আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৩

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৩
অরাত্রিকা রহমান

গাড়ির ভেতর হঠাৎ বাতাস ভারি হয়ে উঠল। ইঞ্জিনের গর্জন আর রাস্তায় টায়ারের ঘর্ষণের শব্দ যেন মিরায়ার বুকের ভেতরের ধুকপুক ধ্বনির সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। রায়ান কোনো কথা না বলে স্টিয়ারিং শক্ত করে চেপে ধরল, তার দৃষ্টি সামনের অন্ধকার রাস্তায় গেঁথে আছে।
গাড়ির স্পিডোমিটারে কাঁটা দ্রুত ঘুরে ১০০… ১২০… ২০০ কিলোমিটারের ওপর উঠে গেল। রাস্তা ফাঁকা, চারপাশের আলো মিলিয়ে গেছে, শুধু হেডলাইটের তীব্র আলো অন্ধকার কেটে সামনের পথ খুলে দিচ্ছে। গাড়ির ভেতরে তীব্র চাপা উত্তেজনা—প্রতিটি মোড়ে মনে হচ্ছিল যেন যেকোনো মুহূর্তে সবকিছু ভেঙে পড়তে পারে।
মিরায়া ভয়ে থরথর করে কাঁপছে, চোখের পানি ঝরে পড়ছে অবিরাম। তার কণ্ঠ কেঁপে উঠল—

—“রায়ান ভাইয়া… দয়া করে থামুন… প্লিজ… আমি ভয় পাচ্ছি…”
কিন্তু রায়ান যেন শূন্য হয়ে গেছে। তার ঠোঁট শক্তভাবে চেপে ধরা, মুখে গভীর রাগের ছাপ, আর হাতের মুভমেন্টগুলো কেবল আরও স্পিড বাড়িয়ে তুলছে।
গাড়ি শহরের আলো পেছনে ফেলে অনেক দূরে চলে এলো। রাস্তার দুপাশে অন্ধকার জঙ্গল, কোথাও কোথাও হালকা কুয়াশার মতো ধোঁয়ার আস্তরণ। বাতাসের তীব্র চাপ গাড়ির জানালা কাঁপিয়ে দিচ্ছে। প্রতিটি বাঁকে চাকার শব্দ আর গাড়ির হেলে ওঠা মিরায়ার বুক কাঁপিয়ে দিচ্ছিল।
সে হাত জোড় করে কাঁদতে কাঁদতে অনুনয় করল রায়ানের দিকে ফিরে—
—“আপনি চাইলে আমি এখনই চলে যাব… আর আপনার সামনে আসবো না… কিন্তু প্লিজ, স্পিড কমান… আমার খুব ভয় করছে… আমি মরতে চাই না, রায়ান ভাইয়া… প্লিজ…”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

তার গলায় কান্না এতটাই ভারি যে প্রতিটি শব্দ ভেঙে যাচ্ছিল। সে সিটবেল্ট আঁকড়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ফেলল, যেন এই ঝড় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে চাচ্ছে।
রাস্তাটা এবার নদীর দিকে বাঁক নিল। দূরে পানির প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে, চারপাশে নিস্তব্ধতা—শুধু ইঞ্জিনের গর্জন আর নদীর বাতাস। স্পিড তখনও ২০০-এর ওপরে। গাড়ির সামনে হেডলাইটে নদীর ধারে ঝোপঝাড় আর অন্ধকার স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
মিরায়া ভয়ে আরও জোরে কাঁদল—

—“আমি দোষী হলে শাস্তি দেন… কিন্তু প্লিজ… এমন করবেন না… দয়া করে থামুন…”
কিন্তু রায়ানের চোখ তখনও সোজা সামনে। তার রাগ, হতাশা আর বিশ্বাসঘাতকতার দহন মিশে এক অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি করেছে। যেন এই গতি, এই অন্ধকারই তার ভিতরের ঝড়কে বহন করছে।
গাড়ি হঠাৎ নদীর ধারের রাস্তায় জোরে বাঁক নিল, টায়ারের ঘর্ষণের শব্দ কানে বাজল। মিরায়ার চিৎকার বাতাসে মিলিয়ে গেল—

গাড়ি নদীর পাড়ের পাশের বড়ো রাস্তায় এসে হঠাৎ ব্রেক কষল। টায়ারের ঘর্ষণে কানে তালা লেগে গেল, গাড়ি কেঁপে থেমে দাঁড়াল রাস্তার একেবারে ধারে। ইঞ্জিন তখনও গর্জন করছে, কিন্তু রায়ানের শরীর স্থির—শুধু তার বুক ওঠানামা করছে দ্রুত শ্বাসে।
চারপাশে গভীর অন্ধকার, দূরে নদীর ঢেউয়ের মৃদু শব্দ ভেসে আসছে। বাতাসে হালকা নদীর গন্ধ মিশে আছে। মনে হচ্ছে পৃথিবীর বাকি সবকিছু থেমে গেছে।
মিরায়া তখন অঝোরে কাঁদছে। সিটের ওপর হেলে পড়েছে, হাতদুটো বুকের ওপর জড়িয়ে ধরেছে। তার কণ্ঠ ভেঙে আসছে—

—“রায়ান ভাইয়া… আমি আপনাকে আঘাত দিতে চাইনি… আমি কসম করে বলছি… আমার ইচ্ছা ছিল না আপনার থেকে এমন কিছু লুকোনো…… প্লিজ, আমাকে বোঝার চেষ্টা করুন…”
সে আর কোনো কিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারছিল না, শুধু কান্নায় ভেঙে পড়ছিল। প্রতিটি ফোঁটা অশ্রু পড়ে যাচ্ছিল তার গালে, গলায়, পোশাকে।
রায়ান নিঃশব্দ। স্টিয়ারিং চেপে ধরে বসে আছে, চোখ সামনে নদীর অন্ধকারে গেঁথে আছে। তার ভেতরের রাগ যেন একটু একটু করে গলছে, কিন্তু বদলে আসছে এক অদ্ভুত শূন্যতা। যেন পুরো পৃথিবী তার কাছ থেকে বিশ্বাস কেড়ে নিয়েছে।
মিরায়া ভয় পেয়ে আবার বলল—

—“আপনি চাইলে আমি আপনার জীবন থেকে চলে যাব… আর কোনোদিন সামনে আসবো না… শুধু প্লিজ… এভাবে ঘৃণা নিয়ে চুপ করে থাকবেন না… আমি ভয় পাচ্ছি…”
তার কণ্ঠ ভাঙা, গলায় হাহাকার, চোখে অসহায়তা। সে জানালার বাইরে নদীর অন্ধকারে তাকাতে পারল না, যেন মনে হচ্ছিল ওই অন্ধকারই তাকে গিলে নেবে। তাই সে মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকল, বারবার হাত ও ওড়না দিয়ে চোখ মুছতে চেষ্টা করল, কিন্তু চোখের পানি থামল না।
রায়ান তখনও কিছু বলল না। তার বুকের ভেতর আগুনের মতো জ্বলতে থাকা রাগ, হতাশা আর ভালোবাসা একসাথে মিশে তাকে নিস্তব্ধ করে দিয়েছে। গাড়ির ভেতর শুধু শোনা যাচ্ছে মিরায়ার কান্নার শব্দ আর ইঞ্জিনের ভারি গুঞ্জন।

রায়ান হঠাৎ স্টিয়ারিং থেকে হাত সরিয়ে মিরায়ার দিকে ঘুরে তাকাল। তার চোখে এমন এক দৃষ্টি—যেখানে রাগ, অপমান আর গভীর যন্ত্রণা একসাথে জ্বলছে। মিরায়া চমকে উঠল, নিঃশ্বাস আটকে গেল।
এক মুহূর্তও দেরি না করে রায়ান জোরে দরজা খুলে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এল। ঠাস করে দরজার শব্দ রাতের নিস্তব্ধতায় প্রতিধ্বনি তুলল। নদীর ধারে হালকা বাতাস বইছে, কিন্তু সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল চারপাশের সব বাতাসও রায়ানের রাগের আগুনে দমবন্ধ হয়ে গেছে।
সে সামনে দিয়ে গিয়ে মিরায়ার দিকের দরজা টেনে খুলে ফেলল। মিরায়া আতঙ্কে চোখ বড় করে তাকাল। রায়ান কোনো কথা না বলে একটানে তার সিটবেল্ট খুলে দিল।

—“কি করছেন…!”—মিরায়া কাঁপতে কাঁপতে বলল, কিন্তু তার কথা শেষ হবার আগেই রায়ান তাকে শক্ত করে টেনে গাড়ি থেকে নামিয়ে নিল।
মিরায়ার পা মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই রায়ান দরজাটা জোরে ধাক্কা দিয়ে বন্ধ করল। শব্দটা রাতের অন্ধকারে বজ্রপাতের মতো লাগল। তারপর সে মিরায়াকে ঠেলে গাড়ির গায়ে চেপে ধরল। রায়ানের মুখ একেবারে কাছে, তার নিঃশ্বাস গরম, আর চোখে রাগে লাল আগুন। মিরায়ার বুকের ধুকপুকানি যেন বাইরে থেকেও শোনা যাচ্ছিল।
রায়ানের কণ্ঠ ভাঙা কিন্তু গর্জনের মতো—

—“কিসের বিবাহিতা মেয়ে তুই? কার স্ত্রী হয়ছছিস?… কাকে বিয়ে করলি?”
তার হাত এখনো মিরায়ার কাঁধে শক্ত করে ধরা। রায়ান মিরায়ার কাঁধ ধরে ঝাকাতে ঝাকাতে জিজ্ঞেস বলল-
—“কবে? কেন? কোন কারণে?… আমার জন্য একটু অপেক্ষা করা যেত না? হ্যাঁ? রং লেগেছিল তোর মনে?”
রায়ানের চোখে জল জমে উঠেছে, কিন্তু সেটা রাগে আর যন্ত্রণায় কাঁপছে।
—“আমি তোর জন্য এদিকে কত কিছু সহ্য করে নিজেকে সামলাচ্ছি, আর তুই?… তুই গিয়ে অন্য কারও বউ হয়ে বসে আছিস?!”
তার কণ্ঠে রাগের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে পড়া এক দহন—যেন ভিতরে ভালোবাসার টান এখনো তাকে ছাড়তে পারছে না।
মিরায়া কাঁদতে কাঁদতে শুধু বলল—

—“না… রায়ান ভাইয়া… আমার কথা শোনেন…”
কিন্তু রায়ানের চোখে এখনো ঝড়—সে নিঃশ্বাস ফেলে আবার ফিসফিস করে উঠল, কণ্ঠে ব্যথা মিশ্রিত রাগ—
—“কেন করলি এটা? কার বউ হয়েছিস তুই, মিরা?”
গভীর নীরবতা নদীর ধারে নেমে এল, শুধু মিরায়ার কান্না আর রায়ানের দমবন্ধ করা যন্ত্রণা ভরা কণ্ঠ বাতাসে ভাসতে লাগল।
মিরায়া তখনও কান্নায় ভেঙে পড়েছে। চোখে-মুখে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে, ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু কোনো কথা বেরোচ্ছে না। তার শরীর ভয়ে থরথর করছে, যেন প্রতিটি মুহূর্তে দমবন্ধ হয়ে আসছে।
রায়ান দাঁত চেপে ফিসফিস করে উঠল, কণ্ঠে বজ্রপাতের মতো রাগ—

—“বল ছেমরি! কাকে বিয়ে করেছিস তুই? কথা বল। কার সাথে আমায় ঠকালি?”
তার চোখে আগুন জ্বলছে। মিরায়া চুপ করে কাঁদছে, কোনো জবাব নেই। রায়ান হঠাৎ গর্জে উঠল—
—“কে ওই হারামজাদা? নাম বল! আগে ওই শয়তানটাকে খুন করবো, তোকে বিধবা বানাবো… তারপর আবার তোকে নিজের করবো। শালার সাহস কেমন করে হলো তোকে ছোঁয়ার?”
মিরায়া চোখ নামিয়ে ফেলল, শুধু শরীর কুঁকড়ে উঠল ভয়ে। তার ঠোঁট কাঁপছে, কেবল মাথা ডান বাম নাড়াচ্ছে কিন্তু শব্দ বেরোচ্ছে না।
মিরায়ার এই নীরবতা রায়ানকে আরও বেপরোয়া করে তুলল।
সে মিরায়াকে গড়ির সাথে চেপে রেখেই কাঁধ থেকে হাত সরিয়ে এক হাত নামাল কোমরে। শক্ত করে টেনে নিলো তাকে নিজের শরীরের সাথে। মিরায়ার বুক ধড়ফড় করছে, চোখে আতঙ্ক।
রায়ানের আরেকটা হাত জোরে গাড়ির বডিতে আঘাত করল। ঠাস! শব্দটা অন্ধকার নদীর ধারে প্রতিধ্বনি তুলল।
সে ফুঁসে উঠল—

—“কিরে, বান্দির বাচ্চা! চুপ আছিস কেন? কথা বল! কে ওই হারামজাদা… যে সাহস করেছে তোর দিকে হাত বাড়াতে? নাম বল, মিরা!”
তার নিঃশ্বাস ভারি, চোখে রক্তিম শিখা। মিরায়া কাঁপতে কাঁপতে মাথা নাড়ল, কিছু বলার চেষ্টা করল, কিন্তু গলা দিয়ে শব্দ বেরোলো না। শুধু তার শরীর রায়ানের বুকে চেপে কুঁকড়ে আছে, আর কান্নার আওয়াজ নদীর বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছে।
রায়ান মিরায়ার কোমর আরো শক্ত করে ধরে নিজের শরীরের সাথে লাগিয়ে গাড়িতে জোরে একটা লাথি দিয়ে চেঁচালো-

—“স্পিক আপ ইউ ইডিয়েট? হু ইজ দ্যাট মাদার **কার? কার কাছে গেছিস তুই?”
মিরায়া কাঁপছে, চোখ ভিজে গেছে কান্নায়। হঠাৎ সে বুক ভরে চিৎকার করে উঠল—
—“আমি জানি না! আমি জানি না সে কে!”
তার গলা ফেটে কান্না বেরোতে লাগল। সে বুক ধড়ফড় করতে করতে হঠাৎ রায়ানের বুকের ওপর মাথা ঠেসে দিল। হাতদুটো বুকের কাছে কাঁপছে, শরীর জুড়ে আতঙ্ক আর কান্না।
মিরায়া কেঁদে ফিসফিস করে বলতে লাগল—

—“আমি কিছু জানি না… আমি জানি না সে কে… কোথায় থাকে, কী তার পরিচয়… আমি কিছুই জানি না…”
সে মাথা নাড়তে লাগল নাসূচক বারবার, ঠোঁট কাঁপছে, চোখ বন্ধ। রায়ানের বুক ভিজে যাচ্ছে তার কান্নায়।
রায়ান এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে গেল। তার শরীর শক্ত হয়ে আছে, কিন্তু চোখে অদ্ভুত শূন্যতা ভেসে উঠল। মিরায়ার ভাঙা কণ্ঠ, তার কান্নায় ভিজে যাওয়া বুক, আর সেই অসহায় স্বীকারোক্তি যেন রায়ানের রাগকে হঠাৎ থামিয়ে দিল।
সে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল—এক হাতে এখনো মিরায়ার কোমর জড়িয়ে আছে, অন্য হাত গাড়ির গায়ে থেমে গেছে। তার চোখে বিস্ময়, রাগ আর যন্ত্রণার মিশ্রণ এক মুহূর্তে স্তব্ধতায় পরিণত হলো। রায়ানের বুক ভিজে যাচ্ছে মিরায়ার কান্নায়। তার চোখে তখনো লালচে রাগের ছাপ, কিন্তু ভেতরে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব ঘুরছে।

“তাহলে কি… মিরা কিছুই জানে? সে কি অন্ধকারে বন্দি? নাকি… সে আসলেই আমাদের অতীতের সেই সত্যটা জানে?”
মনে মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরছে, কিন্তু মিরায়ার কাঁপা কণ্ঠ আর অসহায় কান্না ধীরে ধীরে তার বুকের রাগকে ভেঙে দিচ্ছে।
রায়ান নিঃশব্দে গাড়ির গায়ে রাখা হাতটা সরিয়ে এনে মিরায়ার মাথায় রাখল। ধীরে ধীরে চুলে হাত বুলিয়ে দিল। সেই স্পর্শে মিরায়ার ভেঙে পড়া কান্না আরও তীব্র হলো।
মিরায়া হঠাৎ রায়ানের বুক আঁকড়ে ধরল। তার হাতদুটো শক্ত করে রায়ানের জামায় চেপে আছে। মাথাটা রায়ানের বুকে লুকিয়ে কাঁপছে, যেন পৃথিবীর সব ভয় থেকে আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে কেবল তার বুকেই।
রায়ান এবার গভীর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চোখ বন্ধ করল। এক হাতে মিরায়ার কোমর জড়িয়ে ধরে তাকে আরও কাছে টেনে নিল, অন্য হাত দিয়ে তার মাথার চুলে ধীরে ধীরে হাত বুলিয়ে যেতে লাগল।
নদীর ধারে রাতের নিস্তব্ধতায় গাড়ির ধাতব দেহে ভর করে দাঁড়ানো দু’জন মানুষ—একজন রাগে জর্জরিত কিন্তু ধীরে ধীরে শান্ত হচ্ছে, আরেকজন কান্নায় ভেঙে পড়ে আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে সেই একই বুকে। রায়ানের বুকের ভেতরে ঝড় এখনো আছে, কিন্তু মিরায়ার চোখের জল তার ভেতরের আগুনকে ধীরে ধীরে নিভিয়ে দিচ্ছে।
রায়ান দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আস্তে করে বলল—

—“হৃদপাখি… শান্ত হও। আমার দিকে তাকাও।”
মিরায়া মাথা নড়লো না। বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে কান্নায় কাঁপছে। তার ঠোঁট কাঁপছে, কিন্তু চোখ তুলতে পারছে না।
রায়ান আবার নরম অথচ কষ্টমাখা কণ্ঠে বলল—
—“হার্ট-বার্ড… লুক অ্যাট মি।”
কোনো সাড়া না পেয়ে রায়ান নিজের দু’হাত বাড়িয়ে দিল। আস্তে করে মিরায়ার মুখ দু’পাশ থেকে ধরে তার অশ্রুসিক্ত মুখটাকে বুক থেকে সরিয়ে নিজের দিকে ঘুরিয়ে মুখ বরাবর আনলো।
দু’জনের চোখ চোখে পড়তেই রায়ানের ভেতরের ঝড় যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। এতক্ষণ ধরে জমে থাকা রাগ, আগুন, অস্থিরতা—সব মিশে গেল মিরায়ার চোখের ভেতর লুকানো অসহায় কান্নায়।
রায়ানের ঠোঁট কাঁপল। সে ধীরে, স্নেহের আবেগ নিয়ে মিরায়ার কপালে চুমু দিল। কণ্ঠে ভারি ব্যথা মিশে রইল—

—“যদি সত্যিই কিছু না জানিস… তবে তখনকার ওই কথার মানে কী ছিল, হৃদপাখি? কেন‌ আমাকে কষ্ট দিচ্ছিস? কেন আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নিচ্ছিস?”
মিরায়া কান্না চেপে রাখতে চেষ্টা করল। তার নিঃশ্বাস থেমে থেমে আসছে, হাতদুটো এখনো রায়ানের জামা আঁকড়ে ধরা।
রায়ান আবারও তার চোখের ভেতর তাকিয়ে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল—

—“নিজেকে কেন বিবাহিতা দাবি করলি, হৃদপাখি? কেন? আমার বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যাচ্ছে… সামলাতে পারছি না। তুই যদি মুখ খুলে আমায় সত্যি না বলিস, তবে আমি কখনো শান্ত হবো না।”
তার কণ্ঠে ছিল না আর আগের মতো রাগ, বরং ছিল যন্ত্রণায় কাঁপা আকুতি—যেন পৃথিবীর সব উত্তর একমাত্র মিরায়ার মুখেই আটকে আছে।
মিরায়া ঠোঁট কাঁপিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করল। বুক ওঠানামা করছে দ্রুত শ্বাসে। চোখে জমে থাকা অশ্রু ঝরে পড়ছে থেমে থেমে।

—“আমি… আমি আসলে…”—শব্দগুলো গলা ছেড়ে বেরোতেই আটকে গেল।
সে চোখ নামিয়ে ফেলল, ঠোঁট কেঁপে উঠছে, কিন্তু বাক্যগুলো যেন বুকের গভীরে গিয়ে হারিয়ে যাচ্ছে। হাতদুটো রায়ানের জামা আঁকড়ে ধরা, শরীর কাঁপছে ভয়ে আর অস্থিরতায়।রায়ানের ভেতরে অস্থিরতা আরও বাড়ল। সে মিরায়ার মুখের দিকে গভীরভাবে তাকিয়ে রইল। তার চোখে লালচে শিরা, নিঃশ্বাস ভারি।
—“বল, হৃদপাখি… থেমে থেমে নিঃশ্বাস নিচ্ছিস কেন? গলার ভেতর শব্দ আটকে রাখছিস কেন? আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্যই কি থেমে যাচ্ছিস? আমি আর পারছি না ধৈর্য ধরতে!”
রায়ানের কণ্ঠে রাগের আগুন আর ব্যথার ভারি সুর মিলেমিশে বাজল। সে আবারও দু’হাতে মিরায়ার মুখ আলগোছে তুলে নিল নিজের দিকে। রায়ান নিঃশ্বাস আটকে তার দিকে তাকিয়ে রইল—যেন সেই ভেজা চোখের ভেতর থেকে সত্যটা বের করে আনতে চাইছে।

চৌধুরী বাড়ির পথে~
রুদ্র গাড়িতে একা বসে স্টিয়ারিং ধরে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। রিমি থেকে নিজের বড় ভাইয়ের ওমন বেপরোয়া কাণ্ডের বর্ণনা শুনে সে রিমিকে পরিস্থিতির স্বাভাবিকতার আশ্বাস দিয়ে বিদায় নিয়েছে। রাতের হালকা বাতাস জানালা দিয়ে ঢুকছে, কিন্তু তার মন এক মুহূর্তও শান্ত নেই।
হঠাৎ রুদ্রর ফোনটা বেজে ওঠে। ফোনে স্ক্রিনে সেভড নাম “আম্মু”‌ । রুদ্র খুব ভালো করেই জানে কলটা তার মা তাকে কেন করেছে। রুদ্র একটা শুকনো ঢোক গিলে বাঁচতে থাকা ফোনটা হাতে তুলে নিয়ে কলটা রিসিভ করে-
-“রুদ্র ! কোথায় তুই? মিরায়া এখনো বাড়ি ফেরে নি । ফোন ও তুলছে না । তুই ওর ব্যাপারে কিছু জানিস, তোকে কিছু বলেছে?”
রুদ্র ফোনটা ধরতেই অপর পাশ থেকে রামিলা চৌধুরী এক নিঃশ্বাসে কথাটা বললেন।
রুদ্র একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল যেন তার আগে থেকেই জানা এমন কিছুই হতে যাচ্ছিল। তোদের ঠান্ডা মাথায় তার মায়ের প্রশ্নের উত্তর করে-

“হ্যাঁ আম্মু আমি জানি। টেনশন করো না মিরা ঠিক আছে ড়য় তো ফোন সাথে নেই তাই ধরতে পারে নি।”
রামিলা চৌধুরী রেগে- “তোর আব্বু ফিরেছেন সন্ধ্যায় অথচ বাড়িতে একটা ছেলে, মেয়ে নেই সোরায়া ছাড়া। তোরা কি আমাদের চিন্তা কখনো বুঝবি? আসার পর থেকেই তোর আব্বু তোদের কথা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছেন , কি বলবো আমি?এত বছর পর দেশে ফিরেছে গুনধর ছেলে আমার তার ও কোনো পাত্তা নেই। আর এই দিকে বাড়ির বড় বউ এখনো বাড়ি ফেরে নি। মশকরা চলছে?”

রুদ্র মায়ের রাগে আওয়াজ শুনে ফোনটা কানে থেকে খানিকটা দূরে নিয়ে নেয় । তার মনে হচ্ছে এবার বুঝি কানের পর্দা ফেটে রক্ত বের হয়ে যাবে। রুদ্র স্বাভাবিক হয়ে কানে আবার ফোন নিয়ে বলল-
“আম্মু আমি বাড়িই ফিরছি রাস্তায় আজকে অফিসে মিটিং ছিল তাই রেট হয়েছে বের হতে।”
রামিলা চৌধুরী আবার চেঁচিয়ে – “তুই আর তোর বড়ো ভাই জাহান্নামের চৌরাস্তায় যা। তোদের নিয়ে চিন্তা নেই আমার। আমাকে এইটা বলে মিরা কোথায়। রুদ্র ভুলে যাস না মিরা চৌধুরী বাড়ির বড় বউ এই বাড়ির সম্মান। মিরা ঠিক আছে নাকি সেটা জানতে চাইছি।”

রুদ্র অস্থির হয়ে মনে মনে-” উফ্! কি এক পেপারে পড়লাম কি বলি এখন।!”
রামিল চৌধুরী-“হ্যালো, রুদ্র শুনতে পাচ্ছিস?”
রুদ্র চোমকে উঠে কাঁপা গলায় বলে- “হ্যাঁ আম্মু শুনছি। মিরা ভাবি ভাইয়ার সাথে আছে। ভাইয়া ভাবির ক্লাস শেষে গাড়িতে করে নিয়ে গেছে। ঠিক আছে ও।”
রামিলা চৌধুরী আরো আশ্চর্য হয়ে সন্দেহভাজন কন্ঠে বললেন-
“কিহ, রায়ানের সাথে!”
রুদ্র – “হুঁ।” এক প্রকার হকচকিয়ে।
রামিল চৌধুরী আবার চেঁচিয়ে বললেন- “এখনি রায়ানকে ফোন করে মিরা কে নিয়ে বাড়িতে ফিরতে বল। ওর সাথে আমার বউমা আরো আনসেইফ। কখন কি করে বসবে ঠিক নেই। দেখিস নি মিরায়ার কথা উঠলেই কেমন রেগে ফুঁসতে থাকে।”

রুদ্র তুচ্ছার্থে হেঁসে মনে মনে – “আম্মু গো! আগের দিন বাঘে খাইছে, তোমার ছেলে প্রেমে পরছে। নাম শুনলে রাগবে কি! এখন বউয়ের নাম শুনলে নাচে।”
রুদ্রর ধ্যান ভঙ্গ করে রামিলা চৌধুরী জোরে আওয়াজ করে বললেন-“কি বললাম! মাথায় ঢুকলো। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে বল আর নিজেও তাড়াতাড়ি আয় তোদের আব্বুর মেজাজ খারাপ হওয়ার আগে।”
রুদ্র মনোযোগ ফিরিয়ে এনে সম্মতি দিল- “জ্বি, আম্মু।”
কথা শেষ করেই রুদ্র ফোন টা রেখে দেয়।
এর পর রুদ্র একা একাই গাড়ির ভিতরে বিরবির করতে থাকে-

“ভাইয়া… তুমি চাইছোটা কি? আমি কিভাবে সামলাবো এখন সব? উফ, কী জ্বালা লাগছে…? এত দেরি হয়ে গেছে মিরা তাও বাড়ি ফেরেনি বাড়িতে সবাই চিন্তা করছে।”
তার হাত চেপে ধরেছে স্টিয়ারিং। চোখে অন্ধকার ভাব। মনে মনে সে বারবার প্রশ্ন করছে—
“মিরা ভাবি ঠিক আছে কি? ভাইয়া আমার যে বেপোরোয়া হয়েছে কি না কি করে বসবে তার ঠিক নেই, আম্মু অন্যভাবে বললেও ভুল বলে নি।”
রুদ্রের ভেতরে চিন্তার ঝড়। উদ্বেগ, কৌতূহল, অস্থিরতা একসাথে মিলেমিশে ঘূর্ণন করছে। তার নিঃশ্বাস ভারী, চোখ বারবার স্টিয়ারিংয়ের দিকে আটকে, কিন্তু মনের মধ্যে সে ঘুরছে শুধু—রায়ান ও মিরা কী করছে, কোথায় আছে, ঠিক আছে কি না।
রুদ্র নিজের মনেই ভাবলো-

“ আমি কি একবার কল করেই দেখবো! আম্মু তো তাই করতে বলল…”
সে নিজের ফোন হাতের কাছে নিয়ে, রায়ানের নাম্বার বের করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। রুদ্র গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে নাম্বার ডায়াল করল। ডায়ালিং টোন বাজছে, আর রুদ্র মনে মনে তার হাত থরথর করছে। রাতের নীরবতা, বাতাসের হালকা শব্দ—সব মিলিয়ে তার উদ্বেগ আরও তীব্র করছে।
মনে মনে বলল—
“দয়া করে ফোন ধরো, ভাইয়া… আমি শুধু জানতে চাই, তোমরা ঠিক আছে তো…”

রায়ান দাঁড়িয়ে আছে, দু’হাত দিয়ে মিরায়ার মুখ সামলানো, চোখে গভীর আবেগ আর প্রশ্নের ঝলক।
—“হৃদপাখি… কেন… কেন বল না……? নিজের কথা গুলো বল।”
হঠাৎ, রায়ানের পকেট থাকা ফোন বাজতে লাগল। দুজনের মনোযোগ মুহূর্তে ছিন্ন হয়ে গেল। রায়ান চোখ কুঁচকে বিরক্তি প্রকাশ করল। সে পকেট থেকে ফোনটা বের করল।
মনে মনে-“শালার বউটার সাথে থাকলেই কিছু না কিছু বিরক্ত করবেই। এখন কে কল করল।”
ফোন পকেট থেকে বের করার পর স্ক্রিনে চোখ পড়তেই অবাক হয়ে গেল—রুদ্র।
—“রুদ্র… এই সময়ে ফোন?”—মনের মধ্যে হঠাৎ বিস্ময় আর খানিকটা হতবোধ।

তার পর বার মনে মনে আওড়ালো- “ঠিকই আছে আমার ভাইয়ের থেকে এর চেয়ে ভালো কিছু আশা করা যায় না।”
মিরায়ার চোখে কান্না, আর রায়ানের চোখে রাগের ছাপের সঙ্গে সাথে সামান্য বিস্ময়। রায়ান ফোন হাতে ধরে নীরব, কয়েক মুহূর্ত স্থির, আর তারপর নিজের নিঃশ্বাস নিয়ন্ত্রণ করতে করতে ফোনের দিকে তাকাল।
রায়ান ফোনটা হাতে নিয়ে নিজের গলার স্বর একটু গভীর করল।
—“বল কি হয়েছে? কি এমন মরা মরলো যে কল দিলি এত বাজে সময়ে।”
ফোনের অপর পাশে রুদ্রের কণ্ঠ কাঁপছে, উদ্বেগ আর চিন্তায় ভরা।

—“ভাইয়া… তুমি… তুমি কোথায় আছো? মিরা.. মিরা ভাবি ঠিক আছে তো? রিমি বললেন তুমি নাকি ক্যাম্পাসে সিক্রেট করেছ আর ভাবিকে তুলে নিয়ে গেছ? জানো ভাবি এখনো বাড়িতে ফেরেনি বলে আম্মু চিন্তা করছে।”
রায়ানের চোখে মুহূর্তে রাগ, উদ্বেগ ও বিরক্তির ছাপ মিলেমিশে দেখা গেল। সে মিরায়ার দিকে চোখ রাখল, যে এখনও বুকের ভেতর লুকানো, চোখ ভেজা। এক’হাত দিয়ে মিরায়ার মাথা সামলালো, চুলে হাত বুলাচ্ছে, যেন তাকে শান্ত করার চেষ্টা করছে।

—“রুদ্র… আমি ঠিক আছি। মিরাও ঠিক আছে। অযথা বেশি চিন্তা করিস না। ফোন রাখ আমরা ঠিক সময় চলে আসবো বাড়িতে সবাইকে জানিয়ে দিস মিরা ঠিক আছে আর আমার সাথে আছে।”
রুদ্র কিছুটা শান্ত হলো, কিন্তু কণ্ঠে এখনও সতর্কতা।
—“ভাইয়া… আমি শুধু জানতে চাচ্ছিলাম… মিরা ভাবি নিরাপদ তো? কিছু করো নি…? ”
রায়ান নিঃশ্বাস নিয়ে ফোনটি সামলাল, চোখে অদ্ভুত শান্তি আর ভারি আবেগ।
—“কেন রে? খেয়ে ফেলব নাকি আমি ওকে। আর চাইলে তাও পারি কিন্তু এমন কিছু করছি না। তোদের জ্বালায় পারবো বলেও মনে হয় না। তুই অযথা চিন্তা বাদ দিয়ে বাড়ি ফিরে বাকি সবাইকে সামলে নে, গর্ধব একটা ”
মিরায়া রায়ানের বুকের সঙ্গে মিশে আছে, চুলে হাত বুলানোর স্পর্শে কিছুটা শান্তি পেল। ফোনের সংলাপ যতই এগোচ্ছিল না কেন, রায়ানের চোখে এখন শুধুই মিরায়ার দিকে মনোযোগ।
রুদ্র শেষ পর্যন্ত কিছু বলার আগেই রায়ান ফোন রেখে দিল।
রুদ্র কিছু বলার সুযোগই পেল না যে বাড়িতে রায়হান চৌধুরী তাদের অপেক্ষা করছে। রুদ্র নিজের মাথা চুলকালো বিরক্তিতে আর বলল-

“শুরু শালা! এক দিকে নিজের মা জাহান্নামের চৌরাস্তায় যেতে বলে তাও বাড়ির বউয়ের সেইফটি আগে বাড়ির ছেলের থেকে , অন্য দিয়ে ভালোর জন্য কল করলেও নিজের ভাইয়ের কথা শুনা লাগে। এইসব আমার সাথেই কেন হয়। আমার জীবনে কেউই নাই আমাকে নিয়ে টেনশন করার মতো। বাড়ি গিয়ে সব ডার্ক রোমান্স এর বই ফেলে দিবো পড়ে কি লাভ জীবনে কাজে লাগানোর সুযোগই পাবো না মনে হয়।”
রুদ্র মন খারাপ করে এমন বিরবির করতে করতে গাড়ি চালাতে থাকে আর বাড়ির দিকে অগ্রসর হয়।

রায়ান ফোন রেখে হালকা দীর্ঘশ্বাস দিল। চোখে অদ্ভুত শান্তি।
মিরায়া এখনও বুকের সঙ্গে লুকিয়ে আছে, কিন্তু ধীরে ধীরে তার শরীর আর মন শান্ত হতে লাগল। রায়ান চোখে কোমলতা নিয়ে হাত সরিয়ে মাথা থেকে চুল খসকাতে লাগল, আর মিরায়ার মাথা তার বুকে আরও কাছে টেনে নিল।
কিছুক্ষণ নীরবতা—রায়ান যেন ভুলেই গেছে একটু আগের পরিস্থিতি এখন কেবল তার হৃদপাখি তার বুকে আছে এতটুকুই তার শান্তি।
শুধু তাদের নিঃশ্বাস আর রাতের বাতাস। নদীর দূরে ধীর লহরির শব্দ ভেসে আসছে। রায়ানের চোখে মিরায়ার চোখের ভেতরের অশ্রু আর আতঙ্ক ধীরে ধীরে মিলেমিশে গেছে।
“চলো…”—রায়ান আস্তে করে বলল, নিজের কণ্ঠে শীতল ও স্নেহমাখা—“নদীর ধারে চল। একটু শান্ত বাতাসে ভালো লাগবে।”

মিরায়া কিছুই বলল না, শুধু মাথা নাড়ল। রায়ান হাত ধরে তাকে নদীর ধারে নিয়ে এল। কচি হাওয়া, জলরাশির নরম শব্দ—সব মিলিয়ে দুইজনের মনে শান্তি ভেসে এল।
দু’জন নদীর পাড়ে বসল। রায়ান পাশে বসে মিরায়ার হাত ধরে রেখল। মিরায়া কিছুক্ষণ নিঃশ্বাস নিয়ে নিল। চোখে অশ্রু ঝরে, কিন্তু এবার ভয় নয়, বরং মনে শান্তি, ভেতরের চাপ হ্রাস পাচ্ছে। ধীরে ধীরে মিরায়া স্বাভাবিক হয়ে উঠল। বুকের ভেতরের ভয়, সত্য, আর আবেগ একসাথে মিলেমিশে মুখে আসতে লাগল। সে কেঁপে কেঁপে বলল—
—“আমি… আমি আসলে…”
রায়ান তার দিকে তাকিয়ে ধীর ধীর হাত ধরে সমর্থন করল, চোখে অদ্ভুত কোমলতা আর প্রহরী মতো সতর্কতা।
—“কথা বলো… আমি এখানে আছি।
শুনছি, কিছুই হবে না।”
মিরায়া নিঃশ্বাস গেড়ে মুখ খুলল, আর তার ভেতরের সত্য, যেটা এতদিন লুকিয়ে ছিল, সে জানাতে শুরু করল কাঁপা কাঁপা গলায় –

-“আমি যা বলেছি তা মিথ্যা বা বানোয়াট নয় বরং আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সত্যি। আমার ১৫তম জন্মদিনে আমি প্রথমবার জানতে পারি যে আমি বিবাহিত। একজনের সাথে আমার বিয়ে সম্পন্ন হয়ে আছে। যখন আমার সাত বছর বয়স। ঠিক আমার বাবা-মার কার এক্সিডেন্ট এর পর পরই। কিন্তু তাকে আমি চিনি না, আর না তার সম্পর্কে কিছু জানি। সব কিছুই আমার অজানা। জানার মধ্যে শুধু এতটুকুই যে “আমি বিবাহিত”।”
রায়ান হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গেল। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কম্পন। মিরায়ার কণ্ঠে নিজেদের বিয়ের কথা শোনার পর, তার মনের মধ্যে এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। অস্বস্তি, আর শান্তি—একসাথে।
রায়ানের মনের ভাব যেন সকল বর্ণনার ঊর্ধ্বে চলে গেল। রায়ান মিরায়ার মুখের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। রায়ানের মনে ঝড় উঠলো এক গুচ্ছ প্রশ্নের-
“হৃদপাখি যদি তুমি জানেই থাকো আমাদের বিয়ের ব্যাপারে তাহলে কেন জানো না আমি তোমার বর। কি করে সম্ভব এটা ?”

রায়ান নিজের এত কৌতুহল আর ধরে রাখতে পারলো না অবশেষে নীরবতা ভেঙ্গে জিজ্ঞেস করল-
“সাত বছর বয়সে বিয়ে হওয়ার এত বছর পর কিভাবে জানতে পারলে তাহলে? এমন কিভাবে হয় যে কিছুই জানো না নিজের বরের ব্যাপারে।”
মিরায়া হালকা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলে –
“এমন না যে কিছুই জানি না । জানার মধ্যে আমি তার নাম জানি। ওই দিন প্রথম শুনেছিলাম না এর আগে শুনেছি আর না ঐ দিনের পর কখনো শুনেছি। তবে স্পষ্ট মনে আছে তার নাম- “রিভান”।”
রায়ান মিরায়ার কথায় অবাক হলো তবে স্বাভাবিক ভাবেই নিলো কারণ তার সম্পূর্ণ নাম- “রিভান চৌধুরী রায়ান “। তার খালামণি অর্থাৎ মিরায়ার চাচি তার এই নাম রেখেছিলেন তাই তিনি রায়ানকে এই নামেই ডাকতেন।
রায়ানের নিজের নাম এর এমন গোলমাল পাকিয়ে যাওয়াতে হঠাৎই বেশ কৌতূহলী হয়ে সম্পূর্ণ ঘটনাটা জানতে। রায়ানের মনে মনে এই একটাই কথা ঘুরছিল । তবে বিষয়টা তার জন্য যথেষ্ট বিরক্তির।
রায়ান মনে মনে নিজের পরিস্থিতিকছ উপহাস করে-

– “আমার নাম… রিভান চৌধুরী রায়ান, সেটা আমায় বউ জানে না। তবে আমার বউ… আমার কাছেই আছে… এবং এখন আমার বউ আমার থেকে নিজেকে আমার জন্যই আড়াল করছে। হায়রে হায়, বালের জীবন!”
রায়ান এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরায়ার থেকে জানতে চায়-
“এসব কিভাবে জানতে পারলে হৃদপাখি? তোমার পরিবারের কেউ মানে তোমার চাচি বা চাচা বলেছেন?”
মিরায়া নদীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাসূচক নেড়ে বললো-

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২২ (২)

“না, তারা বলেন নি। তারা চান নি আমি কষ্ট পাই তাই লুকিয়েছেন। আর আমিও চাইনি আমি জানি এটা তারা জানুক । কারণ আমি জানি তারা জানলে কষ্ট পাবে ভাববে তাদের অতীতে নেওয়া একটা সিদ্ধান্তে আমি কষ্ট পাচ্ছি।”
রায়ান আবার জিজ্ঞেস করল-
“তবে কিভাবে জানলে?”
মিরায়া রায়ানকে সেই দিনের ঘটনা বলতে শুরু করলো-
ফ্লেশব্যাক~

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here