প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৯
জান্নাত নুসরাত
ঘড়ির কাটায় ভোর প্রায় চারটা। পরিবেশে তখন নরম বাতাবরণ বইছে। সেই নিরম বাতাবরণ, নিস্তব্ধতা চিড়ে সৈয়দ বাড়ির সামনে পরপর এসে কয়েকগুলো গাড়ি থামল শব্দের সহিত হর্ণ বাজিয়ে। আবার কয়েকটা গাড়ি পাশ কাটিয়ে চলে গেল নাছির মঞ্জিলের দিকে। হেলাল সাহেব গাড়ি থেকে বের হয়ে দরজা লাগাতে নিবেন তার পূর্বেই উল্কা গতিতে হুরহুরিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল তার পাশ ঘেঁষে। আরেকটু কাছ ঘেঁষলেই নির্ঘাত তার মৃত্যু ঘটত। আকস্মিক এই ঘটনায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন ভদ্রলোক।
যখন মস্তিষ্ক ধরতে পারল হয়েছে কী, তখন খেঁকিয়ে উঠে পা বাড়ালেন সামনের সেই গাড়ির দিকে। গাড়িটা মাত্র নাছির মঞ্জিলের সামনের খালি জায়গায় পার্ক করা হয়েছে। একে একে সেই গাড়ির ব্যাক সিট হয়ে বেরিয়ে আসলো মমো, সৌরভি, আহান, ফ্রন্ট সিট থেকে বের হলো ইরহাম আর সবার শেষে ড্রাইভিং সিট থেকে খালি পায়ে বের হলো নুসরাত। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হওয়ায় সবুজ রঙের দূর্বা ঘাসগুলো ভিজে আছে, মেয়েলি পা দুটো জমিন স্পর্শ করতেই শীতল অনুভূতি হলো পায়ের নিচের তালুতে। মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে, পা দিয়ে দরজা লাগাল। সামনের দিক থেকে পিছু ফিরতেই চোখাচোখি হলো হেলাল সাহেবের সাথে। নুসরাত ঝাপসা দেখল মাথা ব্যথায়, চোখের পাতা ঝাপটিয়ে শুধাল,”কী চান?
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
হেলাল সাহেব খড়খড়ে কন্ঠে বললেন,
“কী চান, মানে কী..! এক্ষুণি যে তুই আমায় মেরে ফেলতে চাইলি এর জবাব কে দিবে?
নুসরাত বিরক্ত কন্ঠে বলে ওঠল,
” মরে তো যাননি, মরে গেলে না হয় সে প্রশ্নের উত্তর দিতাম।
নুসরাত হেলাল সাহেবকে গোলকধাঁধায় ফাসিয়ে দিয়ে ভ্রু কুঁচকাল। সামনে থেকে সরতে না দেখে পরপর জানতে চাইল,”আপনি কিছু বলতে চাইলে সেটা পরিস্কার করে বলুন, নাহলে সামনে থেকে সরুন, এমন পেঙ্গুইন এর মতো মুখ বানিয়ে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকার মানে কী?
হেলাল সাহেব চোখের আকার বড় করে নিলেন। নিজের দিকে আঙুল তাক করে বিস্ময় প্রকাশ করে বলে শুধালেন,”আমি পেঙ্গুইন?
নুসরাত ভাবলেশহীন দাঁড়িয়ে রইল। ভনিতাহীন গলায় বলল,”অবশ্যই, আপনি বড় পেঙ্গুইন, আপনার বড় ছেলে একটা পেঙ্গুইন, ছোট ছেলে একটা পেঙ্গুইন, আপনার পুরো পরিবারটা-ই একটা পেঙ্গুইন!
হেলাল সাহেব রাগে প্রায় ঝাঁঝিয়ে উঠলেন। তেতো কন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,”কোন দিক থেকে আমাদের পরিবারকে পেঙ্গুইন এর মতো লাগে তোর কাছে?
“কোনদিক থেকে না লাগে সেটা জিজ্ঞেস করুন!
নুসরাত মাথায় ব্যথায় চোখে কোনো কিছুই দেখছে না, তারপরব হেলাল সাহেবের সাথে পায়ের সাথে পা লাগিয়ে ঝগড়া করছে। এমনকি হেলাল সাহেবের সাথে কথা বলতে বলতে বার কয়েক চোখ ঝাপটাল। চোখের সাদা বর্ণের অংশে লাল শিরা উপশিরা তখন ভেসেছে অনেক জায়গায়। হেলাল সাহেব রাগে ফোঁস করে উঠে শুধালেন,”কোনদিক থেকে পেঙ্গুইন লাগে বল?
“এই তো মাত্র পেঙ্গুইন এর মতো লাফিয়ে উঠলেন, আর কী বলব! আপনাদের পরিবারকে পেঙ্গুইন বললে অপমান করা হবে, আই থিংক আপনাদের সাথে ব্যঙের পরিবার এই শব্দটা বেশি মানাবে।
ইরহাম আহানা মিটিমিটি হাসল ঠোঁটে হাত চেপে। হেলাল সাহেব নাকের পাটা ফুলিয়ে বলে ওঠলেন,
” তুই এখন রীতিমতো আমাকে অপমান করছিস।
“আমি এখন থেকে আপনাকে অপমান করছি না, এতক্ষণ যাবত ধরে অপমান-ই করছিলাম।
হেলাল সাহেব রাগে ফোঁসফোঁস করলেন। ব্যঙের মতো হা করে শ্বাস ফেললেন নিজেকে সামলানোর বৃথা প্রচেষ্টায়। জিজ্ঞেস করলেন,” আর এটা তুই দম্ভ নিয়ে বলছিস ও?
নুসরাত মাথা নাড়িয়ে বলল,
“অবশ্যই, নুসরাত নাছির সত্য বলতে কখনো পিছ পা হয় না। যদি আমার বলা বাক্যে দুনিয়ায় আগুন লেগে যায় তবুও আমি আমার এই সত্য বলা মুখ বন্ধ করব না।
“তোর মুখ থেকে বের হওয়া বাক্যে দুনিয়ায় আগুন না লাগাতেও পারলে বর্তমানে আমার মাথায় আগুন লাগিয়ে দিয়েছে।
নুসরাত ভ্রু যুগলের মধ্যিখানে মেকি চিন্তার ভাঁজ ফেলে বলল,”তাহলে তো এক্ষুণি আপনার মাথা ঠান্ডা করার জন্য একড্রাম কেরোসিন ঢালতে হবে। এই ইরহাম একটু কেরোসিন ঢেলে দিস, শ্রদ্ধেয় ইসরাতের শ্বশুরের মাথায়।
নুসরাত শেষের কথা টেনে টেনে বলে শেষ করল। হেলাল সাহেবকে পুরো চেতিয়ে দিয়ে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে এগিয়ে গেল নাছির মঞ্জিলের দিকে। যেতে যেতে দেখল সৈয়দ বাড়ির ইয়া বড় গেটটা পুরো খুলে দেওয়া হয়েছে। বধুবরণের জন্য মা-চাচিরা হাতে ঢালা নিয়ে দাঁড়িয়ে, এমনকি বাড়িটার চারপাশে বিভিন্ন প্রকার আতশবাজি ফোটানো হচ্ছে। জায়িন একহাতে ইসরাতের লেহেঙ্গা সামলে তাকে নিয়ে প্রবেশ করছে সৈয়দ বাড়ির ফটকের অভ্যন্তরে। নুসরাত যত দ্রুততা নিয়ে এসেছিল নাছির মঞ্জিলের ভেতর প্রবেশ করার জন্য ততটা ঝিমিয়ে পড়ল বোনকে ওই বাড়ির অভ্যন্তরে যেতে দেখে।
নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইল ততক্ষণ যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরাতের প্রতিবিম্ব দেখা যায় ফটকের সামনে৷ ইসরাত গেটের আড়ালে ঢেকে যেতেই নুসরাত চোখ ফিরিয়ে আনতে নিল সেদিক থেকে, তখনই চোখাচোখি হলো আরশের সাথে। নুসরাত তড়াক করে চোখ সরিয়ে এনে হাতের চাবি দিয়ে তালা খুলতে ব্যস্ত হলো। আশপাশ না দেখেই তড়িৎ গতিতে বাড়ির ভেতর এসে প্রবেশ করল। গরম লাগল ভীষণ তাই গা থেকে টেনে হিঁচড়ে খুলল কালো গ্রাউনটা। ছুঁড়ে মারল কাউচে। দ্বিধাহীনভাবে নেচেকুঁদে ঢুকল নিজের রুমে। কাবার্ড খুঁজে ফিনফিনে নরম কাপড় বের করে আনল। গায়ে জড়াতেই কিছু একটা মনে পড়ল তার! একহাতে মোটা একটা ব্যাগ বাহুতে চেপে ধরে দৌড়াল সৈয়দ বাড়ির দিকে। সৈয়দ বাড়ির গেটের সামনেই হেলাল সাহেবের সাথে দেখা হলো নুসরাতের। দু-জনে দু-জনের দিকে খেপাটে চোখে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ। পরপর নুসরাত মুখ ঝামটা মেরে হেলাল সাহেবের থেকে চোখ সরিয়ে নিল। হেলাল সাহেব জিজ্ঞেস করলেন,”এখানে কী?
নুসরাত হেলাল সাহেবকে পাত্তা দিল না। একপ্রকার ধাক্কা মেরে যেতে যেতে বলে ওঠল, “আমার দাদার বাড়ি এসেছি, কাউকে উত্তর দিতে বাধ্য না!
হেলাল সাহেব ব্যগ্র কন্ঠে বলে ওঠলেন,
“তেরো বছর মনে পড়ল না দাদা বাড়ির কথা, আর এখন মনে পড়ল কেন, কারণ জানতে পারি?
নুসরাত ঘাড় বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্য করে হাসল হেলাল সাহেবকে। উপহাস করে বলে ওঠল,”কিছু মানুষ কব্জা জমিয়ে বসেছিল, তাই আসতে পারিনি, এখন যখন এসেছি আর কেউ বের করতে পারবে না এ বাড়ি থেকে। লাশ হয়ে না হয় একদম বের হবো, তার আগে না।
নুসরাত সৈয়দ বাড়ির চৌকাঠে ডান পা রাখতেই নিজের পাশে আরেকটা ছায়ার উপস্থিতি পেল। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকাতেই চোখাচোখি হলো পাশেরজনের সাথে। নুসরাত এক পা সামনে বাড়িয়ে আবার পিছিয়ে নিল, মনে হলো কানের কাছ ঘেঁষে হেলাল সাহেব তেরো বছর আগের মতো করেই বলছেন,’আজ, এক্ষুণি, এই মুহুর্তে, তুই আমার বাড়ি থেকে বের হো!
নুসরাত চোখের পাতা ঝাপটাল। চোখ বুজে নিয়ে নিঃশ্বাস টেনে নিল ভেতরে। চোখ খুলে ডান-পা সামনে বাড়াতেই শক্ত হাতের ভেতর নিজের হাতের অস্তিত্ব পেল। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার প্রয়োজন বোধ করল না, গাড় কুস্তুরির সুগন্ধি নাকে প্রবেশ করতেই বুঝে নিল কার হাত চেপে ধরেছে তাকে!
সদর দরজার সামনে পানি ভর্তি পাত্রে গোলাপ ছিটিয়ে রাখা সেখানে পা ধোয়ানো হচ্ছে ইসরাতের। মমো ঝুঁকে বসে পানির মধ্যে ইসরাতের পা ভালো করে ধোয়াচ্ছে। যখন পা ধোয়ানো শেষে উঠে দাঁড়িয়ে হাত পেতে দিল বকশিস এর জন্য তখন ইসরাত চোখ সরু করে জিজ্ঞেস করল,” আমার কাছ থেকে টাকা নিবি তুই?
মমো অবাক কন্ঠে বলে ওঠল,
“তো নিব না, আমি তোমার পা ধোয়েছি।
মাহাদি জায়িনের পেছন থেকে উঁকি মেরে বলে ওঠল,
“তুমি কী কাজের-ঝি, ওদের কাছ থেকে টাকা নিবে?
মমো তেতিয়ে উঠল। ভ্রু-যুগলে ভাঁজ ফেলে জানার ভঙ্গিতে প্রশ্ন ছুঁড়ল,” টাকা নিলে কী কেউ কাজের-ঝি হয়ে যায়?
মাহাদি উপর নিচ মাথা নাড়িয়ে সরল স্বীকার উক্তি দিল,”আমার জানা মতো কাজের-ঝিরা টাকা নেয়, কাজ করে দিল।
মাহাদির মুখ থেকে বের হওয়া কাজের ঝি শব্দটা বারবার শুনে মমোর মুখের রঙ পরিবর্তন হতে শুরু করল। মনে হলো কেউ কানে সিসা ঢেলেছে তার। নিমেষেই গা জ্বলে উঠল, ঝাঁঝ মিশ্রিত কন্ঠে কিছু বলতে নিবে নুসরাত ধাক্কিয়ে এসে পাশ ঘেঁষে দাঁড়াল মমোর। মুরব্বিদের মতো থু করে পানের পিক ফেলে বলে ওঠল,” হইছে আর ঝগড়া করতে হইব না।
লিপি বেগম নুসরাতকে এমন পান খেয়ে লাল ঠোঁট করে নেওয়ায় অবাক হলেন, আবারো অবাক হলেন হঠাৎ তার আগমনে, পরপর দুটো অবাকতা গিলে নেওয়ার পূর্বেই নুসরাত নিজের ইয়া মোটা ব্যাগ থেকে টাকার বান্ডিল বের করল। জায়িনের দিকে তাকিয়ে হিহি করে হেসে বলে ওঠল,”আজ একটু বেশিই আপনাকে সুন্দর লাগছে তাই নজর কাটাতে চলে আসছি।
কথা শেষ করে থু থু করে পিক ফেলল। পান সচারাচর না খাওয়ায় পানের পিক ভুলে গিলে নিল আর এতেই বিকৃত হলো মুখশ্রী-র, অতিরিক্ত তেতো পান হওয়ার ধরুণ মুখের গঠন বদলে নিল, ওয়াক করে পিক ফেলল, না চাইতেও মুচড়ে উঠল শরীর।
নুসরাত আবারো পান চাবিয়ে নিয়ে বলে ওঠল,
“তাহলে নজর কাটিয়ে নিই..!
লিপি বেগম নুসরাতের ব্যবহারে ভীষণ খুশি হলেন, তাহলে মেয়েটা মিলছে তার ছেলেদের সাথে। বাড়ির কর্তীরা তাকে বিশ্বাস করলেও ইরহাম, আহান, ইসরাত, জায়িন এমনকি কয়েকদিন পূর্বে পরিচিত হওয়া মাহাদি বিশ্বাস করল না তাকে। আরশের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বলে ওঠল,”তোর বউটার ভেতর ঘাপলা আছে, দেখবি নির্ঘাত কিছু একটা করবে, এত পিরিত জায়িন ভাইয়ের সাথে আমি ঠিক মেনে নিতে পারছি না। এই দেখ আমার দম গলার কাছে এসে আটকে আছে।
মাহাদির এত কথার বিপরীতে আরশ শীতল কন্ঠে বলল,”নজর কাটিয়ে টাকা ওর ওই ব্যাগে ঢুকিয়ে নিবে।
মাহাদি বিশ্বাস-ই করল না। হেসে উড়িয়ে দিল আরশের কথাটুকু। বলল,” না এমন করবে না, নজর উঠানোর টাকা আবার কে ব্যাগে ঢোকায়, অন্যকিছু করবে ও!
“কেউ না ঢোকালেও নুসরাত নাছির ঢোকাবে নিজের ব্যাগে।
মাহাদি দু-পাশে মাথা নাড়িয়ে বলে ওঠল,
” এমন কিছু করবে না, এতটাও খারাপ না তোর বউ, এর থেকে বেশি খারাপ!
আরশ কথা বলল না, প্রয়োজন বোধ করল না এই খাটারা এর কথার উত্তর দেওয়ার। এর মধ্যে নুসরাত টাকা জায়িনের মুখের আশপাশ ঘুরিয়ে নিজের বেসুরা গলায় গলা ছেড়ে গাইল,
“Teri Nazron Ke Sadke
Yeh Jaan Vaar Doon Ga
Tu Jo Keh De Tou Apna
Jahan Vaar Dunga
Maine Maula Se Teri Meri
Duniya Hai Maangi
Woh Jo Likh De Tou Usko Hi
Haq Maan Lunga…
টাকা দু-জনের মুখের আশেপাশে ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের ইয়া বড় ডাফল ব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। এটা দৃষ্টি সীমায় পড়তেই আরশ ঠোঁট টিপে হাসি ঢাকার চেষ্টা করল, সফলও হলো! মাহাদি তড়াক করে আরশের দিকে তাকিয়ে বিমূর্ত কন্ঠে বলে ওঠল,”এ্যাহ, এটা কী ভাই? সত্যি করে বল আরশ, তোর শ্বশুর কী খেয়ে একে জন্ম দিয়েছে, আই মিন শাশুড়ি! এমন কেন তোর বউটা?
আরশ মাহাদির জবাবে বিড়বিড় করে একটাই কথা বলল,”ও এমন বলেই আমার বউ, এমন না হলে অন্য কারোর বউ হতো!
আরশের বিড়বিড় মাহাদির কান অবধি পৌঁছাল না লিপি বেগমের উঁচু আওয়াজে। তিনি সামান্য কড়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করছেন,” টাকাগুলো তুমি তোমার ব্যাগে ঢুকিয়ে নিয়েছ কেন, এগুলো গরীব মিসকিনকে দিবে না?
নুসরাত অবাক সুরে বলে ওঠল,
“ওমা, গরীব মিসকিনকে কেন দিব টাকা, এই বাড়িতে সবচেয়ে বড় গরীব-ই তো আমি, তাহলে বাহিরে দিয়ে হবে কী!
লিপি বেগম নুসরাতের এমন কথায় বিরক্ত হলেন। আওয়াজ আরেকটু উঁচু করে বললেন,” এ কেমন কথা! যদি টাকা না দাও তাহলে নজর তুলেছ কেন?
লিপি বেগমের প্রশ্নে নুসরাত মোটেও দমে গেল না। নিজে দ্বিগুণ জোরে লিপি বেগমের প্রশ্নের বিপরীতে উত্তর দিল,”আপনার এই পান্ডার মতো দেখতে ছেলে যেন আমার বোনকে নজর না লাগায় তাই নজর তুলেছি, এখন টাকা গুলো আমি নিজের কাছে রাখিনা আচার দিয়ে খাই আপনার মাথা ব্যথা কোথায় বড় আম্মু! টাকাগুলো তো আমার!
লিপি বেগম আরশের দিকে তাকালেন। আয়েশ করে ছেলেকে পকেটে হাত পুরে দাঁড়িয়ে ঝগড়া দেখতে দেখে বললেন,”দেখছিস তোর বউ কী করছে!
“বড় আম্মু আপনি নালিশ দেওয়া এখন থেকে শুরু করেছেন, আপনি তো পাড়ার কুচুটে বুড়িদের মতো কুচুটে শাশুড়ি হবেন। আপনার ছেলের বউদের জন্য কষ্ট হচ্ছে। বেচারি….
নুসরাত মুখ দিয়ে চুকচুক করে শব্দ বের করল। দুঃখ প্রকাশ করা আর হলো না লিপি বেগম এসে চেপে ধরলেন তার কান। বলে ওঠলেন,” কুচুটে শাশুড়িরা বউদের পিঠে দু-য়েক ঘা দেয়, তোকেও কয়েল ঘা লাগিয়ে দেই?
নুসরাত নাক ফুলিয়ে নিজের কান ছাড়িয়ে আনল লিপি বেগমের থাবার হাত থেকে। কথার উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলতে নিবে আরশ এসে দাঁড়াল দু-জনের মাঝে দেয়াল হয়ে। নুসরাতের কাঁধে থাকা ডাফল ব্যাগ ঈগলের মতো ছু করে নিয়ে নিল নিজের হাতের মুঠোয়। ব্যাগের ইলাস্টিক খুলে টাকার বান্ডিলটা বের করল। প্রথমে একশত টাকার একটা নোট থাকলেও ভেতরে সব দু-টাকা। আরশ ভ্রু কুঞ্চন করে নুসরাতের কাছে জানতে চাইল,”এখানে কতটাকা?
নুসরাত হিহি করে হাসল। বলল,
“মোট তিনশত টাকা।
আরশ সেই টাকা নিজের হাতে রেখে নিজস্ব গুরু গম্ভীর কন্ঠে বলে ওঠল,”মাম্মা ওর কথায় তুমি চ্যাঁচাও কেন, তোমাকে জ্বালাতেই এমন করে!
লিপি বেগম ছেলেকে মুখ ঝামটা মারলেন। উল্টো তাকে ভেঙ্গিয়ে বললেন,”কে বলছে দেখো, যে নিজে হাঁটতে, বসতে,বউয়ের কথায় চেঁচায়।
আরশ শীতল দৃষ্টিতে এক পলক মাকে দেখে নিয়ে পকেটে হাত ঢোকাল। নুসরাতের ব্যাগ থেকে বের হওয়া তিনশত টাকা লিপি বেগমের কাছে হস্তান্তর করে দিতেই নুসরাত চ্যাঁচাল,” এটা কী করলেন, ওগুলো আমার টাকা!
আরশ বিরক্ত গলায় বলল,
“এনয়িং পার্সন, আমরা জানি এগুলো আপনার টাকা। চ্যাঁচিয়ে সোসাইটির মানুষ জমা করতে হবে না এই ভোরবেলা।
আরশের তাচ্ছিল্যতায় নুসরাত মুখ ঝামটা মারল। চুল উড়িয়ে চলে যেতে নিবে আটকে গেল সে, যখন ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল তখন তার হাতের মধ্যে টাকা ধরিয়ে দিল আরশ। অবাক কন্ঠে কিছু বলতে নিবে তার মুখ আটকে দিয়ে গম্ভীর মুখে জায়িন আর ইসরাতের মুখের সামনে সেই টাকাগুলো ঘোরাল, এমনভাব করল যেন এখানে কী হচ্ছে তা তার বোধগম্য নেই। এমনকি সে যে নুসরাতের হাত জোর করে চেপে ধরে নতুনভাবে বিয়েতে আবদ্ধ কাপলের নজর তুলছে তা ও কাউকে বুঝতে দিল না। ইসরাত, আরশ আর নুসরাতের সামনে দাঁড়িয়ে ঠোঁট টিপে হাসল। হাসি আটকানোর চেষ্টা করলেই নুসরাতের ভড়কে যাওয়া চেহারা দেখে হাসি আটকানো তার পক্ষে কষ্টদায়ক হয়ে উঠল।
ফজরের আজান দিয়েছে তখন। সৈয়দ বাড়ির বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ পুরুষসহ সকলেই নামাজে গিয়েছেন। আহান আর ইরহাম নামাজে যায়নি তাদের নাকি কী কাজ বাড়িতে আছে, আর নুসরাত সাতদিনের জন্য নামাজ থেকে ছুটি পেয়েছে তাই সেও নিশ্চিন্ত মনে পা তুলে বসে আছে সোফায়, নামাজ পড়ার কোনো চাপ নেই। এর মধ্যে সেখানে আবির্ভাব ঘটল ইরহাম আর আহানের। তারা আসতেই নাছির মঞ্জিলের ড্রয়িং রুমে গোল মিটিং শুরু হলো। গোল মিটিং এ আজ সৌরভি, মমো, ইসরাত নেই, শুধু আছে নুসরাত, আহান, ইরহাম। নাজমিন বেগম সারাদিনের ক্লান্তি কাটাতে শুয়ে পড়েছেন নিজ রুমে, আত্মীয় স্বজন সবাই প্রায় চলে যাওয়ায় আজ কোনো উল্লাস নেই এ বাড়িতে, ঠান্ডা পড়ে আছে গত দু-দিনের তুলনায়। কিন্তু ও বাড়িতে যেন আজ ঈদের আনন্দে সবাই মেতেছে, ভোর হতে চলল এখনো পর্যন্ত সেখান থেকে মানুষের গমগম সুর, পুরুষদের গল্পের আওয়াজ ভেসে আসছে।
গোল মিটিং করার পর কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারায় চিন্তায় উঠে দাঁড়াল এতক্ষণ আরাম করে সোফায় বসে থাকা নুসরাত। গোল গোল করে পায়চারি করল। পাগলের মতো চক্কর কাটতে কাটতে ইরহামকে উদ্দেশ্য করে বলে ওঠল,”ইসরাতের জায়গায় কনে সেজে কে বসবে?
ইরহাম আগের মতো আহানের দিকে ইশারা করল। দু-জনেই আহানের দিকে একসাথে ঘুরে তাকাতেই আহান মৃদু সুরে আর্তনাদ করে উঠল। মিটিং চলাকালে যেমন করে বলেছিল তেমন করে আবারো হাপিত্যেশ করে বলল,”না আমি বলির পাঠা হবো না, একটু আগে খাওয়া হাই হিলের বারির এখনো পর্যন্ত ব্যথা কমেনি আর তুমি এখন আরেকটা খাওয়ানোর জন্য আমার পিছু নিচ্ছ।। না বাবা না, আমি এসবে নেই..!
নুসরাত আহানের কাছ থেকে হতাশ হয়ে ফিরে আসায় ঝিমিয়ে পড়ল, অলস ভঙ্গিতে নিজের শরীর ছেড়ে দিল সোফায়। ঠোঁটের কোণে অসহায়ের মতো হাসি ঝুলিয়ে চোখা দৃষ্টিতে ইরহামের দিকে তাকাতেই ইরহাম নিজেও দু-পাশে মাথা নাড়ল। নুসরাতকে ভৎসনা করে বলে ওঠল,”আমি বসব না আগেই বলে দিচ্ছি, অন্য ব্যবস্থা কর।
নুসরাত কপালে ভাঁজ ফেলে উঠে দাঁড়াল, বুঝল আজ এরা তার কথা শুনবে না, তার ভাইগুলো তার ভাই থাকেনি, সবগুলো বদলে গেছে। কাকে বসিয়ে প্ল্যান অনুযায়ী কাজ করা যায় সেটা মাথায় না আসায় দু-পাশে পায়চারি করল ব্যস্ত ভঙ্গিতে। ঠোঁট চেপে একটাই কথা বিড়বিড়াল,”কাকে বসানো যায়, কাকে বসানো যায়..!
যখন বিশ্বাস যোগ্য কাউকে পেল না, ঠোঁট এলিয়ে হেসে আহানের দিকে তাকাল মিনতি করার জন্য। স্নেহময় কন্ঠে বলে ওঠল,”তুই আমার সোনা ভাই না, তুই বসবি না? আপুর কথা শুনবি না?
আহান সহজ কন্ঠে নাক ফুলিয়ে নাকচ করল,
“আমি তোমার কোনো সোনা রুপা, তামার ভাই না, তাই আজ আমি তোমার কথা শুনবও না আর বসবও না।
নুসরাত ঠোঁট কুঁচকে নিল। বিকৃত মুখে গালি দিল,
“বাল দুটোকে এমনি এমনি পেলে পুষে বড় করেছি।
ইরহাম নুসরাতের কথায় ভুল ধরিয়ে দিয়ে শুধরে দিল,
“তেরো দিনে বড় আমি তোর থেকে।
ইরহামের কথা শেষ হতেই তার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল নুসরাত। নুসরাতকে ইমোশনাল ব্ল্যাকমিলের প্রস্তুতি নিতে দেখে ইরহাম ঘাড় অন্যদিকে বাঁকিয়ে ভাব নিয়ে হাত দিয়ে না করে দিল। নুসরাত টু শব্দটি করার জন্য মুখ খুললেও তা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিল সে।
অনেকক্ষণ নিশ্চুপ সময় কাটল তাদের মধ্যে। নুসরাত যখন চিন্তায় চিন্তায় মাথা ফাটানোর অবস্থা ইরহাম চ্যাঁচিয়ে উঠে বলল,” আইডিয়া!
নুসরাতের মলিন মুখে আশার আলো জ্বলে উঠল। জ্বলজ্বল করতে থাকা মণি নিয়ে শুধাল,”কী আইডিয়া?
ইরহাম কৌতূক করে ভিটকেল মার্কা হাসল। শেষবারের মতো গলা খাঁকারি দিয়ে পরিস্কার করে নিয়ে নির্বিকার চিত্তে বলে ওঠল,”সবসময় আমরা পুরুষ মানুষ কেন বলির পাঠা হবো, তুই মেয়ে আছিস তাই আজ বলির পাঠা হবি তুই, বাসর ঘরে কনের সাজে বসবি তুই!
ইরহামের কথায় ফোঁস করে নিভে গেল নুসরাত। আশার আলোয় জ্বলে উঠা চোখ গুলো দপ করে হারিয়ে গেল মলিনতার ভীরে। মিনমিনিয়ে বলল,”আমি কীভাবে?
ইরহাম চ্যাত করে উঠে বলল,
“আমি কীভাবে, মানে কী, আমরা পুরুষ মানুষ বসতে পারলে, তুই মেয়ে মানুষও বসতে পারবি।
আহান ইরহামের সাথে সহমত পোষণ করল। নুসরাতকে দেনামোনা করতে দেখে ইরহাম বলে ওঠল,”আজ তুই বসবি মানেই বসবি।। এই আহাইন্না আয়, ওরে ধর!
আহান আর ইরহাম এসে নুসরাতের বাহু চেপে ধরল। নুসরাত যেতে চাইল না, তাকে একপ্রকার দু-জন মিলে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চলল তাকে সৈয়দ বাড়ির উদ্দেশ্যে।
সৈয়দ বাড়ির সদর দরজা দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে ভেতরে ঢোকাতেই সম্মুখীন হলো অনেকের। চেনা অচেনা মানুষকে দেখে নুসরাত গা ঝাড়া দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার বাহু ধরে টেনে আনা ইরহাম আর আহান ও চুপটি করে দাঁড়াল। মুখে তিনজনের নিষ্পাপ ভাব, যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না। সবাইকে অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকাতে দেখে তিনজনই হাসল হে হে করে সুর ধরে। ভদ্র ভঙ্গিতে মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে সুরসুর করে একে অন্যের পিছু পিছু চলে গেল। জায়িনের রুম কোনটা না চেনায় নুসরাত নকবিহীন সর্বপ্রথমই খোলা একটা রুমের ভেতর ঢুকে গেল, পরমুহূর্তে আবার ফরফরিয়ে বেরিয়ে আসলো বাহিরে। আহান আর ইরহাম কে আছে জানতে চেয়ে উঁকি দিতে চাইল ওই রুমে নুসরাত বগলদাবা করে নিয়ে চলে গেল। শুধাল,” জায়িন ভাইয়ের রুম কোথায়? গাধার মতো আমাকে আগে পাঠাচ্ছিস কেন? আমি কিছু চিনি এ বাড়ির?
ইরহাম সন্দেহি চোখে নুসরাতকে অবলোকন করে জানতে চাইল”ওই রুমে কী দেখেছিস তুই?
নুসরাত ঢোক গিলে তাকাল ইরহামের দিকে। চ্যাঁচিয়ে উঠে তার কাছে জানতে চাইল,”আমাকে দেখে মনে হচ্ছে কিছু দেখেছি?
ইরহাম নুসরাতের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে কানে কানে বলল,
“ওই রুম কিন্তু আরশ ভাইয়ের, উনি ফজরের নামাজ পড়তে যায়নি, বলেছে রুমেই পড়বে৷ আমি নিশ্চিত তুই কিছুমিছু দেখেছিস।
নুসরাত ঝাঁঝ মিশ্রিত কন্ঠে বলে ওঠল,
” তো, দেখলে তোর সমস্যা কী?
ইরহাম চতুরতা নিয়ে হেসে সরাসরি প্রশ্নের ভান ছুঁড়ল,
“তার মানে তুই বলতে চাচ্ছিস, কিছু দেখেছিস?
ইরহামের খবিশের মতো হাসিতে নুসরাতের মুখে বিতৃষ্ণা ফুটে উঠল। হাতের তালু তুলে থাবা মেরে বসল মুখের চামড়ায়। হিংস্র বাঘিনীর মতো চ্যাঁচিয়ে উঠে সাবধান করল,”একদম খবিশের মতো আমার দিকে তাকিয়ে হাসবি না। তোকে এমন করে হাসতে দেখলে ইচ্ছে হয় চুলের মুঠি চেপে ধরে সালফিউরিক এসিডে ডুবিয়ে দেই।
ইরহাম তবুও হাসল। জায়িনের রুমে নকবিহীন আগেভাগে ঢুকতে নিলে নুসরাত নিজের এক্সেস মতো সজোরে কোমরে একটা লাথি বসাল। আঙুল তুলে শাসাল,”আজ শুধু হাসার জন্য লাথি মেরেছি পরেরবার লাথি মারব না ঘুমের ঘোরে মেরে ফেলব একদম।
ইরহাম নুসরাতকে ভেঙ্গাল। আহান নুসরাতের মতো হু হা করল। অঙ্গ ভঙ্গি মারের মতো করে এসে প্রবেশ করল জায়িনের রুমে। ইসরাত কাপড় চেঞ্জ করেনি তখনো, দরজা ঠেলে বানর পাটিকে ঢুকতে দেখে কিছুটা হতবাক হলো। আর তা চেহারায় ফুটে উঠল অবলীলায়, বিস্ময় প্রকাশ করে কিছু বলতে নিবে নুসরাত হাতের ঘড়ি দেখল। বলল,”সময় নেই, কাপড় চেঞ্জ করে আয় ঝটপট!
ইসরাত নুসরাতের কথায় প্রশ্ন করল,
” কাপড় চেঞ্জ করব কিন্তু কেন?
আহান ইসরাতের প্রশ্নের উত্তর দিতে বলে ওঠল,
“তা ছোট ভাইয়া তোমাকে যেতে যেতে বোঝাবো আপু, তাড়াতাড়ি কাপড় চেঞ্জ করে আসো।
ইসরাত কড়া কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,
” আবারো উল্টোপাল্টা কিছু করার ধান্দা আছিস তোরা?
নুসরাত ইসরাতের কথা মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে উড়িয়ে দিল। বলল,”আমরা সবসময়ই উল্টাপাল্টা করার ধান্দায় থাকি, সেটা অন্য বিষয় যে কখনো একদম সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছাই না।
ইসরাতের মুখের উপর ফুটে উঠা কঠিনত্ব নিমেষে সরে গেল ওদের কথায়। কড়া ভাষায় কিছু বলতেও পারল না, সবার নিষ্পাপ চেহারা দেখে। ইসরাত কিছু বলতে নিলেই মুখ পাউট করে তিনটা একসাথে তার মুখের কাছে এসে নিজেদের নিষ্পাপ প্রমাণ করার ভঙ্গি করছে। এমন হাবভাব দেখে ইসরাত না চাইতেও হেসে দিল। কাবার্ড থেকে কাপড় বের করে নিয়ে যেতে যেতে সবার উদ্দেশ্যে বলল,”তোদের জঘন্য লাগে এমন মুখ বানালে!
তিনটা একসাথে সমস্বরে বলল,
“আচ্ছা..!
ইসরাত কাপড় চেঞ্জ করে আসতেই বারান্দার সামনে নিয়ে দাঁড় করাল নুসরাত তাকে। ইসরাতের কোমরের কাছে দড়ি বাঁধল যাতে রেলিঙ থেকে পা পিছলে পড়ে কোমর না ভেঙে ফেলে, এমনকি যদি ভুলবশত পড়ে যায় সেজন্য সবুজ ঘাসে ফম বিছিয়ে রেখেছে ইরহাম, আহান মিলে। ইসরাত রেলিঙ বেয়ে নেমে গেল আল্লাহর নাম নিয়ে, এরপর মইয়ের উপর ভর দিয়ে সুস্থ স্বাভাবিক একদম নিচে নেমে গেল। সৈয়দ বাড়ির ইরহাম, আহান ছাড়া কেউ-ই জানতে পারল না, বিয়ের রাতে বউকে নিয়ে চলে গেছে তার ভাই বোন আবার।। ইরহাম ফম পেঁচিয়ে নিয়ে স্টোর রুমে রাখল, মই, দড়ি সব জায়গা মতো রেখে নুসরাতকে থামজ আপ দেখিয়ে পালাল নাছির মঞ্জিলে। সে জানে নুসরাত ফাসবে, ওই আরশ ভাই তাদের উল্টো বেঁধে রেখেছিল আর বড় ভাইয়া নিশ্চয়ই নুসরাতকে রেলিঙের সাথে উল্টো বেঁধে রাখবেন। নুসরাত সবাই চলে যেতেই বারান্দায় দাঁড়িয়ে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। নিজেকে সাহস দিল নুসরাত তুই পারবি বলে। নার্ভাসনেস একপাশে ফেলে যখন বারান্দা থেকে ফিরতে ঘুরে দাঁড়াল, বিপরীত মুখী বারান্দা থেকে শব্দ আসলো,”নুসরাত?
নুসরাত ভয়ে কেঁপে উঠল। ভয়ে পা লেগে আসলো মেঝেতে। নুসরাতের কান ঘেঁষে আবারো সেই তীব্র কন্ঠ বয়ে গেল,” ওহ ইসরাত এটা তুমি, স্যরি আমি অন্ধকারের জন্য চিনতে মনে হয় ভুল করেছি।
নুসরাত বন্ধ করে নেওয়া শ্বাস ফেলে দৌড় দিল রুমের ভেতর। হাত মুঠোয়ে চেপে নিজেকে সাহস দিল,নুসরাত পারবি তুই, পারবি!
ইসরাতের লেহেঙ্গার সাথে পরা দোপাট্টা দিয়ে নুসরাত নিজের মুখ ঢেকে নিল। চুপটি করে বিছানার একপাশে গিয়ে বসল কনের মতো করে পা উঠিয়ে। দু-মিনিট সময় অতিবাহিত হলো এর মধ্যে দরজা নব ঘুরিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল জায়িন। গায়ে সাদা পাঞ্জাবি জড়ানো, নুসরাত চোখ মুখ কুঁচকাল। আহানটাকে এখানে বসালেই ভালো ছিল, ভাওতাবাজির চক্করে এখন না নিজেই লজ্জার সম্মুখীন হয়। নুসরাতের হঠাৎ টনক নড়ল, আরে লজ্জা বলতে কোনো ডিকশিনারি-ই তো তার ভেতর নেই। অস্বস্তি, নার্ভাসনেসে হাত পায়ের তালু ঘামল অতি দ্রুত। নুসরাত একে তো নার্ভাস ছিল তার মধ্যে জায়িনের গম্ভীর কন্ঠ শুনে কেঁপে উঠল। নিজ চিন্তায় ব্যস্ত থাকায় ঠিকভাবে কর্নপাত হয়নি তা। হকচকিয়ে ওঠায়, অপ্রত্যাশিতভাবে মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসলো,”জি জ্বি জ্বিইইই!
জায়িন সূক্ষ্ম দৃষ্টি বুলাল নুসরাতের দিকে। ইয়া বড় ঘোমটা দেওয়ার মানে খুঁজে পেল না, এমনকি এত হাত ঘষার কারণটা কী তাও ধরতে পারল না। নুসরাতের পায়ের দিকে তাকাল এক পলক, তারপর আবার চোখ সরিয়ে নিল। মনে করল বাঁদরগুলো কোনো বাঁদরামি করেনি, ভরসা পেলে এটা ইসরাতের-ই পা। দু-য়েক সেকেন্ড পার হওয়ার পর জায়িন মিনমিন করে শুকরিয়া আদায় করল,”থ্যাংক গড, এরা বাঁদরামি করেনি।
নুসরাত হাত ঘষল। জায়িন এক পা আগাতেই নুসরাতের চোখ দুটো লাফিয়ে বের হতে নিল, নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে চুপচাপ বসাতে চাইলেও মনে মনে বলল, এই জায়িন ভাই তো দেখি আশিক, পুরো আশিক হওয়ার পূর্বেই নুসরাত ভাগ, না হলে হার্ট অ্যাটাকে তোর মৃত্যু নিশ্চিত। পরে দেখা যাবে নিউজ হচ্ছে, বোনের বাসর ঘরে ঢুকে বদমায়েশি করার চেষ্টা করায়, দম আটকে বসে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল তারা সৈয়দা নুসরাত নাছির, যে এই কম বয়সে দু-বাচ্চার মা হওয়ার কথা ছিল সেই বয়সে, অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ইন্তেকাল করেছেন।
প্রিয় প্রণয়িনী ২ পর্ব ৩৮ (৩)
নুসরাত আর ভাবতে পারল না, সামনে তাকিয়ে দেখল জায়িন বেডের পাশে এসে প্রায় দাঁড়িয়েছে। ওড়না ঢিল মেরে ফেলে দিতেই ঘোমটা সরে গেল, বেরিয়ে আসলো শ্যাম মুখখানি। জায়িন সামান্য ভরকাল নুসরাতকে দেখে। প্রথমবারের মতো সারাদিন লম্ফঝম্প করা বোন ভাবা মেয়েটাকে খেয়াল করল, হাত পা ফর্সা, একদম ইসরাতের মতো, শুধু মুখ ফর্সা নয়, যদি মুখ থেকে ঘোমটা না সরাত তাহলে ধরা খাওয়ার কোনো অবকাশই ছিল না। নুসরাত লাফ দিয়ে বেডের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নার্ভাস কন্ঠে ভ্যাবাচেকা গলায় বলে ওঠল,”জায়িন ভাই, আমি, এটা আমি, আপনার একমাত্র দুষ্টু, মিষ্টি, পিয়ারি, সুন্দরসি, শালিকা। হিহি..!