কাজলরেখা পর্ব ৬

কাজলরেখা পর্ব ৬
তানজিনা ইসলাম

আঁধারের বন্ধুরা চলে যাওয়ার পর ও রেগেমেগে আগুন হয়ে এলো চাঁদনীর কক্ষে।আজ ওই জেদ্দি মেয়েটার সব জেদ ছাড়াবে ও। সাহস কতো! আধার মানা করার পরও ওঁদের সামনে গেছে।ইজ্জত সম্মান সব খেয়ে দিয়েছে ওর।
আজ প্রথমবারের মতো আঁধার হেরে গেছে। জীবনের প্রথম থেকে সবকিছুতেই জিতে আসা আঁধারের অভ্যাস।অথচ জীবনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে, আজ শাবিহার কাছে গো হারা হেরেছে ও। সব হয়েছে চাঁদনীর জন্য।থাপড়ে ওর গাল লাল করে দিবে আঁধার।

শব্দ করে দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো আঁধার। চাদনী ঘুমাচ্ছিলো। ওঁকে শায়েস্তা করার যে সেন্সিটিভিটি নিয়ে আঁধার এসেছিলো, তা মুহুর্তেই হারিয়ে গেলো আঁধারের। গা ছেড়ে দাঁড়ালো ও। কোমড়ে হাত দিয়ে চেয়ে থাকলো চাঁদনীর দিকে। মেয়েটা ঘুমে কাঁদা। গালের নিচে দু-হাত রেখে অঘোর ঘুমে তলিয়ে। চুলগুলো পরে আছে মুখের উপর। কি আদুরে যে লাগছে মেয়েটা কে! মেয়েটা এত্তো মায়াবী! আঁধার রাগ গলে গেলো।
এগিয়ে গিয়ে ওর সামনে হাঁটু মুড়ে বসলো।চুলগুলো ঠিক করে হাত বুলিয়ে দিলো মাথায়।ওর গালে হাত রেখে কিছুক্ষণ দেখলো ওঁকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো। এসি ছেড়ে ওর গায়ে ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিলো।
উদাস হয়ে মেঝেতে বসলো ওর বালিশের কাছটায়। চাদনী ডাকলো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“দাদাভাই।”
আঁধার পাশ ফিরে তাকালো। চাদনী ঘুমোঘুমো চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। চোখের পাতা টেনে খুলতে পারছে না। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় বললো
-“কিছু বলবে?”
-“তোর সাহসিকতার জন্য পুরষ্কার দিতে এসেছিলাম। আমার বউ পরিচয় পাওয়ার এতোটা ডেস্পারেট তুই জানতাম না।এতোবার মানা করার পরও ওঁদের সামনে চলে গেলি।পুরষ্কৃত করতে হবে না তোকে!কালকের জন্য তোলা রইলো।এখন ঘুমা। ”
চাদনী পুরোপুরি সজাগ হলো এবারে।হামি তুলে আঁধারের দিকে তাকিয়ে বললো

-“তোমার বউয়ের পরিচয় পাওয়ার জন্য মরে যাচ্ছি না আমি।বিশ্বাস করো আমার নিজেরই লজ্জা লাগে নিজেকে তোমার বউ ভাবতে।আমি ইচ্ছে করে যাইনি নিচে।তোমার বন্ধু আমাকে দেখে ফেলেছিলো। তোমার কী আক্কেল তাই না দাদাভাই!এতো রাত বিরেতে তোমার চাচাতো বোন একা তোমার বাড়িতে তোমার সাথে কী করছে? একবারও ভেবেছো সবাই কে যে এই পরিচয় টা দাও।ওরা কী ভাবে আমাকে?তুমি তো পরিচয় দিয়েই শেষ, সাফার করতে হয় আমাকে।খারাপ মেয়ে ভাবে।চরিত্রের উপর প্রশ্ন তোলে। দারোয়ানের হেয় দৃষ্টি এখনো ভুলতে পারছি না। বিশ্রী ভাবে চুপতেছে এখানে।” বুকের উপর তর্জনী ঠেকিয়ে বললো চাদনী! আধার চুপ থাকলো। চাদনীর গলা কাঁপছে।ও আবার বললো

-“তোমার বন্ধুরা যাতে আমাকে বাজারি মেয়ে না ভাবে সেজন্য বলতে বাধ্য হয়েছি। দারোয়ান তো ভেবেই রেখেছে সেটা।আমি কোনোদিন কোনো ছেলের সাথে কখনো কথাও বলিনি, অথচ তোমার ওই একটা পরিচয়ে ওরা আমাকে কী কী ভেবে নেয়, কখনো ভেবে দেখেছো। সরি, আর কাওকে বলবো না কখনো। তোমার যদি আমাকে বউ পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে, তাহলে চাচাতো বোন পরিচয় টাও দিও না।ওরা ওঁদের মতো ভেবে নিক আমাকে। তোমাকে বিয়ে করে যে শুলে চড়ানোর মতো অপরাধ টা আমি করেছি, তার শাস্তি না পেলে কী করে হয়?”
আঁধার এবারেও চুপ। একটু মেঝেতে আঁকিবুঁকি করতে করতে বললো

-“বুঝেছি।”
চাঁদনীর চোখের কার্ণিশ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে বালিশে গিয়ে পরে। ভীষণ অসহায়ত্ব নিয়ে প্রশ্ন করে ও
-“এমন করো কেন আমার সাথে? মানুষ বলে মনে হয়না আমাকে?কষ্ট লাগে না আমার?”
-“আমি না আসলে মানতে পারি না যে আমার বউ কালো।” আঁধারের নিচু কন্ঠস্বর। চাঁদনী বললো
-“এটা আমার দোষ? আমি বানাইছি নিজেকে? বিশ্বাস করো, নিজেকে বানানোর ক্ষমতা থাকলে, আমি আমার গায়ের রং খুব ফর্সা করে বানাতাম।তখন তুমি আমাকে কালো বলে যখন তখন অপমান করতে পারতে না।”
-“তুই একটু ফর্সা হতে পারলি না চাঁদ?কেন তুই ফর্সা হলিনা? শুধুমাত্র তোর কারণে আজ আমি অপমানিত হয়েছি।শাবিহা আমাকে অপমান করে চলে গেছে, আমি কিচ্ছু করতে পারিনি।খোঁটা দিয়ে গেছে আমাকে, আমার বউ কালো।”

-“তোমার কথাগুলো খুব গায়ে লাগে আমার।ইচ্ছে করে এই কালো চামড়া ছুড়ি দিয়ে কেটে তুলে ফেলতে। তারপর অনুশোচনা নিয়ে ভাবি,তোমার মতো সুন্দরের পূজারির জন্য আমি আমার রুহ কে কেন কষ্ট দিব?নিজেকে কষ্ট দেওয়াও হারাম। আমার আল্লাহ বলেন, তার সকল সৃষ্টিকে তিনি সুন্দর আকৃতি দান করেছেন।”
চাদনী শক্ত অথচ ভঙ্গুর গলায় বললো।আঁধার উঠে দাঁড়ালো। ওর মাথায় হাত রেখে বললো
-“ঘুমা!”
-“দরদ দেখিও না।ধরবা না আমাকে।কালো রং লেগে যাবে আবার তোমার হাতে। গিরগিটির মতো একবার একরকম বিহেভিয়ার করবা না। তোমার এই নাটকগুলা ভীষণ বিরক্ত লাগে আমার।”
আঁধার কক্ষের বাইরে পা বারাতে গিয়ে ফিরে তাকালো আবার। চাঁদনী ভেজা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।আঁধার ওর চোখে চোখ রাখতেই বললো
-“আমি মুক্তি দিয়ে দিব তোমাকে। একটু সময় দাও।বেশিদিন এই কালির ড্রাম বয়ে নিয়ে যেতে হবে না তোমাকে।”

আকিব শিকদারের মনটা ভালো নেই। চাঁদনীর
জন্য ভীষণ মন পুড়ছে তার।কাল এ সময়টাতেও তার মেয়েটা বাড়িতে ছিলো, অথচ আজ নেই।আঁধার আদোও ওঁকে দেখছে তো।অপমান করছে না তো আবার? এসব ভাবতে ভাবতে অসুস্থ লাগছে তার নিজেকে।বড় ভাই, ভাইয়ের ছেলের কথা ভেবে নিজের মেয়েকে বানের জলে ভাসিয়ে দেওয়া বাবা তিনি। এতো চিন্তা মানায় না তার।কথা রাখতে গিয়ে মেয়েটার উপর অন্যায় করেছে সে।

কাল রাতে এক ফোঁটাও ঘুম হয়নি তার।চোখের পাতা বুজলেই আজেবাজে স্বপ্ন দেখতো, ধরফরিয়ে উঠে বসতো।অসহ্য একটা রাত কেটেছে কাল।সকাল হতেই আঁধারের নাম্বারে ফোন দেওয়া শুরু করেছেন তিনি।চাঁদনীর সাথে একটু কথা বলা দরকার। মনটা ভীষণ ছটফট করছে।ওর গলা না শোনা পর্যন্ত শান্তি নেই।অথচ আধার কল ধরছে না।আকিব শিকদার কল দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে একসময় ফোন রেখে দেন। ড্রইংরুমে নেমে ডাইনিং টেবিলের উপর বসেন।বর্ষা বেগম কিচেনে সকালের নাস্তা বানাচ্ছেন। পরোটা ভেজে তিনি সেগুলো টেবিলের উপর রাখতে এলেন।আকিব শিকদার কে অসহায় মুখ করে বসে থাকতে দেখে বললেন

-“ভাইয়া, মন খারাপ আপনার?”
-“চাঁদনীটার কথা খুব মনে পরছে। আঁধার কল করেছে আপনাকে?”
-“না তো! কাল থেকে একবারো কল করেনি ও।পৌঁছেছে কি-না সেটাও জানায়নি।ছেলেটার উপর বড্ড অন্যায় করেছি আমরা!”
আকিব শিকদার তড়িৎ বেগে তাকালেন।কন্ঠ গম্ভীর করে বললেন
-“আমার মেয়ের উপর অন্যায় হয়নি? সব অন্যায় খালি আধারের উপর হয়েছে?”
-“তা বলছি না! চাঁদনী রাজি ছিলো না এটা যেমন ঠিক।সাথে এটাও সত্যি ও আমার আঁধারের মতো ছেলে কখনোই পেতো না।”

আকিব শিকদার বুঝলেন, তিনি কী ইঙ্গিত করে কথা বলছেন।চাঁদনী শ্যামলা, আঁধার অবশ্যই ওর চেয়ে সুন্দর। চাদনীর বিয়ে হলেও এতো সুদর্শন ছেলে তিনি পেতেন না চাদনীর জন্য, এটাই খোঁচা মেরে বললো।
আকিব শিকদার কথা বাড়ালেন না।বর্ষা বেগমও কিচেনে চলে গেলেন।একটু পর অপূর্ব শিকদার এসে ডাইনিং এ বসলেন। তার পিছু পিছু জবা বেগম আর আরমান শিকদার কেও আসতে দেখা গেলো। জবা বেগম কিচেনের কোনো কাজে হাত লাগান না। তিনি শুধু পায়ের উপর পা তুলে বসে বসে খান।রাফিয়া বেগম বর্ষা বেগম কে ঝাড়লেও ওনাকে কিছুই বলেন না। কারণ আরমান শিকদার এতে খুব রেগে যায় মায়ের উপর।তার ভাষ্যমতে তার বউয়ের যেটা করতে মন চায়বে সেটাই সে করবে, তিনি বউ এনেছেন কাজের লোক আনেনি।

জবা বেগম বসে পরলো সবার সাথে খেতে। রাফিয়া বেগমের খাবার কক্ষে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।বর্ষা বেগমও কিচেনের কাজ শেষ করে টেবিলে এসে বসলেন।
জবা বেগম খাওয়ার মাঝেই ,একপলক সবার দিকে তাকিয়ে পাশে বসা আরমান শিকদার কে কনুই দিয়ে গুঁতো দিলেন।উনি তাকাতেই চোখ দিয়ে ইশারা করলেন কিছু। আরমান শিকদার বুঝতে পেরে গলা খাকাড়ি দিয়ে সবার উদ্দেশ্যে বললেন

-“অর্পিতার খোঁজ পাওয়া গেছে!”
সবাই খাওয়া থামিয়ে তাকালো তার দিকে। অর্ণব শিকদার অবাক স্বরে বললেন
-“কী করে?”
-“ফোন করেছিলো কাল রাতে আমাকে।”
-“কী বললো তোকে? অর্পিতা কোথায় গেছে? পালিয়েছে কেন সে?”
-“একটা ছেলেকে ভালোবাসতো।আমাদের ভয়ে বলতে পারেনি। এখন ওই ছেলের ফ্যামিলিও মেনে নিচ্ছে না ওঁদের কে।আমাকে সাহায্য করতে বলছে।”
-“ওরা বিয়ে করেছে?”
-“হ্যাঁ!”
ইতস্তত করে বললেন আরমান শিকদার।

-“তোর মেয়ের আক্কেল কী রে? আদর করতে করতে এতোটায় মাথায় উঠিয়ে ফেলেছিস যে পরিবারের মুখে চুলকানি দেওয়ার পরও বড় মুখ করে সাহায্য করতে বলছে, বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। সে নিজে পালিয়েছে, নিজের ঠিকানা নিজে খুঁজে নেবে। তার জায়গা এ বাড়িতে হবে না।”
অর্ণব শিকদার শক্ত গলায় বললেন।জবা বেগমের মুখ কালো হয়ে গেলো। দৃঢ় স্বরে ঘোষণা দিলেন তিনি
-” এ বাড়িতে জায়গা দিতে হবে না ভাইয়া। এমনিই খোঁজ পাওয়া গেছে সেটা জানিয়ে রাখলাম।আমাদের মেয়ের কথা আমরাই ভেবে নেবো! আপনাদের উপর সে চিন্তার প্রভাব পরবে না!”

অপূর্ব শিকদার ভ্রু কুঁচকে তাকালেন।আকিব শিকদার এতোক্ষণ কোনো কথা বলেননি।কিন্তু এবার ওনার রাগ লাগলো কিছুটা। মেয়েটা পরিবারের কথা একবারো ভাবেনি।অথচ তাকে নিয়ে ওঁদের ভাবনার শেষ নেই।কিন্তু চাঁদনীর বেলায় ব্যাপারটা উল্টো! সে কোনো দোষ না করেও এ মানুষটার কাছে সবসময় কথা শোনে। ওনার মেয়ে এমন করলে ওঁদের জ্বালায় এ বাড়িতে তার নাম পর্যন্ত নেওয়া যেতো না।এখন পরিবারের মান সম্মান নিয়ে ভাবছে না ওরা? কালকে চাদনী, অর্পিতা কে পালাতে সাহায্য করেছে ভেবে কতো কথা শোনালো ওঁকে।এই পরিবারটার কথা ভেবে ওনিও চাঁদনীর মতের বিরুদ্ধে ওঁকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। শুধু পরিবার পরিবার করেই পুরো জীবনটা কাটালেন তিনি? মেয়ের কথা ভাবার সুযোগ পর্যন্ত হয়নি তার।
পরিবারের কথা ভাবার ঠেকা খালি ওনি নিয়ে বসে আছেন ? সব ভাবনা তার? আর কারো ভাবনা নাই পরিবার নিয়ে?
আকিব শিকদার গম্ভীর গলায় বললেন

-“মেয়ে তো তোমাদের কথা একবারো ভাবলো না।”
-“সন্তানরা তো অনেক ভুল করে থাকে। সে ভুল ধরে বসে থাকলে আমরা মা-বাবা হলাম কেন? সন্তানরা মা-বাবদের ফেলে দিতে পারলেও, সন্তানকে ফেলে দেওয়া যায় না।আপনি আমার কষ্ট বুঝবেন না ভাইয়া।মেয়ে জন্ম দিলে বুঝতেন!”

আকিব শিকদারের হাত থেমে গেলো। পরোটার লোকমা আর মুখে তুলতে পারলেন না তিনি। আধো খেয়েই উঠে দাঁড়ালেন তিনি।সিড়ি বেয়ে চলে গেলেন উপরে, চাঁদনীর কক্ষে। বেডের উপর অসহায় বসলেন। নিজের ফোন বের করে কল দিলেন চাঁদনী কে। মোবাইল ফোন বাজতে শুরু করলো।বালিশের পাশ থেকে ফোনটা হাতে নিলেন। স্ক্রিনে ওনার আর চাঁদনীর হাস্যোজ্জ্বল ছবি।চাঁদনীর স্কুলে বিদায় অনুষ্ঠানের দিন দু’জনে সেলফি তুলেছিলো।

আকিব শিকদার ফোনটা বুকের সাথে চেপে ধরলো।চোখের জল গড়িয়ে গাল বেয়ে পরে তার, নিঃশব্দে ।এ কান্নার কোনো শব্দ হয় না।অনুশোচনায় শেষ হয়ে যাচ্ছেন তিনি।মেয়েটা রেগে ফোনটাও বাড়িতে রেখে গেছে।আচ্ছা, ও তো ফোন ছাড়া একদিনও থাকতে পারে না।বাবাকে ছাড়া তো একদমই না।ওখানে কী করে থাকছে একা একা? আকিব শিকদার আঁধার কে কল দিলেন। ধরলো না ও। এ পর্যন্ত পঞ্চাশ বার কল দেওয়া হলো ওনার। আঁধার এখন ভার্সিটিতে সম্ভবত, কল ধরতে পারবে না।এটা ওনার জানা কথা।তবুও মন কে বুঝ দিতে পারছে না। চাদনীর কন্ঠ শোনা ভীষণ ভাবে প্রয়োজন তার।মেয়েটা নিশ্চয়ই বাড়িতে একা আছে।ভয় পাচ্ছে। ও তো কখনোই একা থাকে না।
বেডের উপর হাত বুলালেন আকিব শিকদার। চোখের জল গড়িয়ে বেডের উপর পরছে তার।কি ভীষণ যন্ত্রনার যে সে অসহায়ত্ব! ঝাপ্সা দৃষ্টিতে তাকিয়ে তিনি প্রশ্ন করলেন
-“আমি আসলেই তোমার বাবা হতে পারিনি আম্মা? ”

চাঁদনীর ঘুম ভাঙলো খুব বেলা করে।রাতে ঘুম হয়নি ওর।পুরো রাত কেঁদে পার করেছে।এ সম্পর্কটা গলার কাটা হয়ে ফুটছে।চাদনী গিলতেও পারছে না, উগড়াতেও পারছে না ফলস্বরূপ তড়পাচ্ছে। ভীষণ ভাবে তড়পাচ্ছে। আঁধারের খোঁচা মারা কথাগুলো শুনলে নিজের উপর কি যে ঘৃণা হয় ওর! চাঁদনী বোঝাতে পারে না।কেও বুঝলো না ওঁকে। কেও না।চাদনী মুখ ধুয়ে ডাইনিং এ এলো।টেবিলের উপর নাস্তা রেডি দেখে ভ্রু উচালো।প্লেটের পাশে একটা চিরকুট।চাদনী চিরকুট নেয় হাতে।

-“নাস্তা করেনিস। ফ্রিজে খাবার রাখা আছে। দুপুরে একটু গরম করে নিলে হয়ে যাবে।আমার আসতে সন্ধ্যা হয়ে যাবে।ভদ্র মেয়ে হয়ে বসে থাকবি।উল্টাপাল্টা কিছু করলে গলা টিপে দিব আমি তোর!”
চাদনী দীর্ঘশ্বাস ফেললো।নাস্তা হিসেবে সেন্ডউইচ আর জুস।চাদনী ঠোট উল্টায়। রুটি বা পরোটা না হলে ওর ব্রেকফাস্ট টা আসলে জমে না। পেট ভরে না মনে হয়, পুরোদিন খিদে লেগে থাকে পেটে।
অপূর্ণ হৃদয় নিয়ে, চাদনী খাওয়া শেষ করলো। এখন পুরো বাড়িতে ও একা। আঁধারের আসতে সন্ধ্যা হবে। অবশ্য সে কাছেপিঠে না থাকাই ভালো। চাদনী স্বস্তি পায়।ওর গায়ের রঙ নিয়ে কেও পিঞ্চ মারে না, বুকে লাগিয়ে লাগিয়ে কথা বলে না।

ফোনটা সাথে নেই।থাকলে একটু আকিব শিকদারকে কল দিতো চাঁদনী। এ ফোন ছাড়া পুরো দিনটা যে কী করে কাটবে ওর! বিরস ভঙ্গিতে সোফার উপর গিয়ে বসলো চাদনী। টিভি ছেড়ে কিছুক্ষণ কার্টুন দেখলো। চায়ের ক্রেভিংস উঠায় কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে এলো।চাদনী চুরুৎ চুরুৎ করে চা টানে আর ভাবে, আঁধার কে কী করে উচিত শিক্ষা দেওয়া যায়? ছেলেটার প্রতি ওর সব ভালোবাসা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তার জায়গায় জমা হচ্ছে একরাশ ঘৃণা। একটা মানুষ ওঁকে কতোটা ছোট করলে কুকুরের সাথে তুলনা দিতে পারে! চাদনীর গায়ে কাটা দেয়। টিভি বন্ধ করে কিছুক্ষণ উরাধুরা গালিগালাজ করে আঁধার কে। কিছুক্ষণ বিরহের গান শুনতে থাকে।আবার গালিগালাজ করে।আবার গান শোনে।

এলোমেলো হয়ে সোফার উপর শুয়ে থাকে চাদনী। পা দু’টো ঝুলছিলো ওর কাউচের নিচে।চ্যাম্প এসে পা মুড়ে বসলো ওর পায়ের কাছে।ছিটকে সোফার উপর উঠে গেলো চাদনী। হাত দিয়ে তাড়াতে তাড়াতে বললো
-“এই,দূরে যাও। আআআা! ভয় লাগছে আমার। যাও, যাও কাছে আসবে না! আব্বুউ, আব্বুউউউ! কোথায় তুমি?”
চ্যাম্প বোধহয় অপমান বোধ করলো।করুনভাবে ডেকে চলে গেলো চাদনীর কাছ থেকে।চাদনী অবাক হয়ে তাকালো।বাহ! কুকুরটার তো বেশ ম্যানার্স! খালি ওর মালিকটার ই কোনো ম্যানার্স নেই।ভেবেই চাদনী মুখ বাকায়।
দুপুরের খাবার খায় না চাদনী।শুধু গোসলটা করে নেয় আর যোহরের নামাজ পরে।কিছুক্ষণ সেজদায় পরে কান্নাকাটি করে,এই বন্দিদশা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।আঁধারের কথার বিষ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। এই বউ নামক সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য যেটার যোগ্য না ও।

ওর কিছু ভালো লাগছে না।গ্রামের কথা মনে পরতেই চাদনীর বুক ভাঙে। আঁধার আসুক, ওঁকে বলবে চাদনীকে গ্রামে রেখে আসতে।এখানে এ বন্দি দশায় ও মরে যাবে।অসহ্য লাগছে ওর সবকিছু।চাদনী গিয়ে করিডোরে ধাক্কা দিলো।বাইরে থেকে লক করা।আঁধার ওঁকে বন্দি বানিয়ে চলে গেছে।যেন চাদনী জেলের কয়েদি।
একটু পরই আবার চ্যাম্পের দেখা মিলে।চাঁদনী আবার তাকে তাড়িয়ে দেয়।
চ্যাম্প চাঁদনীর পিছু পিছু ঘোরে।চাদনী বোঝে কুকুরটাও চাঁদনীর মতো ভুক্তভোগী,একা। ওর মতোই অসহায়।তাই হয়তো বন্ধুত্ব পাতাতে চায়ছে।তবুও চাঁদনীর ভয় লাগে।
কিছুক্ষণ নিজের কক্ষের বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো ও।পুরোদিন একা একা কেটে অবশেষে সন্ধ্যা নামলো। চাদনী উদাস হয়ে রেলিঙে কপাল ঠেকায়।

-“শুনছো আপু?”
মেয়েলি কণ্ঠ কানে আসতেই চাদনী হকচকিয়ে আশেপাশে তাকালো।পাশের ফ্ল্যাটের বেলকনিতে একটা হাস্যোজ্জ্বল মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ওঁকে দেখে হাত নাড়াচ্ছে।মেয়েটা কি যে সুন্দর! চাদনী শিউর হওয়ার জন্য নিজের দিকে আঙুল তাক করে বলে
-“আমি?”
-“হ্যাঁ, তোমাকেই ডাকছি!নাম কী তোমার?”
-“আমি চাঁদনী!”
-“বাহ বেশ সুন্দর নাম তো তোমার! তুমি ওই ফ্ল্যাটে থাকো? আগে তো কখনো দেখিনি!”
চাদনী বললো
-“কালকেই এসেছি!”
-“ওওওও!তুমি আধার ভাইয়ের কী হও যে?”
চাদনী চুপ করে গেলো।মেয়েটা সে প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষা করলো না। উৎফুল্ল হয়ে বললো
-“ছাদে আসবে মেয়ে?”
-“বাইরে থেকে দরজা লক করে গেছে!”
-“আহারে! বাড়িতে একা তুমি তাই না?”
-“জ্বি! আপনার বাড়িতে কে কে আছে?”
-“আমি আর আমার শ্বাশুরি! আমার হাসবেন্ড আর আঁধার ভাই কিন্তু খুব ভালো বন্ধু!”
চাদনী মলিন হাসে।মেয়েটা আবার বললো

-“আঁধার ভাইয়ের কে হও বললে না তো!”
চাদনী কথা কাটাতে বললো
-“আমি যাই।মাগরিবের নামাজ টা পড়ে নি!”
-“আচ্ছা। তোমার সাথে পরিচিত হয়ে ভালো লাগলো।এখানে প্রতিদিন এসো কেমন! গল্প করবো আমরা!”
-“আচ্ছা!”
চাদনীর মনটা ভালো হয়ে গেলো।কি সু্ন্দর একটা মানুষ! শুধু মুখ না, মনটাও সুন্দর। ওর মতো শ্যামলা মানুষকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেনি। নিচুও করেনি। ওনার মতো যদি সবাই হতো! কালো,সাদার পার্থক্য না থাকতো।দুনিয়াটা কতো সুন্দর হতো তাই না।একদিন তো সবাইকেই ওই সাড়ে তিন হাত মাটির নিচে যেতে হবে। মাটির শরীর একদিন শেষ হয়ে যাবে। সেদিন সাদা, কালো কোনো পার্থক্য থাকবে না।

আঁধার সন্ধ্যায় ফিরবে বললেও সে ফিরলো সন্ধ্যার পর।তখন চাদনী ড্রইংরুমে সোফার উপর অসহায় হয়ে বসেছিলো। চ্যাম্প ওর পায়ের কাছে বসেছিলো।এখন আর চাদনী ওঁকে তাড়িয়ে দিলো না।ভরসা জাগছে একটু আধটু কুকুরটা কিছু করবে না। ড্রইংরুম কিঞ্চিৎ অন্ধকার। ইদানীং অন্ধকার টাই ভালো লাগে চাদনীর।কিচেনে আলো জ্বলছে।সেখান থেকে ঈষৎ আলো আসছে সেখানে।দরজা খোলার শব্দে চাদনী বুঝতে পারলো আঁধার এসেছে।ও সেভাবেই বসে থাকলো যেভাবে বসা ছিলো। ড্রইং রুম অন্ধকার দেখতেই আঁধারের কপালে ভাজ পরে। অন্ধকারে ও চাদনী বা চ্যাম্প কাওকেই খেয়াল করে না। লাইট জালাতেই ওরা দৃশ্যমান হয়। আঁধার আঁতকে উঠার ভং ধরে চাদনীকে বললো

-“কতোবার বলেছি তোকে, অন্ধকারে বসে থাকবি না।তোকে অন্ধকারে দেখা যায় না।ভয়ের চোটে আরেটুর জন্য আমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতো!”
চাদনী অন্যদিকে তাকালো,যেন ও শুনতেই পায়নি। ইগনোর করলো আঁধার কে।আঁধার এগিয়ে গেলো ওর কাছে।নিজের ফোনটা এগিয়ে দিয়ে বললো
-“চাচ্চু কল করেছে অনেকবার।ক্লাসে থাকায় ধরতে পারিনি।বেরোনোর পর কল ব্যাক করেছিলাম, তোর সাথে কথা বলতে চেয়েছিলো।”
চাদনী ছো মেরে ফোন হাতে নেয়।তড়িঘড়ি করে কল করে আকিব শিকদার কে। মুহুর্তেই কল রিসিভ হয়।যেন ওপাশের মানুষটা চাঁদনীর কল করার আশা নিয়ে বসেছিলো।

-“আম্মা, তুমি?”
চাদনীর সকল অভিমান গলে পানি হয়ে যায়।করুন স্বরে ডাকে ও
-“আব্বুউউ। তোমার কথা কি ভীষণ ভাবে যে মনে পরছে আমার!আমার এখানে একটুও ভালো লাগছে না!”
আকিব শিকদার ভাঙা গলায় বললেন
-“চলে আসবে আম্মা? আমিও তোমাকে ছাড়া থাকতে পারছি না।”
-“প্লিজ আসো।আমাকে নিয়ে যাও।এই ইট পাথরের শহরে আমার দম বন্ধ হয়ে আসতেছে!”
-“আঁধার তোমার খেয়াল রাখছে না আম্মু?”
চাদনী একপলক আঁধারের দিকে তাকালো।ও কাউচের উপর বসে আছে। ছোট ছোট চোখ করে তাকিয়ে আছে চাদনীে দিকে।চাদনী উত্তর দিলো না। বললো

-“বাড়ির সবাই কেমন আছে?”
-“ভালো আছে।শুধু তোমার বাবাটা ভালো নেই তোমাকে ছাড়া। সকাল থেকে খুঁজছি তোমাকে।তোমার ফোনটাও রেখে গেছো এখানে!”
-“মনে ছিলো না আনতে! কাওকে দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া যায় না? নয়তো আমাকেই নিয়ে যাও!”
আঁধার ফোন কেঁড়ে নিলো চাঁদনীর কাছ থেকে।আকিব শিকদারকে কোমল স্বরে বললো
-“তুমি চিন্তা করো না চাচ্চু। চাঁদ ভালো আছে এখানে। আর তোমাকে ওর ফোনটা পাঠাতে হবে না।আমি ওঁকে একটা নতুন ফোন কিনে দিব।তুমি চিন্তা করো না।ও এখন আমার দায়িত্ব। আমার দায়িত্ব আমি ভালোভাবেই পালন করবো!”
আকিব শিকদার আরো কিছু কথা বলে ওপাশ থেকে ফোন কেটে দিলেন।আঁধার রাগী দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো চাদনীর দিকে।ক্রোধান্বিত স্বরে বললো

-“চাচ্চুর কাছে আমাকে খারাপ প্রুফ করতে চাইছিলি কেন তুই?”
-“কীরকম?”
-“ন্যাকামি আর কতো করবি? চাচ্চুর কাছে ফোন চাইছিলি কেন? আমার কাছে চাওয়া যেতো না?”
-“আমার বাবার কাছে ফোন চাইবো না তো কার কাছে চাইবো?তোমার দয়া আমার লাগবে না!”
-“বিয়ের সময় তো ঠিকই দয়া নিয়েছিস! নয়তো তোর মতো মেয়েকে বিয়ে করতাম আমি?সারাজীবন কুমারী থাকবি তাই বিয়ে করে দয়া করেছি তোকে!”

-“না করলেও চলতো! তোমার মতো জানোয়ারের সাথে বিয়ে করার চাইতে আমি সারাজীবন কুমারিই থাকতাম!”
-“আমি জানোয়ার?”
-“তার চেয়েও অধম।”
-“কালো নই এটলিস্ট তোর মতো।সমাজ সুন্দর খোঁজে। জানোয়ার সুন্দর হলে তার সমাজে অনেক দাম।বাট কালোর ভালো হয়েও লাভ নেই।”

কাজলরেখা পর্ব ৫

-“তোমার কথাগুলো ভীষণ ঘেন্না লাগে আমার!”
-“আর আমার তোর মুখ দেখলেই ঘেন্না লাগে! সৌন্দর্যের ছিটাফোঁটাও নেই যার মুখে, তার আবার এতো বড় বড় কথা!”
আঁধার উঠে চলে গেলো।

কাজলরেখা পর্ব ৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here