আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৪
অরাত্রিকা রহমান
ফ্ল্যাশব্যাক~
“আমি তখন কেবল ১৫তে পা দিয়েছি। ওইদিন দুপুরে দূরের এক আত্মীয়রা এসেছিল। তাদের বিদায় দিতে যাওয়ার সময় আমি চাচিকে ডাকতে গিয়েছিলাম। বারান্দার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ চাচার কণ্ঠ শুনতে পেলাম। গলাটা ছিল খুব রাগী। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলাম।”
চাচা- শফিক রহমান রাগে গর্জে উঠলেন—
— “রোকেয়া, আমরা এটা কেমন করে পারলাম? বিয়ের দিনই ছেলেটা আমেরিকা চলে গেল, মেয়েটার ভবিষ্যৎ নিয়ে একবারও ভাবেনি। এখন মেয়েটার কী হবে?
একটু থেমে আবার বলেন,
—“আমি বুঝতেই পারছি না! ওই ছেলে রিভান, সে তো এখনও আমাদের মেয়েটার সঙ্গে বিয়ে মানতেই চাইছে না। তার মায়ের মুখে বিয়ের ব্যাপারে শুনলেই তা অস্বীকার করে।মানলাম বিয়েটা তার অনিচ্ছায় হয়েছে । তাই সে ১৭ বছর বয়সে আমেরিকায় চলে গেছে! আর মেয়েটা তখন মাত্র সাত বছরের…তবে এখন ? এখন তো চাইলেই সব ঠিক হতে পারে।”
চাচি-রোকেয়া বেগম শান্ত গলায় বললেন—
— “তুমি কেন এত উত্তেজিত হচ্ছ? তখনকার পরিস্থিতি ভেবে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। আমরা মিরার ভালোর জন্য করেছিলাম সেসব। বিয়েটা—ওটা আমাদের দায়িত্ব ছিল। অন্তত মেয়েটার মাথার উপর একটা ছায়া রাখার জন্য।”
চাচা আরো রেগে গেলেন—
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “ছায়া রাখার জন্য? হাহ! এটা ছায়া বলছ তুমি? একে ছায়া নয়, অন্ধকার বলে। একটা সাত বছরের বাচ্চা, যে জানেই না কী হচ্ছে তার সাথে—তার জীবনে বোঝা চাপিয়ে দিলাম? তুমি ভেবেছো, ও বড় হলে এটা জেনে কী করবে? তার স্বামী কে—সে-ও জানে না! শুধু নামটা রেখে দিলাম, এটাই কি ভবিষ্যৎ?”
চাচি কষ্টের হাসি হেসে বললেন—
— “সবকিছুর সময় আছে। এখন বললে মেয়েটা কষ্ট ছাড়া আর কিছু পাবে না। তুমি কি চাও, ওর শৈশবটা বিষাদে ভরে যাক? আমি চাই না মিরা ছোটবেলা থেকেই ভেঙে পড়ুক।”
চাচা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়লেন—
— “তুমি বুঝতে পারছো না, রোকেয়া। এভাবে লুকিয়ে রাখা মানে মেয়েটার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। একদিন ও নিজেই জেনে যাবে। তখন আমরা চোখে চোখ রেখে কীভাবে দাঁড়াবো?”
চাচি শান্ত স্বরে বললেন—
— “ও বড় হলে বুঝবে। তখন আমরা নিজেরাই সব বলব। এখন নয়। তাছাড়া, রিভান খারাপ ছেলে নয়। ও ফিরে আসবে, তখন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
আমি তখন দরজার আড়ালে কাঁপছিলাম। আমার পা যেন শক্ত মাটির উপর থেকেও শূন্যে ঝুলে আছে।
শুধু একটা শব্দ কানে লেগে রইল—“রিভান”।
হয়তো চাচার কণ্ঠেই শুনেছিলাম, বা হয়তো চাচির ঠোঁট থেকে—কিন্তু সেই নামটা আমার বুকের ভেতর পাথরের মতো বসে গেল।
সেদিন থেকে আমি জানেছি, আমি অন্য সবার মতো মুক্ত নই। আমার একটা নামজড়ানো সম্পর্ক আছে, যা আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
ঠিক তখনই প্রথমবার জানলাম আমি বিবাহিত।
ফ্ল্যাশব্যাক শেষ → বর্তমান
মিরায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন বুকের ভেতরের পাথরটা বের করে দিল।
তার চোখ এখনো নদীর দিকে, কিন্তু কণ্ঠে শীতল শান্তি মিশে আছে।
—“সেদিনের পর থেকে আমার ভেতরটা পাল্টে গিয়েছিল। আমার জীবনের সঙ্গে অন্য কেউ জড়িয়ে আছে। এমন এক মানুষ, যাকে আমি কোনোদিন দেখিনি, চিনি না, শুধু নামটা জানি।
রিভান…”
মিরায়ার কণ্ঠ কেঁপে উঠল। সে রায়ানের দিকে তাকাল, চোখে হালকা জল চিকচিক করছে।
—“এতগুলো বছর শুধু একটা নাম নিয়েই বেঁচে আছি। নিজের স্বামীকে না চিনে, না জেনে, কেবল সেই নামটাই আমার কাছে সত্যি ছিল। আমি কখনো কারও কাছে কিছু বলিনি। শুধু নিজেকে লুকিয়ে রেখেছি।”
রায়ান নীরবে তার দিকে তাকিয়ে ছিল। তার বুকের ভেতর যেন ঝড় বয়ে যাচ্ছে—কিন্তু মুখে অদ্ভুত শান্তি যেন বেশ আরাম পেয়েছে সব কিছু শুনে।
মিরায়া কণ্ঠ নিচু করে ফিসফিস করে বলল—
—“আজ আপনাকে সব বললাম কারণ আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছিল না। এই সত্যি আমার ভেতর অনেকদিন ধরে আগুনের মতো জ্বলছিল। আপনাকে এসব না বলা আপনাকে ধোঁয়াশায় রাখা হতো, তাই আমি চেয়েছিলাম আপনি জানুন।”
নদীর বাতাস দুজনের নিঃশ্বাসে মিশে যাচ্ছিল। দূরের জলরাশি নরম শব্দে ভেঙে পড়ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তে শুধু তাদের নীরবতা—আর মিরায়ার বুক ভরা সত্যটাই চারপাশ ভরে রাখল।
মিরায়ার মুখ থেকে সব শুনে রায়ান চুপচাপ বসে রইল। রায়ান প্রথমে একেবারে পাথরের মতো হয়ে গেল। চোখে শূন্য দৃষ্টি, বুকের ভেতর যেন হাজারটা ঢাক-ঢোল বাজছে।
সে ভেতরে ভেতরে ভাবল—
“আমার বউ… সে জানে তার বিয়ে হয়েছে, জানে তার বরের নাম ‘রিভান’। অথচ এই রিভানই আমি! আমি এখানে বসে আছি। তবু সে জানে না আমি-ই তার সেই স্বামী! হায় আল্লাহ্, এ কেমন কপাল??”
রায়ান কপাল চেপে ধরল। মনে মনে একটা থাপ্পড় নিজেকেই মারল—
“আরে বেকুব রিভান! তুই কি নামের কারখানা খুলেছিলি নাকি? একবার রিভান, একবার রায়ান—এত নাম নিয়ে এডিশন-সাবট্র্যাকশন করলে—বউ তো গুলিয়ে ফেলবেই! হায়রে আমার জীবন! এইবার খালামনির বাড়ি গেলে এই নাম রাখার জন্য কথা শুনাবো। রিভানের জায়গায় রায়ান বললে কি এমন হতো।”
তার মনে হচ্ছিল—
“এই মুহূর্তে যদি মাটির নিচে ঢুকে যাই, তবুও শান্তি পাবো না। মানে, আমার বউ আমাকে তার কাছে যেতে দিচ্ছে না আমার জন্য! এটা কি কমেডি নাকি ট্র্যাজেডি? ”
রায়ান চোখ নামিয়ে চুপচাপ বসে থাকল, কিন্তু ভেতরে ভেতরে তার অবস্থা এমন—
যেন সে এখনই কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে নদীর বালির ওপর গড়াগড়ি খাবে।
তার মনে হচ্ছিল, কেউ যদি দূর থেকে দেখে তবে ভাববে—“একজন যুবক তার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ হাস্যকর নাটক মঞ্চস্থ করছে।”
সে আবার ভাবল—
“আমার হৃদপাখি এখানে বসে বুক ভেঙে কাঁদছে, আর আমি তার পাশে বসে বউ-ইন-ডিসগাইস-এর রহস্য সমাধান করছি। হায়রে রায়ান, তোর কপাল যে মশারির বাইরে থাকা মশার চেয়েও খারাপ!”
রায়ান মুখে কিছু বলল না, কিন্তু মনের ভেতরে নিজের কণ্ঠে এক মহা-বিলাপ বাজছিল—
“হায় খোদা, কি কপাল আমার!
বউ জানে ওর বিয়ে হয়েছে, আমি জানি আমি বিয়ে করেছি—
কিন্তু মুশকিল হলো, নামে!
এই ঘটনা যদি টিভি-সিরিয়ালে দেখাত, নাটকের নাম, “আমার বউয়ের বর আমি-ই”—
আমি হোতাম সবচেয়ে করুণ নায়ক, কিন্তু দর্শকদের কাছে সবচেয়ে বড় কমেডি পিস! ওই শোয়ের জোকার!”
রায়ান মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
“কী দোষ আমার!
আমার নাম যদি হতো ‘আব্দুল করিম’, তাহলে কি আমার বউটার নিজের বরের এমন নাম গুলিয়ে যাওয়ার ঝামেলা হতো?
কখনো না!
কিন্তু না, নাম হলো রিভান চৌধুরী রায়ান—
এমন নাম শুনলেই তো নাটকের তিন সিজন বানানো যায়!”
হঠাৎ রায়ানের মাথায় প্রশ্ন ঘুরতে লাগলো- “আচ্ছা মিরা যদি সত্যি টা জানে কখনো। জানাতে তো আমাকে হবেই । তখন মিরা কি করবে?
রায়ান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ গলা খাঁকারি দিল, যেন খুব দার্শনিক প্রশ্ন করতে যাচ্ছে—
“আচ্ছা হৃদপাখি… যদি… সেই লোক মানে তোমার ‘বর’ হঠাৎ একদিন সামনে এসে দাঁড়ায়, তখন তুমি কী করবে? তার সঙ্গে সংসার করবে? নাকি…”
রায়ান ভেতরে ভেতরে গম্ভীর মুডে নিজেই নিজের ব্যঙ্গ করছিল—
“আরে বাপরে, মানে..নিজের বউকেই জিজ্ঞেস করছি আমার বউ আমাকে বিয়ে করে সংসার করবে কি না! আহারে জীবন, তুই কি রঙ্গশালা নাকি!”
মিরায়া একটু থেমে, নদীর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
তার কণ্ঠ কাঁপছিল—
“জানি না… সত্যি বলছি, জানি না কী করব। সে আসবেও কিনা জানি না। তবে… ভালো কিছু হবে বলে মনে হয় না।”
রায়ান ভেতরে ভেতরে হাঁফ ছাড়ল—
“ভালো কিছু হবে না মানে? আমি যদি এখন বলি আমি-ই সেই রিভান, তাহলে হতে পারে ও আমার সাথে সংসার করবে! … হ্যাঁ, মাঝেমধ্যে হয়তো মাথায় বেলন উড়ে আসবে, কিন্তু তাও সংসার তো হবে!”
মিরায়া হালকা গলায় যোগ করল—
“তবে… যদি আসে, আমি তাকে অনেক প্রশ্ন করব। কেন আমাকে ফেলে চলে গিয়েছিল? কেন কোনোদিন খোঁজ নেয়নি? কেন এত বছর আমার অজানায় রেখেছে?”
রায়ান ভেতরে ভেতরে নিজের চুল ছিঁড়ে ফেলতে চাইলো—
“এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেওয়ার জন্য তো আমাকেই দাঁড়াতে হবে!
মানে, আমার বউ-ই আমার কাছে এসে আমাকে জেরা করবে, আর আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কোর্টের আসামির মতো সাফাই দিবো। কিন্তু কি বলব—
‘জজ সাহেবা, আসলে ফ্লাইট মিস হয়েছিল…
আচ্ছা না, গিয়েছিলাম একটু আমেরিকা ঘুরতে…
আচ্ছা না, আসলে নামের গোলমাল!’
উফ্! মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে!”
সে বাইরে অবশ্য মুখ গম্ভীর করে শুধু মাথা নাড়ল।
কিন্তু ভেতরে মনে হচ্ছিল, এখন যদি গড়াগড়ি খেয়ে চেঁচিয়ে বলতে পারত—
“হৃদপাখি! ওই রহস্যময় বর অন্য কেউ নয়, আমিই! আমিই তোমার স্বামী যার অপেক্ষা করছো তুমি। সংসার করতে হলে আমার সাথেই করতে হবে! না করতে চাইলেও আমার সাথেই করতে হবে!”
রায়ান তাও আবার জিজ্ঞেস করল দৃঢ় কন্ঠে –
“শুধু প্রশ্নই করবে তাকে?”
মিরায়া রায়ানের দিকে না তাকিয়ে নদীর পাশে চোখ রেখে বলল-
“উঁহু! প্রশ্ন করার আগে, তার মাথায় এক বালতি পানি ঢালবো আমাকে ছেড়ে যাওয়ার জন্য। এর বেশি কিছু করতে চাই না কারণ আমার জানা অনুযায়ী তার বয়স ও বেশি ছিল না তবে আমার থেকে অনেক বড় ছিলেন। সেই হিসেবে বোঝার ক্ষমতাও বেশি হওয়া উচিত। তাই না?”
রায়ান এক বালতি পানি ঢালার কথা শুনে-
“নাউজুবিল্লাহ!” বলে কাশতে থাকে ।
মিরায়া হকচকিয়ে রায়ানের দিকে তাকিয়ে রায়ানের মাথায় হাত ডলতে ডলতে বলে-
“আপনার আবার কি হলো? পানি খাবেন?”
রায়ানের যেন ‘পানি’ শব্দের আতঙ্ক হয়ে গেছে । সে সাথে সাথে চুপ করে গিয়ে মাথা নাড়ায় ডানে বামে। মিরায়া ও রায়ানের মাথা থেকে হাত নামিয়ে নেয়।
রায়ান নিজের আবেগ সামলে হঠাৎ উঠে দাঁড়াল।
তার চোখে হাস্যকর হতাশা আর একই সাথে নরম কোমলতা—এক ধরনের “আমি আর সহ্য করতে পারছি না, তবে তোমার জন্য সব ঠিক আছে” মিশ্রণ।
রায়ান মিরায়ার দিকে হাত বাড়িয়ে, গভীর কণ্ঠে বলল—
“বেইব, ইটস টাইম টু গো হোম। আর এসব শুনতে ইচ্ছা করছে না।”
মিরায়া কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে রইল। তার চোখে অবাক ভাব আর অল্প আতঙ্ক-
“সব জানার পরও আপনি এখনো কি সব নামে ডাকছেন আমাকে?”—হালকা চটচটে ভয় আর বিস্ময় মিলিয়ে মৃদু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
রায়ান বাঁকা হেসে কোনো উত্তর দিল না। বরং এক মুহূর্তের মধ্যেই হঠাৎ মিরায়াকে বসা অবস্থা থেকে সরাসরি কোলে তুলে নিল।
মিরায়া চমকে উঠল, মুহূর্তে দু’হাত দিয়ে রায়ানের গলা আঁকড়ে ধরল। পড়ে যাওয়ার ভয় তার শরীর কাঁপিয়ে দিল।
রায়ান মিরায়াকে কোলে নিয়ে তার কানে ধীরে ধীরে বলল—
“কি সব-এর কথা বলছো হৃদপাখি? তোমার বিবাহিত হওয়ার কথা?”
মিরায়ার চোখে বিস্ময়, গলায় কেঁপে ওঠা হাওয়া, আর তবুও অদ্ভুত নিশ্চয়তা—উপর-নিচ মাথা নাড়িয়ে এক অল্প কণ্ঠে হ্যাঁ বলল—
“হুম…”
রায়ান হেসে তার মাথায় নিজের কপাল দিয়ে হালকা টোকা দিল, যেন বলছে—“সব ঠিক আছে।”
“আই ডোন্ট কেয়ার এবাউট দ্যাট, বেইবি।”
মিরায়া স্তব্ধ হয়ে তার দিকে তাকিয়ে রইল। চোখে বিস্ময়, হৃদয় একটু দ্রুত ধাক্কা খাচ্ছে, আর মনে হচ্ছিল—এই মানুষটা বেছে নেবে আমার সব সময়, সব রহস্য, আর আমাকে ঠিকই সুরক্ষিত রাখবে- কিন্তু কেন!
রায়ান মিরায়ার অবাক-অস্থির চোখ দেখেই আরও হেসে উঠল, মুখে সেই দুষ্টু বাঁকা হাসি—
“অবাক হওয়ার কিছু নেই, হার্ট-বার্ড।
নিজের বউ ইজ ওকে,
বাট অন্যের বউ… হিটস ডিফারেন্ট।
ইউ নো?”
কথাটা শেষ করেই মিরায়ার দিকে চোখ মেরে দুষ্টু ইশারা করলো।
মনে মনে রায়ান হেসে ফেলল আর বিরবির করল-
“যদি ওই অন্য কেউটা আমি-ই হই…তাহলে অন্যের বউয়ে আমার খুব ইন্টারেস্ট।”—ভাবতেই কপাল সব চিন্তার ভাঁজ যেন চলে গেল এক অদ্ভুত শান্তি কাজ করছে, নদীর ধারের শীতল হাওয়া শরীরকে যেন আরো ফুরফুরে করে তুললো।
রায়ান কল্পনা করে নিজেকে ‘তার বউয়ের স্বামী হিসেবে যাকে ঠকাবেনা বলে তার বউ নিজের স্বামীকেই বাঁধা দিচ্ছে কাছে আসতে’ ভাবতে গিয়ে নিজের দোষারোপ আর হতাশা এমন হাস্যকর লাগছিল যে সত্যিই চোখ বন্ধ করে হেসে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছিল তার।
রায়ান হেসে মিরায়াকে কোলে নিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করল।
মিরায়া এখনও হতবাক, চোখ বড় করে তাকিয়ে বলে উঠল—
“রায়ান ভাইয়া, নামান! পড়ে যাব আমি… হাঁটতে পারব আমি নামিয়ে দিন!”
তারপর দুইবার বাইসেপস টানল মিরায়ের শরীর হাতে নিয়ে, যেন ওজন তুলছে, আর মিরায়ার শরীর শক্ত করে নিজের কোলে ধরে রাখল।
রায়ান কেবল হেসে বলল—“যেইনা শরীর তোমার, আবার ভাবছো আমার কোল থেকে পড়ে যাবে? হাহ!”
গাড়ির দিকে পৌঁছে রায়ান আস্তে করে মিরায়াকে সিটে বসাল। মিরায়া এখনও অবাক, কিছুটা লজ্জিত, কিছুটা আতঙ্কিত। চোখের কোণ দিয়ে রায়ানকে বিড়াল ছানার মতো খেয়াল করছে—কীভাবে হঠাৎ এত সাহস পেল?
রায়ান গাড়িতে বসে ইঞ্জিন স্টার্ট করল।
দূরে নদীর নীরবতা ভেঙে হালকা বাতাসের সঙ্গে গাড়ির হালকা আওয়াজ মিশে গেল।
মিরায়া অনুভব করল—এই মানুষটা সব জানে, সব দেখেছে, এবং হাস্যকর হলেও নিজের ভাবমূর্তিতে এক অদ্ভুত নিশ্চয়তা নিয়ে তার পাশে রয়েছে।
রায়ান মনে মনে হেসে বলল, “হায় হায়, নিজের বউ আমার কোলে, আর আমি জানি—আমি যে বিবাহিত সেটা সে জানে না। কী কপাল, কী ফানি অবস্থা!”
হঠাৎ তার হালকা হাসি মিরায়ার দিকে তাকিয়ে আরও প্রাণবন্ত হয়ে উঠল।
আর এভাবেই গাড়ি বাড়ির দিকে রওনা হলো, নদীর নীরবতা আর রাতের হাওয়া দুইজনের মধ্যে শান্তি আর হাস্যরসের মিশ্রণে ভেসে চলল।
চৌধুরী বাড়ি ~
রাতের অন্ধকার চৌধুরী বাড়ির আঙিনায় নেমে এসেছে অনেক আগেই। ঘড়ির কাঁটা তখন ৮টার ওপরে। আকাশে হালকা কুয়াশা, আর বাইরে বাতাসে নদীর ধীর শব্দ ভেসে আসছে। এই শান্ত পরিবেশের মধ্যেও বাড়ির ভেতরে উত্তেজনার ঢেউ বয়ে যাচ্ছে।
রুদ্র বাড়ির সামনে এসে গাড়ির ব্রেক কষে। মনে একরাশ অদ্ভুত রকমের চিন্তা – না জানি ভেতরে ঢুকেই কি কি শুনতে হবে আজ। নিজের অবাধ চিন্তা নিজের মাঝে রেখেই সে বাড়ির ভেতরে পা বাড়ালো।
ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে রুদ্র চোখে স্বাভাবিক শান্তি ধরে রাখার চেষ্টা করল, কিন্তু রামিলা চৌধুরী যেন তারই বাড়ি ফেরার অপেক্ষায় বসে ছিলেন। চোখে রাগ, কণ্ঠে কঠোরতা—যেমন মনে হচ্ছে, রুদ্র যদি ভয় নাও পায়, তিনি তার ভয় নিজে তৈরি করে দেবেন।
রামিলা চৌধুরী সোফায় বসেই রাগি গলায় চেঁচিয়ে উঠলেন-
“রুদ্র! তুই কোথায় ছিলি জানতে চাইছি না আমার সেটা নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই। রায়ান আর মিরা কোথায়?!”—রামিলার প্রশ্নে কাঁপা কণ্ঠের মধ্যে রাগ আর উদ্বেগ মিলেমিশে আগুন লাগা শব্দ বেরোচ্ছিল।
রুদ্র শান্তভাবে বোকা হেসে কাঁপা গলায় বলল—
“আম্মু, চিন্তা কোরো না। আমি কল করেছিলাম। ওরা আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।”
কিন্তু রামিলার রাগ রোধ করা সম্ভব হলো না। তিনি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয়ে ড্রয়িং রুমের মাঝখান থেকে চেঁচিয়ে উঠলেন—
“এটা কি কোনো ভদ্রলোকের বাড়ি। যে যখন যা ইচ্ছা করবে! এই সব ভেঙে দিচ্ছে, আবার ঘুরতে চলে যাচ্ছে, কোনো পরোয়া নেই! তোরা যা খুশি কর। আমি আর কিছু বলতে চাই না।”
এই বলে তিনি নিজের রুমের দিকে চলে গেলেন। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ এতটা কঠোর ছিল যেন পুরো বাড়ি কম্পিত হয়ে উঠল। রুদ্র এক দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
ড্রয়িং রুমের কোণে দাঁড়িয়ে সোরায়া অবাক হয়ে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইল। তার চোখে মিশে আছে বিস্ময়, কৌতূহল আর অল্প অল্প আতঙ্ক।
“রুদ্র ভাইয়া,”—সে ধীরে ধীরে বলল—“কে কি ভেঙে ফেলল? আর কে কাকে নিয়ে ঘুরতে চলে গেল? আর আপু বাড়ি ফেরেনি কেন? আমার কতো কিছু বলার আছে আপুকে। আপু কখন আসবে তুমি জানো?”
রুদ্র তার চোখে হালকা হাসি আর কপালে ভাঁজ নিয়ে সোরায়ার মাথায় হাত রাখল। চুল খানিকটা কষে ধরল যেন সবকিছু শান্ত করার চেষ্টা করছে।
“সোরা বনু, দেখ, আমার এখন আর ভালো লাগছে না। কিছুই জিজ্ঞেস করিস না।”
ড্রয়িং রুমে হঠাৎ এক ধরনের নীরবতা নেমে এলো। বাতাসে ভাসছে রাতের ঠাণ্ডা, আর রুমের কোণে চোখ বন্ধ রেখে, রুদ্র মনে মনে ভাবল—
“আজকের দিন… ওরা সবাই নিজের মতোই ছড়িয়ে আছে। আর আমি যেন শুধু পর্যবেক্ষক।”
সোরায়া বিস্ময়ের চোখে রুদ্রকে দেখল। তার বিস্ময় বুঝতে পেরে রুদ্র কেবল হালকা কাঁপানো হাসি দিয়ে মাথা নাড়ল। রুদ্র নিজের গা এলিয়ে দিলো সোফার উপরে। সোরায়া ও রুদ্র রং পাশে ধস করে বসে পরলো। দুজনই তখন এক মনে রায়ান আর মিরায়ার বাড়ি ফেরার অপেক্ষায়।
সময় ৮.৩০ মিনিট~
রায়ান গাড়ি চৌধুরী বাড়ির সদর দরজার সামনে আসতেই হালকা ব্রেক কষল। গাড়ির ইঞ্জিন ধীর হয়ে গেল, বাতাসে রাতের শান্তি ভেসে উঠল। রায়ান গাড়ি থামিয়েই মিরায়ার দিকে তাকাল। তার চোখে একধরনের মৃদু হাসি, আর মনে মনে অদ্ভুত উত্তেজনা।
রায়ান গাড়ি থেকে নেমে মিরায়ার দরজা খুলে-
“বেইব… কাম আউট, উই আর হোম,” সে বলল, হাত বাড়িয়ে মিরায়ার দিকে।
মিরায়া কিছুটা অবাক, চোখ বড় করে তাকিয়ে মনে মনে ভাবছে, “সব জানার পরও এই মানুষটা এখনো কি সব নামে ডাকছে আমাকে? তাও এত স্বাভাবিক যেন কিছু হয়ইনি।”
মিরায়া রায়ানের হাতে হাত দিয়ে গাড়ি থেকে নামে।
দুজন নরম ধাপে চৌধুরী বাড়ির দিকে এগোল। রায়ান তার পাশে দিয়ে হাঁটতে লাগল, মৃদু হেসে মিরায়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
দু’জন ধীরে ধীরে বাড়ির প্রধান দরজার দিকে পৌঁছাল। বাড়ির দরজা এখনো খোলাই। ঠিক তখনই, ড্রয়িং রুমের পেছনের দরজা থেকে জুলিয়েট হালকা কদমে মিউ করে মুল দরজার সামনে চলে গেল। সে একধরনের রহস্যময় উপস্থিতি, যেন ভেতরে ছায়ার মতো ভেসে বেড়াচ্ছে। সোরায়া কেবল অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল, আর রুদ্র শান্তভাবে দেখল।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই ঘরটা শান্তি এবং উষ্ণতায় ভরে উঠল। মিরায়ার চোখ সরাসরি ছোট্ট জুলিয়েটকে খুঁজে পেল। জুলিয়েট মুল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, মায়ের জন্য অপেক্ষা করছিল। মিরায়ার পায়ে হালকা ছন্দ, চোখে মমতা—সব মিলিয়ে রায়ানের মনমাঝে মুগ্ধকর ভাবনার ঝড় তুলল।
মিরায়া মৃদু হেসে জুলিয়েটকে কোলে নিল—রায়ানের চোখে মুগ্ধতা আর হিংসার মিশ্র অনুভূতি। মিরায়া জুলিয়েটকে কোলে তুলে আদর করল, অসংখ্য চুমু দিল, নাম ডাকল—“আমার সোনা বাচ্চা, আমার লক্ষ্মীটিয়া, আমার মাম্মা… ডিড ইউ মিস মি? মাম্মা সরি দেরি করে ফেরার জন্য।”
রায়ান পেছন থেকে এই দৃশ্য দেখছিল। সে ও জুলিয়েট কে মনে মনে বলল- “পাপা ইজ অলশো সরি বেইবি। মাম্মাকে লেইট করানোর জন্য।”
তার মনের মধ্যে মুগ্ধতা, খুশি, আর হালকা হিংসা—সব মিলেমিশে এক অদ্ভুত মনোমুগ্ধকর অবস্থায় রূপ নিল। মনে মনে সে মিরায়ার উদ্দেশ্যে বলল,
“নিজে এক বাচ্চা আবার রাস্তা থেকে একটা বিড়াল ছানা এনেছে। মনটা চায় একদম আদরে আদরে নাজেহাল অবস্থা করে নিজের বুকে লুকিয়ে রেখে দেই। এতো আদুরে মানুষ হয়। অসহ্যকর!”
মিরায়া রায়ানের দিকে পিছন ফিরে তাকালো। রায়ানও মিরায়ার দিকে তাকালো। দুজনের চোখাচোখি হতেই মিরায়া লজ্জায় চোখ সড়িয়ে সামনের দিকে তাকায়।
ড্রইংরুমের সোফায় বসা রুদ্র ও সোরায়া কিছুক্ষণ চুপচাপ অবস্থান করছিল। চোখে প্রশ্নের ঝলক, মনে নানা কৌতূহল। সোরায়া ধীরে ধীরে রুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল, “রুদ্র ভাইয়া, ওরা ঠিক কোথায় ছিল, সব ঠিক আছে তো?”
রুদ্র হালকা করে কাঁধ টিপে, মৃদু হেসে উত্তর দিল, “সব ঠিক আছে, সোরা। চিন্তা করিস না। ওরা আমাদের সঙ্গে আছে, এখন আর কোনো ঝামেলা হবে না।”
সোরায়া মিরায়ার কাছে দৌড়ে যায় আর তাকে আজকের দিনের ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবে।
সেই সময়ে চৌধুরী বাড়ির মাস্টার বেডরুমের দরজা ধীরে ধীরে খুলল। দরজা খুলতেই রায়হান চৌধুরী ধীরে ধীরে বেরিয়ে এলো। তার উপস্থিতি দেখার সঙ্গে সঙ্গে রায়ান ও মিরায়ার চোখ বড় হয়ে গেল। মুহূর্তের জন্য তারা সামান্য অবাক হয়ে একে অপরের দিকে চেয়েছিল, যেন বলতে চাইছিল, “আচমকা বাবা?”
মিরায়া ভয় ও শ্রদ্ধার মিশ্র অনুভূতিতে বলল, “আসসালামুয়ালাইকুম বাবা। কেমন আছো? কখন এলে?”
রায়হান চৌধুরী মৃদু হাসি দিয়ে উত্তর দিলেন, “এই মা সন্ধ্যায় এসেছি। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?”
মিরায়াও মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ালো, “হুম বাবা, আমিও ঠিক আছি।”
হঠাৎ করেই রায়হান চৌধুরীর নজর পড়ল রায়ানের দিকে। রায়ান তখন স্বাভাবিকভাবে বাবার দিকে তাকিয়ে ছিল না; সে মিরায়ার সঙ্গে কথোপকথন, বন্ধুসুলভ আচরণ সব খেয়াল করছিল। ঠিক সেই সময়ে রায়ানের চোখ পড়ল বাবার চোখের দিকে। হকচকিয়ে সে সালাম জানাল—“আসসালামু আলাইকুম আব্বু।”
রায়ানকে মৃদু করে আদেশ করলেন রায়হান চৌধুরী, “ওয়ালাইকুম আসসালাম। রায়ান, আমার সঙ্গে আমার রুমে এসো। তোমার সঙ্গে কিছু কথা আছে।”
ড্রইংরুমে মিরায়াও, রুদ্রও, সোরায়াও এক মুহূর্তের জন্য অবাক হয়ে একে অপরের দিকে তাকাল। সবাই বুঝতে পারছিল যে, রায়হান চৌধুরী রায়ানের সঙ্গে রুমে গিয়েই গুরুত্বপূর্ণ কিছু কথা বলবে।
রায়ান স্বাভাবিকভাবে সামান্য ভয় অনুভব করলেও হাতের কোর্টটা মিরায়ার কাঁধের উপর রাখল। চোখে অদ্ভুত এক ধরণের মিশ্র ভয় আর নিশ্চয়তা। মিরায়ার চোখে সামান্য বিস্ময়, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
রায়হান চৌধুরী রায়ানের কাজটা খেয়াল করল তবে কিছু বললেন না। তিনি পিছন ফিরে নিজের রুমের দিকে হেটে গেলেন, আর রায়ানও পিছনে পিছনে হাঁটল তার সাথে। ধীরে ধীরে দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ ড্রইংরুমে ভেসে এলো।
রুমের দরজা বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মিরায়া, রুদ্র এবং সোরায়া এখনো অবাক দৃষ্টিতে সেই দিকে তাকিয়ে রইল। চেয়ার কিংবা সোফার পাশে দাঁড়িয়ে তাদের চোখে মিশ্র বিস্ময়, কৌতূহল এবং সামান্য চিন্তার ছাপ।
কেউ কিছু বলল না। কেবল নীরবতা। কিন্তু সেই নীরবতার মধ্যেই তারা সবাই বুঝতে পারছিল—রায়ানের সঙ্গে রায়হান চৌধুরীর কথোপকথন সহজ হবে না, এবং সেই মুহূর্তটা ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
বেডরুমে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গে রায়ান সামান্য নীরব হয়ে দাঁড়ালো। রুমের ভিতরে রায়হান চৌধুরী পেছনের দিকে ফিরে, পিছন থেকে হাত বাধা অবস্থায় রায়ানকে উদ্দেশ্য করে ধীরে ধীরে বললেন,
“তোমার আম্মু বললেন, তুমি নাকি ডিভোর্স পেপারস রেডি করেছ। মুক্তি চাইছো এই সম্পর্কটা থেকে। আমি ও তোমার মা ভেবে দেখেছি—জীবনটা তোমার, সিদ্ধান্ত নেওয়ার সম্পূর্ণ অধিকার তোমার আছে। তোমার খালা-খালুকেও এই ব্যাপারে জানানো হয়েছে। তাদের এই ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই। তারা চাইবেন না মিরা এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে থাকুক আমরাও চাই না। তুমি চাইলে ডিভোর্স নিতে পারো, মিরাকে এ বিষয়ে কিছু জানানো হবে না। শুধু পেপারটায় সাইন নিয়ে নেওয়া হবে। আশা করি এবার খুশি হয়েছো।”
রায়ান হালকা অবাক হয়ে ভেতরে কিছুক্ষণ দাঁড়ালো। সে জানত না যে মিরায়ার চাচা ও চাচিকে এ ব্যাপারে জানানো হয়েছে—এমনটা সে চায় নি, কিন্তু পরিস্থিতির চাপে বোঝা যাচ্ছে ইতিমধ্যে সেটাই হয়ে গেছে। হালকা মাথা নেড়ে সে ভাবল, “ইগো ধরে রাখার কোনো মানে নেই। আমি চাই বউকে, সংসার করতে চাই তার সঙ্গে। আমার হৃদপাখি, শুধু আমার শুরু থেকে শেষ অব্দি।”
রায়ান স্পষ্ট গলায় উত্তর দিল,
“আমি মিরাকে ডিভোর্স দেব না। ও আমার বউ হয়েছিল, আর বউ হয়েই থাকবে।”
রামিলা চৌধুরী এবং রায়হান চৌধুরী দুজনেই এই সিদ্ধান্ত শুনে অবাক হলেন। রায়হান চৌধুরী সামান্য এগিয়ে এসে রামিলা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন,
“রামিলা, তোমার ছেলেকে বলে দাও—আমার একটা মান-সম্মান আছে। ওর কথা রাখতে আমি নিজেই সব মান সম্মান বিসর্জন দিয়ে রোকেয়া আপা আর শফিক ভাইয়ের কাছে ডিভোর্সের কথা বলেছি। তারা রাজিও হয়েছে। এখন এসব কি বলছে ও?”
রায়ান এক চমৎকার দৃঢ়তার সঙ্গে মৃদু হাসি দিয়ে বলল,
“আম্মু, যা বলছে, তা স্পষ্ট এবং পরিষ্কার ছিল। আর এখন আমি যা বলছি সেটাও। আমি আমার বউকে ছাড়ছি না—শেষ নিঃশ্বাস অবধি না। আমি ওকে চাই, যে কোনো মূল্যে হোক।”
রায়হান চৌধুরী সামান্য হেসে প্রশ্ন করলেন,
“এত বছর তো তোমার বউকে লাগেনি, এখন কেন লাগবে, শুনি?”
রায়ান স্বাভাবিক কিন্তু দৃঢ় গলায় উত্তর দিল,
“ তোমার আম্মুকে যেসব কারণে লাগে, আমার বউকেও আমার সেসব কারণে লাগবে।”
রামিলা চৌধুরী ও রায়হান চৌধুরী দুজনই হতবাক হয়ে গেলেন। তারা ছেলের মুখে এমন ঠোঁটকাটা কথা আশা করেন নি। বোঝা দায় এই ছেলে আর দুইদিন আগে ডিভোর্স চাওয়া ছেলে এক।
রায়ান আরো বলে-
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৩
” আমি আমার বউকে ছাড়বো না কারণ ও আমার। ও আমার বউ, ও আমার জীবনের অংশ। আমি মরে গেলেও ওকে ছাড়বো না।”
রামিলা চৌধুরী ও রায়হান চৌধুরী দুজনই চোখে অবাকির মিশ্রণ নিয়ে রায়ানের দিকে তাকাল। রায়ানের চোখে শান্ত কিন্তু অদম্য দৃঢ়তা, চরম প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং মিরায়ার প্রতি নিঃশর্ত আসক্তি স্পষ্ট। তার শরীরের ভঙ্গি থেকে বোঝা যাচ্ছিল—এখন আর কোনো আপত্তি বা প্রলোভন তাকে থামাতে পারবে না।
রায়ানের দৃষ্টিতে মিরায়া যেন শুধু একজন মানুষ নয়; সে তার জীবনের সমস্ত, তার পরিবার, তার আনন্দ, তার শান্তি। আর এখনই সে প্রতিজ্ঞা করেছে—মিরায়াকে ছাড়বে না।