আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৯
অরাত্রিকা রহমান
মিরায়া আচমকা এমন কথা শুনে-
“কিহ্! আ.. আমি? আপনার সাথে? বাইকে? তাও আবার এই হেলমেট পড়ে?”
রায়ান মিরায়ার চোখে চোখ রেখে বলল-
“হ্যাঁ তুমি বেইব। মাত্রই তো বললাম তোমার চেয়ে উপযুক্ত এই মোমেন্টার জন্য আর কেউ নেই। তোমাকে দিয়েই উদ্বোধন করবো। ( মিরায়ার মুখের কাছাকাছি পৌছে) আর তোমাকে দিয়েই সমাপ্তি।”
তারপর সামান্য হেঁসে আবার নিজের জায়গায় সোজা হয়ে বলল-
“নাও, কাছে আসো হেলমেটটা পড়িয়ে দেই।”
মিরায়ার ধ্যান রায়ানের কথাই আটকে গেল- “আমাকে দিয়ে উদ্বোধন আর আমাকে দিয়েই সমাপ্তি, মানে?” মিরায়ার মাথা ধরে যাচ্ছে তবে রায়ানের সব কথা শুনলো কিন্তু মস্তিষ্কের সাথে মন সায় দিচ্ছে না। মিরায়ার খুব ইচ্ছে করছে বাইক টাতে উঠতে- চালানোর সুযোগ না থাকলেও, বাইকে উঠে অন্তত এটার অনুভূতিটা তো বুঝতে পারবে সে। কিন্তু নিজেকে মানাতে পারছে না সম্পূর্ণ ভাবে। মিরায়া নিজের মনেই নিজের সাথে যুদ্ধ করছে- বাইকে উঠা ঠিক হবে, কি হবে না।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
তখনি ক্যাম্পাসের রাস্তা ধরে দুজন মেয়ে রায়ানের দিকে আর বাইক টার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে ক্যাম্পাসের ভিতরে প্রবেশ করছিল। তাদের মাঝে একটু ফিসফিস শুনা যায়-
১ম জন-“OMG, ওই বাইকটা দেখ।”
২য় জন-“আরে বাইক ছাড় বাইকার দেখ। কি হেন্ডসাম বল।”
আবার, ১ম জন- “গিয়ে কথা বলবি রাইড শেয়ার করে কিনা।”
২য় জন-” ভালো বলছিস। চল।”
মিরায়া তাদের কথা স্পষ্টভাবেই শুতে পেয়েছে সেখানে দাঁড়িয়ে হঠা্ৎ করেই যেন তার মনে অদ্ভুত রকমের একটা অনুভুতির উদয় হলো। তার ওই মেয়ে দুটোর ফিসফিসিয়ে রায়ানের উদ্দেশ্যে বলা কথা যেন গায়ে বিধলো। মিরায়া তবু চুপ থেকে দেখতে থাকলো, এরই মাঝে ২য় মেয়েটা রায়ানের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলতে শুরু করলো তবে রায়ানের মেয়ে দুটোর দিকে এখনো মন যায়নি সে মিরায়ার দিকেই তাকিয়ে আছে।
২য় জন-“Excuse me, ভাইয়া।”
রায়ান কথাটা শুনলো তবে পাত্তা দিলো না সে মিরায়ার দিকেই দেখছে হাসি মুখে। মিরায়া রায়ানের প্রতিক্রিয়া না দেখে মেয়েটার দিকে একবার তাকিয়ে পরে রায়ানের দিকে তাকিয়ে হাত নাড়িয়ে বলে-
“এই যে ভাইয়া, please excuse her.”
রায়ান মিরায়ার কথা মতো মেয়েটার দিকে ঘুরে ঠিক মতো না তাকিয়েই বলল-
“You are excused miss.”
তারপর আবার মিরায়ার দিকে তাকিয়ে রইল। রায়ানের এভাবে মেয়েটার সাথে আচরণ করা মিরায়াকে অদ্ভুতভাবে শান্তি দিল। মিরায়া নিজের মনে একটু মুচকি হাসলো তবে তা মুখে প্রকাশ পেল না।
২য় জন-“ভাইয়া কি রাইডার নাকি? আপনি কি রাইড শেয়ার করেন? আপনার নাম্বারটা পাওয়া যাবে? কখনো দরকার পরলে আর কি।”
মেয়েটার এ কোথাও যেন রায়ানের কান অব্দি পৌছলো না। মিরায়া আবার রায়ান কে বলল-
“ভাইয়া, উত্তর দিন। আপনাকে প্রশ্ন করেছেন উনি।”
রায়ান এবার ভালো করে ঘুরে মেয়েটাকে উত্তর দিলো-
“Yes,miss. আমি একজন রাইডার তবে তার (মিরায়ার দিকে আঙুল তুলে) পার্সোনাল।”
রায়ানের কথায় মেয়েটার মুখ একদম ছোট হয়ে গেল শুকিয়ে। মেয়েটা একবার মিরায়ার দিকে দেখলো। মিরায়া মিটিমিটি হাসছে। মেয়েটা রেগে তার সাথে থাকা অন্য মেয়েটার হাত ধরে ক্যাম্পাসের ভিতরে চলে গেল। মিরায়া সম্পূর্ণ দৃশ্যটা তার নিজের অজান্তেই বেশ উপভোগ করল।
রায়ান মিরায়ার উদ্দেশ্যে –
“এই যে ম্যাডাম, আপনার পার্সোনাল রাইডার হিসেবে পরিচয় দিয়েছি বলে এমন না আমার সময়ের মূল্য নেই। দেরি হচ্ছে তো নাকি। এবার বলো কি ঠিক করলে? তৃতীয় কথাটা শুনবে নাকি এখানেই…।”
রায়ানের কথা শেষ হতে না দিয়েই মিরায়া রায়ানের কাছে এগিয়ে গিয়ে রায়ানের দিকে মাথাটা হেলিয়ে দিল রায়ানের থেকে হেলমেটটা পড়ে নেওয়ার জন্য। রায়ান চুপ করে গিয়ে মুচকি হেঁসে মিরায়াকে হেলমেটটা পড়িয়ে দিয়ে বলল-
“বাহ্! বিড়াল কান গুলো তোমায় খুব মানিয়েছে হার্ট-বার্ড। একদম জুলিয়েটের মাম্মা লাগছে।”
মিরায়া কথাটাতে মজা পেল কিন্তু হাসলো না। রায়ান এবার মিরায়াকে বলল-
“বেইব, উঠতে পারবে না কোলে করে বাসাবো?”
মিরায়া বাঁকা হেঁসে হেঁয়ালি করে বলল-
“না থাক এতো কষ্ট করতে হবে না।”
এই বলে নিজেই বাইকে উঠে বসলো রায়ানের না ধরেই। পুরোনো অভ্যাস তাই আর প্রয়োজন পরেনি ধরার। কিন্তু রায়ান মিরায়ার তাকে না ধরে উঠাতে বিরক্ত আর অবাক হলো- ” মেয়ে হয়ে এভাবে এত সহজে স্পোর্টস বাইকের পিছনে বসে গেলো!” মনে মনে।
রায়ান ঘার ঘুরিয়ে বলল-
“ধরে বসো পড়ে যাবে।”
মিরায়া পাত্তা দিল না। রায়ান মিরায়ার ওভার কনফিডেন্স দেখে দুষ্টু হেঁসে হঠাৎ বাইক স্টার্ট করলে মিরায়া ব্যালেন্স রাখতে না পেরে রায়ানের কাধ ধরে ফেলে। রায়ান মিরায়ার স্পর্শে হেঁসে উঠে বলে-
“hold me tight, babe.”
মিরায়া বিরক্তিতে তাকালো তবে রায়ানের সে দিকে নজর নেই। রায়ান তারপর বাইক ছুটালো সোজা রাস্তায় এক অজানার দিকে।
বিকেল_৩টা
দুপুর ফুরিয়ে বিকেল নেমেছে। রাস্তার পাশে গাছগুলোর ছায়া লম্বা হয়ে এসে গাড়ির গায়ে পড়ছে। রোদটা আর আগের মতো ঝলমলে নেই, হালকা ম্লান আলোয় রাস্তা যেন একটু কোমল হয়ে উঠেছে। সোজা রাস্তা ধরে গাড়ি এগিয়ে চলেছে।
রুদ্র চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে, তার চোখ সামনের দিকে নিবদ্ধ। পাশে বসা রিমি বারবার নিজের দু’হাত একসাথে ঘষছে। অজানা গন্তব্য আর হঠাৎ এভাবে চলে আসা নিয়ে তার ভেতরে একধরনের অস্থিরতা জমে উঠছে।
রুদ্র হঠাৎ চোখের কোন দিয়ে রিমির হাত ঘষাঘষি দেখে নিয়ে গলাটা নরম করল—
“আপনি… ঠিক আছেন তো? মনে হচ্ছে একটু টেনশন করছেন। কোন সমস্যা হলে বলতে পারেন।”
রিমি চমকে তাকাল তার দিকে, তারপর চোখ নামিয়ে ভাঙা গলায় বলল—
“আসলে… মিরাকে আমি মিথ্যে বললাম। আপনি বলেছিলেন তাই… কিন্তু সেটা কেন বললেন? সত্যি বললে কি হতো…”
রুদ্র হালকা মাথা নাড়ল, ঠোঁটের কোণে একরকম হাসি ফুটল।
“মিরা আমার ছোট বোন। ওর সাথে প্রায় সময়েই খুনসুটি চলে। যদি জানত আপনি আমার সাথে আছেন, তাহলে আমি বাসায় ফিরলেই শেষ—ও যত রকম খোঁচা দেয়া যায় সব দিত। তাই মিথ্যে বলাতে বাধ্য হলাম।”
রিমি ভ্রু কুঁচকে কৌতূহলভরে বলল—
“মজা নিত মানে?”
রুদ্র একটু হেসে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেই উত্তর দিল—
“ওসব বোঝানো মুশকিল। ছোট বোনেরা যেমন হয় আর কি।একফোঁটা সুযোগ পেলেই খেপানো, মজা করা। আপনার হয়তো বিশ্বাস হবে না, কিন্তু ওর খুনসুটি মাঝে মাঝে সহ্যের সীমা ছাড়ায়।”
রিমি তার কথা শুনে আর কিছু বলল না। ঠোঁট কামড়ে জানালার বাইরে তাকাল। গাড়ির ভেতর আবার নীরবতা নেমে এল।
কিছুক্ষণ পর রিমি ধীরে গলা খুলল—
“আচ্ছা… আপনি আজকে হঠাৎ কেন এসেছিলেন ক্যাম্পাসে? আর আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
রুদ্র এক মুহূর্ত চুপ করে থাকল, যেন ভেতরে কথা খুঁজে নিচ্ছে। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল—
“সেদিনের পর থেকে আমি শান্তি পাচ্ছিলাম না। মাথার ভেতর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, না—আপনার সাথে কিছু কথা না বলা পর্যন্ত আমি শান্তি পাব না। তাই এসেছিলাম।”
সে একটু থেমে আবার যোগ করল—
“কিন্তু ক্যাম্পাসে এসব কথা বলা যায় না। ভিড়, কোলাহল—সেখানে মন খুলে কথা বলার পরিবেশ নেই। তাই ভাবলাম, একটা নিরিবিলি জায়গায় যাই। তাই আমরা এখন এক কফি শপে যাচ্ছি।”
রিমির বুকটা ধক করে উঠল। অজানা আশঙ্কা আর কৌতূহল মিলেমিশে তার ভেতরে ভয় তৈরি করল। মনে হল, রুদ্র কোন বড় কিছু বলতে চাইছে। সে ধীরে ফিসফিস করে বলল—
“আপনি… এখনো সেই দিনের ঘটনা ভুলতে পারেননি, তাই না? আমি সত্যিই খুব দুঃখিত। আমি তো কিছুই করিনি, তারপরও মনে হচ্ছে আপনার কাছে আমি দোষী।”
রুদ্র একচুল ঘুরে তার দিকে তাকাল, তারপর নরম হেসে বলল—
“এমা না না, দুঃখ করবেন না প্লিজ। সেদিনের ঘটনায় আপনার কোনো হাত ছিল না। এটা আমি জানি। আর হ্যাঁ, ভুলতে পারিনি সেটা সত্যি। কিন্তু ভুলতে না পারার মানে এই নয় যে আমার নিজের জন্য খারাপ লেগেছে। বরং উল্টো—আমি কিছু উত্তর খুঁজছি। সেই উত্তরগুলোই আপনার কাছে চাই।”
রিমির বুক কেঁপে উঠল। সে আর কিছু বলল না। কেবল গাড়ির কাঁচে হাত রেখে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগল। তার ভেতরে প্রশ্ন জেগেই চলল—রুদ্র ঠিক কি বলতে চাইছে?
গাড়ি থামল এক মার্কেটপ্লেসের ভেতরে। ভিড়ভাট্টার মাঝে একটা সুন্দর, নিরিবিলি কফি শপ। কাঁচের দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই নরম জ্যাজ মিউজিক, কফির গন্ধ আর হালকা হলুদ আলোয় অন্যরকম শান্ত পরিবেশ তৈরি হল।
ওরা দুজন কোণের একটা টেবিলে বসল। বাইরে থেকে বিকেলের আলো ভেতরে এসে পড়ছে, আলো–ছায়ার মিশ্রণে দৃশ্যটা যেন সিনেমার মত লাগছিল।
রুদ্র ওয়েটারকে অর্ডার দিল। কফি শপের ভেতর নরম হলুদ আলো ছড়ানো। বাইরে গ্লাস দিয়ে ভেসে আসছে বিকেলের কমলা আলো। দুজনই কোণের একটা টেবিলে বসেছে। টেবিলের ওপরে রাখা দুটো কাপ থেকে ধীরে ধীরে ধোঁয়া উঠছে।
রুদ্র কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। তার চোখে কৌতূহল, আবার অদ্ভুত দ্বিধা। বারবার যেন কথা শুরু করতে গিয়ে থেমে যাচ্ছে। শেষে হঠাৎ সাহস সঞ্চয় করে ধীরে গলা নামিয়ে
বলল—
“রিমি… যদি আপত্তি না থাকে, একটা প্রশ্ন করি?মনে শান্তি না থাকলে আসলে সব উল্টোপাল্টা লাগে …”
রিমি নিঃশ্বাস আটকে তাকাল তার দিকে। রিমি রুদ্রর চোখের দিকে তাকাতে না পেরে নিচের দিকে তাকিয়েই বলল-
“জ্বি বলুন। আমি আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করবো।”
রুদ্র কফির কাপটা ছুঁয়ে নিয়ে আবার রেখে দিল। গলা কেঁপে উঠল হালকা—
“সেদিন আপনার ভাইকে যেভাবে দেখলাম… আপনি কীভাবে সহ্য করলেন? মানে, একজন ভাই নিজের ছোট বোনের সাথে এভাবে আচরণ করে? এত খারাপ ভাষা, গালি… সেটা তো স্বাভাবিক কিছু না। আপনার পরিবারের আর কেউই এগিয়ে এল না কেন? কেউ আপনার হয়ে কথা বলল না কেন?”
প্রশ্নটা হাওয়ায় ভেসে রিমির বুকের ভেতরে ধাক্কা দিল। তার গলা শুকিয়ে গেল, চোখ নামিয়ে কফির কাপে তাকাল। কিছু বলল না। শুধু দুই হাত দিয়ে কাপের গরমতা টের পেতে লাগল, যেন সাহস খুঁজছে।
রুদ্র আরও নরম স্বরে বলল—
“দয়া করে কিছু মনে করবেন না। আসলে সেই দিনের পর থেকে আপনার কথা আমার মাথায় ঘুরছে। আপনি ঠিক আছেন তো? আপনার ভাই আবার খারাপ ব্যবহার করছে না তো? কারো অবর্তমানে… আপনাকে কষ্ট দিচ্ছে না তো? আমি শুধু জানতে চাই… মানবিকতার জায়গা থেকেই ধরে নিতে পারেন।”
তারপর আবার দৃষ্টি ফিরিয়ে দিল রিমির দিকে। যেন চোখ দিয়েই তার মুখে উত্তর খুজছেন সে।
রিমি দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ চুপ থেকে ধীরে বলল—
“আপনি ঐদিন যতটুকু দেখেছেন, তাতেই হয়তো যথেষ্ট ছোট হয়েগেছি। কিন্তু… সত্যিটা বলা দরকার। আপনার প্রশ্নও যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত। আমার ভাই ছাড়া আর কেউ নেই আমাদের পরিবারে।”
রুদ্র অবাক হয়ে ঝুঁকে পড়ল—
“মানে? আপনার বাবা–মা কোথায়?” (কৌতূহলে)
রিমি কাঁপা গলায় বলল—
“আছেন। কিন্তু… আমাদের সাথে নেই।”
রুদ্র কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করল—
“নেই মানে? তারা… মারা গেছেন?”
রিমি তাড়াতাড়ি মাথা নাড়ল, চোখে জল চিকচিক করল—
“না… বেঁচে আছেন। কিন্তু আমাদের জীবন থেকে অনেক আগেই চলে গেছেন।”
রুদ্রের দৃষ্টি ভারী হয়ে উঠল।
“তাহলে… তারা থেকেও নেই কেন?”
রিমি এক চিলতে হাসল—একটা ভাঙা হাসি, যেটা কান্নার থেকেও বেশি কষ্টের।
“কারণ, সব গল্পেরই এক কালো দিক থাকে… আমার জীবনের গল্পও ব্যতিক্রম না।”
সে ধীরে ধীরে বলতে শুরু করল—
“আমার বাবা আগে ব্যবসায়ী ছিলেন। হঠাৎ একদিন বড় ক্ষতি হয় আমাদের ব্যবসায় আর তিনি ভেঙে পড়লেন। সংসারের চাপ নিতে না পেরে ধীরে ধীরে নেশার দিকে চলে গেলেন। যত সময় গেল, নেশা যেন তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলল। মা–বাবার ঝগড়া, চিৎকার, মারধর—এসব ছিল আমাদের প্রতিদিনের দৃশ্য। আমি আর ভাইয়া এগুলো দেখে বড় হয়েছি।”
তার চোখ নামল টেবিলের দিকে।
“ভাইয়া মাকে খুব ভালোবাসত। আমি–ও। বাবার অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে মা শেষমেশ আমাদের নিয়ে নানুবাড়ি চলে গেলেন। কিন্তু সমাজ তো কাউকে শান্তিতে থাকতে দেয় না। মা প্রতিদিন অপমান, কটূক্তি শুনতে লাগলেন। শেষে নানুর জোরাজুরিতে মা আবার বিয়ে করলেন।”
রিমি হালকা হেসে মাথা নাড়ল।
“মা নিজের সংসার সামলাতে চলে গেলেন। আমরা নানুবাড়ি রইলাম। তখন থেকেই ভাইয়ার ভিতর বদল আসতে শুরু করে। সবাই কটূক্তি করত—‘মা অন্যত্র গেছে, এদের ভবিষ্যৎ কি’। আমার ভাইয়া এসব একটুও সহ্য করতে পারত না। ধীরে ধীরে ওর ভেতরে এক রাগ জমতে লাগল—মেয়েরা নাকি সব খারাপ। তারপর একসময়… বাবার মতোই নেশায় জড়িয়ে পড়ল।”
রিমি থেমে গেল। মুখে একটা শান্ত হাসি রাখল, অথচ চোখে জল চিকচিক করল।
“তাই ওইদিন বিকেলে আপনাকে আমার সাথে দেখে ও যেভাবে রেগে গেল… সেটা আসলে তার ধারণা। ও ভাবে পৃথিবীর সব মেয়ে একরকম- খারাপ।”
রুদ্র স্তব্ধ হয়ে রইল। কিছু বলতে পারল না। শুধু এক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে ভাবল—একটা মেয়ের জীবনে এত দুঃখ, অথচ সে হাসিমুখে সেই জীবনের গল্প বলছে।
রুদ্র আস্তে বলল—
“আপনার ভাই নেশা করে… কিন্তু টাকা পায় কোথা থেকে? দেখে তো মনে হয় না সে কিছু করে বলে।”
রিমি শান্ত গলায় উত্তর দিল—
“আমার থেকেই নেয়। জোর করে। না দিলে চিৎকার, ভাঙচুর, মারধর… এসব তো আছেই। শেষমেশ দিতে হয় সহ্য করতে পারি না বলে।”
রুদ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলল, যেন বুকের ভেতরটা ভার হয়ে গেছে।
“তাহলে আপনি নিজের খরচ চালান কিভাবে? টাকাই বা পান কোথা থেকে?”
রিমি এবার হেসে রুদ্রের দিকে তাকাল।
“কেন? আমি উপার্জন করতে পারি না বুঝি?”
রুদ্র হালকা হেসে বলল—
“না, না, আমি সেইটা বলিনি।”
রিমি চোখ নামিয়ে কাপের ধোঁয়ার দিকে তাকাল।
“আমি একটা কোচিং সেন্টারে পড়াই। সেখান থেকে মাসিক যে টাকা পাই, তাতে আমার চলে যায়। পাশাপাশি কিছু প্রাইভেট টিউশনও করি। খরচ মেটানো যায়। চাকরির জন্য চেষ্টা করে ছিলাম তবে মেয়ে মানুষ চাকরি করতে গেলে সব পুরুষ মানুষরা কুকুরের মতো আচরণ করে। আশা করি বুঝতে পেরেছেন কি বলতে চাইছি।”
রিমি স্বাভাবিক ভাবেই হেঁসে কফির কাপ হাতে নিয়ে কফি খেতে লাগলো।
রুদ্র মাথা নামিয়ে নিলো আর একটা লম্বা শ্বাস নিল। দেশের আর দুনিয়ার বাস্তবতা আজ তার পুরুষ মানুষ হওয়াকে কলঙ্কিত করছে মনে হতে লাগলো তার। তবে এমন সব মানুষের প্রতি ঘৃণা আমার জায়গায় নেই কারোর চোখেই।
রুদ্র রিমির মতোই স্বাভাবিক হয়ে কফিতে চুমুক দিল, কিন্তু মনে হচ্ছিল কফির স্বাদ হারিয়ে গেছে। ভদ্রতা বজায় রেখে শুধু বলল—
“ধন্যবাদ… আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য এবং আন্তরিক ভাবে দুঃখিত আপনাকে এসব জানতে চেয়ে কষ্ট দেওয়ার জন্য। অন্তত এখন বুঝতে পারছি কেন আপনাকে নিয়ে এত চিন্তা হচ্ছিল।”
তারপরও রুদ্রর বুকের ভেতর কেবল একটাই প্রশ্ন ঘুরতে থাকল—
“একটা মেয়ে এত অনিশ্চিত একটা জীবনে এত কষ্ট নিয়ে কীভাবে হাসিমুখে বেঁচে থাকতে পারে?
আসলে পৃথিবীতে কত ধরনের মানুষ থাকে তাদের জীবন গল্প একজনের থেকে অন্যজনের টা সম্পূর্ণ আলাদা। মানুষের চোখের দেখার বাইরেও আসলে অনেক কিছু দেখার আছে যেটা সচরাচর হয়ে উঠে না। আজকাল মানুষের এত সময় কই কে কেমন আছে সেটা দেখার।”
তারপর রুদ্র তাদের কথোপকথনের বিষয়ে পরিবর্তন করে স্বাভাবিকভাবে হেসে রিমির সাথে বন্ধুর মতো আড্ডা দিতে থাকে। রিমিও কিছুক্ষণ আগের বিষাদে ভরা জীবনের বর্ননা থেকে বেরিয়ে এসে রুদ্রর সাথে কথা বলায় মেতে উঠে। দুজনই হেঁসে আনন্দের সাথে নিজেদের কফি উপভোগ করতে থাকে।
একই সময়ে অন্যদিকে~
রাস্তাটা ছিল ফাঁকা—একেবারে লম্বা সোজা, দু’পাশে হালকা ঝাপসা হয়ে ছুটে চলা দোকানপাট আর গাছপালা। বাতাসের তীব্র শব্দে মিরায়ার কপালের সামনে চুলগুলো উড়ছিলো হেলমেটের ফাঁক গলে।
রায়ান ইচ্ছে করেই বাইকটা আস্তে চালাচ্ছিল, যেন কারও সেফটির দায়িত্ব তার হাতে। রায়ান নিজের জীবনে কখনো এতো ধীরে বাইক রাইড করে নি। মিরায়া একজন বাইক রাইডার হয়ে রায়ানের এমন স্লো রাইডিং এ বিরক্ত হয়ে উঠলো। মিরায়া মনে মনে বিরবির করলো-
“ধুর, কি ভেবে উঠলাম বাইকে আর কি হচ্ছে। বাইক কি চালাতে জানেন না নাকি উনি? ইচ্ছে করছে উনাকে পিছনে দিয়ে নিজেই রাইড করি।”
মিরায়া বিরক্তি গোপন করতে পারল না সে রায়াকে খোঁচা দিতে বলল—
– “আচ্ছা একটা কথা বলুন বাইক চালাচ্ছেন নাকি সাইকেল চালাচ্ছেন? লাখ টাকা দিয়ে সাইকেল কিনেছেন?”
রায়ান বুঝলো মিরায়া কিছু বলছে সে হালকা হেসে জবাব দিল,
– “কি বলছো শুনতেই পাচ্ছি না।”
মিরায়া তার হেলমেটটার গ্লাস একটু ওপরে তুলে রায়ানের হেলমেটের কাছে মুখ নিয়ে এল, গলার সুরে ব্যঙ্গ ঝরে পড়ছে—
– “বলছি, আপনি লাখ টাকা দিয়ে সাইকেল কিনেছেন নাকি? এরকমভাবে বাইক চালায় কেউ?”
রায়ান মিরায়ার কথার আওয়াজে বুঝতে পারল মিরায়া বিরক্ত সে নিচু স্বরে ফিসফিস করে বলল,
– “আমি এভাবে বাইক চালাই না, বেইবি। সত্যি বলছি। নিজেরই বিরক্ত লাগছে। আই সুয়ের। তবে পিছনে যখন আমার সবচেয়ে মূল্যবান জিনিসটা বসে আছে, তখন তার সেফটি সবার আগে আসে। তাই ধৈর্য ধরে চালাচ্ছি এভাবে।”
মিরায়া ভ্রু কুঁচকে একটু হেসে নিলো মনে মনে বলল—”ইস্! আসছে! মূল্যবান সম্পদ!”
মিরায়া রায়ানের ভুল ধারণা ভাঙ্গার জন্য বলে,
– “মূল্যবান জিনিস মূল্যবান একটা রাইড চায়। যা মনে রাখার মতো। অমূল্যবান না।”
রায়ান মুখ বাঁকা করে হাসল, যেন মিরায়ার মনের কথা আগেই বুঝে ফেলেছে।
– “ওকে, দেন মাই প্রেশিয়াস হার্ট-বার্ড… হোল্ড মি লাইক ইউ ডোন’ট ওয়ান্ট টু লিভ মি ফরএভার।”
মিরায়ার ঠোঁট থেকে কোনো শব্দ বের হবার আগেই, রায়ান হঠাৎ গিয়ার পাল্টে দিলো। বাইক গর্জন তুলে ঝড়ের গতিতে ছুটলো সামনে।
মিরায়া অপ্রস্তুত হয়ে ধাক্কা খেলো রায়ানের হেলমেটে, “আহ্!” করে উঠলো।
বাতাসের গর্জনে কিছু শোনা যাচ্ছিল না। রায়ান চেঁচিয়ে বলল,
– “বেইব, আর ইউ হার্ট?”
মিরায়া হাসি চেপে রাখতে পারল না। চোখ ভিজে উঠছিলো বাতাসে, তবুও খিলখিল করে হেসে জবাব দিলো—
– “নো, আই’ম ওকে! ইউ? আপনার হাল কি?”
রায়ান তার হাত দিয়ে মিরায়ার হাতটা কাঁধ থেকে পিছন থেকে টেনে এনে নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরল। সেই মুহূর্তে বাইকটা যেন আরও দ্রুত ছুটে চললো।
রায়ান নিঃসংকোচে গুনগুনিয়ে উঠল—
– “Haal Jo Mera hai
Main kis ko bataun? Mere sahiba…
Dil na kiraaye ja, Thoda toh sambhaalo na
Naazuk hai yeh toot jaata hai…”
তার কণ্ঠে গানটা কেবল একটা লিরিক্স না, যেন অদ্ভুত এক স্বীকারোক্তি ছিল। মিরায়া রায়ানের কন্ঠে গানের লাইনগুলো শুনে বিমোহিত। বড় বড় চোখে রায়ানকে দেখতে লাগলো সামনের বাইক মিররে। রায়ানের মুখের শান্তিভাবে তার মনকেও একদম শান্ত করে তুলল। তার রায়ানের থেকে দূরে থাকার ইচ্ছা আর কাছে যাওয়ার দ্বিধা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে।
রায়ান তাকে এমনভাবে তাকে আঁকড়ে ধরতে বাধ্য করবে, গান গেয়ে উত্যক্ত করবে—সে কখনো ভাবেনি। তবুও অদ্ভুতভাবে তার খারাপ লাগছিল না। বুকের ভেতর অজানা কাঁপন ছড়িয়ে পড়ছিল।
রায়ান হেসে উঠলো,
– “কাঁধে হাত রাখলে ফিল আসে না, বেইব। এমনিতেই ঠান্ডা বাতাস বুকে লাগছে। এভাবে জড়িয়ে ধরে থাকো…আমার ভালো লাগছে এখন। এবার তো সত্যিকারের রাইডের মজা।”
মিরায়া বিরক্তির ভান করেও না চাইতেই দুই হাত দিয়ে রায়ানকে জড়িয়ে ধরলো। রায়ানের কথা তার কানে লাগলো- হয়তো সত্যি এত বাতাসের গতিতে খারাপ লাগছে রায়ানের।
রায়ানের ঠোঁট বাঁকা হয়ে উঠলো, দাঁত চেপে হাসল সে। যেন এটাই চেয়েছিল, আর ঠিক সেভাবেই সবকিছু হচ্ছে। তার বউ তার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ছে। রায়ান এবার বাইক চালানোর জন্য অন্য ধরনের একটা উৎসাহ নিয়ে মিরায়ার উদ্দেশ্যে বলল-
– “লেটস ফ্লাই, মাই হার্টবার্ড,” রায়ান গর্জে উঠল, আর বাইক বাতাস কেটে উড়তে লাগল বিকালের সড়ক ধরে।
বাতাসে তাদের শরীরের দূরত্ব মুছে যাচ্ছিল, বাইকের গর্জনে দুজনের হৃদস্পন্দন মিলেমিশে যাচ্ছিল এক ছন্দে। মিরায়ারও ঠান্ডা লাগছিল রায়ান মিরায়ার শরীর কাঁপন বুঝতে পেরে বাইকের স্পিড কমিয়ে নিজের দুই হাতের মাঝে মিরায়ার হাত টা তার বুক থেকে নিয়ে একটু ঘষে উত্তপ্ত করতে থাকে মিরায়া এখনো কাঁপছে কিন্তু সে বাইক রাইডের আকর্ষণে কিছু অনুভব করতে পারছে না যে তার খারাপ লাগছে। মিরায়া হঠাৎ নিজের হাত গরম হওয়াতে একটু আরাম অনুভব করে তাকিয়ে দেখতেই বুঝতে পারলো রায়ান নিজের হাত এর মাঝে তার হাত গরম করছে। মিরায়া একটু কাঁপা গলায় বলল-
“কি করছেন আপনি?”
রায়ান একটু চিন্তা মিশ্রিত কন্ঠে বলল-
“হৃদপাখি, তোমার কি খারাপ লাগছে? ঠান্ডা লাগছে?”
মিরায়া মাথা নড়লো – “কই না তো, ঠিক আছি।”
এই বলে নিজের হাত রায়ানের থেকে নিয়ে আবার রায়ানের কাঁধে রাখলো।
রায়ান বাইকের হ্যান্ডেল ধরে বলল –
“মনে তো হচ্ছে না। শরীর কাঁপছে, হাত ঠান্ডা বরফ হয়ে গেছে। আর বলছো ঠিক আছো। তোমার বাইকে উঠার অভ্যাস নেই হয়তো তাই না?”
মিরায়ার ভীষণ হাসি পেল রায়ানের কথা শুনে। মিরায়া মুখ টিপে হেসে উঠে ভাবলো- “বাইক রাইডারের বাইকে উঠার অভ্যাস নেই। হিহিহি। মজার কথা তো।”
মিরায়া খুব সরলতা নিয়ে মাথা নাড়ালো-
“হুঁ, খুব একটা উঠি নি।”
মিরায়ার কথা শুনে রায়ান একটু গম্ভীর ভাবেই মাথা নাড়ালো আর মিরায়া মনে মনে হেসে ফেটে পড়ছে। তারপর রায়ান খুব সিরিয়াসলি বলল-
“বেইব, লিসেন। আজ না হয় ধীরে রাইড করি কেমন? আমি তোমাকে নিয়ে রিস্ক নিতে চাই না। এরপরের বার ফুললি রাইড করার ড্রেস আপে তোমাকে নিয়ে রাইড করবো, ওকে? আজ থাক।”
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ২৮ (২)
রায়ান নিজের কথা গুলো খুব যত্ন মিশিয়ে বলল। মিরায়ার মনে হতে শুরু করলো একটু হালকা হাতই তো ঠান্ডা হয়েছে । বাইক রাইডার হয়ে এটা জানে না নাকি যে বাইক চালালে বাতাসে হাত ঠান্ডা হয়।
রায়ান মিরায়ার কথা ভেবে ধীরে বাইক চালাতে থাকলো। মিরায়াও কিছু বলল না এইবার বাইক ধীরে চালানো নিয়ে।