সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫২

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫২
জাওয়াদ জামী

” ও সিক্তাপু , তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও । তোমার বাবার বাড়িতে যাচ্ছি , অথচ তুমিই ঢিলেমি করছ! এটা কোন কথা! যেখানে তুমি ভোর না হতেই তৈরি হয়ে আমাকে তৈরি হতে জোড়াজুড়ি করবে, সেখানে তোমাকেই আমার তৈরি হতে জোড়াজুড়ি করতে হচ্ছে। হায়রে মানুষ! ” দৃষ্টি কপাল চাপড়ে বলল।
সিক্তা ওর কাপড় ব্যাগে রেখে সিক্তার দিকে তাকায়। দৃষ্টিকে সাজুগুজু করতে দেখে হাসল ও।
দৃষ্টি এসে সিক্তার বিছানায় বসল। আনান ড্রেসিংটেবিলের আয়নায় দু’জন দেখে নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল।
” বাহ্ সিক্তা , তোকে তো সেই লাগছে! হ্যাঁ রে , ভাইয়া কি তোকে ঐ বাসায় থাকতে দেবে? তোকে ভাইয়া এক রাতও অন্য কোথাও থাকতে দেয় না, এটা কিন্তু আমরা জানি। কিন্তু আজকে হঠাৎই তুই বলছিস, ঐ বাড়িতে থাকবি। ঘটনা কি বলতো? ঝগড়া করেছিস ভাইয়ার সঙ্গে? ” সিক্তা জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় দৃষ্টির দিকে।

” আরে না। ঐ বেডার সঙ্গে ঝগড়া করার মুড নেই আমার। শুধু আমি ঝগড়া করলেই তো আর হবে না। তাকেও ঝগড়া করতে হবে। তবেই না ঝগড়া করে মজা। আর সেই মজা আমার কপালে নেই বুঝলে? তোমার ভাসুরের নির্দেশ রাতেই আমাকে বাসায় ফিরতে হবে। সে অফিস থেকে ফেরার পথে আমাকে নিয়ে আসবে। কিন্তু আমিও বলে দিয়েছি, আজকে যদি সে আমাকে নিয়ে আসে তবে আগামীকালই কালই আমি শ্বশুর বাড়িতে চলে যাব। একমাসের আগে ঢাকা আসব না। ব্যাস এতেই কাজ হয়ে গেছে। আমি আগামী তিনদিন মামা শ্বশুরের বাড়িতে থাকার পারমিশন পেয়ে গেছি। ”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

” ওরে সাংঘাতিক মেয়ে রে! তুই যে আমার মেয়ে এটা ভাবলেই আমার বুক কেঁপে ওঠে। আমার চাচার মেয়ে এত বিটলা হবে এটা বাপের জন্মেও ভাবিনি আমরা। চাচী কত ভালো মানুষ ছিল। আবার কোকিলাও চাচীর থেকেও ভালো। কিন্তু তুই হয়েছিস আমাদের জাতের থেকেও আলাদা। তোর মাথায় সব সময় কুবুদ্ধি গিজগিজ করে আর সেগুলো বেরিয়ে আসার রাস্তা খোঁজে। এই শোন, তুই কিন্তু আমার সাধাসিধা বউকে তোর মত কুচুটে বানাবি না। কয়দিন পর দেখব আমার চুপচাপ ভাইয়া তোর হুমকিধামকিতে পাবনার রাস্তা ধরেছে। আবার আমার বউও যদি তোর মত হয় তবে আমাকেও ভাইয়ার পথেই হাঁটতে হবে। যেটা আমি চাই না। এখনো আমার নাতি-নাতনিরা দুনিয়ায় ল্যাণ্ড করেনি। ওদেরকে কাঁধে নিয়ে বেড়ানোর কত ইচ্ছে আমার সেটা কি জানিস? ” দৃষ্টির কথা শুনে আনান ধমকে উঠল। কিন্তু দৃষ্টি সেটাকে পাত্তা দিলে তো?

” তোমাদের কথা ভাবতে গেলে নিজেদের নিয়ে ভাবার সময় পাবো না। তারচেয়ে বরং তোমরা নিজেরাই নিজেদের নিয়ে ভাব। আপু , আর দেরি করো না কিন্তু। বড় মামী কয়েকবার ফোন দিয়েছে। এখনই যদি না বের হই , তবে কিন্তু আমাদের সত্যিই দেরি হয়ে যাবে । ”
” আমার হয়ে গেছে। এই অলসের গ্যারাজ বেরিয়ে গেলেই আমরাও বের হব। ” সিক্তা আনানকে দেখিয়ে বলল।
” এই তুই আমাকে অলসের গ্যারাজ বললি কেন? আমি কি অলস? যদি আমি অলসই হতাম, তবে কি সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠে তোকে কাজে সাহায্য করতাম? ” দৃষ্টি রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই আনান সিক্তাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বলল।
” তুমি তো অলসই। সকাল সাতটায় ঘুম থেকে উঠেছ ঠিকই , কিন্তু সকাল দশটা বেজে গেলেও সাজুগুজু শেষ হচ্ছে না তোমার। ”

” সাজুগুজু করছি মানে! আমি কি লেডিস নাকি যে সাজুগুজু করব ? ঐটা তোদের সেক্টর। আমার কাজ শেষ। এখনই বেরিয়ে যাব। শোন, রাতে কিন্তু বাসায় চলে আসবি। আমি সবার সামনে বারবার তোকে বাসায় আসবার কথা বলতে পারব না । ”
” আমি তো এবার সাতদিন ঐ বাসায় থাকছিই । বিয়ের পর বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকাই হয় না । আমার কি ইচ্ছে করে না বাবার বাড়িতে গিয়ে থাকতে ? ”
সিক্তার দিকে তাকিয়ে আনানের খারাপ লাগল। সত্যিই বিয়ের এক বছর হতে চলল , অথচ মেয়েটা বাবার বাড়িতে গিয়ে দুইদিনও থাকেনি।

” ঠিক আছে , তোর যে কয়দিন ইচ্ছে তুই ততদিনই থাকবি । তবুও মন খারাপ করে থাকবি না। তোর মলিন মুখখানা বাঁধ ভাঙা ঢেউ হয়ে আমার বুকের পাঁজরে আছড়ে পরছে। বেদনার তীব্র দহনে ছারখার হচ্ছে আমার হিয়ার মধ্যিখানে। ” আনান মলিন মুখে কথাগুলো বলে সিক্তাকে বুকের মাঝে জড়িয়ে নিল।
” এভাবে বলো না। তুমি এভাবে বললে আমি কোথাও গিয়ে থাকতে পারব না। এই শোন না , তুমি ক্লাস শেষ করে ঐ বাসায় যাবে। আজকে তোমাকে এখানে আসতে হবে না। ”
” আজ কিছুতেই শ্বশুর বাড়িতে থাকতে পারব না । তুই কিন্তু জোর করবি না । আমি ক্লাস শেষ করে শ্বশুর বাড়িতে যাব ঠিকই । কিন্তু রাতেই আবার ফিরে আসব। আগামীকাল সকালে একজনের সঙ্গে আমার মিটিং আছে । এবং সেটা সকাল আটটার মধ্যে । ”

” কিসের মিটিং ? আর সঙ্গে মিটিং ? ” সিক্তা সন্দেহের চোখে তাকায় আনানের দিকে।
” আরে আগে আমার পুরো কথাটা শোন । একটা কোম্পানির এমডির সঙ্গে আমার জানাশোনা আছে। সেই ভদ্রলোক আমাকে তার কোম্পানিতে জয়েন করতে বলছে। সেসব নিয়েই আলোচনা করতে তার সঙ্গে দেখা করতে যাব। ”
” তুমি পড়াশোনা বাদ দিয়ে চাকরি করতে চাও! তোমাকে কি কোনভাবে আমি প্রেশার দিচ্ছি? পড়াশোনার পাশাপাশি তুমি পাঁচটা টিউশনি করছ। সংসারে টুকটাক সহযোগিতা করছ । যদিও নিহান ভাইয়া চায় না তুমি সংসারে কনট্রিউট কর । সবাই চায় তুমি আগে পড়াশোনা শেষ কর। সংসারের চাপ মাথায় নিও না । কিন্তু তুমি কি কারও কথাই কানে তুলতে চাও না। সবাইকে ইগনোর করতে চাইছ তুমি? ” সিক্তা রেগে গেল।

” আমি কি একবারও বলেছি যে পড়াশোনা ছেড়ে দেব ? পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরি করতে চাচ্ছি। সেসব নিয়েই ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে আলোচনা করতে চাই । আমি জানি , ভাইয়া কিংবা আব্বু-আম্মু কেউই চায় না সংসারে একটা টাকাও দেই । তারা চায় আমি পড়াশোনা শেষ করার পর যা করার করি । আমিও তেমনটাই চাই । কিন্তু কয়েকদিন আগে হঠাৎই সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হয়। তিনিই আমাকে জবের অফার করলেন । আমি বলেছি , চিন্তাভাবনা করে জানাব। আগামীকাল তাকে জানানোর কথা। ”
” কোন আলোচনার প্রয়োজন নেই । পড়াশোনা শেষ না করে তুমি চাকরি করতে পারবে না । তাকে তুমি ফোনে জানিয়ে দেবে , এখন তুমি চাকরি করবে না । ”

” ঠিক আছে , ঠিক আছে উনাকে ফোন করব । তবুও তুই রাগ করিস না । পড়াশোনা কমপ্লিট না করে , চাকরি করব না । স্বয়ং আমার ভুঁড়িওয়ালা শ্বশুরও যদি আমাকে রিকুয়েষ্ট করে তবুও আমি তাকে সাফ জানিয়ে দেব , আমার বউয়ের কথাই আমার কাছে আদেশ। বউয়ের আদেশ বহির্ভুত কোন কাজ আমি করব না । ”
” সত্যি? ”
” তিন সত্যি । এবার একটু হাস। তোর হাসিমুখটা দেখে আমার প্রান জুড়াক। ”
আনানের কথা শুনে সিক্তা ফিক করে হাসল। ঠিক তখনই আনান ওকে নিজের খুব কাছে টেনে নিল। নিমেষেই দু’জোড়া অধর মিলিত হল সুখের আবেশে। প্রেমাসিক্ত এক নারী তার পুরুষের বাহুডোরে পিষ্ট হতে থাকল। প্রেমের বান ডাকল দু’জনের তনুমনে।

” কুহু মা , আজকেও তুই ক্লাসে যাচ্ছিস? আজকে ক্লাসে না গেলে হয় না , মা? আর কিছুক্ষণের মধ্যেই তমা, ফারদিন চলে আসবে। সিক্তা আর দৃষ্টিও নাকি বাড়ির কাছাকাছিই এসে গেছে। ” কুহুকে তৈরি হয়ে নিচে নামতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন তাহমিনা আক্তার।
” মা, আমি এক থেকে দেড় ঘন্টার মধ্যেই ফিরে আসব। জরুরী কাজ পরে যাওয়ায় আমাকে আজ যেতে হচ্ছে, নয়তো আজকের দিনে কোথাও যেতাম না আমি। রাগ করো না , মা। ”
” পাগলী মেয়ে , রাগ করব কেন ! তোর দরকার থাকলে বাহিরে যাবি। আমি জিজ্ঞেস করেছি বলেই কি রাগ করেছি ভেবেছিস ? তবে যেখানেই যাস না কেন , খেয়ে তারপর যা। দিনদিন কেমন শুকিয়ে যাচ্ছিস সেটা খেয়াল করেছিস? তোর চেহারায় আগের সেই লাবন্যতা আর নেই। আম্মাও গতকাল বলছিলেন সে কথা। আয় খেয়ে নে। ”
কুহু বাধ্য মেয়ের মত শ্বাশুড়ির পিছুপিছু রান্নাঘরে গেল।

” মামী , আপু কোথায় ? আমরা তোমাদের বাসায় এসেছি কিন্তু আপুর দেখা নেই। সে কোথায় লুকিয়ে আছে? ” দৃষ্টি চঞ্চল চোখে চারপাশে তাকাল।
দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে হাসলেন আফরোজা নাজনীন। এই চঞ্চল মেয়েটিকে তিনি কুহর থেকে কম ভালোবাসেন না ।
” কুহুর আজ বোধহয় জরুরি ক্লাস আছে। কিছুক্ষণ আগেই বাসা থেকে বেরিয়ে গেল। তুই গিয়ে তোর দিদুনের সঙ্গে দেখা কর । তিনি সকাল থেকেই তোদের কথা বারবার জিজ্ঞেস করছেন। ততক্ষণে আমি তোদের জন্য টেবিলে খাবার সাজাই। তারপর তোর সঙ্গে গল্প করব । ”
” ঠিক আছে মামী , আমি দিদুনের কাছে যাচ্ছি। তবে এখন কিছুই খাব না । বাসা থেকে খেয়ে এসেছি । তবে যখন ক্ষুধা লাগবে , তখন তোমার কাছ থেকে চেয়ে খাব। ” দৃষ্টি নিজের কথা শেষ করেই দিদুনের রুমের দিকে পা বাড়াল।
দৃষ্টির চঞ্চলতা দেখে আবারও হাসলেন আফরোজা নাজনীন। তিনি চারপাশে তাকিয়ে সিক্তাকে খুঁজলেন। মেয়েটা অনেকদিন পর এই বাসায় এসেছে। আজকে তার খুব ইচ্ছে করছে সিক্তাকে কাছে নিয়ে বসে থাকতে। তিনি দেখলেন সিক্তা রান্নাঘরে বসে তাহমিনার সঙ্গে গল্প করছে। তিনি হেসে এগিয়ে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।

” খালমণি , কুহু কখন আসবে ? ওকে ছাড়া একটুও ভালো লাগছে না। ”
তাহমিনা আক্তার তমার দিকে তাকালেন। তমার কোলে ফারজাহ কে দেখে তিনি ওকে কোলে নিতে হাত বাড়ালেন। ফারজাহ ও তাহমিনার কোলে ঝাঁপিয়ে পরল।
” ও চলে আসবে , মা। তুই ততক্ষণ আমার সঙ্গে গল্প কর। তুই কেমন আছিস, তোর সংসার জীবন কেমন যাচ্ছে সেটা বল ? তোর শ্বশুর বাড়ির সবাই কেমন সেটা বল আমাকে। তারা তোকে আদর করে? ”
তাহমিনা আক্তারের কথা শুনে লজ্জা পেল তমা। লাজুক হেসে বলল,

” আমি খুব ভালো আছি , খালামণি। ও বাড়ির সবাই ভিষণ ভালো । সবাই আমাকে ভালোবাসে। বাবা-মা তো আমাকে ছাড়া কিছুই বোঝে না। ”
” আর ফারদিন ? সে কেমন ? ওর সঙ্গে কথা বলিস তুই ? ফারদিন কথা বলে তোর সঙ্গে? ” তাহমিনা আক্তার খুব সাবধানে জিজ্ঞেস করলেন।
খালামণির প্রশ্নে চমকায় তমা । এই প্রশ্নের জবাব দিতে একটু ইতস্তত বোধ করল। তারপরও মৃদুস্বরে বলল,
” উনিও খুব ভালো মানুষ , খালামণি। তিনি বাসায় যতক্ষণ থাকেন , ততক্ষণই আমার সঙ্গে কথা বলেন । আমার প্রয়োজনীয় সকল কিছু না চাইতেই এনে দেন তিনি। কখনো আমার সঙ্গে রাগ করে কথা বলেন না উনি। অথচ আমি রেগে যাওয়ার মত কাজ করি। আমার ভুলভাল কাজ দেখলে উনি শুধু হাসেন। ”

তমার কথা শুনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লেন তাহমিনা আক্তার। তিনি মনেপ্রাণে চান তমা ফারদিনকে মেনে নিক।
” কি ভুলভাল কাজ করিস শুনি ? তুই না আমার লক্ষ্মী মেয়ে। তুইও আবার ভুলভাল কাজ করিস! ”
” মাঝেমধ্যে করিই তো । এই যেমন গতকাল উনার টি-শার্ট ক্যালেণ্ডার করতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছি। উনি সেটা দেখে হাসলেন। কিছুই বললেন না। তারপর আরেক দিন উনার একটা প্রয়োজনীয় কাগজ ডাস্টবিনে রেখে দিয়েছিলাম। পরে উনি সেটা দেখতে পেয়ে ডাস্টবিন থেকে তুলে নিলেন। তখনও আমাকে একটুও বকা দেননি। এরকম অনেক ভুলভাল কাজই করি। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫১

” মা গো , প্রথম প্রথম সংসার জীবনে এরকম অনেক ভুলই হয়। তবে ধীরে ধীরে ভুলগুলোকে শুধরে নিতে হয়। শ্বশুর বাড়ির মানুষদের মন জুগিয়ে চলতে হয়। তবে আমি জানি, তুই চেষ্টা করলেই সবার মন জোগাতে পারবি। কারন তুই মানুষটাই বড্ড আদুরে। শোন , ফারদিন বাসায় থাকলে তুই ওর আশেপাশে থাকার চেষ্টা করবি । ও যখন যেটা প্রয়োজন সেগুলো দেয়ার চেষ্টা করবি । ও কি খেতে পছন্দ করে জেনে নিয়ে, সেগুলো রান্না করবি। শ্বশুর-শ্বাশুড়ির পছন্দের খাবার রান্না করবি। তাদের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলবি। বুঝেছিস আমার কথা? ”
” বুঝেছি , খালামণি। ”
” এবার আমার সঙ্গে আয় । কুহু তোদের জন্য শপিং করেছে সেগুলো দেখবি। ”

সিন্ধুতে সন্ধির খোঁজে পর্ব ৫৩

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here