আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪০ (২)

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪০ (২)
অরাত্রিকা রহমান

রায়ান মিরায়াকে কোলে করে ছাদ থেকে নেমে নিজের ঘরের দিকে নিয়ে যাতে থাকে। মিরায়ার চোখে মুখে ভয় স্পষ্ট, সেভাবেই রায়ানকে দেখছে। রায়ান মিরায়ার দিকে তাকিয়ে আবার সোজা তাকায়-
“আজ আমাকে এভাবে কেন দেখছো পাখি? মনে হচ্ছে চোখ দিয়েই খেয়ে ফেলবা।”
মিরায়া রায়ানের কথায় একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে আর সাথে সাথে নিজের চোখ রায়ানের থেকে সরিয়ে নিয়ে মাথা নিচু করে বিড়বিড় করলো-

“আমার রুচির অবক্ষয় হয়নি যে মানুষ খেতে হবে।”
রায়ান মুচকি হেঁসে মিরায়া কে নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে মিরায়াকে বিছানার উপর নিয়ে বসায়। মিরায়ার মন আনচান করছে রায়ান কি করতে চলেছে এখন এই ভেবে। রায়ান মিরায়াকে বিছানায় রেখে একটু আগে রুদ্র যেই লাগেজটা রেখে গিয়ে ছিল সেটা স্লাইড করে নিয়ে আসে মিরায়ার সামনে।
-“আপনি কি করছেন? ব্যাগ দিয়ে কি হবে? আপনি কি আবার চলে যাবেন?”
মিরায়া রায়ানের পরবর্তী পদক্ষেপ বুঝতে পারছিল না বলে রায়ানকে এমন প্রশ্ন করলো।
রায়ান মিরায়ার দিকে তাকিয়ে হালকা হেঁসে আবার চোখ ব্যাগের দিকে নামিয়ে বলল-
“চিন্তা করো না, আমি আর কোথাও যাচ্ছি না। শিক্ষা হয়ে গেছে আমার। এরপর যেখানে যাবো আমার হৃদপাখি সাথে যাবে। এবার হ্যাপি?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কথাটা রায়ান ব্যাগের চেইন খুলতে খুলতে বলল।
মিরায়া রায়ানের কথা গায়ে না মেখে মতো করে মুখ ভেঙিয়ে ফিসফিস করল-
“শিক্ষা যে হয়েছে তা ওই ডিভোর্স পেপার আর আপনার এখনকার ব্যাবহার এর আকাশ পাতাল তফাত দেখে বুঝতে পেরেছি অনেক টাই। এবার শুধু বাজিয়ে দেখার পালা। সত্য কোনটা আর ভুল কোনটা।”
রায়ান মিরায়ার কথা শুনতে পেলো না তবে অল্প আওয়াজে তার মনে হলো মিরায়া বরাবরের মতো তাকে অপবাদ দিচ্ছে বিভিন্ন গালির মাধ্যমে। রায়ান সেগুলো তে নজর না দিয়ে ব্যাগটা আন-প্যাক করে মিরায়ার সামনে খুলে দিয়ে হাতের ইশারায় ব্যাগটা দেখিয়ে বলল-

“ট্যা..ডা..!”
মিরায়া রায়ানের উৎসাহ ভরা মুখটা দেখে হেঁসে ব্যাগটার দিকে তাকাতেই দেখলো সম্পূর্ণ ব্যাগ ভর্তি বাইরের দেশের চকলেটস, চিপস, কোল্ড ড্রিংকস, বিস্কিটস ইত্যাদি (বিভিন্ন প্রকারের আরো শুকনো খাবার-দাবার ছিল)। মিরায়া ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে রইল ব্যাগটার দিকে। আশ্চর্য হয়ে রায়ান কে প্রশ্ন করলো-
“এইসব কি? এতো কিছু কার জন্য?”
রায়ান একটু চোখ বাকিয়ে বলল-
“কার জন্য আবার কি! এই ঘরে এই মুহূর্তে তুমি ছাড়া যেহেতু কেউ নেই, অবশ্যই সব তোমার জন্য। এই বুদ্ধি নিয়ে ঢাবি য

তে চান্স হলো কিভাবে তোমার?”
মিরায়া আরও বিরক্তি প্রকাশ করে রায়ানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল-
“আমার জন্য হলে এতোসব কেন? আপনার কি আমাকে দেখলে মনে হয় যে এসব আমি একা খেতে পারবো? আপনি এই বুদ্ধি নিয়ে এতবড় বিজনেস কিভাবে সামলান?”
রায়ান বউয়ের সাথে যুক্তি তর্কে পেরে উঠবে না ভালোই বুঝতে পারছে বউ আইন বিভাগে পড়ছে বলা চলে তারই প্রভাব। রায়ান তর্কে না জড়িয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল-
“বললাম না তখন এখন আমি এসে গেছি তুমিও হেলদি হয়ে যাবে। ওর জন্যই এই ছোট্ট প্রচেষ্টা। ট্রাস্ট মি বেইব আমেরিকার সব বেস্ট স্নেক্স এইগুলো ভীষণ মজা। একটা কিছুও বাদ যায় নি, আমি নিজে চেক করেছি।”
মিরায়া রায়ানের দিকে তাকিয়ে পরপর চারবার চোখের পলক ফেলল-“মানুষটা পাগল নাকি! আমেরিকা থেকে আমার জন্য এসব বয়ে এনেছে শুধু আমাকে খাওয়াবে বলে!” (মনে মনে)
মিরায়া হাঁফ ছেড়ে ব্যাগটার দিকে তাকিয়ে বলল-

“আপনি আমাকে হেলদি কেন করতে চান এখনো মাথায় ঢুকছে না তবে এইগুলো কোনো টাই হেলদি না সব আন-হেলদি।”
রায়ান হেসে মিরায়ার দুই গালে হাত রেখে বলল-
“ওইসব তোমার বুঝতে হবে না, ওটা আমার একান্ত ব্যক্তিগত প্রয়োজনীয়তা। আর এসবের একটাও আন-হেলদি না, আমি সবকিছু চেক করে এনেছি। সবগুলোর রো ইনগ্রিডিয়েন্স ভালো।”
মিরায়া ব্যাগের মধ্যে থাকা ৩ বক্স চকলেট আর চকলেট বারস গুলোর দিকে আঙুল করে বলল-
“তাহলে আপনি বলতে চাইছেন, চকলেট ও আমার জন্য হেলদি?”

রায়ান একটু চুপ করে গেল। আসলে রায়ানের বলা কথা সত্যি বাকি সব সে দেখেই এনেছে তবে চকলেট এনেছে মিরায়া পছন্দ করবে তাই। রায়ান নিজে মিষ্টি খায় না খুব একটা, চকলেট ও না, এমন কি চা বা কফিতেও না। কিন্তু শুধু মিরায়া পছন্দ করবে বলেই এনেছিল। মিরায়াও চকলেট আন-হেলদি বলল বলে সে সন্তুষ্ট মনে বলল-
“আচ্ছা তাহলে চকলেট খেতে হবে না। বাকি গুলো খাবে। আমি চকলেট সরিয়ে নিচ্ছি।”
মিরায়া এবার নিজের কথাতেই ফেসে গেল। চকলেট তার ভীষণ পছন্দ কিন্তু তেমন খায় না। তাও বাইরের থেকে আনা চকলেট খাবে না তা কিভাবে হয়? রায়ান চকলেট সরিয়ে নিতে গেলে মিরায়া বিছানা থেকে উঠে তড়িঘড়ি করে ব্যাগটার অপর অংশ দিয়ে খাবার গুলো ঢেকে দিয়ে বলল-

“সব আমার জন্য এনেছেন মানে সব কিছুই আমার। চকলেট আন-হেলদি হলেও ওগুলো আমারই।”
রায়ান মিরায়ার দিকে তাকাতেই একটা বাচ্চার প্রতিবিম্ব তার মাঝে দেখতে পেলো। রায়ান হেসে ব্যাগটা আবার খুলে চকলেট গুলো উঁচু করে নিচের থেকে কিছু বের করতে উদ্যত হতেই মিরায়া জোরে বলল-
“আরে অদ্ভুত, বললাম তো চকলেট সরাতে হবে না।”
রায়ান মিরায়ার কথার উত্তর না দিয়ে দুইটা বক্স বের করলো ব্যাগ থেকে। মিরায়া চুপ করে গেল যখন দেখলো রায়ান চকলেট সরাচ্ছিল না বরং অন্য কিছু বের করছিল। কিন্তু মিরায়া বুঝতে পারলো না ওইগুলো কিসের বক্স যেহেতু বক্স গুলো ডেকরেট করা ছিল রেপিং পেপার আর রিবন দিয়ে। সে একটু ভ্রু কুঁচকে তাকালো ওই গুলোর দিকে।

-“এইটা নাও।” রায়ান একটা বক্স মিরায়ার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল।
মিরায়া অবাক হয়ে বক্স টা হাতে নিল-“এটার ভিতরে কি আছে?”
রায়ান-“খুলে না দেখলে কিভাবে বুঝবেন ম্যাডাম। ওপেন ইট।”
মিরায়া রায়ানের কথার ভেঙচি কেটে বক্স টার রেপিং পেপার টা খুলে ফেলল। আর তখনি উঁচু গলায় আওড়ালো-
“আইফোন!?”
রায়ান মিরায়ার দিকে এগিয়ে বলল-“দ্যাটস রাইট। আই ফোন 17 প্রো ম্যাক্স। এবার খুলে দেখো।”
মিরায়া ফোনের উপরের অংশ টা আলাদা করতেই কালো রংয়ের ফোন দেখতে পেল। মিরায়া ফোনটা বের করে রায়ানকে প্রশ্ন করলো-
“আপনি এটা কেন এনেছেন?”
রায়ান আশ্চর্য হয়ে বলল-“আরে তুমিই তো বললে কমলা রং টা তোমার ভালো লাগে নি তাই ব্ল্যাক এডিকশনের টা নিয়েছি।”

মিরায়া বিরক্ত ভাব দেখিয়ে-“আমি রঙের কথা বলছি না। ফোন কেন এনেছেন।”
রায়ান শান্ত গলায় বলল-“তুমি না বললে ওই দিনের এতো কল ঢোকার পর থেকে ফোন হ্যাং করছে তাই এনেছি। তোমার পছন্দ হয়নি? না হলে এখন চলো অন্য একটা কিনে দিচ্ছি।”
মিরায়া হা করে তাকিয়ে রইল রায়ানের দিকে। কি বলবে মাথা কাজ করছে না। তবু রায়ানকে বুঝানোর বৃথা চেষ্টা করলো-
“আরে পছন্দের ব্যাপার না। আপনি এতো দামি একটা ফোন কেন কিনতে গেলেন। কোনো প্রয়োজন..!”
-“এই চুপ। ১৭০০ কোটির ডিল সাইন করার পর ফোনটা আর দামি মনে হয় নি তাই কিনেছি, তোমার কি? দিয়েছি সুতরাং এটাই ব্যবহার করবে।”

মিরায়া রায়ানের কথা শুনে বিড়বিড় করলো আশ্চর্য হয়ে-“১৭০০ কোটি?!”
কিন্তু ফোনটা মিরায়ার নিতে আপত্তি ছিল তাই সে প্রতিবাদী গলায়-“কিন্তু রায়ান আপনি বুঝছেন না…”
-“সসস্! চুপ। কথা কম বলো।” রায়ান মিরায়ার একদম কাছে এসে তার ঠোঁটে আঙুল রেখে চুপ করিয়ে বলল।
মিরায়া মুহূর্তের মধ্যে চুপ হয়ে গেল ওই পরিস্থিতিতে কিছু বলতেও পারলো না। রায়ান মিরায়াকে আবার বিছানার উপর বসিয়ে দিলো আর নিজে হাঁটু ভেঙ্গে মেঝেতে বসলো। তার চোখের চাহুনিতে আজ অন্য রকম অধিকার বোধের ঝলকানি দিচ্ছিল। মিরায়া রায়ানের দিকেই তাকিয়ে সব কিছু ভাবছে মনে মনে-
“রায়ান আপনি যদি আমাকে সত্যিই এতো টা চেয়ে থাকেন তাহলে ওই ডিভোর্স পেপার আপনার কাছে কেন ছিলো? কোনটাকে সত্যি মানবো আমি? যা অনুভব করছি তা? নাকি যা শুধুই কাগজে দেখেছি সেটা?”
রায়ান মিরায়ার দিকে এবার দ্বিতীয় বক্সটা এগিয়ে দিয়ে বলল- “হৃদপাখি এবার এইটা খোলো।”
মিরায়ার মনে এবার চিন্তা ভীর করলো এই বক্সে কি থাকবে এইবার। সে রায়ানের হাত থেকে বক্সটা নিয়ে আন-রেপ করতেই দেখলো একটা ছোট গয়নার বক্স। কিন্তু স্বাভাবিক কোনো গয়নার বক্স বলে মনে হচ্ছে না।
বক্স টা কাঠের তৈরি, আর তার সামনে একটা ছোট্ট হাতল। উপরে খোদাই করে মিরায়ার নাম লিখে রাখা। মিরায়া নিজের নামটা খেয়াল করতেই সেটার উপর নিজের আঙুল বুলিয়ে রায়ানকে প্রশ্ন করলো-
“এখানে তো আমার নাম খোদাই করা! কিভাবে হলো?”

রায়ান হেঁসে বলল-“আমি করিয়েছি। কাস্টমাইজড জুয়েলারি বক্স। এ্যান্ড ইউ নো হুয়াট? এইটাতে যেই কাঠ ব্যবহার করা হয়েছে সেটা ওয়ার্ডের সবচেয়ে বেস্ট কুয়ালিটিফুল এ্যান্ড প্রাইসি।”
মিরায়া রায়ানের বলা কথা শুনে আবার একবার বক্সকা হাত দিয়ে ছুয়ে দেখলো। রায়ান মিরায়ার এমন অবাক হওয়া দেখে মিরায়াকে বলল-
“বেইবি ভিতরে কি আছে দেখবে না? খুলো বক্সটা।”
মিরায়া রায়ানের কথায় ধ্যান থেকে বাস্তবে ফিরে হালকা কাঁপতে থাকা হাতে বাক্সটা খুলতেই সেখান থেকে একটা তেলাপোকা বের হয়ে আসে। আর মিরায়া সেটা হঠাৎ দেখতে পেয়ে চিৎকার করে উঠলো-“আআআআআআ..মাআআ!”

মিরায়া ভয় পেয়ে নিচে বসে থাকা রায়ানের কলে চড়ে বসলো। রায়ান দুষ্টু হেঁসে মিরায়ার কোমর ধোরে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। রায়ান ইচ্ছে করে এটা করেছে মিরায়াকে ভয় দেখাতে দুষ্টুমি করে। মিরায়া রায়ানের কাঁধের দিকে গলার ভাঁজে মুখ লুকিয়ে নিল। রায়ান শক্ত করে মিরায়াকে ধরে আছে। কিছু সময় বাদে মিরায়ার নিঃশ্বাস ভারি আর গরম হয়ে এলো, তেলাপোকার ভয় কেটে গেছে কিন্তু নিজের অবস্থান কোথায় বুঝতে পেরে সে আরো ভয়ে সিটিয়ে গেলো। রায়ান নিজের গলায় মিরায়ার উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভব করতে পেরে নিজের নিয়ন্ত্রন হারাচ্ছে ধীরে ধীরে। সে মিরায়ার কোমর আরো শক্ত করে আকড়ে ধরলো। মিরায়া একটুও কেঁপে উঠে রায়ানের থেকে সড়তে চাইতেই রায়ান আবার মিরায়াকে ভয় দেখালো-

“ওই যে তেলাপোকা!”
-“আআউউ..!”
মিরায়া আবার রায়ানের গলা জড়িয়ে ধরলো।রায়ান শব্দ করে হেঁসে উঠতেই মিরায়া রেগে গেলো‌। মিরায়া রায়ানের কোলে সোজা হয়ে বসে রায়ানের বুকে পিঠে তার ছোট হাতে আঘাত করে বলল-
“বজ্জাত বেডা, নির্লজ্জের হাড্ডি, আমাকে এভাবে ভয় দেখালেন কেন? আর একটু হলেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেত, আর না হলে দম বন্ধ হয়ে মরে যেতাম।”
রায়ান বাঁকা হেঁসে বলল-“এতো সহজ মনে হয় তোমার? হার্ট অ্যাটাক হলে প্রয়োজনে হার্ট ট্রান্সফার করে নিতাম আর দম আটকে গেলে নিজের টা তোমার সাথে শেয়ার করতাম। নিজের ব্রিদিং এমন কাজে লাগাতে পারলে বেঁচে থাকা সার্থক।”

মিরায়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবার রায়ানের বুকে হাত দিয়ে আঘাত করে বলল-“অশ্লীল লোক। ছাড়ুন আমাকে। আপনি ডেঞ্জারাস। আপনার কাছে থাকা যাবেনা।”
এই বলে মিরায়া রায়ানের কোল থেকে উঠতে যাবে তখনি রায়ান মিরায়াকে টান দিয়ে আবার নিজের কোলে ফেলে দিয়ে প্যান্টের পকেটে হাত দিয়ে সেখান থেকে একটা ব্রেসলেট বের করে করলো।
ব্রেসলেট—পুরোটাই সাদা সোনার ওপর নিখুঁতভাবে বসানো একেকটা ছোট ছোট ডায়মন্ড, যেন আলোর কণা ছড়িয়ে আছে সারি সারি করে। প্রতিটা নড়াচড়ায় ডায়মন্ডগুলো থেকে প্রতিফলিত আলো চোখে পড়ে চকচক করে উঠছিল, নরম আলোতেও যেন নিজেই জ্বলছিল ব্রেসলেটটা। ডিজাইনটা ছিল রাজকীয় অথচ মার্জিত—পাতলা, নিখুঁতভাবে গাঁথা, কিন্তু এক নজরেই বোঝা যায়, এর দাম সাধারণের নাগালের অনেক বাইরে।
মিরায়া অবাক হয়ে তাকালো ব্রেসলেট টার দিকে। রায়ান মিরায়ার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে ব্রেসলেটটা পড়িয়ে দিতে দিতে বলল-

“তোমার কাছে অন্য কোন উপায়ান্তর নেই পাখি। এই ডেঞ্জারাস আমিটার কাছেই থাকতে হবে তোমাকে।”
মিরায়ার বুকের কম্পন হঠাৎ অতি দ্রুত হয়ে গেলো। রায়ান মিরায়ার হৃৎস্পন্দনের শব্দ নিজের কানে শুনতে পেয়ে বললো- “নিজের মনকে শান্ত করো হৃদপাখি আমি অশান্ত হলে পরিস্থিতি আউট অফ কন্ট্রোল হয়ে যাবে।”
মিরায়া কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেল না মুখে যেন আঠা লেগে আছে। রায়ান মিরায়ার হাতে ব্রেসলেট টার পড়িয়ে দিয়ে হাতটা কাছে নিয়ে তার ঠোঁটে ছোঁয়ালো সেখানে। মিরায়ার শরীর মৃদু কেঁপে উঠলো। মিরায়া নিজের হাতটা রায়ানের কবল থেকে মুক্ত করে নিয়ে আবার উঠতে চাইলো রায়ানের কোল থেকে কিন্তু রায়ান এবারও বাঁধা দিল।
মিরায়া অস্বস্তিতে আমতা আমতা করে বলল-“ছেঁ.. ছেঁড়ে দিন না, প্লিজ।”
রায়ান অধৈর্য গলায় বললল- “ছাড়তেই তো পারছি না হার্ট বার্ড। সমস্যা টাই এখানে- না ছাড়তে পেরেছি, না পারছি, আর না ভবিষ্যতে পারবো।”

মিরায়া রায়ানের দিকে তাকিয়ে ভাবলো-“উনি কি এই মাত্র ছাড়তে পারেন নি বলতে আমাকে ডিভোর্স না দিতে পারার কথা বললেন? কেন পারবেন না? আমাকে ভালোবাসেন তাই? নাকি অন্য কিছু!”
মিরায়ার এই মুহূর্তে নিজেকে খুব অসহায় লাগছিল সে কি ভেবেছিল আর কি হচ্ছে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। মিরায়া মনে মনে অন্য সব কথা চিন্তা করতে শুরু করলো-
“আল্লাহ আমি কি করবো। একটা মানুষ এতোটা বেপরোয়া শুধু আমাকে নিয়ে। এতো আয়োজন তার শুধু আমার জন্য। আমার এত বছরের অপেক্ষার তুলে রাখা সকল শাস্তি কিভাবে তার উপর প্রয়োগ করবো? কিচ্ছু বুঝতে পারছি না। নিজেকে এতো দূর্বল কেন লাগছে? আমি তো এমন নই।”
রায়ান মিরায়ার চিন্তা ভরা মুখটা দেখে মিরায়ার মুখে উড়ে আসা চুলগুলোকে তার কানের পিছনে সরিয়ে দিয়ে বলল-

“এতো ভেবো না পাখি। আর এসব উল্টো পাল্টা আবদার আমার কাছে করবে না। তোমার আবদার মেটাতে না পারলে আমার শান্তি লাগবে না আর না ওই আবদার আমি কখনো পূরণ করবো।”
মিরায়া নিজেকে রায়ানের জায়গায় রেখে একবার বোঝার চেষ্টা করলো-
“আচ্ছা দশ বছর আগে আমি উনার জায়গায় হলে কি করতাম? ওতো ছোট বয়সে নিজের অজান্তে দশ বছরের ছোট মেয়ের সাথে হওয়া বিয়ে কি মেনে নিতাম ? যেখানে আমি মেয়েটাকে চিনি না জানি না!
হয়তো না। বিয়ে একটা পবিত্র বন্ধন, এখানে জোর চলে না। এতে উনার দোষ কোথায়? আর আমিই বা কি করতে পারতাম তখন তাকে নিজের কাছে আটকে রাখতে? কিভাবে তাকে এমন কিছুর জন্য দোষারোপ করবো যেটা নিজের ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক মনে হচ্ছে?”

মিরায়া রায়ানের দিকে একটানা এভাবে তাকিয়ে থাকাতে রায়ান কিছু টা শান্ত মনে মিরায়ার মুখটা কাছে টেনে তার কপালে স্নেহের পরশ এঁকে দিয়ে বলল-
“হৃদপাখি আমার তোমাকে কিছু বলার আছে। শুনবে?”
মিরায়ার মন হঠাৎ কেঁপে উঠলো-“কি বলবেন উনি? আমাদের বিয়ের ব্যাপারে! যদি বলেন তাহলে আমি কি করবো? কিভাবে সামাল দেবো সবকিছু।”
রায়ান মিরায়াকে চুপ থাকতে দেখে আবার জিজ্ঞেস করলো-
“কি হলো? বলো শুবে?”
মিরায়া আগু পিছু না ভেবে মাথা উপর নিচ নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।
তখনি মাহির দরজায় নক না করেই রায়ানের ঘরে ঢুকলো জোরে কথা বলতে বলতে-
“ওই তুই কই মরলি আবার। দেরি হয়ে যাবে, খাবি না?”

ঘটনাটা হঠাৎ ঘটায় মিরায়া রায়ান কিছু বুঝলো না। মিরায়া দুই হাতে রায়ানের গলা আকরে ধরে আছে রায়ানের হাতও তখন মিরায়ার কোমরেই। দুজনেই শব্দ পেয়ে অবাক চোখে দরজার দিকে তাকায়। মাহির দরজা ঠেলে ঢুকে রায়ান মিরায়াকে ওই রকম অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখে সাথে সাথে চোখে হাত দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বলল-
“আসতাগফিরুল্লা, নাউযুবিল্লাহ, তওবা তওবা।”
রায়ান মিরায়া মাহির কে দেখে দুইজন দুজনের দিকে তাকিয়ে জিভ কামড় দিয়ে তাড়াতাড়ি আলাদা হয়ে মেঝেতেই দুই দিকে সড়ে হাঁটু মুড়ে বসে। মিরায়ার মনে হচ্ছিল পারলে পাতালে চলে যায় এখনি। আর রায়ান তো বেজায় বিরক্ত হয়ে বিড়বিড় করলো-

“আল্লাহ এমন মানুষ জন কেন দিছো তুমি আমার জীবনে। আমার এমন কাঙ্খিত মুহূর্ত গুলোতে সব সময় বেগরা দিতে কেউ না কেউ থাকবেই। কেনননননন!”
রায়ান নিজের চুল খামচে ধরলো।
মাহির ভালোই বুঝতে পারছে তার উপস্থিতি এই মুহূর্তে কতোটা বিরক্তি কর লাগছে রায়ানের কাছে। মাহির উল্টো হয়ে দাঁড়িয়ে থেকেই নিজের সাফাই দিতে বলল-
“দোস্ত বিশ্বাস কর, আমার দোষ নাই। আন্টি তোকে ডাকতে বলল। আর আমি তো এর আগে তোর রুমে নোক করে কখনো ঢুকি নি তাই অভ্যাসবশত ভুল হয়ে গেছে। আই সুয়ের আমি কিছু দেখি নি।”
মিরায়া দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করছে। লজ্জায় এমন অস্বস্তিকর অনুভব হচ্ছে তার বলে বুঝানোর মতো না। রায়ান উঠে দাঁড়িয়ে মাহির কাছে গিয়ে ওর কানে বলল-

“শালা তোরে তো আমি রেসের সময় দেখে নিব। তোর মতো বন্ধু আর আমার লাগবে না। অন্যদের বন্ধুদের দেখি মেয়ে বিয়ের আসর থেকে তুলে এনে বন্ধু সাথে বিয়ে দেয়। আর তুই এক, বিবাহিত বন্ধুর বিয়েটা টিকাইতেও সাহায্য করতে পারিস না। তো কি ঘাস কাটতে লাগবো আমার তোরে?”
মাহির বুঝতে পারছে রায়ান কি পরিমান রেগে গেছে। মাহির তাও স্বাভাবিক থেকে বলল-
“তাইলে চল আজকে ভাবিকে তোর সাথে অফিসিয়ালি বিয়ে দিয়ে দেই আমি। খুশি থাক তাও।”
রায়ান রেগে মাহিরকে আরো কিছু বলবে তার আগেই মাহির রায়ানকে বলল-
“হইছে তো ভাই। এখন আমারে ঝাড়া বাদ দিয়ে তোর বউ কে সামলা।”
রায়ান মিরায়ার দিকে একবার তাকিয়ে আবার রেগে মাহির এর উদ্দেশ্যে বলল-
“তোর বউ কি আবার তোরে না বলছি ভাবি মা ডাকতে। বের হো এখন তোর সামনে ও নরমাল হবে না।”
মাহির-“আচ্ছা ঠিক আছে। তুই আয় আমি নিচে আছি।”
মাহির রায়ানের ঘর ত্যাগ করে নিচে চলে যায়।
মাহির চলে যাওয়ার পর রায়ান ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে মুখ লুকিয়ে বসে থাকা তার ছোট্ট বউটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখলো।
তারপর হাঁফ ছেড়ে মিরায়ার কাছে গিয়ে রায়ান হাঁটু গেড়ে বসে মিরায়ার চুলে হাত রেখে বললো-

“মুখ তুলো পাখি। ও চলে গেছে।”
মিরায়া মাথা না সূচক নাড়িয়ে শব্দ করলো-“উঁহু!”
রায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেলে মিরায়াকে বসা অবস্থা থেকে কোলে তুলে নিলো। মিরায়া চমকে গিয়ে রায়ানের গলা জড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো-
“আবার কি হলো?”
রায়ান না বুঝার ভাব নিয়ে-“কি আবার কি হলো?”
মিরায়া আবার বলল-“কোলে নিলেন কেন আবার তা জিজ্ঞেস করলাম।”
রায়ান মিরায়াকে বিছানায় বসিয়ে বলল-“আমার ইচ্ছা হলো তাই। অনেক দিন ব্যস্ত থাকায় এক্সারসাইজ করা হয়নি তাই শরীরটাকে খাটাচ্ছি।”

মিরায়া মুখ বেঁকিয়ে ঘুরিয়ে নিলো রায়ানের থেকে। রায়ান ঠোঁট কামড়ে হেঁসে মিরায়া ব্রেসলেট পড়ে থাকা হাতটা নিজের হাতে নিয়ে মিরায়ার উদ্দেশ্যে আদেশ মূলক কন্ঠে বলল-
“এই যে ম্যাডাম, এইটা যেন হাত থেকে কখনো খোলা না হয়। সাবধান করে দিলাম।”
মিরায়া আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলো-“কেন?”
রায়ান মিরায়ার চোখে চোখ রেখে বলল-“আমি বলেছি তাই।”
মিরায়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার প্রশ্ন করলো-“কখনোই খোলা যাবে না? গোসলের সময় ও না?”
রায়ান মাথা ডানে বামে ঘুরিয়ে উত্তর করলো-
“না, খুলা যাবে না। শুধু একটা কারণ ছাড়া।”
মিরায়া তখনি উৎসাহিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো-“কি কারণে?”
রায়ান মিরায়ার সামনে থেকে সরে গিয়ে বলল-“জানতে হবে না।”
মিরায়া কৌতুহলী হয়ে জেদ ধরে রায়ানকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল-“জানতে হবে আমার। বলুন কি কারণে খুলা যাবে?”

রায়ান মিরায়ার কোমর ধরে আবার নিজের বুকে টেনে তার মুখ মিরায়ার কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলল-
“যদি তোমাকে নিজের করে পাওয়া সময় এটা আমার বিরক্তির কারণ হয় তাহলে খুলবো আমি। বুঝেছ না ডিটেইলসে বুঝাবো?”
মিরায়া আতকে উঠে রায়ানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বলল-“আচ্ছা আপনার লজ্জা নেই, তাই না? ”
রায়ান স্বাভাবিক শান্ত গলায় স্বীকার গেল-“না নেই। বেডা মানুষ তার বেডির কাছে নিতান্তই নির্লজ্জ।”
মিরায়া রায়ানের সাথে আর তর্ক করতে চাইলো না তাই সোজা দরজার দিকে এগোলো। তখনি রায়ান আবার পিছন থেকে বলল-

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪০

“আবারও বলছি, ওটা হাত থেকে খুলবে না। আমি ছাড়া ওটা খুলার অধিকার কারো নেই। মাইন্ড ইট।”
মিরায়া মুখ না ঘুরিয়ে ঘর থেকে বের হলো। আর তার পিছন পিছন রায়ান ও বের হলো নিচে যেতে। একটু আগেই মাহির এসে বলেছে মা ডেকেছে খেতে।

আত্মার অঙ্গীকারে অভিমোহ পর্ব ৪০ (৩)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here