাদ বিরক্ত হয়ে ভ্রু উঁচিয়ে তাকায় তারেক রায়ানের দিকে। দুজনের মুখমোখি হওয়াতে হলঘরে এক থমথমে পরিবেশের সৃষ্টি হয়। তারেক রায়ান সরাসরি আহাদের দিকে তাকিয়ে ঠাণ্ডা অথচ গম্ভীর গলায় বললেন,
“আমার মেয়ের কাছ থেকে দূরে থাকবেন, মিস্টার আহাদ। আমার মেয়ে এসব ঝগড়া-মারামারি ভ’য় পায়।”
এই কথা বলেই সে একবার তাকালো রিদিতার দিকে। আহাদ রাগ্বনীত্ব হয়ে এক আঙুল উঁচিয়ে কিছু একটা বলতে যায়।তখনই পাশ থেকে আসফাক মীর এসে তার হাত নামিয়ে কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন,
“কি করছিস আহাদ! নিজেকে সংযত রাখ। এটা রিদিতার বাবা, উল্টাপাল্টা কিছু করিস না।”
আহাদ ফুঁস করে ভিতর থেকে একটা নিশ্বাষ ছেড়ে রাগ ঝাড়ার চেষ্টা করছিলো। মাথা ঝাঁকিয়ে নিয়ে এক ঝলক তাকালো গুটিয়ে যাওয়া নিজের প্রেয়সীর দিকে। তার চোখে ছিলো এক অজানা ব্যথা, আর অপার ক্ষোভ, হাত শক্ত করে মুষ্ঠিবদ্ধ করে নিয়ে গটগট করে সিঁড়ি বেয়ে উপরে চলে গেলো। তার পিছুপিছু ছুটলো আসফাক মীর। এক মুহূর্ত নীরবতার পর উপর তলা থেকে ভাঙচুরের বিকট আওয়াজ ভেসে আসে। ভাঙচুরের শব্দ এতটাই তীব্র ছিল, যে পুরো বাড়িটা কেঁপে উঠলো। তার সাথে সাথে হলঘরে বসে থাকা প্রত্যেকেও কেঁপে ওঠে। রিদি অনায়াসে চোখ বুজে নেয়, তার চোখের কোণে পানি ছলছল করে উঠে। ভিতরে অসহ্যনীয় যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছ সে, অথচ কেউ সেটা বুঝলো ও না।
আহাদ নিজের রুমে এসেই তুলকালাম শুরু করে। তার নিঃশ্বাসের তীব্র গতি আর শরীরের প্রতিটা স্নায়ু যেন রাগে জ্বলে উঠেছে। এক নিমিষেই সাজানো রুমটাকে পরিণত করলো ধ্বংসস্তূপে। আসফাক মীর দরজার কাছে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে দেখছিল এতক্ষন। এবার কাছে এসে শান্ত করার চেষ্টা করছে,
“আহাদ রিলেক্স! শান্ত হ, কি করছিস।”
আহাদ এবার আরো তেঁতে যায়। শক্ত করে হাত মুষ্ঠিবদ্ধ করে সামনে থাকা বড় আয়নায় এক ঘু’ষি বসিয়ে দেয়, আর সাথে সাথেই আয়নার কাঁচ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আহাদের হাত থেকে র’ক্ত টপটপ করে পরছে মেঝেতে। আহাদ সেটার পরোয়া না করে গর্জে উঠলো,
“আমাকে শান্ত থাকতে বলছো? আমাকে?!”
আসফাক মীর এগিয়ে এসে ধরতে গেলেন তার হাত।
কিন্তু আহাদ সেই হাত ঝটকা মেরে তাকে সরিয়ে দিয়ে হুংকার ছাড়ে,
“আমি সব ছাড়খাড় করে দিবো, সব!”
রাগে তার বুক উঠা নামা করছে, পায়ের কাছে পরে থাকা চেয়ারটাকে আবার লাথি মেরে দূরে সরিয়ে দিলো। আসফাক মীর এবার বিরক্ত হয়ে বললেন,
“তোর যা ইচ্ছা তাই কর। আমি নিচে গেলাম, তবে একটা কথা মাথায় রাখিস। তোর এমন আচরণের জন্যই কিন্তু তুই রিদিতাকে হারাবি।”
“চাচুউউউ!”
আসফাক মীর আর এক মূহুর্তও দেরি করলো না। বড় বড় পা ফেলে সেখান থেকে দ্রুত বেড়িয়ে এলো। আফরোজা শেখ এখনো অতিথিদের সামনে নিজের ভারসাম্য রাখার চেষ্টা করছেন। মুখে সৌজন্যের হাসি, কিন্তু ভেতরে একরাশ লজ্জা আর ক্লান্তি। অপরাধবোধ গলায় বললেন,
“আমার এই ছেলেটা একটু বদমেজাজি, কিছু মনে করবেন না প্লিজ! আসলে সব ভাই বোনের মধ্যে ওর রাগটা একটু বেশি, হুটহাট রেগে যায় আবার একটু পরে ঠিক হয়ে যায়। আপনারা এসব নিয়ে চিন্তা করবেন না। আদনান কিন্তু একদমই এরকম না।”
তারেক রায়ান হালকা হাসার চেষ্টা করে বললেন,
“জ্বি, আমরা আগে থেকেই আপনার ছেলের সম্পর্কে জানি। আর আদনানের সম্পর্কেও খোঁজ খবর নিয়েছি। আমাদের কোন আপত্তি নেই। আপনি বিয়ের কথাবার্তা এগোতে পারেন।”
এই কথায় আফরোজা শেখের চোখে ঝিলিক ফুটে উঠলো। এক মুহূর্তে তাঁর ক্লান্ত মুখে ফিরে এলো রাজকীয় প্রশান্তি। হালকা হেসে বলে উঠলেন,
“আলহামদুলিল্লাহ, তাহলে এবার তো মিষ্টি মুখ করাই যায়। হালিমা, বানি কে বলো মিষ্টি নিয়ে আসতে।”
হালিমা বেগম ধড়ফড়িয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে যায়।
চারদিকে আবার কথাবার্তা শুরু হলো, কিন্তু পরিবেশে একটা টান টান নীরবতা এখনো রয়ে গেছে। সবার মনেই লেগে আছে একটু আগে ঘটে যাওয়া ঝড়ের প্রতিধ্বনি। এই সময় আহিয়া এসে বসে রিদির পাশে, এতে রিদি একটু সরে বসলো। আহিয়া অবাক হয়ে রিদির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি হয়েছে তোর? আসার পর থেকে তুই আমার সাথে কথা বলছিস না কেনো?”
রিদি ঠোঁট চেপে ফিসফিস করে বলে উঠলো,
“কি কথা বলবো তোর সাথে! আজকে যা কিছু ঘটেছে, এসব কিছুর জন্য তুই দায়ী।”
আহিয়া বেশ খানিকটা অবাক হয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে বিস্ময়ের সাথে বললো,
“আমি কী করেছি!”
“তুই তোর মা কে বলেছিস, আমাকে যেনো আদনানের জন্য বউ করে আনে। তাই না?”
আহিয়ার ঠোঁট জোড়া ফাঁক হয়ে যায়, সে এক মূহুর্ত থম মেরে বসে থাকে। অতঃপর রিদির কানে ফিসফিস করে বললো,
“আজব, আমি যখন জানি তুই ভাইয়াকে ভালোবাসিস, তাহলে আমি আদনান ভাইয়ের কথা কেনো বলবো। বিশ্বাস কর রিদি! আমি আম্মুকে কিছুই বলি নাই।”
রিদি চোখে অবিশ্বাসের ছায়া নিয়ে তাকালো তার দিকে,
“সেদিন ও তো তুই আদনানের কথা বলেছিলি। আমি বিশ্বাস করি না।”
“আমি সত্যি বলছি, আম্মু নিজে থেকে আদনান ভাইয়ের জন্য তোকে পছন্দ করেছে। আর তাছাড়া আমি তো নিজেও জানতাম না, যে আদনান ভাইয়ের জন্য যে মেয়ের কথা বলছে সেটা তুই। আজকে তোকে দেখে আমিও অবাক হয়েছি।”
রিদি ভ্রু কুচঁকে আহিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার মুখের অভিব্যক্তি ধীরে ধীরে নরম হয়ে এলো, সে বুঝতে পারছে আহিয়া সত্যি বলছে। একটা গভীর নিশ্বাস নিয়ে নিচু গলায় বললো,
“আচ্ছা, ঠিক আছে। হয়েছে, আর বলতে হবে না।”
আহিয়া একটু স্বস্তি পেল, চোখ তুলে তাকাতে অনিচ্ছাকৃতভাবে দৃষ্টি আটকে গেল আদনানের দিকে। আদনান তখন তাদের দিকেই তাকিয়ে আছে। আহিয়া অস্বস্তিতে একটু নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসে। এমন সময় সিঁড়ির ধাপে পায়ের শব্দ হতেই ড্রয়িংরুমে বসা সবার চোখ ঘুরে যায় সেই দিকে। আহাদ কেমন নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে নেমে আসছে, হাতে ব্যান্ডেজ প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে। শেষ সিড়ির ধাপে পা রেখে সরাসরি তাকায় রিদির দিকে। হাতে থাকা ব্যান্ডেজ দাঁতের সাহায্যে গিট দিয়ে উঁচু গলায় ডেকে উঠলো,
“কোকো, সিরিয়াস!”
আহাদের ডাক শুনে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলো তার দুই পোষা কুকুর। আহাদ একটু ভঙ্গি করে এসে বসল ড্রয়িং রুমের এক কোনার সোফায়। টেবিল থেকে একটা লাল বল নিয়ে, পা দুটো টেবিলের উপর তুলে দিলো। এরপর একরকম খেলতে শুরু করে তার দুই পোষা প্রাণীর সাথে। একবার লাল বলটা ছুড়ে মারে দূরে, আর তার পোষা কুকুর দুটো দৌড়ে গিয়ে মুখে তুলে এনে আহাদের হাতে তুলে দেয়। তার এই অদ্ভুত ভঙ্গিমা আর খেলায় ড্রয়িংরুমের সবাই অবাক হয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। এইতো একটু আগেও কত তুলকালাম করলো অথচ এখন সম্পূর্ণ শান্ত! আহাদ এবার লাল বলটা ছুড়ে দিয়ে জোরে ঢেকে উঠালো,
“রিতুউউ.. রিতু।”
রিতু তাকাতেই আহাদ দু আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে কাছে ডাকলো। রিতু দ্রুত আহাদের সামনে এসে দাঁড়ায়। আহাদ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো আদনানের দিকে। অতঃপর হালকা হেসে বললো,
“বাড়িতে বিয়ে হচ্ছে, অথচ আমি মিষ্টি পেলাম না! যা মিষ্টি নিয়ে আয়। কুইক!”
“এখনি আনতেছি।”
এই বলেই দৌড়ে গিয়ে রান্নাঘর থেকে মিষ্টি নিয়ে এলো। আহাদ ঠোঁট কামড়ে মিষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ জোরে হেসে উঠলো। একটা উগ্র, অচেনা হাসি। আফরোজা শেখ ছেলের এমন অদ্ভুত কান্ডে বিরক্ত হলেন। জলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই আহাদ তার হাসি থামিয়ে দিল। এরপর একটা মিষ্টি তুলে নিয়ে, আদনানের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা আঙ্গুল দেখিয়ে রহস্যময় একটা হাসি দিয়ে বললো,
“বেস্ট অফ লাক, ভা ই য়া!”
আদনানের মুখ শক্ত হয়ে গেল। তার চোয়ালের পেশি টানটান। ভালোকরেই বুঝতে পারলো আহাদ ভিতরে ভিতরে কোন ষড়যন্ত্র করছে। আহদা এবার তার পোষা কুকুরের গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“তোরাও মিষ্টি মুখ করবি নাকি? হা কর, হা কর হা হা হাআআআ!”
আহাদের এসব কর্মকাণ্ডে উপস্তিত সবাই বিরক্ত হলো। তারেক রায়ান ধৈর্যের চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেল। তবুও নিজেকে সংযত করে শক্ত হয়ে বসে রইলেন। ফরিদা বেগম ও চুপচাপ বসে শুধু তাকিয়ে রইল। তবে তানভীর এর কাছে বিষয়টা খুব কৌতুহলী মনে হল। সে আহাদের ভাব ভঙ্গিতে মাঝে মাঝে হেসে ফেলে। রিদি আহাদের এই পরিবর্তনের কারণ বুঝতে পারল না, কেমন অস্থিরতা হলো তার। নিজেকে সামলাতে উঠে উপরের দিকে যেতে নেয়। তখন আফরোজা শেখ জিজ্ঞেস করলেন,
“কোথায় যাচ্ছ?”
“জ্ব জ্বি ওয়াশরুমে।”
তিনি সাথে সাথে আদনানের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“আদনান, রিদিতাকে উপরে নিয়ে যাও।”
আদনান বিরক্ত মুখে উঠে রিদিতাকে নিয়ে উপরে চলে যায়।
তারা করিডোর পার হতেই, আহাদ তড়াক করে উঠে দাঁড়ালো। সে ধীরে ধীরে তাদের পিছনেই সিঁড়ি ভাঙতে লাগলো, চোখে বিদ্রুপের হাসি। দুই কুকুর তার পেছনে ছুটলো। আদনান রিদিতাকে আহিয়ার রুমের কাছে রেখে নিজের রুমে চলে যায়। রিদি আহিয়ার রুমে গিয়ে একটু ফ্রেশ হয়ে কিছুক্ষণ পর আবার বেরিয়ে আসে। আর তখনই সামনে পরে আহাদের। রিদির বুকটা ধড়ফড় করে উঠে। একটা শুকনো ঢোক গিলে, আহাদ হালকা হেসে বিদ্রুপ মেশানো গলায় বললো,
“আমাকে ভয় পাচ্ছেন নাকি ভা বি জী!”
আহাদের মুখে ভাবি ডাক শুনে মূহুর্তই রিদির জগত উল্টে গেলো। সে কি ঠিক শুনছে? আহাদ রাজা তাকে ভাবি সম্বোদন করছে? রিদিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে আহাদ হাসলো আরও প্রশস্ত হয়ে, এবার একটু ঝুকে এসে দুই আঙুলে তুড়ি বাজিয়ে বললো,
“ভাবিজী, পুরুষ নারীর চোখের প্রেমে পড়ে, পুরুষ কিন্তু নারীর চুলের প্রেমে পড়ে, পুরুষ কিন্তু নারীর আঙ্গুলের মায়ায় পড়ে, পুরুষ কিন্তু নারীর ছাঁয়ারও মায়ায় পড়ে ভাবিজী! বাকি কথাগুলো নাই বললাম। সাবধান ভাবিজী, দেবর পড়ে যেতে পারে মায়ায়!”
তার কথা শুনে রিদি হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। এক বিন্দু পরিমাণ নড়ার শক্তিও যেন তার নেই। আহাদ পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করলো রিদিকে। রিদির মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ঠোঁটে এক চিলতে হাসি ফুঁটিয়ে বললো,
“বাই দ্যা ওয়ে, শাড়িটা সুন্দর! শাড়িটা মানিয়েছে আপনার শরীরে।”
এই বলে চোখ টিপে দিয়ে পাশ কাটিয়ে, রিদির গা ঘেঁষে চলে গেলো। রিদি পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আর তখনই পাশের রুম থেকে আদনান বেরিয়ে আসে। রিদিকে এভাবে থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে, এক মুহূর্তের দ্বিধা করে এগিয়ে যায় তার দিকে। কাছে এসে গম্ভীর গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“এনি প্রবলেম!”
রিদি চোখ তুলে তাকায় আদনানের দিকে। এই প্রথম আদনান কোন কথা বলছে তার সাথে। রিদি এক মূহুর্ত তাকিয়ে থাকে তার চোখের দিকে, বোঝার চেষ্টা করে আসলে তার জীবনের মোড় কোনদিকে ঘুরতে চলেছে। আদনান ভ্রু কুচঁকাতেই রিদি মাথা নেড়ে বললো,
লাল শাড়িতে প্রেয়সী পর্ব ২৩
“আ, ও, না, না কিছু না।”
“তাহলে এবার নিচে যাই?”
রিদি শুধু চোখের ইশারা করলো। এরপর দুজনেই কড়িডোর পেরিয়ে নিচের দিকে হাটা দিলো। দূর থেকে আহাদ সেদিকে তাকিয়ে, নিজের খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে একটা বাঁকা রহস্যময় হাসি দিলো।