প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩১ (২)
সাইয়্যারা খান
কালো রঙের গাড়িটা পৌষকে নিয়ে এলো ভার্সিটির প্রাঙ্গনে। পৌষ ভীষণ উসখুস করছে। নামছে তো নামছে না। তৌসিফ চোখে থাকা সানগ্লাসটার আড়ালে তাকালো পৌষের দিকে। ওর ভাবভঙ্গি বুঝার চেষ্টা করে তৌসিফ। ফোনটা পকেটে রেখে জিজ্ঞেস করে,
“কোন সমস্যা হচ্ছে পৌষরাত?”
পৌষ আড়চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
” সমস্যা মানে? বিরাট সমস্যা। আমি এখানে নামব না। আমাকে গেটের দিকে নামিয়ে দিন।”
“তোমার ক্লাসের বিল্ডিং তো এটাই।”
“হুঁ। কিন্তু এখানে আমি নামব না।”
তৌসিফের কপালে ভাজ পড়লো। নামবে না কিন্তু কেন? পৌষ মুখ বাঁকা করে বললো,
“আমি হেঁটে ঢুকতেই কমফোর্ট পাই। এভাবে হঠাৎ করে আরেকজনের উপর পোদ্দারি করা আমার পছন্দ না।”
“কিহ?”
পৌষ দাঁত বের করে হাসলো। দুই আঙুল দিয়ে হাত চুলকে বললো,
“নামিয়ে দিন গেটের দিকে।”
“এখানেই নামবে। তোমার হাসবেন্ড হই আমি। পর কেউ না।”
“ছাতার মাথা।”
পৌষ দরজা ঠেললো। পারলো না। তৌসিফ এগিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে খুলে বললো,
“বাঁদরামো করো না। আমি নিতে আসব।”
“আমাকে বান্দর বললেন?”
“না, বলেছি বাঁদরামো না করতে।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“শুনুন, শয়তান যেমন শয়তানি করে তেমনই বান্দর করে বান্দরামি ঠিক যেমন কুত্তা করে কুত্তামি।”
বউয়ের যুক্তি তৌসিফকে হট খাওয়ালো। ও কিছু বলার আগেই পৌষ বেরিয়ে সোজা হেঁটে চলে গেলো। হাটলো না দৌড়ালো তৌসিফ বুঝলো না। সামান্য গাড়ি থেকে নামছে বলে এত অকওয়ার্ড কেন লাগবে ওর? আশ্চর্য!
গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো তৌসিফ তখনই তার ফোনে কল এলো। তাকিয়ে দেখলো বিদেশি নাম্বার। স্পিকারে রেখে রিসিভ করে গম্ভীর কণ্ঠে হ্যালো বলা মাত্রই ওপাশ থেকে ভাঙা গলায় ফিসফাস শুনতে পেলো তৌসিফ। মূহুর্তেই কপাল কুঁচকে গেলো ওর। তৌসিফ গাড়ি থামালো তারাতাড়ি। শান্ত মস্তিষ্কে বেশ ঠান্ডা কণ্ঠে ডাকলো,
“তুহিন?”
ওপাশে নীরবতা। অনেকক্ষণ নীরবতা চললো। তৌসিফ শুনলো ছোট ভাইয়ের প্রতিটি নিঃশ্বাস। তুহিন বেশ খানিক সময় পর ডাকলো,
“মেঝ ভাই।”
“কোথায় তুই?”
“মেঝ ভাই… ”
“হ্যাঁ, আমি শুনছি। তুই কোথায়? এটা কার নাম্বার?”
“মেঝ ভাই, আ..আমি আমি আসলে পালিয়ে এসেছি।”
বলেই ফুঁপিয়ে উঠলো তুহিন। তৌসিফ থমকে গেলো। ভাঙা গলায় ভাইকে শুনেই বুঝেছিলো খারাপ কিছু হয়েছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আসলেও তৌসিফ নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
“ভাইকে বল তুহিন, কোথায় তুই? কি হয়েছে?”
“মেঝ ভাই.. আমার ওখানে ভালো লাগে না। আমার ওখানে ভীষণ ঠান্ডা লাগে। ওরা আমাকে কম্বল দিয়ে পেঁচিয়ে রাখে। আবার আমার ভীষণ গরম লাগে। আমি লেকের বরফ পানিতে গিয়ে ডুব দিয়ে থাকি। আমার পায়ের তালু জ্বলে মেঝ ভাই। আমি ঘুমাতে পারি না। আমি আজকে চারদিন ঘুমাতে পারি না। ওখানে আমাকে কোন চিকিৎসা দিচ্ছে না৷ একটাও ঘুমের ঔষধ দেয় নি। আমার চোখেমুখে কেমন জানি ঝাপসা ঝাপসা লাগে। আমি ওখানে থাকলে মরে যেতাম মেঝ ভাই তাই পালিয়ে এসেছি। একজন ভদ্রলোক আমাকে এক গ্লাস বিয়ার দিয়েছে। ওটা খেয়ে একটু ভালো লাগছে কিন্তু আমার কাছে টাকা নেই। সে টাকা চাইছে। টাকা দেই নি দেখে… ”
তুহিন থেমে গেলো। তৌসিফ থম ধরা গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“মেরেছে?”
“হুঁ।”
“কোথায়?”
“ধাক্কা দিয়ে ফেলে লাথি দিয়েছে।”
“খুব ব্যথা পেলি?”
“খুব।”
তৌসিফ চুপ রইলো পরক্ষণেই জিজ্ঞেস করলো,
“এমাউন্ট বলতে বল। আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি।”
“মেঝ ভাই?”
“শুনছি।”
“চলে আসি? আর নেশা ছুঁয়েও দেখব না৷ প্রমিজ করছি।”
তৌসিফ চোখ বন্ধ করলো। চোখের সামনে ভেসে উঠলো তার ছেলেবেলা। অবাধ্য ছেলেপুলে তারা মায়ের আঁচল নিয়ে কাড়াকাড়ি করছে। মা তাদের খুব আদরে বড় করেছেন। বারবার বলেছেন তারা যেন কখনোই আলাদা না হয়৷ একসাথে থাকে। মায়ের কথাটা রাখা হলো না। একত্রে থাকা হলো না। তৌসিফ নীরবতা ছেড়ে বললো,
“আমি ওখানে ফোন দিচ্ছি। নিতে আসলে রিহ্যাবে চলে যাবে।”
“আচ্ছা।”
তুহিন এক শব্দে মেনে নিলো। তৌসিফ সাহায্যকারী ব্যাক্তিকে ধন্যবাদ জানিয়ে অতিরিক্ত কিছু টাকা পাঠিয়ে দিলো। রিহ্যাব থেকে যেই পর্যন্ত না গাড়ি এসে তুহিনকে নিলো ততক্ষণই তৌসিফ গাড়িতে বসে রইলো। যখন পুরোপুরি জানলো তুহিনকে নিয়ে গিয়েছে তখনই মাথাটা স্টেরিং এ রেখে শক্ত করে চেপে ধরলো। রাগে হাতের শিরা-উপশিরা স্পষ্ট হয়ে উঠলো তার। ফর্সা চামড়ায় বেশ ফুলেফেঁপে উঠেছে। তৌসিফ মাথা তুলে বাড়ি দিলো স্টেরিং এ। একবার দুইবার পরপর কয়েকবার। আশেপাশে কেউ নেই। খালি মাঠের একপ্রান্তে তৌসিফ। আচমকাই চিৎকার করে বললো,
“কেন এসেছিলে? কেন এসেছিলে আমার জীবনে? ধ্বংস করে দিলে তুমি সব।
সবটা নষ্ট করে দিলে। আমার দোষটা কি ছিলো? আমি কেন শাস্তি পেলাম? আমার মানুষ কেন হারালো? তুমি এত নিষ্ঠুরতা কিভাবে দেখালে আমাকে?”
বুকটা ওঠানামা করছে অতিদ্রুত। চোখের পাতায় ভেসে উঠে কতকিছু। কত স্বপ্ন, কত জল্পনা কল্পনা, কত ওয়াদা, হারিয়ে যাওয়া, ফিরে আসা, এক লহমায় ধ্বংস করে দেওয়া। সেই সাথে নষ্ট হওয়া সম্পর্ক। তৌসিফ কপাল চেপে রাখে। মাথা ব্যথা করছে তার। মুখে বিরক্ত উচ্চারণ করে তৌসিফ,
“উফ উফ, এখন তোমাকে প্রয়োজন ছিলো পৌষরাত। ভীষণ মাথা ধরেছে। তোমার হাতের জাদুতে অন্তত সাময়িক কষ্টই নাহয় কমিয়ে দিতে।”
প্রায় দুই ঘন্টা ওখানে থেকে গাড়ি ঘুরিয়ে নিলো তৌসিফ। সোজা অফিসে গিয়ে ইমুকে দিয়ে কফি আনিয়ে তা পান করলো। তখনই ইমু বললো,
“স্যার, একজন এসেছিলো। আপনাকে নাকি খুব জরুরি প্রয়োজন।”
“কে?”
“নাম সোহা বললো।”
তৌসিফের মুখভঙ্গি বদলালো না। একই ভাবে হাতের কাগজে সাক্ষর দিতে দিতে বললো,
“এগুলো ক্রস চেক কে করেছে?”
“সব তো টিম থেকেই করা। ক্রস চেকটা আমি করেছি। কোন সমস্যা স্যার?”
বেশ ভীতু কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ইমু। তৌসিফ এক পলক ওর দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,
“না, বেশ গোছানো ছিলো।”
“ধন্যবাদ স্যার।”
ইমুর ফোন আসে তখনই। রিসিপশন থেকে কল দিয়ে জানালো কেউ দেখা করতে এসেছে। ইমু তৌসিফের অনুমতি চাইলো,
“স্যার ঐ ম্যাম আবার এসেছেন৷ আপনি অনুমতি দিলে..। ”
“উমম, দশ মিনিট পর আসতে বলো।”
তৌসিফ দাঁড়ি চুলকালো। পৌষ প্রথম দেখায়ই বেশ বেয়াদবি করেছে সোহার সাথে। কে ওকে কতটুকু কি বলেছে তৌসিফ বুঝতে পারছে না তবে খুব ভালো কিছু নিশ্চিত কেউ বলে নি। কারো সাহস হয় না তৌসিফের সামনে কিছু বলার কিন্তু আড়ালে গেলেই নাম বদনাম। তৌসিফ গা এলিয়ে দুলে দুলে বললো,
“বুঝলে ইমু, মানুষ হলো সবচাইতে আজীব প্রাণী। এরা আগাও চায় আবার মাথাও চায়। জখমও করে আবার তাতে হলুদও ছিটায়। কারো মন চাইলে লবনও ছিটিয়ে যায়।”
“জি, স্যার।”
তৌসিফ চোখে হাসে। ইমু ছেলেটা আজ পর্যন্ত বললো না যে স্যার আপনি ভুল। সবটায় তার জি স্যার। ইমু সব গুছিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“তাকে আসতে বলব?”
“পাঠাও।”
ইমু যাওয়ার ঠিক এক মিনিটের মাথায় সোহা হাজির হলো কেবিনে। দ্রুত পা ফেলে কাছাকাছি আসতে নিতেই তৌসিফ হাত উঠিয়ে নিষেধ করলো। সোহা বসলো ওর সামনে। তৌসিফ ল্যাপটপ থেকে চোখ সরিয়ে প্রশ্ন করলো,
“কোন কাজ ছিলো সোহা?”
“কোন কাজ মানে কি তৌসিফ? আমি বাসায় গিয়েছিলাম, ডু ইউ নো হোয়াট হ্যাপেন্ড?”
তৌসিফ যেন কিছুই জানে না ঠিক তেমন ভাব করলো। তা দেখে সোহা বিভ্রান্ত হলো। সত্যিই কি তবে জানে না তৌসিফ? কেউ না বললেও তো মিনু বলার কথা। সোহা ঢোক গিললো। নিজেকে শক্ত করে বললো,
“তোমার ঐ বউ আমাকে অপমান করে বের করে দিয়েছে। প্রচুর বেয়াদব ঐ মেয়ে। ছোটবড় মানে না। চরম বেয়াদব বিয়ে করেছো তুমি।”
বেশ ঠান্ডা মেজাজে তৌসিফ হাতের ঘড়িতে সময় দেখলো। বললো,
“প্রথমত ওর নাম পৌষরাত। আর শুধু পৌষরাত কেন যে কোন মেয়ে আমার বউ হলে তোমার সাথে আমার বাড়ীতে ওমন ব্যাবহারই করবে। এর যোগ্য তুমি।”
“আমি শুধু মিনুকে দেখতে… ”
“উম, কথা শেষ হয় নি আমার।”
সোহা চুপ করে গেলো। তৌফিক দাঁড়িতে হাত বুলিয়ে বললো,
প্রেমসুধা সিজন ২ পর্ব ৩১
“তুমি নিজে নিজের অবস্থানের জন্য দায়ী। তুমি নিজে ঢোল পিটিয়ে জাহির করেছো নানান কিছু। এখন সহ্য করো। পৌষরাত বেয়াদব জায়গা বুঝে। নিশ্চিত আমার আগেই তোমার বিষয়ে কারো থেকে শুনেছে।”
সোহা মাথাটা নিচু করে নিতেই তৌসিফ একই ভাবে গা দুলাতে দুলাতে বললো,
“এঁটো নিয়ে আমার ভাবনা শূন্য। প্রস্থান যেখানে সমাধান সেখানে গেড়ে বসার মানেই হয় না৷ চরম বোকামি করছো।”