তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৯
নীল মণি
ঘরজুড়ে হালকা গন্ধ ছড়ানো, মেঝেতে ছড়ানো জুঁই ফুলের পাপড়ি, মৃদু আলোয় জ্বলজ্বল করছে সোনালী গয়না আর কাঁচের চুড়ি। ঘরের এক কোণে, বড় আয়নার সামনে বসে আছে তিয়াশা একেবারে নিঃশব্দ, একা, সাজগোজ সম্পূর্ণ, কিন্তু এখনও বিয়ের মণ্ডপে যাওয়া হয়নি।
পরনে গাঢ় মেরুন লেহেঙ্গা মসৃণ সিল্ক, ঘেরওয়ালা, নিচ থেকে যেন ঢেউ খেলিয়ে উঠছে। লেহেঙ্গার প্রতিটা জরির রেখায় সূক্ষ্ম সোনার নকশা, যেন মনের কথা বুনে রাখা হয়েছে সুঁই সুতোয়। বুকের গঠন অনুযায়ী ফিট করা কাট, হাতা থ্রি-কোয়ার্টার, আর হাতার সারা জুড়ে খাঁজখাঁজ পুঁতির কাজ যেন একেকটা রঙিন জ্যোতিষ্ক বসানো সেই লেহেঙ্গার ব্লাউজে।ব্লাউজের গলা ছিল সামনে থেকে গোল, কিন্তু পিছনটা খোলা ডিজাইন ডিপ ব্যাক কাটমাথার উপর দিয়ে ওড়না টেনে রাখা, সেটার পাড়ে চিকচিক করছে মুক্তোর মতো পাথর, ওর গায়ে এসে পড়া আলোয় যেন পুরো রুমটাই নিঃশব্দে থমকে গেছে।তিয়াশা নিজেকে দেখছে আয়নায়। একটানা। মুখটা একেবারে থেমে আছে, কিন্তু চোখে হাজার কথা। সেই চোখে আজ শুধু কাজল নয়, আছে গোপন স্বীকারোক্তির ছায়া। ঠোঁটে লালচে রঙ, কিন্তু সেটার চেয়েও গভীর রঙ লেগে আছে বুকের মধ্যে একজন মানুষকে ঘিরে জমে থাকা সব না বলা কথার রঙ।তিয়াশার মনে শুধু একটাই নাম বারবার ধ্বনিত হচ্ছে_____
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“আবরার জায়ন চৌধুরী…”
মেকআপ আর্টিস্টরা সবে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেছে। ঘরের বাতাসে এখনো ভাসছে চুলের স্প্রে আর আতরের মৃদু গন্ধ। ঠিক সেই মুহূর্তে ঝড়ের বেগে দরজা ঠেলেই একে একে ঢুকে পড়লো বৃষ্টি, অনন্যা, মারিয়া, আরোহী, পরি, রুবিনা আর নেহা।
সবাই থমকে গেল একসাথে। কারো মুখে কথা নেই, চোখ শুধু একটাই দিকে তিয়াশার দিকে।
সে বসে আছে ঘরের মাঝখানে, আয়নার সামনের পাটাতনে বিয়ের কণে সেজে। যেন গল্পের রূপকথা থেকে উঠে আসা চরিত্র। মেরুন লেহেঙ্গায় মোড়া, ভারী গয়নায় সাজানো, মুখে মেকআপের হালকা আভা, চোখে মিষ্টি ঘোর, ঠোঁটে লাজুক চাপা হাসি তিয়াশাকে দেখে কারো যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না, এটা সেই তাদের খুনসুটি করা, চুপচাপ ঘুরে বেড়ানো, আপন ভুবনের মেয়ে।
“উফফ… মা কসম, চোখ সরানো যাচ্ছে না আপু” ….
বলে উঠলো মারিয়া।
তিয়াশার ঠোঁটের কোনায় ফুটে উঠল এক চিলতে হাসি।
“বেবি আজকে সিওর ভাইয়া তোকে দেখে কট খাবে, ভাইয়ারে আজকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা।”
আরোহীর এই কথা শুনেই ঘরে হাসির শব্দে বেজে উঠলো । তিয়াশার মুখ লজ্জায় রাঙ্গা হয়ে যাচ্ছে , এই মুহূর্তে সবাই যেনে গেছে যে তার জামাই কত বেহায়া ।
আরোহীর এই দুষ্টু কথায় আরো মিষ্টি ঢালতে পরি জবাব দিল —
” আরে ভাইয়া তো কট খেয়েই পরে আছে , দেখ আজকে কি হয় ভাইয়ার শুধু সেইটা দেখা বাকি।”
তিয়াশা কিছু বলছে না, শুধু মুচকি হেসে বসে আছে। কিন্তু সেই হাসির মাঝেও চোখে জমে থাকা জলরঙের ছায়া আর মুখের লালচে আভা যেন সব বলে দিচ্ছে। তার গাল রাঙা হয়ে উঠেছে লজ্জায় বারবার। যেন সবাই আজ জেনে গেছে তিয়াশার এই সাজ, এই রূপ, এই কল্পনার মতো সুন্দর হওয়া… সবকিছু শুধুমাত্র একজন মানুষের জন্য।
বৃষ্টি চুপচাপ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তিয়াশার দিকে। চোখ যেন কেমন আটকে গেল। তারপর আস্তে করে মুখটা এগিয়ে এনে কপালে একটু চুমু দিয়ে গলার স্বরে একরাশ বিস্ময় মেশানো প্রশংসা ঝরে পড়ল–
“তোকে কি বলবো বনু … চোখের পলক ফেলতে মন চায় না রে , জায়ন ভাই কি শুধু শুধু চিন্তায় আছে সে তো তার রূপবতীর এই রূপের চিন্তায় আছে , মাশাল্লাহ বনু শুধু জায়ন ভাই এর পাগলামোর কারন তুই নিজেই …”
তিয়াশা লজ্জায় কী বলবে বুঝতে পারছে না , তবুও নিজের লজ্জা কে একটু সরিয়ে বলে উঠলো —
” তুমিও তো রূপবতী রাজকন্যা আপু ।”
এর মধ্যেই নেহা চিৎকার করে উঠলো —
” ওরে তিয়াশা তোকে দেখে তো আমার ও বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে রে বোন । আমি বিয়ে করবো রে , কেউ বিয়ে করিয়ে দাও ।”
নেহার কথা শেষ হতেই ঘরে ঘরে থাকা সবাই আবারো মেতে উঠল হাসিতে।
শুধু কি তিয়াশা? আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে ব্যস্ত জায়ন ও , শেরওয়ানির কড়া ফিটিং বারবার আয়নায় যাচাই করছে জায়ন। মাশাল্লাহ এই হ্যান্ডস্টিচড কাজ করা আইভরি হোয়াইট শেরওয়ানিটা যেন ওর জন্যই বানানো।চুলগুলো একদম নিখুঁতভাবে সেট করা, হাতে সেই চেইন ডিজাইনের দামি রিস্টওয়াচ, শেরওয়ানির কফলিঙ্কে হালকা হিরার ঝলক।তার ওপর ওই বিদেশী পারফিউমের ফ্রেগেন্স যেন নিঃশ্বাসে ঢুকে মনের ভেতর একরাশ অস্থিরতা ছড়িয়ে দেয়।
আর চোখে একজোড়া সাদা ফ্রেমের হালকা পাওয়ার চশমা,যেটা প্রথম দেখায় বোঝাই যায় না, ঠিক যেন স্কিনের সাথে মিশে গেছে। এতটাই সূক্ষ্ম আর নিখুঁত ডিজাইনের যে তার চোখদুটো যেন আরও গভীর, আরও তীক্ষ্ণ লাগে। আর মুখে যে আলোর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে, তাতে স্পষ্ট বোঝা যায় আজ সে কাউকে দেখতে যাচ্ছে, যাকে দেখার জন্য বহু রাত নির্ঘুম কেটেছে।
আজ তার ‘কিটি ক্যাট’ সামনে থাকবে জায়নের চোখে যেন মরিচে ছিটানো উত্তেজনা। ঠোঁটে চাপা হাসি, কিন্তু চোখে আগুন।
ইউভি, আকাশ রায়ান আর জেমস অন্য রুমে দাঁড়িয়ে এখনো রেডি হওয়ার তোড়জোড়ে ব্যস্ত।কিন্ত জায়ন অনেক আগেই রেডী হয়ে বসে আছে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে, ফোন টিপছে, উঠে দাঁড়িয়ে আবার বসছে এক অজানা অস্থিরতা যেন ছটফট করছে চোখেমুখে।গলার রন্ধ্রে গরম নিঃশ্বাস জমে আছে, বুকের ভেতরটা হু হু করছে এক অজানা উত্তেজনায়। ওদের দুই বার ডাকাও হয়ে গেছে, কিন্তু ওরা এখনও বেরোয়নি।
__”আরে তোরা কি বেরোবি? লেট হয়ে যাচ্ছে তো,” —
অবশেষে ধৈর্য্যচ্যুত হয়ে বিরক্তিতে গলা চড়ে যায় জায়নের।
জায়নের কথায় রিল্যাক্স ভঙ্গিতে ইউভি হেসে বলে ওঠে ,
__ “আরে ভাই, এত উতলা হচ্ছ কেনো? এখনো সন্ধ্যা হয়নি। এই আট দিন ধরে অপেক্ষা করেছো, আর নয় এক ঘণ্টা পার করো। তোমার তো টিকিট পাশ , আমাদের গুলো তো এখনো পাশ হয়নি , একটু ভালো করে রেডি না হলে ওই আমার সুন্দরী পাখির কাছে তো চান্স জোটবে না।”
এদিকে রুমে বসে রায়ান ফিস ফিস করে বলল —
” বড় ভাইযের মজা নিও না ইউভি ভাই তোমার সময় আমি ও মজা নেব ।”
একটু থেমে রায়ান বলল একটু মজার ছলেই —
” বুঝলা জামাই ।”
ইউভি চমকে উঠে হেসে বললো —
” এই বেডা তুই কি করে জানলি রে ? ওরে সম্বন্ধি গলা জড়া গলা জড়া।”
ওদের ওদিক চলছে এই নিয়ে হাসি ঠাট্টা,
কিন্তু জায়ন যেন আর সহ্য করতে পারছে না। জায়নের মনে যেন ঝড় বইতে লাগল।এই আটদিন তো আর আটটা দিন ছিল না প্রতিটা মুহূর্ত যেন তার হৃদয়ের ভেতরে কোনো যুদ্ধের মতো কেটেছে।চোখে মুখে একরাশ আগুন, গলায় ব্যগ্রতা মিশে বলে ওঠে ,
__”আমি বলেই দিচ্ছি আর দশ মিনিট দিচ্ছি, তার মধ্যে না বেরোলে আমি একাই চলে যাব।”
তারপর একটু চুপ করে যায় সে। হাতদুটো কোমরে রেখে রুমের এক কোণ থেকে আরেক কোণে পায়চারি করে নিজেই নিজেকে বলছে ,
__”এমনিতেই আমার সুন্দরী বউ নিয়ে মাথার ভেতরে বজ্রপাত শুরু হয়েছে… অনুর নাম্বার থেকেও ব্লক করে রেখেছে এই বেয়াদপ মেয়ে, আজকে সব তেনদরগিরি ভাঙবো তোমার, তোর বর আজ শান্ত নয়, এই কয়দিন অনেক জ্বালিয়েছিস কিটি ক্যাট।”
ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক দুষ্টু হাসিঅপেক্ষার ছটফটে পাগলামি, আর ভালবাসার বেপরোয়া উন্মাদনা একসাথে মিশে, ঠিক যেন একটা বর না, আগুনে জ্বলে ওঠা প্রেমিক।
এই ভাবনার মধ্যেই এসে পৌঁছাল সাগর, পলাশ আর আহান।সবার মাঝে একটু ভিড় তৈরি হল। হাসি-ঠাট্টা আর কুশল বিনিময়ে মুহূর্তটা জমে উঠলো।
নাজিম যেহেতু চৌধুরী বাড়ির জামাই, তাই তাকে ও বাড়িতেই থাকতে হবে, সকালে চৌধুরী বাড়িতে নাজিমের আম্মু আব্বু ও এসেছে , সবাই খুব খুশি এখন বৃষ্টি আর নাজিম কে নিয়ে সব থেকে বেশি খুশি ছোট্ট রেজোয়ান কে নিয়ে । তবে আজকের দিনের আনন্দ মিস না করতে, সে পরে তার বন্ধুদের সঙ্গে আবার যোগ দেবে।
কিন্তু জায়ানের মুখে স্পষ্ট বিরক্তির ছাপ পড়তেই আহান হাসতে হাসতে বলে উঠল —
“কিরে জায়ান, এমন মুখ কেন করেছিস? তোকে দেখলেই মনে হচ্ছে কেউ জোর করে বিয়ে দিতে নিয়ে যাচ্ছে।”
ঠিক তখন ই সিরি দিয়ে নামছিল ইউভিরা।
জায়ান কিছু বলবে এমন সময় সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে আকাশ হো হো করে বলে উঠল–
“আরে আহান ভাই, আসলে আমরা একটু দেরি করে ফেলেছি রেডি হতে… তাই স্যারের মুড হালকা গরম। বুঝতেই পারছো, বিয়ের জন্য তাড়া পড়েছে।”
এই কথা শোনা মাত্রই জায়ানের চোখে যেন আগুন ঝরে পড়ল।সবার সামনে বিব্রত করার কায়দাটাও যেন আকাশ দিনে দিনে আরও দক্ষ হয়ে উঠেছে—
কিন্তু আজকের দিনটা স্পেশাল, তাই জায়ান শুধু চোখে রাগের ঝলক ছুঁড়ে দিয়ে থেমে থাকল।
সবার গায়ে কুর্তা পায়জামা, মাশাল্লাহ একেকজন একেকটা নায়ক।কিন্তু আজকের আসর জেমস হাফ বাঙালি, হাফ ব্রিটিশ এই প্রথম কুর্তা-পায়জামা পরে যেন নিজেকেই চিনতে পারছে না। বারবার নিচের দিকে তাকাচ্ছে, হাত দিয়ে জামার পাড় ছুঁয়ে দেখে নিচ্ছে ঠিকঠাক আছে কিনা।
সাগর পাশ থেকে হেসে বলে উঠল,
__”আরে হাফ-বিদেশী ভাই, তোমারে তো একদম হ্যান্ডসাম লাগতাসে এতবার নিজেকে দেইখো না, আজ বিয়াবাড়ি, কোনো মাইয়া হইলে কিন্তু খবর করে দিব তোমারও।”
ওর কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে উঠল।
শুধু জায়ানের মুখটা একটুও ফুরালো না। বিরক্তির ছায়া তার কপালে স্পষ্ট আর কত দেরি করবে এরা? বউকে দেখার জন্য বুকের ভেতরটা ছটফট করছে তার, কিন্তু বন্ধুরা যেন পিকনিকে এসেছে।
সাগরের ঠাট্টায় হালকা একটা মুচকি হাসি ছুঁয়ে গেল জেমসের ঠোঁটের কোণায়। সে নরম গলায় বলল—
__”হ্যাঁ ভাই, তোমরাই তো এখন আমার faith।”
__”আরে বা*** তোরা কি যাবি?”
বিরক্তি চেপে আর রাখতে না পেরে গর্জে উঠলো জায়ান, কপালের মাঝখানটা ভাঁজ পড়ে গেছে, যেন এখনই কেউ একটু দেরি করলেই, সে নিজেই বিদ্রোহ ঘোষণা করবে।তার এই রেগে ওঠা দেখে বাকিরা হো হো করে হেসে উঠলো।
পলাশ হাসতে হাসতে বলে উঠলো,
__”চল চল ভাই, না হলে আমাদের জায়ান ভাইয়ের উত্তেজনা এতটাই হাই ভোল্টেজ, ফায়ার সার্ভিস ডাকলেও ঠান্ডা করতে পারবে না।”
এই বলে সবাই অবশেষে বেরিয়ে পড়লো, তবে কোনো রাজকীয় মার্সিডিজ বা বিএমডব্লিউ নয়, বরং নিজেদের চিরচেনা বাইকগুলোতেই। জেমসকে তার রঙিন কুর্তায় দেখে ইউভিই প্রথমে হেসে ফেলল, তারপর আপনভোলায় বলল,
__”ওই ভাই, তুমি আমার পিছে উঠো, পাছে রাস্তায় আবার মডেলিং শুরু করো।”
জেমস একটু লাজুক হেসে পেছনের সিটে উঠে বসে বলল,
“ইয়েস ভাইয়া… ওই ফেইন নিয়ে পার্টি জমাতে চাই।”
আর জায়ান? সে এবার চোখ উপরের দিকে তুলে নিজেকেই বোঝাচ্ছে,
__”হায় আল্লাহ, আমায় শুধু আমার বউ এর সামনে নিয়ে যাও… না হলে এইগুলো কে নিয়া আমি পাগল হয়ে যাব”
ছুটলো সবাই বাইক নিয়ে হাওয়ায় উড়ে যাওয়া একটা বিকেল যেন, তারুণ্যের ছেলেমানুষি ঢেউয়ে ভেসে। শহরের পথ আজ যেন ওদেরই হয়ে উঠলো, রাস্তায় বাজলো বন্ধুত্বের হর্ন।
এক অভিজাত কমিউনিটি হলের সামনে হইচই লেগেই আছে।গেটের বাইরে ছেলেরা আর ভেতরে মেয়েরা । চোখাচোখি, হাসাহাসি, আর ঠাট্টা-মশকরায় জমজমাট এক যুদ্ধক্ষেত্র যেন। নাজিম ও কোলে ছেলে কে নিয়ে এসে দাঁড়াল বন্ধু দের পাশে।
তার মাঝেই এক চোখের ইশারায় শুরু হয়ে গেছে কিছু গোপন গল্প…নীল লেহেঙ্গা, খোলা চুল আর কপালে টিপে অনন্যা ঠিক যেন গোধূলির রঙ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে ইউভি একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকল, আর নিজের অজান্তেই বলল, “আহা… জান জলে যাচ্ছে পাখি।”
অনন্যা ঠিক দেখছে ইশারায় তার ইউভি কি ভাবে তাকিয়ে আছে । অবশ্য যতই দুজনের মধ্যে দুষ্টু মিষ্টি রাগ থাকুক না কেন সে তো এই সাজ বিয়ের জন্য না তার ইউভি ভাইয়ের জন্য সেজেছে।
আকাশ তো একেবারে বোবা হয়ে গেল জাম রঙা লেহেঙ্গা পরে চুল গুলো ঢেউ খেলে যাচ্ছে , লাল লিপস্টিক পরে হেসে যেন আকাশের বুকে তির চালাচ্ছে জলপরী আরোহী। যেন স্বপ্ন ভাঙবে বলে মনে হচ্ছে তার।আকাশ যেন মনে মনে ভাবছে সেও যদি আজ বিয়ে করতে পারত ।
দাড়ান দাড়ান এখানে যে আরেক জন ও চোখে যেন টিউলিপ দেখছে , জী
আমাদের হাফ বিদেশী জেমস পরি কে দেখে , সাগর এর কানে জেমস ফিস ফিস করে বলল —
” সাগর ব্রো আমি ও খবর হতে চাই ।”
সাগর জেমস এর কাঁধে হাত দিয়ে বলল —
” হ ভাই কও শুধু কোনডার লগে খবর হতে চাও।”
জেমস ইশারা করে পরির দিকে দেখিয়ে একটু মুচকি হাসলো ।
পরি কে দেখে সাগর চোখ বড় করে একটু হেসে বলল —
” ভাই মাশাল্লাহ তোমার চয়েস আসে ।”
জেমস একটু হেসেই লজ্জা মাখা মুখে বলল —
” ব্রো ডোন্ট লুক হার।”
” হুর বেডা ওর পাশেই দেখ আমার বউ আমার পোলা নিয়ে খারায় আছে ।”
কিন্তু এসবের মাঝে যে দুজন অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে , রায়ান এই মেয়ে দের ভিড়ে খুঁজে পাচ্ছেনা তার কিশোরী শাকচুন্নি মারিয়া কে , কিন্তু দুচোখ তো তাকেই খুঁজছে ।
আরেক জনের কথা তো বলার দরকার নেই ।তার মুখে যেন বিরক্তি লেগেই আছে , সেই বিরক্তি নিয়েই বলল —
” তোরা এই ভাবে কেন দাড়িয়ে আছিস সামনে থেকে সর , আমি ভিতরে যাব । ”
বৃষ্টি বলে উঠলো —
” হ্যা যেতে দেব আগে এক লাখ ফেলেন ভাইয়া । তারপর”
পেছন থেকে পলাশ ঠাট্টার সুরে বলে,
__“চলো তোমরা এত টাকা, আমরা বর নিয়াই চলে যাই।”
কিন্তু জায়নের মুখ গম্ভীর। সে ঠাণ্ডা গলায় বলে–
__“দুই লাখ দিচ্ছি, নাটক বন্ধ করো। শুধু আমি ভিতরে যাব। বর আসুক তার পরে তোরা যা খুশি করিস।”
তার গলায় এমন একটা স্বর যেন অস্থিরতা লুকিয়ে আছে কারও চোখে চোখ পড়ে যাওয়ার আগে সে ঢুকে পড়তে চায় ভেতরে।
জায়নের এই কান্ড দেখে পলাশ আর আহানের রাগ উঠে গেল–
ফিসফিস করে বলল”শালা মীরজাফরের বাচ্চা ,এত বউ পাগল হইছে যে, আমাগো পুরা প্ল্যানটাই বরবাদ করলো, ঠিকঠাক মজাটাও নিতে দিল না রে ভাই”
জায়ন জেমসকে টাকার ব্যাপারটা বুঝিয়ে দিয়ে অবশেষে আলোকময় কমিউনিটি হলের ভিতর প্রবেশ করতে পারলো। চলছে সাউন্ড বক্সে নানান রকম গানের মেলা।
রুহেনা বেগম আর সুরাইয়া বেগম জানকে বরণ করে স্টেজে বসিয়ে দিল ,চোখেমুখে আনন্দ, বুকভরা তৃপ্তি অবশেষে তারা দেখছে সংসারের আলো ছায়া একত্রিত হচ্ছে।
এদিকে প্রান্তিক সাহেব, প্রণয় সাহেব আর আশরাফ খান অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যস্ত।
খুব জাঁকজমক করেই বিয়ের অনুষ্ঠান হচ্ছে আহমদ প্রান্তিক সাহেবের ছেলের বিয়ে বলে কথা।
অনেকদিন পর কোনো সম্পর্ক সুস্থভাবে, নির্ঝঞ্ঝাটে পরিণতি পাচ্ছে , এই ভেবেই সকলে খুশি।
তাদের চোখে মুখে একধরনের শান্তি, যেন দীর্ঘ ক্লান্ত যাত্রার শেষে মিলেছে ঠিকানা।
কিন্তু…
জায়ান?সে যেন এই উৎসবের সুরে নেই।
সবার মাঝে থেকেও একা, চারপাশে হাসির গুঞ্জন, ফটোফ্ল্যাশ কিন্তু তার চোখ শুধু একটাই মুখ খুঁজছে।
সে আর সহ্য করতে না পেরে পাশে দাঁড়ানো তাহসান সাহেবকে টেনে নিয়ে বলল —
“চাচ্চু, আমার বউ কোথায়?”
তাহসান সাহেব এক মুহূর্তে যেন হাওয়া খেয়ে পড়ে যাবেন।এই ছেলে গত কয়েকদিন ধরে যা শুরু করেছে, তাতে উনি তো মাথা ঘুরে মরেই যাবেন
তবু কষ্টেসৃষ্টে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন —
“বাপ, তুই থামতে কি নিবি? তোর এই ‘বউয়ের গান’ একটু বলতেই পারিস?”
আর এদিকে মেহজাবিন বেগম রেজওয়ান কে কোলে নিয়ে ,আর আয়েশা বেগম ছেলের এই কান্ড দেখে একচোট হেসেই যাচ্ছে।
তাদের চোখে মায়া, মুখে মিষ্টি হাসি —
এর মধ্যেই সাউন্ড বক্সে বেজে উঠলো —
” খুশি খুশি প্যাহনা তেরা দিয়া গেহনা,
কিতনা ক্যাঙ্গন জ্যাচে
দেখ ক্যালাই আই আই আই,
তুঝে মেরে লিয়ে
মুঝে তেড়ে লিয়ে
হ্যায় ব্যনায়া গ্যায়া
ওহ হার্যায়ী আই আই আই ……
হলভর্তি মানুষের ভিড় এক মুহূর্তে থমকে গেল।
সব আলো যেন পড়ে আছে কেবল এক জায়গায়।
মেরুন লেহেঙ্গার সাদা সোনালি পাড় ছুঁয়ে নেমে আসছে তিয়াশা, মাথায় লাল ঘোমটা, গানের তালে তালে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে তিয়াশা,
হাতের মেহেদি-রাঙা আঙুলগুলো নরম তাল রেখে নাড়ছে… দৃষ্টি তার স্টেজের দিকে আস্তে আস্তে ঠোঁটের কোনায় নিজের সখের পুরুষ কে পাওয়ার খুশিতে হেঁটে চলেছে ফুলে মোড়া লাল গালিচার পথ ধরে।
তিয়াশার মাথার ওপরে থাকা সেই ফুলের চাদরটা ধরে আছে তার সবচেয়ে আপনজনেরা ,ইউভি, রায়ান, আকাশ আর নাজিম।চারদিকের আলো ছাপিয়ে যেন সেই চারজনও হেঁটে চলেছে এক অদ্ভুত সম্মানের ভার নিয়ে।
চারপাশে সবার চোখে একসাথে মুগ্ধতা আর অশ্রু।
স্টেজের দিকেই এগিয়ে চলেছে তিয়াশা,
যেখানে অপেক্ষা করছে তার জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত…
আর একজন…
যার দৃষ্টি কেবল তাকিয়ে আছে তারই দিকে, রাজকীয় সোফায় বসে থাকা জায়ন উঠে দাড়াল, সে যেন নিঃশ্বাস নিতে ভুলে গেল।
ধীরে ধীরে নিজের বুকের ওপর হাত রাখল সে–
চোখের সামনে দিয়ে তারই বউ হেঁটে আসছে,
আর সে তাকিয়ে আছে ঠিক সেই চোখ নিয়ে
যা এক পাগল প্রেমিক রাখে শেষবারের মতো দেখা পাওয়া মুখটার দিকে।
তার চোখে শুধু একটাই কথা ঝরে পরছে —
আমি কিভাবে সামলাবো তোকে…তুই যে আজও আমার হুশ কেড়ে নিচ্ছিস ,এই মেয়ে… আমার বউ…কিন্তু আজ কেন এত অপরিচিত লাগছে,এত সুন্দর লাগছে কেন। আমি এই রূপ আগে কখনও দেখিনি…”
চারপাশে সাজসজ্জা, আলো, হাসির গুঞ্জন, আতিথেয়তার ব্যস্ততা সবকিছু যেন মিলেমিশে এক উৎসবের কোলাজ তৈরি করেছে। কিন্তু সেই কোলাজের মাঝেও, জায়ান কিছুই শুনতে পাচ্ছে না, কিছুই দেখতে পাচ্ছে না। তার পুরো দৃষ্টি আটকে গেছে একটা মাত্র জায়গায়।
সামনে থেকে মেহেদি রাঙা কাচের চুরি ভরা হাত তুলে গানের তালে তালে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে
তার দিকে ।
জায়ান যেন আর সহ্য করতে পারছে না।
সে কাঁপা হাতে বুকের ওপর চাপ দেয়…
“শা** এমন সৌন্দর্যও কেউ বয়ে আনতে পারে?
তার বুকটা কেমন করে উঠচে ।প্রতিটা পদক্ষেপে তিয়াশা যত তার দিকে এগিয়ে আসছে,
সে তত গভীরে হারিয়ে যাচ্ছে।মনে হচ্ছে, প্রতিটা পদক্ষেপে জায়ানের সমস্ত হুশ, যুক্তি, বাস্তবতা কে যেন ছিনিয়ে নিয়ে যাচ্ছে তিয়াশা।তার চোখ দিয়ে একবার তাকায়, আর লজ্জায় মুখ ঘুরিয়ে নেয়,
তবে তার ঠোঁটের কোণে সেই ক্ষীণ হাসি–যেটা শুধু জায়ান বোঝে।কটা চুপচাপ দাবি, একটা নরম মালিকানা–
“হ্যাঁ, আমি তোমার। শুধু তোমার।”
জায়ন আর সহ্য করতে পারলো না। তিয়াশার রূপ যেন তাকে পাগল করে দিচ্ছে চোখের তৃষ্ণা যেন কোনোভাবেই মিটছে না, বরং বুকের ভেতরটা জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাচ্ছে। আর সে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারলো না স্টেজের উপর দাঁড়িয়ে থেকেও সে কারো দিকে না তাকিয়ে, কারো একটুও পরোয়া না করে হঠাৎ করে নেমে এলো নিচে, গানের তালে তালে এগিয়ে আসা তিয়াশার দিকে সে ছুটে গেল, সবার সামনে, সব কিছু ভুলে।মূহূর্তেই তিয়াশার সামনে এসে দাঁড়াল জায়ন। কোনো কিছু না বলেই, তিয়াশার কোমরে এক হাত রেখে, আরেক হাতে ওর পিঠে ভর দিয়ে হঠাৎই কোলে তুলে নিল তাকে।
চমকে উঠলো তিয়াশা, কিন্তু নিজেকে সামলানোর জন্য ওই চুরি ভর্তি হাতে পেঁচিয়ে নিল জায়ন এর গলা।চুলের ফুল , সব উড়ে যাচ্ছে জায়নের এই আচমকা আগ্রাসনে।
এই হল ভরা শত শত মেহমান, আত্মীয়স্বজন, তবুও এই লোকটাকে কোনো কিছু থামাতে পারছে না।
তিয়াশা লজ্জায় কুঁকড়ে জায়নের বুকে মুখ লুকিয়ে নিল নিজেকে । সেই বুকে যেন সে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুরক্ষিত আশ্রয়।
স্টেজের সামনে পুরো পরিবার হতবাক।
প্রান্তিক সাহেব রাগে কপালে ভাঁজ ফেলে চোখ নামিয়ে নিলেন–
__”এই ছেলের আবার বিয়ের সময় এই নাটক দরকার ছিল?”
প্রণয় সাহেব লজ্জায় মুখে চেয়ে রইলেন অতিথিদের দিকে, যেন মাটির নিচে ঢুকে যেতে চান।
তাহসান সাহেব হতাশ হয়ে বসে পড়লেন, দুই হাতে মাথা চেপে ধরলেন নিজের ।
আর তখনই আশরাফ খান আয়েশা খানের হাত ধরে জায়ন এর দিকে তাকিয়ে বললেন —
“জিও মেরে লাল ।”
চোখে গর্বের এক উচ্ছ্বাস,আর বাড়ির গিন্নিরা?
ছেলের এমন বেপরোয়া মুর্তি দেখে লজ্জায় একে অন্যের দিকে তাকিয়ে মুচকি মুচকি হাসতে লাগলো।
বাকিরা সবাই হা করে তাকিয়ে আছে,
এমন নির্লজ্জ ভালোবাসা দেখাতে পারে যে ছেলেটা?
সবার সামনে নিজের কনের দখল নিয়ে স্টেজের দিকে হাঁটছে সে, নিজের মায়াবী রমণী কে বুকের ঠিক মাঝে জড়িয়ে, যেন এই শত মানুষের ভিড়েও সে আর কিছুই দেখতে পায় না, শুনতে পায় না —
শুধু ওর রোদ, শুধুই ওর বউ , শুধুই ওর কিটি ক্যাট ।
জায়ন তিয়াশাকে ধীরে ধীরে সোফায় বসিয়ে দিল। চারপাশে ফুল, আর তর ঘ্রাণ, সোনালি আলো… আর তার চোখের সামনে বসে আছে আজকের নববধূ তার
“তিয়াশা রোদ চৌধূরী।”
জায়নের বুকের ভেতর কেমন যেন কাঁপছে… যেন কেউ তার ভিতর থেকে বলছে–
“তুই পেয়েছিস জীবনের সবচেয়ে সুন্দর দোয়া তোর বউ।”
জায়ন হাঁটু গেঁড়ে বসে পড়ল তিয়াশার সামনে, একে অপরের দিকে দৃষ্টি রাখতেই খুশিতে ভিজে উঠেছে দুজনের চোখের কোণা, ধীরে ধীরে দুই হাত নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে একটা চুমু রেখে বলল–
“, তোর চোখের দিকে তাকিয়ে কসম নিচ্ছি জান —
তোর সব দুঃখ আমার হবে, তোর সব হাসি আমার জীবন। তোকে শুধু ভালোবেসে নয়, তোকে দোয়া করে রাখব প্রতিদিন।আজ থেকে তোর হাসি আমার শক্তি,তোর চোখের জল আমার দুর্বলতা,আর তুই… আমার চিরন্তন ভালোবাসা।তুই আমার শুধু বউ না জান… তুই আমার পৃথিবী।”
আবার ও একটু থেমে জায়ন বলল —
“হেয় বেব, দেয়ার ইজ অন থিং ইন মাই হার্ট
ইটস অলওয়েজ ফর ইউ, থ্রী ইয়ার্স এগো হোয়েন
আই ফার্স্ট স ইউ, ‘আই লাভ ইউ, আই লাভ ইউ ‘ ।
এদিকে জায়ন এর এই ভলোবাসা দেখে তিয়াশার চোখে পানি, ঠোঁটে কাঁপুনি কিন্তু জায়ন তিয়াশার চোখের পানি মুঝতে মুজতে ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসি রেখে বলল —
” এখন কাঁদে না জান , একটু পরে তোমাকেই এমনিতেই কাদিয়ে ছাড়ব ।”
তিয়াশা আবার চমকে উঠলো, লজ্জায় ঠোঁটের কোণে
শুধু একটাই শব্দ বের হল —
___ ” অসভ্য ”
জায়ন শেরওয়ানির পকেট থেকে লাল মখমলের ছোট্ট বক্সটা বের করল, আর ভিতর থেকে এক জোড়া রুপার নুপুর তুলে আনল।
জায়ন তিয়াশার পা ছুঁতে এগোতেই, তিয়াশা তাড়াতাড়ি ওর হাত চেপে ধরল,তিয়াশা চমকে উঠে চোখ বড় বড় করে বলল–
__”কি করছেন, সবাই দেখছে তো?আর আপনি আমার বড় পায়ে হাত দেবেন না প্লীজ”
জায়ন চোখে পাগলামির ঝিলিক নিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল–
__“আই ডোন্ট কেয়ার বেবি। এই যে আজ তোকে আমি আমার সঙ্গে বেঁধে রাখলাম।”
আবার একটু থেমে জায়ন সেই ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি রেখে বলল —
__“এখন তো তোর পা আমার হাতে,
কিন্তু রাতে থাকবে আমার কাধের উপর…
শুধু স্পর্শ না, আমি তোকে সাঁজিয়ে নেবো আমার নিঃশ্বাসের মতো।”
তিয়াশা হতভম্ব হয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল,এই লোক কোথা থেকে এত ঠোঁটকাটা লাইন বলে । এমনিতেই সবার সামনে মুখ তুলতেও পারছে না লজ্জায় ।
প্রান্তিক সাহেব আর বাকিরা এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে হাই প্রেশার উঠে গেছে।কেউ কেউ পানি খুঁজছে, কেউ কেউ লজ্জায় মুখ লুকাচ্ছে ঘোমটার আড়ালে।
গিন্নিরা নিচু গলায় ফিসফিস করছে,
বৃষ্টি নাজিম কে একটু কনু দিয়ে গুত দিয়ে। বলল
__” শেখো কিছু আমার ভাইয়া আর তোমার বন্ধুর কাছ দিয়ে ।”
নাজিম বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো —
__”আস্তাগফিরুল্লাহ নাইজিবুল্লাহ বৃষ্টি এসব বলো না।”
এদিকে আরোহী আকাশ এর দিকে তাকিয়ে ফিশ ফিশ করে বলে উঠলো —
“দ্যাখছো বউ পটাতে কী করতে হয়… শিখে রাখ বুঝলে”
আকাশ বলে উঠল —
” আমার সাহস নাই জলপরী, আমার এই দেখে অসুস্থ লাগছে।
আরোহী মুখ ঘুরিয়ে আবার অনন্যা আর পরির পাশে দাঁড়াল,
রুবিনা বলল —
” মাশাল্লাহ আর কিছু চাইনা , ব্যাস চোঁখ ধন্য হয়ে গেল।”
এদিকে পলাশ আহানের কানে ফিসফিস করে বলল–
__”রেডি থাকিস বাসায় গিয়ে বউ হাতে ডোজ খাওয়ার জন্য ।আমি তো পাক্কা খাব ।”
আহান ও চিন্তায় পরে গেছে । তাদের বউ রা এসব দেখছে নিশ্চই বাসায় গিয়ে শুনাবে।
এদিকে সাগর মাথায় হাত দিয়ে বলল —
” আমার চোখ অন্ধ হইয়া যাক ।”
এদিকে চোখের ইশারা চলেই যাচ্ছে জেমস আর পরির মধ্যে । জেমস আবার এসে একটা গোলাপ ও দিয়ে গেছে।
জায়ন কোন কিছুর তোয়াক্কা না করে, তিয়াশার পুরনো নুপুর খুলে,নিজের আনা নতুন নুপুরটা যত্ন করে পরিয়ে দিল।
সেই মুহূর্তে যেন বিয়ে কেবল রীতির ভেতর সীমাবদ্ধ রইল না,ওটা হয়ে উঠল এক পাগল পুরুষের ভালোবাসার ঘোষণাপত্র।
মারিয়া অনুদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল, লাল রঙের লেহেঙ্গা পরে সোনালি আলোয় যেন মুখটা ঝলমল করছিল। হঠাৎ রায়ান সামনে এসে বলল —
“ওই শাকচুন্নি, এইটা ধর।”
এক গুচ্ছ লাল গোলাপ এগিয়ে দিল মারিয়ার দিকে। সবাই স্তব্ধ। মারিয়া চমকে তাকাল, চোখ বড় বড় করে রায়ানের দিকে। পাশে থাকা সবাই নিঃশব্দ হয়ে উঠল রায়ান এর কাণ্ড দেখে।
রায়ান মাথা নিচু করে একটু অন্যদিকে তাকিয়ে বলল
“তোর ওই লম্বা চুলে তো কিছুই লাগানো নাই। এগুলো লাগিয়ে নিস।”
একটু থেমে তারপরে বাসাউন্ড বক্সের পাশে দাঁড়ানো মারিয়ার বয়স ই ছেলেগুলোর দিকে একবার তাকিয়ে বলল —
“এখানেই থাকিস, শাকচুন্নির মতো এদিক ওদিক ঘোরাঘুরি করবি না। দেখলে ঠ্যাং ভেঙে দেবো, ঠিক আছে?”
এত লোকের সামনে কাউকে পাত্তা না দিয়ে রায়ান এই বলে নিজের কুর্তার ওড়না ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে চলে গেল।
মারিয়া কি বুঝল, জানে না। শুধু চোখে গোলাপের লাল ছায়া, মারিয়ার এই কিশোরীর মাথায় রায়ান এর আসল উদ্যেশ্য গেলো না,শুধু বুঝতে পারল তাকে এই রায়ান ভাই বকা দিয়েছে, কিন্তু ফুল কেন দিল?
এদিকে আরোহী হালকা হাসিতে অনন্যার কানে কানে বলল —
“অনু, কেমন যেন জায়ন ভাইয়ের ছোট ভার্সন সামনে হাঁটছে না রে?”
অনু ও রায়ান এর দিক তাকিয়ে আছে এক ভাবে স্তব্ধ হয়ে —
“আমিও তো তাই দেকছি, রুহি আপু। বোন, মারিয়া রেডি হয়ে যা, তোর ফিউচার পাগলা হাজির হইছে মনে হয়।”
এদিকে নেহা ঠিক যেন গায়ের পেছনে লতিয়ে থাকা গাছের মতো, ইউভির পেছনে পেছনে ঘুরেই যাচ্ছে।
__”ইউভি ভাই, আপনি আমার সঙ্গে এমন করেন কেন? একটু বলেন না… আজকে কেমন লাগছে আমাকে?”
তার গলায় টানা সুর, চোখে আকুলতা, আর ঠোঁটে একরাশ কৃত্রিম অভিমান।ইউভি চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলদেহ তার এখানেই, কিন্তু মন তার বহু দূরে, এক অদেখা রাজ্যের কোনো এক হৃদয়কন্যার পাশে।
এই মেয়ে নেহা যে আসলেই যেন জ্বালানোর মেশিন।
একসঙ্গে উঠতে চায়।এতো চাপ, এতো চাপ
এক তো তার হৃদয়পাখি একদম পাত্তাই দিচ্ছে না, অথচ এই মেয়ে তাকে পিছু ছাড়ে না।
অবশেষে ইউভি এক নিঃশ্বাসে বলে উঠল, চোখেমুখে বিরক্তি স্পষ্ট,
__”শোন নেহা।তোকে আজ একটা কথা পরিষ্কার করে বলি।আমি জানি তুই কী চাস… কিন্তু আমার এই মনে একজন অনেক আগেই নিজের জায়গা বানিয়ে নিয়েছে।তুই আমার পেছনে এভাবে ঘুরিস না, ভালো লাগে না… অসহ্য লাগে… বিরক্ত লাগে…তোকে কষ্ট দিতে চাই না, কিন্তু আর সহ্য হয় না…”
শব্দগুলো যেন ছুরি হয়ে বিঁধে গেল নেহার বুকে।
মেয়েটা স্তব্ধ। তারপর ঠোঁট কামড়ে, চোখের জল চেপে, কাঁপতে কাঁপতে সরে গেল।
না… সরে গেল না, যেন ভেঙে পড়ে পালিয়ে গেল।
ঠিক সেই মুহূর্তে,দূরে দাঁড়িয়ে থাকা অনন্যার চোখে পড়ে গেল দৃশ্যটা।কথা শুনতে পাই নি কিন্তু বুঝতে পেরছে কিছু একটা ঘটছে তাদের মধ্যে,
নেহার অশ্রুজল, ইউভির দাঁড়িয়ে থাকা গম্ভীর মুখ…
সব মিলিয়ে এক আগুন লাগানো দৃশ্য।মাথা বিগড়ে গেল অনন্যার।সে নিজের রাগ, সন্দেহ আর দুঃখকে আর দমন করতে পারল না।
দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে কাঁপা গলায় বলল–
__”নেহা আপুর সঙ্গে কি করছিলেন আপনি?
সবসময় মেয়েদের সঙ্গে এমন ঘোরাফেরা করে বেড়ান কেন আপনি?আমার সঙ্গে ভালোবাসার কথা বলে, ওদিকে আবার নেহা আপুর পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন?
আপনি একটা চিটিংবাজ,
ইউভি বাকরুদ্ধ। মুখ খুলতেই চায়, কিন্তু তখনই অনন্যা ছুটে পালিয়ে গেল। ইউভি রাগে দুই হাত দিয়ে মাথার চুল ছিঁড়তে ছিড়তে বলল —
” হায় আল্লাহ কি পাপ করছি জীবনে আমি, সব সময় এরম জেনারেটর এর মধ্যে কেন ফেলো আমারে।
তোমার দেওয়া এই হুদাই এর জীবন আমার লাগবে না, তুমি নিয়ে নাও ।”
এদিকে অতিথিদের সঙ্গে বাসার বড় দের সবার খাওয়া প্রায় শেষ বলতেই চলে। ওদিকে শুরু হয়েছে জায়ন আর তিয়াশার বিয়ের রিচুয়াল। সবাই সেখানেই দাড়িয়ে আছে এখন
কমিউনিটি হলের একপাশে পুরুষদের, আর অন্যপাশে পর্দা টেনে বসানো হয়েছে মেয়ে দের জন্য। প্যান্ডেলের মাঝখানে কাঠের চৌকো একটা মঞ্চ তৈরি হয়েছে সেখানেই বসে আছেন কাজী সাহেব, সামনে খোলা রয়েছে নিকাহ নামা, আর পাশে জায়ন চোখে ভালোবাসার মিশ্র আবেগ।
জায়ান বিরক্ত হয়ে উঠছে এখনো বিয়ে পড়ছে না ,তারপর কাজী সাহেব এর উদ্যেশ্য রেগে বলেই উঠলো–
__”আরে কাজী সাহেব বিয়ে পড়াবেন?না পড়লেও চলবে আমরা অলরেডি বিবাহিত , আমার সব সম্পত্তি দিয়ে আমি আমার বউ কে আগেই নিয়ে নিয়েছি।”
জায়ানের কথাটা শুনে পুরো হলে এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা।
কাজী সাহেব চোখের চশমা একটু নামিয়ে জায়ানের দিকে তাকিয়ে রীতিমতো হাঁ হয়ে গেলেন। তারপর কাশি দিয়ে বললেন–
“আরে বাবা… আমি তো ভেবেছিলাম বিয়েটা আজই হচ্ছে।তুমি যদি আগেই বউ নিয়ে নাও, তাহলে আমার কাজ কী? আমি কি শুধু তাবারুক খাওয়ার জন্যই আসছি?”
চারপাশে হাসির রোল পড়ে গেল। কিন্তু তিনি গম্ভীর মুখ করে বুকের পকেট থেকে খাতা বের করে বললেন
কাজী সাহেব শান্ত কণ্ঠে বললেন–
“আবরার জায়ন চৌধুরী, আপনি কি তিয়াসা রোদ চৌধুরী কে পঞ্চাশ লাখ ১ টাকা মোহরানায়, ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক, বিবাহ করতে রাজি আছেন?”
জায়ন ব্যাস এক পলকেই এক নিশ্বাসে বলে দিল —
“কবুল, কবুল ,কবুল
পুরুষদের দিকে হালকা আওয়াজ উঠলো —“আলহামদুলিল্লাহ!”
ওদিকে মহিলাদের প্রান্তে, পর্দার আড়ালে বসে আছে তিয়াশা। মেহেদি রাঙা হাতে পবিত্র কুরআনের উপর হাত রেখে বসে আছে সে , পাশে বসা ইউভি তার হাত শক্ত করে ধরে রেখেছে।
কাজী সাহেব এবার বললেন–
“তিয়াসা রোদ চৌধুরী, আপনি কি আবরার জায়ন চৌধুরী কে পঞ্চাশ লাখ ১ টাকা মোহরানায়, ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক, বিবাহ করতে রাজি আছেন?”
তিয়াশা একটু থেমে চোখ বন্ধ করে ফেলে। গলা কেঁপে উঠছে, কিন্তু ঠোঁট কাঁপছে না।
“কবুল, কবুল ,কবুল”
এই তিনবার উচ্চারণের পর, হলঘরে যেন আলোকরেখা ছড়িয়ে পড়ল সবাই একসঙ্গে বলল
“মাশাআল্লাহ, নিকাহ মোবারক।”
তারপর কাজী সাহেব ঘোষণা দিলেন–
“আজ, ইসলামী শরিয়তের নিয়ম অনুযায়ী, আবরার জায়ন চৌধুরী এবং তিয়াসা রোদ চৌধুরী বৈধভাবে স্বামী স্ত্রী হিসাবে গৃহীত হলেন। আল্লাহ তাদের দুজনের মধ্যে বরকত দান করুন।”
বাকি সবাই খাওয়া দাওয়া শেষ করে যখন বাসায় যাওয়ার জন্য দাড়িয়ে, ঠিক তখনই জায়ন তিয়াশার হাত ধরে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন মেহজাবীন বেগমের সামনে।
তিয়াশার হাতটা তখনও জায়নের শক্ত মুঠোয় বাঁধা , বিয়ের কাবিননামায় সই দেওয়ার সময় ছেড়েছিল কেবল একটুখানি, তাও যেন নিজের ইচ্ছেতে নয়, জোর করেই।
জায়ন বেশ বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
“মা, হয়ে গেছে বিয়ে। এবার আমি যাবো আমার বউ নিয়ে?”
মেহজাবীন বেগম ভুরু কুঁচকে তাকালেন,
___ “হয়েছে মানে? এখনো অনেক নিয়ম এত ব্যস্ত কিসের?”
জায়ন মনে মনে মুখ চেপে হাসল।
__”এই ব্যস্ততার কারণ তোমাকে বললে হয়তো এখনই বেহুঁশ হইয়া পড়বা মা”
এমন ভাব করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল–
__ “ওকে, তোমরা করো তোমাদের নিয়ম-নীতি। আমি আর পারছি না তোমাদের এই নিয়ম নিতে। আমি আমার বউ নিয়ে গেলাম, দেখি কে আটকায় ।”
এই বলেই তিয়াশার হাতটা এমনভাবে টান দিল, যেন বিয়ে করেছে এক মিনিট আগে আর বাসর রাতটা এক মিনিট পরেই।
তিয়াশা প্রায় আধেক জড়সড় হয়ে লজ্জায় ফিসফিস করে বলল,
__“এভাবে টানতেছেন কেন? পরে যাই না সবার সঙ্গে?”
জায়ন তাকিয়ে চোখে এমন একটা রূঢ় দৃষ্টি ছুঁড়ল, যেন সে-ই এখন আইন, সে-ই বিচার। তারপর ঠান্ডা গলায় বলল–
__ “একদম চুপ ,এখন থেকে সকাল পর্যন্ত আমার কোন কাজে বাধা দিবি না সকাল থেকে আবার তোর সব কথা শুনবো।”
এদিকে পেছন থেকে মেহজাবীন বেগম হাক দিয়ে বললেন–
__“আরে দাঁড়া, বাসার চাবি তো নিয়ে যা।”
জায়ন শুনল না, দেখলও না। তিয়াশা এক হাতে তার লেহেঙ্গার ওড়না সামলাতে ব্যস্ত, আরেক হাতে জায়নের কবজি ছাড়ানোর ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত।
দুটো ধাপ পরেই বাইক। জায়ন হেলমেট এক হাতে তুলে বাইকে বসাল তিয়াশাকে, নিজেও এক লাফে উঠেই বাইক স্টার্ট দিল।
পেছনে তিয়াশা এক হাতে আঁচল, আরেক হাতে জায়নের জামা চেপে ধরেছে। মুখে লজ্জায় , বুকের ভিতর দুরুদুরু।
আর জায়ন? মুখে বিশাল আত্মতৃপ্তি বউকে নিয়ে চলেছে সে, নতুন জীবনের প্রথম রাতের দিকে।
খানিকটা পথ পেরিয়েই তিয়াশা ধীরে গলা নামিয়ে বলল,
__”এই রাস্তা তো ওই বাসার দিকে নয়… মানে… এইটা তো বনানীর রাস্তা?”
জায়নের ঠোঁটের কোণে দুষ্টু হাসির রেখা।
__”হুম।”
তিয়াশা একটু সোজা হয়ে বসে বলল
__”কিন্তু আমরা তো… মানে… ওই বাসায় যাওয়ার কথা ছিল… এদিকে কেন?”
জায়ন হালকা গ্যাস টিপে দিয়ে চোখের কোনে তীব্র হাসি মেখে বলল
__” রাতে তোর চিৎকার বাসার লোক নিতে পারবে না তাই , যদি তুই লজ্জায় পড়তে না চাস আমি ঐ বাসায় যেতেও রাজি আমার তো লজ্জা শরম নেই তুই জানিস।ওই বাসায় গেলে কেউ ঘুমাতে পারবে না।”
তিয়াশা হাঁ করে তাকিয়ে রইল। চোখ বড় বড় হয়ে বলল–
__”আপনার কি সত্যিই লজ্জা নেই?”
জায়ন আবারও এক ঠোঁটে কামড় দিয়ে বলল–
__”আমার লজ্জা তো তুই ৩ বছর আগেই কেড়ে নিয়েছিস, এখন থেকে শুধু তোকে নিয়ে অসভ্যতা করাটাই আমার পবিত্র কাজ মনে হবে।”
তিয়াশা লজ্জা আর রাগে হাত বাড়িয়ে জায়নের পিঠে জোরে চিমটি কাটল—
__”আপনাকে দেখলে অসভ্যরাও বলবে ভাই আমরা ভুলে জন্মাইছি।”
জায়ন হো হো করে হেসে উঠল।
__”চল, তোর চোখে আজকে প্রমাণ করে দিই
‘অসভ্য’ মানে কী।”
অমনি বাইকের গতি আরো বাড়িয়ে দিল, তিয়াশা ভয়ে জায়নকে চেপে ধরল। জায়ন নিয়ে চলল তাকে সেই চেনা ঠিকানায় যেখানে রাতের নিস্তব্ধতা কেবল একজনের দম বন্ধ হওয়া চিৎকারেই জেগে উঠবে।
জায়ন দরজার লক ঘোরাতেই তিয়াশা থমকে দাঁড়িয়ে গেল।
ঘরের ভিতরে পা রেখেই চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল চারপাশে।
আলো আঁধারি ঘরটায় ছড়ানো হাজারো ফেয়ারি লাইট, সাদা-গোলাপি পর্দায় নরম করে লাগছে আলো, মেঝেতে ছড়িয়ে সাদা গোলাপের পাঁপড়ি, বাতাসে মিশে থাকা সুগন্ধি ফুলের গন্ধ যেন কোনো সিনেমার সেটে ঢুকে পড়েছে সে।
তিয়াশার বুক কাঁপছে।শরীরে অচেনা শিহরণ, মনে অজানা গতি। গলা শুকিয়ে এসেছে, জিভে একফোঁটা লালা নেই যেন।হঠাৎই কিছু না বলে রান্নাঘরের দিকে ছুটে গেল, ফ্রিজ খুলে ঠান্ডা পানি বের করে ঢকঢক করে খেতে শুরু করল।
হঠাৎই পেছন থেকে শক্ত এক বাহু জড়িয়ে ধরল তিয়াশার উন্মুক্ত বাকানো ঢেউ খেলানো মেদহীন কোমর ।তিয়াশার শরীর যেন মুহূর্তেই কেঁপে উঠল।
__”শুনুন ” মুখে এনে শেষ করতে পারল না।
সেই মুহূর্তেই জায়নের মুখ গুঁজে গেল তিয়াশার গলার কাছে, ঘাড়ে হালকা ভেজা চু*ম্বন একে দিল, গরম নিঃশ্বাসে জড়সড় হয়ে গেল সে।
তিয়াশার হাত কাঁপতে কাঁপতে পানির বোতলটা পরে গেলো মেঝেতে।
চোখ বন্ধ করে একটা চাপা গোঙানি বেরিয়ে এলো ওর মুখ থেকে–
__”উম্… ফ্রেশ হইনি তো…”
জায়ন হালকা হাস্কি সুরে, কিন্তু গলায় অসহ্য উত্তাপ নিয়ে বলল–
__”আমি আর পারছি না কিটি… পরে হবি… এখন তোকে ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারছি না।”
তিয়াশা নিশ্বাস বন্ধ করে ফেলল কিছু মুহূর্তের জন্য।
ভয় আর অচেনা শিহরন দুটো এক সঙ্গেই অনুভব হচ্ছে।
জায়ন এক টান দিয়ে তিয়াশার লেহেঙ্গার ওড়না খুলে দিল , নিজের দাঁত দিয়ে খুলে দিল তিয়াশার লেহেঙ্গার ব্লাউজের পিছনের দড়ির গিট গুলো।
তিয়াশা চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলল। এক অজানা কাঁপুনি ওকে গ্রাস করছে, মাথা উচু করে যেন নিজেকেই সামলানোর চেষ্টা করছে।
জায়ন এর ডান হাতটা হঠাৎই পেছন থেকে তিয়াশার কোমরের নিচে গিয়ে এমন এক ভরসাহীন জোরে চেপে ধরল যে ওর নিঃশ্বাস আটকে গেল মুহূর্তেই, চোখ মেলে কিছু বোঝার আগেই জায়ানের বাম হাত ওর গলার ঠিক নিচে এসে চুলের মুঠোয় শক্ত করে ধরে ওকে ঘুরিয়ে দেয় ফ্রিজের গায়ে ঠেসে, আর ঠিক তখনই ঠোঁ*টের কোণ থেকে শুরু করে গালের পাশ দিয়ে গলা বরাবর নামতে থাকা চু*ম্বন গুলো ঝড়ের মতো বৃষ্টি নামে শরীরজুড়ে,ওর কাঁধ থেকে ব্লাউজ সরে গিয়ে তখন প্রায় অর্ধেক খুলে পড়ছে, শ্বাসগুলো ঘনিয়ে এসে তিয়াশার বুকে ঢেউ তুলছে,
এবং তিয়াশা নিজেকে সামলে নেওয়ার আগেই
এক ঝটকায় জায়ান তিয়াশাকে তুলে বসিয়ে দিল কিচেনের মার্বেল এর স্ল্যাবের উপর। তার মুখটা তিয়াশার খুব কাছে এনে এক অদ্ভুত উত্তেজনায় ফিসফিস করে বলল–
“তোর চুলে আমি রাত কাটাতে চাই… ঘুমাতে না, জেগে থাকতে চাই… তোর নিঃশ্বাস গুনে গুনে প্রতিবার তোর নাম বলতে চাই… আর যখন তুই ‘না’ বলবি, তখন আমি তোর চোখে তাকিয়ে শুধু বলব ‘আমার হয়ে , না বলার অধিকার তুই হারিয়েছিস”
এই বলেই জায়ন নিজে হামলে পরল তিয়াশার ঠোঁ*টের উপর। কিছুক্ষন ঠোঁ*টের উপর নিজের অধিকার চালানোর পর জায়ন নিজের ঠোঁ*ট তখন তিয়াশার ঘাড়ের একপাশে রেখে দাঁত বুজে হালকা কা**মড় বসিয়ে দিচ্ছে, আর নিঃশ্বাসে ভরা একটা গর্জনের মতো শব্দে বলে উঠছে কিছু, যা তিয়াশার রক্ত জমিয়ে দেয়, এরপর একটুও দেরি না করে দুই হাতে ওকে কোলে তুলে নিয়ে সোজা সোফার দিকে হাঁটতে থাকে, পায়ের শব্দ যেন নিঃশব্দ দাবানলের মতো ঘরের নিস্তব্ধতা চিরে যাচ্ছে, আর জায়ান ওকে নরম গদির উপর এমনভাবে ফেলে দেয় যেন এটা ভালোবাসার নয়, এটা একটা অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ, আর সেই যুদ্ধের শুরুটা ও করেছিল রান্নাঘরের ধোঁয়া থেকে, এখন সেই আগুন ছড়াবে শরীরের প্রতিটা কোণায়।
জায়ন এর চোঁখে তখন কামনা উত্তেজনার আগুন ছড়িয়ে পড়েছে , শ্বাস ভারী হয়ে উঠছে এক টানে খুলে দিল নিজের পরণের শেরওয়ানী যার বোতাম গুলো ছড়িয়ে পড়ল এদিক ওদিক,এরকম পাহাড়ের মত মানুষ টিকে দেখে তিয়াশা ভয়ে গুটিয়ে যাচ্ছে কিন্তু শরীরের শিহরন বলছে অন্য কিছু ,তিয়াশা কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বলে উঠলো —
__” আ আমার ভয় করছে।”
জায়ন ঝাঁ*পিয়ে পড়ল তিয়াশার উপর —
__”আমি দেখতে চাই তোর ভয়,আজকে তোকে ছোবো না… ছিঁ*ড়ে ফে*লবো, কিটি ক্যাট।এতদিনের দহনটা আজ ঠোঁটের আগুনে ফুঁ দিয়ে নিভাবো না, জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করবো।তোর শ্বাসের গতি আমি নিয়ন্ত্রণ করবো এখন থেকে…আর কিছুই তোর নিজের থাকছে না না রাত, না তোর শ*রীর।”
গলায় নামতে থাকা চু*ম্বন গুলো হঠাৎ থেমে গিয়ে জায়ানের ঠোঁট যখন তিয়াশার কো**মরের নিচে, নাভির আশপাশে নেমে এলো, তখন একটানা নিঃশ্বাস ফেলতে ফেলতে ওর ঠোঁট একেকবার গরম চু**ম্বন ছুঁয়ে ছুঁয়ে আগুন ছড়িয়ে দিতে লাগলো নরম ত্ব**কের উপর, মাঝে মাঝে ঠোঁট থেমে দাঁত বুজে হালকা করে কামড় বসাচ্ছিল, যেন ও নিজেও আর নিজের পাগলামি সামলাতে পারছে না ঠিক তিয়াশার শরীর ও যেন কেঁপে উঠছিল , তাদের মুখ থেকে ঘন নিঃশ্বাসে মিশে থাকা অধিকার, কামনা আর আগুনে পোড়া ভালোবাসা ওকে একপলকে অসহায় করে তুলছিল, আর জায়ান তখন গলার ঠিক নিচে, কণ্ঠনালীর পাশ বরাবর ঠোঁট চালিয়ে একটার পর একটা চু**ম্বন দিতে দিতে ভারী করে শ্বাস ফেলছিল ওর গায়ে, সারা গায়ে চলছে হাতের খেলা যেন ওর ত্বকেই ও নিজের অস্থিরতা গলিয়ে দিতে চাইছে, যেন আজ রাতের পরে তিয়াশার শরীর আর ওর মাঝখানে কোনো সীমা থাকবে না সব মুছে যাবে শুধু একবার ত্ব*ক ছুঁয়ে ত্ব*কে মিশে যেতে পারলেই।
এক টানে খুলে দিল তিয়াশার গায়ের গহনা ,ছুঁড়ে দিল পরনের লেহেঙ্গা আর ব্লাউজ ।
তিয়াশা লজ্জায় গুটিয়ে নিল নিজেকে , হাত দিয়ে ঢাকার চেষ্টা করছে নিজেকে , চোঁখে ভয় লজ্জা মিশে গিয়ে একাকার, এরপর জায়ন নিজের শেষ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলল তিয়াশাকে এই ভাবে দেখে । মুখ থেকে
একটাই বাক্য বের হল —
__” ওহ ফাঁ** বেব ইউ আর টু মাচ বিউটিফুল কিটি , ইউ লুক লাইক মাইন।”
একটা নিঃশব্দ দাহ, একটানা কাঁপুনি জায়ন তার ওই মস্ত বড় শরীরে ছোট্ট শরীর তিয়াশাকে কোলে তুলে উপড়ে গিয়ে বেডরুমে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিলো এক ধাক্কায়, ঘরের ফেয়ারি লাইটের আলো বিছানা কারুকার্য কোরে সাজানো নানান রকমের সাদা ফুল দিয়ে , সেই বিছানায় ছুঁড়ে দিল হালকা করে তিয়াশাকে, জায়ন নিজে একটু ঝুঁকে তিয়াশার কানের কাছে গিয়ে হাস্কি স্বরে বলল —
__ ” বেব আই উইল বি জেন্টলম্যান ফর ইউ ইন ইওর লাইফ, বাট আই উইল নট জেন্টল অন আওয়ার বে”ড মাই কিটি ক্যাট ।”
তিয়াশার গলা শুকিয়ে আবারো কাঠ হয়ে উঠছে, নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে , কাপা কন্ঠে বলে উঠলো —
__”মা মানে?”
জায়ন গলায় একরাশ মাদকতার নেশা নিয়ে তিয়াশার দিকে এগিয়ে বলল—
___” কাছে আয় বুঝিয়ে দিচ্ছি, বাঘের বাচ্চা বলিস না আমাকে ,আজকে দেখাবো বাঘরা কি করে শীকার করে , আজকে দেখাবো বাঘের হিংস্র ভালোবাসা ।”
এই বলেই পুরোই ঝুঁকে পরল ____
সারা ঘরে ছড়িয়ে পড়েছে এক সুন্দর ফ্রেগেন্স , জানলার থাই গ্লাস ভেদ করে আসা আসা চাঁদের আলো পড়েছে তিয়াশার কাঁধের হাড়ে, সেই হাড় বরাবর ওর ঠোঁ”ট দিয়ে নামতে নামতে জায়ন তীব্র গতিতে নিশ্বাস ফেলছে যেন সব শব্দ থেমে গেছে, কেবল শরীরের স্পর্শই ভাষা, হৃদস্পন্দনের ধাক্কা যেন বিছানার চাদর কাঁপিয়ে দিচ্ছে, এক হাত দিয়ে ওর দুই হাতের কবজি চেপে ধরে জায়ান যখন গা**য়ের উপর ঝুঁ**কে পড়ল, তখন তিয়াশা চোখ বন্ধ করে শুধুই শ্বাস নিচ্ছিল, ঠোঁ*ট অল্প ফাঁকা, বুক ওঠানামা করছিল ধীরে ধীরে যেন মিলনের আগের নিঃশব্দ অস্থিরতা, শরী**র আর আত্মা তখন একসাথে ফেটে পড়ার ঠিক আগের ক্ষণ।তিয়াশার ঠোঁ**টের কোণে জমে থাকা কম্পনটুকু গিলে নিয়ে জায়ান ওর চোখের উপর ঝুঁকে পড়ল, এক হাতে ওর চুলের মুঠো শক্ত করে ধরে মুখটা পিছনে হেলিয়ে দিল, অন্য হাতে ওর কোমরের ঘূর্ণিতে আঙুল চালিয়ে নিচের ঠোঁটে নামিয়ে দিলো এমন এক চু**ম্বন যা শব্দহীন কিন্তু বীভৎস রকম আবেগী, তারপর তার শরীর নিজের তলায় টেনে নিয়ে ওর বুকের ওপর ভর দিয়ে একটানা ঠোঁ*ট চালাতে লাগল ঘাড় থেকে বুক পর্যন্ত ভিজিয়ে দিয়ে রেখে দিল অজস্র চিন্হ, শ্বাসগুলো ভারী হয়ে বিছানার চাদর ছিঁড়ে দেওয়ার মতো ঘন হয়ে উঠছিল, আর তিয়াশা তখন চোখ বন্ধ করে নিঃশ্বাস ফেলে দিচ্ছিল একেকটা কাঁ**পুনির মতো, ঠিক সেই মুহূর্তে জায়ান ওর হাতদুটো মাথার পাশে আটকে নিজেকে মিশিয়ে দিল।
এমন এক তীব্রতায়, যেখানে চাদর ভিজে উঠছিল নিঃশব্দ কান্না, অস্ফুট হাহাকার আর ভালোবাসার সর্বনাশা দাবিতে, এবং মিলনের সেই মুহূর্তে ওরা কেউ আর আলাদা ছিল না ওদের শ**রীর গলে গিয়ে এক হয়ে যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে, ধকধকে এক আগুনে।
এই মুহূর্তটা অনেক নরম, আবেগী, কিন্তু পাষাণ ভালোবাসার দখলে বন্দি এক মেয়ে ,তিয়াশার চোঁখ বেয়ে গড়িয়ে পরছে চোখের পানি,যে আর পারছে না, শরীর অবশ, চোখ অন্ধকার… তবু ছেড়ে দিচ্ছে নিজেকে।
আর এই চার দেওয়ালে বেজে উঠেছে তিয়াশার কান্না চাপা চিৎকার আর জায়ন এর গোঙানি।
রাত কতদূর গড়িয়েছে কেউ জানে না, শুধু জানে তিয়াশার চোখ বুঁজে আসছে, শরীর যেন নিজের ওজনেই গলে গিয়ে চাদরের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে, বুক ওঠানামা করছে ভেঙে পড়া নিঃশ্বাসে, উরু কাঁপছে প্রতি মুহূর্তে, পিঠ ঘেমে একাকার, গলার আওয়াজ আর বেরোচ্ছে না… ঠোঁট শুকিয়ে গেছে, কণ্ঠ আটকে গেছে, আর জায়ান তখনো থামেনি তার বুকের উপর ঝুঁকে, ওর চোখে চোখ রেখে ঠোঁটে চেপে ধরে এমনভাবে শ্বাস নিচ্ছে যেন আজ রাতেই শেষবার পাচ্ছে তাকে।তিয়াশা অস্ফুট গলায় ফিসফিস করে ‘আর পারছি না’ বলতে চাইলেও শব্দ বের হয় না, আর ঠিক তখনই জায়ান ওর হাত দুটো উপরে তুলে বিছানায় আটকে ফিসফিসিয়ে বলে ওঠে,
তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৮
__ “বউ তুই যদি আর একটুও কাঁপিস… আমি এরপরে আবার ও শুরু করবো”
আর তিয়াশা কাঁপে শুধু ভয়ে না, ভালোবাসায় না, সে নিজেও জানে না ।শুধু জানে, ওর শরীরটা আর নিজেকে বহন করতে পারছে না, তবু জায়ানের ভালোবাসায় বারবার নিজেকে তুলে দিচ্ছে, যেমনটা ভালোবাসায় পুড়ে যাওয়া মেয়েরা করে।