তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫০

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫০
নীল মণি

চৌধুরী বাসায় সকাল হতেই শুরু হয়েছে হৈচৈ আর রান্নাবান্নার ধুম।রান্নাঘরে তখন যুদ্ধকালীন প্রস্তুতি চলছে।বড় বড় ডেগচি, হাঁড়ি-পাতিলের তালে যেন পুরো বাসা কাঁপছে।চুলার একদিকে ফুটছে সুগন্ধি কাচা ঘি দিয়ে রান্না হওয়া বাসমতী চালের পোলাও,তার পাশে হাঁড়িতে বসানো মাটন কোরমা পেঁয়াজ-আদা-রসুনের মশলার ঘ্রাণে মুখে জল এসে যায়।
আরেক পাশে এক হাঁড়ি গরম দুধে কিশমিশ-বাদাম দিয়ে তৈরি হচ্ছে জর্দা।
রুহেনা বেগম নিজে দাঁড়িয়ে দেখছেন কাচ্চি বিরিয়ানির ডেকচি–
পোস্ত, জাফরান, এবং মাংসের স্তরে স্তরে হাতের ছোঁয়া।
এককোণে বড় থালায় সাজানো হচ্ছে বেগুনী, আলুর চপ, পেঁয়াজি।
রায়ান বলেই উঠেছিল

__, “এইসব না থাকলে তো খাবারে হুমু হুমু যায় না, বড় আম্মু।”
তাও যেন যথেষ্ট না মেহজাবীন বেগম নিজে দাঁড়িয়ে স্যালাড বানাচ্ছেন,
আর পাশ থেকে খালারা বলছেন __“নতুন বউ দেখতে আসলাম , নতুন বউ কই।”
যতোই বাড়ির মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হোক না কেন ছেলের, তাই ফোনের ফোন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু জায়ন ফোন ধরছে না।
নতুন বউ তো আর রোজ আসে না,একা একা দেখতে হবে এমন তো নয় আত্মীয় স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, সবাই তো মুখিয়ে আছে এক নজর দেখবে বলে।”
চৌধুরী পরিবারের সবাই গত রাতেই যখন লক্ষ্য করেছিল, জায়ন বাসায় আসেনি ।তখনই ইউভি জানিয়ে দিয়েছিল যে জায়ন বনানীর বাসায় গেছেন।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

সবাই খুব ক্লান্ত ছিল, তাই আর তেমন কিছু না বলেই যার যার ঘরে ফিরে গিয়েছিল।
কিন্তু আজ সকাল থেকে পরিস্থিতিটা একটু অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছে।ঘড়িতে তখন প্রায় দশটা বাজতে চলেছে।
এদিকে বাসায় এত মেহমান এদিকে জায়ন ফোনটাও ধরছে না ।এত বেলা পর্যন্ত জায়ন ঘুমায় না, সবাই তা জানে।তবুও একাধিকবার ফোন করেও কেউ ওর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেনি।
তাহসান সাহেব তখন সোফার পাশে দাঁড়িয়ে পত্রিকা উল্টাচ্ছিলেন,হঠাৎই মেহজাবীন বেগম চিন্তিত কণ্ঠে বলে উঠলেন —
__“ভাই, তুমি আর ইউভি একটু দেখে আসো না? ছেলে মেয়েটার কোনো বিপদ টিপদ হলো না তো! ফোনই ধরছে না।”
ইউভি তখনই ঠান্ডা গলায় বলল–

“বড় আম্মু, ভাইয়া হয়তো ঘুমাচ্ছে। কাল রাতে অনেক দেরিতে ফিরেছে তো… উঠলে ঠিক ফোন করবে।”
রুহেনা বেগম চট করে বলে উঠলেন–
“আরেহ্, তাই বলে ফোন তো ধরবে! ঘুমের মধ্যেও তো মানুষ রিং শুনতে পায়।।”
ইউভি একটু অস্বস্তি বোধ করছিল। সে তো জানে, এখন ওদের কিছুটা সময় দেওয়া উচিত।কিন্তু বড়দের সামনে সেসব বোঝানো যায় না।
ওর ঠোঁট কেঁপে উঠলো, কিছু একটা বলার মতো, কিন্তু থেমে গেল।
তাহসান সাহেব তখন গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন–
“আচ্ছা ভাবি, আর ঘণ্টাখানেক দেখি। এরপরও যদি ফোন না ধরে, আমরাই গিয়ে দেখে আসব।”
সবাই তাহসান সাহেবের কথায় সম্মতি জানালেন।
তবুও কারও কারও মুখে চিন্তার ছায়া স্পষ্ট।

রান্নাঘর থেকে গুনগুন রান্নার গন্ধ আসছে, ঘরভর্তি অতিথিদের উপস্থিতিতে সবার মুখে যদিও ব্যস্ততার ছাপ,তবুও কোথায় যেন এক অজানা অস্বস্তি বাতাসে ঘন হয়ে উঠছে।
বেলা চড়ানো সকালটা ছিল নিঃশব্দ, জানালার ফাঁক গলে ঢুকে পড়া করা রোদের রেখা ধীরে ধীরে ছুঁয়ে যাচ্ছিল ।রাতের উন্মাদনা এতটাই গভীর ছিল যে আজ সকালেও তার দাগ লেগে আছে ঘরের প্রতিটি জিনিসে বিছানার বিছানার মাথার দিকের হেডবোর্ডে ভাঙা দাগ পড়েছে, যেন গতরাতের অস্থিরতা তার চিহ্ন রেখে গেছে ।সহ্য করতে পারেনি তার আগুনে উন্মাদনা । মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের অন্তর্বাস ও গোলাপের পাপড়িগুলো আজ যেন নিস্তব্ধ সাক্ষী একটা উষ্ণ রাতের বেসামাল কবিতা হয়ে, আর বিছানার চাদরের ভাঁজে ভাঁজে এখনো আটকে আছে ভালোবাসার থরথর কাঁপন। তিয়াশার শরীরে রয়ে গেছে সেই উগ্র ছোঁয়ার অবশিষ্ট জ্বালা ঘাড়ে, কাঁধে, আর নরম পিঠের ভাঁজে ভাঁজে লালচে দাগ, আর গায়ে-মাথায় ঝুলে আছে সেই রাতের গন্ধ… জায়নের ছায়া যেন তাকে এখনো বিছানা থেকে বেরোতে দিচ্ছে না।বিছানার এলোমেলো চাদর ।

তিয়াশা বিছানার এক কোণে গুটিয়ে পড়ে আছে, মুখ ফুলিয়ে দুষ্টু রাগে নিঃশব্দে কান্না লুকিয়ে রাখছে। পরনে কিছু নেই, শুধু পাতলা কমফোর্টারটা জড়িয়ে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে যেন নিজের শরীরটা থেকেও নিজেকে লুকাতে চায়।
অথচ জায়নের হাতটা এখনও তিয়াশার উদরের ওপর শক্ত করে আঁকড়ে আছে যেন কিছুতেই যেতে দেবে না।আর জায়নের মুখ তিয়াশার গলায় গুজে রেখেছে, একেবারে নিঃশ্বাসের কাছাকাছি মুখ গুঁজে ঘুমোচ্ছে। যেন ওর এই নিঃশ্বাসে, এই গন্ধেই শান্তি খুঁজে পেয়েছে অসভ্য বাঘের বাচ্চা।এমন ভাবে ঘুম যেন বহু বছর পর শান্তি পেয়েছে পুরুষটা। মাঝরাত পেরিয়ে একেবারে ভোরের দিকে জায়ন এর উন্মাদনার উত্তেজনা থেকে মুক্তি পেয়েছে তিয়াশা….
কিন্তু তিয়াশা পড়ে আছে যেন জড় পদার্থের মতো মন আর শরীর, দুটোই নিস্তেজ। চোখ বুজতে পারছে না ব্যথায়। ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে রেখেছে, কিন্তু মনে মনে ঝড় তুলছে একের পর এক গালি, প্রতিটা অভিমানে গলে যাচ্ছে হৃদয়, বিড়বিড় করেই যাচ্ছে

__” বদজাত লোক আমায় এত কষ্ট দিয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। আরেকটু কর সখের পুরুষ কে বিয়ে , আরেকটু হাস বাসরের কথা বলে। অসভ্য লোক এই জন্য এই বাসায় নিয়ে এসেছে ।”
রাগে ঠকঠক করে কাঁপছে ওর শরীরটা যদিও কাঁপারও শক্তি নেই আর। তবু একটা শেষ চেষ্টায় জায়নের হাতটা সরাতে গেল কোমর থেকে, কিন্তু সেই চেষ্টাও ব্যর্থ। শরীরে যেন একটা নারীর আত্মার চেয়ে ক্লান্ত একটা ছায়া পড়ে আছে শুধু।
ঠিক তখনই জায়ন একটু নড়ে উঠে অস্পষ্ট গলায় বলে উঠল,
__”বেইব ডোন্ট ডিস্টার্ব মি, আই এম ইন
হেভেন রাইট নাউ।”
তিয়াশার কানে কথা ঢুকতেই মাথার ভেতরটা গরম হয়ে গেল।ওর ভেতর জমে থাকা ক্ষোভ এবার আর চুপ করে থাকল না। বহু কষ্টে, দম টেনে, একটুখানি জোরে বলে উঠল-

__”অসভ্য লোক, সারারাত আমাকে জ্বালিয়ে এখন হেভেন দেখছে , আগে জানলে কখনও বিয়েই করতাম না আপনাকে।”
কথাটা ছুরি হয়ে ছুঁড়ে দিল ওর দিকে।শব্দে ছেদ পড়ে জায়নের ঘুমে। চোখ আধা মেলে, একটু ঘুম-ঘুম স্বরেই বলে,
__”কি বললি?”
তিয়াশা মুখ ঘুরিয়ে দিল অন্যদিকে, ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
__”যা শুনেছেন, তাই বলেছি। এবার হাতটা সরান।”
জায়ন চোখ টা একটু ভালো করে মেলে একটু মুচকি হাসি দিয়ে বলল —
__” আমি যদি জানতাম আমার বউ এর বিয়ের আগেই সব কিছু জানার ইচ্ছা , তাহলে তো বিয়ের আগে একটু ভালো করে ট্রায়াল দেখিয়ে দিতাম ।”
তিয়াশা মাথা চাপরাবে না নিজের গলা নিজেই টিপে ধরবে বুঝতে পারছেনা —

” শুধরে যান শুধরে যান অসভ্য লোক ।”
হঠাৎ জায়নের হাতের বাঁধন শক্ত, আর তিয়াশার শরী*রটা তার দিকে আরও খানিকটা গলে এলো ।কো*মরের কাছটা এক ঝটকায় ওর শ*রীরের আরও কাছে টেনে নিল সে ,ঠিক তখন… জায়নের উ*ন্মুক্ত উষ্ণ বুকটা ঠেকে গেল তিয়াশার নরম পিঠে।
তিয়াশা মুহূর্তেই চমকে উঠল।ভয়ের ছায়া ছেয়ে গেল চোখে। কাঁপা কণ্ঠে ধীরে ফিসফিস করে বলে উঠল–
__“আ… আবার কি কি করছেন?”
জায়ন মুখ গুঁজে ছিল তিয়াশার গলার পাশে, এখন নাক দিয়ে গভীর শ্বাস নিতে নিতে ওর চুলের ভেতর ডুবে যেতে যেতে নিচু স্বরে শীতল কন্ঠে বলল —

__“মন তো চাইছে অনেক কিছু করতে… কিন্তু আমার বাচ্চা বউ আমায় এখন আর সহ্য করতে পারবে না, তাই থেমে আছি। এদিকে শুধরাতে ও পারবো না আগে জানতাম আমার বাচ্চা বউ ‘মায়াবী সুন্দরী’ কিন্তু এখন দেখছি আমার বউ ‘সো হট’ ও , যাকে দেখে বারবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছি।”
তিয়াশা মুহূর্তে নিঃশ্বাস বন্ধ করে ফেলল, জায়নের কণ্ঠে ঠাণ্ডা আগুন।
সে আবার একটু থেমে, আরও নিচু গলায় কানের কাছে মুখ এনে নিস্তব্ধ ঘরের মাঝে শীতল হুমকির মতো ফিসফিস করে বলল ,

__”কিন্তু বিয়ে নিয়ে যদি আর একবার ও কোন কথা শুনি এর থেকেও খারাপ কিছু উপভোগ করাবো, যা হবে খুব ভয়ঙ্কর সেটা আপনার ধারণার বাইরে মিসেস আবরার।”
জায়নের কথায় তিয়াশা মুহূর্তেই চুপ হয়ে গেল।
ভয়ে গুটিশুটি হয়ে শরী*রটা আরও সেঁটে নিল নিজের ভেতরেই।কিন্তু তবু… সেই চুপ করে থাকা অভিমানের মাঝে একফোঁটা সাহস খুঁজে নিয়ে ধীরে বলল,
__“এর থেকেও ভয়ংকর কিছু থাকতে পারে নাকি…?”
জায়নের ঠোঁ*টে একটু বাঁকা হাসি ফুটে উঠল।
ওর আঙুল তখনও তিয়াশার উ*ন্মুক্ত শ*রীরের উপর ছুঁয়ে ছুঁয়ে খেলছে, যেন জানে এই খেলায় ওরই নিয়ন্ত্রণ, শুধু ছোঁয়া নয়, অনুভবও।
__“দেখতে চাস?”
জায়ন গলার নিচু স্বরে বলে উঠল, ঠোঁটে খেলা করা সেই নিষ্ঠুর কোমলতা,

__“এক্ষুনি দেখাতে পারি। কিন্তু তারপর তোর কী হবে, সেটা কিন্তু আমি জানি না কিটি…”
তিয়াশার গলা শুকিয়ে কাঠ।ভয়ে আর অপমানে আর একটা শব্দও বের হলো না ওর মুখ থেকে।কিছুক্ষণ নীরবতা।এই অবস্থায় নিজেকে আটকে রাখতে তীব্র অস্বস্তি হচ্ছিল তিয়াশার। অবশেষে নিঃশ্বাস চেপে ধীরে বলল,
__“সরেন… আমি ফ্রেশ হবো।”
কাঁপা হাতে জায়নের হাত সরাতে গেল, কিন্তু ব্যথায় শরীর অবশ হয়ে এসেছে। উঠতেই পারল না ঠিকমতো।ঝাঁপিয়ে পড়া রাগে এবার চোখ সরাসরি জায়নের দিকে তাকিয়ে ফেলে বলল,
__“আপনি পশুর থেকেও অধম।”

জায়ন এবার আর কিছু বলল না,শুধু ঠোঁটে সেই চেনা মুচকি হাসি।বিছানা ছেড়ে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালো তিয়াশার সামনে।তিয়াশা ওর এমন উ**লঙ্গ উপস্থিতিতে তাড়াতাড়ি চোখে হাত চাপা দিল।ওর বুকের দিকে আর তাকানো যায় না,চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে জায়ন,চুল এলোমেলো, শ্যামলা ফর্সা ট্রিমড করা মসৃণ উজ্জ্বল ত্বক ,সিক্স প্যাক অ্যাবস, , বুকে সেই রহস্যময় ট্যাটু, আর শরীরে শুধুমাত্র একটা কালো হাল্ফ বক্সার।
জায়নের চোখে তখন শুধু কিছু পেয়ে যাওয়ার অনুভূতি ও পজেসিভ ভালবাসার মিশ্র রসায়ন।সে হঠাৎ একটু নিচু হয়ে এল…
তিয়াশা চমকে উঠল ,এক সেকেন্ডে ওকে কোলে তুলে নিল জায়ন।
লজ্জায় লাল হয়ে গেল ও।চোখ বন্ধ করেই কাঁপা স্বরে বলল,

__“কি… কি করছেন…?”
জায়ন কোনো উত্তর দিল না।নির্বিকার মুখে সোজা ওকে নিয়ে ঢুকে পড়ল ওয়াশরুমে। ওয়াশরুমের ভেতরে জায়ন জাকুজিতে বসে পড়ল তিয়াশাকে নিয়ে।
ঠান্ডা জল ছুঁয়ে যেতেই তিয়াশার কাঁপা শরীর আরও কুঁকড়ে গেল জায়নের বুকের মধ্যে।
জলের ছোঁয়ায় জায়নেরই করা ক্ষতগুলো এক এক করে জ্বলে উঠল তিয়াশার গায়ে ,নিঃশ্বাস আটকে এল যন্ত্রণায়।
তখনই জায়নের মনে প্রথম একটা ধাক্কা লাগল।
নিজের তৈরি দাগগুলোতে ওর বউ যেভাবে ছটফট করছে তা দেখা একরকম নিষ্ঠুর শাস্তির মতো।তার বুকের মধ্যে কোথাও একটা ভেঙে পড়ল।কিন্তু মাথার ভেতর তখনও আগুন…চোখ দুটো লাল, শ্বাস ভারী…
নিজের হাতেই তৈরি ছায়ার মতো অবস্থা।
একদিকে অপরাধবোধ, আরেকদিকে এক উন্মাদ পজেসিভ ভালোবাসা।
সে ধীরে ধীরে তিয়াশার কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিস করে বলল–

__“সরি কিটি ক্যাট, সরি বাচ্চা কি করবো বল আমি তো পাগল হয়ে যাচ্ছি । সরি সোনা হয়তো কখনো এর থেকেও বেশি ব্যাথা দেবো —
‘ বিকজ আই কান্ট কন্ট্রোল মাই সেল্ফ ফ্রন্ট অফ ইউ
বেইব’ । ”
তিয়াশা নিঃশব্দে বসে আছে জাকুজিতে, জায়নের কো*লের উপর তার বুকের আশ্রয়ে।কী বলবে, কীভাবে বলবে, কিছুই মাথায় আসছে না।
জায়নের হাত দিয়ে ধীরে ধীরে ছড়িয়ে দিচ্ছে পানি ওর উন্মুক্ত শরীরে । সাবধানে, যত্নে ,তিয়াশা চোখ বন্ধ করে নেয়, যেন ছোঁয়া না দেখে অনুভব করতে চায়।তারপর হঠাৎ জল পড়া থেমে গেলে চোখ মেলে নিচের দিকে তাকাল তিয়াশা… আর চোখ আটকে গেল জায়নের বুকের ঠিক পাশে সেই ট্যাটুতে।অচেনা ভাষা, অদ্ভুত গাঢ় কালির লেখা… কিন্তু কেমন যেন টানে তাকে।

তিয়াশা নিঃশব্দে হাত বাড়িয়ে ওর বুকে নিজের আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে দিল ট্যাটুর উপর ,তুলতুলে আঙুলে স্পর্শ হতেই জায়নের সারা শরীর কেঁপে উঠল।মুঠি শক্ত করে, চোখ বন্ধ করে, নিজেকে সামলাতে মুখ ঘুরিয়ে নিল সে।
তিয়াশা অবাক হয়ে ওই দিকেই তাকিয়ে থাকল। তারপর নিঃসন্দেহে কৌতূহল নিয়ে বলল —
__“এইখানে কি লেখা?”
জায়ন ধীরে ধীরে চোখ খুলল, মুখ ফিরিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে গলা নিচু করে উত্তর দিল,
__“ইল মিও সোল…”
তিয়াশার ভেজা চুল গলা ছুঁয়ে পড়ছে, কপালে জলের ফোঁটা ঝরছে। উ*ন্মুক্ত শ*রীর জায়ন এর করা চিহ্নে বিন্দু বিন্দু পানি যেন আরো চমকে উঠছে , মায়াবী চোখ তাপ মেশানো সৌন্দর্য এই মুহূর্তে তিয়াশাকে স্বপ্নের মতো লাগছে জায়ন এর চোঁখে , আর এই রূপে এই মেয়ে কে দেখার একমাত্র অধিকার শুধু মাত্র আবরার জায়ন চৌধুরীর। আর এই মায়াবী রমনী শুধু মাত্র তার ।
সে নরম গলায় জিজ্ঞেস করল,
__“মানে?এটা কোন ভাষা?”
জায়নের ঠোঁট শুকিয়ে এলো, গলা কাঁপছে। ওর চোখে চাপা উ*ন্মা*দনা, ভালোবাসা আর এক ধরনের স্বীকারোক্তির ঘন ছায়া।
শেষমেশ ধীরে ফিসফিস করে বলল,,

__“ইতালি ভাষায় লেখা আমার রোদ।”
তিয়াশা স্তব্ধ।এক মুহূর্তে যেন সব অভিমান, ব্যথা, আতঙ্ক গলে পড়ল সেই এক কথায়।
জায়নের গলা ভারী হয়ে এল, যেন নিজের বুকের গভীর থেকে তুলে এনে সত্যিটা ফাঁস করল।
এই কথা শোনা মাত্রই তিয়াশার চোখ ভরে উঠলো জলে। হাতটা এখনো জায়নের বুকে, সে চোখ তুলে তাকাতেই জায়নের বুকের ভেতর যেন একটা ঝড় বয়ে গেল।হঠাৎ তিয়াশাকে নিজের আরও কাছে টেনে নিলো জায়ন। হাস্কি, কাঁপা স্বরে বলল–
“বেইব, আই এম সরি… বিকজ ইউ আর ইমপসিবল। তুই আমাকে পাগল করে দিস ।”
তিয়াশা স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রইল তার দিকে। গলায় কাঁপা কাঁপা স্বর–
“মা মানে…”

জায়নের চোখে তখন ভর করে আছে মাদকতা। তার গলার অ্যাডামস অ্যাপেল ওপর নিচে ওঠানামা করছে, নিঃশ্বাস ভারী উঠছে । তিয়াশার দিকে তাকিয়েই ফিসফিস করে বলল,
“আই নিড ইউ রাইট নাও… কিটি।”
তিয়াশা ভয়ে কেঁপে উঠল, তার নিঃশ্বাস ছেঁড়া ছেঁড়া। সে বোঝে জায়ন কী বলতে চাইছে, তবু বুঝেও না বোঝার ভান করে আবার বলল–
“মা মানে মানে…”
জায়ন হঠাৎ ওকে এক ঝটকায় নিজের দিকে ফিরিয়ে আনলো। স্বরে স্পষ্ট আদেশ–
“সিট অন মি, বেইব।”
তিয়াশা নিঃশব্দ হয়ে কাঁপছিল। সে জানে জায়ন কি করতে চাইছে, তার শরীরে আর ক্ষমতা নেই জায়ন এর পাগলামি সামলানোর , শরীরের সব শক্তি হারিয়ে যাচ্ছে।কিন্তু জায়নের গলা আবার কানে বাজল–
“বেইব, সিট অন মি… প্লিজ।”
তিয়াশা কিছু না বলাতে, জায়ন নিজেই ওকে কাছে টেনে নিলো। নিজের ওপর বসিয়ে নিল এক ঝটকায়।
একটা শ্বাসরুদ্ধ চিৎকার ফেটে বেরিয়ে এল তিয়াশার মুখ থেকে, জায়ন সঙ্গে সঙ্গে ওর ঠোঁ*টে নিজের ঠোঁ*ট চেপে ধরল যেন সেই চিৎকারের শব্দ আর যাতে না শুনতে হয় ।তিয়াশার চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি, বুকের মধ্যে এক অজানা উত্তাল ঝড়। আবারও সেই ওয়াশরুমের নিস্তব্ধতায় ভেসে উঠল জায়নের স্পস্ট গোঙানিতে । মিলে মিশে একাকার হলো দুইটি শরীর ওই ঠান্ডা পানির ধারায়…….

“পাখী কথা টা তো শোন”
ইউভির এইভাবে হঠাৎ করে অনুর রুমে আসায় চিন্তা হতে লাগল। এত অতিথি দের মধ্যে যদি কেউ দেখে নেয়। অনু চিন্তিত স্বরেই বলল —
“আরে আপনি আমার রুমে কি করছেন এই সময় ?কেউ দেখে ফেললে অনেক বিপদ হয়ে যাবে, যান এক্ষুনি প্লিজ।”
কিন্তু আজ ইউভি কিছুতেই তার হৃদয়পাখি রাগ না ভাঙ্গিয়ে এই ঘর থেকে যাবেনা যা কিছুই হয়ে যাক।
ভেবেই এসেছে যে আজ তার হৃদয় পাখির ভুল ভাঙ্গিয়েই ছাড়বে ।
হঠাৎ করেই ইউভি অনুর হাত ধরে বলল–
” যাব না আগে তুই আমার কথা শুনবি তারপরে সব হবে।”
কোন একটি চমকেই উঠলো, হঠাৎ করে এই মানুষটার মধ্যে এত সাহস কোথা দিয়ে চলে আসলো?
সে তাকিয়ে আছে ইউভির দিকে , একটু ঠোট উল্টে শেষমেষ প্রশ্নটা করেই বসলো —
__”বাবা আপনার মত এত সাহস কোথা থেকে আসলো ইউভি ভাই ?”
ইউভি তখন এক মায়া জড়ানো সুরে বলে উঠলো —

__” যখন হৃদয়ের পাখি নিজের জেদ ধরে বসে থাকে,
ভুল বোঝাবুঝি শিকার হয় তখন অনেক কিছুই নিজেদের করতে হয়।”
অনু একভাবে তাকিয়ে আছে এবার ইউভির দিকে–
ইউবি একটু থেমে আজ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো–
“শোন পাখি তোর আমার এমন কি আরো অনেকের দেখা ভুল বোঝাবুঝি কতটা খারাপ হতে পারে তাই আমি চাই না যে আমাদের মধ্যেও ভুল বোঝাবুঝি হয়ে সম্পর্কের দূরত্ব বেড়ে যাক। আমি যখন তোকে বলেছি আমি তোকে ভালবাসি তার মানে আমি তোকে ভালোবাসি। আমি কোন চিটিংবাজ নেই। অনেক সময় চোখে দেখা জিনিসও ভুল হয়। তা তোর ভালো করেই জানা বোনের সঙ্গে কি হয়েছিল তিন বছর আগে। একটা সম্পর্কে বিশ্বাসটা অনেক জরুরী হয় বুঝলি পাখি, যবে থেকে এই মা-বাবা পরিবার এর ভালোবাসার অনুভূতি ছাড়া যখন অন্য কোন এক অচেনা অনুভূতি তৈরি হয়েছে, তা হয়েছে একমাত্র তোর জন্য তুই ব্যতীত এই মনে অন্য মেয়ের ছায়াও কখনো পরেনি না ভবিষ্যতে পড়বে। একটা সম্পর্ক চাইলেই মুহূর্তে ভেঙে দেওয়া যায় কিন্তু তৈরি করতে অনেক সময় লাগে।
অনু যেন মুহূর্তে থমকে গেল , সে স্পস্ট দেখতে পাচ্ছে ইউভির চোঁখে এই কথার মানে গুলো কতটা গুরুত্বপুর্ন,
তবুও নিজের সন্ধেহ বিশদ করার জন্য বলে উঠল —

__” তাহলে গতকাল ঐ আবডালে আপনি আর নেহা আপু কি করছিলেন ?,”
ইউভি আবার ও এক দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো
__” তুই তো আমি বললে বিশ্বাস করবি না , তুই বরং নেহার কাছ থেকেই শুনে নিস।”
ইউভি এই বলেই অনুর হাত ছেড়ে রুম ত্যাগ করল,
কিন্তু অনু একভাবে তাকিয়ে রইল ইউভির যাওয়ার দিকে । অনুর কেন যেন চোখ ভিজে উঠলো।
এদিকে ইউভি নিচে আসতেই রুহেনা বেগম রেজওয়ান কে কোলে নিয়ে অবস্তায় বলে উঠলেন —
” ইউভি এখনো তো কোন খবর আসলো না ওদের, যাবি একটু ?”
ইউভি মাথা নাড়িয়ে বলল হ্যাঁ সম্মতি জানাল।

প্রায় ঘণ্টা খানেক পর,
তিয়াশার নিস্তেজ ছোট্ট দেহটা নিঃশব্দে যাকুজি তে বসে কোলে তুলে নিয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল জায়ন।তার চুলে জড়িয়ে থাকা পানি টাওয়াল দিয়ে আলতো হাতে মুছিয়ে দিল, যেন একেকটা সুতোর মধ্যে নিজে গলে যাচ্ছে।
তারপর নিজেরই একটা সাদা টিশার্ট তুলে পরিয়ে দিল তিয়াশাকে,তিয়াশার চোখ বন্ধ, মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে অন্যদিকে।শব্দ নেই, অভিযোগ নেই শুধু নিঃশ্বাসের ভার।জায়ন এক ঝলক তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
চোখের নিচে জমে থাকা ক্লান্তি, ঠোঁটে জমে থাকা না বলা কথা।নামিয়ে আনল মাথা, কপালে রাখল এক নরম চুমু।
“সরি জান… প্লিজ রাগ করিস না,কি করবো পাগল হয়ে যাই তো ।”

গলা যেন কাঁপছে, নিজেরই স্বরে অপরিচিত লাগছে।
তারপর ধীর পায়ে উঠে গেল কাবার্ডের দিকে ,
সাদা রঙের ব্যাগি ট্রাউজার আর কালো টিশার্ট বের করে পড়ে নিল নিঃশব্দে।
আবার ফিরে এসে বেডের পাশের ড্রয়ার খুলল।
পেইন কিলার মেডিসিন আর একটা পিল এনে, জলের গ্লাসে ওর ঠোঁটের কাছে এগিয়ে দিয়ে বলল —
” এটা খা ব্যথা কমে যাবে । তুই শুয়ে থাক আমি ব্রেক ফাস্ট বানিয়ে আনি।”
তিয়াশা কিছু বলল না জায়ন এর কথা মত ওষুধ গুলো খেয়ে নিল । শুধু চোখের কোণ বেয়ে একটা নীরব জলবিন্দু গড়িয়ে পড়ল বালিশে।জায়ন সেটা দেখেও কিছু বলল না।এই মুহূর্তে শব্দগুলো ভেঙে যায় ,শুধু নীরবতা বলে।
হঠাৎ করেই জায়ন শুনতে পেল কলিং বেলের শব্দ ,
একটু অবাক ই হলো এই সময় কে ?
তারাতারি করে নিচে এসে দরজা খুলতেই দেখতে
পেল , তাহসান সাহেব, নাজিম আর ইউভি দাড়ান ।

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৪৯

এদিকে তাহসান সাহেব এর চক্ষু উঠে গেল চরক গাছে। নাজিম আর ইউভি মুচকি মুচকি হাসছে ,
জায়ন মনে মনে ভাবছে এরা হাসছে কেন ? একটু বিরক্তি ই হল —
তাহসান সাহেব গলা খাকারি দিয়ে বিস্ফোরিত চোখে জায়নের গলার আর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন —
” বাপ তুই কি সকাল দিয়ে নিজেরে আয়নায় দেখিস নাই।”

তোমার ছোঁয়ায় আসক্ত আমি পর্ব ৫১

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here