আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৭

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৭
অরাত্রিকা রহমান

ঠিক তখনই—
মিরায়ার চোখ ফেটে ওঠে বিছানার উপরে হঠাৎ উঠে বসে। সে নিজেকে বুঝতে পারে না, এটা কি স্বপ্ন ছিল। সব স্পর্শ, সব কুয়াশা, সব উত্তেজনা—মাত্র মনের কল্পনা। হাত মুখে ধরে, রেখে হাজার বার শান্ত হতে চাইছে। হৃদয় দ্রুত ধাক্কা খাচ্ছে। মিরায়া সাথে সাথে অস্থিরতায় ফোন হাতে নেয়। হাত অনবরত কাঁপছে তার। ফোনটা খুলতেই দেখলো সকাল ৫টা বাজে। (শনিবার ভোর)

মিরায়া বিছানা থেকে নেমে ধরফরিয়ে বারান্দায় যায়। আর ঠিক সেই সময়ই আকাশ চিড়ে একটা প্লেনের যাওয়ার শব্দ পেয়ে সে আকাশের সেই প্লেনের দিকে তাকায়। তারপর হঠাৎ এক শূন্যতা তার ভিতরে জেঁকে বসে, তার মাথায় এলো রায়ান বলেছিল ভোরে ফ্লাইট কিন্তু সময় জানা ছিল না। মাত্র যেই প্লেনটা আকাশে ছিল এইটা যদি ভোরের ফ্লাইট হয় তবে রায়ান কি এখন আর বাড়িতে নেই? চলে গেছে তাকে একবার না দেখেই। মিরায়ার মন মানলো না। সে কিছু না ভেবে দৌড়ে যায় রায়ানের ঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে উঁকি দেয় দরজাটা খোলাই ছিল। ঘরে সত্যিই রায়ানের কোনো অস্তিত্ব অনুভব না হওয়ার জন্য সে পা টিপে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

ঘরটা একদম পরিপাটিভাবে সাজানো, কেউ একটু আগেও এই ঘরে ছিল দেখে বলা মুশকিল। মিরায়া আশ্বস্ত করল নিজেকে, যে রায়ান চলে গেছে। মিরায়া খালি ঘরটা চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রস্থান করার জন্য পা বাড়াতেই তার চোখ রায়ানের টেবিলের উপর যায়। টেবিলের উপর একটা কাগজ বোঝা যাচ্ছে না আসলে কি হতে পারে তবে এটা স্পষ্ট যে রায়ান চোখে পরার মতো করেই রেখে গেছে হয়তো নিজ ইচ্ছায় কারো উদ্দেশ্যে। মিরায়া ধীরে পদক্ষেপে টেবিলের দিকে এগিয়ে গিয়ে কাগজটা হাতে নেয়। উপরে কিছু লিখা ছিল না তবে। ভিতরে কিছু লিখা আছে তা বোঝা যাচ্ছে। মিরায়া বুঝতে পারছিল না তার কি করা উচিত চিঠিটা কি খুলে দেখবে একবার? নাকি রেখে দেবে। কার জন্য এটা সেটা বোঝারও তো উপায় নেই না খুলে দেখলে।
মানুষ জাতির জন্য একটি তিতা সত্য কথা হচ্ছে- নৈতিক শিক্ষা আর কৌতুহলের মাঝে জিৎ সব সময় কৌতূহলের হয়।

মিরায়াও তো মানুষ তার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম কিছু হয়নি, জানার কৌতূহলেই মিরায়া চিঠিটা হাতে নিয়ে খুলে পড়তে শুরু করে। চিঠিটার প্রথম লিখাপড়া পড়েই মিরায়ার চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল। লিখাপড়া কিছু টা এমন ছিল-
” হেই মাই লিটল হার্ট-বাড, আমি জানতাম তুমি আসবে আমার ঘরে। তবে একটা ওয়ারনিং আগে দেওয়া হয়নি, এখন দিচ্ছি এসেছ নিজের ইচ্ছেতে আমার ঘরে, তবে নিজের ইচ্ছেতে যেতে পারবে না। আমার ঘরে এই মুহূর্তে অবস্থান করা সবকিছু একান্ত আমার।”
কথাটা মিরায়ার মুখে একটা তৃপ্তির হাসি এনে দিল। মিরায়া চিঠিটার পরবর্তী অংশ পড়লো-
“আমি খুব যত্নবান মানুষ, আমার জিনিসের উপর অবহেলা আমার পছন্দ না। তাই সাবধান, আমার অবর্তমানে নিজের অবহেলা করোনা বেইবি। কারণ এর শাস্তি তোমার জন্য খারাপ হলেও আমার জন্য এনজয়এবল হবে। কাজ শেষে দ্রুত ফিরে আসবো। বাই ।”
চিঠির বাকি অংশে যত্ন ছিল না হুমকি তা বোঝা দ্বায়। তবে মিরায়া নিজেই চিঠিটা পড়ে হাসছে। যেন তার মনটা অদ্ভুত শান্তি পেল। হঠাৎ মিরায়া পাশের ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় নিজের মুখ দেখতে পায়- এতো মন খোলা হাসি একটা চিঠি পড়ে। মিরায়া সাথে সাথে হাসি থামিয়ে চিঠিটা ভাঁজ করে হাতে নিয়ে রায়ানের ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে যায়।

শনিবার~
সবাই স্বাভাবিক ভাবে দিন পার করলো। বাড়িটা একটু মনমরা তবে শান্ত কোনো কোলাহল নেই, রায়ানের অনুপস্থিতি সবারই অনুভব হচ্ছিলো। রামিলা চৌধুরীর মন খারাপ ছিল সকাল থেকেই তবে কিছু মুখ ফুটে বলেননি। রিমিও সকালের নাস্তা শেষ করে নিজের বাড়িতে ফিরে গেছে। রুদ্র তাকে নিজে গাড়ি করে দেয়ে আসেছে। সৌভাগ্য বসোতো তার ভাই বাড়িতে ছিল না ওই সময়, যদিও ওই বাড়িতে সে টাকার প্রয়োজন ছাড়া পা রাখে না। রুদ্র আর রায়হান চৌধুরী নিজেদের কাজে ব্যস্ত সোরায়া নিজের মতো আছে আর অন্য দিকে মিরায়া একদম চুপচাপ নিজের ঘরেই বসেছিল সারা দিন।

মিরায়ার ঘর~
মিরায়া নিজের বারান্দায় বসেছিল এক মনে আকাশের দিকে তাকিয়ে। মুখে যেমন মন খারাপের ছাপ তেমন চিন্তার। মিরায়া শ্বাস ফেলে নিজে নিজে কথা বলতে থাকলো-
“গুনধর ব্যক্তি চিঠি লিখে গেছে কিন্তু এখনকার যুগের ফোন ব্যবহার করে একটা কল দিয়ে পৌঁছেছে কিনা জানাবে সেটা পারছে না। যত্তসব!”
-“আচ্ছা উনি আমাকে তো চিঠি দিয়ে গেছেন এখন কি আমার কল করা উচিত! একবার কল করে জিজ্ঞেস করবো- লেন্ড করেছেন কিনা?”
মিরায়া নিজেই আবার নিজের অতিরিক্ত চিন্তায় বিরক্ত হয়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল-
“ইস্! না, আমি কেন কল করতে যাবো। লেন্ড করলে করবে নাহলে উড়তে থাকুক আমার কি।”
এই বলে নিজের জেদ ধরে রেখে ঘরের ভিতরে চলে গিয়ে পড়তে বসলো। এতো পড়া জমে গেছে দেখেই এক চিন্তায় পড়তে পড়তে দিন পার করলো।

আমেরিকা~ (শনিবার- সময় এর তারতম্যের জন্য)
নিউইয়র্কের জন এফ কেনেডি এয়ারপোর্টে প্লেন ল্যান্ড করতেই ট্যাক্সিওয়ে জুড়ে আলো-আঁধারির ঝলকানি। রাতের শহর যেন আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রায়ান লম্বা ট্রেঞ্চ কোট পরে, হাতে ব্ল্যাক লেদার ব্রিফকেস নিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। কাস্টমস আর চেকআউট শেষ করেই সে সোজা বেরিয়ে এলো। ড্রাইভার আগেই অপেক্ষা করছিল কোম্পানির লোগো লাগানো ব্ল্যাক সেডান নিয়ে।
ড্রাইভার সম্মান ভরে দরজা খুলে বলল— “স্যার, অফিস ডাইরেক্টলি?”
রায়ান হালকা মাথা নাড়ল— “ইয়েস। স্ট্রেইট টু দ্য মেইন ব্রাঞ্চ।”
গাড়ি এয়ারপোর্ট ছাড়তেই রাতের নিউইয়র্কের স্কাইলাইন চোখে পড়ল। উঁচু বিল্ডিংগুলো আলোকিত, প্রতিটি রাস্তা আলো আর কোলাহলে ভরা। রায়ান বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছুটা শান্ত মুখে শ্বাস ফেলল—অনেকদিন পর আবার এই শহর, নিজের কোম্পানি।

গাড়ি এসে থামল কোম্পানির বিশাল হেডকোয়ার্টারের সামনে। আধুনিক গ্লাস বিল্ডিংটা আলোয় ঝলমল করছে। গেটের সামনে থেকেই সিকিউরিটি গার্ডরা রায়ানকে দেখতে পেয়ে স্যালুট দিল।
লবির ভেতর ঢুকতেই কর্মচারীদের চোখে আলোর ঝলকানি—
“ও মাই গড, মিস্টার রায়ান ইজ হিয়ার!”
“স্যার, ওয়েলকাম ব্যাক আফটার সো লং!”
সবাই যেন একসাথে খুশিতে মুখর হয়ে উঠল। অনেকদিন পর তাদের মালিক, লিডার, অনুপ্রেরণা ফিরে এসেছে। রিসেপশনের মেয়েটা সম্মান ভরে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল—

“গুড ইভনিং, মিস্টার রায়ান। উই আর সো গ্ল্যাড টু সি ইউ এগেইন।”
রায়ান ঠাণ্ডা ভদ্র হেসে বলল—“গুড টু সি ইউ অল টু। লেটস ক্যাচ আপ সুন।”
লম্বা করিডোর পেরিয়ে সে পৌঁছাল কনফারেন্স রুমে। কাঁচের দরজার ওপাশে টেবিল ঘিরে আগে থেকেই বসে আছে কোম্পানির বড় বড় এক্সিকিউটিভ, ডিরেক্টর আর ম্যানেজমেন্ট হেডরা। সবাই দাঁড়িয়ে পড়ল রায়ানকে দেখে।
প্রবেশ করতেই ভেতরটা যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
“ওয়েলকাম ব্যাক, মিস্টার রায়ান!”
“ইটস অ্যান অনার টু হ্যাভ ইউ হিয়ার এগেইন, স্যার।”
রায়ান ভেতরে ঢুকে একে একে সবার সাথে হ্যান্ডশেক করতে লাগল। বিজনেস মাইন্ড রায়ানের বরাবরই ভালো-
“গুড টু সি ইউ, মিস্টার স্মিথ।”
“হাউ আর ইউ, মিস্টার জনসন?”
“লং টাইম, মিস ক্লেয়ার। নাইস টু সি ইউ এগেইন।”

সবাই উষ্ণ হাসিতে জবাব দিল। পুরো রুম ভরে উঠল প্রফেশনাল অথচ আনন্দঘন এক পরিবেশে। সবাই বসে পড়তেই রায়ান টেবিলের হেডচেয়ারে বসল। এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর গম্ভীর মুখে নথিপত্র সাজিয়ে বললেন—
“মিস্টার রায়ান, উই’ভ বিন ওয়েটিং ফর ইউ। দ্য ইমার্জেন্সি সিচুয়েশন ইজ কোয়াইট ক্রিটিকাল। উইদাউট ইয়োর ডিসিশন, উই কুডন’ট মুভ ফরওয়ার্ড।”
রায়ান হালকা মাথা নেড়ে উত্তর দিল—
“অলরাইট। লেটস নট ওয়েস্ট এনি মোর টাইম। টেল মি একজ্যাক্টলি হোয়াট হ্যাপেন্ড। আই ওয়ান্ট এভরি ডিটেইল অন দ্য টেবিল।”

ম্যানেজার দ্রুত ল্যাপটপ খুলে প্রেজেন্টেশন চালু করল। প্রজেক্টরের আলো জ্বলে উঠল কনফারেন্স রুমে।
“স্যার, লাস্ট কোয়ার্টার’স সাডেন মার্কেট ড্রপ, দ্য লিগ্যাল কমপ্লিকেশনস ইন দ্য ইউরোপিয়ান ব্রাঞ্চ, অ্যান্ড দ্য মার্জার প্রোপোজাল ফ্রম আওয়ার রাইভাল কোম্পানি—এভরিথিং কেম টুগেদার অ্যাট দ্য সেইম টাইম। উই নিডেড ইউ টু মেক দ্য ফাইনাল কল।”
রায়ান ভ্রু কুঁচকে স্ক্রিনের দিকে তাকাল। তারপর গভীর গলায় বলল—
“অলরাইট, লিসেন আপ এভরিওয়ান। ফ্রম নাও অন, আই’ল্ল টেক ফুল চার্জ অফ দিস ম্যাটার। বাট আই নিড ইয়োর কমপ্লিট কোঅপারেশন। অ্যাম আই ক্লিয়ার? আই সেভ টু গো টু দুবাই পর সামথিং রিলেটেড টু দিস।”
সবাই একসাথে দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল—
“ইয়েস, মিস্টার রায়ান! উই নো হেভিং ইউ ইজ আ সল্যুশন ইটস সেল্ফ।”
রায়ান লেন্ড করেই সোজা নিজের অফিসে যাওয়া‌য় অন্যকিছুর কথা তার মাথায় ছিল না। সবাই এতো দিন পর তার উপস্থিতি পেয়ে বেশ খুশি। তারপর সবাই কম্পানির গ্রোথ এর জন্য আরো কিছু প্লেন সাজায়। দীর্ঘ ৩-৪ ঘন্টা টানা মিটিং এর পর সবাই রায়ানের সকল প্রেক্ষাপটে সহমত প্রকাশ করে মিটিং টার সমাপ্তি হয়।

বাংলাদেশ ~
রাতের বেলা সবাই খেতে বসেছে। রায়হান চৌধুরী খেতে খেতে রামিলা চৌধুরীকে প্রশ্ন করলেন-“রামিলা, রায়ান পৌঁছানোর পর কি তোমাকে কল করেছে?”
রামিলা চৌধুরী খুবই বিরক্ত ছিলেন রায়ানের একবারও কল না করায়। তিনি রায়হান চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বললেন-
“না, তোমার ছেলে আমাকে ফোন করবে কেন? আমার কি কোনো চিন্তা আছে নাকি যে তোমার ছেলে ঠিক মতো পৌঁছেছে, না পৌঁছায়নি।”
রামিলা চৌধুরীর কথায় স্পষ্ট বিরক্তি ও কষ্টের ছাপ। মিরায়া খাওয়া থামিয়ে দিল। তার মাথায়ও একই কথা ঘুরছে রায়ান ঠিক মতো পৌঁছেছে কিনা। রায়হান চৌধুরী আবার বললেন –

“আচ্ছা বাদ দেও। হয়তো কাজে ব্যস্ত। এখন খাওয়ায় মনোযোগ দেও সবাই।”
রামিলা চৌধুরী আবার একই শুয়ে বললেন-
“সেই বরং ভালো। এখনকার বাচ্চারা না মা বাবার চিন্তা বোঝে না মন। ব্যস্ততা এতো বেশি যে একটা কল করে নিজের অবস্থাও জানানো যায় না।”
তারপর আর কেউ কোনো কথা বলল না। বললে হয়তো কথা আরো বাড়তো সাথে মনে থাকা কষ্টও। রাতটা সবারই অন্য রকম শুন্যতায় কাটলো। কেউই নিজেদের মনের কথা প্রকাশ করলো না।

আমেরিকা~ (শনিবার- সময় এর তারতম্যের জন্য)
কনফারেন্স রুমের দরজা আস্তে করে খুলে বাইরে বেরিয়ে এল রায়ান। মিটিং টা শেষ হয়েছে, কিন্তু মাথার ভেতর এখনও গুঞ্জন করছে নানা হিসাব, নানা চিন্তা। সে নিজের কেবিনে গিয়ে বসতেই টেবিলের উপর রাখা সাজানো ফাইলগুলো একে একে চেক করতে লাগল। গম্ভীর মুখে চোখ বোলাচ্ছে লিগ্যাল ডকুমেন্ট, মার্জার প্রোপোজাল, রিপোর্টের লাইনগুলো—সব কিছুই যেন একসাথে চেপে বসেছে মাথায়।
আমেরিকার রাত শেষ। কোম্পানির বিল্ডিং থেকে বের হওয়ার সময়টা তখন ভোররাতের মতো। আমেরিকার আকাশে সূর্যের প্রথম আলো ঢুকতে শুরু করেছে। ঠাণ্ডা বাতাসের ঝাপটা গায়ে এসে লাগতেই রায়ান এক নিঃশ্বাস নিয়ে বেরিয়ে এল নিজের জন্য পাঠানো কালো সেডানে। ড্রাইভার বিনয়ের সাথে দরজা খুলে দিল, কিন্তু রায়ান শুধু মাথা নেড়ে বলল—

“Home. Straight home.”
কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামল শহরের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রায়ানের সেই বিশাল লাক্সারিয়াস ভিলার সামনে।
গ্লাস আর মার্বেলের দোতলা বাড়ি, চারদিকে আলো জ্বলছে—কিন্তু ভেতরে নীরবতা। বহুদিন পর আমেরিকায় ফিরে নিজের বাড়িটাকে দেখে রায়ানের ভেতরে হঠাৎ এক ধরনের হতাশা ছেয়ে গেল।
বাংলাদেশে তো সে এতদিন একসাথে ছিল মা-বাবা, ভাই-বোন আর নিজের বউটার সাথে। আলোর ঝলমলে এই বাড়িটা এখন অদ্ভুত ফাঁকা আর ঠাণ্ডা মনে হচ্ছে তার কাছে।
সিঁড়ি দিয়ে নিজের ঘরে যায় রায়ান। ভেতরে ঢুকেই ব্লেজারটা সোফার উপর ছুঁড়ে রাখল। হাতের ফোনটা বের করে ভাবল—“একবার বাড়িতে কল করি? এত ব্যস্ততার মাঝে সিমটাও চেঞ্জ করা হয়নি আর কল ও করা হয়নি। মা নিশ্চয়ই রেগে আছে চিন্তায়।”

কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই মনে পড়ল—এখানে এখন ভোর, মানে ওদিকে বাংলাদেশে গভীর রাত। এমন সময় ফোন দেওয়া ঠিক হবে না। কাল কল করে নেবে।
রায়ানের মনে কেবল ঘুরছে মিরায়ার মুখটা আসার আগে একবার দেখে আসারও সুযোগ হয়নি। প্রাণটা হাশফাশ করছে। রায়ান মনে মনে চিন্তা করছে-
“এখন ও কি করছে? ঘুমোচ্ছে তো? আমার জন্য একটু হলেও কি ওর খারাপ লেগেছে আজকের সারাটা দিন? আমাকে ভেবেছে?” মাথার ভেতর হাজারটা প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে।
আচমকা মনে পড়ে গেল সেই চিঠিটার কথা— যেটা সে যাওয়ার আগে লিখে রেখে এসেছে। রায়ানের মাথায় এবার সেই চিন্তা ভর করলো-
“ও কি আদৌ পড়েছে চিঠিটা? ও কি আমার ঘরে গিয়েছিল? যদি পড়ে থাকে, তাহলে একবারও কেন খবর নিল না এখন পর্যন্ত…!”

মনের ভেতর অদ্ভুত এক শূন্যতা আর অভিমান জমে উঠল। তবে আবার নিজেকে বুঝালো-
“ও খবর নেবেই বা কিভাবে বাংলাদেশের নাম্বার তো এখন আর কাজ করবে না এখানে আর এখানকার নাম্বার টা তো দেওয়া হয়নি ওকে।”
সারাটা রাত বাংলাদেশে না ঘুমিয়ে কাটিয়ে আবার এখানে সারাদিনের পরিশ্রম—শরীর যেন আর টানতে পারছে না।
মাথার ব্যথাটা বাড়তে বাড়তে চোখ ভারী করে তুলেছে রায়ানের।
রায়ান ফোন রেখে। ক্লোজেট থেকে তাড়াহুড়ো করে একটা সাধারণ টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করল। শাওয়ার নিয়ে আসার পর পেটের ক্ষুধাটা মনে হলো জেগেছে মাত্র, এখন কিছু অর্ডার করে আনাবে সেই ধৈর্য আর কুলালো না।
শেষমেষ একটা ডিম নিয়ে সেদ্ধ করল। সেদ্ধ ডিমটাও খেতে যেন অদ্ভুত কষ্ট লাগছিল—একলা টেবিল, একলা রাত। কিছু ভালো লাগছিল না তার।

খাওয়া শেষ করেই ক্লান্ত শরীর নিয়ে শোবার ঘরে গেল।
বড়সড় কিং-সাইজের বেড, সাদা চাদর, ঝকঝকে রুম—কিন্তু আজ সবকিছুই শূন্য। বালিশে মাথা রাখতেই শরীর আর মাথা দুটোই হেরে গেল ক্লান্তির কাছে। শেষবারের মতো মনে ভেসে উঠল মিরার হাসি, তার চোখ, তার ঠোঁট—আর সেই চিঠি-“ও কি সত্যিই পড়েছে…?” রায়ান চোখ খুলে একবার নিজের পাশের খালি বালিশের উপর মিরায়ার মুখটা কল্পনা করতেই মুখে খেলে গেল এক মিষ্টি হাসি আর সাথে সাথেই চোখ বন্ধ করার মাঝে সবকিছু ঘুমের অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। শুধু ঘড়ির টিকটিক শব্দে ভরে রইল পুরো ভিলা।

রবিবার সকাল~
সকালটা চৌধুরী বাড়িতে ছিল একেবারেই স্বাভাবিক, নিরিবিলি অথচ নিয়মের ছন্দে ভরা। ভোরের হালকা রোদ উঠতেই বাড়ির চারপাশে এক শান্ত পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আঙিনার গাছগুলোতে পাখির কিচিরমিচির, বাতাসে একধরনের সতেজ গন্ধ। ডাইনিং টেবিলে সবার একসাথে সকালের নাস্তা শেষ হলো। আলাপচারিতায় ভরা টেবিল ধীরে ধীরে শান্ত হলো—যেন নতুন সপ্তাহ শুরু হওয়ার আগে সবার ব্যস্ততার আভাস।
রুদ্র আর রায়হান চৌধুরী—গম্ভীর মুখে, হাতে ফাইল নিয়ে স্যুট পরা অবস্থায় বাড়ি থেকে বেরোলেন। গাড়ি অপেক্ষা করছিল গেটের সামনে। ড্রাইভার দরজা খুলে দিল, আর তিনি উঠে বসলেন। গাড়ি ছুটলো—চৌধুরী গ্রুপ অফ কোম্পানির হেড অফিসের দিকে।

এইদিকে সোরায়া—ব্যাগ কাঁধে নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে করতে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। কলেজের নোটে ভরা ব্যাগ, আর মুখে একরাশ উদ্যম। বেরোনোর সময় রামিলা চৌধুরীকে হালকা হাসি দিয়ে বলল, “মামণি, আমি যাচ্ছি।” তারপর বাইরে বেরিয়ে কলেজের জন্য রিকশায় ঠিক করে চড়ে বসলো।
অন্যদিকে মিরায়া—চুপচাপ, কিন্তু প্রাণবন্ত চেহারায় ক্যাম্পাসের জন্য রওনা দিল। হাতে ব্যাগ, পরনে হালকা রঙের কুর্তি। গেট পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল, তার দৃষ্টি যেন অজান্তেই কিছুটা দূরে কোথাও হারিয়ে আছে। মন টানছে না তবে ক্যাম্পাসে যেতে হবে। নিজের এই অবস্থার কারণও তার অজানা।
সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর চৌধুরী বাড়িতে একরকম নিস্তব্ধতা নেমে এল। ডাইনিং টেবিল গুছিয়ে রাখা হলো। প্রচণ্ড কোলাহলপূর্ণ সকালের পর হঠাৎ নীরবতা যেন বাড়িটাকে ঘিরে ধরল। যেন দিনের ব্যস্ততার শুরুটা বাইরে গিয়ে ছড়িয়ে পড়ল।

সোরায়ার কলেজ~
সকালের প্রথম ক্লাস—অর্থনীতি। ক্লাসরুম ভরা, বোর্ডে প্রফেসর স্যার মার্কার চালাচ্ছেন একের পর এক ডায়াগ্রাম আঁকতে আঁকতে। মাঝের বেঞ্চে বসে সোরায়া—দুই চোখে হালকা ঘুমঘুম ভাব, মাথা দুলছে, খাতায় কলম ছুঁয়ে রেখেছে বটে কিন্তু কোনো নোটই নামছে না। তার এমনিতেই অর্থনীতি বিষয়টা কঠিন লাগে। পাশেই জুঁই বসে আছে, একই অবস্থায়। তবে সোরায়ার ওই আধা ঘুমন্ত চেহারা দেখে জুঁইর আরও মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে—”উফ্ সোরা! একে তো ক্লাসটাই বিরক্তিকর, তার উপর তুই ঘুমে গুট্টি মেরে আছিস, এইসব সহ্যই করা যায়?”
ঘন্টা বাজতেই প্রফেসর স্যার ফাইল গুছিয়ে বেরিয়ে গেলেন।
ক্লাসরুমের ভেতর হালকা একটা মুক্তির হাওয়া বইলো। প্রফেসরের চলে যাওয়ার সাথে সাথে সবাই যার যার মত কথা বলা আরম্ভ করল ক্লাসটা সাথে সাথেই কোলাহল পূর্ণ হয়ে উঠল। জুঁইও সঙ্গে সঙ্গেই সোরায়ার দিকে ঘুরে বলল

“ওই ছেমরি! ক্লাসে এমন ঘুমে পড়ে যাচ্ছিলি কেন? রাতে ঘুমাসনি নাকি?”
সোরায়া বেঞ্চে মাথা রেখে বসেছিল, প্রশ্ন শুনে অলস ভঙ্গিতে মাথা অল্প তুলল। চোখ আধো বোজা, কণ্ঠেও আলস্য—
“দেখ জুঁই, সকালের ক্লাস দেহ পায় কিন্তু মন পায় না।”
জুঁই থ হয়ে গেল। একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল সোরায়ার দিকে, যেন মনে মনে হিসাব করছে—এই মেয়ের মাথা ঠিক আছে তো? তারপর ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল—
“ক্লাসে মন না বসা এক কথা, কিন্তু তুই তো একেবারে ঘুমে টলছিলি। রাতে কি ঘুমাসনি?”
সোরায়া এবার একটা লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল। ঠোঁট নাড়ল ধীরে ধীরে, নিজের মনে বিড়বিড় করল—
সোরায়া (নিজের মনে): “আর ঘুম… যে বই কিনেছি, ঘুম হারাম হয়ে গেছে আমার। যেমন চিন্তা দিচ্ছে, তেমন আকর্ষণ।”

জুঁই ভ্রু কুঁচকে আবার বলল—“কিরে? কিছু জিজ্ঞেস করছি তো উত্তর দে।”
তখন সোরায়া মাথা তুলে হাসির ছোঁয়া মিশিয়ে উত্তর দিল—
“এত দাম দিয়ে একটা বই কিনলাম, ওইদিন টাকা উসুল করার মতো বইটা পড়ে শেষ না করলে কি চলে! এজন্য রাত জেগে পড়েছি।”
জুঁই দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে ধরল, তারপর সোরায়ার মাথায় হালকা চাপড় দিয়ে বলল— “তুই আর তোর বই পড়া—দুটোই অদ্ভুত।”
সোরায়া হেসে দিলো—একেবারে দুষ্টুমি ভরা মুখে।
আর জুঁইর বিরক্তি আর অবিশ্বাস মিশ্রিত অভিব্যক্তি দেখে।
অর্থনীতির সেই তন্দ্রাচ্ছন্ন ক্লাস শেষে যখন সোরায়া আর জুঁই এখনও হাই তোলার ফাঁকে ঝগড়া চালাচ্ছিল, তখনই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকল মাহির। মুহূর্তেই যেন শ্রেণিকক্ষে পিনড্রপ সাইলেন্স! ঘুমন্ত ছাত্রছাত্রীদের চোখে হঠাৎই আলো জ্বলে উঠল।

সোরায়ার শরীরেও একেবারে এনার্জি শট! সে চোখ তুলে মাহির দিকে তাকাতেই হালকা একটা চকচকে হাসি দিল।
কিন্তু পরম মুহূর্তেই বুকশপের সেই ঘটনা মাথায় চলে আসতেই, তার হাসি একেবারে হ্যাং হয়ে গেল লোডশেডিং-এর মতো! মাথা নিচু করে এমন ভান করল, যেন বেঞ্চের কাঠের ভেতর ঢুকে যাবে।
জুঁই ফিসফিস করে:
“কিরে? হাসছিলি, হঠাৎ মাথা নিচু করলি কেন?”
সোরায়া একেবারে সাইলেন্ট মোড অন করে বসল। কিছুই বলল না জুঁইকে। এসব বলল খেপাতে আর কিছু বাকি রাখবে না জুঁই তার সেটা ভালো করেই জানা।
মাহির স্যার কণ্ঠ খাঁকারি দিয়ে বললেন—
“স্টুডেন্টস, আগামী ১ তারিখ আমাদের নবীনবরণ অনুষ্ঠান হবে। তোমরা সবাই নোটিস বোর্ড টা একটু চেটে করে নিও।”

পুরো ক্লাস খুশিতে একসাথে হাততালি!
“ইয়া-ইয়া-ইয়া!” সোরায়া আর জুঁইর চোখও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
তারপর মাহির সিরিয়াস মুখে জিজ্ঞেস করল—
“ওকে সাইলেন্ট নাও। সবাই ক্লাসে মন দেও এবার। কে কে হোমওয়ার্ক করেছে?”
কেউ কেউ কাতর গলায় বলল—“জি স্যার…”
অন্যরা চুপ।
মাহির ভ্রু উঁচু করে বলল— “ঠিক আছে। এবার কে কে হোমওয়ার্ক করো নি, দাঁড়াও।”
একসাথে একগাদা স্টুডেন্ট দাঁড়িয়ে গেল।
তাদের মাঝে লজ্জায় মাথা নিচু করে দাঁড়ালো জুঁই আর সোরায়া। মাহির চোখ একেবারে সরাসরি গিয়ে থামল সোরায়ার উপর। বুকশপের ঘটনা তার মাথায় তখনও ঘুরছে।
মনে মনে ভাবল—“এই মেয়েটা? উগ্র অভদ্র! এবার দেখি কি বলে।”
সে ধীরে ধীরে এগিয়ে এসে সোরায়ার বেঞ্চের সামনে দাঁড়াল।
গম্ভীর কণ্ঠে বলল—

“হোমওয়ার্ক না করার কারণ কী?”
সোরায়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল।
মাহির আবার বলল—
“শুনছো না জিজ্ঞেস করছি কিছু? কারণ কী?”
সাহস করে সোরায়া মাথা তুলে বলল—
“বিশ্বাস করুন স্যার, আমি হোমওয়ার্ক করেছি… কিন্তু—”
মাহিয সঙ্গে সঙ্গেই প্রশ্ন করল—
“কিন্তু কী?”
সোরায়া-“ খাতা ভুলে বাসায় রেখে চলে আসছি।”
মাহির ভ্রু কুঁচকে হেসে উঠল আর হেসেই বলল-

“তোমরা নিউ জেনারেশন অন্তত অজুহাত হিসেবে কিছু নতুন বানাও। এগুলো তো আমাদের সময়কার অজুহাত—‘খাতা বাসায় রেখে এসেছি’। আর কত বছর চালাবে এটা?”
ক্লাসে সবাই হেসে গড়াগড়ি। জুঁই তো একেবারে পাশে দাঁড়িয়ে সোরায়ার দিকে তাকিয়ে হাসি চাপতে চাপতে কেঁদে ফেলছে।
শেষে মাহির হাত উঁচু করে বলল—
“আজকের জন্য মাফ করা হলো। তবে এরপর থেকে সবাই হোমওয়ার্ক কমপ্লিট করেই আসবে।”
তারপর আবার ঠান্ডা মাথায় লেকচারে ফিরে গেলেন। দীর্ঘ ১ঘন্টা ক্লাসের পর ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। সোরায়া এক দমে বসে পড়ল। তার মুখ গরম, বুকশপের ঘটনা মনে পড়তেই আবার মাথা নিচু।
একটু ভেতরে ভেতরে মজা পেলেও, সে হাসিটা বের করতে পারল না।
জুঁই চাপা গলায়: “তুই তো আজকের পুরো অজুহাত কুইন!”
সোরায়া কানের কাছে হাত দিয়ে শুধু বলল—
“চুপ কর, না হলে কিল খাবি।”
ক্লাস আবার নতুন প্রফেসরের সাথে শুরু হলো।

ঢাবি ক্যাম্পাস~
দুপুরের দিকে ক্লাস শেষ করে মিরায়া আর রিমি দুই বান্ধবী পাশাপাশি হাঁটছে ক্যাম্পাসের বিশাল সবুজ মাঠ ঘেঁষে। হাওয়ায় হালকা ধুলোর গন্ধ, পাখির ডাক, চারপাশে ছাত্রছাত্রীদের ছোট ছোট গ্রুপ জমে গল্প করছে। মিরায়া আর রিমির হাতে গরম গরম এগ রোল, কাগজে মোড়ানো, ধোঁয়া উঠছে। দুজনেই খেতে খেতে হালকা হেসে পাশাপাশি হাঁটছে সবুজ গাছের উপর পা ফেলে তবে মিরায়ার মুখটা একদমই মনমরা আর গম্ভীর।
রিমি এক কামড় দিয়ে রোল চিবুতে চিবুতে মিরায়ার দিকে তাকিয়ে খেয়াল করছিল—“সকাল থেকে মেয়েটার মুখে হাসি নেই। কিছু না কিছু তো গোলমাল লেগেছে।”
মিরায়ির চোখে স্পষ্ট ক্লান্তি। মাথার ভেতরে শুধু ঘুরছে—
“একদিন হয়ে গেল রায়ান নেই… কেমন আছে, কি করছে? কল তো দিল না একবারও। অথচ চিঠিতে কত আবেগ লিখলো… যত্ন রেখো, অবহেলা করো না, না হলে শাস্তি আছে…ধুর ধুর সব বেফালতু‌”
মিরায়া বিরক্তির সাথে নিজের মনেই বলল—

“ফালতু! সবই আবেগ। দেশের বাইরে গিয়ে একটুও মনে নেই বোধহয়। এখন আমি বোকা হয়ে শুধু ভাবছি।”
চোখের কোণে বিরক্তি জমলেও ভিতরে একটা হালকা কষ্ট রয়ে গেল।
রিমি হঠাৎ মিরায়ার কাঁধে হালকা কাঁধ লাগিয়ে ধাক্কা দিয়ে বলল—
“কিরে? কোথায় হারিয়ে আছিস? সকাল থেকে চুপচাপ, শুধু খাচ্ছিস। কিছু বলবি? নাকি দিবাস্বপ্নে ডুবে আছিস?”
মিরায়া স্বপ্ন শব্দটা শুনলেই কেঁপে উঠলো। কেমন যেন ভয় কাজ করে স্বপ্নের কথা ভাবলেই। দীর্ঘ ১৮ বছরের জীবনে জানতে অজান্তে এমন কোনো স্বপ্ন দেখেনি সে যেটা ওই রাতে দেখেছে। মিরায়া রাগ ঝেড়ে ফেলে ছোট্ট উত্তর দিল— “কিছু হয়নি।” কণ্ঠে বিরক্তি স্পষ্ট।
রিমি চোখ সরু করে মিরায়ার দিকে তাকাল।
“হুঁ, বুঝেছি! এটা তোর নরম গলায় ‘কিছু হয়নি’। মানে ভেতরে পুরো আগুন জ্বলছে। ঠিক না?”
মিরার মুখে কোনো জবাব নেই দেখে রিমি ইচ্ছে করেই বলল—“তুই কি রায়ান ভাইয়াকে নিয়ে ভাবছিস? চলে গেছে তো, তাই খুব মিস করছিস, না? কথায় আছে না দাঁত থাকতে মানুষ দাঁতের মর্ম বোঝে না।”
মিরায়া চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রাগান্বিত সুরে বলল—

“যাতা! বাজে কথা বলিস না তো। উনার কথা আমি কেন ভাববো? আর শোন আমি আমার দাঁতের বেশ যত্ন করি এই আফসোস আমার হবে না ভবিষ্যতে।”
রিমি মুচকি হেসে ফিসফিস করল—
“হুম… এইরকম বিরক্তি মানেই আসলেই ভাবছিস।”
রিমি আবার বলল—
“আচ্ছা, উনার খবর কি? কবে ফিরবেন?”
মিরায়া একটু জোরে নিঃশ্বাস ফেলে বলল—
“আমি জানি না। যাওয়ার পর থেকে উনি একবারও কল করেননি বাড়িতে।”
এই কথা শুনে রিমি যেন আরও স্পষ্ট বুঝল—মেয়েটা সত্যিই মন খারাপ করেছে। তখনই রিমি হালকা নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল—

“হয়তো সময় পায়নি। নাহলে কে জানে… বিদেশে নতুন কাউকে পেয়ে গেছে নাকি? যাওয়ার আগে তো কাউকে কিছু বলেও গেল না…”
মিরায়া এক ঝটকায় প্রতিবাদ করে উঠল—
“ধুর! একদম বাজে কথা বলিস না তো। রায়ান ভাইয়া মোটেও এমন না।”
মিরায়ার কণ্ঠে অতিমাত্রার প্রতিবাদ শুনে রিমি হো হো করে হেসে ফেলল। রিমি একদম নিশ্চিত হয়ে গেল মিরায়া ধীরে ধীরে রায়ানের প্রতি দুর্বল হয়ে গেছে তাই রায়ানের জন্য করা সামান্য কটুক্তি ও তার সহ্য হচ্ছে না আবার নিজেও দুর্বলতা স্বীকার করার মেয়ে নয়।
রিমি মিরায়া কে খেপাতে কাঁধে কাঁধ ঠেকিয়ে খেপানোর ভঙ্গিতে বলল—

“তাহলে বল, কেমন বান্ধবী? সব খুলে বল আমিও শুনি সে কেমন।”
মিরায়া ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল—
“তুই যদি আর একটা কথা বলিস উনাকে নিয়ে, দেখিস আমি তোর কি করি।”
রিমি দুই হাত উঁচু করে মজার ছলে নাটকীয় ভঙ্গিতে বলল—
“না না বাবা! থাক, আমি আমার বোনের মতো বান্ধবীর সাথে অন্য কারো জন্য ঝগড়া করতে চাই না।”
মিরায়া বিরক্তির মাঝেই হেসে দিল। রিমি এবার একটু গম্ভীর ভঙ্গিতে মজার সুরে বলল—
“তবে এটুকু সত্যি, আমার মিরা জানের সামথিং-সামথিং হচ্ছে।”
মিরায়া চোখ বড় বড় করে রিমির দিকে তাকিয়ে রাগ দেখাল—“নাথিং ইজ হ্যাপেনিং! একদম বেশি বুঝবি না।”
রিমি মুচকি হেসে মাথা দোলাল—

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৬

“যা-ই বলিস, চোখ কিন্তু সব বলে দিচ্ছে।”
দুজনেই হেসে একসাথে এগ রোল শেষ করল। সবুজ মাঠে হাঁটার সেই মুহূর্তটা যেন আবার হালকা আর নির্ভার হয়ে উঠল। মিরায়ার রিমির খেপানো মজার লেগেছে বলা বাহুল্য। সে নিজেও এক মুহূর্তের জন্য রায়ানের প্রতি নিজের দুর্বলতা অনুভব করতে পারলো কিন্তু প্রশ্রয় দিল না। মনের ভাব মনেই দাফন করে রাখলো।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৭ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here