কাজলরেখা পর্ব ২৮

কাজলরেখা পর্ব ২৮
তানজিনা ইসলাম

সকালে আঁধারের ঘুম ভাঙতেই দেখলো, চাদনী টেবিলের উপর মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আড়মোড়া ভেঙে উঠে বসলো ও। মুখ ফুলিয়ে তাকালো চাদনীর দিকে।দরকার হলে ঘাড়, পিঠ ব্যাথা করে ফেলবে, তারপরও ওর পাশে শোবে না। এতো জেদ এই মেয়ের।ওর গায়ে কি এলার্জি আছে, না ওর পাশে বসলে, থাকলে এই মেয়ের জাত যায়!
আঁধারের মন চায়লো উঠে একটা গাটা মারতে মাথায়। তারপর আবার ঘুমন্ত চাদনীকে দেখে মায়া হলো। মেয়েটার উপর বড্ড প্রেশার যাচ্ছে বেশ কয়েকদিন ধরে। আঁধার এগিয়ে গিয়ে চাদনীর পাশে দাঁড়ালো। কাঁধে হাত রেখে ডাকলো

-“চাঁদ!”
চাদনী উঠলো না। আঁধার কোলে তুললো ওঁকে, বিছানায় শুইয়ে দিয়ে ব্ল্যাঙ্কেট টেনে দিলো। একপলক ওর দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে গেলো কক্ষ থেকে।
চাদনী সোফায় বসে বসে স্যান্ডউইচ খাচ্ছে। আজ বুয়া আসেনি। আঁধারও কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে।
চাদনী ঘুমিয়ে ছিলো প্রায় শেষ রাতের দিকে।সকালে ঘুম ভাঙলো না ওর, ঘুম ভাঙলো প্রায় দুপুর বারোটার দিকে। এরপর থেকে ও একবারও আঁধার কে দেখেনি। চাদনীর আঁধার কে খুজতেও হয়রান লাগে। এতো বড়ো ফ্ল্যাটে ওরা শুধু দু’জন মানুষ থাকে। আগে আঁধার একা কী করে থাকতো এই ভেবেই কূল পায় না ও। মানুষের এতো বিলাসিতা! শুধু একা থাকার জন্যও এতো বড় ফ্ল্যাট লাগে আঁধারকে না দেখলে বুঝতো না চাদনী। অবশ্য ওর সবকিছুতেই বেশি বেশি।
চাদনীর স্যান্ডউইচ খেতে ইচ্ছে করছে না, না পারতে খাচ্ছে ও। বুয়া না আসলে, আঁধার এটা মাস্ট বানাবেই বানাবে। কি করে খায় কে জানে! চাদনী পানি দিয়ে গিলে বহু কষ্টে শেষ করার চেষ্টা করলো। আঁধার তক্ষুনি নামলো সিঁড়ি বেয়ে। চাদনীর মুখে তখন খাবার ঠাসা। কোনোমতে প্রশ্ন করলো

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-“কই ছিলে এতোক্ষণ?”
-“মিস করছিলি?”
-“বয়ে গেছে।”
চাদনী মুখের খাবার শেষ করলো। আঁধার ওর পাশে বসে বললো
-“কি সুখ তোর চাঁদ। বারোটা বাজে ঘুম থেকে উঠিস। ঘুম থেকে উঠতেই দেখিস সবকিছু রেডি করা আছে তোর জন্য।কপাল পোড়া তো আমি না!”
-“বাঁশ কেন মারছো হ্যাঁ! আমি কি বলেছি আমি রান্না করতে পারবো না? তুমিই তো কিচেনে যেতে দাও না। আমার কি করার! বানালে তোমার স্যান্ডউইচ এর চেয়ে ভালো কিছুই বানাবো।”
আঁধার তাকালো ওর দিকে। বললো

-“উমমম.. তোর স্যান্ডউইট খেতে ভালো লাগে না? একচুয়ালি আমার এটাই পছন্দ। বানাতেও কম সময় লাগে। তুই বল তুই কী খাবি?আমি ওটাই বানাবো এরপর থেকে। কিন্তু হ্যাঁ, কঠিন কোনো রেসিপি বলা যাবে না!”
-“লাগবে না কিছু!”
-“বল, তোর তো আবার চাচ্চু কে বিচার দেওয়ার স্বভাব। পরে দেখা গেলো বললি, তোকে খেতে না দিয়ে অত্যাচার করেছি।”
চাদনী নাক কুঁচকে তাকালো। আঁধার ওর হাত টেনে ওঁকে হাঁটুর উপর বসালো।গালে টোকা দিয়ে বললো
-“দাগগুলো যায় না কেন? এতোবার অয়েন্টমেন্ট লাড়ানোর পরও ফিকে হচ্ছে না। এগুলো খুউউব বিরক্ত করছে আমাকে!”

-“তােমার বদৌলতেই পাওয়া!”
-“সেজন্যই বেশি খারাপ লাগছে। নিজের দোষের ছাপ বেশিক্ষণ রাখতে নেই। অথচ তোর গালে আমার অমনুষ্যত্বের ছাপ রয়ে গেছে। বার বার আমার দোষটা মনে করিয়ে দিচ্ছে।”
চাদনী উঠতে চায়লে,আঁধার হাত দিয়ে চেপে ধরে রাখলো ওকে।মেয়েটা সবসময় ওর থেকে দূরে থাকতে চায়, কথা শোনায়, আঁধারের কোনো কথায় ওর উপর প্রভাব ফেলে না এসব আঁধারের খুব গায়ে লাগে খুব। এই যে মেয়েটা অসুস্থ অবস্থায়ও ছুটতে চায়ছে, এখানেই তো আঁধারের ইগো, এটিটিউড, কনফিডেন্স সব ধূলিসাৎ হয়ে যায়। আধার মানতে পারে না, মানতে পারে না চাদনীর অবহেলা, অবজ্ঞা। এসব তো ও করতো অতীতে, কিন্তু এভাবে যে পাশার দান উল্টে যাবে আঁধার সেটা ভাবতে পারেনি।
আঁধার চাদনীর চুলগুলো সামনে পাঠিয়ে, কপাল ঠেকায় ওর পিঠে।
উদাস স্বরে জানতে চায়

-“চাঁদ, বিরিয়ানি খাবি? আমার খেতে ইচ্ছে করছে!”
-“আমারও। কিন্তু বানাবে কে, আজ তো বুয়া আসেনি।আমি তো পারি না বানাতে।”
-“আমি বানাবো, আমি থাকতে তুই কেন রান্না করতে যাবি?”
-“তুমি বিরিয়ানি রাঁধতে পারো?”
-“তোর জামাই সব পারে!”
চাদনী তাচ্ছিল্য করে হাসলো। ব্যঙ্গ করে বললো
-“আমার জামাই!”
-“হ্যাঁ, তোরই তো। পুরোটাই তোর!”
-“পুরোটা আমার না। এখানে অর্পিতা আপু, শাবিহা আপু আরো নাম না জানা অনেকজনের ভাগ আছে। আমি এমনিতে নামেই পেয়েছি। কিন্তু অধিকার আছে অন্যদের।”
আঁধার ভ্রু কুঁচকে বললো
-“হু?তুই আমাকে বা*রোভা*তারি বলছিস?”
-“বলছি! ক্যারেক্টারলেস বলছি!”
-“তুই আমাকে ক্যারেক্টারলেস বলতে পারছিস?”
-“পারছি!”

-“যাহ! সইলাম সব। কিন্তু অন্যদের অধিকার আছে এটা বলে সস্তা বানিয়ে দিস না। তোকে কাবিন করে নিজেকে শুধু তোকে দিয়েছি চাদনী, অন্য কাওকে অধিকার দিয়েছি অপবাদ দিলে সেটা মানতে পারবো না!”
-“আমি অধিকার চাইনি। প্রথমদিন তুমিই বলেছিলে, স্ত্রী হওয়ার চেষ্টা যাতে না করি। তাই কখনো করিনি। তুমি তোমার নিজের কথা নিজে ভুলে যেতে পারো, গিরগিটির মতো সবসময় কথা বদলাতে পারো। কখনো পুতুলের মতো কুড়িয়ে নিয়ে কখনো ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারো। কিন্তু আমার প্রতি তোমার অবজ্ঞা, আমি ভুলতে পারি না! আমার মাথায় সেট হয়ে গেছে, আমি তোমার জন্য সবসময় কালির ড্রামই থাকবো!”
চাদনী উঠে দাঁড়ালো। আঁধার আটকালো না ওঁকে। চাদনী বললো
-“আসো, বিরিয়ানি বানাতে হেল্প করি তোমাকে!”
-“লাগবে না, তুই যা। আমি বানাতে পারবো।”

আঁধার চাদনীর হেল্প নিলো না। অবশ্য চাদনী দু-তিনবার কিচেনে উঁকি দিয়েছিলো। আঁধার তখন খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিলো। কিচেনের অতিরিক্ত তাপে বোধহয় টিশার্টও খুলে ফেলেছিলো। খালি গায়ে মানুষ রান্নাও করে, আর কি কি যে দেখতে হবে চাদনীকে এ বাড়িতে! ওর অস্বস্তি হয়, আঁধার কে এভাবে দেখতে।আঁধার সেসব বুঝতে পেরে কাজগুলো আরো বেশি বেশি করে।
আঁধার রান্না শেষে চাদনীকে ডাকলো। বিরিয়ানির ঘ্রাণে তখন পুরো ড্রইংরুম মাতোয়ারা।
চাদনী নেমে দেখলো আঁধার গোসল সেড়ে এসেছে। এখন আর খালি গায়ে নেই ও। টিশার্ট পরে এসেছে। চাদনী স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো। আঁধার টেবিলে সবকিছু এনে রাখছিলো। চাদনী গিয়ে চেয়ারে বসলো।আঁধার বিরিয়ানি বেড়ে দিলো ওর প্লেটে।

-“শুরু কর!”
আঁধার নিজেও বসলো।চাদনী আঁড়চোখে তাকিয়ে বললো
-“খালি গায়ে কে রান্না করে?”
-“আমি। তোর কোনো সমস্যা? তোকে দেখতে বলেছি আমি?”
চাদনী দুপাশে মাথা নাড়লো। আঁধার বললো
-“খেয়ে বল,কেমন হয়েছে!”
চাদনী একলোকমা মুখে দিয়ে আবেশে চোখ বুজলো। নিঃসন্দেহে রান্নাটা অনেক মজা হয়েছে। চাদনী উৎফুল্ল হয় বললো
-“অনেক মজা। এই, তুমি এতো মজাদার বিরিয়ানি বানাতে পারো জানতাম না তো।”
-“বাড়িতে কখনো বানাইনি, তাই জানিস না! এখানে এসে শখের বশেই বানাতাম।”
-“তুমি সব রান্না পারো আঁধার ভাই?”
-“হু।”
চাদনী খাবারে মনোযোগ দিলো। ও খুবই কম ভাত খায়।বড় চামচে জাস্ট এক চামচ ভাত নেয়। কিন্তু আজ দেড় প্লেট বিরিয়নি শেষ করলো ও। বিরিয়ানি ওর খুব পছন্দের। কিন্তু এখন থেকে সেটা একজন নির্দিষ্ট মানুষের হাতে বানানো হয়ে গেলো।

চাদনীর জ্বর উঠার পর থেকে আঁধার বহুদিন ভার্সিটিতে আসেনি।পড়াশোনার শেষের দিকে এসে সবকিছুতে খুব গ্যাপ পরে যাচ্ছে ওর। ওই যে মানুষ বলে, বিয়ে করার পর কি পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়া যায় না? আঁধারের এখন মনে হয়, যায় না! দুই নৌকায় পা দিয়ে আসলেই চলা যায় না। চাদনীকে ও পড়াশোনা নিয়ে চাপ দেয়, মনোযোগ দিতে বলে। অথচ ওর মনোভাব বিচ্ছিন্ন হয়েছে অনেক আগেই। গ্রাম থেকে আসার আগে যতটা ডিসিপ্লিনড স্টুডেন্ট ছিলো ও, এখন তার এক ভাগও নেই।সংসার আর পড়াশোনা একে অপরের বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক। দু’টো একসাথে কখনোই ভালোভাবে কন্টিনিউ করা যায় না। গেলেও সেখানে পারিবারিক সাপোর্ট থাকতে হয়। আঁধারের মূল জিনিসটায় নেই। ওর পরিবারের মানুষজন খালি চাপিয়ে দিতে পারে।
আঁধার লাইব্রেরিতে বসে আছে।ও আজ খুব সকাল সকাল এসেছে। নটারও আগে। চাদনীর পরীক্ষা নয়টা থেকে। আঁধার ওঁকে ড্রপ করে দিয়ে ডিরেক্ট এখানে চলে এসেছে। আঁধার বইয়ের পাতায় খুব মনোযোগী। ওর মনোযোগ খন্ডন করে এক নারী কন্ঠ ডাকলো ওঁকে

-“ভাইয়া!”
আঁধার কপালে ভাজ ফেলে তাকালো। পড়াশোনার সময় ডিস্টার্ব ওর একদম পছন্দ না। ফ্রেশ মাইন্ডে পড়ার জন্য লাইব্রেরিতে চলে এসেছে।এখানেও শান্তি নেই। আধার বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকালো। আরে, ওইদিনের ওই লাভ লেটার দেওয়া মেয়েটা। যে আঁধারের পিছনে হাত ধুয়ে পরেছে। তার চোখেমুখে খুশির ঝিলিক। যেন খুব দামী কিছু পেয়ে গেছে।
সে আবার বললো
-“ভাইয়া, আমি তামান্না!”
আঁধার চিনতে পারলো ওঁকে। কিন্তু, না চেনার ভং ধরে, ভ্রু কুঁচকে বললো
-“তামান্না কে?আমি তোমাকে চিনি?”
মেয়েটার মুখের হাসি মিইয়ে গেলো। আবারও হেঁসে বললো
-“আমাকে চেনেননি! ওই যে চিঠি দিয়েছিলাম। আপনি তো আর উত্তর দিলেন না?”
-“ওহ তুমি! চিনেছি!”
মেয়েটা বেজায় খুশি হলো। পলক ঝাপ্টে সরল গলায় বললো

-“ভাইয়া, আপনার উত্তর কী? আমি অনেক দিন ধরে আপনাকে খুঁজছি! কিন্তু আপনি ভার্সিটিতে আসেননি অনেকদিন। আই মিস ইউ সো মাচ!”
আঁধার মিষ্টি করে হাসলো। ঘায়েল করা হাসিতে, লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেললো সে। অথচ ওর সব মুগ্ধতাকে কর্পূরের মতো উড়িয়ে দিয়ে আঁধার বললো
-“আমার বিয়ে হয়ে গেছে, খালাম্মা!”
আকাশ থেকে পরলো সে। চিল্লিয়ে বললো
-“আপনি মজা করছেন আমার সাথে তাই না?”
-“তোমার সাথে আমার মজা করার সম্পর্ক? সিনিয়র কে প্রেমের প্রস্তাব দাও লজ্জা করে না? এসেছো দু’দিন হচ্ছে না। অথচ হাত ধুয়ে পরেছো আমার পিছনে! আরেকবার যদি তুমি আমাকে বিরক্ত করো..
মেয়েটা মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে বললো

-“কিন্তু আমি তো জানতাম আপনার বিয়ে হয়নি। বর্তমানে আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ডও নেই।”
-“হ্যাঁ।গার্লফ্রেন্ড নেই। বউ আছে। ওর জ্বর ছিলো, তাই আসতে পারিনি অনেকদিন।”
মেয়েটার তবুও বিশ্বাস হলো না।উদ্বিগ্ন স্বরে বললো
-” আপনি আমার থেকে পিছু ছাড়ানোর জন্য বলছেন, তাই না! আপনি অনেক রিলেশন করেছেন বাট সবার সাথে তো আপনার ব্রেকআপ হয়ে গেছে। এখানকার একটা মানুষ জানে না আপনি বিবাহিত!”
আঁধার শাসিয়ে বললো

কাজলরেখা পর্ব ২৭

-“কাওকে জানাইনি তাই। লিসেন, আমি আমার বউকে অনেক ভালোবাসি। আগে রিলেশনে থাকলেও বিয়ের পর থেকে সব মেয়েকে আমি ভাইয়ের নজরে দেখি।আমার বউ ছাড়া এই দুনিয়ার সব মেয়ে আমার পাতানো বোন।সে হিসেবে তোমাকে আমি ছোট বোন ভাবতে পারি। পরেরবার থেকে আরেকবার যদি আমার পিছনে পরো তুমি, এই ভার্সিটিতে টেকা মুশকিল হয়ে যাবে তোমার জন্য। মাইন্ড ইট!”

কাজলরেখা পর্ব ২৯

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here