আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪০

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪০
অরাত্রিকা রহমান

কম্পিত গলায় মিরায়া আইডি কার্ডে থাকা নামটা নিজ মুখে আওড়ালো- “রি.. রি..রিভান চৌধুরী রা..রায়ান! রি..ভানন!”
নিজের চোখে কি দেখছে আর পড়ছে ঠিক যেন ঠাওর করতে পারছে না মিরায়া। চোখে পানি ছলছল করে উঠলো মুহুর্তের মধ্যে ঠিক যেমন অনেক কাঙ্খিত কিছু খুঁজে পেয়েছে আজ। মিরায়া বারবার নিজের চোখ টিপটিপ করে পলক ফেলে চোখের থেকে জমে থাকা পানি সড়িয়ে নাম টা বারংবার পড়তে লাগলো।

-“রি..রিভান চৌধুরী রায়ান। রিভান। হ্যাঁ এখানে রিভান ই লিখা। কোন রিভার উনি?”
মিরায়া অস্থির হয়ে উঠলো কিছুক্ষণের মধ্যেই। সে এবার আইডি কার্ড টা রেখে দিয়ে টেবিলের বাকি সব জিনিস ঘেঁটে দেখতে শুরু করলো এক অনিশ্চিত আশা বুকে আকরে ধরে যদি সে কিছু খুঁজে পায়।
মিরায়া একে একে সব খাতা, বই এর পাতা উল্টে পাল্টে দেখলো। দুই হাত বাঁধনহারা অনবরত কাঁপছিল বলে ঠিক মতো খাতা বই গুলো ধরতেও পারছিল না, হাত ফসকে পড়ে যাচ্ছিল সেগুলো। তবুও মনে সাহস রেখে বিরতিহীন ভাবে খুঁজছে কিছু। কি খুঁজছে সেটা তার অজানা, শুধু মনে হচ্ছিল আজকের এই মুহূর্ত তার নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়ার সুবর্ণ সময়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বই, খাতা সব দেখা হয়ে গেলে মিরায়া ছোট টুকরো কাগজ গুলোরও ভাঁজ খুলে খুলে দেখছিল। সেসব কাগজের মাঝেই ছিল দশ বছর আগের বিয়ের বন্ধন ভাঙার ডিভোর্স পেপার টা। মিরায়ার প্রেমে পড়ার পর রায়ান ওই ডিভোর্স পেপারের কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি বলে পুরোনো টেবিলের ড্রয়ারেই রেখে দিয়েছিল। মিরায়া সব কাগজের ভাঁজ খুলে দেখা শেষ করেও তার চাওয়ার কিছুই পেয়ে হতাশায় কাঁপা হাতে সেই ডিভোর্স পেপারে এর কাগজটা হাতে নিয়ে ভাঁজ খুলে সেটার উপর চোখ বুলাতে শুরু করলো।

সবকিছু একদম মিলে যাচ্ছে কাগজের তথ্যের সাথে- তার নাম, রায়ানের নাম, বাবা-মায়ের নাম সব। মিরায়া কয়েক মুহূর্তের জন্য থ মেরে গেল। নিজ চোখকে তার বিশ্বাস হচ্ছে না।‌ ছোট থেকে মা বাবার মতো আদর করা দুইজন মানুষ, ভাইয়ের মতো আগলে রাখা তার রুদ্র ভাইয়া সবাই তার এতো আপন, অথচ সে সম্পর্কে তাকে কেউ একবারও জানতে দেয় নি। আর সেই মানুষটা! যে তাকে এই কিছু দিন এতো পাগলের মতো চেয়েছে, সে তার স্বামী কিন্তু তা সে স্বীকার করেনি একবারের জন্যও। এমনকি মিরায়া তার অতীত রায়ানকে বলার পরও না।
মিরায়ার এসব কিছুই হজম হচ্ছিল না, চারপাশটা হঠাৎ খালি হয়ে গেলো তার আছে। প্রথম দিন থেকে রায়ানের করা সকল পাগলামি, মুখে বলা প্রতিটি কথা যা আগে মিরায়া বুঝতে অক্ষম ছিল এখন সব হঠাৎ একদম পরিষ্কার হয়ে মাথায় ধরা দিচ্ছে। অদ্ভুত আদুরে সব ডাক, অধিকার বোধ, চিন্তা, আদেশ মূলক কন্ঠে বলা কথা সবকিছু যেন এখন অর্থবহ মনে হচ্ছে মিরায়ার কাছে।

আগের বোঝা সবকিছু মুহূর্তের মাঝে মিথ্যে হয়ে গেলো। মিরায়ার চোখের পানির বাঁধ ভাঙলে তার বাদামী রঙের মায়াবী চোখ থেকে টপটপ অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগলো। মিরায়া চোখ মুছার চেষ্টাও করলো না একবার। বুক ফেটে আসা আর্তনাদ গুলো কেবল গিলে নিচ্ছে।
মিরায়া ডিভোর্স পেপার টা শুধু রেখে বাকি সব জিনিস আবার ঠিক মতো ড্রয়ারে তুলে রেখে দিল জায়গা মতোন। অশ্রু সিক্ত চোখ জোরা ঘোলাটে দৃশ্য প্রদর্শন করছে তারপরও একবারের জন্যও মিরায়া অবাধ চোখের পানি মুছে তাদের প্রবাহে বাঁধা দিল না। কিছু সময় পর প্রত্যেকটা জিনিস গুছিয়ে রেখে ডিভোর্স পেপার টা হাতে নিয়ে নিজের নিস্তেজ দেহটাকে চালনা শক্তির তীব্র প্রয়োগে ছাদে নিয়ে গেল।
ছাদের প্রতিটা সিঁড়ি আজ তার কাছে বেশ দীর্ঘ লাগছে। অবশেষে ছাদে গিয়ে মিরায়া হঠাৎ ধপ করে ছাদের মেঝেতে বসে পরলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে মনের আর্তনাদ আর আটকে রাখতে না পেরে হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করলো আহাজারি করতে করতে-

“হে আল্লাহ, কেন! কেন এমন করলেন আমার সাথে উনি এটা। তুমি তো জানো, আমি কত রাত জেগে তার নামটা মুখে মুখে বলেছি, কেঁদেছি… শুধু একদন্ড তাকে নিজের করে পাবার আশায় স্বপ্ন বুনেছি। তাহলে আমার সাথে কেন এমন হলো? সবাই কেন এভাবে আমাকে ঠকালো? আমি এতো বোকা কিভাবে হয়ে গেলাম?
আমি ভাবতাম ভালোবাসা মানে বিশ্বাস, মানে প্রতিশ্রুতি।
কিন্তু আজ বুঝছি ভালোবাসা যদি প্রতারণার ওপর দাঁড়ায়,
তাহলে সেটাও একটা কারাগার… যেখানে আমি বন্দী হয়ে ছিলাম দশ বছর ধরে। আর এই দশ বছর পর অপেক্ষার ফল হিসেবে কি পেলাম এই ডিভোর্স পেপার?

কেন করলেন এমন রায়ান? কেন আমায় জানালেন না একবারও এতো দিনেও? আপনি জানতেন আমি আপনার অপেক্ষায় কতটা অধির, তবে কেন আমার কাছে সত্য গোপন করলেন?
আমি ছোট থেকে ভেবেছিলাম বিয়ে নামক এই অজানা বাঁধন আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সত্যি…
আল্লাহ, আমি তো আমার অতীত খোলাখাতার মতো কেবল উনার সামনে রেখেছিলাম তাহলে কেন সব জানার পরও কেন? কেন উনি চুপ করে রইলেন? একবারও বলেন নি, ‘মিরা, আমার হৃদপাখি, আমিই সেই অতীত! কিন্তু না, একবারও না!.. কেন?”

মিরায়া ছাদে একা নিজের কথা গুলো সৃষ্টি কর্তার কাছে অঝড়ে কাঁদতে কাঁদতে বলে যাচ্ছে। রায়ানের তাকে দশ বছর আগে অস্বীকার করে চলে যাওয়া টা যতো না কষ্ট দিচ্ছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট দিচ্ছে সবকিছু জানার পরও চুপ করে থাকাটা। কিন্তু মিরায়া সমীকরণ মিলাতে পারছে না কেবল এক জায়গায় যদি রায়ান তাকে ডিভোর্স ই দিতে চাইবে তাহলে সেটা মুখ ফুটে কখনো কেন বলল না? আর এমনভাবে নিজের মোহে বাঁধার চেষ্টা করার কারণ কি?
-“আমাকে যদি ছাড়তেই এসেছিলেন তবে কেন আমাকে ভালোবাসার নাটকে জাড়ালেন? কেন মায়া তৈরি করলেন আমার মনে নিজের জন্য? হে খোদা এসবে মানে কি? আমি কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।”

মিরায়া নিজের মাথা শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে ধরলো। হাজারো প্রশ্নের চাপে যেন তার মনে হচ্ছে এবার মাথাটা ফেটেই যাবে। আর নিতে পারছে না এসব ভাবনা। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে সাহায্য চাইলো সৃষ্টি কর্তার কাছে-
“আমাকে ধৈর্য দেও আল্লাহ। বোঝার ক্ষমতা দেও। আমি আমার নিজের উপর অন্যায় করতে পারি না। আমি এই মুহূর্তে এসে হাড় মানতে পারবে না। শক্তি দেও আমায় আল্লাহ।”

মিরায়া উঠে দাঁড়িয়ে ছাদের রেলিং এর কাছে যেতে লাগলো। পায়ের প্রত্যেকটা পদক্ষেপ তার টলমল করছে যেন একদম নাজুক হয়ে আছে শরীর। ধীর পায়ে রেলিং এর কাছে গিয়ে রেলিং টা শক্ত হাতে আকারে ধরলো মিরায়া। আর দুই চোখ বন্ধ করে মনের সকল জোর একীভূত করে জোরে চিৎকার করল দুইবার আকাশ পানে মুখ করে-
“আআআআআআআআ…! আআআআআআআআ…!”

নিস্তব্ধ ফাঁকা ছাদে হঠাৎ চিৎকার গুলো হাওয়ায় মিশে গেল কারো কানে পৌঁছালো না সেই চিৎকার। জমে থাকা রাগ-ক্ষোভ, চিন্তা-চেতনা, কষ্ট সব বিসর্জন দিলো এভাবে। মন শান্ত করতে একলা ছাদে এর বাইরে করার মতো আর কিছুই ছিল না মিরায়ার। বরাবরই শক্ত ও শান্ত মনের অধিকারী মেয়ে মিরায়া- বাবা মার মৃত্যুর পর কখনো তার এতো খারাপ অনুভব হয়েছে কিনা সে নিজেও জানে না।
তখনি চৌধুরী বাড়ির সামনে এসে একটা সাদা গাড়ি দাঁড়ালো। গাড়ির হর্নের শব্দ কানে যেতেই মিরায়া ছাদে থেকে নিচে উঁকি দিয়ে গাড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলো।
মাহির গাড়ি থামাতেই রায়ান গাড়ির দরজা খুলে তড়িঘড়ি করে বাড়িতে ঢুকলো। বলা চলে এক প্রকার দৌড়ে। মাহির রায়ানের অস্থিরতা দেখে হেঁসে বলল-

“ভালোবাসা আসলেই ভয়ংকর। একটা মানুষের ভিতর বাহির এতো কম সময়ে কিভাবে বদলে দেয়। জিনিসটা বেশ জটিল, নিজের ক্ষেত্রে না হওয়া পর্যন্ত সব বেফালতু আর হুজুগে লাগে।”
মাহির নিজে গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির ডিকি থেকে রায়ানের লাগেজটা বের করে নিয়ে বাড়ির মূল দরজার দিকে অগ্রসর হলো।
মিরায়া ছাদে থেকে রায়ান কে দ্রুত পায়ে বাড়িতে প্রবেশ করতে দেখলো কিন্তু ওই অল্প সময়ে উপর থেকে তার মুখ দেখতে পেলো না কান্না ভরা ঘোলাটে দৃষ্টিতে। মাহির কেও সে আগে কখনো দেখে নি আজ প্রথমবার দেখলো কিন্তু সেই দিকে তার খেয়াল নেই আর না আগ্রহ আছে।
মিরায়া তার গাল বেয়ে পড়তে থাকা অশ্রু হাতের উল্টো পিঠের সাহায্য মুছে নিয়ে নিজ মনে শান্ত মাথায় একের পর এক কড়ি মিলাতে লাগলো-

-“ডিভোর্স পেপার সত্য সেটার প্রমাণ নিজ হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছি আমি। তাহলে এই কয়দিন যে মায়ার টান অনুভব করলাম তার দিক থেকে সেসব কি মিথ্যে?”
-না, না, অসম্ভব। সেগুলো মিথ্যে হতে পারে না। মানুষের মুখের কথা অবিশ্বাস্য হতে পারে কিন্তু তার কর্ম না। উনার বলা সব কথা তার কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। একবারের জন্যও আমি মিথ্যে অনুভূতির সংস্পর্শে যাই নি। তার কাজ, কথা, ছোঁয়াতে আমার জন্য ব্যাকুলতা স্পষ্ট এতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা আমার নেই। কিন্তু উনি সত্যি যদি আমাকে চেয়ে থাকেন তবে এই ডিভোর্স পেপার এর অস্তিত্ব কেন খুঁজে পেলাম আমি।”
মিরায়া প্রশ্ন এ দ্বিধার ভীরে বিরক্ত হয়ে ছাদের রেলিংয়ে জোরে হাত দিয়ে আঘাত করে বলল-

“উফ্! আল্লাহ দয়া করো আমাকে। আমি কিছু মিলাতে পারছি না। কোনটা সত্যি আমার অনুভব করা ভালোবাসা, না এই কাগজটা?”
মাথায় সব চিন্তা ভাবনা এখন কেবল এই এক উত্তর এর খোঁজ করে যাচ্ছে। রায়ান কেন এমন করলো? আর এই ডিভোর্স পেপার এর মানে কি?”
নিচে~
রায়ান বাড়িতে প্রবেশ করতেই মা রামিলা চৌধুরী কে দেখতে পেয়ে দৌড়ে যায়-“আম্মু…!” শক্ত করে জোরিয়ে ধরলো ।রামিলা চৌধুরী ছেলেকে এতো দিন পর আবার দেখতে পেয়ে কেঁদেই বসলেন।
ছেলেকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরে মমতা ভরা গলায় জিজ্ঞেস করলেন -” কেমন আছিস বাবা? আম্মু তোকে খুব মিস করেছি। আরো একটু তাড়াতাড়ি ফিরতে পারলি না?”
রায়ান মাকে ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের উদ্দেশ্যে বলল-
“আমি দশ বছরেও এতো মিস করি নি তোমাদের জানো এইবার এতো মিস করেছি। আমি একদম পারফেক্ট আছি ঠিক যেমন দেখতে পাচ্ছ।”
মায়ের সামনে একবার ঘুরে নিজেকে প্রদর্শন করে বলল।
রামিলা চৌধুরী রায়ানের বাচ্চা সুলভ আচরণে রায়ানকে হালকা মিষ্টি হেঁসে থাপ্পর দিলেন। রায়ান একটু ভয় পেয়ে সড়ে গেল।

তখনি পিছন থেকে মাহির রায়ানের লাগেজ বহন করে আনতে আনতে বলল-
“আন্টি, তোমার ছেলেকে ভালো করে একটু শিক্ষা দেও তো। বন্ধু কে দিয়ে নিজের ব্যাগ টানাচ্ছে।”
রামিলা চৌধুরী মাহিরের দিকে অবাক হয়ে তাকালেন। রায়ান বিদেশে যাওয়ার পর মাহির তেমন একটা চৌধুরী বাড়িতে আসতো না মাঝে মাঝে শুধু খোঁজখবর নিতে আসতো এতদিন পর আবার মাহিরকে রায়ানের সাথে দেখে রামিলা চৌধুরী বেশ আনন্দিত হলেন।
রায়ান সড়ে গিয়ে রান্না ঘরে তার জন্য বানিয়ে রাখা শরবতের গ্লাসটা হাতে নিয়ে খেতে থাকলো নিজে নিজেই। আর রামিলা চৌধুরী মাহির এর কাছে গিয়ে মিষ্টি হেসে মাহিরের কান ধরে হালকা মোচড় দিয়ে বললেন-
“ছেলেকে পরে শিক্ষা দিব আগে তোকে শিক্ষা দিয়ে নেই। বন্ধু বাড়ি নেই বলে কি বন্ধুর বাড়িতে আসা যায় না? আজ কতদিন পর বাড়িতে পা রাখলি বল তো?”

মাহির একটু নাটুকে আর্তনাদ করলো- “উউউ! আহ্! আন্টি লাগছে ছাড়ো।”
রায়ান শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলল-“আরো একটু জোরে দেও আম্মু। আমি ওকে অনেক বলেছি বাড়িতে গিয়ে ঘুরে আসিস ও ইচ্ছা করে আসে নি।”
মাহির তৎক্ষণাৎ প্রতিবাদ করে বলল-“ডাহা মিথ্যা কথা বলছে আন্টি। একবারও বলে নি এটা, তুমি বিশ্বাস করো।”
রামিলা চৌধুরী মাহিরের কান ছেড়ে দিয়ে শাসনের সুরে বললেন-“ও বলার কে? ও বলনি তো কি হয়েছে, তুই নিজের থেকে আসতে পারলি না?”

মাহির রামিলা চৌধুরীর কথায় রায়ানের দিকে তাকিয়ে কুটিল হাসতেই রায়ান এবার সাথে সাথে প্রতিবাদ করল মায়ের কথার-“আম্মু, আমি বলার কে মানে কি? তুমি ওকে এসব বলে আর আসকাড়া দিও না তো।”
মাহির রামিলা চৌধুরীকে পিছন থেকে কাঁধে হাত রেখে ঢাল স্বরূপ দাঁড়া করিয়ে বলল-“আন্টি দেখ তোমার ছেলে কেমন করে আমার সাথে। এর পরেও যে আমি ওর বন্ধু হয়ে আছি এটা ওর সৌভাগ্য, ওকে বলে দাও।”
রায়ান তুচ্ছ হেঁসে বলল-“ইইস্! সৌভাগ্য না দুর্ভাগ্য সেটা আমিই জানি। আমি সামলাই তো!”
মাহির চেতে গিয়ে বলল-“ওই সামলাস মানে কি হ্যাঁ?”
রামিলা চৌধুরী দুইজনের তর্ক থামাতে জোরে বললেন-
“আচ্ছা আচ্ছা, হয়েছে। এবার দুইজন চুপ কর তোরা। বড় হলি না দুজনের কেউই।”
রুদ্র তখন রায়ান আর মাহিরের আওয়াজে মুখের চিন্তা ভাব সড়িয়ে বানোয়াট উৎসাহ নিয়ে সিঁড়ি থেকে নামতে নামতে বলল-

“ওরে বাবা, চৌধুরী বাড়িতে এক চাঁদ থাকতে আরো দুই চাঁদের উদয় হলো আজকে?”
রুদ্র নেমেই মাহিরের কাছে গিয়ে মাহির কে জড়িয়ে ধরে বলল-“আরে মাহির ভাইয়া তোমাকে যে আমি কি মিস করেছি এই কয় দিন। কি আর বলবো।”
মাহির ও হেঁসে রুদ্র কে জড়িয়ে ধরে বলল-“আমিও তোকে মিস করেছি ছোট ভাই।”
এইদিকে রায়ান নিজের ভাইকে তার আগে তার বন্ধুর কাছে যেতে দেখে মুখ বাঁকিয়ে বলল-“ইফ ‘মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশি’ হ্যাড আ ফেস। হাহ্! নিজের রক্তই চিনলো না। আমি আবার তার জন্য PS5 কিনতে চেয়েছিলাম।”

রুদ্র রায়ানের কথায় তার দিকে তাকিয়ে বলল-“আমি ছোট নেই যে এসবের শখ থাকবে আর না সময় আছে এখন।”
রায়ান রুদ্র কে খাপাতে বলল-“ইস্! এই বয়সে একটা না গার্লফ্রেন্ড আছে, না বউ তার আবার সময় নাই। কালে কালে যে কত কি দেখতে হবে আরো।”
রুদ্র গার্লফ্রেন্ড এর কথা উঠতেই কেন জানি ভরকে গেল। কিন্তু কিছুই বলতে পারলো না। কি ই বা বলবে রায়ান যা বলেছে তা তো ষোলো আনাই সত্য।
এবার রায়ান সবকিছু বাদ দিয়ে চারদিকে তাকিয়ে দেখলো। কিন্তু তার হৃদপাখি কে আশে পাশে কোথাও দেখতে পেলো না। হাতের শরবতের গ্লাস টা টেবিলে রেখে রুদ্রর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“ওই আমার বউ কই?”

রুদ্র চটে গিয়ে চেঁচিয়ে নিজের মাথার দিকে আঙুল তাক করে দেখিয়ে বলল-
“আমার মাথায় নাচতেছে দেখ, নাও নাও কলে নিয়ে নাও তোমার বউকে।”
রায়ান মুখ বাঁকিয়ে ফেললো অভক্তি প্রকাশ করে-
“নেকামি না করে বল না ভাই কোথায় আমার বউটা। কতদিন দেখিনা। মনে হচ্ছে কত যুগ দেখি নি।”
রুদ্র এবার আর কিছু বাড়তি না বলে জবাব দিল-
“দেখ গিয়ে উপরে নিজের ঘরে তো নেই নামার সময় দেখি নি। হয়তো ছাদে আছে।”
রুদ্র এবার রায়ানের দিকে দুই হাত খুলে দিয়ে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরতে যাবে তখনি রায়ান তার লাগেজটা রুদ্র কে ধরিয়ে দিয়ে বলল-
“আপাতত ব্যাগ টা ঘরে রেখে আয় ভাই। আমি গেলাম তোর বোনকে আই মিন তোর ভাবি, মানে আমার বউকে জড়িয়ে ধরতে।”
কথাটা বলেই রায়ান দৌড়ে উপরে গেল সিঁড়ি বেয়ে। রুদ্র হা করে রইলো ব্যাগ হাতে। রামিলা চৌধুরী হেঁসে মাহির কে বললেন –

“মাহির তুই ওদের ছাড়। এইদিকে আয় রান্না করেছি খাবার খাবি আয়। রায়ান পরে খাবে।”
মাহিরও খাবার খাওয়ার উৎসাহে রামিলা চৌধুরীর পিছনে গেল। আর রুদ্র বিরক্তি ভরা চেহারায় মুখ ঝুলিয়ে রায়ানের ব্যাগ রায়ানের ঘরে রেখে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা লাগিয়ে দিল। সবকিছুই বিরক্তি কর লাগছে তার। ঘরে ঢুকেই ফোনটা থেকে করলো রিমি এখনো মেসেজ এর রিপ্লাই করে নি দৈগে ফোনটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে বালিশের উপর মুখ লাগিয়ে উল্টো হয়ে শুয়ে পড়ল।

ছাদে~
মিরায়া সব কিছু সাজিয়ে গুছিয়ে নিতে নিতেই আবার সব ভেঙ্গে যাচ্ছিল। মিরায়া ক্লান্ত দেহ আর ক্লান্ত মনে ছাদে দাঁড়িয়ে আছে নিজের এক গাদা প্রশ্ন নিয়ে-
-“তবে কি, রায়ান আমাকে ডিভোর্স দিতে চেয়েও দিতে পারেন নি আমাকে ভালোবেসেছেন বলে? এমন কিভাবে হয়? না, না ভুল ভাবছি আমি। কিন্তু এটা ভুল হলে আর কি কারণ থাকবে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পিছনে?”
-“উফ্! বুকটা এমন অস্থির হয়ে আছে কেন? শান্তি মিলছে না কিছুতেই। কি কারণ হতে পারে এতো কিছুর পেছনে!”
ছাদের দরজা হঠাৎ -“ঠাস” একটা সজোরে আওয়াজ হয়ে খুলল। সাথে সাথে পিছন থেকে পরিচিত সেই কন্ঠ শুনতে পেলো মিরায়া-

“হৃদপাখি..!”
হৃৎপিণ্ড নিজের কাজ এক মুহূর্তের জন্য ভুলে গেল দুজনের ই। মিরায়া উল্টো দিকে মুখ করে আছে, চোখ এখনো অশ্রু ভেজা। রায়ানের ডাক যেন চোখের পানিতে অতিরিক্ত গতি যুক্ত করলো। শত চেষ্টার পরও মিরায়া ব্যর্থ হলো তার চোখের বারি ধারা আটকাতে। নিজের অজান্তেই তা গাল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। রায়ান অধৈর্য হয়ে আছে তার হৃদপাখিকে একনজর দেখার জন্য।
রায়ান আবার আদুরে নামে ডাকলো-“হার্ট বার্ড! আমার দিকে ঘুরো প্লিজ!”
মিরায়ার জান চলে যাচ্ছিল তার কাঙ্খিত পুরুষ কে কাছ থেকে আরো একবার দেখার জন্য কিন্তু সাহসে কুলিয়ে উঠতে পারছিল না। মিরায়া রায়ানের দিকে তাকালো না। কিন্তু এবার রায়ান আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না। সে দ্রুত পায়ে মিরায়ার কাছে দিয়ে তার কাঁধ ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নেয়।
মিরায়ার কিছু করার ছিল না বিধায় চুপ করে মাথা নত করে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রায়ানের সামনে। হাতের ডিভোর্স পেপার টা নিচে ফেলে সেটার উপরই দাঁড়িয়ে আছে এখন।
মিরায়াকে এভাবে অসহায়ের মতো কাঁদতে দেখা রায়ান এই মুহূর্তে কল্পনাও করেনি। বুকের হৃৎস্পন্দন যা একটু আগে থেমে ছিল এখন জোরে ধকধক করছে। মাথায় চিন্তা নাড়া দিয়ে উঠলো হঠাৎ, রায়ান অস্থির হয়ে মিরায়ার কাঁধে হাত রেখে জিজ্ঞেস করলো-

“হৃদপাখি! এই কি হয়েছে? এভাবে কাঁদছো কেন?”
মিরায়া আরো জোরে কাঁদছে এখন। রায়ান আরো চিন্তিত হয়ে উঠলো। দুই হাত কাঁধ থেকে সড়িয়ে মিরায়ার মুখ দুই হাতের মাঝে নিয়ে নিজের দিকে তুলে আবেগপ্রবণ হয়ে আবার জিজ্ঞেস করলো-
“জান, কি হয়েছে আমাকে বল একবার? কাঁদছিস কেন? কেউ কিছু বলেছে তোকে? কে কি বলেছে আমাকে বল বাকি আমি দেখে নেবো। এভাবে কাঁদে না পাখি। আমার কষ্ট হচ্ছে। কান্না থামা প্লিজ।” (মিরায়ার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে)

মিরায়া একটা টু শব্দ ও করছে না। বৃথা চেষ্টা চালাচ্ছে কান্না থামানোর কিন্তু প্রিয় মানুষের কাছে সবাই একটু বেশিই দূর্বল হয়ে পরে তাই তার শত চেষ্টাও ব্যর্থ ছিল রায়ানের সামনে। সে চুপ করে রায়ান কে দেখে যাচ্ছে- এই মানুষটাই তার বর যার অপেক্ষায় এতগুলো বছর পার করেছে। ভাবতেই এক অদ্ভুত বিরহ সুখে তলিয়ে যাচ্ছিল মিরায়া। কিন্তু এইদিকে নিজের এতো আদরের বউকে কাঁদতে দেখে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বসেছে রায়ান। কিছু বুঝতে পারছে না মিরায়া কেন এমন ভাবে কাঁদছে। ধৈর্যের সব সীমা পার হয়ে গেলে রায়ান চেঁচিয়ে উঠলো-
“ওইইই..চুপ কর। একদম চুপ!”

মিরায়া হঠাৎ কেঁপে উঠলো রায়ানের চেঁচানোতে ভয় পেয়ে। রায়ান আবার চেঁচিয়ে বলল-
“তখন থেকে জিজ্ঞেস করছি কি হয়েছে, কি হয়েছে। কিছু না বললে বুঝব কিভাবে আমি। কোনো প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিস আর কেঁদেই যাচ্ছিস। বলছি কষ্ট হচ্ছে আমার। কানে যায় না?”
মিরায়া চমকে গেল রায়ানের জোরে কথা বলাতে। সে নিজে কে সড়িয়ে নিতে চাইলো রায়ানের হাতের বাঁধন থেকে কিন্তু তার শরীরের দূর্বলতা অঙ্গসঞ্চালনে বেশ বুঝা যাচ্ছে। মিরায়া দূরে যেতে চাইছে বুঝে রায়ান শক্ত করে মিরায়ার দুই কাঁধে হাত রেখে আটকিয়ে নরম গলায় বলল-
“আচ্ছা সরি। আর চেচাবো না। তুই কিছু বলছিস না তাই তো চেঁচিয়েছি। আমাকে বল হৃদপাখি কি হয়েছে তোর? কোথায় সমস্যা হচ্ছে? শরীর খারাপ লাগছে? নাকি…।”

রায়ান আর কিছু বলতে যাবে তার আগেই মিরায়ার ছোট্ট শরীরটার আশ্চর্য করা গতিবিধি বুঝতে পারলো সে। মিরায়া ধীরে স্থির ভাবে দুই কদম রায়ানের দিকে এগিয়ে তার মাথা ঠেকায় রায়ানের প্রশস্থ বুকে। রায়ান থ মেরে গেলো কিছু সময়ের জন্য বুঝতে পারলো না হঠাৎ কি হলো। সে ওই মুহূর্তে কি করবে? বা কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারলো না। তার বড্ড ইচ্ছে করতে লাগলো মিরায়াকে নিজের সাথে একেবারে মিশিয়ে নিতে কিন্তু চাইলেও হটকারীতায় এমন কিছু করা ঠিক হবে না বলে সে কেবল মিরায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো।
এক পর্যায়ে রায়ান অনুভব করলো তার কন্ট্রোল হারাচ্ছে ধীরে ধীরে মিরায়ার সংস্পর্শে। মিরায়া রায়ানের বুকে মাথা রেখে রায়ানের হৃৎস্পন্দন শুনছিল। মিরায়া কান্না ভরা চোখেই মুচকি হাসলো- কারণ রায়ানের ব্যাকুলতা তার হৃৎস্পন্দন এর গতিবিধি দেখে অনেক টাই ঠাওর করতে পারছে মিরায়া।
মিরায়া নিজের মনে ভাবতে লাগলো-

“এই ডিভোর্স পেপার কেন আছে আমি জানি না। কিন্তু উনার বুকের অস্থিরতা মিথ্যে হতে পারে না। আমি এই ক্ষেত্রে কোনো প্রকার ভুল বুঝি নি।”
রায়ান মিরায়ার নীরবতায় আরো অধৈর্য হয়ে পড়ছিল। তারপর নিজেই আবার জিজ্ঞেস করলো-
“হৃদপাখি! কি হয়েছে বল আমাকে? আমি …”
রায়ানের কথা আবার অর্ধ পূর্ণ রেখে মিরায়া এবার রায়ানের আরো কাছে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরলো দুই হাতের বন্ধনে। রায়ানের শরীরে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বয়ে গেল, মিরায়া কি চাইছে তার মাথায় কাজ করছে না কিছু। রায়ান ঠোঁট কামড়ে নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করে বিড়বিড় করলো-
“রায়ান কন্ট্রোল। এখন কিছু করলে আর সামলাতে পারবি না। নিজেকে সামলা, তোর বউ কোথাও যাচ্ছে না পরেও করতে পারবি। এখন না।”

রায়ান সুযোগ হাতে পেয়েও তা কাজে লাগাতে চাইছিল না শুধু মাত্র সত্যি বিয়ে গোপন করার বিষয়টা ভেবে। রায়ান বরাবরই চেয়েছে তার বউ নিজের থেকে তার কাছে ধরা দিক তাকে স্বামীর অধিকার দিয়ে।
রায়ান এভাবে মিরায়ার কাছে থাকলে উল্টোপাল্টা কিছু হয়ে যাবে এমন ধারণায় সে মিরায়াকে সাবধান করতে বলতে শুরু করলো-“বেইবি, আমার দ্বারা কন্ট্রোল হবে না যদি তুমি এমন করে..!”
-“আমাকে একবার জড়িয়ে ধরবেন, রায়ান?” মিরায়া রায়ানকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নিজের আবদার রাখলো।
রায়ান আবার ও অবাক হয়ে গেল, এই প্রথম মিরায়া রায়ানের নাম ধরে ডাকলো পিছনে ভাইয়া ডাক লাগানো ছাড়া। কি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছে না রায়ান। হঠাৎ বউ এতো আদর পাগল হয়ে উঠলো কিভাবে এই চিন্তা ঘুরছে মাথায়। রায়ান মিরায়াকে এখনো জড়িয়ে ধরেনি বলে মিরায়া একটু বিরক্ত হলো-
“থাক ধরতে হবে না আমাকে।”

রায়ানের বুক থেকে মাথা তুলতে যাবে তখনি রায়ান নিজের বৃহৎ শরীরের সাথে মিরায়াকে মিশিয়ে নিল এক মুহূর্তে। মিরায়া মুচকি হেঁসে আবারো নিজের মাথা রায়ানের বুকের উপর রাখলো। আর তার ছোট হাত গুলো আকারে ধরলো রায়ানের পিঠ। রায়ান আর নিজেকে সংবরণ করতে পারছিল না তাই এমন করল- দশ বছর এর ও বেশি দীর্ঘ বিবাহিত জীবনে এই প্রথমবার বউয়ের আবদার এসে তাকে ছোঁয়ার এই আবদারে সাঁড়া না দিয়ে থাকতে পারা পুরুষ নিতান্তই কাপুরুষের কাতারে পড়বে।

রায়ান আরো শক্ত করে মিরায়ার ছোট্ট শরীরটা আঁকড়ে ধরলো। মিরায়াও রায়ানকে আকরে ধরে আপন করে নিচ্ছে।
সময় যত গড়াচ্ছে পরিবেশ টা তত গরম আবহাওয়া পূর্ণ হয়ে উঠছে। রায়ান নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলো না। নিয়ন্ত্রণের কথা মাথাতেও এলো না মিরায়া সম্মতি পেয়ে। রায়ান নিজের হাতের গতি বাড়ালো। মিরায়ার শরীর রায়ানের সাথে মিশে থাকা অবস্থায় কাঁপছে যা রায়ানের নিয়ন্ত্রণের অস্তিত্ব শূন্য পরিমাণ করে দিচ্ছে।
রায়ান পিছন থেকে হাত ঘুরিয়ে মিরায়ার কাঁধে পড়ে থাকা চুল গুলো সড়িয়ে দিয়ে সেখানে নিজের মুখ গুঁজে দিল। মিরায়া চমকে কেঁপে উঠে রায়ানের শার্টটা খামচে ধরলো, শরীর এর প্রতিক্রিয়ায় যেন তার ভেতরে তোলপাড় শুরু হলো।

রায়ান এবার পুরোপুরি ধ্যান হারা হলো, মিরায়ার উন্মুক্ত ঘাড়ে ছোট ছোট চুমু খেতে শুরু করতেই মিরায়া কেঁপে উঠে রায়ানের থেকে দূরে যেতে চাইলো। কিন্তু কামনার অনুভূতি যে অস্বস্তি মানে না- রায়ান মিরায়াকে শক্ত করে ধরে গরম নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিসিয়ে বলল-
“স্টে স্টিল বেইবি, প্লিজ। ছটফট করো না। একটু সহ্য করো।”

মিরায়ার চোখের কোনে অশ্রু জমা হলো সুখে যা পলক ফেলার সাথে গড়িয়ে পরলো। রায়ান মিরায়ার ঘাড় আর গলায় নিজের রাজত্ব পেয়ে নিজের সমস্ত ক্লান্তি সেখানে বিসর্জন দিতে লাগলো। মিরায়া না চাইতেও সঙ্গ দিচ্ছে। জীবনের প্রথম পুরুষ তাও নিজের স্বামীর ছোঁয়া কি অস্বীকার করা যায় চাইলেই? হোক না সেটা অজানা রহস্য!
রায়ান সোজা হয়ে মিরায়ার মুখ তার সামনে নিয়ে এলো। মিরায়ার চোখ অর্ধখোলা, ঠোঁট কাঁপছে শিহরণে। নিঃশ্বাস ভারী দুইজনেরই। মিরায়া চোখ খুলতে পারছে না লজ্জায় আর এই লজ্জায় রাঙা মুখ রায়ানের বুকে আগুন ধরিয়ে দিল। সে হালকা মুচকি হেঁসে মিরায়ার কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দিল। মিরায়ার মুখেও স্পষ্ট সেই আদরের ছোঁয়ার প্রতিক্রিয়া। রায়ান মিরায়ার সমস্ত অবয়বে নিজের ঠোঁট ছোঁয়ালো। প্রতি বারই মিরায়া আবেশে কেঁপে উঠছিল। কপাল, গাল, নাক সবশেষে সেই চিরচেনা কাঙ্ক্ষিত ঠোঁট জোড়ায় নজর পড়লো রায়ানের। সে খেয়াল করলো মিরায়ার শুকনো কমল ঠোঁট দুটো কেঁপে উঠছে বারবার, রায়ান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে মিরায়ার ঠোঁটে হালকা স্পর্শ করে স্লাইড করলো। মিরায়া রায়ানকে না আটকাতে পারছে আর না সড়ে আসতে কিন্তু যা হচ্ছে তা হওয়ার সময় এটা নয় সেটা বুঝতে পেরে ভারী নিঃশ্বাসের ফাঁকে মৃদু স্বরে রায়ানের উদ্দেশ্যে ফিসফিস করলো বলল-
“রায়ান প্লিজ, থেমে যান। এটা ঠিক হচ্ছে না। প্লিজ থেমে যান।”

রায়ান নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বহু আগে। সে মিরায়ার গালের নাক ঠেকিয়ে মাথা না সূচক নাড়াতে লাগলো-“আমি পারবো না হৃদপাখি!” সে হাস্কি ভয়েসে আওরালো।
মিরায়া নিজেকে সংবরণ করার চেষ্টায় দুই তিনবার জোর পূর্বক চোখ বন্ধ করে খুলল। একটু স্বাভাবিক হতে রায়ানের বুকে হাত রেখে তাকে পড়িয়ে দিতে চেয়ে বলল-“পারবেন আপনি। চেষ্টা করুন নিজেকে সামলাতে।”

রায়ান মিরায়ার হাত ধরে পিছনের দিকে নিজের হাতে লোক করে দিয়ে জোরে বলল-“এই চেষ্টা আমার দ্বারা হবে না পাখি। আই এম সো সরি। ফোরগিভ মি। নিজেকে এই মুহূর্তে সামলানোর চেষ্টা, আমি করতে পারবো না। আর না।”
রায়ান পরক্ষণেই মিরায়ার দুই গালে চুমু খেয়ে নিয়ে ঠোঁটের স্বাধ নিতে অগ্রসর হয়। কিন্তু ঠিক সেই সময়েই বাড়ির পাশের মসজিদে আসরের আজান শুরু হয়। স্বাভাবিকভাবেই তখন বিকেল ৫টা বরাবর আজানেরই সময়। রায়ান মিরায়ার দুই জনেরই ঘোর কাটলো আজানের শব্দে। মিরায়া রায়ানের বুকে এবার হালকা ধাক্কা দিতেই রায়ান ছিটকে সড়ে গেল।

দুইজন তখনো ঘন নিঃশ্বাস ত্যাগ করছে। মিরায়া হাঁপিয়ে উঠেছিল রায়ানের সুঠাম দেহের আয়ত্তের মাঝে। রায়ান ওই অবস্থায় মিরায়ার দিকে কিভাবে তাকাবে বুঝে পাচ্ছিল না।
এই টুকু সময়ে কি থেকে কি হলো দুইজনের কেউ বুঝে উঠতে পারছে না। রায়ান নিজের মনে জানে সে অন্যায় করে নি নিজের বউকে ছুঁয়েছে এতে তো দোষের কিছু নেই, কিন্তু তার অস্বস্তি হচ্ছিল এই ভেবে এখন মিরায়া যদি এসবের জন্য রায়ানকে খারাপ ভেবে দোষী করে তাহলে কিভাবে সামাল দেবে ও এখনো সত্যি টাও জানায় নি অযুহাত স্বরূপ বলার মতোও কিছু নেই।

রায়ান অপরাধী চোখে মিরায়ার দিকে তাকাল। কিছু সময় আগের রায়ানের পাগলামির দরুন মিরায়ার ওড়না বুক থেকে সড়ে গেছে চুল গুলো ও অগোছালো কিন্তু সব মিলিয়ে থাকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে, যেন বিলের ফুটন্ত তাজা পানাফুল। রায়ানের বুকে আবার উন্মাদনার সৃষ্টি হলো-

“উফ্! আর পারছি না খোদা‌। কেন এমন পরীক্ষা নিচ্ছ আমার ? এইভাবে নিজের বউকে দেখে কিভাবে টেকা সম্ভব!”
মিরায়া নিজের ওড়না ঠিক করে নিল দ্রুত। রায়ানের দিকে একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে ফেলল- স্বামীর পরিচয় পাওয়ার পর নিজেকে না আটকাতে পারার ফল এই সব। মিরায়া নিজের উপর বিরক্ত হয়ে-“এটা কি হয়ে গেলো। হায় খোদা, উনি কি ভাববেন এবার? উনি তো জানেন, যে আমি জানি না আমি উনার বউ। তাহলে এখন তো ভাববেন আমি বিবাহিত হওয়ার পরও অন্য কাউকে..! ছিঃ ছিঃ ছিঃ! কি করে হলো এটা।”
কিন্তু রায়ান এসব কিছুই ভাবছে না তার মাথায় তার বউ তার বউই, সেটা তার বউ জানুক বা না জানুক। মিরায়া রায়ানকে এড়িয়ে যেতে পালাতে চাইলো সেখান থেকে।

মিরায়া রায়ানের পাশ কাটিয়ে দৌড়ে ছাদের থেকে নামতে সিঁড়ির দিকে যেতে নিলে রায়ান মিরায়ার কোমর আকারে ধরে ঘুরিয়ে নিজের বুকের সাথে মিরায়ার পিঠে ঠেকিয়ে দাঁড়া করালো। মিরায়া ছাড়া পাওয়ার জন্য ছটফট করতে লাগলো কিন্তু রায়ান তার পাত্তা না দিয়ে বলল-
“ওই! এতো নড়ার মতো কি কিছু করেছি নাকি? এমন করছো কেন?”
মিরায়া ভয়ার্ত গলায় বলল-“ছেঁড়ে দিন প্লিজ। আমি আর আপনাকে জড়িয়ে ধরতে বলবো না।”
রায়ান দুষ্টু হেঁসে মিরায়ার কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে কানের লতিতে ছোট চুমু দিয়ে ফিসফিসিয়ে বলল-
“শুকরিয়া আদায় করো পাখি। সময় এখন আমার নয় তাই বেঁচে গেলে। কিন্তু এমনটা সব সময় হবে না। বি রেডি।”
মিরায়া অল্প বেঁকে গিয়ে বিরক্ত গলায় বলল-“অশ্লীল বেডা।”

রায়ান ও মিরায়ার কথায় তাল দিয়ে বলল-“আমার সুশীল বেডি।”
মিরায়া জোরে আওয়াজ করে বলল-“ছাড়ুন বলছি। আমি নিচে যাবো।”
রায়ান মিরায়াকে হঠাৎ ঝটকায় কোলে তুলে নিল । মিরায়া আতংকে প্রশ্ন করলো-“কি করছেন? কোলে কেন তুললেন?”
রায়ান মিরায়ার সেই প্রশ্নের তোয়াক্কা না করে নিজের প্রশ্ন করলো-“ওই বলেছিলাম না, আমি না থাকা কালীন নিজের যত্ন নিতে?”

মিরায়া-“হুম, নিয়েছি তো।”
রায়ান বিরক্ত হয়ে-“তো শরীরে কিছু নাই কেন? হ্যাল্থ ইমপ্রুভ কেন করে নি? কি ছাতার মাথা যত্ন নিয়েছো?”
মিরায়া চুপ করে রইল। রায়ানের সব সময় মিরায়ার চিকন হওয়া নিয়ে বকা দেওয়ার বিষয়টা ওর অপমানজনক লাগে।রায়ান মিরায়ার নীরবতা দেখে বলল-
“সমস্যা নেই। এবার আমি এসেছি সব দিক থেকে হেলদি হয়ে যাবে।”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৩৯ (৪)

মিরায়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো-“সব দিক থেকে মানে?”
রায়ান ছাদে প্রস্থান করতে করতে বলল-“নিচে ঘরে নিয়ে বোঝাচ্ছি, চলো।”
মিরায়া শুকনো ঢোক গিললো ভয়ে। রায়ানের দিকে তাকিয়ে আছে এক নজরে মনে মনে অন্য ভয় কাজ করতে লাগলো তখন তার-“ঘরে গিয়ে কি বোঝাবেন উনি?”

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪০ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here