Death or Alive part 3

Death or Alive part 3
priyanka hawlader

অর্ষা জানালার পাশে বসে ছিল। সন্ধ্যার আলো ফুরিয়ে এসেছে, ঘরভর্তি নিস্তব্ধতা আর হালকা বাতাসে পর্দা কাঁপছে। কিন্তু তার মনের ভেতর ঝড় বয়ে চলেছে।
সে ভুলতে পারছে না সেই নীল চোখের নেকড়েটিকে।
সে কিছু করল না,
নাক না মুখ—কোনো আওয়াজও করল না।
শুধু তাকিয়ে ছিল অদ্ভুতভাবে।
কেন?”

“কেন আমাকে কিছু না বলেই চলে গেল?”
“কেন আমায় ছুঁলো না, মারল না, ছিঁড়ে ফেলল না?”
“সে কি… সত্যিই একটা নেকড়ে?”
সেই ভাবনার মাঝেই মায়ের গলা ভেসে আসে—
“অর্ষা, মা… একটু বাইরে আয় তো… কে এসেছে দেখ। তোকে দেখতে এসেছে।”
অর্ষা এক ঝটকায় ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে।
সে ধীরে ধীরে বারান্দায় আসে।
আর সেখানেই তাকে চমকে দেয় এক মুখ—
মীরা।
তার ছোটবেলার বান্ধবী। সেই মেয়ে যে তার সঙ্গে গাছে উঠে পাকা জাম খেত, বর্ষার দিনে জলে ঝাঁপ দিত, আর দুপুরবেলা পালিয়ে মেলার দিকে দৌড়াত।
অর্ষার মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
দুই বান্ধবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

অর্ষা: “তুই এখন এলি! আমি তো অনেক আগেই এসেছি গ্রামে।”
মীরা: “আরে রে, আমি তো বাড়িতে ছিলাম না। ফুপুদের বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আজ সকালে এলাম, আর শুনলাম তুই এখানে—তাই দৌড়ে এলাম রে!”
মীরা একেবারেই আগের মতোই আছে। প্রাণবন্ত, সরল, আর একটু বাচাল।
কিছুক্ষণ গল্প করার পর হঠাৎ মীরা বলে ওঠে—
মীরা: “চল না, আমার বাড়ি। মা তোকে নিয়ে যেতে বলেছে। বিকেলেই যাবি আর একেবারে রাতে ফিরবি।”
অর্ষার হাসিমুখ হঠাৎই একটুখানি কেঁপে ওঠে।
“রাতে ফিরবি…” — এই কথাটাই কেমন ছুরি হয়ে গেঁথে যায় মনে।
সেই নেকড়ে… সেই নীল চোখ… সেই ঠান্ডা শ্বাস…
কিন্তু সে নিজেকেই গুছিয়ে নেয়।
নিজের মনকে শক্ত করে বলে:

অর্ষা তুই পড়াশোনা করে ডাক্তার হবি। তুই যদি ভয় পাস, তাহলে তো চলবে না।
ঢাকায় তুই কত ছেলেকে ঝাড়ি মেরে এক করে দিয়েছিস। আর এটা তো তোর নিজের গ্রাম! এখানে ভয় পাবি?”
হালকা এক নিশ্বাস ফেলে সে মাথা নাড়ে।
তার মা তখন উঠানে দাঁড়িয়ে হাসছেন।
অর্ষা কাছে যায়, মা’কে জড়িয়ে ধরে।
অর্ষা: “আমি যাচ্ছি মা, রাতে ফিরব। চিন্তা করো না।”
মা মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
আর দুই বান্ধবী হাঁটা শুরু করে।
পথে সূর্য আর নেই,
পাখিরাও গাছে ফিরেছে।
আকাশে হালকা লালচে রেখা ধীরে ধীরে মিলিয়ে যাচ্ছে।
কিন্তু অর্ষার মনে পড়ছে একটাই দৃশ্য—
গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা সেই নেকড়ে…
যার নীল চোখ যেন এখনও তার পেছনে পেছনে হাঁটে।

রাজসভার কাজ শেষ করে সন্ধ্যার কুয়াশাভরা করিডোর পেরিয়ে জ্যাইম হাঁটছে অন্দরমহলের দিকে। প্রাসাদের সেই অংশে আলো একটু কম, কিন্তু বাতাসে একধরনের শান্তি মিশে থাকে—যেমনটা বাইরের রাজনীতিতে নেই।
অন্দরমহলের প্রবেশপথ পেরিয়ে সে যখন ভিতরে পা রাখে, তখনই চোখে পড়ে এক পরিচিত মুখ—তার আদরের ছোট বোন ইসাবেলা। রুপার মত চুলে ফুল গুঁজে খেলতে খেলতে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে সে। জ্যাইমের মুখে হালকা হাসি ফুটে ওঠে।
“এই যে! রাজকুমারী সাহেবা! তুই না বলেছিস আমাকে চিঠি লিখবি?” – বলে পেছন থেকে চুপিচুপি গিয়ে দুই হাতে চোখ ঢেকে ধরে জ্যাইম।
– “উফ্‌ফ! আবার তুমি!” – ইসাবেলা একটু গম্ভীর ভাব নিয়ে বলে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে হাসি লুকিয়ে রাখতে পারে না।

এরপরই শুরু হয় সেই চিরচেনা খুনসুটি—জ্যাইম তাকে ধরে বিছানায় ফেলে দেয়, আর ইসাবেলা পায়ের আঙুল দিয়ে ঠেলতে থাকে তাকে। মাঝে মাঝে দুই ভাইবোনের হাসির শব্দে কেঁপে ওঠে পুরো অন্দরমহল।
ওয়াজফান “দা এর রাজসভা কেমন গেল আজ?
“খুব একঘেয়ে নিশ্চয়ই দা যেমন রুড বাবা … যদি তুমিই সিংহাসনে বসতে!”
– “তাহলে রাজ্যের সব মানুষকে বলতাম, সপ্তাহে একবার অন্তত চকলেট খেতেই হবে!” – ইসাবেলা মুখ ফুলিয়ে বলে।
– “হাহাহা! তবে রাজ্য ডায়াবেটিক রোগীতে ভরে যেত!” – জ্যাইম হাসতে হাসতে বলে। আর তুই ওয়াজফান ব্রো কে রুড বললি দারা আমি তাকে বলে দেব।
ইসাবেলা সঙ্গে সঙ্গে বল ওঠে না না দাদা বলোনা আমার ভুল হয়েছে আর হবে।
জ্যাইম হেসে ইসাবেলার মাথায় গাট্টা মেরে বলে আচ্ছা বলবো না।
এরপর ইসাবেলা জিজ্ঞেস করে,

– “তুমি কি এবারও চলে যাবে দাদা? আবার নতুন কোনো দেশের দিকে? তোমার তো সারা জীবন এক দেশ থেকে অন্য দেশে ঘোরাঘুরি, কাজের ভেতরেই কেটে যায়…”
জ্যাইম একটু হেসে ইসাবেলার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল,
– “হ্যাঁ, এবার এসেছি শুধু ওয়াজফান দা’র রাজ্যাভিষেক দেখতে। সে রাজা হবে, আর তার পাশে আমি থাকবো না—তা কি হয়! তাই এলাম। তবে এবার আমি যাচ্ছি একেবারে অন্যরকম এক দেশে… এক ইউনিক জায়গায়। সেখানে আমি জিন রূপে নয়, মানুষের রূপে যাবো। মানুষের দুনিয়ায়… মানুষদের মাঝেই।”
শুনেই ইসাবেলার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। চোখ বড় বড় করে বলল,
– “কি বলছো তুমি! মানুষের রূপে? মানুষের জগতে? ওয়াজফান দা পারমিশন দিয়েছে? তিনি তো মানুষকে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে… তার চোখে মানুষ মানেই দুর্বল, মিথ্যেবাদী, বিশ্বাসঘাতক। তিনি তো সহ্যই করতে পারেন না তাদের!”
জ্যাইম একটু হাসে। তারপর নরম গলায় বলে,

– “তাই তো… প্রথমে রাজি হয়নি। চেয়েছিল আমাকে আটকে রাখতে। কিন্তু… ভালোবাসে যে আমাকে, সেই ভালোবাসার জোরেই আমি তার থেকে পারমিশন আদায় করে নিয়েছি। দামটা যদিও একটু বেশি… কিন্তু পেয়েছি। তুই চিন্তা করিস না।”
এতটা বলে সে ইসাবেলার নাক টেনে দিয়ে মজা করে বলল,
– “তুই বরং এবার অন্তত একটা চিঠি লিখিস, প্লিজ। প্রতিবারই বলিস, কিন্তু পাঠাস না…”
ইসাবেলা নিচু গলায় ফিসফিস করে বলল,
– “তোমার চিঠির উত্তর লেখার আগে প্রতিবার আমার চোখ ভিজে যায়… দাদা… এবারও কি তুমি অনেক দিন থাকবে না?”
জ্যাইম তার ছোট বোনের দিকে তাকিয়ে বলে আমি একটু পরে চলে যাব তুই দা এর খেয়াল রাখিস।

মীরাদের বাড়ি গল্প করতে করতে কখন যে রাত হয়ে গেছে, অর্ষা টেরই পায়নি।
ঘড়ির কাঁটা দেখে হঠাৎই আঁতকে ওঠে,
তবু মীরা বলে, “রাত তো হয়েছে, থাক না রে আজ এখানে।”
কিন্তু অর্ষা হেসে বলে—
না, মা চিন্তা করবে। আর তুই জানিস, আমি রাতের অন্ধকারে মর্গে ঢুকেছি, সেখানে তো ভূতের সঙ্গেই ছিলাম। এই অন্ধকার তো আমার পুরনো বন্ধু।”
সে একাই রওনা দেয় ফিরতি পথে—
জঙ্গলের মেঠো পথ ধরে।
সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে অনেক আগে, এখন নিঃসাড় রাত।
নির্জনতা যেন চিৎকার করে কানে বাজছে।
গা ছমছমে পরিবেশ,
মাঝে মাঝে ঝোপের ফাঁক দিয়ে শিয়াল ডাকার শব্দ,
পেছন থেকে রাতজাগা পাখির হুহু ডাক—
তবুও অর্ষা ভয় পায় না।
ভূত না হোক, হিংস্র পশু থাকতেই পারে…
সেইটাই তো আসল ভয়…”
হঠাৎ,

তার স্পষ্ট অনুভব হয়— কিছু একটা তার পেছনে দিয়ে ছায়ার মতো ছুটে গেল।
অর্ষা দাঁড়িয়ে পড়ে।
দ্রুততার সাথে সে নিজের পকেট থেকে একটা ছোটো ধারালো ছুরি বের করে।
ওটা সে সবসময় রাখে, নিজের সেফটির জন্য।
তার চোখে ঝিলিক ঝলকায়—
আজ যদি কিছু আসে, আমিও লড়ব!”
সে ঘুরে দাঁড়াতে যাবে ঠিক তখনই—
পিছন থেকে কারো সাথে হঠাৎ এসে ধাক্কা খায়।
সে সামলে উঠতে না পেরে পিছনের দিকে পড়ে যেতে থাকে…
কিন্তু…

ঠিক মাটি ছোঁয়ার আগমুহূর্তে
দুটি শক্তিশালী হাত তার কোমরে জড়িয়ে ধরে তাকে পড়ে যেতে দেয় না।
তার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ভয়ে।
কিন্তু ধীরে ধীরে, নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হলে সে চোখ খুলে দেখে—
দুটি নীল রঙের মণি ঠিক তার চোখের সামনে।
আগুন নয়, রক্ত নয়—এই চোখ যেন বরফের মতো ঠাণ্ডা,
আবার… তাতে আছে অদ্ভুত তাপ।
তারপর… ধীরে ধীরে সে পুরো মুখটা দেখতে পায়।
সে এক অপরূপ যুবক।
চেহারা এতটাই সুদর্শন যে প্রথম দেখাতেই মন ছুঁয়ে যায়।
তার চুল হালকা লালচে রঙের,
বেশি লম্বা নয়, আবার ছোটও না—

সুন্দরভাবে সেট করা, মাথার ওপর থেকে চোখ ছুঁয়ে এক পাশ বেয়ে পড়ে আছে।
তার চামড়া দুধে রাঙা, যেন কোনো চিত্রকরের তুলি থেকে উঠে এসেছে।
অর্ষা নিশ্চিত—এই যুবক বাংলাদেশি না।
হয়তো ভিনদেশী।
হয়তো… ভিন্ন এক জগতের।
তার বুকের সঙ্গে ঠেকে আছে অর্ষার হাত।
তারা একে অপরকে দেখে।
তাকিয়ে থাকে।
তবে ছেলেটা এমনভাবে, তাকিয়ে আছে,
যেন কেউ বহু শতাব্দী পর
হারিয়ে যাওয়া আত্মাকে খুঁজে পেয়েছে।
ছেলেটার চোখে নেশার মতন এক দৃষ্টি,
আর অর্ষা নিজের অজান্তেই ধরা পড়ে যায় সেই দৃষ্টির ফাঁদে।
সেই নীল চোখ…
সেই ছায়ামূর্তি…

হ্যাঁ—এটাই সে! নেকড়ে
কিন্তু আজ সে মানুষের রূপে।
তারা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে…
তাকিয়ে থাকে। তবে অর্ষা তা ধরতেও পারে না।
আর ঠিক তখনই,
আকাশের কোণে গর্জে ওঠে মেঘ, ঝলকে ওঠে বিদ্যুৎ।
নিশ্চুপ নিশুতি যেন ধ্বংসের পূর্বসন্ধ্যা নিয়ে দাঁড়িয়ে।
অর্ষা তখনও সেই ছেলেটির হাতের মাঝেই। বুক ধুকপুক করছে, কিন্তু মুখে আঁচ নেই।
হঠাৎ তার ধ্যান ভাঙে।
সে এক ঝটকায় নিজেকে সরিয়ে নেয়।
একটু দূরে সরে দাঁড়িয়ে বলে—
কে আপনি? আর আমার পেছনে পেছনে আসছেন কেন?”
ছেলেটি চোখে হালকা বিস্ময় নিয়ে বলে—
আমি আপনার পেছনে কেন যাব বলুন? আমি তো আমার পথেই যাচ্ছিলাম। আপনি হঠাৎ ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলেন… আমি শুধু আপনাকে বাঁচালাম।”

অর্ষা কিছুটা সংকোচে পরে যায়। সে নিজেও জানে, ছেলেটার কথা মিথ্যে না।
তবে তবুও সন্দেহের সুর গলায় বজায় রেখে জিজ্ঞেস করে—
“ও আচ্ছা… তবে এত রাতে আপনি এখানে কী করছেন? কে আপনি? আপনাকে তো কখনো এখানে দেখিনি।”
ছেলেটা হালকা হাসে।
তার হাসির মধ্যে লুকিয়ে আছে রহস্য,
আবার একধরনের ভদ্র সৌজন্য।
আমার নাম ক্যালিয়ন। আমি এই দেশে থাকি না।
বাংলাদেশে এসেছি ভ্রমণ করতে।
জঙ্গল আমার খুব প্রিয়…
আর শুনেছিলাম এই মধুপুরে নাকি অসাধারণ জঙ্গল আছে।
তাই… চলে এসেছি।”

অর্ষার কপালে একটু ভাঁজ পড়ে, কিন্তু পরক্ষণেই তার মুখে অতিথির জন্য স্বাভাবিক সৌজন্য ফিরে আসে।
সে একটু এগিয়ে এসে ছেলেটার দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলে—
“ও আচ্ছা… আপনি তো আমাদের দেশের মেহমান!
তাহলে আপনাকে স্বাগতম, ক্যালিয়ন!
আমি অর্ষা। এই গ্রামেরই মেয়ে।
আপনি অনেক সুন্দর জায়গায় এসেছেন—
মধুপুর শুধু জঙ্গল না, প্রাণের একটা অংশ।
আপনি এখানে প্রকৃতির সত্যিকার স্বাদ পেতে পারবেন।”
ক্যালিয়ন এবার অর্ষার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা নরম করে ধরল।
তার হাত ঠান্ডা… অথচ ছুঁয়ে অদ্ভুত এক অনুভূতি।
সে হালকা মাথা নোয়াল—
“Thank you, অর্ষা।
আপনার নামটা যেমন সুন্দর…
আপনিও তেমনই।”
অর্ষা লাজুকভাবে মুখ সরিয়ে নেয়।
কিন্তু তার চোখ বলছিল অন্য কথা—
এই ছেলে অদ্ভুত, অন্যরকম।
তার কথার মধ্যে কেমন যেন একটা মায়ার ছোঁয়া।
হঠাৎ ক্যালিয়ন বলে—

আসলে আমি এখানে কিছুই চিনি না।
কাউকে খুঁজছিলাম যে আমাকে গ্রামটা চিনিয়ে দেবে।
এমন কেউ, যার সঙ্গে ঘোরার মাঝে আমি এলাকাটাকে ঠিকঠাক বুঝে নিতে পারব।
আপনি… কি আমার গাইড হবেন?”
অর্ষা চমকে ওঠে।
সে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে।
তার মন বলছে না,
কিন্তু মেয়ের দায়িত্ববোধ আর এই দেশে অতিথিকে সম্মান করার শিক্ষা বলছে—
“হ্যাঁ”।
অর্ষা মনে মনে ভাবে—
“উনি তো অতিথি… তাকে সাহায্য করাটাই আমার দায়িত্ব।
আমি শুধু একটু ঘুরিয়ে দেখাবো। কিছুই তো হবে না…”
সে একটুখানি হাসে, তারপর বলে—
ঠিক আছে ক্যালিয়ন।
কাল সকাল থেকে আমি আপনাকে মধুপুর দেখাবো।
যতটা পারি, চেষ্টা করব আপনাকে প্রকৃত মধুপুর চিনিয়ে দিতে।”

ক্যালিয়নের ঠোঁটে এক প্রশান্তির হাসি।
তার চোখে আবার সেই রহস্যের আভা।
অর্ষা তার ফোন থেকে ক্যালিয়নের নাম্বার টাইপ করে, তাকে ফোন করে রাখে।
“ভালো থাকবেন, ক্যালিয়ন। দেখা হবে কাল সকালে।”
আমিও অপেক্ষায় থাকব, অর্ষা।” — ছেলেটি বলে।
অর্ষা এবার বিদায় নিয়ে চলে যায়।
কিন্তু চলে যাওয়ার সময় অজান্তেই আরেকবার পেছনে ফিরে তাকায়…
সেই নীল চোখ আবার তাকে দেখছিল—
কিন্তু এবার তাতে আগুনের ঝলক নেই,
বরং ছিল এক অদ্ভুত আর গা ছমছমে প্রশান্তি।

রাত গভীর। রাজপ্রাসাদের একদম নির্জন কোণায় নিজের ঘরের ভেতর চেয়ারে বসে আছে ওয়াজফান কায়াস্থ। এক পা তুলে রেখেছে অন্য পায়ের উপর। ডান হাতটা রাখা টেবিলের উপর, আর বাম হাতে ধরা একটা স্ফটিক গ্লাস—যার ভেতরে গাঢ় লাল এক অজানা পানীয়। পাশে বিশাল জানালার পর্দা নেমে আছে, তবু অল্প চাঁদের আলো এসে পড়ে তার নিঃশব্দ মুখে।
তার চোখ গভীর ভাবনায় নিমগ্ন। কিন্তু ঠোঁটের কোণে লেগে আছে এক অস্পষ্ট, রহস্যময় হাসি—যার মানে কেবল তিনিই বোঝেন। সেই হাসির মাঝে লুকিয়ে আছে রাজ্য, প্রতিশোধ, স্মৃতি, আর কিছু অব্যক্ত বেদনা।
ঠিক তখনই—
কোনো নক ছাড়াই দরজাটা খোলার শব্দ হয়। ওয়াজফান মাথা ঘোরায় না, কারণ সে জানে—এই রাজ্যে একমাত্র একজনই আছে, যে তার ঘরে অনুমতি ছাড়া ঢুকতে পারে।
জ্যাইম।
জ্যাইম সোজা হেঁটে এসে দাঁড়ায় তার সামনে। চোখে বিদায়ের গভীরতা, তবু কণ্ঠে সহজ ভঙ্গি।

– “দা, আমি যাচ্ছি… আমার গন্তব্যে। বিদায় নিতে এলাম।”
ওয়াজফান ধীরে ধীরে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়। এগিয়ে আসে ভাইয়ের সামনে। চোখে কোনও আবেগ নেই, কিন্তু কণ্ঠে এক অদ্ভুত দৃঢ়তা।
– “যাচ্ছিস, ঠিক আছে। তবে মনে রাখিস—কোনো মানুষকে বিশ্বাস করবি না। মানুষ মনস্টার, জ্যাইম। ওরা যতটা দুর্বল দেখায়, তার থেকেও অনেক বেশি জঘন্য। বিশ্বাসঘাতকতা করতে ওদের দুই মিনিটও লাগে না। ওরা পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু জাতের জীব। যত দূরেই থাকিস, ওদের কাছ থেকে সাবধানে থাকবি।”
জ্যাইম মাথা হেঁট করে মৃদু হেসে বলল,
“আচ্ছা দা, ঠিক আছে। সাবধানে থাকব।
তবে মনের গভীরে অন্য কিছু কাঁপছিল—
“তুমি ভুল বলছো, দা… মানুষ এতটা খারাপ নয়। একদিন তুমি নিজেই বুঝবে। কিন্তু আজ… আজ এই কথা মুখে বলার সাহস আমার নেই…”
জ্যাইম চলে যায়। ধীরে ধীরে দরজার দিকে হাঁটে, তারপর নিরবে বেরিয়ে যায় রাজপ্রাসাদ থেকে—নতুন এক যাত্রার পথে।
ওয়াজফান তাকিয়ে থাকে দরজার দিকে। এক মুহূর্ত চুপচাপ। তারপর হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠে বলে ওঠে,

– “আয়রাক।”
ছায়ার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে একজন—ওয়াজফানের পার্সোনাল রক্ষী। গা-ঢাকা কালো পোশাক, চোখে নির্লিপ্ততা।
– “হুকুম দিন, বাদশাহ।”
ওয়াজফান এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে নিচু স্বরে বলে,
– “জ্যাইম… যেখানেই যাক, তার ওপর নজর রাখবি। কোনো বিপদে যেন না পড়ে। সে যেন টের না পায়, তুই তাকে দেখছিস। দূর থেকে, আড়াল থেকে সব খবর দিবি। ওর প্রতিটি পদক্ষেপ আমার জানার বাইরে যাবে না। এটা আমার আদেশ।”
আয়রাক মাথা নিচু করে বলে,

Death or Alive part 2

– “আপনার আদেশই আমার শ্বাস।”
ওয়াজফান আবার চেয়ারে বসে। টেবিল থেকে তুলে নেয় লাল পানীয় ভর্তি গ্লাস। জানালার বাইরে চাঁদের আলো আরও ম্লান। ভেতরে জমে ওঠে এক অদ্ভুত নিঃশব্দ যুদ্ধ—ভাইয়ের প্রতি ভালোবাসা, আর মানুষের প্রতি গাঢ় ঘৃণার মাঝখানে দ্বন্দ্বে জর্জরিত এক রাজাধিপতি।

Death or Alive part 4

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here