না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৪ (৩)
মাইশা জান্নাত নূরা
ইলমার পাশের রুমে ছেলেদের পোশাক পরিহিত সেই মানুষটি যখন চাবি ঘুরিয়ে দরজার তালা খুলতে ব্যস্ত তখন পিছন থেকে ইলমা দৃঢ় কণ্ঠে বললো….
—“মাফ করবেন, আপনি কে?”
মানুষটা থেমে গেলো। ইলমার দিকে ঘুরে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কয়েক সেকেন্ড। ইলমা হালকা চমকে উঠলো। মনে মনে আওড়ালো…
—”ওমা! এ তো একজন মেয়েই!”
মেয়েটার চুলগুলো ছোট করে কাটা৷ চোখের নিচে ক্লান্তির হালকা ছাপ স্পষ্ট ফুটে আছে। ফর্সা শরীরের বর্ণ। বয়সটা অনেক কম। ১৫-১৬ হবে হয়তো। ইলমা অবাক কন্ঠে বললো….
—“আপনি এখানে থাকেন?”
মেয়েটা তার চোখ নামিয়ে নিলো। কন্ঠ নিচু করে উত্তর দিলো….
—“হ্যা। আমি এখানেই থাকি।”
তারপর ইলমাকে ২য় কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে মেয়েটা তাড়াহুড়ো করে নিজের রুমে ঢুকে দরজাটা ঠা*স করে বন্ধ করে দিলো। ইলমা ‘থ’ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো সেই জায়গাতেই। বিস্ময় ভরা কন্ঠে বললো…
—“এ কেমন মেয়ে রে বাবা! এমন আচরণ করলো কেনো? আমি তো কিছুই বলি নি!”
অতঃপর ইলাম একটু থেমে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো….
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
—“কোনো না কোনো ব্যপার-স্যপার তো আছেই এই মেয়ের মাঝে। নয়তো একা থাকতে থাকতেই এমন হয়ে গিয়েছে। সবার থেকে পালিয়ে বেড়ানোর স্বভাব তৈরি হয়েছে।”
ইলাম রুমে ফিরে এসে মেঝেতেই কিছুক্ষণ পায়চারি করলো। রাত একটু গাঢ় হতেই ইলমা একটা প্লেটে রান্না করা ভাত-তরকারি উঠিয়ে নিলো সেই অচেনা মেয়েটির জন্য। প্লেটটি হাতে নিয়ে মেয়েটির দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে কিছুটা ই*ত*স্তত বোধ নিয়ে নরম কণ্ঠে বললো….
—”আমি পাশের রুমে আজ নতুন উঠেছি। ভাবলাম, যেহেতু একসাথে থাকছি, পরিচয়টা হওয়া যাক। আপনি ভয় পাবেন না। আমি আপনার কোনো অ*সুবিধা হয় এমন কাজ করবো না।”
রুমের ভেতর থেকে কোনো শব্দ এলো না। পরিবেশটা পুরোপুরি নীরব হয়ে আছে। ইলমা আবারও বললো…..
—“আপনি যদি না চান তাহলে আমি আপনাকে বির*ক্ত করবো না। শুধু বলছিলাম, আমি ২জনের পরিমাণে ভাত ও তরকারী রান্না করেছিলাম। তাই আপনার জন্য না এনে পারলাম না। রুমের বাইরেই দরজার সামনে রাখলাম। ইচ্ছে হলে খেয়ে নিয়েন।”
ইলমা একটু নিরব রইলো এই ভেবে, এবার হয়তো ভিতর থেকে মেয়েটা কোনো সাড়া দিবে। কিন্তু না, নিস্তব্ধতা আগের থেকে আরো গাঢ় রূপ ধারণ করলো। ইলমা হালকা হেসে বললো…..
—“আপনি ঠিক আমার মতোই জানেন! আমিও সহজে কাউকে বিশ্বাস করি না। ঠিক আছে, আপনি সময় নিন। আমি তো পাশের রুমেই আছি। কখনও কোনো দরকার মনে করলে বিনা দ্বিধায় ডাকবেন।”
এই বলে ইলমা নিজের রুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে দু’কদম এগোতেই পিছন থেকে মেয়েটার রুমের দরজাখটাস করে খুলে গেলো। ইলমা থেমে গেলো। ওর ঠোঁটে হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। আবারও ঘুরে তাকালো পিছনে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই মেয়েটা। ইলমা মেয়েটির চোখে এক ধরনের ভ*য় আর দ্বিধা দেখতে পেলো। ইলমার হাসি থেমে গেলো।
ভ্রু যুগল কিন্ঞ্চিত কুঁচকে এলো। মেয়েটি একটি কথাও না বলে হালকা ঝুঁকে দরজার সামনে রাখা খাবারের প্লেটটা তুলে নিয়ে আবারও দরজাটা ভিতর থেকে লাগিয়ে দিলো। ইলমাও এ বিষয়ে আর মাথা না ঘামিয়ে নিজ রুমে চলে এলো। নিজের জন্য অল্প খাবার প্লেটে উঠিয়ে নিয়ে খেলো। এরপর বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো। সারাটাদিন এটা-সেটা করতে করতেই কেটে গেলো ওর। ঘর গুছানো এখনও অনেকটাই বাকি। আগামীকাল বাকি থাকা কাজগুলো শেষ করবে বলে মনঃস্থির করেছে সে। ক্লান্তির ভাড়ে ওর দু’চোখ বুঁজে এলো।
বাংলোর ভিতর ড্রয়িংরুমে নিভু নিভু ভাবে বাতিগুলো জ্বলছে। সোফার উপর নির্ঝর নিঃশব্দে বসে আছে। ওর দু’চোখের জল অনেক আগেই শুকিয়ে গিয়েছে। ফর্সা বর্ণের চোখের নিচে হালকা কালচে দাগ দেখা যাচ্ছে। ঠোঁটজোড়া মৃদুভাবে কাঁপছে এখনও। নির্ঝরের সামনেই টি-টেবিলের পাশে দু’হাটু ভাঁজ করে মাথা নুইয়ে মেঝের উপর বসে আছে তেজ।
কিয়ৎক্ষন পর তেজ বসা থেকে উঠে সিঁড়ি বেয়ে উপরে যেতে শুরু করলো। কেমন এলোমেলো লাগছে তেজের হাঁটার ধরণ। ঠোঁটে কোনে কে*টে যাওয়া অংশে শেষ র*ক্তটুকু জমাট বেঁধে আছে। থা*প্প*ড় খাওয়া গালটা হালকা ফুলে উঠেছে৷
নির্ঝর ঘাড় ঘুরিয়ে তেজের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো কেবল। মুখ ফুটে কিছু বলতে চেয়েও যেনো বলতে পারলো না। কথাগুলো আটকে যাচ্ছে গলার ভেতরেই। তবুও নির্ঝর জানে, তেজের এই মুহূর্তে একা থাকা দরকার।
ছাদের দরজাটা খুলে ভিতরে প্রবেশ করলো তেজ।
বাইরে টুপটাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। কালচে মেঘের দল চাঁদ ও তারাদের ঢেকে নিয়েছে চারপাশ থেকেই।তেজ ধীরে ধীরে সামনের দিকে এগিয়ে এসে ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালো। এলোমেলো হাওয়ায় ও বৃষ্টির টিপটাপ ফোঁটায় তেজের কালচে চুলগুলো ভিজে গিয়ে কপালের সাথে লেপ্টে যাচ্ছে। তেজের ঠোঁটজোড়াও মৃদুভবে কাঁপছে। একটু পর পর ভারী নিঃশ্বাস ফেলছে সে।
তেজ মাথা নিচু রেখেই কাঁপান্বিত কণ্ঠে বললো…..
—“আমি, আমি অনেক বড় পা*পী। আল্লাহ, আমার আপনার কাছেও মুখ দেখানোর কোনো উপায় নেই।
যে বড় ভাইয়ের কাঁধে ভর দিয়ে আজ এতো বড় হয়েছি! সেই ভাই আমার দিকে ঘৃ*না ভরা দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছে, ‘তুই আমার কাছে আজ থেকে মৃ*ত’…!”
তেজ থামলো। শব্দ করে নিঃশ্বাস ফেলে আবারও বললো….
—”হ্যাঁ, আমি মৃ*ত! বেঁচে থেকেও আজ আমি মৃ*ত!”
তারপর তেজ হঠাৎ হেসে উঠলো। কি বি*কৃ*ত লাগছে সেই হাসির শব্দ! হাসতে হাসতে বললো….
—“হাহাহা…! মৃ*ত আমি! হ্যাঁ, আমি মৃ*ত! দেহের মৃ*ত্যুতেই কেবল মানুষের মৃ*ত্যু হয় না, মনের মৃ*ত্যু*তেও মৃ*ত্যু হয়। দেহের মৃ*ত্যু মানুষকে দুনিয়াবি য*ন্ত্র*ণা থেকে মুক্তি দেয় আর মনের মৃ*ত্যু মানুষকে দুনিয়াবি জীবনেও জা*হা*ন্নাম দেখিয়ে দেয়। দুনিয়াবি জীবনে জা*হা*ন্না*মে*র আ*গুনে দ*গ্ধ হয়েও য*ন্ত্র*ণার শেষ হয় না। এরপর দেহের মৃ*ত্যু হলে দুনিয়াবি জীবনে করা প্রতিটি পা*প কর্মের ফল হিসেবে পরকালের জীবনেও জা*হা*ন্না*মে*র আ*গুনে পু*ড়ে ছাড়-খাড় হতে হয়।”
তেজের বি*কৃ*ত সেই হাসি থেমে গেলো। তেজ আকাশ পানে চেয়ে বললো….
—”আমার ভেতরটা তো পঁ*চে গিয়েছে তাই হয়তো নিঃশ্বাস নেওয়াটাকেও বড় অভি*শাপ বলে মনে হচ্ছে।”
তখুনি ব*জ্র-পাত ঘটলে তার তীব্র আলোয় তেজের মুখটা এক ঝলক দেখা গেলো। কপালের উপর লে*প্টে থাকা ভেজা চুলের নিচে থাকা চোখ দু’টির ভিতরের সাদা অংশ লালচে বর্ণ ধারণ করে আছে। নোনাজল টইটম্বুর করছে। তেজ ওর বুকের বা’পাশে হাত রেখে বললো….
—“হে দয়াময়, আপনি তো জানেন আমি কতোটা নোং*রা! তবুও আপনি ছাড়া আমার যাওয়ার মতো আর কোনো জায়গা নাই।”
তেজ ওর কাঁপান্বিত ভাড়ি কন্ঠে সুর তুললো….
❝আমি পা*পি, অধম দয়াল তোমার দুনিয়ায়,
তোমার কাছে যাবার মত নেক জীবন এ নাই (২)
দয়াময়..ও..ও..ও..ও..ও..ওয়
মাফি মাঙ্গি তোমার দরবারে (২)
জীবন গেলো ভোগ বিলাসে
আনন্দ আর আড্ডালাতে
তোমার কাছে যাবার মত সঞ্চয় কিছু নাই (২)
দয়াময়..ও..ও..ও..ও..ও..ওয়
মাফি মাংগি তোমার দরবারে (২)
ক্ষমা করো দয়াল আমায়
ক্ষমা করো পাপের এই দায়
তুমি ছাড়া ক্ষমা করে
আর তো কেহ নাই (২)
দয়াময়..ও..ও..ও..ও..ও..ওয়
মাফি মাঙ্গি তোমার দরবারে (২)❞
তেজ থেমে গেলো। তখুনি মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হলো। বৃষ্টির ভাড়ি ফোঁটার সাথে তেজের চোখের জল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে।
তেজ দুই হাত আকাশের পানে তুলে চিৎকার করে বললো…..
—“ক্ষমা করুন আমায়, আল্লাহ! আমি আপনার ক্ষমার যোগ্য না জানি, তবুও ক্ষমা চাইছি! আমার ভাই আজ আমায় ঘৃণা করে। আমি তার চোখে মৃ*ত! তার কাছে আমি ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য নই।
আপনিও যদি আমায় ক্ষমা না করেন তাহলে আমি কীভাবে বাঁচবো এই পৃথিবীতে?”
বজ্রপাতের ভারী শব্দে যেনো আকাশটা কেঁপে উঠলো এবার৷ তেজের বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া শরীরটা থরথর করে কাঁপছে। তেজ আবারও বললো…
—“আমি জানি, আপনি সব দেখছেন। সব জানেন আপনি। আমার ভিতরে কতোটা আ*গুন জ্ব*লছে, আমি যে আমার পা*পের শা*স্তি পাচ্ছি! সেই সবকিছুই আপনি দেখছেন। ও আল্লাহ! আমার ভেতরে আজ একটু শান্তি দিন। এই য*ন্ত্রণা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খা*চ্ছে। কথা দিচ্ছি সব পা*প কাজ ছেড়ে দিবো এবার। আপনার ইবাদতে মশগুল হয়ে যাবো পুরোপুরি।”
রাত প্রায় ১২টা….
খান ভিলার চারপাশে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে।
মেইন গেটের ভারি লোহার দরজাটা খুলে গাড়ি নিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলো সারফারাজ। দারোয়ান আবারও গেটটা বন্ধ করে দিলো। ড্রয়িংরুমে চিন্তিত মুখশ্রী নিয়ে সেই ১০ টা থেকে সারফারাজের অপেক্ষায় বসে থাকা পিহু এবার গাড়ির শব্দে মাথা তুলে মূল দরজার দিকে তাকালো।
এইতো দুই দিন হলো পিহু সারফারাজের অর্ধাঙ্গিনী রূপে খান বাড়িতে থাকছে৷ কিন্তু সারফারাজের বাহির থেকে না ফেরা পর্যন্ত পিহুর অপেক্ষা করার এই অভ্যাসটা যেনো পুরোনো দিনের ঘরোয়া বউদের মতো হয়ে যাচ্ছে।
পিহু সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। তখুনি সারফারাজ গম্ভীর মুখ নিয়ে ভিতরে ঢুকলো। সারফারাজের সর্বশরীর ভিজে পান্ঞ্জাবিটা শরীরের সাথে লেপ্টে আছে। ভাড়ি কদমগুলো সামনের দিকে ফেলছে আর টপ টপ করে ওর শরীর বেয়ে পানি গুলো নিচে গড়ে পড়ছে।
গুটিয়ে রাখা পান্ঞ্জাবির হাতার নিচের দৃশ্যমান দু’হাতের শিরাগুলো ফুলে আছে। দু’চোখ লালচে বর্ণ ধারণ করে আছে। সারফারাজের সম্পূর্ণ মুখশ্রী কেমন ফুলো ফুলো লাগছে পিহুর কাছে।
সারফারাজ সোজা ড্রয়িংরুমেই এসে সোফার উপর মোবাইল ছুঁড়ে ফেললো। অতঃপর টি-টেবিলের পাশেই ধপ করে মেঝের উপর বসে পড়লো। পিহু তৎক্ষণাৎ সারফারাজের কাছে এগিয়ে এসে হাঁটু ভে*ঙে বসে বললো….
—”সারফারাজ! কি হয়েছে আপনার? এমন দেখাচ্ছে কেনো আপনাকে?”
সারফারাজ পিহুর দিকে হালকা হেলে গেলো। পিহু সারফারাজকে দু’হাতে ধরে নিলো। সারফারাজ কাঁপা গলায় বললো…..
—“মানুষ কখন ভা*ঙে জানো, বউ? যখন সে যাদের জন্য বাঁচে, ঠিক সেই মানুষগুলোই তার ভিতরটা কেঁ*টে-ছিঁ*ড়ে এতোটা জ*খ*ম তৈরি করে দেয় যে সেই ক্ষ*ত সারার কোনো ঔষধী আর খুঁজে পাওয়া যায় না তখন।”
পিহুর বুকের ভেতরটা কেমন মো*চ*ড় দিয়ে উঠলো সারফারাজের এরূপ কথায়। এই সারফারাজকে আজ পিহুর কাছে বড্ড অচেনা লাগছে। সারফারাজের বাহিরের শক্ত দেওয়ালের মতো রূপটার আড়ালে থাকা এই নরম, ভ*ঙ্গু*র রূপটা আজ ১ম বার দেখছে পিহু তাই হয়তো এমন অনুভূতি হচ্ছে ওর। পিহু বললো…..
—”আপনাকে বড্ড অগোছালো লাগছে এমপি সাহেব। দয়াকরে আপনি শান্ত হোন। আমি আপনার জন্য পানি আনছি।”
পিহু উঠে দাঁড়াতেই ওর হাতে টান পড়লো। ঘাড় ঘুরাতেই দেখলো সারফারাজ ওর হাত ধরে আছে। পিহু কিছু বলার আগেই সারফারাজ পিহুকে টেনে নিজের কোলের উপর ওকে বসিয়ে দিলো। অতঃপর দু’হাতে পিহুর পেট জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধের উপর নিজের থুঁতনি ঠেকালো। পিহু হালকা কেঁ*পে উঠলো সারফারাজের এমন কাজে। শরীরের মধ্যে কেমন বিদ্যুৎ খেলে গেলো ওর। সারফারাজ বললো……
—“আমার অগোছালো হওয়ার পিছনের কারণ জানতে চাইলে না তুমি! কিন্তু তোমাকে না বলা পর্যন্ত শান্তি পাবো বলে মনে হয় না। তাই নিজ থেকেই বলি সব টা!”
পিহু ঢোক গি*ল*লো একবার। সারফারাজ ওর ঠোঁটে তা*চ্ছি*ল্যের হাসির রেখা ফুটিয়ে তুলে বললো….
—”আমার দুই ভাই। ছোট ছোট দুই ভাই। তেজ আর নির্ঝর। যাদের আমি আমার প্রাণ ভাবতাম। আমার বুকের মাঝে আগলে রাখতাম। আজ জানতে পারলাম, সেই ভাইয়েরাই আমার বুকের ভিতরটাতে যত্ন নিয়ে ছু*ড়ি*কা*ঘাত করে গিয়েছে দীর্ঘ সময় ধরে।”
পিহুর নিঃশ্বাস কেমন ভারি হয়ে এলো। তেজ আর নির্ঝরের নাম এ বাড়ির অনেকের মুখে মুখেই শুনেছে পিহু কিন্তু এখনও পর্যন্ত ওদের সাথে সামনা-সামনি দেখা বা কথা হয় নি পিহুর। সারফারাজের গরম নিঃশ্বাস পিহুর খোলা কাঁধে আছড়ে পড়ছে। সারফারাজ আবারও বললো…..
—“আমি ওদের জন্যই কতো কিছু করেছি আমি। ছোট বেলায় আঙুল ধরে হাঁটতে শিখিয়েছি। কোলে করে দু’জনকেই স্কুলে নিয়ে গিয়েছি। নিজ হাতে খাবার উঠিয়ে খাইয়েছি। খেলার সময় পড়ে গিয়ে আ*ঘা*ত পেলে বুকের ভিতরে কেমন চাপা য*ন্ত্র*ণা অনুভব হতো। ওরা যখন যা আবদার করেছে তা কোনো প্রশ্ন ছাড়াই পূরণ করেছি। বাবা-মা, চাচা-চাচীদের কড়া শাসণের ভারে যেনো ভু*ল পথ না বেছে নেয় তাই তাদের থেকে প্রটেক্ট করেছি। পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছি। অগাধ বিশ্বাস ছিলো ওদের প্রতি আমার। কখনও কোনো ভু*ল পথে পা দেওয়ার আগে অন্তত আমাকে জানাবে। নির্দ্বিধায় জানাবে। কিন্তু আমার সব ধারণা, এতো বছরে নেওয়া সব সিদ্ধান্ত আজ ভুল প্রমাণিত হলো। নয়তো আজ সেই ভাইয়েরাই আমার মুখে এভাবে থু*থু ছুঁ*ড়তে পারতো না। র*ক্তের সম্পর্কটাকে আজ এমন শব*দেহ বলে মনে হতো না।”
সারফারাজের কন্ঠ কাঁপছে। ওর দু’চোখ থেকে অশ্রুরা টপটপ করে পিহুর কাঁধের উপর গড়ে পড়ছে। পিহুর সর্বশরীর কেঁপে উঠলো। পেটের উপর থেকে সারফারাজের হাত সরিয়ে ওভাবেই ওর দিকে ঘুরে বসলো পিহু। দু’হাতে সারফারাজের চোখের পানি মুছে দিতে দিতে নরম কণ্ঠে বললো……
—“আপনি যদি আজ এভাবে ভেঙে পড়েন এমপি সাহেব তাহলে কাল এই পুরো পরিবার ধ্ব*সে পড়বে। আপনি তো সবার থেকে আলাদা বলুন!আপনি শক্তিশালী। আপনার দু’চোখে আমি সর্বদা যেই আ*গু*ন, শক্তি, পরিবারের সবার জন্য নমনীয়তা দেখতে পাই আজ সেই চোখে এতো য*ন্ত্র*ণা দেখতে পারছি না আমি। এই রূপে আপনাকে বড্ড বেমানান লাগছে। বড্ড বেশিই বেমানান লাগছে।”
সারফারাজ পিহুর দিকে ছল ছল নয়নে তাকিয়ে আছে। ওর ঠোঁটজোড়া হালকা কাঁ*প*ছে। সারফারাজ বললো…..
—”এ বাড়ির প্রত্যেকটা মানুষ বড্ড সহজ-সরল মানসিকতার, বউ। কাল যখন তাদের নিজ নিজ সন্তানদের ওমন রূপ তারা দেখবে, সব সত্য জানতে পারবে তখন তাদের মনের অবস্থা কি হবে তা ভাবতেই আমার বুকের ভেতরটা কেমন করে করে উঠছে, জানো! খান বংশের মর্যাদা যা যুগের পর যুগ থেকে ধরে রেখেছে প্রত্যেকটা সদস্য সেই মর্যাদায়, সেই র*ক্তেই আজ ক*ল*ঙ্কের দাগ লাগিয়েছে ওরা। এই দাগ আমি ঢাকবো কোন চাদর দিয়ে? বলো! আছে এমন কোনো চাদর? আছে কি?”
পিহু সারফারাজের দু’গালে নিজের দু’হাত রেখে বললো…..
না চাইলেও তুমি শুধু আমারই পর্ব ২৪ (২)
—“র*ক্ত, মর্যাদা এসব কেবল এক-একটা শব্দ সারফারাজ। এসবে দা*গ লাগলে পরে আমাদের সম্পর্ক ভুলে গেলে চলে না। ক্ষমা করে দিতে হয়। ক্ষমা করা মহৎ গুণ। ক্ষমা করলে কেউ ছোট হয় না। ক্ষমা জীবনের অনেক কঠিন সময়কে বদলে সহজ করে দেয়। তবে যদি পা*পে*র পরিমান আকাশ ছুঁয়ে নেয় তখন তারা ক্ষমার অ*যোগ্য হয়। আপনার ভাইদের পা*প কি আকাশ ছুঁয়ে নিয়েছে, এমপি সাহেব? নিজের মনকে একবার জিজ্ঞেস করুন তো!”
সারফারাজ দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। পিহুর কথায় সত্যিই এবার সারফারাজের মন হয়তো ওর মস্তিষ্কের দিকে প্রশ্ন ছুঁ*র*ছে, ‘ক্ষমা করা যায় কি আমার ভাইদের? একটা সুযোগ পাওয়ার কি যোগ্য ওরা? ওদের পা*প কি ছুঁয়েছে আকাশ?’
