আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৯ (৪)
অরাত্রিকা রহমান
রায়ান এবার শান্ত কন্ঠে উত্তর করলো-“আমার মোঃ মিরাজ রহমান এর বড় বাচ্চাটাকে ভালো লাগে খুব। একটু জেদি কিন্তু খুব মিষ্টি।”
মিরায়া হা করে রইলো রায়ানের উত্তরে। কোনো চিন্তা ভাবনা ছাড়া একটা মানুষ এইভাবে কিভাবে এসব কথা বলে মিরায়ার মাথায় ধরেছে না। কিন্তু রায়ানের এমন লাগামহীন কথা মিরায়ার খারাপ লাগে তা একদমই নয়। এই কিছু দিনে রায়ান এর আচার আচরণ কথাবার্তা সবকিছু বেশ পছন্দের হয়ে উঠেছে মিরায়ার তার নিজের অগোচরেই।
রায়ানের কথায় মিরায়া মুচকি হাসলো তবে রায়ানের কাছে প্রকাশ হতে দিল না। সে বিরক্ত ভাব নিয়ে রায়ান কে সাবধান করতে হুমকির সুরে বলল-
“বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে কিন্তু।”
রায়ান চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিল ক্লান্তিতে। তার আর এই লুকোচুরি খেলা ভালো লাগছে না। বউয়ের সাথে দুটো মনের কথাও বলা মুশকিল হয়ে যাচ্ছে এটা আর সে নিতে পারছে না। নিজের মনেই এই সকল গোপনীয়তা নিয়ে বিরক্ত হয়ে রায়ান মিরায়াকে অধৈর্য গলায় ডাকল-
“হৃদপাখি?”
মিরায়া রায়ানের গলার সুরে পরিবর্তন দেখে তার ডাকে সারা দিল-“হুম, কি?”
রায়ান একই ভাবে অশান্ত গলায় বলল-” আমি আর পারছি না, হৃদপাখি। আই জাস্ট কান্ট!”
মিরায়া শুকনো ঢোক গিললো রায়ান এর গলা আগে এতটা অস্থির কখনো শোনায় নি। মিরায়া চিন্তিত কন্ঠে আমতা আমতা করে প্রশ্ন করলো রায়ান কে-
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“হুয়াট ইউ কান্ট? কি পারছেন না আপনি? বলুন আমাকে।”
রায়ান নিজের মন শক্ত করলো- “এভাবে আর চলতে পারে না। আমি পারবো না আমার বউকে ছাড়া থাকতে। সত্যি টা একদিন ঠিকই জানাতে হবে আমায় তাহলে সেটা আজ কেন নয়! মিরা যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব। ভুল আমার দ্বারা হয়েছে তার ক্ষমা চাইবো। তবুও আর লুকিয়ে রাখা সম্ভব না এই সত্য।” (মনে মনে)
রায়ান মিরায়াকে আত্মস্থ করে নিজের মনের অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো-“বলবো পাখি, কিন্তু এভাবে ফোনে কাপুরুষের মতো নয়। তোমার কাঙ্খিত পুরুষ তোমার চোখে চোখ রেখে সব বলবে। আর কিছু সময় অপেক্ষা করো, জান বাচ্চা আমার।”
রায়ানের গম্ভীর হয়ে বলা কথাগুলো মিরায়ার শরীরে একরকম শিহরণ জাগিয়ে তুলল। মিরায়া বুঝেও যেন বুঝতে চাইছে না রায়ান তাকে ঠিক কি বলার কথা বলছে। মিরায়া মনে মনে দ্বিধায় ভুগতে শুরু করলো-“কি বলবেন উনি আমাকে? যদি যা ভাবছি তা বলেন তাহলে তুই কি ভাবে সামলাবি মিরা? কি করবি তখন?”
মিরায়া নিজেই বেশ ভালো ভাবে বুঝতে পারছে রায়ানের চাওয়ার বাইরে গিয়ে কিছু চাওয়ার ক্ষমতা তার কাছে থেকেও নেই। মনের সাথে চিন্তা ভাবনার সম্পর্কের বিচ্ছেদ ঘটেছে অনেক আগেই। যা যা চায়নি তার সবকিছুই হয়েছে- এমনি কি! হয়তো রায়ানের দিকে দূর্বলতাও তৈরি হয়েছে।
রায়ানের অফিস রুমের দরজায় কেউ নোক করলো তখনি, রায়ান খানিকটা বিরক্ত অনুভব করে মনে মনে বিড়বিড় করলো- “শালার গোটা একদিন পর বউটার সাথে কথা বলছি এর মাঝেও বাঁধা এসে হাজির। মনটা চায় সবগুলারে কুচিকুচি করে ফেলি।”
রায়ান রাগি গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করল-“হু ইজ দ্যাট?”
দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা স্টাফ উত্তর করলো-“স্যার, ইউর কার হ্যাজ এ্যারাইভড। ইউর ড্রাইভার ইজ ওয়েটিং ফর ইউ।”
রায়ান সাথে সাথে উত্তর করলো-“আই হ্যাভ টাইম, টেল হিম টু ওয়েট। আই এম বিজি, ডুয়িং সামথিং ভ্যারি ইম্পরট্যান্ট।”
স্টাফ বাহির থেকেই রায়ানের আদেশ শুনে চলে গেল। মিরায়া সবটা শুনলো অপর দিক থেকে। রায়ান নিজের অফিসে এতো গম্ভীর আর শক্ত গলায় কথা বলে তা আজ প্রথমবার শুনলো মিরায়া। মনে মনে ভাবতে লাগলো- “খবিশের মতো এমন রস কস ছাড়া কথা বলেন উনি অফিস? কি আশ্চর্য!”
রায়ান স্বাভাবিক ভাবে আবার মিরায়ার সাথে কথা বলায় ফিরে গেল-“হ্যালো, মিরা?”
রায়ানের আওয়াজ পেয়ে মিরায়া তার মনে উঠা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলো রায়ান কে-“আচ্ছা আপনি কি এমন ভাবেই কথা বলেন অফিসে?”
রায়ান মিরায়ার প্রশ্নের কারণ বুঝতে পেরে হালকা হেসে জবাব দিলো -“হ্যাঁ, কেন?”
মিরায়া অদ্ভুত একটা মুখ বানিয়ে আবার প্রশ্ন করলো-
“আপনি সবার সাথে এমন গম্ভীর আচরণ করেন কেন?”
রায়ান কাজের ক্ষেত্রে নরম ব্যবহার দূর্বলতা মনে করে তাই নিজেকে সবসময় আদর্শ একজন ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছে। সে মিরায়ার প্রশ্নের জবাবে সত্যি টাই বললো-
“কারণ, আমার সবাইকে আগলা পিরিতি দেখাতে ভালো লাগেনা।”
মিরায়া তার ক্ষেত্রে রায়ানের ব্যবহারগুলো মনে করে বিড়বিড় করলো-“কই আমার সময় তো আগলা পিরিতি উতলাই পরে।” তবে সে মনের কথাটা না বলে রায়ানকেই প্রশ্ন করলো উত্তর জানতে-
“তাহলে আমার সাথে…!”
রায়ান শান্ত গলায় মিরায়াকে তার গুরুত্ব রায়ানের জীবনে ঠিক কতটা সেটার অল্প আন্দাজ করাতে বলল-“তুমি আর সবাই এক নও। তুমি আমার জন্য বাকি সবার মধ্যে পড়ো না, হৃদপাখি।”
মিরায়ার নরম গাল গুলো রায়ানের কথায় লাল হয়ে উঠলো, চোখগুলো ঝকঝক করছে আর ঠোঁটের কোণায় এক মিষ্টি লাজুক হাসি লেগে আছে। মিরায়া চুপচাপ হয়ে যাওয়ায় রায়ান নিজের থেকে আন্দাজ করে বলল-
“আর লজ্জা পেতে হবে না পাখি। এখনি লজ্জা সব শেষ করে ফেললে হবে বলো। জমিয়ে রাখো, এখনো কত কিছু বাকি, আমি যে তোমার আমার কারণে পাওয়া লজ্জায় রাঙা মুখটা খুব করে দেখতে চাই।”
মিরায়া আরো লজ্জায় পড়ে নেতিয়ে গেল। কি বলে সামলাবে নিজেকে বা কিভাবে রায়ানকে চুপ করাবে তা ভেবে পাচ্ছে না। অবশেষে আর কোনো উপায় না পেয়ে অন্য কথা তুললো-
“আচ্ছা আপনি কখন ফিরবেন? আজকে না আপনার বাইক রেস আছে সন্ধ্যার পর?”
রায়ান বুঝলো মিরায়া ইচ্ছে করে অন্য কথা তুলছে সে ঠোঁট কামড়ে একটু মুচকি হেঁসে মিরায়ার সঙ্গো দিলো কথা পাল্টাতে-
“বিকেলের দিকে বাংলাদেশ ল্যান্ড করবো। বাড়ি ফিরে তারপর রেস এ যাবো। আজকের রেসটা জেতার জন্য আমি এ্যাক্সাইটেড।”
মিরায়া বাঁকা হেঁসে বলল-“ও বাবা, নিজে জিতবেন এটাও ঠিক করা হয়ে গেছে? যদি অন্য দলের ক্যান্ডিডেট জিতে যায়?”
রায়ান আত্মা বিশ্বাসী হয়ে উত্তর দিল- “আই এম দ্যা বেস্ট অ্যামাং অল অফ দ্যাম। বাট আই হোপ অন্য দলের ক্যান্ডিডেট যেন ওই দলের বেস্ট হয় নাহলে মজা কোথায় জিতে।”
মিরায়া এবার রায়ানের কথা তাচ্ছিল্য করে মনে মনে বলল-
“লেট’স সি মি.অশ্লীল, কে জেতে আর কে হাড়ে। আপনার জীবনের প্রথম হাড় আমার কাছে হবে। আই প্রমিস ইউ দ্যাট।”
মিরায়া রায়ানকে আর কিছু বলতে চাইলো না এই ব্যাপারে যা হবার রেসের ট্র্যাকে হবে। মিরায়ার পরের ক্লাসের সময় হয়ে যাওয়ায় সে রায়ানের থেকে বিদায় নিতে বলল-
“আচ্ছা সে নাহয় রেস এর পর বাড়ি ফিরলে দেখা যাবে। আমাকে যেতে হবে ক্লাসের সময় হয়ে গেছে।”
রায়ান শ্বাস ছেড়ে না চাইতেও বলল-“ওকে বেইবি, সি ইউ। ক্লাসে যাও এখন। বাড়িতে ফিরে আমার অপেক্ষায় থেকো যত দ্রুত সম্ভব তোমার কাছে চলে আসছি আমি অনেক কিছু বলার আছে।”
মিরায়া হালকা হেঁসে উত্তর করল-“ওকে, সি ইউ টু। আমি অপেক্ষায় থাকবো আপনার সব কথা শোনার জন্য। বাই।”
রায়ান-“বাই।”
কলটা কেটে যাওয়ার পর রায়ান মনোস্থির করলো দেশে ফিরেই মিরায়াকে সব সত্যি জানাবে। আর অন্ধকারে রাখবে না মিরায়াকে। মিরায়াকে নিজের করতে যা যা করতে হয় সব করবে, সব শাস্তি সহ্য করবে যদি ফলাফল স্বরূপ তার বউ তার হয়। রায়ান ফোনটা রেখে দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল-
“হার্ট-বার্ড গেট রেডি টু মিট ইউর বি লাভ’ড হাসবেন্ড মি.রিভান চৌধুরী রায়ান। আই এম অন মাই ওয়ে টু মেইক ইউ মাইন ফরেভার।”
এরপর রায়ান নিজের কোর্ট টা নিয়ে বেরিয়ে গেল। কোম্পানির বিল্ডিং এর নিচে দাঁড়িয়ে থাকা কালো mercedes গাড়িতে উঠে ড্রাইভারকে আদেশমুখী গলায় বলল-“টু দ্যা মোল। এ্যান্ড দেন দ্যা এয়ারপোর্ট। গোট ইট?”
ড্রাইভার মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর দিল -“ইয়েস স্যার, সিওর।”
রায়ান দেশে ফেরার আগে মিরায়ার জন্য কিছু কিনতে চেয়েছিল তবে সময় হয়ে উঠে নি তাই যাওয়ার আগেই কিনে নেবে ঠিক করেছে। তার উপর যেহেতু ঠিক করে ফেলেছে এইবার দেশে ফিরেই সব সত্যি জানাবে মিরায়াকে সেক্ষেত্রে বউকে খালি হাতে তো আর মনের কথা বলা যায় না, তাই আর কি প্রথমে মোলে যাবে তার পর এয়ার পোর্ট থেকে সোজা বাংলাদেশ।
কলেজ~
মাহির আজ অনেক আশায় কলেজে এসেছিল এই ভেবে হয়তো সোরায়া আজকে থাকবে কলেজে কিন্তু সকালেই সব আশায় পানি দেওয়া হয়ে গেছে। ক্লাসে সোরায়ার অনুপস্থিত মাহিরকে যন্ত্রণা দিচ্ছে। জুঁই কে আলাদা করে অফিস রুমে ডেকে সোরায়ার ব্যাপারে মাহির জিজ্ঞাসাবাদ করে কিন্তু কোনো লাভ হলো না তাতে। জুঁই কিছুই জানে না এমন কি তার সাথে সোরায়ার এর পর আর কোনো রকম কথাই হয় নি বলে জানায় জুঁই।
মাহির কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না এমন পরিস্থিতিতে কখনো পরতে হবে তার ধারণা ও করা যায় না।
মাহির এখন বাড়িতে নিজের ঘরে স্টাডি টেবিলে বসে আছে দুই হাতে মাথা র ভর দিয়ে। তখনি রায়ানের কল এর করা মাহিরের মাথায় এলো, রায়ান তাকে মেসেজ ও করেছিল ৪.৩০ মিনিটে ফ্লাইট ল্যান্ড করতে পারে। তার রায়ানকে রিসিভ করতে যেতে হবে এয়ার পোর্টে এখনি।
এখন বাংলাদেশের সময় বিকেল ৪টা বাজছে। রায়ান আমেরিকা থেকে রওনা দিয়েছিল রাত ১.৩০ মিনিট এর দিকে। বাংলাদেশে পৌঁছাতে আর খুব একটা সময় লাগবে না। মাহির চিন্তা একদিকে রেখে রেডি হয়ে এয়ার পোর্টের উদ্দেশ্যে রওনা হয়।
রায়ানের দেশে ফিরে আসার খবরে খুশির চেয়ে সোরায়ার অনুপস্থিতি এতো তীব্র হবে মাহির বুঝতে পারে নি। গাড়ি চালিয়ে কোনো রকম এয়ার পোর্টে পৌঁছালো মাহির। তারপরই এয়ার পোর্টে পৌঁছে গাড়ি থেকে নেমে রায়ানের অপেক্ষা করতে থাকলো।
সময় খুবই নিকটে। রায়ানের ফ্লাইট ল্যান্ড করলো ঠিক সময়ে।রায়ান তার ব্যাগপত্র নিয়ে চেক আউট করে বের হতেই একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে ধীরে ছাড়লো। অনেকদিন পর আবার যেন আপন দেশের একটা অনুভুতি কাজ করছে। নিঃশ্বাসের গতি যেন বাড়ছে। দেশের মাটিতে পা রেখেই মনটা বাড়ি ফেরার জন্য আনচান আনচান করতে শুরু করলো। আর এক মুহূর্তও বাড়ি থেকে দূরে থাকতে অস্থির লাগছে।
রায়ান বাইরে বেরিয়ে আসতেই মাহির কে দেখতে পেয়ে হাসি মুখে মাহিরের দিকে এগিয়ে গেল। মাহির গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিল, রায়ান যে চলে এসেছে সেই দিকে খেয়াল নেই, মাথা নিচু। রায়ান মাহিরের সামনে এসে মাহিরের পায়ে তার পা বাড়ি খাইয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলো মাহিরের।
মাহির সাথে সাথে চোখ উঠিয়ে রায়ানকে দেখে হেঁসে রায়ান কে জড়িয়ে ধরলো উত্তেজিত হয়ে। উত্তেজনা দেখতে মনে হলেও আসলে সেটা একাকিত্বের কারণে ছিল। মনের ব্যাকুলতা কাউকে বলতে না পেরে এমন একটা লাগছিল যে বন্ধুকে এবার এতো দিন পর দেখে তার উৎসাহ বেড়ে গেছিল।
এই দিকে রায়ান মাহিরের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল-
“শালা তুই এমন গায়ের উপর উঠে যাস কেন প্রত্যেক বার? কত বার বলবো আমি বিবাহিত প্লাস স্ট্রেইট। তোর কোনো চান্স নেই আমার কাছে দূরে যা তো শোর।”
মাহির হেঁসে উঠলো। তারপর রায়ানকে আরো একটু জ্বালাতে রায়ানের থুতনি ধরে ঘুরিয়ে বলল-
“ওরে আমার ফুলটুস রে, নিজেরে বিবাহিত দাবি কর এখন তাই না? মনে আছে প্রথম দিন ভাবির কথা তুলে ছিলাম বলে কেমন ঝেড়ে ছিলি?”
রায়ান মাহিরের হাত তার থুতনি থেকে ছাড়িয়ে দিয়ে বলল-
“নাটক কম করো পিও। তুমি যে তখন ইচ্ছা করে বউয়ের টপিক ঘাটতা আমারে বিরক্ত করার জন্য সেটা আমি আগের থেকেই বুঝতে পারতাম তোমার ব্যবহারে পিও।”
মাহির আবার থুতনিতে ধরে ঘুরিয়ে বলল-“ভাগ্যিস ভাবি মা আমার সুন্দরী তাই তো আমার খেপানোর জায়গা টা একটু বেড়েছে।”
রায়ান আবার মাহিরের হাত সড়িয়ে দিয়ে বলল-“এইসব নাটক বাদ দিয়ে এখন চল আমি আর থাকতে পারতেছি না। বউটার জন্য বুকে চিনচিন ব্যথা করছে।”
মাহির রায়ানের কথায় হেঁসে মাত্রই বুক চিনচিন গানটা ধরতে গেল-“বুক চিনচিন করেছে হায়, মন তোমায়…!”
রায়ান বিরক্ত হয়ে মাহিরের মুখ চেপে ধরে গাড়ির দরজায় ঠেলে বলল-“গান পরে গাবি এখন চল। আমার বউ আমার জন্য বাড়িতে অপেক্ষা করতেছে।”
মাহির গান থামিয়ে রায়ানের হাত নিজের মুখ থেকে নামিয়ে নিয়ে শর্ত দেওয়ার সুরে বলল-
“যাব তো, আগে বল আজকে ভাবি মার সাথে দেখা করাবি তাহলে যাব। না হলে এখানে রেখে দেবো তোকে।”
রায়ান চোখ বেঁকিয়ে তুচ্ছার্থে হেঁসে বলল-
“ভাবি মাকে দেখতে চাও না তার বোনকে তা কি আমি বুঝি না! যদিও লাভ নেই চড়ুই বাড়িতে নেই চট্টগ্রাম গেছে কিছু দিনের জন্য তাই তোকে আজকে দেখা করাবো চল।”
মাহির অবাক হয়ে রইল এক মুহূর্তের জন্য। সত্যি বলতে সে মোটেও সোরায়াকে দেখার জন্য চৌধুরী বাড়িতে যাওয়ার আবদার জানায় নি সে সত্যি সত্যি মিরায়াকেই দেখতে চেয়েছিল। রায়ান পুনরায় শুধু শুধু সোরায়ার কথা টানায় মাহির আর কিছু বলল না এখন আর তার কোনো আগ্রহ নেই। রায়ান এতে একটু অবাক হলো কিন্তু সেও মুখ ফুটে কিছু বলল না।
তারপর মাহির কথার টপিক পরিবর্তনের জন্য মজার ছলে বলল-“বাড়িতে বউ রেখে গেছিস কেন যদি এতই বুক চিন চিন করে বউয়ের খাতিরে?”
রায়ান নিজের ব্যাগটা গাড়ির ডিকিতে রাখতে রাখতে বলল-
“টাকা, টাকা বুঝেছিস। টাকা সব নষ্টের মূলে। ১৭০০ কোটির ডিল না চাইতেও যেতে হতো কম্পানির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটা ডিল ছিল।”
মাহির রায়ানের টাকা নিয়ে কথা বলায় হালকা উদার মানসিকতার ভাব নিয়ে নিজেকে বড় দেখিয়ে বলল-“আরে টাকা তো হাতের ময়লা আসবে আর যাবে। কিন্তু তাই বলে নিজের এত আদরের বউটাকে রেখে চলে যাবি? আমি হলে কখনো যেতাম না।”
রায়ান কুটিল হেঁসে বলল-“টাকা অনেক মানে রাখে জীবনে সেটার সাথে সম্পর্ক তুলনা করে লাভ নেই বুঝেছিস?”
মাহির এবারও একই ভাব নিয়ে একটা বিখ্যাত প্রবাদ বাক্য আওরালো-“Money can’t buy happiness দোস্ত। টাকাই সব কিছু না বুঝলি?”
রায়ান মাহিরের কথায় কোন উত্তর দিল না মনে মনে এটা দুষ্ট বুদ্ধি এনে হঠাৎ মাটির দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে হালকা জোরে চেঁচিয়ে বলল-
“দোস্ত দেখ দেখ মাটিতে ১০০০ টাকার একটা নোট কে যেন ফেলে চলে গেছে।”
মাহির সাথে সাথে রায়ানের কথায় হকচকিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে এদিক ওদিক চোখ ঘুরিয়ে টাকার নোটটা খুঁজতে খুঁজতে বলল-“কই কই। কোথায় নোট পড়ে আছে দেখতেছি না তো।”
রায়ান ঠোঁট কামড়ে হেঁসে মাহিরের দিকে তাকিয়ে বলল-
“কে যেন একটু আগে বলছিল ‘টাকাই সব কিছু না’, ‘হাতের ময়লা’, can’t buy happiness’।”
মাহির রায়ানের কথায় বুঝতে পারলো রায়ান সম্পূর্ণটা নাটক করছিল তাকে টাকার মর্ম বোঝাতে। মাহির নিজের ফেঁসে যাওয়া বুঝতে পেরে সোজা হয়ে একটু ভাব নিয়ে বলল-
“দিন দিন বেশি চালাক হয়ে যাচ্ছিস তুই ভাবিরে বলবো একটু যেন টাইট দেয়। চল এবার দেরি হচ্ছে।”
রায়ান হাসলো আর তার পর দুইজনই গাড়িতে চড়ে বসলো । মাহির গাড়ি চালাতে লাগলো আর রায়ান হালকা গা লাগিয়ে দিল গাড়ির সিটে।
চৌধুরী বাড়ি ~
মিরায়া ক্যাম্পাস থেকে ফিরে এসেই রামিলা চৌধুরীকে রায়ানের আজকে বাড়ি ফিরে আসার খবর জানায়। ছেলের বাড়ি ফেরার খুশিতে রামিলা চৌধুরী সাথে সাথে রান্নাঘরে গিয়ে ছেলের পছন্দের সকল খাবার তৈরির আয়োজন শুরু করেছেন। সাথে মিরায়াও সাহায্য করছে। দুজনেই বেশ খুশি মনে মুখে হাসি নিয়ে রান্নাবান্নার কাজ করছে। মিরায়া মনে মনে বেশ খুশি অনেকদিন পর আবার সে তার অশ্লীল পুরুষকে নিজের সামনে দেখতে পাবে বলে।
রান্নাবান্নার কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। রায়ানের পছন্দের মাটন বিরিয়ানি রান্না করা হয়েছে সাথে আরো কিছু সাইট ডিশ রান্না করেছেন রামিলা চৌধুরী। বিরিয়ানি টা দমে বসিয়ে রামিলা চৌধুরী মিরায়াকে উদ্দেশ্যে করে বলেন-
“মিরা মা রান্নাঘরের কাজ তো শেষ । এবার বাড়ির কি করবো? সব গুছানো আছে তো?”
মিরায়া হালকা একটু ভেবে রামিলা চৌধুরীকে বলল-
“হ্যাঁ মামনি, সবই তো ঠিক আছে সোফার কাভার, ডাইনিং টেবিলের কাভার সব চেন্জ করেছি যেমনটা বলেছ।”
রামিলা চৌধুরী একটু থেমে আত্মস্থ হবেন ঠিক সে সময় তার মাথায় এলো এতদিন তো রায়ানের ঘরে কেউ ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই জন মানবহীন ঘরটা বেশ নোংরা হয়ে গেছে এ কয়দিনে। কিন্তু সব কাজের মাঝে তো রায়ানের ঘরটাই পরিষ্কার করা হয়নি। তৎক্ষণাৎ রামিলা চৌধুরী মিরায়াকে
বললেন হকচকিয়ে –
“ও মা সব ঠিক কিভাবে হলো বল! যে আসছে তার ঘরটাই তো পরিষ্কার করা হয়নি। একদম মাথা থেকে বের হয়ে গেছিল। ছেলেটা বাড়ি ফিরে নিজের ঘরটা অপরিষ্কার দেখলে কি মনে করবে?”
রামিলা চৌধুরীর কপালে চিন্তার ভাজ ফুটে উঠতেই মিরায়া তাকে শান্ত করতে বলল-
“আহা মামনি, এটা চিন্তা করার কোন বিষয় হল। একটা ঘর পরিষ্কার করতে কি এমন সময় লাগে। তুমি থাকো আমি এক্ষুনি ঘরটা পরিষ্কার করে দিয়ে আসছি। উনারই বাড়িতে পৌঁছাতে এখনো মিনিটখানেক সময় লাগবে।”
রামিলা চৌধুরী মিরায়াকে জিজ্ঞেস করলেন-“এখন তুই পারবি সব করতে?”
মিরায়া হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বলল-“হ্যাঁ পারবো। তুমি জাস্ট সময় দেখা মামণি। আমি এই যাব আর এই কাজ শেষ করে নিচে চলে আসবো।”
মিরায়া কথাটা বলেই উপরে উঠে গেল ক্লিনিং করার সরঞ্জাম হাতে নিয়ে রায়ানের ঘরটা পরিষ্কার করার উদ্দেশ্যে। আজ রুদ্র ও বাড়িতে চলে এসেছে তাড়াতাড়ি রায়ান ফিরবে বলে। কিন্তু নিজের ঘরে রয়েছে মন মরা হয়ে।
কারণটাও যথেষ্ট গুরুতর ছিল। মিরায়ার আসার পর রুদ্র তাকে রিমির ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল একটা কথার মাঝে শুধু এতো টুকু নিশ্চিত হতে যে রিমির কিছু হয়নি। কিন্তু মিরায়া যখন তাকে জানালো যে রিমি আজকে ক্যাম্পাসেই আসেনি তখন তার চিন্তা আরো দ্বিগুন বেড়ে গেল।
মনে মনে শুধু ভেবে যাচ্ছে একটা জলজ্যান্ত মানুষ কিভাবে কেন কোথাও হয়ে গেল হঠাৎ না ফোন তুলছে আর না বাড়িতে আছে। রুদ্র রিমির নাম্বারটা যে আবার একবার চেক করতে কল করলো। এইবার আশ্চর্য ভাবে কল টা ঢুকলো রিমির নাম্বারে। রুদ্র রিমির নাম্বারে কল ঢোকার পর অবাক হয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে ফোনটা কানে নিয়ে বলল-
“রিমি পিক আপ দ্যা কল। প্লিজ প্লিজ। একবার কল তুলুন।”
কিন্তু রিমি ওপাশ থেকে কল তুললো না। রুদ্র টানা কয়েকবার রিমিকে কল করলো কিন্তু রিমি তারপরও কলটা রিসিভ করল না। উপায়ান্তর না দেখে রুদ্র রিমিকে একটা মেসেজ পাঠালো-
“রিমি আপনার কি হয়েছে? এমন কেন করছেন? আপনি ক্যাফেতেও আসেননি সেখান থেকে বললে আপনি কাজ ছেড়ে দিয়েছেন, মিরা ভাবিকে জিজ্ঞেস করার পর বলল আপনি ক্যাম্পাসেই যাননি, আমি বাড়িতে গিয়ে সেদিন আপনাকে পেলাম না। কেন? কি হয়েছে? আমি আপনার সাথে দেখা করতে চাই খুব আর্জেন্ট পারলে এক্ষুনি। আপনি বলুন আপনি কোথায় আছেন আমি আসছি। ”
মেসেজটা সেন্ড হলো কিন্তু রিমির দিক থেকে কোন রিপ্লাই এলো না। রুদ্র রেগে গিয়ে ফোনটা বিছানার উপর ছুড়ে ফেলে ধপ করে বসে পড়ল নিজের মাথার চুল খামচে ধরে। চারপাশে সব কিছু তার এখন বিরক্তিকর লাগছে।
মাহিরের গাড়িতে~
রায়ান মনে মনে মিরায়াকে আজ সবকিছু কিভাবে জানাবে তা নিয়ে ভাবছে। তার চোখে মুখে একটু ভয় ও দ্বিধার ছাপ স্পষ্ট। কিছুই মাথায় ধরছে না শুধু ভাবছে মিরায়া সত্যি শোনার পর কেমন অনুভব করবে কি করবে। যদি সে মেনে না নেয় ? যদি কষ্ট পায়? যদি তাকে দোষী মনে করে?
এসব ভাবতে ভাবতে রায়ানের মুখ থেকে অচিরেই একটা দীর্ঘশ্বাস পড়ল। মায়ের পাশে গাড়ি চালাতে চালাতেই সবকিছুই পর্যবেক্ষণ করছে। সে অপেক্ষা করছিল রায়ার নিজের থেকেই তাকে বলবে কি হয়েছে। কিন্তু রায়ান এমন কিছু করছিল না নিজের মনে সব কিছু ভেবে নিজের মনে সবকিছুর দাফন করে দিচ্ছিল। রায়ানের হাত এক পর্যায়ে তার কপালে উঠতেই। মাহির রায়ানকে উদ্দেশ্যে করে প্রশ্ন করল-
“ওই কি রে? তখন থেকে দেখে যাচ্ছি কি যেন ভেবেই যাচ্ছিস মনে মনে। হয়েছে টা কি? ফ্লাইটে কি কিছু ফেলে রেখে এসেছিস? নাকি কোন কাজ বাকিয়ে রেখে চলে এসেছিস সেখানে?”
রায়ান কি করবে সেটার উত্তর নিজের কাছে এমনিতেও খুঁজে পাচ্ছিল না হাজারবার ভেবেও। মাহিরের দিকে তাকিয়ে তার একবারের জন্য মনে হলো যদি মাহির কে বলে তাহলেও হয়তো ভালো কোন উপায় পেতে পারে। নিজের একমাত্র বন্ধুর প্রতি সেই আস্থা রেখেই রায়ান মাহিরকে বলল-
“ভাই আমি না আর এই লুকোচুরি সহ্য করতে পারছি না। ঠিক করেছি মিরাকে সব কিছু বলে দেবো। কিন্তু কিভাবে কি শুরু করব, আর সেটা কোথায় গিয়ে শেষ করব, ফলাফল কি হবে, এসব ভাবতে ভাবতে কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে । পারলে একটা ভালো উপায় বলল না যাতে তোর ভাবি মা পোটে যায় সত্যি জানার পর।”
মাহির রায়ানের কথায় হালকা গম্ভীর ভাব নিয়ে একটু চিন্তা চিন্তা মুখ করে বলল-
“একটা ভালো আইডিয়া আছে।”
রায়ান একরাশ আশা নিয়ে মাহিরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো-“কি ? কি সেটা?”
মাহির আবার গম্ভীর ভাব নিয়ে বলল-“চল তোকে তুলার দোকানে নিয়ে যাই। সেখান থেকে তো পুরোটা শরীর তুলা দিয়ে ঢেকে নিয়ে যায় যাতে ভাবি মা সত্যি শোনার পর তোকে ঝাড়ু দিয়ে বাড়ি দিলও গায়ে না লাগে। তাহলে অনেকক্ষণ ধরে সরি বলতে পারবি। আর ক্ষমা পাওয়ার চান্সও বেড়ে যাবে।”
মাহিরের উত্তরে রায়ানের সব আশা জলাঞ্জলি গেল। বিরক্ত হয়ে গাড়ির ডেসকে জোরে পা দিয়ে লাথি দিয়ে বলল-
“বালের দোকানে নিয়ে যাবি আমাকে হাড়ামি। একটা আইডিয়া চাইলাম , ভালো কিছু সাজেস্ট না করে সে আমার বউয়ের হাতে ঝাড়ুর বাড়ি খাওয়ার কল্পনা সাজিয়ে বসে আছে।”
মাহির হেসে উঠে বলল-“তোকে আইডিয়া দিয়ে আমার লাভ কি হ্যাঁ?”
রায়ান মাহিরের লাভের কথা শুনে অবচেতন মন বলে বসলো-
“এই যাত্রায় বাঁচার মতো একটা প্ল্যান বল তোকে আমি চড়ুই পাখিকে দিয়ে দেব।”
মাহির রায়ানের কথায় ভ্রুকুচকে তাকালো-“কি দিবি আমাকে তুই?”
রায়ান আবার একটু লাজুক মুখে বলল-“আমার ছোট্ট বোনের মতো শালি টাকে দিবো। এবার আইডিয়া দে ভালো দেখে।”
মাহির আবারো অবাক হলো বউয়ের রাগ কমানোর আশায় উপায় খুঁজতে শেষ মেষ বউয়ের বোনকে বাজি লাগাচ্ছে!
মাহির একটু তুচ্ছ সুরে বলল-
“হায় রে বউ পাগলা রে। অবশেষে বউয়ের জন্য শালি বিসর্জন! জোশ তো।”
রায়ান এখন একটু বিরক্তি নিয়ে বলল-“ওই হারামি, তুই তো সারাদিন আমার কাছে আমার শালির নাম নাম্বার এইটা ওইটা চাইতি। এখন যা চাস তাই দিচ্ছি ভালো লাগছে না তোর? নেকামো করিস?”
মাহির এবার একটু গম্ভীর হয়ে গেল। রায়ানের শালির প্রতি তার আকর্ষণ একটা সময় কাজ করতো সেটা নিতান্তই শুরু বন্ধুর শালি হিসেবে তার বেশি কিছু না। কিন্তু সোরায়ার বিষয়টা ঘটার পর এখনই সবকিছুর জন্য অনুতাপ করছে।
মাহির রায়ানকে শান্ত গলায় বলল-“আমার ওসব কিছু লাগবে না। আর না তোর চড়ুই পাখি বোনকে লাগবে। আমার আছে নিজের টা।”
রায়ান হতবাক হয়ে দেখলো মাহিরকে। মাহিরের বলা কথাটা, “আমার আছে নিজের টা।” শুনে চেঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করল-
“তোর কাছে তোর নিজের টা আছে মানে? এই কাহিনী আবার কবে হলো? আর আমি জানি না কেন?”
মাহির একা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপরই রায়ানের কথার উত্তর দিল নিজের উপরে বিরক্তি নিয়ে-
“এই কাহিনী অনেক নতুন আর সেই জন্যই তুই জানিস না। কাহিনীটা এতই নতুন যে আমি নিজেও জানতাম না। আমার নিজেরই ডিকোড করতে সময় লেগে গেছে। আর এত সময় লেগে গেছে যে এখন আর সামাল দিতে পারছি না।”
রায়ান মাহিরের কথায় একদম হাঁ হয়ে আছে। কি বলছে এসব মাহির তার মাথায় ঢুকছে না। রায়ান কৌতুহলে প্রশ্ন করলো-
“হাতে সময় কম একবারে বল সব কিছু। বেশি পেচাবি না । আর না বলার কথা বললে লাথি মেরে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে নিজে গাড়ি চালিয়ে বাড়ি যাবো বলে দিলাম। তাড়াতাড়ি শুরু কর এবার।”
রায়ানের হুমকি যে মাহিরের গায়ে লাগলো এমন কিছু না তবে সে নিজের থেকেই রায়ানকে সব বলে হালকা হতে চাইছিল। সেই সুবাদে সোরায়ার ব্যাপারে রায়হানকে জানায় অতি সহজ কিছু লাইনে-
“আমার এক স্টুডেন্ট আমাকে পছন্দ করতো। আমি পরবর্তীতে তার সাথে খারাপ ব্যবহার করেছি আমার বিরক্ত লাগতো তাকে এই জন্য। তার পর ও আমাকে ইগনোর করা শুরু করতেই আমার খারাপ লাগতে শুরু করে। সব বাদে, ১ তারিখে নবীনবরণে ওকে দেখে তো আমার হৃৎপিণ্ড বুক থেকে লাফিয়ে বের হয়ে যাওয়ার উপক্রম। এখন যখন ওর গুরুত্ব বুঝতে পেরেছি, নিজের অনুভূতি বুঝতে পেরেছি সে উধাও সব জায়গা থেকে। এই হচ্ছে কাহিনী কিছু বুঝলি? নাকি বেশি ছোট করে বলে ফেললাম?”
রায়ান মাহিরের দিকে তাকিয়ে নিজের হাসি লুকানোর তীব্র চেষ্টা চালাচ্ছে দাঁতে দাঁত চেপে। এমন সময় মাহির রায়ানের দিকে তাকিয়ে রায়ানের ব্যর্থ চেষ্টা দেখে হাঁফ ছেড়ে বলল-
“আর হাঁসি আটকাতে হবে না, হেঁসে নে।”
রায়ান মাহিরের থেকে হাসার অনুমতি পাওয়ার পর আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না হো হো করে হেসে উঠলো টানা ১০-১৫ মিনিট হাসতেই লাগলো। মাহিরের এমন পর্যায়ে পারলে নিজের কপাল চাপড়াতে চাইছে।
মাহির বিরক্তিতে বলল-“এই সব তোর অভিশাপে হয়েছে সব শালা। তুই আমাকে ওইদিন যদি না বলতি তোর মতো পরিস্থিতি তে আমিও পড়বো তাহলে এসব হতো না। শালা কুফা কোথাকার।”
রায়ান হেঁসে হেঁসে ইং বলল-“বেশ হয়েছে দিয়েছি ওইদিন আমার উপর কিভাবে অমানবিক হেঁসে ছিলি মনে নেই। এবার বেশ হয়েছে। তো বল কেমন লাগছে প্রেমে পড়ে, জোশ না?”
মাহির এক গুচ্ছ বিরক্তি নিয়ে বলল-“হো, একদম স্বর্গে আছি মনে হচ্ছে। খাবার পেটে যায় না , ঘুম হয় না, চোখ বন্ধ করলে ওর মুখ সামনে আসে, আরো অনেক সুখ নতুন নতুন অভিজ্ঞতা হচ্ছে।”
রায়ান আরো জোরে হাসলো আর বলল-“ভেবে দেখ তোর তো বিয়েও হয় নি আর আমি আমার বিয়ে করা বউয়ের প্রেমে পড়ে এক বাড়িতে থেকে কিছু করতে পারছি না সব সহ্য করতে হচ্ছে আমার কেমন লাগে ধারণা করতে পারছিস এবার?”
রায়ানের পরিস্থিতি যে মাহির ওই দিন বোঝে নি তা নয় কিন্তু মজা করা যে তাকে এমন পরিস্থিতিতে এনে ফেলবে তা জানলে এমন মজা মজা করেও করতো না।
চৌধুরী বাড়ি ~
মিরায়া রায়ানের ঘরটা পরিষ্কার করে ফেলেছে। বিছানার চাদর, সোফার কাভার সব চেন্জ করে ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে মোপ দিয়ে মুছে নিয়েছে। সব এখন চকচক করছে। এবার সে শুধু শোপিস গুলো মুছছিল। সব কিছু গুছিয়ে শেষ করে মিরায়া হাত ঝেরে ঘরটা চোখ ঘুরিয়ে একবার দেখে নিল।
পরিষ্কার ঘরটা একবার দেখে তৃপ্তির সাথে মিরায়া বলে উঠলো-“এইবার পার্ফেক্ট লাগছে সব কিছু।”
হঠাৎ তার নজর পরল এককোণে থাকা অনেক আগের একটা টেবিলের উপর। টেবিলটা রায়ানের ছোটবেলার। স্মৃতি রাখতে সেটা ঘর থেকে আর সোড়ার নি রায়ান। সম্পূর্ণ ঘরে কেবল ওই টেবিলটাই অগোছালো লাগছিল। তাই মিরায়া ওই টেবিলটার সামনে গিয়ে সেটা গোছানোর কথা ভাবল।
-“ইস্! এইটা বাকি রয়ে গেছে।”
টেবিলের সামনে রায়ানের ছোটবেলাকার একটা ছবি তিন দিয়ে আটকানো ছিল। মিরায়া মুগ্ধ চোখে রায়ানের ছবির দিকে তাকিয়ে বলল- “এই যে মি. অশ্লীল আপনার জন্য এতো খাটছি। বাড়ি ফিরে আমাকে কি বলবেন আপনি তা শোনার জন্য অপেক্ষা তো শেষ ই হচ্ছে না। কোথায় আপনি তাড়াতাড়ি আসুন না একটু।”
মিরায়া ছবির দিকে তাকিয়ে মুচকি হেঁসে বলল-” বেডায় ছোট থেকেই সুন্দর দেখতে, বড় হলে তো এমনিতেও মানুষ সুন্দর হয় বলার বাহুল্য এই জন্যই এতো হেন্ডসাম লাগে এখন।”
মিরায়া আবার একটু হেঁসে টেবিলটা গোছানো শুরু করে। সব বই, কাগজ, পুরোনো খাতা গুলো গুছিয়ে এক পাশে রাখলো। টেবিলের উপর টা মুছে সব ধুলাবালি সড়িয়ে দিল। তারপর সে টেবিলের নিচের ড্রয়ার টা পরিষ্কার করতে খুলে উপরে তুললো। সব একে একে বের করতে থাকলো ড্রয়ার টা থেকে। সব শেষে এক কোনে রায়ানের ছোটবেলার স্কুল আইডি কার্ড টা পড়ে ছিল।
আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৯ (৩)
মিরায়া কৌতুহলী হয়ে রায়হানকে স্কুল টাইমে দেখতে কেমন লাগতো তা দেখতেই আইডি কার্ড টা হাতে নিয়ে রায়ানের চেহারাটা হাসি মুখে দেখতে লাগলো। হঠাৎ তার নজর আইডি কার্ডের উপর লিখা তথ্য গুলোর উপর। বাকি সব কিছুর আগে আইডি কার্ডের একটা জায়গায় তার চোখ আটকালো।
আইডি কার্ডের উপরে লিখা নামটা পড়ার সাথে সাথে বুকের কম্পন যেন হঠাৎ থেমে গেল। মাথার উপরের ছাদ আর পায়ের নিচের জমিন সব অদৃশ্য মনে হলো তার।
কম্পিত গলায় মিরায়া আইডি কার্ডে থাকা নামটা নিজ মুখে আওড়ালো- “রি.. রি..রিভান চৌধুরী রা..রায়ান! রি..ভানন!”