আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৬

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৬
অরাত্রিকা রহমান

রায়ানের রুম ~
রায়ান ফ্রেশ হয়ে নিজের বিছানায় চোখ বন্ধ করে শরীরটাকে একটু বিশ্রাম দিচ্ছে। হঠাৎ করেই রায়ানের ফোনটা বেজে উঠল। রায়ান বিরক্তি নিয়ে চোখ বন্ধ রেখে, ফোনটা কে করেছে না দেখেই রিসিভ করে কানে ধরে বলল-
“আই এম বিজি। কল মি লেইটার।”
অপর পাশ থেকে মাহির তুচ্ছ স্বরে বলল-
“আরে রাখ তোর বিজিনেস! ইম্পর্ট্যান্ট কথা আছে আমার।”
রায়ান চোখ কচলে ফোটা কান থেকে চোখের সামনে আনতেই দেখলো মাহির কল করেছে। রায়ান হাওয়ায় হাঁফ ছেড়ে দিয়ে আবার ফোনটা কানে নিয়ে বলল-
“কি বলবি বল। আমি ক্লান্ত। মোড নেই তোর বাজে কথা শোনার। সো, ইউর ইম্পর্ট্যান্ট টোক ব্যাটার বি ইম্পর্ট্যান্ট ইনাফ।”

মাহির-“কেন? তোর কি হলো আবার? বউ পাত্তা দিচ্ছে না বুঝি?” কথাটা বলেই মাহির জোরে হাসতে লাগলো।
রায়ান বিরক্তি নিয়ে নিজের মাথার চুল হালকা টেনে বলল-
“ওই শালা ওই! তোরে বলছি বউ পাত্তা দিচ্ছে না? ফালতু কথা বলবি না একদম আমার বউকে নিয়ে।”
মাহির একটু হেঁয়ালি করে-
“ওই, শালা ডাকস কারে? আমার তোর বউয়ের ভাই হওয়ার কোনো ইচ্ছা নাই, তার বোন জামাই হইতে পারি সে চাইলে। কথা বলে দেখ।”
রায়ান-“হাহ! বোন জামাই মাই ফুট। তোকে আমি আমার শালির আসে পাশেও আসতে দিবো না।”
মাহির-“আসে পাশে যাইতে দেওয়া লাগবে না, আগে পিছে যাইতে দিস। তাহলেই হবে।”
রায়ান রাগে রো রো করতে করতে বললো- “শালা লুচ্চা!”
মাহির-“তোর থেকে কম আছি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

রায়ান হাত দিয়ে একবার মুখ মুছে বলল-
“মাহির দেখ, আমার সত্যি ইচ্ছা নেই এখন তোর সাথে লাগার। এইসব তোর ‘ ইম্পর্ট্যান্ট টোক ‘ হলে ফোন রাখ।”
মাহির এবার মজা বাদ দিয়ে বলল-
“আচ্ছা শোন, জোক আসাইড। আমি সত্যিই ইম্পর্ট্যান্ট কিছু বলবো বলেই কল দিয়েছি।”
রায়ান-“বলতে থাক। শুনছি।”
মাহির-“তোকে না বলেছিলাম এই মাসেই বড় একটা বাইক রেস আছে। তুই তো কিছু জানালি না।”
রায়ান-” হ্যাঁ,তো জানানোর কি আছে! তুই ভালো করেই জানিস- আই এম অবসেসড ওভার রাইডিং, তাও জিজ্ঞেস করছিস কেন? নেইম এন্ট্রি করিয়ে রাখ। আই এম ইন।”
মাহির-“আরে, সেটার জন্য না। নাম তো এন্ট্রি করেছি দুজনেরই। কিন্তু তোর তো বাংলাদেশে কোনো স্পোর্টস বাইক নেই। রেসটা করবি কি দিয়ে?”

রায়ান মাহিরের কথায় যুক্তি খুঁজে পেয়ে বলল –
-“ওহ্! তাই তো। এক কাজ কর, কাল তুই তোর কলেজ শেষে দেখা করতে পারবি বিকেলের দিকে, একসাথে গিয়ে বাইক কিনে নিব যেটা ভালো মনে হবে।”
মাহির একটু ভাব নিয়ে বলল-
“বড় লোকস!”
রায়ান-“বড় লোকি কোথায় দেখলি তুই।”
মাহির-” এইযে এক সেকেন্ড ডিসিশন নিয়ে নিলি বাইক কেনার। টাকার গরম না থাকলে কি আর এমন হয়?”
রায়ান হেঁসে বলল-
“আই ক্যান বাই আ হোল শোরুম। অ্যান্ড ইয়েট, উই আর টোকিং এ্যাবাউট আ বাইক।”
মাহির বাঁকা হেঁসে বলল-

“বড়ো লোকস হয়েই বা লাভ কি যদি বন্ধু রে নিজের শালিই না দিতে পারলি।”
রায়ান বিরক্তি নিয়ে চিৎকার করলো-
“মাহিরের বাচ্চা! চড়ুই পাখির থেকে নজর সড়া। ও আমার শালি বাদে বোনও।”
মাহির বলল- “বাহ্! ভালোই তো। নিজের বোনটার নাম্বার টা দিয়ে দে। তাহলেই তো লেটা চুকে যায়।”
রায়ান রেগে-
“শালা লুচ্চা, ফোন রাখ তুই। কালকে তোর খবর আছে।”
এই বলেই রায়ান মাহিরের মুখের উপর ফোন কেটে দিয়ে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলল। আর মাহিরও রায়ানকে রেগে যেতে দেখে জোরে হেঁসে উঠলো।

রাত~৯.৩০
রায়ান বিছানায় বসে ল্যাপটপে মেইল চেক করছিল। তার ম্যানেজার কালকের দিনের সিডিউল পাঠিয়েছে। নিজের অফিসিয়াল কাজ গুলো গুছিয়ে নিয়েই সে একবার আমেরিকায় তার অফিসের আপডেট নিয়ে নেয় ।
কাজ শেষে রায়ান একটু উঠে হাত পা ছড়াতেই তার চোখ যায় ঘড়িতে। ওমনি তার মাথায় এলো- যে সে মিরায়াকে ফ্রেশ হয়ে তার রুমে আসতে বলেছিল তবে মিরায়া এখনো আসে নি। রায়ান মনে মনে বিরবির করল-
“মানলাম মেয়ে মানুষের সময় লাগে ফ্রেশ হতে তাই বলে এতোক্ষণ!”
তারপর আবার কিছু সময় অপেক্ষা করে বলল-

“শয়তান বউ কপালে জুটেছে আমার একটা কথা শুনে না। শুধু রুমেই তো আসতে বলেছিলাম। একবার নিজের করে পাই শুধু রুমে- সাত দিনের আগে দরজাই খুলবো না।”
এই বলে সে রেগে তিরতির করতে নিজের রুম ত্যাগ করে মিরায়ার রুমের দিকে পা বাড়ালো। রায়ান মিরায়ার রুমের দরজায় এসে থামলো।
তবে মিরায়ার অনুমতির কোনো প্রয়োজনীয়তা না মনে করেই মিরায়ার ঘরের দরজা খুলে ঢুকে গেল। কিন্তু ঘর তো খালি। রায়ান অবাক হয় মিরায়া কে রুমে না দেখে মনে মনে ভাবলো-
“ওকি এখনো শাওয়ার নিচ্ছে? কই কোনো আওয়াজ তো নেই ওয়াশ রুমে। তাহলে কোথায় গেল?”
রায়ান মিরায়ার ঘরে এক মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে রুম ত্যাগ করতে উদ্যত হতেই সোরায়া লাফাতে লাফাতে মিরায়ার ঘরে প্রবেশ করলো। হঠাৎ রায়ানকে দেখে সোরায়া আচমকা চেঁচিয়ে উঠলো –

“ওহ্ মা গো!”
রায়ানও সোরায়ার উপস্থিতি ও চেঁচানোতে কেঁপে উঠলো যেন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছে।
সোয়ারা এবার রায়ানের দিকে তাকায় আর সাথে সাথে বলে-
“ওহ্! রায়ান ভাইয়া তুমি।
এখানে কেন? আপুকে খুজতে এসেছ বুঝি?” লাজুক হেসে।
রায়ান হেঁসে মাথা নাড়িয়ে সোরায়ার দিকে হেলে বলল-
“ঠিক বুঝেছ চড়ুই পাখি। এবার বলো তো আমার মিসেস কোথায়?”
সোরায়া মিটিমিটি হেসে মুখ ধরে বলল-
“আপু তো ছাদে। আমাকে বলল ওর ল্যাপটপ টা নিয়ে জেতে কি যেন একটা কাজ আছে ওর তাই ওটা নিতে এলাম।”
রায়ান একটু ভ্রু কুঁচকে বলল-

“এতরাতে ছাদে কেন গেছে ও? ছাদে কোথায়? বাইরে নাকি ছাদ ঘরে?”
সোরায়া- “আমি তো দেখে এলাম বাইরেই দাঁড়িয়ে হাওয়া খাচ্ছে জিজ্ঞেস করাতে বলল ভালো লাগছে না তাই হাওয়া খেতে গেছে একটু। আর তারপরই ল্যাপটপ নিতে পাঠালো।”
রায়ানের মনে কথাটা বাজলো- “ওর ভালো কেন লাগছে না? কি হলো হঠাৎ?”
রায়ান সোরায়া কে বলল-
“আচ্ছা চড়ুই পাখি এখন তুমি তোমার ঘরে যাও।”
সোরায়া ল্যাপটপ এর দিকে আঙুল তুলে বলল-
“আপু ওইটা নিতে বলেছে। ওটা দিয়ে তার পর নিজের ঘরে চলে যাব।”
রায়ান সোরায়ার চোখে চোখ রেখে কিছু একটা বোঝাতে চাই- আর সাথে সাথে যেন হোরায়রা বুঝেও গেল। সোরায়া হেঁসে প্রতি উত্তরে বলল-

“আচ্ছা ভাইয়া আমি বরং রুমে যাই তুমি আপুকে ল্যাপটপ টা দিয়ে দিয়ো। টাটা।”
এই বলে সোরায়া আবার খুশি মনে লাফাতে লাফাতে নিজের ঘরে চলে গেল।
রায়ান একবার ল্যাপটপ টার দিকে তাকিয়ে বলল-
“আমি আমার বউয়ের কাছে গেলে তোর প্রয়োজন পরবে না। তুই এই ঘরেই থাক।”
তারপর রায়ান হাসি মুখে ছাদের দিকে গেলো।

সোরায়া রুমে এসেই নিজের ফোনটা খাটের থেকে তুলে নিল হাতে। অনেক নোটিফিকেশন জমে আছে তার মাঝে একটা গুরুত্বপূর্ণ মেসেজ ছিল জুঁইয়ের। সোরায়া তাড়াহুড়োতে চেটে ঢুকতেই দেখলো জুঁই একটা ফেইসবুকের একাউন্ট লিংক শেয়ার করেছে নাম- ‘Snigdho Khan Mahir’। আর তার নিচেই জুঁইয়ের মেসেজ-
“এই নে তোর বার্থডে গিফট, ৪মাস আগেই দেয়ি দিলাম। thank me later😘😒।”
সোরায়া প্রথমে বিশ্বাসই করতে পারছিল না মাহিরের ফেইসবুক একাউন্ট পেয়ে গেছে সে। সোরায়া খুশিতে ফোনটা ধরে চিৎকার করে লাফাতে লাগলো –
“আআআআআআআআ…ইয়েস!”
তারপরই হঠাৎ শান্ত হয়ে জুঁইকে মেসেজ করলো-

“আমার জানপাখি রে। তোরে কালকে কলেজে এসে একসাথে ১০টা চুম্মা দিবো । love you.😘😘😘😘.”
মেসেজ টা সেন্ড করেই সে লিংকে ক্লিক করল। আর সাথে সাথে সেটা তাকে মাহিরের একাউন্টে নিয়ে গেল। প্রোফাইল পিকচার এ বিসিএস এর সময়কার ছবি। আর কভার পিকচারে বাইকে হেলান দেয়া একটা ছবি যেখানে মাহির কালো লেদার জ্যাকেট পড়েছিল, আর মাথায় হাতে হেলমেট আর হ্যান্ড গ্লাভস।
সোরায়া নিজের বুকের বা পাশে হাত রেখে সিনেমার মতো ভাবে বলল-
“হায়্! মে মারযাওয়া।”
হোরায়রা উৎসাহ নিয়ে সেন্ড রিকুয়েস্টে ক্লিক করে আর এর পর প্রতি সেকেন্ডে সেকেন্ডে দেখতে থাকে রিকুয়েস্ট একসেপ্ট হয়েছে কিনা। তবে এমন কিছুই হচ্ছে না দেখে সে ভাবলো-
“আমার মতো সাধারণ একটা মেয়ের ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট কি তার মত এত ব্রিলিয়ান আর ট্যালেন্টেড মানুষ একসেপ্ট করবে?”
কথাটা ভেবেই সে হাতাশ হয়ে গেল কিন্তু পর মুহূর্তেই আবার বিরবির করল দুষ্টু হাসি নিয়ে-
“স্বাভাবিকভাবে না করলেও বিরক্ত হয়ে ঠিক করবে।”
তার পর সে আবার মাহিরের একাউন্টে ঢুকে পরপর পাঁচবার ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট ক্যান্সেল করে আবার রিকুয়েস্ট সেন্ড করে।

মাহির তার টেবিল এ বসে কলেজের সব ডকুমেন্টস দেখছিল এমন সময় টেবিলের এক কোণায় রাখা তার ফোনটাতে একটু পর পর নোটিফিকেশন আসছিল। যার শব্দে মাহির একপ্রকার বিরক্ত হয়ে ফোনটা হাতে নেয় চেক করতে এতোক্ষণ ধরে কিসের নোটিফিকেশন আসছে।
সে ফেইসবুক ওপেন করতেই দেখে একটা আইডি থেকে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট আসছে বারবার নাম-‘Jannatul Rahman Soraya’।
মাহিরের ‘সোরায়া’ নামটা দেখেই মনে পরে সে এই নামটা কোথাও শুনেছে। খুব মনে করার চেষ্টার ফলে তার মনে পড়ে সকালে সোরায়ার কথা গুলো। মাহির অবাক হয়ে বলে উঠলো-
-“এই মেয়ে আমার ফেইসবুক একাউন্ট পেলো কোথায়? আমার কি রিকুয়েস্টটা একসেপ্ট করা ঠিক হবে? না না , আমি একজন প্রফেসর, আমার নিজের ব্যক্তিত্ব ধরে রাখা উচিত। একসেপ্ট করা ঠিক হবে না। ইট’স আন-প্রফেশনাল।”
মাহির ফোনটা টেবিলের উপর রেখে দিয়ে রাতের খাবার খেতে চলে গেল।

এতবার রিকুয়েস্ট সেন্ড করার পরও মাহিরের সাইড থেকে সেটা একসেপ্টেড না হওয়ার দুঃখে সোরায়া মন খারাপ করে মুখ ফুলিয়ে বলল-
“করবেন না তো একসেপ্ট! ইগনোর করা হচ্ছে। ঠিক আছে, কালকে দেখবো কি করে আমাকে ইগনোর করেন।”
এই বলে সোরায়া ফোনটা বিছানায় ফেলে নিচে চলে যায়।

মিরায়া ছাদে একা দাঁড়িয়ে আছে মনের সব ভার যেন আকাশের চাঁদ আর তারার দিকে তাকিয়ে বিসর্জন দিচ্ছে। রায়ান ছাদে এসেছে এক মিনিটের চেয়ে ও বেশি সময় হয়েছে কিন্তু সে কোনো কথা না বলে মিরায়াকে তার উপস্থিতি বুঝতে না দিয়ে কেবল চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে মিরায়াকে।
মিরায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো-
“আম্মু-আব্বু! আজ যদি তোমরা থাকতে তাহলে সব কিছু অন্য রকম হতো তাই না বলো? চাচা-চাচির ও কোনো দ্বায়ভার থাকতো না। বনু আর আমি তোমাদের আদর পেতাম। ”
রায়ান মিরায়ার তার বাবা-মাকে উদ্দেশ্য করে বলা কথা গুলো শুনতে লাগলো।

-“তোমরা থাকলে আমার বিয়েটা এমন ভাবে কখনো হতো না তাই না বলো? আব্বু তুমি তো আমাকে প্রিন্সেস ডাকতে, আমার বিয়েটাও নিশ্চয়ই একটা রাজকন্যার মতো হতো তুমি থাকলে। বিয়ে হয়েছে তাও মানা যায় হয়তো আল্লাহর ইচ্ছে ছিলো কিন্তু আমার বর কেন তোমাদের মতো আমাকে ছেড়ে চলে গেল- আমি অনাথ তাই? আমার বাবা-মা নেই বলেই কি চলে গেছে সে?”
মিরায়া নিজের আবেগ ধরে রাখতে না পেরে কাঁদতে লাগলো। আর পিছনে দাঁড়িয়ে রায়ান সবটা কথা শুনলো তবে তার মাথায় শুধু শেষের দুই লাইন ঘুরছিল। রায়ান নিজের আবেগ সামলে মনে মনে মিরায়ার উদ্দেশ্যে বলল-
“না হৃদপাখি, তোমার বর তোমাকে সেই কারণে ছেড়ে যায় নি, বিশ্বাস করো। আমি অনেক সরি বউ তোমাকে না বুঝে ছেড়ে যাওয়ার জন্য। খুব খুব সরি। আমার ভাগ্য যে এভাবে তোমার সাথে আমাকে জুড়ে দেবে সেটা আমার জানা ছিল না বউ।”

মিরায়া আকাশের দিকে তাকিয়ে কেঁদেই যাচ্ছে আর তার চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া প্রত্যেকটা পানির ফোঁটা যেন রায়ানের বুকে জ্বলতে থাকে আগুনে ঘি এর মতো কাজ করছে।
রায়ান না পারছে নিজে গিয়ে তার বউটাকে নিজের বুকে নিতে আর না পারছে তার কান্না সহ্য করতে। রায়ান নিজের মনেই নিজেকে দোষ দিতে থাকলো-
“আমি অপরাধী বউ। আমি তোমাকে খুব কষ্ট দিয়েছি। তার জন্য তুমি যা শাস্তি দেবে তোমার বর তা মাথা পেতে নেবে। তবে শুধু তোমার অনাথ হওয়াতে কেন তোমার অবর্তমানেও তোমার বর তোমাকে কখনো ছেড়ে যাবে না। কথা দিচ্ছে তোমার বর। রাজকন্যার থেকেও জমকালো ভাবে বিয়ে করে বউ বানাবো তোমায়। তোমার সব শখ পূরণ করবে তোমার বর। দয়া করে কান্না থামাও আমি নিতে পারছি না।”
মিরায়ার কান্না দেখে নিজের মনে রায়ান একটা অদৃশ্য বোঝা অনুভব করছে। যেন এখনি যদি একবার বউটাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারতো যে সে ফিরে এসেছে, মনে শান্তি পেত।
রায়ান নিজেকে সামলে নিয়ে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল পিছনে। এক পর্যায়ে মিরায়াও কান্না মুছে নিতে নামার জন্য পিছনে ঘুরতেই হঠাৎ রায়ানকে দেখে চিৎকার দিল-

“আআআআ..!”
রায়ান হকচকিয়ে মিরায়ার কাছে এসে একহাতে মিরায়ার হাত আর অন্য হাতে মিরায়ার মুখ চেপে ধরে বলল-
“চুপ চুপ! আমি..আমি রায়ান ভুত না। চিৎকার কোরোনা লোকে শুনলে কি ভাববে।”
মিরায়া বড় বড় চোখ করে রায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে। তারপর মিরায়া শান্ত হয়ে চোখ নামিয়ে রায়ানের হাতে ইশারা করায় রায়ান মিরায়ার মুখ থেকে হাত নামায়। মিরায়া রায়ানের বলে-

“আপনি এখানে কি করছেন এত রাতে?”
-” আমারো একই প্রশ্ন তুমি এখানে কি করছো এত রাতে?”
-“ঘরে অনেক সাফোকেটিং লাগছিল তাই ছাদে এসেছিলাম একটু ঠান্ডা হাওয়া খেতে।”
-“তাই বলে এত রাতে একা?”
-“বনু ছিল তো সাথে। পরে আমি নিচে পাঠিয়েছিলাম ল্যাপটপ টা আনতে আর এলোই না। তাই নেমে যাচ্ছিলাম আর দেখলাম আপনি দাঁড়িয়ে।”
-“হাওয়া খেয়েছো? ”
-“কি?”

-“বলি হাওয়া খাওয়া হয়েছে আপনার ম্যাডাম? রাতে কি এটা খেলেই হবে খাবার খাবেন না? রাতের খাবার খেতে চলুন আপনার মামণির ডাক পরলো বলে।”
-“আপনি আমাকে ডাকতে এসেছেন?”
-“উঁহু! আমি ডাকতে আসবো কেন আমি তো তোমার বরের পদত্যাগ করিয়ে নিজে সেই পদের অধিকারী হতে এলাম।”
রায়ানের কথা শুনে মিরায়ার চোখ কপালে উঠে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মিরায়া শক্ত গলায় বলল-
“সম্ভব না।”
রায়ান-” এত বছর দেশ শাসনের পর আওয়ামী লীগ সরকার পদ ছেড়ে দিল জনগণ বহিস্কার করাতে আর তুমি দশ বছর ধরে পলাতক স্বামীকে বহিস্কার করতে পারবে না?”
মিরায়া বিরক্তিতে রায়ানকে প্রশ্ন করে বসলো-

“কেন এসেছেন আপনি আমার জীবনে?
রায়ান হালকা হেসে গান ধোরল-
“এসেছি তোর মনেরই দেশে ,
আমি এক মুসাফির বেশে ।
দে না ঠাই একটু হেসে.. ভালোবেসে..!”
মিরায়া রেগে বলল-“কি বলতে চাইছেন?”
রায়ান পিছন ফিরে নিচে নামার ভাব ধরে কথা ঘুড়িয়ে বলল-
“বলতে চাইছি রাত হয়েছে নিচে এসো খেতে।”
মিরায়া রায়ানের কথা ঘুড়ানোর বিষয়টা বুঝে জোরে আওয়াজ করে বলল-
“আমি আবার বলছি আমি বিবাহিত।”
রায়ান নিচে নামতে নামতে স্লোগান তোলার ন্যায় এক হাত মুষ্টিবদ্ধ করে তুলে বলল-
“মানছি না..মানবো না..!”
রায়ান নিজ গতিতে নিচে চলে গেল এদিকে মিরায়া বিরক্তিতে নিজের চুল দুহাত দিয়ে ঝাঁকিয়ে নিলো। আর নিজেও রাগ গিলে খেয়ে নিতে নেমে গেল।

রাত ১১ টা~
ডাইনিং টেবিলে সবাই রাতের খাবার খেতে বসেছে। সবাই নিজেদের জায়গা নিয়ে নেওয়ায় মিরায়া বাধ্য হয়ে বরাবরের মতো রায়ানের পাশের চেয়ারে বসেছে। রামিলা চৌধুরী সবাইকে পরিবেশন করেছেন। সবাই খেতে থাকার এক পর্যায়ে রায়হান চৌধুরী মিরায়াকে প্রশ্ন করলেন –
“মিরা মা তোমার ক্যাম্পাস কেমন লাগছে? সব ঠিকঠাক তো?”
মিরায়া খেতে খেতে হালকা হেঁসে বলে-
“হ্যাঁ বাবা, সব ভালো। ক্যাম্পাস টাও অনেক সুন্দর। যেমনটা দেখে বড় হয়েছি তার থেকেও অনেক বেশি সুন্দর।”
রায়হান চৌধুরী মিরায়ার মাথায় বা হাত দিয়ে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন-
“যাক সব ভালো হলেই ভালো। কোনো রকম সমস্যা হলে আমাকে বলবে।”
মিরায়া হেঁসে হ্যাঁসূচক মাথা নাড়লো। রায়ান নিজের মতো খাচ্ছে। আর নিজের থেকেই যখন যা মনে হচ্ছে মিরায়ার দরকার তার দিকে এগিয়ে দিচ্ছে যেটা মিরায়াকে অনেক অস্বস্তিতে ফেলছিল।
মিরায়া খেতে খেতেই হঠাৎ বলল-

“বাবা-মামণি! আমি ঠিক করেছি হলে সিফ্ট করবো।”
ডাইনিং টেবিলে হঠাৎ সবাই নিজেদের খাওয়া থামিয়ে দিয়ে মিরায়ার দিকে তাকায়। রায়ানও অবাক হয়ে মিরায়ার দিকে তাকায়।
মিরায়া সবাইকে তার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিজেও খাওয়া থামিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে-
“তোমরা সবাই এভাবে কেন দেখছো?
রায়হান চৌধুরী-“কেন মা এই বাড়িতে কি তোমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে থাকতে?”
রায়হান চৌধুরী রায়ানের দিয়ে তাকান বড় চোখ করে এদিকে রায়ান অবাক চোখেই তার দিকে তাকিয়ে বোঝালো- যে সে এমন কিছু বলে নি মিরায়াকে।

মিরায়া নিজের কথাটা আরো পরিষ্কার করে বোঝাতে বলতে লাগলো-
“না বাবা, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আমি নিজেই চাইছি হলে থাকতে। আমার ঢাবিতে পড়ার ইচ্ছার সাথে সাথে হলে থেকে পড়ারও ইচ্ছে ছিল। আর বাড়ি থেকে ক্যাম্পাসে যেতে একটু বেশি সময় লাগে। সব মিলিয়েই আরকি ঠিক করেছি যে হলে সিফ্ট করবো। আবেদন করলেই হয়ে যাবে।”
রায়হান চৌধুরী একবার রামিলা চৌধুরীর দিকে তাকালেন আর তার পর দুইজনেই রায়ানের দিকে তাকালেন। মিরায়া স্বাভাবিক ভাবেই খেয়ে যাচ্ছে। রায়ান মিরায়ার দিকে পানি এগিয়ে দিয়ে বলল-
“হচ্ছে না।”

রুদ্র, সোরায়া, রামিলা চৌধুরী, রায়হান চৌধুরীর নজর রায়ান আর মিরায়ার উপর চলে আসে। সবাই ভালোই বুঝতে পারছে আবহাওয়া বেগতিক।
মিরায়া রায়ানের দিকে তাকিয়ে বলল-
“কি?”
রায়ান-” তোমার হলে সিফ্ট করা হচ্ছে না। এই বাড়িতে থেকেই পড়তে হবে।”
মিরায়া এবার রেগে গিয়ে রায়ানকে কড়া গলায় জবাব দিল-
“ফর ইউর কাইড ইনফোরমেশন, আমি অনুমতি নিচ্ছি না রায়ান ভাইয়া। আমি আমার সিদ্ধান্ত জানাচ্ছি। বাড়ির গুরুজনদের আমার সিদ্ধান্ত জানানো আমার কর্তব্য তাই সবার উপস্থিতি তে বললাম। আমি খালি আবেদন করবো হলের সিটের জন্য। আর আমার সিদ্ধান্তের নড়চড় হবে না।”
রায়ান মিরায়ার জেদ দেখে রেগে গেলো। রায়ান রাগি গলায়-

“মিরা তুমি…!”
রায়ানের কথা বলা থেকে রুখে দিয়ে রামিলা চৌধুরী বলে উঠলেন-
“এটা খাবার টেবিল সবাই খাওয়া শেষ করো এই বিষয়ে পরে কথা হবে।”
মিরায়া চুপচাপ খেতে লাগলো যেন রায়ানের রাগ তার গায়ে লাগছে না। এদিকে মিরায়ার এমন জেদ রায়ানের খুব গায়ে লাগছে রায়ান আর একটু খেয়ে জোর দেখিয়ে চেয়ার থেকে উঠে হাত ধুয়ে নিজের রুমে চলে গেল। বাকি সবাই মিরায়া সহ নিজেদের খাওয়া শেষ করে চলে গেল যার যার রুমে।

রায়ান নিজের ঘরে একাই হম্বিতম্বি করতে লাগলো-
“হলে যাবে না? যাওয়াচ্ছি হলে! এই বাড়ির বাইরে পা রাখার চেষ্টা করলে পা ভেঙ্গে বসিয়ে রাখব।”
রায়ান নিজের রাগ আর সব কিছু কিভাবে সামলাবে ভেবে পাচ্ছে না। রায়ান বিরবির করলো-
“আমাকে এড়ানোর জন্য হলে গিয়ে থাকার ইচ্ছে তোমার কখনো পূরণ হবে না বউ। যেকোনো পর্যায়ে তোমাকে আমার কাছেই থাকতে হবে আর আপোষে না থাকতে চাইলে জোর করে রাখবো। বাট এট এনি কস্ট, ইউ উইল বি উইথ মি, মাই ফাকিং লিটল হার্ট-বার্ড।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৫

মিরায়া এবার বেশ শান্তি তে নিজের রুমে খাটের উপর শুয়ে আছে। মিরায়া মুচকি হাসতে হাসতে মনে করলো তার রেগে কথা বলার পর রায়ানের রাগ না দেখাতে পারার দৃশ্যটা‌।
মিরায়া শুয়ে থাকা অবস্থায় হাসি মুখে বলে-
“বেশ হয়েছে। চলেই যাবো। এবার কার পিছনে লাগবে লাগুক সে। বলে কিনা ‘অন্যের বউ’ hits different ‘। হাহ! নিজেকে কি মনে করে কে জানে।”
মিরায়া খুশি মনে ঘুমের প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমের রাজ্যে পাড়ি দেয়। অন্য দিকে রায়ানের ঘুমহীন রাত কাটায়। তার জন্য রাতের সময় যত যাচ্ছে শূন্যতা তত গভীর হচ্ছে আর রাগ আরো বাড়ছে। কাল সকালে কি করে বসবে সে নিজেও জানে না তবে তার ধৈর্যে কুলচ্ছে না আর। মনে মনে কেবল রাত পাড় হওয়ার অপেক্ষা করতে লাগলো।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here