সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫০

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫০
জাওয়াদ জামী

” তমাপু , দশ মিনিটে তৈরি হয়ে নাও। আমরা ডক্টরের কাছে যাবো। ” কুহু তাড়া দিল তমাকে।
” এই যে আমাকে সপ্তাহে তিনদিন তোমরা ডক্টরের কাছে নাও, এতে লাভ কি হয় বলো? শুধু শুধু টাকা নষ্ট করছো কেন? আর আমি কি অসুস্থ যে তোমরা আমাকে নিয়ম করে ডক্টরের কাছে নাও? ” তমা বিরস গলায় জিজ্ঞেস করল।
” তুমি অসুস্থ সেটা কে বলেছে? তোমাকে আমরা ডক্টরের কাছে নেই শুধুমাত্র তুমি যাতে সকলের সঙ্গে মন খুলে কথা বলো সেজন্য। তুমি তো আবার মুখ প্যাঁচার মত করে রাখতে ভালোবাসো। আমরা শুধু তোমার মুখে হাসি ফোটানোর চেষ্টা করছি। আর কোন কথা নয় । তোমাকে তৈরি হতে হবে। চল আমিই তোমাকে তৈরি করিয়ে দিচ্ছি। ”
তমাকে ঠেলে ওয়াশরুমে নিয়ে গেল কুহু৷

” তাহমিনা , আর কতদিন তোদের বাসায় থাকব? এবার তো আমাকে আমার বাসায় হবে। তিশা , সিয়ামও চাচ্ছে আমি খুব তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরি । ওরা নাকি কিছুদিনের মধ্যেই বেড়াতে আসবে। আমি এখন আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ। নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারছি, নিজের কাজ নিজেই করতে পারছি। আমাকে নিয়ে আর চিন্তা করতে হবে না তোদের। তাই আমি দুই-এক দিনের মধ্যেই বাসায় ফিরতো চাচ্ছি। ” তাসলিমা খানম বোনকে মানানোর চেষ্টা করছেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” আপা , আর কয়েকটা দিন থেকে যাও না। কতদিন পর তোমাকে দেখছি । তাই তোমাকে যেতে দিতে মন চাচ্ছে না। সিয়াম , তিশাকে এখানেই আসতে বলো। ওরা এবারের মত এখানে এসে উঠুক। পরেরবার নিজেদের বাসায় যাবে । ” তাহমিনা আক্তার বোনকে ছাড়তে চাইছেন না।
” গত ছয়মাস ধরে তোদের বাড়িতে আছি। আরও কয়েকটা দিন থাকতে বলছিস তুই আমাকে ! শোন, যখন সব ঝামেলা মিটেই গেছে তখন আর ভয় কি? এখন থেকে নিয়মিত আমরা দুই বোন যখন ইচ্ছে তখন দুই বাড়িতে বেড়াতে পারবো। আর তাছাড়া তমা তো এখানে থাকছেই । ও পুরো সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তাহমিদ ওকে যেতে দেবে না। তমাকে দেখতে মাঝেমধ্যে আমাদের এখানে আসতেই হবে। সিয়াম, তিশাও আসবে বলেছে। তাই আর আমাকে বাঁধা দিস না । ”

” ঠিক আছে , আপা। তোমার যেটা ভালো মনে হয় কর । আবার যে তোমাকে কাছে পেয়েছি এটাই আমার জন্য অনেক । তমাও আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ হয়েছে । মেয়েটাকে এখন দেখলে পাপের বোঝা কিছুটা হলেও হালকা হয়। সেদিন তমা বলছিল, ও বাড়িতে যেতে চায়। কিন্তু তাহমিদ ওকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়েছে। ”
” একজন মায়ের ভাগ্য কতটা ভালো হলে তাহমিদের মত ছেলে আর কুহুর মত ছেলের বউ পায় সে। দেশের প্রতিটা ঘরে ঘরে তাহমিদ আর কুহুর মত ছেলে আর ছেলের বউ হোক । ওদের জন্যই আজ আমার মেয়েটা সুস্থ হয়ে উঠছে। যেখানে আমরা ওর সুস্থ হওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলাম , সেখানে তাহমিদ আমাদের আশার আলো দেখিয়েছে । আর ধীরে ধীরে মেয়েটাকে সুস্থও করে তুলছে। তুই ধন্য এমন ছেলেকে জন্ম দিয়েছিস। ”
” ছেলে তো আরেকটাও জন্ম দিয়েছি , আপা । সে তো আমার মুখে চুনকালি মেখে দিলো। আজ তার নাম নিতেও ঘৃণা হয় আমার। একই গর্ভে তো জন্মেছে দু’জন। তবে দু’জনের মধ্যে এত তফাৎ কেন ? ”
তাহমিনাকে কাঁদতে দেখে তাকে জড়িয়ে ধরলেন তাসলিমা খানম। তিনি বোনকে শান্তনা দিতে থাকলেন।

” আন্টি , তেমন আতো ( কেমন আছো) ? ততন এতেতো ( কখন এসেছো)? আমাল দন্য তকেত এনেতো ( আমার জন্য চকলেট এনেছো) ? ”
আধো আধো গলা শুনে পেছনে তাকায় তমা। ছোট্ট একটা পরীকে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তার দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ছোট্ট পরীটাও তমার ইশারা পেয়ে দৌড়ে এসে তমাকে জড়িয়ে ধরল।
” আমি ভালো আছি , পুতুল সোনা । তুমি কেমন আছো ? আমি এখানে আসবো আর তোমার জন্য চকলেট আনব না , এটা হতেই পারে না। এই নাও তোমার চকলেট। ” তমা পার্স থেকে কয়েকটা চকলেট বের করে পরীটার হাতে দিলো।

” ফারজাহ , এসব কি হচ্ছে , পাপা ? তুমি উনাকে বিরক্ত করছ কেন ? মিলি , তুমি ফারজাহ কে চেম্বারে নিয়ে এসেছ কেন ? তোমাকে আগেও অনেকবার নিষেধ করেছি , ফারজাহ কে নিয়ে এদিকে আসবে না। ” মেয়েকে চেম্বারে আসতে দেখে একটু বিরক্তই হলো ডক্টর ফারদিন মাহমুদ।
” আমি অনেকবার ফারজাহ সোনাকে নিষেধ করেছি। আমার কথা শুনলোই না ও। ” মিলি মুখ কাঁচুমাচু করে বলল।
” রাগ করবেন না , আমিই ফারজাহ কে বলেছিলাম , আজকে আমি এখানে আসব। আসলে আপনি যেদিন চেম্বারে আসতে দেরি করেন , সেদিন আমি ফারজাহ সোনার সঙ্গে গল্প করি । ওর সঙ্গে গল্প করতে আমার বেশ লাগে। ” এবার মৃদুস্বরে কথাগুলো বলল তমা।

তমার কথা শুনে ডক্টর ফারদিন অবাক হয়ে গেছে। গত ছয়মাস যাবৎ তমা তার কাছে চিকিৎসা নিচ্ছে। মাঝেমধ্যেই তার চেম্বারে আসতে দেরি হয় । একটা ক্লিনিকে দুস্থ মানুষদের ফ্রিতে চিকিৎসা করে সে। মেডিকেল থেকে সরাসরি সেখানে যায়। সেখানে রোগী দেখে বাসায় ফিরে বিকেলে নিজের বাসার নিচতলায় চেম্বারে রোগী দেখে সে। চেম্বার বাসায় হওয়ায় ফারজাহ মাঝেমধ্যেই মিলির সঙ্গে এখানে আসে। যদিও সেটা ফারদিনের পছন্দ নয়। সে বারবার ফারজাহ কে নিষেধ করেছে। কিন্তু তার মেয়ে কথা শুনলে তো।

” কিন্তু চকলটের ব্যাপারটা ? ও নিশ্চয়ই আপনার কাছ থেকে চকলেট চেয়েছে? ” ফারদিন তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে তমার দিকে।
” মোটেও না । আমিই পুতুল সোনাকে বলেছিলাম , আজ আসবার সময় ওর জন্য চকলেট নিয়ে আসবো। কারও কাছ থেকে কিছু চেয়ে খাবে , তেমন মেয়েই নয় ও। ”
” আজ আপনার সঙ্গে কেউ আসেনি ? কাউকে দেখছি না যে। ” প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে জিজ্ঞেস করল ফারদিন।
” তাহমিদ এসেছে । পরিচিত একজনের সঙ্গে দেখা হওয়ায়, বাহিরেই তার সঙ্গে কথা বলছে তাহমিদ। চলে আসবে । ”
” এবার বলুন , মাথা ব্যথা এখনো হয় ? মাথা ঝিমঝিম করে মাঝেমধ্যে? আগের মত ভেতরের সেই অস্থিরতা এখনো অনুভব করেন? ”

” গত পনেরদিন আগে শেষবার মাথাব্যথা হয়েছিল। ঝিমঝিম ভাবও নেই। আর অস্থিরতা? না, আগের মত অনুভব করি না। মাঝেমধ্যে হালকা অস্থিরতা বুঝতে পারি। কিন্তু এখন আমি সেটাকে নিজেই সামলে নিতে পারি। ”
” গুড জব। এটাই তো চেয়েছিলাম। আপনার মনে আছে, প্রথম সাক্ষাতের দিন বলেছিলেন, নিজেকে চেনা বড্ড কঠিন ? এখনও কি তেমনটাই মনে হয়? ”
” না। এখন আর সেসব অবান্তর কথা মনেও আসে না । তবে মনে হয়, নিজেকে একটু একটু করে চিনতে শিখছি। ”
” চমৎকার। এটার কৃতিত্ব শুধু আপনার। ঔষধ আর কাউন্সেলিং শুধুমাত্র সাহায্য করেছে আপনাকে। আসল কাজটা আপনি নিজে করেছেন। ”

” তাহলে বলছেন , আমি সুস্থ হয়ে গেছি? ঔষধ বন্ধ করে দেবো? ”
” উঁহু। এখনই নয়। আরও কিছুদিন পর বিষয়টা চিন্তা করে দেখব। ”
ফারজাহ তমার কোলে বসে টুকটুক করে চকলেট খাচ্ছে। মিলি অনেক আগেই বেরিয়ে গেছে।
” তোমলা এত গম্প কতচো কেন, পাপা? আন্তির তিকিৎতা কব্বে না তুমি? ( তোমরা এত গল্প করছ কেন, পাপা? আন্টির চিকিৎসা করবে না তুমি) ”
ফারজার কথা শুনে ওর দিকে তাকায় ফারদিন। তমা মৃদু হাসলো।

” এই যে পরীটা , আমি অসুস্থ যে তোমার পাপা আমার চিকিৎসা করবেন ? আমি পুরোপুরি সুস্থ মানুষ বুঝলে? ”
” হেই ডক্টর, আসতে পারি? ” তাহমিদ এসে দাঁড়িয়েছে দরজায়।
” আসুন , স্যার। আপনার দর্শন দিয়ে ধন্য করুন আমাকে। ” ডক্টর ফারদিন হাসিমুখে বলল।
” আহ্ এভাবে লজ্জা দিচ্ছ কেন ! দেশের একজন নামকরা সাইকিয়াট্রিস্ট কি না আমাকে স্যার বলছে ! এই লজ্জা কোথায় রাখি আমি। ” চেয়ার টেনে বসল তাহমিদ।

” এই লাইনে আছি আট বছর। কিন্তু আমাকে এই পর্যন্ত আসতে কম কষ্ট করতে হয়নি। অথচ তোমাকে দেখ , পাশ করে বেরোনোর সঙ্গে সঙ্গে মেডিকেল তোমাকে লুফে নিলো। আবার বছর খানেকের মধ্যেই সেরাদের কাতারে ঢুকে পরলে। এমনটা কয়জন পারে? মেডিকেলে নাকি রোগীরা ডক্টর তাহমিদ বলতে পাগল। এটাও কি কম পাওয়া! ”
” হয়েছে আর বলতে হবে না। লজ্জা পাচ্ছি। এবার বলো , আমার আপুর কি অবস্থা ? ”
” ফারজাহ , পাপা তুমি আন্টিকে নিয়ে বাসায় যাও । আজকে আমরা একসঙ্গে ডিনার করব। মিলি আন্টিকে ডিনারের ব্যবস্থা করতে বল। বলতে পারবে , পাপা? ” ডক্টর ফারদিন আদুরে গলায় মেয়েকে জিজ্ঞেস করল।
” ভাইয়া , ঝামেলা করতে যেও না । তোমার কাজ শেষ হলেই আমি আপুকে নিয়ে বাসায় ফিরব। ” তাহমিদ বাঁধা দিল।

” কোন কথা হবে না । আমি যা বলেছি সেটাই হবে। আজ যখন তোমাকে পেয়েছি , তখন খুব সহজেই ছাড়ছি না । তমা , আপনি ফারজাহ কে নিয়ে আমার বাসায় যান। আমরা একটু পরই আসছি। ”
তমা কিছু না বলে তাকালো তাহমিদের দিকে।
” তাহলে যাও , ফেমাস ডক্টরের ফ্ল্যাট থেকে ঘুরেই এসো। আমরাও আসছি একটু পর । ”
তাহমিদের সম্মতি পেয়ে তমা ফারজাহ কে নিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে গেল।

” এবার বলো, তোমার রোগীর অবস্থা কি ? ” তমা বেরিয়ে যেতেই তাহমিদ জিজ্ঞেস করল।
” অনেকটাই উন্নতির দিকে । আশা করছি মাস খানেকের মধ্যেই পুরোপুরি সেড়ে যাবে। তবে তারপরও মাঝেমধ্যে তাকে নিয়ে আসতে হবে। আরও বছর খানেক তার কাউন্সিলিংয়ের প্রয়োজন। রোগীর মধ্যে চেষ্টা আছে। তবে প্রথমদিকে এমনটা ছিলো না । ধীরে ধীরে নিজের মনকে গুছিয়ে নিয়েছে সে। ”
” তুমি তো সবটাই জানো । আমরা সবাই চাই আপু সুস্থ হয়ে উঠুক। এতে অন্তত নিজেদের দোষটা কিছুটা হলেও ঢাকবে । তুমি যতদিন চাইবে আপুকে নিয়ে আসবো । আপু খুব ট্যালেন্ট ছিল জানো ? ঢাবিতে পড়তো। রেকর্ড নম্বর পেয়েছিল পরপর দুই বছর। কিন্তু একজন বেইমানের কারনে সব শেষ হয়ে গেল। নিজেকেই হারিয়ে ফেললো আপু । ”

” ডোন্ট অরি , মে খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে যাবে। তখন চাইলে কিন্তু সে পড়াশোনাও করতে পারবে। শুধু তোমরা তার পাশে থাকবে। সবকিছুতে অনুপ্রেরণা দেবে। তাহলেই হবে। অনেক গল্প আছে । এবার বাসায় চলো। বাসায় গিয়ে কথা বলব। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৪৯

ডক্টরের বাসায় গিয়ে তমা পুরোটা সময় কাটালো ফারজাহ ‘ র সঙ্গে । মেয়েটাকে ওর বেশ লাগে। ডিনার শেষে ওরা যখন বাসায় ফিরতে চাইলো , তখন ফারজাহ ‘ র সে কি কান্না । ওকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাসায় ফিরতে ওদের রাত এগারোটার বেশি বেজে গেল। তবে তার আগে ফারজাহ ‘ র কাছে তমাকে প্রমিজ করতে হয়েছে, ও যখনই এখানে আসবে তখনই ওর সঙ্গে তমার সময় কাটাতে হবে। তমাও রাজি হয়।

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here