ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭১ (২)

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭১ (২)
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

নিজের মামার বাড়িতে, অন্য একজন ভয় দুই হাত লম্বা ঘুমটা টেনে ঘুরছে শ্বেতা। চোরের মতো এদিক ওদিক দেখতে দেখতে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে — না জানি আবার কখন ধরা পড়ে!
“শ্বেতাপু”

শেষ সিঁড়ি ভেঙে তিন তলায় পা রাখতেই পেছন থেকে ভেসে আসা নারী কণ্ঠে চমকে উঠলো শ্বেতা। বুকে ফু দিয়ে ভয়ার্থ চোখে পেছন ফিরে তাকালো।
উল্টো দিক থেকে হন্তদন্ত হয়ে দৌড়ে আসছে থিরা। থিরাকে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শ্বেতা — কলিজায় যেন এক বালতি পানি হলো তার!
থিরা দৌড়ে এসে একটা ফোন ধরিয়ে দিলো শ্বেতার হাতে, ব্যস্ত কণ্ঠে বললো,
“আপু, এটা ইরফান ভাইয়ার। এটা উনাকে খুঁজে একটু দিয়ে দাও প্লিজ। আমায় আম্মু ডাকছেন।”
বলে শ্বেতাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলো থিরা।
ফোনটা হাতে চেপে বোকা-র মতো দাঁড়িয়ে রইলো শ্বেতা। মেয়েটার ঝড়ের মতো ছুটে এসে সাইক্লোনের মতো কিছু কথা ছুঁড়ে দিয়ে চলে গেলো!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ফোনটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভীষণ বিরক্ত হলো শ্বেতা — এখন তাকে ইরফানকে খুঁজতে হবে। এমনি‌তেই ‘দেবী’র ভয়ে এক সপ্তাহ যাবৎ গা ঢাকা দিয়ে আছে শ্বেতা, এখন ইরফানকে খুঁজতে গিয়ে যদি ধরা পড়ে…
“ধুর!” — বলে বিরক্তি প্রকাশ করলো শ্বেতা। কিন্তু কী আর করার! উপায় না দেখে খুঁজতে শুরু করলো ইরফানকে।
সামনের দিকে হাঁটা ধরতেই টুং টুং করে পরপর কয়েকটা মেসেজ এলো ফোনে। শ্বেতা অন্যের জিনিস দেখতে ইন্টারেস্টেড নয়, কিন্তু আরো দুই পা এগোতেই হাতের মুঠোয় ফোন ভাইব্রেট করে উঠলো। দাঁড়িয়ে পড়লো শ্বেতা। কৌতূহলবশত ফোনটা চোখের সামনে ধরতেই দেখলো — ব্ল্যাক স্ক্রিনে ফুটে আছে:
“Prithom is calling.”

মেজদার ফোন! শ্বেতা ধরবে কি ধরবে না ভাবতে ভাবতে ফোনটা কেটে গেলো। আবার টুং করে একটা মেসেজ এলো। এবার অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেসেজটার উপর দৃষ্টি আটকালো শ্বেতার।
লেখাটা দেখে জমে গেলো শ্বেতা। গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো রীতিমতো। কয়েক লাইনের মেসেজটা এমন ছিলো:
“আমাদের বড় দাদন অনেক অসুস্থ। অপারেশনের পর অনেক টাকার দরকার, ইরফান।
আমি বাসা থেকে আসার সময় তাড়াহুড়োতে কার্ড, ক্যাশ কিছুই আনতে পারিনি। ভাইয়ার বন্ধুর কার্ডে যতটুকু ছিলো তা দিয়ে অপারেশনসহ এক সপ্তাহের ওষুধপত্র হয়েছে। এখন আর হচ্ছে না। ইমার্জেন্সি টাকার প্রয়োজন।
তুই ইনুর কাছ থেকে আমার কার্ডটা নিয়ে দ্রুত USA আয়। ঠিকানা তোকে মেইল করে দিচ্ছি।”
শ্বেতার মুখ আপনা-আপনি ‘হা’ হয়ে গেলো —

“প্রণয় ভাইয়ের অপারেশন? কেনো!”
শ্বেতা মেসেজটা ক্লিয়ার করতেই আরেকটা মেসেজ ভেসে উঠলো, যেখানে লেখা:
“বিষয়টা একদম গোপন রাখবি। ইরফান যেন বাসার কাক পক্ষীতেও টের না পায়। আমাদের টাকার অনেক প্রয়োজন। প্লিজ, তাড়াতাড়ি আয়…”
শ্বেতা হতবাক হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো ফোনের দিকে। অতঃপর চট করে মাথায় বুদ্ধির বাতি জ্বলে উঠলো — সে আরো দ্রুত ইরফানকে খুঁজতে শুরু করলো। খুঁজতে খুঁজতে একসময় পেয়েও গেলো — তিন তলার ছাদে।
“ইরফান সাহেব।”
ছাদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশ উপভোগ করতে করতে কফির কাপের চুমুক দিচ্ছিলো ইরফান। পেছনে না চেয়েই জবাব দিলো —

“বলো, শ্রুতস্মিনী।”
শ্বেতা ধীরে পায়ে হেঁটে এসে পাশে দাঁড়ালো। ইরফানের ফোনটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো —
“আপনার ফোন।”
“মেজদা বলেছেন কে USA যেতে।”
চায়ের কাপ থেকে চোখ সরিয়ে, কপাল কুঁচকে তাকালো ইরফান। ভ্রু নাচিয়ে শুধালো —
“কেনো?”
“প্রণয় ভাইয়ার নাকি কিসের অপারেশন হয়েছে। তাঁর চিকিৎসার জন্য মেজো ভাবির কাছ থেকে টাকা নিয়ে যেতে বলেছেন।”
“কখন?”
“এই তো, আপনাকে টেক্সট করে।”

ইরফানের একটু খটকা লাগলো। সে ফোনের পাওয়ার বাটন প্রেস করে দেখলো — সত্যি!
এবার শ্বেতার পানে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চাইল —
“তুমি আমার ফোন চেক করছিলে?”
ছাদের রেলিংয়ে শুকোতে দেওয়া থরে থরে সাজানো আচার-এর বয়াম থেকে কেবল একটুকরো তেঁতুলের আচার মুখে দিয়েছিলো শ্বেতা, কিন্তু ইরফানের এমন প্রশ্নে বিষম খেয়ে গেলো। চোখ বড় বড় করে ঠোঁট নাড়িয়ে বললো —
“নাউজুবিল্লাহ! আমি কেনো আপনার ফোন চেক করতে যাবো? ফোন নিয়ে এসেছি, চোখের সামনে পড়েছে, দেখে নিয়েছি।”

চোখে এক সমুদ্র তৃষ্ণা নিয়ে চেয়ে রইলো ইরফান। ঠোঁট নাড়িয়ে নাড়িয়ে কথা বলার ভঙ্গিমাটা কী ভীষণ চমৎকার লাগলো তার! কোন মানবী এত সুন্দরও হয়?
শ্বেতা ফের বললো —
“যাবেন না?”
ইরফানের ধ্যান ছুটে গেলো। মাথা দুলিয়ে বললো
“যাবো।”
“কখন? একটু পরে?”
“আমাকে সাথে নিবেন?”
কফিতে কেবল চুমুক দিয়েছিলো ইরফান, কিন্তু এবার তার ভীষণ লেগে গেলো। শ্বেতা পিঠ চাপড়ে বললো —
“শাট – শাট! আপনি ঠিক আছেন?”
ইরফানের চোখ ডিম্বাকৃতি ধারণ করেছে। সে কণ্ঠে বিস্ময় ঢেলে জানতে চাইল —
“তুমি আমার সাথে যাবে…?”
শ্বেতা উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো।

“কেনো?”
“এমনি। প্রণয় ভাইকে দেখতে। আমার বড় ভাই অসুস্থ, আমি দেখতে যাবো না?”
ইরফানের নিকট ব্যাপারটা কেমন গুলমাল ঠেকলো। কিন্তু উনিশ-বিশ ভাবনাকে পাত্তা না দিয়ে বললো —
“তোমার পরিবার যেতে দেবে?”
শ্বেতা একটু ভেবে জবাব দিলো —
“হুম।”
“ওকে, চলো তাহলে।”

দীর্ঘ ১০ ঘণ্টা যাত্রা শেষে বিমান এসে অবতরণ করলো লস অ্যাঞ্জেলস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। ইরফান অ্যাপল ওয়াচে সময় দেখে নিলো – রাত ৯টা।
শ্বেতা এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দু’হাত মেলে দিলো, বুক ভরে তাজা বাতাস টেনে নিলো ফুসফুসে। এই মুহূর্তে নিজেকে তার পাখির পালকের মতো হালকা মনে হচ্ছে। অন্তত কয়েকটা দিন সে নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে – তাকে আর ভয়ে ভয়ে বাঁচতে হবে না, ওই মহিলার অসহ্যকর মুখটাও আর দেখতে হবে না।
এই শান্তি।
“স্রোতস্বিনী…”

কারো গম্ভীর কণ্ঠের সম্বোধনে স্থম্ভিত ফিরলো শ্বেতা। পাশ ফিরে দেখলো ইরফান দাঁড়িয়ে আছে বিমোহিত নেত্রে, মুগ্ধতা ছড়িয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
ফুল স্লিভ সাদা লং গাউনে শ্বেতাকে পুরো শুভ্র পরির মতো লাগছে। ইরফানের কাছে এই পরীটাকে দেখে বিগত ১০ ঘণ্টা যে কোনো ফাঁকে কেটে গেলো, বুঝতেই পারলো না। বুকের ভিতর কেমন অদ্ভুত তোলপাড় অনুভব করলো।
“আমি কি প্রেমে পড়ে গেলাম?”
“ইরফান সাহেব… এই যে, ইরফান সাহেব!”
শ্বেতার মৃদু শব্দের চেঁচানিতে হকচকিয়ে গেলো ইরফান। ছিটকে পড়লো মোহের জগত থেকে।
দমকা বাতাসে উড়ে যাওয়া এলোমেলো কেশগুচ্ছ কানের পেছনে গুঁজে শ্বেতা বললো,
“এখন কোথায় যাব ইরফান সাহেব?”

ইরফান হালকা কেশে, কণ্ঠে স্বাভাবিক মাত্রা টেনে বললো,
“আপাতত হাসপাতালে। কারণ প্রিথমে আমাকে ওই ঠিকানাটাই দিয়েছে। তারপর আমাদের বাড়িতে যাব।”
অবাক হলো শ্বেতা। বিস্ময় নিয়ে জানতে চাইল,
“আমাদের বাড়ি মানে?”
“হ্যাঁ, আমাদের বাড়ি। আমার বাড়ি তো এখানেই। আর আমার বাড়ি কি তোমার বাড়ি নয়, স্রোতস্বিনী?”
শ্বেতা মুখ হা করে তাকিয়ে রইলো।
এই লোকের কি মাথা খারাপ? তবে এসব নিয়ে কথা না বাড়িয়ে জানতে চাইল,
“আচ্ছা, আমরা হসপিটালে যাচ্ছি… ভাইয়ারা তাহলে ওখানেই আছে?”
“সেটা তো বলতে পারছি না। কারণ আমার ব্যাটারি ডেথ হয়ে গেছে।”
শ্বেতার মুখ মলিন হলো।
ইরফান মৃদু হেসে বললো,
“চলো যাওয়া যাক। এয়ারপোর্ট থেকে হাসপাতালের দূরত্ব মাত্র ১০ মিনিটের হাঁটা পথ। হেঁটেই চলে যাবো।”
শ্বেতা অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আসলেই?”
“হুম।”

CMC হাসপাতালের ১০ তলার করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতা ও ইরফান।
“৭১২ নম্বর ক্যাবিনই তো বললো, ইরফান সাহেব?”
“হুম। কিন্তু আমাদেরকে এভাবে ঢুকতে দেবে না। তার জন্য পেশেন্ট পার্টির কারো পারমিশন লাগবে।”
“হুম… তাহলে মেজদারা কোথায়?”
“নার্স ডাকতে গেছে।”
ইরফান কথা শেষ করার আগেই ৭১২ নম্বর ক্যাবিনের দরজা খোলার শব্দে থেমে গেল দু’জন। কৌতূহল নিয়ে তাকালো সেইদিকে।
গায়ে সাদা অ্যাপ্রোন পরিহিত একজন লম্বা, চওড়া গড়নের পুরুষ বেরিয়ে এলেন ভেতর থেকে। মুখে মাস্ক থাকায় চিনতে পারলো না ইরফান।
কিন্তু সেই ব্যক্তির দর্শন পাওয়া মাত্রই শ্বেতার কলিজায় কামড় দিয়ে উঠলো। চোখ বড় বড় হয়ে এলো বিস্ময়ে। আবির্ভাব দেখে ফেলার পূর্বেই ঢুকে পড়লো ইরফানের পেছনে। মনে মনে কপাল চাপড়ে বললো,
“হায় আল্লাহ! যার থেকে লুকাতে এত দূরে পালিয়ে এলাম, দিন শেষে কিনা তার হাতেই কট খেলাম?”
আবির্ভাব মুখের মাস্ক খুলে এগিয়ে এলো ইরফানের নিকট। ফর্মাল ভঙ্গিতে বললো,

“আপনি ইরফান শেখ, রাইট?”
“জি। প্রিথম কোথায়?”
“প্রিথম আর প্রেম, জাস্ট কিছুক্ষণ আগেই ডিনার করতে গেছে। ওরা টেনশনে দুই দিন কিছুই খেতে পারেনি।”
ইরফান বুঝলো। ওয়ালেট বের করে প্রিথমের দুইটা কার্ড আবির্ভাবের হাতে দিয়ে বললো,
“এইগুলোর জন্যই নিশ্চয় বিপদে পড়েছিলেন।”
আবির্ভাব কিছু বলবে, তার আগেই কিছু একটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। ইরফান তার দৃষ্টি অনুসরণ করে পিছনে তাকালো।
শ্বেতাকে নিজের পেছনে লুকিয়ে পড়তে দেখে মুচকি হাসলো ইরফান। শ্বেতার হাত টেনে সামনে এনে বললো,

“ও আমার সাথে এসেছে, এটা বাড়ির কাউকে বলবেন না প্লিজ। আর প্রিথমকে বলবেন, ওর দাদাকে যেন না বলে।”
আবির্ভাব হতবাক নয়নে চেয়ে আছে শ্বেতার দিকে। যেন নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছে না।
শ্বেতার ঠোঁট কাঁপে, দৃষ্টি নত হয়। ইরফান কোমল হাতের রূঢ় বন্ধন শক্ত করে, নরম কণ্ঠে শুধালো,
“চলো, ডিনার করে নেবে স্রোতস্বিনী।”
শ্বেতা নড়াচড়ার সক্ষমতা পেলো না। ভয়ে তার খাল-বিল-নদীনালা শুকিয়ে যাচ্ছে। সে চোরা চোখে তাকালো আবির্ভাবের দিকে।

আবির্ভাবের শান্ত চোখের শীতল দৃষ্টি দেখে শিউরে উঠলো মেয়েটা।
সে জানে না, আবির্ভাবকে কেন এতো ভয় পাচ্ছে, তবে ভয় পাচ্ছে।
আবির্ভাব চেপে ধরা হাতের পানে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে চলে গেল।
অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করে উঠলো শ্বেতা। ততক্ষণে প্রিথম আর প্রেমও এলো।
তারা শ্বেতাকে দেখে অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কি রে, তুই এখানে কেন?”
শ্বেতা এদিক ওদিক দৃষ্টি ফেলে আমতা আমতা করতে লাগলো,
“ন…মানে… ভাইয়া…”

“কি না মানে? হ্যাঁ মানে করছিস? কার সাথে এসেছিস তুই?”
“আমার সাথে,” পাশে থেকে বলে উঠলো ইরফান।
প্রিথম কণ্ঠে অবাকত্ব টেনে বললো,
“তোর সাথে?”
“হুম।”
“কেন?”
“এমনি… ঘুরতে… কিন্তু এগুলো বাড়িতে বলবি না।”
“মানে, বাড়িতে কি বলেছিস?”
এবার শ্বেতা নিচু কণ্ঠে জবাব দিলো,
“মিথ্যে বলিনি ভাইয়া। আমি সত্যি এখানকার ইউনিভার্সিটিতে একটা প্রজেক্ট নিয়ে স্টাডি করতে এসেছি ফোর্থ টার্মের জন্য।”
প্রিথম আর কিছু বললো না।

“ঠিক আছে।”
ইরফান তাদের শুকনো মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে বললো,
“কি ব্যাপার? তোরা কি রাতে ঘুমাস না?”
“হাসপাতালে আবার ঘুম!” – কণ্ঠটা ভীষণ দুর্বল শোনালো প্রেমের।
ইরফান ধমকে উঠে বললো,
“হাসপাতালে কেন ঘুমাবি? আমার বাড়ি নেই? তোরা আমার বাড়িতে গিয়ে থাকতে পারতি না?”
প্রিথম একটা ছোট্ট দম ফেলে বললো,
“শুধু মুধু কেন? তোদের হয়রানি করাবো?”
ইরফান জবাব দিলো না। নাক কুঁচকে নিজের বাড়ির চাবিটা দিয়ে বললো,
“যা, গিয়ে ঘুমিয়ে পড়।”

“চলো, স্রোতস্বিনী,” বলে শ্বেতার হাত ধরে যাত্রা ধরলো।
শ্বেতার অসস্থিতে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
ইরফান এগোতে নিলে প্রিথম তার শার্ট টেনে ধরলো, ধাক্কা মেরে পাশে নিয়ে গিয়ে বললো,
“হু হু! কি ব্যাপার ভাই, লক্ষণ তো সুবিধার নহে মামা।”
ইরফান হালকা লজ্জা পেলো।
প্রিথম চোখ বড় বড় করে বললো,
“সিরিয়াসলি?”
ইরফান তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,

“তুমি প্রতিদিন একটা করে প্রোডাক্ট উদ্বোধন করছো, আমি করবো না নাকি?”
প্রিথম বাঁকা হেসে থাম্বস আপ দেখিয়ে বললো,
“বেস্ট অফ লাক।”
ইরফান বাঁকা হেসে চলে গেলো শ্বেতাকে নিয়ে।
দূর থেকে এই সকল দৃশ্য দেখতে পেলো আবির্ভাব। শুনতেও পেলো সব কিছু। অতিরিক্ত রাগান্বিত হওয়ার দরুণ টানটান হয়ে থাকা ঘাড়ের শিরায় ব্যথা অনুভব করলো; বক্ষ পাঁজরে বন্দী থাকা পাখিটা ছটফটিয়ে উঠলো বিষাক্ত নীল বিষের যন্ত্রণায়। শরীরের শিরায় শিরায় খেলে গেল বিক্ষিপ্ত এক বিস্রী অনুভূতি, হাত নিশফিশ করে উঠলো সেই কাঙ্ক্ষিত নারীকেই শেষ করে দেওয়ার তাড়নায়।

কোলাহল মুক্ত নীরব রজনী চারদিক ঘন কুয়াশার চাদরে মোড়ানো। অন্ধকারের বুক চিরে দাঁড়িয়ে থাকা সোডিয়ামের টিমটিমে হলুদ আভা ছড়ানো চকচকে রাস্তার এক প্রান্তে গুটিসুটি মেরে দাঁড়িয়ে আছে শ্বেতা। গায়ে আগের সেই ফিনফিনে পাতলা গাউন।

শ্বেতা বারবার ওড়না দিয়ে শরীর ঢাকার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। রাত বাড়ার সাথে সাথে তাপমাত্রা কমছে শু শু করে, চলতে চলতে মাঝে মধ্যে ধমকা শীতল বাতাস এসে ছুঁয়ে দিয়ে যাচ্ছে আনমনে , যদিও সেপ্টেম্বর মাস।
এই তীব্র শীতে ও চকোলেট আইসক্রিমের গায় কামড় বসাতে বসাতে ভুলছে না শ্বেতা তীব্র শীতে ভেতর ভেতর আত্মা কাঁপছে, তবু ও খাওয়া থামাচ্ছে না খেতে খেতে আপন মনে হেঁটে চলেছে।
তার চোখ মুখে ভর করে আছে একরাশ মুগ্ধতা — এই দেশের ফুটপাতটাও কত সুন্দর ঝকঝকে চকচকে!
জুতা খুলে হাতে নিয়ে নিল শ্বেতা, নগ্ন পায়ে ছোট ছোট কদম ফেলতে লাগলো শিশির ভেজা ঘাসে।
নিজের খেয়ালে হারিয়ে গিয়ে অনেক দূরে চলে এলো শ্বেতা, আকাশকুসুম কল্পনা করতে করতে কখন যে এতটা সময় পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারল না।
অনেকটা পথ পেরিয়ে আসার পর হঠাৎ স্থির হয়ে দাঁড়ালো শ্বেতা। তার ষষ্ঠ ইন্দ্র অন্য কারো উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। অজানা আশঙ্কায় শিউরে উঠলো মেয়েটা।

ভয়ে ভয়ে ঘাড় গুড়িয়ে এদিক ওদিক দেখে ঝট করে পিছনে তাকালো — পুরো ফুটপাত একদম শুনশান, যত দূর অব্দি চোখ যায় কেবল ঘন কুয়াশা।
তবুও মনটা খচখচ করছে শ্বেতার। অবচেতন মনে কেবল অনুভব হচ্ছে, কেউ বা কারা তার আশেপাশেই আছে। ভয়ে ভয়ে চারপাশে আরেকবার চোখ বুলালো, কিন্তু এবারও তাই — কাউকেই দেখতে পেল না।
আবারো হাঁটা ধরলো শ্বেতা। দুই কদম এগিয়ে পুনরায় থেমে গেল। চমকে উঠে বলল,
“ইরফান, ইরফান কোথায়?”
এই হাড় কাঁপানো শীতেও শ্বেতার কপালে বিন্দু বিন্দু ঘামের সৃষ্টি হল। মনে পড়লো ৩০ মিনিট আগের কথা—

“স্রোতস্বিনী সুপার শপে যাবে।”
শ্বেতা ইতিমধ্যে অনেক ক্লান্ত, বিধায় স্পষ্ট বাক্যে জানিয়ে দিল—
“না, এখন এত বড় শপে চক্কর কাটতে পারব না, ঘুম পাচ্ছে।”
“শিওর তুমি যাবে না?”
“হুম।”
“ওকে, তাহলে তুমি এখানেই দাঁড়াও, আমি ৫ মিনিটের মধ্যে আসছি। জাস্ট যাব আর আসবো।”
“ঠিক আছে।”
“এখান থেকে এক পা-ও এদিক ওদিক নাড়াবে না কিন্তু।”
“আচ্ছা।”
“পাক্কা?”
“হুম।”
“ওকে, আমি যাচ্ছি আর আসছি।”

বলে সুপার শপের ভেতর ঢুকে পড়েছিল ইরফান।
কিন্তু ইরফানের সতর্কবাণী শ্বেতা বেমালুম ভুলে গিয়ে উল্টোপাল্টা ভাবতে ভাবতে এত দূর চলে এসেছে।
ঠান্ডার তীব্রতায় শ্বেতার ধবধবে শরীর ফ্যাকাশে বর্ণ ধারণ করতে শুরু করেছে, হাত পা ঝিম ধরে আসছে ইতিমধ্যেই।
সে ঢুক গিয়ে ভাবলো—
“এটা আমার দেশ নয়। আমি কিছুই চিনি না, আশেপাশে কাউকে দেখছিও না, কোথায় এসে পড়েছি সেটাও বুঝতে পারছি না।”

শ্বেতা উত্তেজনা দমিয়ে ঠান্ডা মাথায় কিছুক্ষণ ভেবে গুগল ম্যাপ ওপেন করলো।
দুই মিনিট ঘাটাঘাটির পর নিজের লোকেশন উদঘাটন করতে সক্ষম হলো। কিন্তু ম্যাপে যা দেখলো, তাতে শ্বেতার ভয়ে ভিরমি খাওয়ার উপক্রম হলো।
জায়গাটা ভীষণ শুনশান। সাথে পাশেই ৪০০ বছর পুরনো খ্রিস্টানদের কবরস্থান। ভয়ে আতঙ্কে চোখ মুখ নীল হয়ে এলো শ্বেতার। সাহস করে একবার পশ্চিম দিকে তাকালো — এখান থেকেই কবরস্থানের গেট দেখা যাচ্ছে। মাঝ রাতের অন্ধকারে সে ভাঙ্গাচুরা গেট শ্বেতার নিকট আরো কয়েক গুন ভুতুড়ে ঠেকল। আর সেদিকে তাকালো না শ্বেতা।
এখানে থাকা ঠিক নয় ভেবে ম্যাপ অনুসরণ করে যেতে ধরলো।
কিন্তু একটু দূর এগোতেই পিছন থেকে ভেসে আসা অশ্লীল কিছু নোংরা মন্তব্যে পা স্থির হয়ে গেলো।
ভয়ে বুক ধক করে উঠলো শ্বেতার। উল্টো ঘুরে দেখলো— ওর থেকে কিছু দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে চারজন মধ্যবয়স্ক লোক।

আপাদমস্তক মাতাল। কেউই নিজ পায়ে ভর দিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। চোখগুলো কেমন ঘোলা ঘোলা।
এদের দেখে কলিজা কামড়ে উঠলো শ্বেতার। লোক চারটার মধ্যে দু’টো সম্ভবত আফ্রিকান কিংবা নাইজেরিয়ান, আর দু’টো সাদা চামড়ার — হয়তো এই দেশেরই।
ওরা ঠোঁটে বিশ্রী হাসি ঝুলিয়ে এগিয়ে আসছে শ্বেতার পানে। তাদের লোলুপ দৃষ্টিতে লালসা ঝরে ঝরে পড়ছে। যেন চোখ দিয়েই গিলে খেতে চায়।
আফ্রিকান লোকটা অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে ঠোঁট চেটে বললো,
“ওয়াও, বং বিউটি! ইউ আর লুকিং সো সেক্সি! এত রাতে আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছো বুঝি?”
একটু আগেও শীতের তোপে জমে যাচ্ছিল শ্বেতা, কিন্তু এখন ভয়ে উৎকণ্ঠায় অস্থিরতায় দর দর করে ঘামছে। কপাল বেয়ে চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে চিকন ঘামের রেখা।
ভয়ার্থ চোখে তাদের দিকে এক পলক তাকিয়ে উল্টো ঘুরে দৌড় দিল শ্বেতা।
এতে লোক চারটা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
সাদা চামড়ার লোকটা ঠোঁট বাঁকিয়ে বললো,

“হেই প্রিন্সেস, স্টপ দ্য রান! ইউ আর সাচ আ বিউটিফুল…”
শ্বেতা অনুভব করলো, লোক চারটা ওর পিছু পিছু দৌড়াচ্ছে।
দিশেহারা হয়ে যেদিকে পারলো সেদিকেই দৌড় দিল শ্বেতা। ধরা পড়লে আজ তার সব শেষ!
থ্রিপিস পরে বেশি জোরে দৌড়াতে পারছে না শ্বেতা, পাতলা হলেও ঘের অনেক — জামাটা বারবার পায়ে পেঁচিয়ে যাচ্ছে।
অসাবধানতায় দৌড়াতে গিয়ে বুড়ো আঙুলে সজোরে উষ্টা খেলো শ্বেতা। ব্যথায় চিৎকার দিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে নিল পিচঢালা রাস্তায়।
আঁতকে ওঠে চোখ খিচে বন্ধ করে নিল শ্বেতা, নিজেকে ছেড়ে দিল আল্লাহর ভরসায়। সেকেন্ড গড়ানোর পূর্বেই যথারীতি আছড়ে পড়লো — কিন্তু পিচঢালা রাস্তায় নয়, অন্য কিছুর উপর।
চোখ বন্ধ অবস্থাতেই অনুভব করলো, দুটো শক্তপক্ত হাত পরম স্নেহে আগলে নিল, তাকে যত্ন করে ঠাঁই দিল নিজের বুকে।

ইষৎ কেঁপে উঠলো শ্বেতা। নাকে এসে ঠেকলো সুপরিচিত সেই পুরুষালী ঘ্রাণ।
ঝট করে চোখ খুলে ফেললো সে। দৃশ্যপটে উদ্ভাসিত হলো প্রশস্ত এক বুক। শ্বেতা অবাক দৃষ্টিতে মাথা উঁচু করে উপরে তাকালো।
সাথে সাথেই চুম্বকীয় কোনো আকর্ষণে চোখ আটকে গেল শ্বেতার — আবির্ভাব চোয়াল শক্ত করে তাকিয়ে আছে লোক চারটার দিকে, রক্তিম চোখ দিয়ে যেন গলিত লাভা বর্ষণ হচ্ছে।
লোকটা বলল,

“This young man, you move away from our way. It is our fuck.”
কথা শেষ করার আগেই শ্বেতাকে নিজের থেকে সরিয়ে দিল আবির্ভাব। তেড়ে গিয়ে থাবা মেরে ধরলো লোকটাকে। সাথে সাথেই দাবাং এক ঘুষি বসিয়ে দিল লোকটার নাক বরাবর।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই এলোপাতাড়ি মারতে শুরু করল।
হঠাৎ আক্রমণে হতভম্ব হয়ে গেল বাকি তিনজন। সাথে আতঁকে উঠলো শ্বেতা। এমনটা কেউই আশা করেনি হয়তো।
আবির্ভাবের পাশিবহুল হাতের অমানবিক আঘাতে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাচ্ছে লোকটা। নাক-মুখ ছিঁড়ে ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে টাটকা রক্ত।
পুরুষের রাগ ভয়াবহ, আর আঘাত যখন লাগে তার দুর্বলতায় — তখন মানুষ থেকে হিংস্র পশুতে পরিণত হতেও তারা দুবার ভাবে না।

প্রতিটা মারের সাথে কেঁপে কেঁপে উঠছে শ্বেতা। লোকটা রক্তাক্ত শরীর লুটিয়ে পড়েছে মাঝরাস্তায়। এখনো মেরে চলেছে আবির্ভাব। রাগে তার শরীর কাঁপছে থরথর করে।
এতক্ষণ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছিল অন্য তিনজন। তারা আসলে বুঝে উঠতে পারছিল না আসলে ঘটছেটা কি?
কিন্তু এবার ওরা আবির্ভাবকে আঘাত করতে উদ্যত হতেই, আর্তনাদ করে উঠলো শ্বেতা।
দৌড়ে এসে আবির্ভাবের কোমর জড়িয়ে ধরল, টেনে সরিয়ে নিল লোকটার থেকে। আঙুলের ফাঁকে আঙুল চেপে ধরে ভয়ার্থ কণ্ঠে বললো,

“মাথা নষ্ট হয়ে গেছে আপনার? এবার মারলে তো লোকটা মরে যাবে!”
আবির্ভাবের মাথায় খুন চেপে আছে। সে ঝটকা মেরে সরিয়ে দিল শ্বেতাকে। পুনরায় তেড়ে গেল লোকটার পানে।
ভয়েতে হাত-পা অবশ হয়ে আসছে শ্বেতার। সে আবারো ছুটে গিয়ে পেছন থেকে কোমর আঁকড়ে ধরল আবির্ভাব কে। অনুনয় করে বলল,
“আমার কথা শুনুন প্লিজ! চলুন এখান থেকে! এদের সাথে আপনি একা পারবেন না। দেখুন, ওরা চারজন, আর আপনি একা — ওরা মেরে ফেলবে আপনাকে!”
আবির্ভাব ফুঁসে উঠলো। রাগান্বিত দৃষ্টিতে চাইল শ্বেতার পানে।
প্রেমময় দুই চোখে ক্রোধাগ্নি দেখে ভড়কে গেলো শ্বেতা, তবু ও পিছিয়ে গেল না।
লোকগুলো তাদের দিকে ছুটে আসছে দেখে আবির্ভাবের হাত চেপে ধরলো। চিপা গলির দিকে দৌড়াতে দৌড়াতে চিৎকার দিয়ে বলল,

“তারাতারি দৌড়ান! ওরা যেন আমাদের ধরতে না পারে!”
আবির্ভাব আর কোনো প্রতিউত্তর করলো না। শ্বেতার হাত চেপে ধরে ঢুকে পড়লো অন্য একটি গলিতে। মাতালগুলো এখনো তাদের পিছু নিচ্ছে।
শ্বেতা আবারো দৌড়াতে গিয়ে জামায় পা বেঁধে মুখ থুবড়ে পড়তে নিলো। সাথে সাথে সতর্ক হস্তে বাহু টেনে ধরলো আবির্ভাব।
এবারের উষ্টায় জান বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো শ্বেতার। বুড়ো আঙুলের নখ উল্টে গিয়ে রক্ত বেরিয়ে এলো।
ব্যথার তীব্রতায় চোখে পানি টলমল করে উঠলো। ব্যথাতুর চোখ দুটো যেন নিঃশব্দে বলল:
“আমি আর পারছি না আবির্ভাব।”

আবির্ভাব ও যেন শুনতে পেল সেই আর্তনাদ। পিছনে চেয়ে দেখলো — ওরা খুব বেশি দূরে নয়।
এক পলক শ্বেতার মুখের দিকে তাকিয়ে একটানে কাঁধে তুলে নিলো তাকে। লোকগুলোর চোখ ফাঁকি দিয়ে ঢুকে পড়লো অন্ধকার গলিতে।
শ্বেতা হাত-পা ছোড়াছুড়ি শুরু করে দিলো। এলোপাতাড়ি ঘুষি মারতে মারতে অভিমানী গলায় বলল,
“প্লিজ! নামান আমায়!”
এত নড়াচড়াতে চরম বিরক্ত হলো আবির্ভাব। হাতের বাঁধন প্রবল দৃঢ় করে ঠান্ডা গলায় হুমকি ছুড়ে দিল,
“মুখ দিয়ে যদি আর একটাও উহু আহ শব্দ বের হয়, এখানেই সব করে ফেলব যা যা করতে বাকি রেখেছি!”
ছটফটানি বন্ধ করে দিল শ্বেতা। বিস্ময়ে চোয়াল ঝুলে মুখ হা হয়ে গেল…
পেছন থেকে লোকগুলোর চিৎকার শোনা যাচ্ছে:

“Fucking bitch, where do you think you’re going?”
“Come here, you tease! Don’t make us chase you!”
গালাগালি দিতে দিতে লোক চারটে একদম কাছে চলে আসছে বুঝতে পেরে, পাঁচিলের সাথে একদম সেঁটে গেল আবির্ভাব।
শ্বেতাকে কাঁধ থেকে নামিয়ে শক্ত করে ঝাঁপটে ধরলো প্রশস্ত বুকে।
চেপে ধরার তীব্রতায় শ্বেতার হাড়-হাড্ডি গুঁড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম। নিশ্বাস ফেলার ফুসরতটুকু দিচ্ছে না আবির্ভাব।
ছোট্ট বাবুই পাখি বুকের খাঁচায় ছটফট করতে করতে কোনোমতে ফিসফিসিয়ে বললো,
“আহ! একটু আস্তে চাপুন না… ব্যথা পাচ্ছি তো! ৩৩+ হওয়ার পর ও হাড়ে এত জোর আসে কোথা থেকে!”
আবির্ভাব তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শ্বেতার মুখে। মেয়েটার টলটলে ব্যথাতুর চোখ বলছে —
“আর ব্যথা দিও না…”

আবির্ভাবের মায়া হলো। হাতের বাঁধন কিঞ্চিৎ ঢিলে করে ধরলো।
সাথে সাথেই হাঙ্গরের মতো বিশাল হা করে নিঃশ্বাস ফেললো শ্বেতা।
আবির্ভাব এখনো চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে আছে — হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে,
“এই মেয়েটা কি কোনভাবে তাকে বয়সের খোঁটা দিলো?”
শ্বেতা ব্যথা পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু একইসাথে একধরনের সুখের আবেশ ছড়িয়ে পড়ছে শরীরের শিরা-উপশিরায়।
সামনের পুরুষটার শরীরের নেশালো ঘ্রাণে মাতাল মাতাল লাগছে নিজেকে।
সে নিজের অজান্তেই নাক-মুখ ঘষতে লাগলো বুকে।
আবির্ভাবের তপ্ত নিঃশ্বাসের ঝড় এসে আছড়ে পড়ছে তার চোখে-মুখে। মনের দিক থেকে প্রচণ্ড দুর্বলতা অনুভব করে মেয়েটা — সে যে কতটা দুর্বল, তা বোঝানোর জন্য হয়তো এই পুরুষের একটুখানি স্পর্শই যথেষ্ট।
শ্বেতা আর দ্বিতীয় কিছু বলল না। চুপটি করে পড়ে রইল সেই শান্তি নীড়ে!

বেশ কিছুক্ষণ গালাগালি করার পর আর লোকগুলো কোনো শব্দ শুনতে পাচ্ছে না আবির্ভাব। পাঁচিলের উপর দিয়ে উঁকি মেরে দেখল — রাস্তা পুরো ফাঁকা।
হয়তো খুঁজে খুঁজতে অন্য দিকে চলে গেছে।
হাফ ছেড়ে বাঁচল আবির্ভাব। ফস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে হাতের বাঁধন আলগা করল। নিচু কণ্ঠে বলল,
“ওরা চলে গেছে।”
শ্বেতা আবির্ভাবের কাছ থেকে একটু সরে দাঁড়াল। আশেপাশে উঁকি দিয়ে দেখল, সত্যিই মাতালগুলো আর নেই। নিশ্চিন্ত হলো শ্বেতা।
চিপা গলি থেকে বেরিয়ে পুনরায় ফুটপাথে এসে দাঁড়াল দুজন।
আবির্ভাব পকেট হাতড়ে লাইটার বের করে সিগারেট জ্বালালো। নির্মল বাতাসে নিকোটিনের বিষাক্ত ধোঁয়া উড়িয়ে শান্ত অথচ গম্ভীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“তুমি কাকে জিজ্ঞেস করি, বাংলাদেশ থেকে এই দেশে এসেছো? তুমি কাকে চেনো এই দেশের?”
আবির্ভাবের শীতল কণ্ঠে ক্রোধের আভাস পেয়ে মনে মনে একটু ভরকে গেল শ্বেতা। তবে তা চেহারায় না ফুটিয়ে স্পষ্ট বাক্যে জানালো,
“আমি একুশ চলে ডাক্তার রায় চৌধুরী। আমি নিজেই নিজের মর্জির মালিক। আমি নিজ ইচ্ছায় যেখানে খুশি সেখানে যেতে পারি, তার জন্য কাউকে কৈফিয়ত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করি না।”
আবির্ভাবের ঠোঁটের কোণে তাচ্ছিল্য খেলে গেল। ব্যঙ্গ করে বলল,
“Really? তুমি কোন দিক থেকে বড় হয়েছো?”
শ্বেতা জবাব দিল না। আবির্ভাবের হাত থেকে সিগারেটটা কেড়ে নিয়ে ছুড়ে ফেলল দূরে ঘুরিয়ে প্রশ্ন করল,

“আপনি সিগারেট খান?”
“আরো অনেক কিছু খাই।”
“আবার গর্ব করে বলছেন আপনি জানেন না—Smoking causes cancer?”
অদ্ভুত চোখে তাকালো আবির্ভাব। ঠোঁট এলিয়ে হেসে বলল,
“যে ক্যান্সার তুমি আমায় দিয়েছো, তার থেকে বড় ক্যান্সার দেওয়ার সামর্থ্য ও রাখে না।”
শ্বেতা তাজ্জব বনে গেল।
“আমি?”
আবির্ভাব কোনো জবাব দিল না। কেবল তৃষ্ণার্ত চাতকের ন্যায় চেয়ে রইল মায়া মেশানো মুখটার পানে । এই তৃষ্ণার্ত দুই চোখের কী করবে সে! এই চোখ দুটো যে অন্য কিছুই দেখতে চায় না।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে শ্বেতা সন্দিহান কণ্ঠে জানতে চাইল,

“আমি এখানে আছি এটা আপনি কিভাবে জানলেন? আপনি কি আমার পিছু নিচ্ছিলেন?”
আবির্ভাব হাসল। শ্বেতার মায়াবী ধূসর চোখে চোখ রেখে বলল,
“তুমি ভাবলে কিভাবে তোমাকে আমি একা ছাড়বো? আমাকে শেষ করার জন্য ছুরি,কাঁচি কত কিছু ছিল!সব ছেড়ে এই পথ বেছে নিলে? মানলাম আমি তোমার শত্রু, তাই বলে এভাবে প্রতিশোধ নেবে? আজ এখানে কিছু একটা হয়ে গেলে কী হতো আমার? কিভাবে বাঁচতাম আমি?”
এই প্রশ্নে দমে গেল শ্বেতা। কালো চোখের ভারী পল্লব ঝাপটে তাকাল আবির্ভাবের পানে। লোকটার চোখ দুটো কেমন ঘোলাটে।

আবির্ভাব পুনরায় কিছু বলতে উদ্যত হতেই একদম কাছে চলে এলো শ্বেতা। আবির্ভাবকে হতবাক করে দিয়ে নিজের কোমল হাতটা চেপে ধরল কপালে।
সাথে সাথেই উষ্ণ শরীরের মাত্রাতিরিক্ত তাপে কেঁপে উঠল শ্বেতা। কপাল থেকে হাত নামিয়ে গাল, গলা, বুক,সহ দেহের অন্যান্য স্থানে হাত চেপে চেপে দেখলো— ধান দিলে খই ফুটবে এতটা গরম।
শ্বেতার এমন অস্থিরতা দেখে কিছু বলল না আবির্ভাব। কেবল আসক্ত চোখে চেয়ে রইল নিজের দুর্বলতার পানে। এই মেয়েটার চোখে নিজের জন্য ভালোবাসা দেখতে এত ভালো লাগে কেন? এত সুখ-সুখ অনুভূতি হয় কেন?
আবির্ভাবের শরীরে এত জ্বর দেখে ভিতর ভিতর কেঁদে উঠল শ্বেতা। মনের চাপা ক্ষোভ উগরে দিয়ে বলল,
“আপনিনা চব্বিশ ঘণ্টা হাসপাতালে ছিলেন, তারপরও… শরীরে এত জ্বর আসল কিভাবে? নিজের প্রতি এত উদাসীন কেন আপনি? নিজের প্রতি এত অনিয়ম, অবহেলা কিসের আপনার?”
আবির্ভাব কিছু না বলে আচমকা বক্ষভাজে ঝাঁপটে ধরল শ্বেতাকে। নিজের ক্ষতবিক্ষত বুকটা প্রিয়তমার সম্মুখে তুলে ধরে বলল,

“আমার যন্ত্রণার একটু ভাগ নেবে মাই লাভ? একটু বুঝবে আমায়, একটু বিশ্বাস করবে আমায়? জানো,বাবুই পাখি তুমি এই বুকে থাকলে পৃথিবীর কোনো অসুখ আমায় কাবু করতে পারবে না। তুমি এই বুকে থাকলে পৃথিবীর কোনো শক্তি আমায় যন্ত্রণা দিতে পারে না।
কিন্তু তুমি বুকে নেই, এই সত্যটা আমার অস্তিত্ব মানতে চায় না… সহ্য করতে পারে না। এই জায়গাটা খুব খালি খালি লাগে, দম বন্ধ হয়ে আসে। তুমি হীনা মরন অনিবার্য, মাই লাভ?”
শ্বেতা স্তব্ধ হয়ে গেল সরল স্বীকারোক্তিগুলো শুনে। এক চুলও নড়াচড়ার বা প্রতিবাদের ক্ষমতা পেল না।
আবির্ভাব তার তুলতুলে পুতুলটাকে আরেকটু শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরল, যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে তার প্রাণ।

শ্বেতা অনুভব করতে পারছে — আবির্ভাবের শরীরটা আগের থেকেও দ্বিগুণ গরম, মানে জ্বর বাড়ছে। কথাগুলোও কেমন উলট-পালট হয়ে জড়িয়ে যাচ্ছে এখন।
শ্বেতা আবির্ভাবের বুক থেকে মাথা তুলে তার লালচে চোখে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল। আবির্ভাবের তপ্ত বাহু চেপে ধরে নরম গলায় বলল,
“আপনি অসুস্থ, আবির্ভাব। আপনার জ্বর বাড়ছে। চলুন, আপনাকে এক্ষুনি হাসপাতালে যেতে হবে। এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে একটু পর আপনি সেন্স হারাবেন। আপনার এতো জ্বর সহ্য হয় না।”
বলেই সামনে দুই পা এগোতেই পেছন থেকে জরানো কণ্ঠে ডেকে উঠল আবির্ভাব,
“মাই লাভ!”

পা স্থির হয়ে গেল শ্বেতার। প্রিয় পুরুষের কণ্ঠ নিঃসৃত প্রিয় সম্বোধনটা সোজা গিয়ে কলিজায় আঘাত আনল।
সে বুঝতে পারছে, আবির্ভাব ইতিমধ্যেই ভুলভাল বকা শুরু করে দিয়েছে।
শ্বেতা অসহায় বোধ করল। আবির্ভাবের পানে তাকিয়ে করুন গলায় বলল,
“অবুঝপনা করবেন না, আবির্ভাব। আপনাকে এসব মানায় না। দেখুন, কত ঠান্ডা পড়ছে, আপনার শরীরটা খারাপ… আরও খারাপ করবে।”
“করুক! আমার মৃত্যুটাই একমাত্র মুক্তি।”
চমকে উঠল শ্বেতা। চট করে আবির্ভাবের ঠোঁট চেপে ধরল। ক্রন্দনরত কণ্ঠে আর্তনাদ করে বলল,
“এমন কথা দ্বিতীয়বার মুখে আনলে আমিই আপনাকে মেরে ফেলব!”
শ্বেতার অশ্রুজমা চোখের পানে অসহায়ের মতো চেয়ে রইল আবির্ভাব।
আহত কণ্ঠে বলল,

“সত্যি বলছি, মাই লাভ, আমি সব সহ্য করে নেবো। কিন্তু তুমি অন্য কারো ঘরে যাবে— এটা এক সেকেন্ডের জন্যও সহ্য করতে পারব না। একদম মরে যাবো, জানো? আমার মৃত্যু কেউ ঠেকাতে পারব না।
এই বিষয়ে আমি প্রচণ্ড স্বার্থপর। সবাই আমার কলিজা টেনে ছিঁড়ে খাক, আমি নিজেই নিজের কলিজাটা কেটে তাদের হাতে তুলে দেব। কিন্তু তোমার এতটুকু ভাগ আমি কাউকে দিতে পারব না। তোমার ভালোবাসার সবটা আমার, শুধু আমার। তোমার মন ও শরীরের উপর কেবল আমার অধিকার — সেই মালিকানার এক চুলও আমি অন্য কারো সাথে ভাগ করতে পারব না। আমার কলিজার শত শত ভাগ হবে, কিন্তু তোমার নয়।”

শ্বেতা বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। কোনো কিছুরই আজ হিসাব মিলছে না। এই লোকটাই আড়াই বছর আগে বলেছিল, সে তাকে ভালোবাসে না, যা হয়েছে সব ভুল। আর আজ সেই লোকটাই তার জন্য এত পাগলামি করছে।
শ্বেতার সব গুলিয়ে গেল। কিন্তু আবির্ভাবের ওই কাতর চোখ দুটো বলছে — তার বাক্যের একবর্ণও মিথ্যা নয়।
আবির্ভাব শ্বেতার মখমলে দুই গালে হাত রেখে ফের বলল,
“ওই ইরফানের সাথে তোমার এত কিসের সখ্যতা, মাই লাভ? তুমি কেন ওর সাথে এত কথা বলো? আমার সহ্য হয় না, আমি মেনে নিতে পারি না। এই দেখো, এখানটায় ভীষণ জ্বালা করে।”
— বলে শ্বেতার হাতটা নিজের বুকে চেপে ধরল আবির্ভাব।
ব্যাকুল কণ্ঠে বলল,

“ওই ছেলেটা তোমাকে চায়, মাই লাভ! কিন্তু তুমি ওর হতে পারো না। তোমাকে ছুঁয়ে দেওয়ার অধিকার অন্য কারো নেই, তোমাকে বুকে নেওয়ার অধিকার অন্য কারো নেই। ন্যায় হোক বা অন্যায়, আমি এত কিছু বুঝি না। আমি শুধু জানি তুমি আমার, তোমাকে বুকে চেপে পিষে মারার অধিকার শুধু আমার — শুধুই এই আবির্ভাবের।”
আবির্ভাবের এসব কথায় শ্বেতার চোখ বেয়ে অঝোরে নোনাজলের বর্ষণ হচ্ছে। তবুও পূর্ব অভিমানে বুক ভারি হলো। নাকের পাটা ফুলিয়ে আবির্ভাবের বুকে সজোরে ধাক্কা মারল। ভেজা কণ্ঠে বলে উঠল,
“আমাকে এসব বলার কী অধিকার আছে আপনার? কে হন আপনি আমার? আমার যা ইচ্ছে তাই করব, যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে ঘুরব, যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে কথা বলব — আপনার কী?”
জ্বরের ঘোরে থাকা আবির্ভাবও এবার ক্ষেপে গেল। থাবা মেরে চেপে ধরল তার নরম বাহু। রক্তিম চোখ দুটো বেয়ে যেন এক্ষুনি রক্ত ঝরবে। ক্ষিপ্ত কণ্ঠে গর্জন দিয়ে উঠল,

“তুই জানিস না আমি তোর কে! তুই জানিস না আমার কিসের অধিকার! তাহলে শুন — আমার কোনো অধিকার থাক বা না থাক, তবুও তুই আমার। এই দেহে প্রাণ থাকতে তোকে অন্য কারো হতে দেব না আমি! কষ্ট দিচ্ছিস? দে! যন্ত্রণা দিচ্ছিস? দে! পোড়াচ্ছিস? পোড়া, আমিও দেখব তুই কতো পুড়াতে পারিস!”
“আমি আপনাকে যন্ত্রণা দিচ্ছি?”
“নে, ছুঁয়ে অনুভব কর যন্ত্রণা দিয়েছিস কিনা!” — বলে শ্বেতার হাত টেনে পুনরায় বুকে চেপে ধরল।
ক্ষিপ্ত কণ্ঠে বলল,

“কান পেতে শোন কি বলে?”
তুই আমার শরীরের জ্বরটা দেখতে পেলি, কিন্তু মনের জ্বরটা দেখতে পেলি না। তুই আমার হাতে রক্তক্ষরণটা দেখতে পেলি, কিন্তু বুকের রক্তক্ষরণটা দেখতে পেলি না।
মেরে ফেল না আমায়, চিরতরে চোখ দুটো বন্ধ করে দে যাতে এই দুচোখ আর তোকে দেখতে না চায়। বিশ্বাস কর, আর সহ্য করতে পারি না। আমি জানি, আমার জন্য সামনে এমন দিন অপেক্ষা করছে যা দেখার থেকে মৃত্যু শ্রেয়।”
শ্বেতা আর সহ্য করতে পারল না, শব্দ করে ফুপিয়ে উঠল।
প্রেয়সীর চোখে পানি দেখে একদম শান্ত হয়ে গেল আবির্ভাব। বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। আদর করে কাছে টেনে নিল নিজের বাবুইকে। বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা চোখের পানি মুছে দিয়ে নরম গলায় বলল,
“কাঁদিস কেন, পাখি? আমি কি তোকে বকেছি?”

শ্বেতার ঠোঁট কাঁপল। কান্নার বেগ বাড়ল। দুই হাতে মুঠো করে চেপে ধরল আবির্ভাবের শার্ট।
আবির্ভাব উত্তেজিত হলো। শ্বেতার ললাটে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে বলল,
“I’m sorry… I’m sorry… প্লিজ কাঁদিস না ময়না পাখি। তোকে অন্যের বুকে যেতে হলে যাবি, কিন্তু আমাকে শেষ করে যাস প্লিজ… আমি যেটা করেছি, তুই সেটা করিস না। তুই সহ্য করতে পেরেছিস, আমি পারব না।
তোকে অন্যের বুকে যেতে হলে আগে আমার বুকে ছুরি চালাতে হবে। না হলে আমি তোকে কোথাও যেতে দেব না, কারো হতে দেব না। আমি বেঁচে আছি মানে তুই শুধুই আমার। তোকে শুধু আমি ভালোবাসব, আমি আদর করব। সেখানে অন্য কারোর কোনো অধিকার আমি সহ্য করব না। তুই আমার সাথে বাঁচতে না পারলে, আমার সাথে মরবি।”

শ্বেতা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না, শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল…
ততক্ষণে আকাশ জুড়ে বিশাল সাদা আলোকছটার দেখা মিললো। আসন্ন শব্দের ভয়ে কেঁপে উঠলো শ্বেতা। হুড়মুড়িয়ে আবির্ভাবের উষ্ণ বুকে মুখ লুকালো। সেকেন্ড গড়ানোর পূর্বেই বিকট শব্দ তুলে আকাশ গর্জন করে উঠলো।
কেঁপে উঠে আরও গভীরে মুখ ডুবালো শ্বেতা। সঙ্গে সঙ্গেই ঝুম ঝুমিয়ে বৃষ্টি নামলো।
আবির্ভাব শ্বেতার দীঘল চুলের ভাজে আলতো পরশ বুলিয়ে দিতে দিতে আত্মার সুখ অনুভব করতে লাগলো।
আশকারা পেয়ে এবার শব্দ করে ফুপিয়ে উঠলো শ্বেতা।
আবির্ভাবের প্রশস্ত পিঠ জড়িয়ে ধরে বললো —

“আমি ও খুব খুব ভালোবাসি তোমায় পাগলের ডাক্তার, বড্ড বেশি ভালোবাসি।
এতো ভালোবাসার পরও তুমি কেন আমার হলে না? বাকিটা জীবন এই আফসোস নিয়ে আমি কিভাবে বাঁচব?”
মিনিট দুই একের বৃষ্টিতে ভিজে দুজনে জুবুথুবু হয়ে গেলো। হিমেল পানির ঝাপটায় শীত পৌঁছে গেল হাড়ে হাড়ে।
শ্বেতার খেয়াল হলো — আবির্ভাবের ভীষণ জ্বর। এই ঠান্ডা পানিতে ভিজলে নিশ্চয়ই ছ্যাচরা জ্বরে ভুগবে, বিছানা থেকে উঠতে পারবে না এক মাস।
এই ভেবে নিজের আবেগ, অনুভূতি গিলে নিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো শ্বেতা।
সে আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখলো — অদূরে একটা রেস্টুরেন্ট দেখা যাচ্ছে, তবে সম্ভবত বন্ধ।
শ্বেতা আবির্ভাবের বাহু আঁকড়ে ধরে কঠিন কণ্ঠে বললো —

“চলুন।”
“কোথায়?”
শ্বেতা জবাব দিলো না। আবির্ভাবের হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলো রেস্টুরেন্টের কাছে।
রেস্টুরেন্টের উপরের সাইনবোর্ডে বড় বড় করে লেখা — “McDonald’s”
শ্বেতা আবির্ভাবকে নিয়ে আশ্রয় নিলো রেস্টুরেন্টের বারান্দায়। শীতে রীতিমতো থর থর করে কাঁপছে দুজন।
আবির্ভাব মাথা চেপে ধরে সিঁড়ির উপর বসে পড়লো। শরীরে একে তো এত জ্বর, তার উপর বৃষ্টিতে ভেজার দরুন মাইগ্রেনের ব্যথা ও শুরু হয়েছে।
আবির্ভাব না বললেও ব্যাপারটা চট করে বুঝে নিলো শ্বেতা।
নিজেও বসে পড়লো আবির্ভাবের পাশে। নিজের ওড়না দিয়ে আবির্ভাবের মাথার পানি মুছে দিতে দিতে মোলায়েম কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো —

“বেশি কষ্ট হচ্ছে, আধা পাগল ডাক্তার?
অতিরিক্ত মাথাব্যথা দরুন চোখ দুটো আগের থেকে ও দ্বিগুণ লাল।”
শ্বেতার পানে দুর্বল চোখে চেয়ে ছোট করে জবাব দিলো —
“হুম।”
শ্বেতার বুকের ভেতরে কেমন অসহনীয় ব্যথায় চেয়ে গেলো।
ঠোঁট ভেঙে কান্না এলো মেয়েটার।

আবির্ভাব বড় বড় দুটো নিঃশ্বাস ফেলে দাঁতে দাঁত চেপে সকল ব্যথা, বেদনাকে গিলে নেওয়ার চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ।
সাদা শার্টের হাতা গুটিয়ে শ্বেতার বা পা টেনে সম্মুখে আনলো।
তুলতুলে নরম পায়ের সুঘটিত শোভা বর্ধনকারী নখটা উল্টে তরল রক্ত গড়াচ্ছে এখনও।
আবির্ভাব সযত্নে পা টা তুলে নিজের উরুতে রাখলো।
শ্বেতা আজ আর বাধা দিলো না, কারণ সে যা বুঝার সব বুঝে গেছে —
সে জেনে গেছে, সে একা নয়।
এই মানুষটা তাকে ভালোবাসে,পাগলের মতো ভালোবাসে, উন্মাদের মতো ভালোবাসে — হয়তো তার থেকেও বেশি।
এইজন্যই বোধ হয় তার ওপর দেবীর এত রাগ, এত ক্ষোভ।
কারণ শ্বেতা যেমন তার ভালোবাসাকে হারিয়ে প্রতিদিন একটু একটু করে মরছে, দেবীর অবস্থা হয়তো আরও সূচনীয়।

সে তো পেয়েও পেল না, বউ হয়ে ও সংসার করতে পারল না।
কিন্তু সে এতটা আহাম্মক কিভাবে হল?
কীভাবে এতো ভুল বুঝতে পারলো এই মানুষটাকে?
একবারও কী মনে পড়লো — এই মানুষটা তার জন্যে কী কী করেছে, কতটা ভালোবেসেছে?
এত ভালোবাসা কি আদেও কেউ ভুলতে পারে?
চোখ মুখ খিঁচে “আহ” বলে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো শ্বেতা।
ভাঙা নখটা খুলে নিতেই ক্ষতস্থান হইতে ফিনকি দিয়ে রক্ত গড়াতে শুরু করল।
শ্বেতা ঠোঁট উল্টে ব্যথাতুর আওয়াজ করে বললো —
“খুব জ্বলছে, আবির্ভাব।”

আবির্ভাব আলতো হাতে চোখ মুছে দিলো, ললাটে ঠোঁট চেপে আদর মাখা কণ্ঠে বললো —
“এই তো, আর একটু বাবুই সোনা।”
শ্বেতা চোখ মুখ শক্ত করে বসে রইলো।
আবির্ভাব বৃষ্টি পানিতে ক্ষতস্থান ধুয়ে পরিষ্কার রুমাল বেঁধে দিলো।
ভাঙা নখটা এক ফাঁকে চুপিচুপি পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে বলল —
“ফিলিং বেটার, মাই লাভ?”
শ্বেতা উপরে নিচে মাথা ঝাকালো।
“But I’m not okay, please heal me… I need your love.”
শ্বেতা চট করে চোখ তুলে তাকালো।
আবির্ভাব দৃঢ়তার খোলস ছুঁড়ে ফেলে বাচ্চাদের মতো আবদার করলো —

“আমি একটু ও ঠিক নেই… আমাকে একটু বুকে নেবে, মাই লাভ?
একটু আশ্রয় দেবে তোমার মাঝে?”
তৃষ্ণার্ত পুরুষের কাতর দুই চোখে বিষাক্ত প্রেমের আবদার —
শ্বেতার কলিজাটা মুচড় দিয়ে উঠলো।
ছোট্ট হৃদয়টা ব্যথায় জর্জরিত হল।
দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো —
“আসো।”
শ্বেতার বলতে দেরি, কিন্তু আবির্ভাবের কোমল বক্ষে ভাজে মুখ ডুবাতে দেরি হলো না।
ঝড়ের বেগে আছড়ে পড়লো শ্বেতার নাজুক দেহের উপর।
পুরুষালি ভারী শরীরের ধাক্কায় তাল সামলাতে না পেরে পেছন দিকে হেলে পড়লো শ্বেতা,
দেয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে গেলো।
ব্যথায় আর জ্বরের তীব্রতায় এবার গুঙানি বের হচ্ছে।
আবির্ভাবের নিদারুণ জ্বরে শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
শ্বেতা কী করবে বুঝতে পারলো না।
নিজের গায়ের ওড়নাটা খুলে আবির্ভাবের তপ্ত শরীরে জড়িয়ে দিলো,

দুই হাতে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশিয়ে নিলো নিজের সাথে।
চার আঙুলের সাহায্যে আলতো স্পর্শে ধীরে ধীরে কপালে ম্যাসাজ করে দিতে লাগলো।
অন্য হাতে চুলে হাত বুলাতে বুলাতে কোমল স্বরে বললো —
“ঘুমানোর চেষ্টা করুন। ঘুমিয়ে পড়লে আর ব্যথা করবে না।”
“উহ, মাই লাভ…”
“চুপ, একদম। কোনো কথা নয়। চোখ বন্ধ করুন।”
আবির্ভাবের আর কিছুই বলতে ইচ্ছা হলো না।
কতগুলো দিন পর তার তপ্ত বুকে আবার এক পশলা বৃষ্টি হচ্ছে।
হোক না ক্ষণিকের — তবু তো হচ্ছে।
তার পাখি তাকে ভালবাসছে — এই সুখটুকু সে কিছুতেই খোয়াতে চায় না।
বৃষ্টির তীব্রতা বাড়ছে ক্ষণে ক্ষণে। মাঝে মাঝে প্রবল ছাঁট এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে তাদের।
রাত যত গভীর হচ্ছে, আবির্ভাবের শরীরের তাপমাত্রা ততই বাড়ছে।
শ্বেতার দুশ্চিন্তা হচ্ছে ভীষণ।

এই মানুষটাকে সে একটু ও কষ্ট পেতে দেখতে পারে না।
অথচ এই মানুষটা তার চোখের সামনে কত কষ্ট পাচ্ছে — ভিতরটা জ্বলে যাচ্ছে শ্বেতার।
শ্বেতা আবির্ভাবের কপালে গাল ঠেকিয়ে কিছুক্ষণ স্থির হয়ে রইলো। অতঃপর সংকোচ নিয়ে পৃথমের নাম্বার ডায়াল করল।
ইরফান নিশ্চয়ই এতক্ষণ তাকে খুঁজে খুঁজে পাগল হয়ে গেছে।
দুইবার রিং হতেই ফোনটা রিসিভ করল পৃথম।
শ্বেতা কিছু বলার আগেই চিন্তিত কণ্ঠে পৃথম বলে উঠল,
“শ্বেতা, তুই কোথায়? ইরফান-এর ফোন তুলছিলি না কেন? জানিস, আমরা পাগল হয়ে যাচ্ছি তোর চিন্তায়!”
সাথেসাথেই ইরফান-এর ব্যতিব্যস্ত কণ্ঠ কানে এলো শ্বেতার—
“এই… এই… তুমি কোথায় চলে গেলে! জানো তোমায় কোথায় কোথায় খুঁজেছি! এই… তুমি ঠিক আছো? বলো না! তুমি ঠিক আছো?”

শ্বেতা নীরব হয়ে শুনল সবার উৎকণ্ঠা।
অতঃপর শান্ত কণ্ঠে সে খুলে বলল সমস্ত ঘটনা — শুধু আবির্ভাবের করা পাগলামোগুলো চেপে গেল।
শ্বেতার বর্ণনা শুনে ইরফান-এর চোখ-মুখ লাল হয়ে উঠল, হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে এলো আপনা-আপনি। কঠিন কণ্ঠে প্রশ্ন করল—
“তুমি ওই চারজনকে দেখেছো?”
“হ্যাঁ।”
আর কিছু না বলেই স্পষ্ট কণ্ঠে জানতে চাইল—
“এখন কোথায় তোমরা?”
শ্বেতা হোয়াটসঅ্যাপে লোকেশন পাঠিয়ে দিল।
“ওখানেই থাকো, Just 5 minutes এর মধ্যে আসছি।” — বলে হনহন করে বেরিয়ে গেল ইরফান।
ফোন কেটে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল শ্বেতা।

আবির্ভাবকে বুকে টেনে উষ্ণ চুমু এঁকে দিল তার শীতল কপালে। ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে আবির্ভাবের। শ্বেতার ভীষণ মায়া লাগছে। একটুও ইচ্ছে করছে না এই মানুষটাকে নিজের থেকে আলাদা করতে।
কিন্তু যখন তখন ইরফান চলে আসবে। আর এভাবে তাদের একসাথে দেখে ফেললে বিরাট কেলেঙ্কারি!
এসব ভেবে অনিচ্ছাসত্ত্বেও আবির্ভাবকে নিজের থেকে আলাদা করে দিল শ্বেতা। ওড়নাটা নিয়ে নিজের গায়ে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নিল।
আবির্ভাব এখনো গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। হয়তো ব্যথাটা একটু কমেছে।
মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে একটা ব্ল্যাক টেসলা কার এসে থামল রেস্টুরেন্টের সামনে। যার ব্ল্যাক স্লাইডিং ডোর খুলে বেরিয়ে এলো এক অতি সুদর্শন পুরুষ।

ইরফানকে দেখে উঠে দাঁড়াল শ্বেতা। দৌড়ে গিয়ে বলল—
“ওনাকে তারাতাড়ি হসপিটালে নিয়ে চলুন ইরফান, উনি অনেক অসুস্থ।”
ইরফান ভ্রু কুঁচকে তাকাল শ্বেতার দিকে। লাবণ্যময়ী মেয়েটার মুখটা বিবর্ণ ফ্যাকাশে রঙ ধারণ করেছে।
সে শ্বেতার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবির্ভাবের দিকে তাকাল। আবির্ভাবের অবস্থা দেখে ইরফানের কপালের ভাঁজ দৃঢ় হয়ে উঠল।

ইরফানের তীক্ষ্ন পর্যবেক্ষণ দেখে শুষ্ক ঢোক গিলে শ্বেতা নিঃশব্দে কাঁপলো। মনে মনে ভাবল —
“এই লোক আবার কিছু আন্দাজ করতে পারবে না তো!”
ইরফান অনেক কিছু ভাবল, কিন্তু মুখে কিছু না এনে এগিয়ে গেল আবির্ভাবের দিকে।
জাগাতে নিতেই শ্বেতা আর্তনাদ করে উঠল।
“ওনাকে ডাকবেন না প্লিজ! মাইগ্রেনের ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। এই মাত্র কিছুক্ষণ হলো ঘুমিয়েছেন।” — অনুনয়ের সুরে বলল শ্বেতা।
শ্বেতার চোখে যন্ত্রণার চাপ স্পষ্ট দেখতে পেলো ইরফান। কিন্তু না ডাকলে এমন বলিষ্ঠ দেহের পুরুষকে একা সে গাড়ি অবধি নিয়ে যেতে পারবে না।
তাই নিজে নিয়ে ও চুপ হয়ে গেলো একটু থেমে বলল,

“তুমি ডাকো।”
” ওনাকে আমি একা তুলতে পারবো না…”
অসহায় চোখে তাকালো শ্বেতা, বাধ্য হয়ে এগিয়ে এলো আবির্ভাবের কাছে। তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে বাহু ধরে আলতো করে ঝাঁকুনি দিল। কানের কাছে ঠোঁট নিও ধীরে ধীরে ডাকল—
“ডক্টর রায় চৌধুরী…”
একটা, দুটো, তিনটে ডাক দিতেই একটু নড়ে উঠল আবির্ভাব।
চোখ না খুলেই ঝাঁপটে ধরল শ্বেতার কোমর। দুর্বল কণ্ঠে বলল—
“খুব ব্যথা হচ্ছে মাই লাভ… কথা বলো না… চুপটি করে আমার কাছে থাকো… আই জাস্ট ফিল ইউ…”
কথা সম্পন্ন করার পূর্বেই আবির্ভাবের মুখ চেপে ধরল শ্বেতা। ভয়ার্ত চোখে তাকালো ইরফানের দিকে।
ইরফান অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শ্বেতার দিকে।
শ্বেতা কথা কাটাতে হাসার চেষ্টা করে বলল।

“উনার অনেক জ্বর, ইরফান সাহেব। জ্বরের ঘোরে উল্টা পাল্টা বলছেন। প্লিজ, উনাকে ধরুন…”
ভীত কন্ঠে বলা দুর্বল বাক্যগুলো ইরফান কতটা বিশ্বাস করল বোঝা গেল না, তবে এক ঝটকায় আবির্ভাবের বাহু ধরে টেনে শ্বেতার থেকে আলাদা করে দিল।
শ্বেতা বিস্ময়ে হতবাক।
অন্য হাত দিয়ে ধরতে চাইলেই ইরফান চিৎকার করে উঠল—
“Don’t touch him!”
পুরুষালি গর্জনে কেঁপে উঠল শ্বেতা।
সম্পূর্ণ জেগে উঠল আবির্ভাব। চোখ খুলে ইরফানকে সামনেই দেখতে পেয়ে খানিকটা হতবম্ব হলো।
“আপনি এখানে?” — বিষ্ময়ে প্রশ্ন করল আবির্ভাব।
ইরফান কঠিন গলায় জবাব দিল—
“এই একই প্রশ্ন তো আমারও, আপনাকে ডক্টর রায় চৌধুরী। এত রাতে, এমন শুনশান এলাকায় আপনি কী করছেন? আপনার তো আপনার বন্ধুর পাশে থাকার কথা!”

আবির্ভাবের মাথা যেন লাট্টুর মতো ঘুরে উঠল। পড়ে যেতে নিলে ঝাঁপটে ধরতে চাইল শ্বেতা।
কিন্তু আবির্ভাবকে ছোঁয়ার পূর্বেই এক বীভৎস টান অনুভব করল হাতে।
পাশে তাকিয়ে দেখল — ইরফান তার ডান হাত চেপে ধরে রেখেছে, আর বাম হাতে আবির্ভাবকে সামলেছে।
ইরফান বলল—
“ডক্টর রায় চৌধুরী, আপনাকে হসপিটালে নিতে হবে। আপনি যথেষ্ট অসুস্থ। গাড়ি পর্যন্ত যেতে আমি আপনাকে সাহায্য করছি।”
আবির্ভাব এতটাই দুর্বল যে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না।
শ্বেতার খুব কষ্ট হচ্ছে। সে চুপচাপ তাকিয়ে রইল।
আবির্ভাবকে ব্যাক সিটে বসিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে পড়ল ইরফান।
পাশের দরজাটা খুলে দিয়ে ইশারা করল শ্বেতাকে—

“ওঠো।”
শ্বেতা আবির্ভাবের পাশে বসতে চাইলেও পারল না। চুপচাপ ইরফানের পাশে বসে পড়ল।
আবির্ভাব আহত চোখে তাকিয়ে রইল শ্বেতার দিকে।
উফ্‌… এই জ্বালার কোনও তুলনা হয় না। হৃদপিণ্ডের এই দগদগে যন্ত্রণার কাছে শারীরিক ব্যথা যেন নিতান্তই তুচ্ছ।
যন্ত্রণায় মাথা ছিঁড়ে যাচ্ছে আবির্ভাবের, চোখ মেলে রাখতে পারছে না সে।
বক্ষে হাত চেপে মনে মনে বলল—

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭১

“মাত্র একটা রাত… আমাকে শান্তিতে ঘুমানোর সুযোগ দিলে না, মাই লাভ। একটা রাত… আমাকে আমার ভালোবাসার বুকে থাকতে দিলে না,তুই ভীষণ নিষ্ঠুর প্রেয়সী!”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭২

2 COMMENTS

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here