আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৯ (৩)

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৯ (৩)
অরাত্রিকা রহমান

যথারীতি কলেজ শেষ করে মাহির নিজের বাড়িতে পৌঁছালো। আজ তার সম্পূর্ণ সময়টা কলেজে একদম ঝিমিয়ে কেটেছে। ক্লাস করানোতে বা অফিসিয়াল কোন কাজে তার মন ছিল না। এমন কি দুপুরের খাওয়ার সময় কিছু মুখেও দেয় নি।
বাড়ি ফিরতেই নিচে মা- সীমা খান এর সাথে মুখোমুখি হয় মাহির।
ছেলে কে এমন বিধ্বস্ত প্রায় দেখতে লাগছে বলে সীমা খান মাহির কে প্রশ্ন করলেন-
“মাহির কি হয়েছে এমন কেন দেখতে লাগছে তোকে?”

মাহির পায়ের থেকে নিজের জুতা গুলো খুলছিল তখন। মায়ের প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না। নিজের মতো জুতা গুলো খুলে সাইড টেবিলের উপর রাখা পানির গ্লাসটা তুলে নিজের তৃষ্ণা মিটিয়ে নিল। সীমা খান শুধু তাকিয়ে দেখছেন ছেলের অদ্ভুত আচরণ গুলো- মাহির কখনো বাড়িতে ফিরে এমন চুপচাপ থাকে না বরং আরো বেশি কথা বলে মাকে বিরক্ত করে তোলে। হঠাৎ এমন চুপচাপ হয়ে যাওয়াতে সীমা খান ভালোই বুঝতে পারছেন মাহিরের কিছু হয়েছে। কিন্তু বলতে না চাইলে কি আর জোর করে বলানো সম্ভব?
মাহির নিজের মতো তার ঘরে চলে যেতে যেতে বললো-
“খেয়ে এসেছি অনেক। রাতে আর খেতে হবে না আমার সুতরাং ডিনার করতে আমাকে ডেকো না আম্মু কাজ শেষ করে ঘুমিয়ে পড়বো আমি।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নিজের কথা শেষ করে ঘরে চলে গেলো মায়ের উত্তর না শুনেই। সীমা খান চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন। ছেলের এমন রূপ আগে কখনো তিনি দেখেন নি তাই একটু অবাক হয়ে বিড়বিড় করলেন-
“বাড়িতে আসলেই যে ছেলের মুখে খৈ ফুঁটতে থাকে আজ একটা কথাও বলতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না, ব্যাপার কি?”
মাহির ঘরে ঢুকে গোসল করতে চলে গেল। প্রায় ৩০ মিনিট পর ফ্রেশ হয়ে বের হলো মাহির। বিছানায় বসলো , হালকা গা এলিয়ে দিয়ে মন আনচান করছে তা সে বুঝতে পারছে, সোরায়ার জন্য- সেটাও বুঝতে পারছে। শুধু মনে এক প্রশ্ন খেলা করছে-“কেন এমন হচ্ছে!”
মাহিরের হঠাৎ সোরায়াকে খুব দেখতে ইচ্ছে করাতে সে নিজের ফোন বের সোরায়ার নবীনবরণ এর ছবি বের করলো। আলাদা তার সাথে তোলা এমন নয়। একাদশ শ্রেণির সবার সাথে দলবদ্ধ ছবি টা আছে তার কাছে। মাহির সোরায়ার মুখটাতেই শুধু ফোকাস করে জুম করলো।

সোরায়ার চেহারাটা সামনে আসতেই মাহির এর মুখে হালকা মুচকি হাঁসি ফুটে উঠলো ছবিতে সোরায়ার হাঁসি মুখ দেখেই। মাহির নিজের কাজের কোনো মানে খুঁজে পাচ্ছে না সেটা আরো অস্থির করছে তাকে- “মাহির তুই কেন করছিস এগুলো এসব এর কি মানে দাঁড়ায় তুই বুঝিস? মেয়েটা ছোট আর তার থেকেও বড় কথা তোর ছাত্রী। যেই পথে পা বাড়াচ্ছিস সেটার মূল্য চুকাতে হবে নিজের শিক্ষকতার সম্মান বিসর্জন দিয়ে।”
যেই এক মনে মাহির এসব চিন্তা করছে ঠিক তেমনি অন্যদিক ও চিন্তা করছে-“বয়স দিয়ে কি এমন হয়। আমি যথেষ্ট সুদর্শন। আর ছাত্রী কি কখনো পাত্রী হয় না কারো? তাহলে, আমার ছাত্রী কে আমার পাত্রী করলে কার পিছনে আগুন লাগবে? লাগবে না শিক্ষকতা আমার, যা আছে তা যথেষ্ট বিজনেসের পাশাপাশি করি শিক্ষকতা সেটা আমার মূল পেশা তো নয়।”

মাহির নিজের মনের দ্বন্দ্ব তেই ফেসে আছে। এর মাঝেই মাথায় এলো সোরায়া তো তার সাথে এ্যাড আছে যদিও জুঁই বলেছে সোরায়া আইডি ডি অ্যাক্টিভ করে দিয়েছে তবুও একবার চেক করতে ক্ষতি কোথায়। মাহির সোরায়ার আইডি খুঁজেতে থাকলো কিন্তু ফেল না তার ফ্রেন্ড লিস্টে বা ফোলোয়িং লিস্টে। মাহির বুঝতে পেরেছে সোরায়া তাকে সেদিনের পরই সব জায়গা থেকে আলাদা করেছে। মাহির এবার ইনস্টাগ্রামে মেসেজ সেকশন এ গিয়ে সোরায়ার করা আগের মেসেজ গুলো পড়তে থাকলো। ওই গুলো পড়েই তার বেশ শান্তি অনুভব হতে থাকলো। কিন্তু এক পর্যায়ে সেগুলো পড়া শেষ হয়ে গেলে আবারো মন বেজার কে ফেলে। তখনি তার মনে হলো সোরায়া হয়তো মেসেঞ্জারেও মেসেজ করে থাকতে পারে। তাই একটু আশার আলো জ্বলে উঠতেই মাহির মেসেঞ্জার ওপেন করে সোরায়ার আইডি খুঁজে বের করতেই দেখলো প্রায় ৭ টার মতো মেসেজ কিন্তু ভেসে ছিল “‘Jannatul deleted a massage” যার মানে মেসেজ করে সেটা ডিলিট বা আন-সেন্ড করা হয়েছে আবার। মাহির হাঁফ ছাড়লো এই ভেবে এখন সোরায়া কি পাঠিয়েছিল পড়তে পারবে না‌। তবে সে তাও ক্লিক করলো সোরায়ার আইডিতে।
মেসেঞ্জার এর ভিতরে ঢুকার পর দেখলো সব মেসেজ ডিলিট করা শুধু একটা মেসেজ ডিলিট করা হয়নি। মাহির উৎসাহ নিয়ে মেসেজ টা পড়তেই তার চোখ জলজল করতে শুরু করলো, ওমনি কিছু সোরায়া লিখবে তার জন্য সেটা মাহির আশাই করে নি। মেসেজটা কিছুটা এমন ছিল-

“”প্রথম দেখাতে আমি প্রেমে পরেছি আপনার। আপনাকে ছাড়া কিছুই ভালো লাগে না এখন। কলেজ দুইদিন বন্ধ যাবে কিভাবে থাকবো এই দুইদিন কে জানে। আমি জানি আপনি ম্যাসেজটা দেখছেন না হয়তো দেখবেনও না। তাই বলছি। আমি সত্যিই খুব করে প্রেমে পড়ে গিয়েছি স্যার।”
সোরায়া নিজের মনের কথাটা মাহির কে জানিয়ে মেসেজটা করেছিল। মাহির সোরায়া তাকে ভালোবাসে এটা জেনে ঠিক যতটা রেগে যেত আগে দেখলে এখন তার থেকে অনেক গুন তার খুশি লাগছে। মাহির হালকা পুনরাবৃত্তি করলো তার মাথায় রেখে থাকা কথাটা-

“আমি সত্যিই খুব করে প্রেমে পড়ে গিয়েছি স্যার।”
শরীরে হঠাৎ কারেন্টের গতি উপলব্ধি হলো মাহিরের। চারপাশের সবকিছু যেন হঠাৎ সুন্দর হয়ে উঠলো। মাহির দাঁড়িয়ে পায়চারি করতে করতে বিলাপ শুরু করলো-
“সোরায়া আমার প্রেমে পড়েছিল, ও আমাকে ভালোবাসে, আমাকে ভালোবাসে। এখন আমি কি করবো? কি বলবো? রিজেক্ট করবো? না এ্যাকসেপ্ট করবো?”
মাহির আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে একটু থমকে নিজের দিকে তাকিয়ে নখ কাটছে মুখ দিয়ে (ছোট বেলার অভ্যাস- এটা অতিরিক্ত খুশি বা অতিরিক্ত কোনো আবেগ কাজ করলে মাহির করে)।
মাহির বুঝতে পারছে না এটা কেমন অনুভূতি হচ্ছে তার। মাহির আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে প্রশ্ন করলো-
“মাহির তুই ও কি সোরায়ার প্রেমে পড়েছিস?”

মাহির আচমকা স্তব্ধ হয়ে রইল। মনের ভিতরের অনুভূতি সব যেন তাকে জাঁকিয়ে বলছে- “হ্যাঁ, হ্যাঁ, হ্যাঁ!”
মাহির হালকা মুচকি হাসলো এবার যেন মনটা হালকা লাগছে একটু। আসলে মন কি চায় তা বুঝে উঠা কঠিন কিন্তু বুঝে গেলে খুব যে সুখ দেয় এমন না। মাহিরের হঠাৎ চিন্তা শুরু হলো এবার কিভাবে সোরায়ার সাথে যোগাযোগ করবে সব রাস্তা তো বন্ধ। মাহির তারপর নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল-
“মাহির ছিল কর। কলেজে তো আসবেই তখন এসব মেসেজ এর মানে আর ফলাফল তাকে বুঝিয়ে বলিস।”
মাহির তার সাইট টেবিলের উপর রাখা ল্যাম্প টার দিকে তাকিয়ে বলল- “আজকে এই টা একটু বেশি জলজল করছে।”

আবার এসির দিকে তাকিয়ে বলল-“এসিটাও অনেক শান্তির হাওয়া দিচ্ছে।”
সবকিছুই যেন ভালো লাগছে যার কোনো মানে নাই সেটাও সুন্দর লাগছে এটাই হয়তো প্রেমে পড়ার অন্যতম লক্ষণ। চারপাশের সব রঙিন লাগে অথচ এর পরের মাঝে হাজারো ঝড় তুফান আছে যার জন্যই এই আগাম নীরবতা- যেটা মানুষ বুঝতে অক্ষম।
মাহির বিছানা থেকে উঠে একটু ফেলতে ফেলতে চেচালো-
“আম্মু খুদা পেয়েছে খেতে দেও না।”
সীমা খান ছেলের উল্টো সুর দেখে নিচের থেকে চেচালেন-
“তুই না খেয়ে এসেছিস? তাই সব ফ্রিজে রেখে দিয়েছি। এখন ঠান্ডা না খেলে গরম করে খা। আমি ঘরে গেলাম।”
মাহির আর কিছু বলল না। মনটা ফুরফুরে লাগছে তার এখন কাজ করে খেতেও সমস্যা নেই।

চট্টগ্রামে~
রহমান বাড়ির সামনে গিয়ে রুদ্রর গাড়ি থামলো। রুদ্র সোরায়া দুইজনেই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ালো। রুদ্র সোরায়ার লাগেজটা গাড়ির ডিকি থেকে বের করে নিয়ে একসাথে বাড়ির দরজার সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজলো। কিছু সময়ের মধ্যেই রোকেয়া বেগম এসে দরজা খুললেন। সোরায়াকে এতো দিন পর সামনা সামনি দেখেই তার চোখে পানি ছলছল করতে লাগলো। সোরায়া দুঃখী থাকলেও এত দিন পড় চাচি কে দেখে সে খুব খুশি।
সোরায়া চাচি কে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরে-“চাচিইইই…? তোমার ছোট্ট বুড়ি চলে এসেছে। আই মিস’ড ইউ সো মাচ। কেমন আছো তুমি?”
রোকেয়া বেগম চোখের পানিটা মুছে বললেন-“ভালো আছি রে মা, তোদের ছাড়া যতটুকু ভালো থাকা যায় ততটুকুই। তুই ঠিক আছিস তো?”

সোরায়া রোকেয়া বেগম কে জড়ানো থেকে ছাড়া দিয়ে বলল-
“কান্না করলে কিন্তু খেলবো না বলে দিলাম চাচি। হাসো না… তুমি কি খুশি হওনি আমি ফিরেছি বলে?”
রোকেয়া বেগম হেঁসে বললেন-“দেখি তো আমার ছোট্ট বুড়ি টাকে কতদিন দেখি না মন ভরে।”
রুদ্র পিছন থেকে ব্যাগ ধরে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বলল-
“সে না হয় তোমার ছোট্ট বুড়িকে দেখো মন ভরে আমি যাওয়ার পর। আপাতত আমাকে ভিতরে আসতে দাও ব্যাগটা রাখতে হবে তো।”

রোকেয়া বেগম সাথে সাথে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে বললেন-
“আরে আমার ছোট বাবা দেখি, খেয়ালই করি নি আমি। কেমন আছো ছোটবাপজান?”
রুদ্র হেঁসে বলল-“উফ্! খালামণি,তোমার এই ডাকাটাই আমার শুনতে মন চায় শুধু। আমাকে ট্যাপ রেকর্ড করে দিয়ে দিও তো। আমি বরাবরের মতই বিন্দাস আছি।”
রোকেয়া বেগম রুদ্র কে ঢোকার জন্য জায়গা করে দিয়ে বললেন-
“এসো ভিতরে এসো।”
রুদ্র সোরায়ার লাগেজ টা নিয়ে ভিতরে ঢুকতেই জিজ্ঞেস করলো- “খালামনি খালু কোথায় দেখছি না যে?”
রোকেয়া বেগম সোরায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন –

“খালু তোমার বাড়ি নেই। ছোট মেয়ের পছন্দের মাছ মাংস কিনতে গেছেন। তার যত রাগ সব দূরে থাকলে। দুটো মেয়ের মধ্যে একটা কেউ সামনা সামনি দেখলে সাথে সাথে ঘরে পানি। এই দেখ না মেয়ে আসবে বলে বাজারে গেছে কি খাবে সে সব আনতে। তুমি বসো আমি কি নিয়ে আসি।”
সোরায়া দুষ্টু হাসলো চাচা তার জন্য বাজার করতে গেছে শুনে। রুদ্র রোকেয়া বেগমের কথায় হেসে বলল-
“খালামনি প্লিজ রাগ করো না‌ কিন্তু আজকে সত্যি আমার পক্ষে আর চট্টগ্রামে স্টে করা সম্ভব না। ঢাকায় অনেক কাজ আছে অফিস এর মনেমনে (রিমিকে ও তো বাড়িতে পৌঁছে দিতে হবে)। খালামনি তুমি খালু কে বুঝিয়ে বলো কেমন আমি বরং আবার রওনা দেই না হলে দেরি হয়ে যাবে।”
রোকেয়া বেগম রুদ্র কে কয়েক বার বললেন একটু সময় থাকতে কিন্তু কিসের কি‌ রুদ্র রোকেয়া বেগমের কথা না শুনে কোনো রকম বিদায় নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেয়।

বিকেল ৪টা~
রুদ্র ঢাকায় এসে সোজা যথা রীতি রিমির সাথে দেখা করতে তার কাজের জায়গায় গেছে কিন্তু রিমি কে দেখতে পেলো না।‌ রিমির জায়গায় অন্য একটা মেয়ে বসে গান করছে। রুদ্র একটু অবাক হলো। রিমি আসেনি কেন আর তার জায়গায় অন্য কেউ কেন বসে আছে সেটা জানতে রিসেপশে গিয়ে রুদ্র রিসেপশনিস্ট কে জিজ্ঞেস করলো-
“এক্সকিউজ মি!”
রিসেপশনিস্ট- ” ইয়েস স্যার, কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
রুদ্র স্বাভাবিক ভাবে অন্য মেয়েটার দিকে আঙুল তুলে বললো-“ওখানে আগে অন্য একটা মেয়ে বসে গান করতো, তাই না। আজকে কি সেই মেয়ে টা আসে নি?”
রিসেপশনিস্ট হালকা হেসে বিনয়ের সাথে জবাব দিলো-“জ্বি না স্যার। ওই আপু টা আমাদের কে আজকেই ইনফর্ম করেছেন তিনি আর আসতে পারবেন না এখানে ব্যক্তিগত কিছু সমস্যার কারণে।”

রিসেপশনিস্ট এর কাছে রিমির কাজ ছেড়ে দেওয়া আর ব্যক্তিগত সমস্যার কথাটা উঠতেই রুদ্র মূহুর্তে চুপ হয়ে গেল। মনে উথালপাথাল শুরু হলো রিসেপশনিস্ট মেয়েটা বলল-” স্যার আপনাকে আর কিভাবে সাহায্য করতে পারি?”
রুদ্র জ্ঞানে ফিরে বলল-“না না আর কিছু না। ধন্যবাদ।”
রিসেপশনেস্ট মেয়েটা নিজের কাজে মন দিল পুনরায়। রুদ্র ক্যাফে থেকে বের হয়ে এসে নিজে গাড়ির সামনে এসে থামলো। রুদ্র গায়ের উপর এক হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে ভাবল-“হঠাৎ কি এমন ব্যক্তিগত সমস্যায় পড়লেন উনি যে নিজের পছন্দের কাজটা ছেড়ে দিতে হলো? আচ্ছা ওনার ভাই আবার বাড়াবাড়ি করেনি তো? উফ্ কি করবো আমি এখন? আমি কি ওনাকে কল করব? নাকি কল করার থেকে ভালো ওনার বাড়িতে চলে যাই। না না একজনের বাড়িতে এভাবে যাওয়া যায় না আমি বরং একটা কলই করি।”

রুদ্র নিজের ফোনটা বের করে রিমির নাম্বারে কল করলো। কিন্তু রিমির নাম্বারে কল ঢুকছে না। রুদ্র পর পর অনেকবার
কল করার চেষ্টা করল কিন্তু কিছুতেই কল যাচ্ছে না। মনে আরো এক অদ্ভুত চিন্তা ঢুকে রাজত্ব শুরু করল- “রিমির নাম্বার টা অফ কেন?”
রুদ্র অতিরিক্ত টেনশন নিতে পারছিলো না বলে সোজা রিমির বাড়িতেই গিয়ে উপস্থিত হয়। চারপাশটা একটু অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে এসেছে এমনিতেই বেলা শেষ তার উপর দিয়ে একটা লাইট ও নেই সেখানে। রুদ্র নিজের ফোনের টর্চ লাইট টা জ্বালিয়ে ধীরে ধীরে এগোতে লাগলো।

-“রিমি? রিমি? আমি রুদ্র! বাইরে আসবেন একটু?”
রুদ্র রিমিকে ডাকতে লাগলো। কিন্তু কোনো আওয়াজ নেই রিমির। রুদ্র রিমির বাড়ির দরজার সামনে এগিয়ে গিয়ে ফোনের টর্চ লাইট টা তাক করতেই দেখলো বাড়ির সামনে তালা ঝুলছে।
এই মুহূর্তে রুদ্রর কেমন অনুভব হওয়া উচিত বা কি করা উচিত তার জানা নেই। রিমি হঠাৎ কাজ ছেড়ে দিয়ে ফোন অফ করে বাড়ি ছেড়ে কোথায় যাবে আর কেনই বা যাবে রুদ্রর মাথায় কিছুই ধরছে না। উপায়ান্তর না দেখে রুদ্র গাড়ির দিকে ফিরে যায়, এবং এক নজর রিমির বাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল বিরহে-“রিমি আপনি কোথায়? আমাকে একবার জানিয়ে গেলেন না কেন? কি সমস্যা হয়েছে সেটা একবার বলতেন আমাকে। আমি আপ্রাণ চেষ্টা করতাম আপনাকে সেই সমস্যা থেকে বের করে আনার। কেন এমন করে চলে গেলেন আপনি?”

চৌধুরী বাড়ি ~
রাত প্রায় ১০টা। মিরায়া চুপচাপ ড্রয়িং রুমে বসে নিজের ফোনটা ঘাটছে। স্ক্রিনে রায়ানের ফেইসবুক আইডি। আজ সারা দিনে রায়ান একবার ও মিরায়াকে কল করে নি, মেসেজ ও করে নি। মিরায়ার মেসেজ এর রিপ্লাই ও করে নি। মিস’ড কল দেখেও কল ব্যাক করেনি।
জুলিয়েট তার কোলে বসে আছে আর রামিলা চৌধুরী রান্নাঘরে। মিরায়া রামিলা চৌধুরী কে প্রশ্ন করলো স্বাভাবিক গলায়-“ওও মামণি, তোমার গুনধর ছেলে কি তোমাকে কল করেছিল ?”
রামিলা চৌধুরী ভাবলেন মিরায়া রুদ্রর কথা বলছে যেহেতু সোরায়াকে রুদ্র দিতে যাওয়ার পর পৌঁছে দিয়ে একবার ও কল করে নি বরং সোরায়াই কল করে জানিয়েছে। রামিলা চৌধুরী হেঁসে বললেন-“রুদ্র সোরায়াকে পৌঁছে দিয়ে কল করেনি তাই এমন বলছিস তাই তো?”

মিরায়া একটু ভাবলো এখন কি ভুল ভাঙিয়ে রায়ানের কথা জিজ্ঞেস করা ঠিক হবে? যদি কথাটা অন্যভাবে শোনায় তাহলে তো ভালো মারা খাবো একটা। মিরায়া রামিলা চৌধুরীর কথায় না চাইতেও সম্মতি দিয়ে বলল-
“হ্যাঁ হ্যাঁ রুদ্র ভাইয়ের কথাই তো বলছি আর কার কথা বলব?”
ঠিক তখনি বেজার মুখে বাড়িতে প্রবেশ করলো রুদ্র তার হাতে পরনের কোর্টটা অবহেলিত হয়ে ঝুলছে। মিরায়া রুদ্রকে বাড়িতে দেখেই জিজ্ঞেস করল-
“আচ্ছা ভাইয়া তোমার কি কখনো দায়িত্ববোধ বলতে কিছু হবে না? বনুকে চট্টগ্রামে পৌঁছে দিয়ে একটা কল করে জানাতে তো পারতে নাকি।”
রুদ্র কিছু বলল না মিরায়া তাকে কি বললো তাও শুনতে পেয়েছে কিনা বোঝা দ্বায়। মিরায়া আশ্চর্য হয়ে রুদ্র কে উপরে যেতে দেখতে থাকলো আর বললো-

“যা বাবা, কাকে কি বললাম? কোন রিএকশনই নেই!”
রামিলা চৌধুরী যেন মিরায়া তার কথা শুনতে পায় এমন ভাবে
রান্নাঘর থেকে হালকা উচু গলায় বললেন-
“আহ্ রে! তোকে তো পাত্তা দিলো নারে মিরা। ওর কি হয়েছে রে? এমন করলো কেন?”
মিরায়া রামিলা চৌধুরীর কথার উত্তর দিতে বলল-
“আমি কিভাবে বলবো কি হয়েছে। মুখটা বাংলার পাঁচ বানিয়ে রেখেছে।”
রামেলা চৌধুরী মিরার কথায় হালকা হাসলেন রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে। মিরায়া সোফার উপর জুলিয়েট কি কোলে তুলে নিজের ঘরে যেতে যেতে বিড়বিড় করল বিরক্তিতে-
“পাত্তা তো আমাকে তোমার বড় ছেলেও দিচ্ছে না মামণি। ভাব দেখলে মনে হয় গা জ্বলে যায়। সারা দিনে একবার ও সময় হয়নি বুঝি আমাকে কল করার।”
মিরায়া নিজের মনে কথা বলতে বলতে ঘরে চলে গেল।

রাত গভীর হলে সবাই একসাথে খেয়ে নিয়ে যায় যার ঘরে চলে গেছিল। ডিনার টেবিলে রুদ্র একই রকম চিন্তায় মগ্ন বেজার মুখে বসেছিল। কিছু খেয়েছে তো কিছু খায়নি এমন অবস্থা। অন্যদিকে মিরায়া ও তেমন খায়নি। মন মেজাজ রায়ানের সাথে কথা না হওয়ায় এমনিতেই খারাপ।
মিরায়া তার ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছে। কালকে তার জীবনের অনেক বড় একটা দিন। সে প্রথম বারের মতো প্রফেশনাল রাইডার হিসেবে রেস করতে যাচ্ছে। আবার একটু চিন্তা ও হচ্ছে রায়ান যখন জানতে পারবে যে মিরায়া বাইক রাইড করে তখন তার রিএকশনটা কেমন হবে।
মিরায়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নীজেকে উদ্দেশ্যে করে বলল-
“মিরা, তুই যে ভেবে রেখেছিস রায়ানকে তোর আসল পরিচয় বলবি, যদি উনি তোর মেয়ে হয়ে বাইক রাইড করাটা পছন্দ না করেন? তাহলে কি হবে?”

মিরায়া নিজের মনে হাজরবার এক কথায় চিন্তা করছিল রেসের সময়টুকু যদি আত্মপরিচয় গোপনও করতে চাই তাহলে সেটা কিভাবে সম্ভব আর যদি গোপন না রাখে তাহলে তার পরিণতি কি হবে? যত বেশি ভাবছে সবকিছু যেন তো বেশি আরো কঠিন হয়ে ধরা দিচ্ছিল তার কাছে।
মিরায়া অবশেষে নিজেকে জবাব দিল-
“কেন লুকোতে হবে আমার উনার কাছে আমার বাইক রাইড করার বিষয়টা উনিও তো রাইড করে। কারো চোখে ভালো থাকার জন্য আমি মিরায়া রহমান কখনো নিজের ব্যক্তিত্ব নষ্ট করবো না। তাছাড়া আমার কিসের ভয়, কিই বা করবেন উনি বড় জোর সবাইকে জানিয়ে দেবেন বা আমাকে অপছন্দ করবেন এখানে আমাকে করার থাকতে পারে। আমি তাকে আমাকে পছন্দ করতে বাধ্য করতে পারিনা।”

মিরায়া খুব ভেবে সিদ্ধান্তে পৌঁছালো-” আমি অনেক সত্যিটা বলবো আমার পরিচয়, আমি কি করতে পছন্দ করি, সব। এমনি তো একটা মানুষকে পছন্দ করলে তার খারাপ, ভালো, ভুল, ত্রুটি সবকিছু নিয়ে পছন্দ করতে হয়। কাউকে নিজের মত করে নেওয়া যতই ঠিক হক না কেন, কাউকে তার মত করেই স্বীকার করা তার চেয়ে অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য।”

মিরায়া একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বারান্দা থেকে ঘরে এসে বিছানার উপরে শুয়ে পড়ল। ঘুমানোর আগে ফোনটা আরেকবার চেক করলো কিন্তু কিছুই নেই। রায়ান এখন পর্যন্ত তাকে একবারও মেসেজ করেনি আর তার পাঠানো মেসেজগুলো সিন ও করেনি। মিরায়া আর কিছু ভাবতে পারলো না শুধু মনকে সামলালো এই বলে-
“হয়তো ব্যস্ত আছেন উনি। ঠিক মতো কাজটা শেষ করে ফিরে আসুক তাহলেই হয়।”
মিরায়া এর পর কিছু সময়ের মাঝেই ঘুমিয়ে পড়লো।

আমেরিকা~
রায়ান তীব্র ব্যস্ততার মাঝে দুপুরের খাবার পর্যন্ত খেতে পারেনি। এখনো ঠায় নিজের চেয়ারে বসে ল্যাপটপের ওপর দুই চোখ গেঁথে কাজ করে যাচ্ছে। বিকেল শেষে সন্ধ্যা হয়ে এসেছে আর কিছুক্ষণ পরেই মেইন ডিনার প্রোগ্রাম যেখানে ডিল ক্লোজিং করা হবে। নিজের প্রেজেন্টেশন নিয়ে রায়ান বরাবরই বেশ সতর্ক থাকে। তার বিজনেস প্রপোজাল, তার প্রেজেন্টেশন যেন তার ক্লায়েন্টদের “রায়ান ইন্ডাস্ট্রিজ” কে চুজ করতে বাধ্য করে এমন ভাবেই নিজেকে তৈরি করে সে।
কাজের তৎপরতায় সময় জ্ঞান হারিয়েছে সেই সকাল থেকে নিজের ফোনটা একবারও খুলে দেখেনি। খুলে দেখলে হয়তো মিরায়ার মেসেজ ও কলস গুলো চোখে পড়তো। আর তখন হাজারো ব্যস্ততার মাঝেও রায়ান ঠিক সময় করে নিতো তার হৃদপাখির জন্য।

রাত ঠিক আটটা।
D’mont International Hotel (ডি’মন্ট ইন্টারন্যাশনাল হোটেল)-এর পাঁচতলার বিশাল কনফারেন্স ডাইনিং রুমে আলো কমিয়ে দেওয়া হয়েছে, চারপাশে নরম মিউজিক বাজছে। টেবিলের এক পাশে বসে আছেন বিদেশি ডেলিগেট টিম —
Mr. Anderson, Mr. Felix, Ms. Clara —
তারা সবাই ইউরোপের “Aster Global Investments” (অ্যাস্টার গ্লোবাল ইনভেস্টমেন্টস)-এর প্রতিনিধি।
অন্য পাশে রায়ান, নওরিন, আনিস এবং তাদের লিগ্যাল টিম।
রায়ান পরেছে গাঢ় চারকোল কালারের স্যুট, টাইটা নিখুঁতভাবে বাঁধা। তার চোখে সেই আগের মতোই এক ধরনের দৃঢ়তা — যেন সাফল্যের আগুন ভিতরে জ্বলছে। ওয়েটাররা নরমভাবে গ্লাসে জুস পরিবেশন করছে, আলো ঝলমলে ঘরটা শান্ত অথচ তীব্র উত্তেজনায় ভরপুর।
রায়ান ভদ্রভাবে হালকা হাসি দিয়ে বলল —
— “Good evening, ladies and gentlemen. Thank you for being here.”
(গুড ইভনিং, লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন। থ্যাঙ্ক ইউ ফর বিং হিয়ার।)
Mr. Anderson মাথা নেড়ে বললেন —
— “Pleasure is ours, Mr. Rayan. We’ve heard a lot about your company’s precision and success.”

(প্লেজার ইজ আওয়ার্স, মি. রায়ান। উইভ হিয়ার্ড আ লট অ্যাবাউট ইয়োর কোম্পানিস প্রিসিশন অ্যান্ড সাকসেস।)
রায়ান আত্মবিশ্বাসী গলায় জবাব দিল —
— “We believe in building more than properties. We build trust.”
(উই বিলিভ ইন বিল্ডিং মোর দ্যান প্রপার্টিজ। উই বিল্ড ট্রাস্ট।)
সবাই হাসল, একটা পেশাদার কিন্তু আন্তরিক পরিবেশ তৈরি হলো।
প্রজেক্টর অন হলো — স্ক্রিনে ধীরে ধীরে ভেসে উঠল “SunVale Heights – Vision 2030” (সানভেল হাইটস – ভিশন টুয়েন্টি থার্টি)।
নরম ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের সঙ্গে সঙ্গে প্রজেকশন শুরু হলো —
সবুজ ল্যান্ডস্কেপ, আধুনিক রেসিডেন্সিয়াল টাওয়ার, রোবটিক সিকিউরিটি সিস্টেম,
এবং একটা হোলোগ্রাফিক ভিডিও যেখানে লেখা —
“The Future of Sustainable Living.”
(দ্য ফিউচার অফ সাসটেইনেবল লিভিং)।
রায়ান সামনে এগিয়ে গিয়ে উপস্থাপন শুরু করল —

— “SunVale Heights is not just another township; it’s a living innovation.
Four hundred acres of green architecture — powered by the sun, connected by technology, and sustained by community.”
(সানভেল হাইটস ইজ নট জাস্ট অ্যানাদার টাউনশিপ; ইটস আ লিভিং ইনোভেশন।
ফোর হান্ড্রেড একরস অফ গ্রিন আর্কিটেকচার — পাওয়ার্ড বাই দা সান, কানেক্টেড বাই টেকনোলজি, অ্যান্ড সাসটেইনড বাই কমিউনিটি।)
তার কণ্ঠে আত্মবিশ্বাস, চোখে ঝিলিক। প্রতিটি শব্দ যেন ঘরে উপস্থিত সবার মনোযোগ টেনে নিচ্ছে।
Ms. Clara বললেন —
— “Impressive! But how do you plan to ensure the sustainability of this huge investment?”

(ইমপ্রেসিভ! বাট হাউ ডু ইউ প্ল্যান টু এনশিওর দা সাসটেইনেবিলিটি অফ দিস হিউজ ইনভেস্টমেন্ট?)
রায়ান তৎক্ষণাৎ স্ক্রিনে আরেকটি গ্রাফ তুলে ধরল —
Energy Efficiency Report & ROI Graph (2025–2030)
(এনার্জি এফিসিয়েন্সি রিপোর্ট অ্যান্ড আর ও আই গ্রাফ)।
সে ব্যাখ্যা করল —
— “Within five years, the revenue growth will reach 35%, with zero energy waste and full automation.
In short, this project will earn before it’s even complete.”
(উইদিন ফাইভ ইয়ার্স, দা রেভিনিউ গ্রোথ উইল রিচ থার্টি ফাইভ পারসেন্ট, উইথ জিরো এনার্জি ওয়েস্ট অ্যান্ড ফুল অটোমেশন।
ইন শর্ট, দিস প্রজেক্ট উইল আর্ন বিফোর ইটস ইভেন কমপ্লিট।)
Mr. Felix হালকা মাথা নেড়ে বললেন —

— “That’s ambitious… but I like it.”
(দ্যাটস অ্যাম্বিশাস… বাট আই লাইক ইট।)
রায়ান হাসল, আর বলল —
— “Ambition drives progress, Mr. Felix. And we’re not afraid to lead.”
(অ্যাম্বিশন ড্রাইভস প্রগ্রেস, মি. ফেলিক্স। অ্যান্ড উই আর নট অ্যাফ্রেইড টু লিড।)
ঘরে এক মুহূর্ত নিস্তব্ধতা — তারপর Mr. Anderson বললেন গম্ভীর কণ্ঠে —
— “Mr. Rayan, we’re ready to finalize this partnership.
Let’s sign the MOU.”
(মি. রায়ান, উই আর রেডি টু ফাইনালাইজ দিস পার্টনারশিপ। লেটস সাইন দা এম ও ইউ।)
রায়ানের বুকের ভেতর চাপা উত্তেজনা ফেটে পড়ল এক ঝলক গর্বে। সে দাঁড়িয়ে বলল —
— “It’s an honor to have your trust.”
(ইটস অ্যান অনার টু হ্যাভ ইয়োর ট্রাস্ট।)
টেবিলের ওপর রাখা চকচকে ফাইলে সই হলো —
একটা সিগনেচার, একটা ক্লিক, আর সাথে সাথে ফ্ল্যাশ লাইট — “Deal Closed. Project Phoenix – Confirmed.”
(ডিল ক্লোজড। প্রজেক্ট ফিনিক্স – কনফার্মড।)
রুমে মুহূর্তের মধ্যে করতালির শব্দে গর্জে উঠল।

নওরিনের চোখে জল টলমল করল, আনিস হালকা চিৎকার করে বলল —“We did it!” (উই ডিড ইট!)
রায়ান গভীর নিঃশ্বাস নিল, চোখ বন্ধ করল, মনে মনে বলল —“১৭০০ কোটি… শেষমেশ আমি পেরেছি। আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ অনেক অনেক শুকরিয়া তোমার।”
একটা সন্তুষ্ট হাসি তার ঠোঁটে ছড়িয়ে গেল,যেন পুরো পৃথিবী থেমে গেছে তার সাফল্যের সামনে। সবাই তাদের একে অপরের সাধুবাদ জানাতে লাগলো। সবাই রায়ানের সাথে হাত মেলাচ্ছে আর তাকে কংগ্রাচুলেট করছে। সাফল্যের আনন্দের ব্যাখ্যা হয় না এই মূহূর্তে রায়ান তা ভালোই বুঝতে পারছিল। তার খুশি লাগছিল কিন্তু প্রকাশ করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছে যেন।
ডিল ক্লোজিং এর পর সারা রাত পার্টি চলবে এমনটাই ধরা বাধা নিয়ম। রায়ান যেহেতু এই সময়ে সেখানকার মধ্য মণির হয়ে উঠেছে সুতরাং আর কিছুই করার নেই তার না চাইতেও সেখানে উপস্থিত থাকতে হতো নাহলে বিষয়টা দৃষ্টিকটু লাগতো।

বাংলাদেশ~
৩ তারিখ সকাল। চৌধুরী বাড়ির সকালটা যেন আগের মতোই শান্ত, নিয়মতান্ত্রিক আর পরিপাটি। সূর্যের আলো জানলার ফাঁক দিয়ে ডাইনিং রুমের কাঠের টেবিল জুড়ে পড়েছে। টেবিল সাজানো।
রায়হান চৌধুরী পত্রিকা খুলে বসেছেন টেবিলের মাথার দিকে। পাশে বসে আছে রুদ্র— হাতে কফির কাপ, চোখ মোবাইল স্ক্রিনে; অফিসে আজ বড় মিটিং, সেটার নোটস একবার যাচাই করছে।
রামিলা চৌধুরী হাসিমুখে প্লেট সার্ভ করছেন—

— “রুদ্র, নাস্তা শেষ করে যেন আজ তাড়াতাড়ি বের হো, তোর গাড়িটা সার্ভিসে দিতে হবে।”
রুদ্র হালকা গলায় বলল— “হ্যাঁ, জানি। আজ অফিসেও একটু আগে যেতে হবে।”
মিরায়া তখনও চুল বেঁধে, ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে এসে বসলো টেবিলে।
— “মামণি, আমি খেয়ে বের হবো। ক্লাসে আজ প্রজেক্ট সাবমিট। দুদিন যাই নি সেগুলোর নোটস ও নিতে হবে।”
— “এতো সকালে?”
— “হ্যাঁ মামণি, তাড়াতাড়ি যেতে হবে। আবার তাড়াতাড়ি চলে আসবো।”
খাওয়া শেষ হলে সবাই যার যার কাজে চলে গেলেন—
রুদ্র ও রায়হান গাড়ি নিয়ে “চৌধুরী গ্রুপ অফ কোম্পানিজ”-এর পথে, আর মিরায়া নিজের ব্যাগ কাঁধে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেল। গেটের কাছে এসে একবার পেছন ফিরে তাকাল সে। সূর্যের আলোয় সোনালি হয়ে আছে পুরো বাড়িটা। ঠোঁটে হালকা হাসি এনে বলল নিজেকে—
— “আজ দিনটা ভালো যাবে নিশ্চয়ই।”

ঢাবি ক্যাম্পাস~
সময় ১১.৩০ মিনিট। মিরায়া ধীরে ধীরে হাঁটছে ক্যাম্পাসের মাঝপথে। হাতে নিজের নোটস আর কিছু প্রজেক্ট ফাইল। আজ সে সব প্রজেক্ট জমা দিয়েছে— মাথায় আর কোনো চাপ নেই, অথচ মনটা কেন যেন ভারী লাগছে।
ফোনের স্ক্রিনে রিমির নাম বারবার দেখে কল দিচ্ছে, মনে মনে বলছে- “রিমি… উঠলি না নাকি এখনো তুই?”
তবে প্রতিবারই ফোনটা কেটে যাচ্ছে।

সে একটু নিঃশ্বাস ফেলল। চারপাশের কোলাহল থেকেও যেন একটা একাকীত্ব তার ভেতর ঢুকে গেল। দু’টো ক্লাস এখনো বাকি, কিন্তু তার আগে এই বিরতির সময়টা আজ ভীষণ দীর্ঘ লাগছে। হাঁটতে হাঁটতে মিরায়া মূল ফটক পার হয়ে সামনের রাস্তায় এল। ওখানেই রাস্তার একপাশে একটা ছোট্ট ফুলের দোকান। সামনে রঙিন ফুলের সারি— গোলাপ, রজনীগন্ধা, জুঁই, টিউলিপ, গাঁদা… সব মিলিয়ে রঙের এক উৎসব যেন।
মিরায়া দাঁড়িয়ে গেল। হাওয়ায় ভেসে আসা ফুলের গন্ধ তার চুলে, গালে লেগে যাচ্ছে। একটা ভেজা গোলাপের পাপড়ি স্পর্শ করল আঙুল দিয়ে— ঠান্ডা, নরম, জীবন্ত।
তার চোখ পড়ল একপাশে সাজানো একটা ফুলের তোড়ায়।
তোড়ার মাঝখানে টকটকে লাল গোলাপ, আর চারপাশে ধবধবে সাদা গোলাপে তৈরি এক বৃত্ত। রঙের কনট্রাস্টটা এমন নিখুঁত— যেন ভালোবাসা আর পবিত্রতার মেলবন্ধন।
মিরায়া তাকিয়ে থাকল। তার মুখে হালকা হাসি ফুটে উঠল, চোখে প্রশান্তির ঝিলিক। মিরায়াকে অনেক টা সময় ফুলের তোড়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিক্রেতা মিরায়াকে জিজ্ঞেস করল,

— “আপা, ফুল নিবেন?”
মিরায়া একটু হেসে মাথা নাড়ল- “হুম, আচ্ছা ওই ফুলের তোড়া টার দাম কত মামা?
বিক্রেতা- “আপ ওইটা তো ৫০০ টাকা পরবো।”
মিরায়া সামান্য একটা ফুলের তোড়ার এমন দাম শুনে একদম চোখ আকাশে তুলে ফেললো আশ্চর্য হয়ে- “কিহ্! কি বলেন মামা এগুলো। একটা ফুলের তোড়া তাও এতো ছোট সেটার দাম ৫০০ কিভাবে হয়?”
ফুল বিক্রেতা বলল-“আপা বাজার অনেক খারাপ বেচাকেনা নাই একদম চাষিরা দাম বাড়াই দিছে তাই আমাগোর ও কিছু করোনের নাই বুঝছেন।”
মিরায়া বলল-“সবই বুঝলাম মামা কিন্তু ৫০০ টাকা তো এই ফুলের তোড়ার জন্য আমি দিতে পারবো না কমান কিছু।”
ফুল বিক্রেতা-“তাইলে মামা আপনি কন কত টাকা দিবেন?”
মিরায়া সাথে সাথে বলল-“যেহেতু বাজারের অবস্থা ভালো না তাই ৩৫০ টাকা দিব। এটাও অনেক বেশি বলে ফেলেছি আসলে।”
ফুল বিক্রেতা-“না না মামা, কি কন এগুলা। এইটার দাম ৫০০ টাকাই রাখা যাইবো। কম হইবোই না।”
মিরায়াও তর্কাতর্কি শুরু করলো দামাদামি করতে গিয়ে।

পার্টি শেষে এখন রায়ান নিজের অফিসে। বাড়িতে ফেরেনি অফিস থেকেই সোজা এয়ার পোর্টে যাবে। তখন কাজ শেষ হওয়াতে আর এক মুহূর্তও মন টিকছে না এই বিদেশের মাটিতে। রায়ান তার ড্রাইভার কে বলেছে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র গুলো শুধু গুছিয়ে অফিসে নিয়ে আসতে।
এখন আমেরিকায় সময় রাত ১২.৩০ এর উপরে‌। রায়ান নিজের চেয়ারে বসে ফোনটা খুলল সারা দিন পর। সাথে সাথে ফোনের স্ক্রিনে মিরায়ার নাম্বার থেকে প্রায় পাঁচটার মত মিসড কল আর অনেকগুলো মেসেজ পেন্ডিং হয়েছিল। রায়ান দেখেই সোজা হয়ে বসে পরলো-
“হায় আল্লাহ! আমার তো ম তা তেই ছিল না যে মিরা কল করবে। উফ্! এখন কি করবো। নির্ঘাত রাগ করে আছে। অনেক ঝাড়ি খাবো এখন।”

রায়ান দ্রুত মিরায়াকে কল করলো। মিরায়া ফুল বিক্রেতার সাথে তর্কাতর্কিতে ব্যস্ত ছিল তখন। রায়ানের ফোন ঢুকতে তার ফোন বেজে উঠলো। রায়ানের কল দেখেই মিরায়া তর্ক থামিয়ে হাঁসি মুখে কলটা রিসিভ করে স্পিকারে দিল কিছু শুনতে পারছিলো না বলে।
মিরায়া কল রিসিভ করতেই রায়ান মিষ্টি সুরে বলল-
“হ্যালো জানপাখি?”
মিরায়া রায়ানের জবাবে দিবে তার মাঝেই ফুল বিক্রেতা মিরায়াকে প্রশ্ন করলো- “কি আপা! ফুল নিবেন না? কিছু কন।”

রায়ান অন্য কারো আওয়াজ পেলো পাশ থেকে। মিরায়া আবার ফুল বিক্রেতা কে বলল-“আরে মামা কিভাবে নিবে বলেন? ৩৫০ টাকার ফুল আপনি ৫০০ টাকা চাইছেন কেন?”
রায়ান তখন ওপাশ থেকে প্রশ্ন করলো-
“হৃদপাখি, এনি প্রবলেম? কি হয়েছে? চেঁচাচ্ছ কেন?”
মিরায়া ফোনটা কাছে নিয়ে রায়ানের কথার উত্তর দিল-
“আরে আর বলবেন না ক্যাম্পাসের সামনে ফুলের দোকানে একটা ফুলের তোড়া খুব পছন্দ হয়েছে দাম জিজ্ঞেস করাতে বলছে সেটার দাম নাকি ৫০০ টাকা। আপনি বলুন ৫০০ টাকার একটা ফুলের তোড়া হয়। মোটে ৮ টার মতো মনে হয় গোলাপ আছে ওটাতে। আমি ৩৫০ বলেছি উনি আমাকে দিচ্ছেন না।”
বউয়ের মুখে এমন ৫০০ টাকার উপর দামাদামির কথা শুনে রায়ান মাথায় হাত দিয়ে মনে মনে বলল-
“হায় আল্লাহ! আমি এখানে ওর জন্য ১৭০০ কুটির ডিলক্লুস করছি আর আমার বাচ্চা বউ ওখানে ৫০০ টাকার জন্য ফুল ওয়ালার সাথে লড়াই করছে। কপাল আমার আসলে।”

রায়ান হাঁফ ছেড়ে মিরায়াকে বলল-“আচ্ছা তুমি ফুল ওয়ালাকে ফোনটা দেও আমি দামাদামি করে দিচ্ছি।”
মিরায়াও রাজি হলো স্বাভাবিক ছেলেরা একটু জোর দিয়ে দামাদামি করলে বিক্রেতারা দিয়ে দেয়। মিরায়া ফোনটা ফুল ওয়ালার দিকে দিয়ে বলল-
“মামা একটু কথা বলুন। আপনাকে কিছু বলবে।”
মুখে একটা মিষ্টি কিন্তু দুষ্টু হাসি।
ফুল বিক্রেতা মিরায়ার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে কানে ধরে বলল-“হ্যালো কে?”
রায়ান বিনয়ের সাথে অনুরোধ করে ফুল বিক্রেতাকে বলল-
“মামা, যা দিচ্ছি নিয়ে নিন প্লিজ, বাকি আমি এসে দিয়ে দেব। একদম ছেদি বাচ্চা বউ আমার ওকে রাগানোৎ আমি একদমই আফোর্ড করতে পারবোনা। প্লিজ ৩৫০ এ দিয়ে দিন।”

ফুল বিক্রেতা একবার ভাবল মনে সত্যিই বলতে ফুলের দাম তো ৩৫০ টাকাও নয় যেহেতু এভাবে অনুরোধ করছে লোকটা তার বউয়ের জন্য তাই সামান্য মন গলে গেল তার।
ফুল বিক্রেতা মিরায়াকে তার ফোনটা ফেরত দিতে দিতে বলল-
“আচ্ছা আপা, ৩৫০ টাকাই দেন।”
মিরায়া হালকা গর্বিত ভাব নিয়ে হেসে ফোনটা ফিরত নিল। আর বললো-“আগে মেনে গেলেই হতো। এখন দিন।”
রায়ান ফোনের ওপাশ থেকে সব শুনে হালকা হাসলো। সামান্য ফুলের তোড়াতে খুশি হওয়া মানুষদের আর কি ই বা বলা যায়। মিরায়া ফুল বিক্রেতার টাকা টা তাকে বুঝিয়ে দিয়ে ফুলের তোড়াটা হাতে নিতেই একটা বাচ্চা যে রাস্তা দিয়ে তার মায়ের হাত ধরে যাচ্ছিল মিরায়ার হাতের ফুল গুলো দেখে জেদ ধরলো তার ওইটা লাগবে।
-“আম্মু, ওই ফুলতা দেও। আমাল ভালো লাতছে।”

বাচ্চার মা মিরায়ার দিকে তাকিয়ে একটু অস্বস্তিতে হেঁসে বাচ্চা টাকে বকলেন-“এমন করতে হয় না লোকে পচা বলবে। কান্না থামাও। এতোটা আপুর।”
বাচ্চাটা আরো হাউমাউ করে কাঁদছে। রায়ান আবার ওপাশ থেকে প্রশ্ন করলো-
“কি হয়েছে এখন আবার চুপ কেন? আর বাচ্চা কাঁদে কোথায়?”
মিরায়া রায়ান কে বলল-“একটু অপেক্ষা করুন। লাইনে থাকবেন।”
মিরায়া বাচ্চা টার কাছে গিয়ে ওর ফুলের তোড়া থেকে একটা ফুল খুলে দিয়ে বলল-“এই দেও বেবি। এইটা সব চেয়ে সুন্দর ফুল। তোমার জন্য।”
বাচ্চা টা খুশি মনে ফুলটা নিয়ে নিলো। বাচ্চার মা মিরায়াকে ধন্যবাদ জানালেন-“থ্যাংক ইউ। কিছু মনে করবেন না আসলে বাচ্চা তো বোঝে না।”

মিরায়া ভদ্রভাবে বলল-“আমি কিছু মনে করি নি বাচ্চা রা নিষ্পাপ তাই ফুলের মতো পবিত্র জিনিসে আকৃষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক। ভালো থাকবেন।”
উনারা চলে গেলে মিরায়া ফোনটা কানে ধরে বলল-
“হ্যালো, আছেন?”
রায়ান এতক্ষণ সব কিছু শুনছিলো আর নিজের বউটার সরল মনের উদাহরণের সাক্ষী হচ্ছিল। রায়ান মিরায়ার কথায় উত্তর দেয়-
“হুম আছি বলো।”
মিরায়া মাত্র বাচ্চার সাথে কথা বলাতে তার মাথায় একটা প্রশ্ন এলো তাই সেটা রায়হানকে ততখনাৎ জিজ্ঞেস করলো-

“আচ্ছা আপনার বাচ্চাদের কেমন লাগে?”
রায়ান মনে মনে মিরায়ার তা ভেবে বলল-
“উমম্, খুব ভালো লাগে।”
মিরায়া এবার উৎসাহ নিয়ে আবার জিজ্ঞেস করল-
“সত্যি ভালো লাগে? কেমন বাচ্চা ভালো লাগে ছেলে না মেয়ে?”
রায়ান জিজ্ঞেস করলো-“আচ্ছা তোমার বাবার নাম কি ছিল?”
মিরায়া অবাক হয় রায়ানের প্রশ্নে সে আবার পাল্টা প্রশ্ন করল-“বাবার নাম কোত্থেকে এলো?”
রায়ান অধৈর্য হয়ে-“আহা জিজ্ঞেস করেছি বলোনা।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৯ (২)

মিরায়া ভাব নিয়ে নিজের বাবার নাম বলল-“মোঃ মিরাজ রহমান।”
রায়ান এবার শান্ত কন্ঠে উত্তর করলো-“আমার মোঃ মিরাজ রহমান এর বড় বাচ্চাটাকে ভালো লাগে খুব। একটু জেদি কিন্তু খুব মিষ্টি।”
মিরায়া হা করে রইলো রায়ানের উত্তরে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৯ (৪)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here