Death or Alive part 4

Death or Alive part 4
priyanka hawlader

পরদিন সকালটা ছিল অদ্ভুত রকম পরিষ্কার।
সূর্য যেন ঝলমল করে উঠেছিল মধুপুরগড়ের আকাশে, তবে জঙ্গলের ভিতর দিকটা একটু অন্ধকার সেখানে সূর্য বেশি তাপ নেই।
গাছের পাতাগুলোতেও আলো ছড়িয়ে পড়ছিল যেন সোনার জল।
অর্ষা ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে নিল।
আজ তার কথা ছিল ক্যালিয়নকে পুরো মধুপুরগড় ঘুরিয়ে দেখানোর।
তারপর সকাল ১০টা নাগাদ
গ্রামের মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যালিয়নকে দেখে হালকা হাত নাড়ল অর্ষা।
ক্যালিয়ন এগিয়ে এলো।
আজও তার চেহারায় এক অপার্থিব ঔজ্বল্য।
নীল চোখদুটি যেন আলোতেও ঝিলমিল করছে,
আর তার শরীরী ভাষা—অদ্ভুত শান্ত, কিন্তু তাতে এক রকম সিংহভাগ আত্মবিশ্বাস লুকানো।
অর্ষা বলে উঠল—

“চলেন, আজ আপনাকে আমাদের মধুপুরের রত্নগুলো দেখাই।”
সেই শুরু হল তাদের গ্রাম দেখা অভিযান।
অর্ষা তাকে নিয়ে গেল—
চিলির গড়ের পাহাড়ে, যেখানে দূর থেকে পুরো বন দেখা যায়।
পুরনো বটগাছের তলা, যেখানে লোকেরা বলে পুরনো কালের প্রেত আত্মা ঘোরাফেরা করে।
আতপড়ার পুকুর, যেখানে নাকি একসময় কুমির থাকত, আর এখনো গোপনে কিছু যেন আছে বলে শোনা যায়।
কিন্তু ক্যালিয়ন…
তার মন যেন প্রকৃতির সৌন্দর্যে নেই।
সে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে অর্ষার দিকে।
অর্ষা যখন কিছু বোঝাচ্ছে, সে যেন তার মুখের ভঙ্গিমা, হাসি, চোখের গভীরতা—সব কিছু মনের গভীরে ভরে নিচ্ছে।
একসময় অর্ষা খেয়াল করে বিষয়টা।
সে হেসে বলে—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আচ্ছা ক্যালিয়ন, আপনি তো বাঙালি না… তাহলে এত সুন্দর করে বাংলা বলেন কীভাবে?”
ক্যালিয়ন হালকা হাসে।
তার চোখে জ্বলজ্বল করে ওঠে এক রহস্যের ছায়া।
সে বলে—
আসলে আমি শুধু বাংলা না… আমি প্রায় সত্তরটা দেশের ভাষা জানি।”
অর্ষা থমকে যায়।
তার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে ওঠে।
“সত্তরটা ভাষা?! এক জন মানুষ এতগুলো ভাষা কিভাবে পারে!”
সে মনের ভেতরে এক ধরণের কৌতূহল অনুভব করে।
কিন্তু সে জানে না—

এই যুবক মানুষ নয়।
সে জানে না ক্যালিয়নের ভেতরে থাকা সেই নেকড়ে সত্তা,
যে শুধু ছায়ার ভেতরে বেঁচে থাকে।
আর তার এক বিশেষ শক্তি হলো—
যাকে সে স্পর্শ করে, তার ভাষা ও অভ্যন্তরীণ তথ্য নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নিতে পারে মাত্র দুই মিনিটে।”
কিন্তু ক্যালিয়ন তা বলে না।
সে শুধু হেসে বলে—
“শখ ছিল ভাষা শেখার। সময়ের সাথে সাথে অনেক শিখে ফেলেছি।”
অর্ষা এবার একটু গম্ভীর হয়ে জিজ্ঞেস করে—
আপনি এখানে কোথায় থাকছেন?”
ক্যালিয়ন তার দৃষ্টি অর্ষার চোখ থেকে সরিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে—
আমি তো ট্যুরিস্ট দলের সাথে এসেছি।
তারা সবাই আমাদের জাতীয় উদ্যানের পাশে একটা হোটেলে আছে।
সেখানেই উঠেছি।”
অর্ষা মাথা নাড়ে।

“ও আচ্ছা… ওই হোটেলটা বিখ্যাত, সত্যিই। খুব সুন্দর জায়গায়।”
এরপর তাদের হাঁটা আবার শুরু হয়।
কিন্তু অর্ষা এবার বুঝতে পারে—
ক্যালিয়ন প্রশ্ন করছে অনেক কিছু… কিন্তু তার দৃষ্টি বারবার আটকে যাচ্ছে অর্ষার চোখে, ঠোঁটে, মুখে।
একটা নেশার মতো।
অর্ষা একটু লজ্জা পায়,
আবার একটু বিরক্তও।
সে কিছু না বলে একপাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ফুলের দিকে ইঙ্গিত করে বলে—
এইটা দেখেছেন কখনো? এটার নাম শিমুল।
বসন্তে পুরো বন রক্তরঙ হয়ে যায় ওদের জন্য।”
ক্যালিয়ন ফুলের দিকে না তাকিয়ে বলে—

আমি যা দেখছি… তার চেয়েও রঙিন কিছু এখন আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, অর্ষা।”
এই কথা শুনে অর্ষার বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে।
সে কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়।
তখনই হঠাৎ বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ ভেসে আসে…
ভেজা মাটি, রক্ত, আর জং ধরা লোহার মিশ্র গন্ধ।
অর্ষার মুখ কালো হয়ে যায়,
সে বলে—
এই গন্ধটা… আমি আগেও কোথাও পেয়েছিলাম।
অদ্ভুত… খুবই অদ্ভুত!”
ক্যালিয়ন কিছু না বলে হালকা একটা হাসি দেয়।

সকালের আলো তখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়ছে শহরের আকাশে। কিন্তু সেই আলোয় স্নান করতে আসা নতুন ছাত্রটির চোখে ছিলো ছায়া, আর মুখে এক আশ্চর্য নির্লিপ্ততা।
আজ প্রথম দিন, জ্যাইম মানুষের পৃথিবীর একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখল।
ছাতা মাথায় চাপানো, হালকা ধূসর ট্রেঞ্চ কোট, আর চোখে কালো সানগ্লাস। সূর্যের আলো তার গায়ে যতটা পড়ছে, তার চেয়ে বেশি যেন সে চেষ্টা করছে নিজেকে সেটি থেকে বাঁচাতে। ক্যান্টিন থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের করিডোর—সবচেয়ে ছায়াময়, নির্জন কোণ গুলোতেই সে বেশিক্ষণ থাকে।
ছেলেরা অবাক হয়—কে এই ছায়ার মানুষ?
কিন্তু মেয়েরা?
তারা যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার দিকে।
তার উপস্থিতি যেন সময়কে কিছুক্ষণের জন্য স্থির করে দেয়। কেউ পেছন থেকে ফিসফিস করে বলে,

— “এই ছেলেটার চোখে কী যেন আছে না? ভয়ংকর সুন্দর!”
— “তার গলার স্বর শুনেছো? গভীর আর ঠান্ডা… কিন্তু কেমন যেন আগুনের মতো লাগে!”
সে যেন কোনও সাধারণ মানুষ নয়, বরং ভিন জগতের কেউ।
তার চুল কালো হলেও তাতে মাঝে মাঝে হালকা রুপালি ঝিলিক পড়ে, যেন রাতের অন্ধকারে বাজ পড়েছে।
চোখ দুটি গাঢ় বাদামি—তবে কোনও আলো পড়লে তাতে লালচে আভা জ্বলে ওঠে, অনেকটা গহীন আগুনের মত।
তার ত্বক উজ্জ্বল, কিন্তু খুব ঠান্ডা—তাকে ছুঁয়ে দিলে কেউ বলেই ফেলবে,
— “তোমার গায়ে কি বরফ? নাকি তুমি রক্তশূন্য?”
তার শরীর লম্বা, সুঠাম—কিন্তু চলাফেরা এত নরম আর নিঃশব্দ যে কখন যেন সে কারও পাশে এসে দাঁড়ায়, কেউ টেরই পায় না।
তাকে দেখে মনে হয়—সে সুন্দর, কিন্তু সেই সৌন্দর্য ধ্বংস ডেকে আনে। সে ভার্সিটিতে আসার পর থেকে মেয়েরা পাগল হয়ে আছে তার জন্য।
জ্যাইম দিনের বেলা ভার্সিটিতে ক্লাস করে ঠিকই, তবে সূর্যের আলো সে সহ্য করতে পারে না। তাই সবসময় ছাতা হাতে ক্যাম্পাসে আসে, যেন তার চারপাশে সব সময় একটা ছায়ার বলয় আছে।
আর ক্লাসে সে বসে জানালার ঠিক পাশে, যেখানে পর্দা ঝুলে থাকে, অথবা সেই করিডোরে, যেখানকার লাইট সবসময় আধা-আলো।
বন্ধুরা বলে,

— “এই ছেলে এতটা কম আলোয় থাকে কেন?”
— “ওর চোখে কি সমস্যা?”
কিন্তু কেউ তার কাছে কিছু বলতে সাহস পায় না।
জ্যাইম জানে সে এখানে এসেছে একটি মিশনে।
সে এসেছে মানুষের ভেতরের জগৎকে বোঝার জন্য। তাদের বিশ্বাসঘাতকতা, ভালোবাসা, ঘৃণা, করুণা—এসব আবেগের মুখোমুখি হতে।
সে মনে মনে বলে,

“তারা কি সত্যিই এত জঘন্য, যেমনটা দা বলে? নাকি তারা… কেবল ভাঙা? আমি জানবো… আমি বুঝব।”
এবং এই বোঝার পথেই তার কৌতুহল দূর হবে।
ভার্সিটির করিডোর তখন ফাঁকা। সবে ক্লাস শেষ হয়েছে। চারপাশে গুনগুন শব্দ, হাসাহাসি, কেউ কেউ সেলফি তুলছে, আবার কেউ ক্যান্টিনের দিকে ছুটছে।
কিন্তু করিডোরের এক কোণে, আধা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে ছাতা হাতে —জ্যাইম। যদিও ছাতাটা মেলে ধরা না তবুও তার এক হাতে ছাতাটা রেখে দিয়েছে।
তার চোখ ছায়ার দিকে—শান্ত, কিন্তু স্থির নয়।
ঠিক তখনই…

“এক্সকিউজ মি, এই ছায়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকলে কেউ ভাববে ভূত!”
কণ্ঠটা চটপটে, কৌতুক মিশ্রিত।
জ্যাইম চোখ ঘুরিয়ে তাকায়। তার সামনে দাঁড়িয়ে এক মেয়ে—গাঢ় নীল টপ, জিন্স, চোখে সানগ্লাসটা তোলার সময় মাথার চুলে ঠেসে রেখেছে। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর মুখ, ঠোঁটে বাঁকা হাসি।
ইয়ানা।
– “আমি… ভূত নই।” – জ্যাইম ঠাণ্ডা গলায় বলল।
ইয়ানা হেসে ফেলল।
– “চিন্তা করো না, আমি ভয় পাই না। আমি ইয়ানা। তুমি নিউ কমার, তাই না?”
– “হ্যাঁ। আমি… জ্যাইম।”
– “তোমার নামটাও বেশ মিস্টেরিয়াস। তোমার মতোই।
তবে তোমাকে দেখে তো মনে হচ্ছে না তুমি বাংলাদেশের নিশ্চয়ই অন্য দেশ থেকে এসেছো।
জ্যাইম উত্তর দেয় হ্যাঁ আমি ইরান থেকে এসেছি আমার অনেক কিছু নিয়ে রিসার্চ করার ছিল আর আমি তাই এখানে ভর্তি হয়েছি।আমাদের গ্রুপটা এমন যে একেক সময় একেক দেশে আমরা রিসার্চ এ যাই আর সেখানে কোন একটা ভার্সিটি তে ভর্তি হই।
ইয়ানা হেসে ফেলে এরপর বলে তুমি কি ভূতের রিসার্চ করো সব সময় অন্ধকারে থাকো মনে হয় তুমি ভূত নিয়ে কোন রিসার্জ করছো।
জ্যাইমের চোখে একটু অবাক ভাব। মানুষের কেউ এভাবে কথা বলে তাকে নিয়ে?

– “তুমি এতটা সহজে অপরিচিতদের সাথে কথা বলো সবসময়?” – জ্যাইম প্রশ্ন করে।
– “সবাইকে বলি না। শুধু যাদের চেহারা দেখে মনে হয় তারা আসলে অন্য গ্রহ থেকে এসেছে…” – শুধু তাদের সঙ্গে বলি, ইয়ানা চোখ টিপে বলে।
এই প্রথম জ্যাইমের ঠোঁটে হালকা হাসি দেখা যায়।
এরপর সে বলে তুমি অনেক ইন্টারেস্টিং একটা পারসন।
ইয়ানা বলে হুম সবাই এটাই বলে, তবে তুমি চাইলে আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি রিসার্জ এ।
জ্যাইম বলে আচ্ছা সাহায্য লাগলে জানাবো।
এরপর দুজনেই চলে যায় নিজেদের কাজে।
পারস্য রাজ্য,,
প্রাসাদের সিংহ কক্ষ।
চুপচাপ বসে আছে ওয়াজফান কায়াস্থ। সিংহাসনের পাশে রাখা আগুনজ্বলা টর্চগুলো ধীরে ধীরে জ্বলছে। ছায়াগুলো নাচছে তার মুখের চারপাশে। ঠোঁটের কোণে কোনো হাসি নেই, শুধু গভীর চিন্তার রেখা। ঠিক তখনই ছায়া থেকে বেরিয়ে আসে সেই পরিচিত মুখ—আয়রাক, ওয়াজফানের পার্সোনাল রক্ষী।
ওয়াজফান মাথা না ঘুরিয়েই বলে,

– “কোথায় আছে সে?”
আয়রাক কণ্ঠ নামিয়ে বলে,
– “বাদশাহ, প্রিন্স জ্যাইম এখন বাংলাদেশ নামক একটি দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছে। মানুষের জগতে… দিন কাটাচ্ছে। আমি তার গতিবিধি প্রতিদিন পর্যবেক্ষণ করছি।”
ওয়াজফান মুহূর্তেই স্থির হয়ে যায়। এক মুহূর্ত পর তার ঠোঁট সরে। গলায় চাপা রাগ ও বিরক্তি গর্জে ওঠে—
– “বাংলাদেশ?”
– “এত দেশ থাকতে… ওই ছোট্ট, ঘিঞ্জি, গরীব দেশের মাঝেই ওর মন পড়লো?”
– “আর আমি কী বলেছিলাম তাকে? বলেছিলাম মানুষের থেকে দূরে থাকতে, না? আমি তাকে কি সতর্ক করিনি?”
আয়রাক চুপ। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।
ওয়াজফান দাঁড়িয়ে উঠে ধীরে ধীরে সামনে হাঁটে। তার পেছনে আগুনের আলো তার ছায়াকে বিকট করে তোলে। চোখে অন্ধকার ঝলক।

– “সে কি জানে না মানুষ কী জিনিস?”
– “ওরা দুর্বল, কিন্তু ওদের ভেতর আছে বিষ। মানুষ নিজের স্বার্থে নিজের রক্ত সম্পর্ককেও ছেড়ে দিতে পারে। ওদের মধ্যে বিশ্বাস বলে কিছু নেই, কেবল মুখোশ আর মিথ্যা। আর যদি কখনো তারা জানতে পারে জ্যাইম একজন জিন, তবে ওকে ছিঁড়ে খেতে বেশি সময় লাগবে না।”
তার চোখে তখন একটা অদ্ভুত ভয় আর ক্রোধ একসাথে খেলে যায়।
– “তুমি নজর রাখো, আয়রাক, সে কোথায় যায়, কাদের সঙ্গে কথা বলে, কাকে ছুঁয়ে ফেলে! আমি চাই না সে কারও সঙ্গে জড়িয়ে পড়ুক। বিশেষ করে কোনও মেয়ে… মানুষ মেয়েরা একবার হৃদয়ে ঢুকে গেলে, তারা দুর্বলতা তৈরি করে। আমি চাই না আমার ভাইকে সে পথেই নামতে দেখাতে।”
আয়রাক মাথা নিচু করে বলে,

– “যেমন আপনি আদেশ করেছেন, বাদশাহ। আমি ছায়া মতে তার পিছনে বিশেষ কাউকে লাগিয়ে রেখেছি । প্রয়োজন হলে… হস্তক্ষেপও করবো।”
ওয়াজফান হঠাৎ থেমে যায়।
এক মুহূর্ত স্থির হয়ে বলে—
– “না… এখনই হস্তক্ষেপ নয়। এখন শুধু… নজর রাখো। ও যদি নিজের ভুলে আগুনে পুড়ে, তবে আমি তার ছায়া হবো। কিন্তু… আগুন আমি নিজে জ্বালাব না… এখনো না।”
তার চোখে আবার সেই পুরনো শূন্যতা ফিরে আসে। ভাইয়ের প্রতি এক অদৃশ্য ভালোবাসা… যেটা সে মুখে বলে না, কিন্তু আগুনের ছায়ায় ঢেকে রাখে।

সারাদিনের হাঁটা আর কথা বলা শেষে আজ যেন একটা অন্যরকম শান্তি নেমে এসেছে মধুপুরের আকাশে।
সূর্য পশ্চিম দিগন্তে হেলে পড়েছে অনেক আগেই।
চারপাশে শীতের ধোঁয়াটে আলো, পাতার ফাঁকে ফাঁকে সূর্যের শেষ কিরণ মিশে গেছে গা ছমছমে জঙ্গলের ছায়ায়।
অর্ষা ও ক্যালিয়ন ধীরে ধীরে হাঁটছে গ্রামের দিকে।
শীতটা একটু বেশিই পড়েছে আজ।
গ্রাম্য পাহাড়ি অঞ্চল বলে সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই ঠান্ডা কনকনে হয়ে উঠেছে।
অর্ষা নিজের দুই হাত ঠাণ্ডায় ঘষে ঘষে গরম করার চেষ্টা করে।
ক্যালিয়নের চোখ সেখানেই।
সে কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ থাকে।

তার চোখে ছিল এক অদ্ভুত কোমলতা—যা তার বুনো, আগুনের মত চোখের বিপরীত।
সে হঠাৎ নিজের গায়ে পড়া কোটটা খুলে অর্ষার কাঁধে রাখে।
অর্ষা অবাক হয়ে পেছনে তাকায়।
“না না, এটা লাগবে না। আমি ঠিক আছি,”
বলতে চায় অর্ষা।
কিন্তু ক্যালিয়ন চোখে সরলতা রেখে, গলায় মৃদু দৃঢ়তা এনে বলে—
“তুমি সারাদিন আমার গাইড হয়ে এত কিছু দেখালে,
আর আমি যদি তোমার একটু সাহায্যও না করতে পারি,
তবে কীসের বন্ধুত্ব আমাদের?”
“একদিনেই তো অনেক কিছু ভাগ করে নিয়েছি।
এইটুকু তো পরিমাণ… বন্ধুত্ব হয়েছে, তাই না?”
অর্ষার মুখে এক টুকরো মুচকি হাসি।
সে মাথা নিচু করে কোটটা ভালোভাবে গায়ে জড়িয়ে নেয়।
শীত হঠাৎ আর লাগছিল না—হয়তো কোটটার ওমে না,
কিংবা কারও স্পর্শে।

অর্ষা তাকায় সোনালী আলোর দিকে।
“আচ্ছা, এবার আমাদের ফেরা উচিত। সন্ধ্যা হয়ে গেছে।
গ্রামে রাত নামলে চলাফেরা একটু কঠিন হয়।”
ক্যালিয়ন মাথা নাড়ে।
“ঠিক বলেছ। কাল আবার দেখা হবে?”
অবশ্যই,” — বলে অর্ষা হেসে বিদায় নেয়।
সে ধীরে ধীরে দূরে হেঁটে যায়।
তার চুলগুলো ঠাণ্ডা বাতাসে উড়ছে, আর পায়ের নিচে শুকনো পাতার খসখস শব্দ।
কিন্তু পিছনে থাকা ক্যালিয়নের চোখ—
তা স্থির, গভীর, আগুনে ঝলসানো।
সে দাঁড়িয়ে থাকে অনেকক্ষণ।
তার ঠোঁটে এক নিঃশব্দ বাক্য ফুটে ওঠে—

“তুমি জানো না, অর্ষা…
আমি তোমার জন্য কত বছর ধরে অপেক্ষা করেছি।
তোমাকে তোমার জগৎ থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার জন্যই আমি এসেছি।
এবার তোমাকে নিয়ে আমি যাব…
যেখানে মানুষ যায় না।”
তবে আমি তোমাকে সেখানে খুব যত্ন করে রাখবো।
তার চোখের নীল বৃত্তজুড়ে ধীরে ধীরে এক গা ছমছমে রক্তরঙ ছায়া ভেসে ওঠে।
সেই মুহূর্তে জঙ্গলের গহীন থেকে ভেসে আসে এক ভয়াবহ হাঁকডাক…
যা মানুষের নয়, পশুরও নয়—
কোনো অজানা রক্তমাংসের সত্তার।
আকাশে ভেসে ওঠে পূর্ণ চাঁদের মলিন ছায়া।
রাত নেমেছে মধুপুরগড়ে।

জঙ্গলের ফাঁকফোকর দিয়ে শীতল বাতাস হু হু করে বইছে।
মাঠ-ঘাট নিস্তব্ধ। দূর থেকে ভেসে আসছে ঝিঁঝিঁ পোকাদের একঘেয়ে আওয়াজ,
যেন রাতকে আরো গা ছমছমে করে তুলছে।
অর্ষা নিজের রুমে বিছানায় চুপচাপ শুয়ে আছে।
ঘরের জানালা দিয়ে চাঁদের আলো হালকা সাদা রেখা এঁকে দিয়েছে তার কপালের ওপর।
বিছানার এক পাশে রাখা ক্যালিয়নের দেওয়া কোটটা।
হঠাৎই অর্ষার দৃষ্টি পড়ে যায় সেই কোটের দিকে।
সে একটু উঠে বসে, হাত বাড়িয়ে নিয়ে কোটটা নিজের কোলে রাখে।
কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ।
তার নাকের কাছে আসে এক পরিচিত কিন্তু গভীর গন্ধ—
আর্দ্র জঙ্গল, কফি, আর পুরুষালী কাঠের গন্ধ মিশে এক অদ্ভুত আকর্ষণ।
সে ধীরে ধীরে বলে ফেলে—

লোকটা অদ্ভুত… অনেক বেশি অদ্ভুত।
তবু আজ যেভাবে কেয়ার করছিল… যেন কতদিনের চেনা কেউ।
আমি কষ্ট পাচ্ছি সেটা বুঝে গিয়েছিল।”
অর্ষার ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি খেলে যায়।
কিন্তু সেটা ছিল ভেতরের দোলাচলের ছায়া।
তার চোখে তখন ক্যালিয়নের সেই নীল চোখদুটি ভেসে উঠছে।
যে চোখ দুটো সারাদিন কোনো শব্দ ছাড়াই তার ভিতরের অস্থিরতাকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
সে আবার বিছানায় শুয়ে পড়ে, কোটটা বুকে জড়িয়ে।
চোখ বন্ধ করার আগে সে নিঃশব্দে ফিসফিস করে
“তুমি কে, ক্যালিয়ন? এত অচেনা হয়েও এত আপন কেন মনে হয়?”
চোখ বন্ধ করতেই অর্ষা আর বুঝতে পারে না—
তার বালিশের পাশে বাতাস হঠাৎ হিম হয়ে উঠেছে।
জানালার পর্দা ধীরে ধীরে নড়ে উঠেছে…
আর কেউ যেন একটানা তাকিয়ে আছে ঘরের ভেতর,
অন্ধকার থেকে।

সন্ধ্যার নরম আলো ক্যাম্পাসের গাছপালার ফাঁক দিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। করিডোরের এক কোণায় দাঁড়িয়ে জ্যাইম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সামনের লনে—যেখানে ইয়ানা কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে বসে হাসছে।
কিন্তু তার দৃষ্টি গভীর, যেন সে ইয়ানার চোখের ভাষা পড়তে চাইছে।
মনেই বলে সে…
“মানুষদের সম্পর্কে সত্য জানতে হলে… একজন মানুষের অন্তরেও ঢুকতে হবে। আর ইয়ানা নিজেই তো সাহায্যের কথা বলেছে। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব… মানে এক দরজা খুলে যাওয়া।”
ঠিক তখন ইয়ানা তার দিকেই তাকায়। চোখে প্রশ্ন। তারপর একা একা উঠে এসে জ্যাইমের পাশে দাঁড়ায়।
– “এই দৃষ্টিটা অনেকক্ষণ ধরে বুঝতে চেষ্টা করছি… তুমি এত গম্ভীর কেন?”
– “চেষ্টা করছি… বুঝতে।”
– “কাকে?”
– “তোমাদের।” – জ্যাইম ধীরে বলে।
ইয়ানা হেসে ফেলে।

– “তাহলে তো তুমি ভালো জায়গায় এসেছো। আমি নিজেই পুরো জাতির সবচেয়ে কনফিউজড প্রতিনিধি!”
দু’জনেই হেসে ফেলে একটু, যদিও জ্যাইমের হাসিটা ছোট। কিন্তু সেটা আসল, মন থেকে।
– “আমি চাই… তুমি আমাকে সাহায্য করো। তোমরা কেমন, তোমরা কী ভাবো, কাকে বিশ্বাস করো, কী ভালোবাসো… এই সব জানতে চাই।”
ইয়া না বলে আমরা বলতে কি বলতে চাইছো তুমি কি আমাদের বাইরের কেউ।
জ্যাইম বলে না মানে আমি বাংলাদেশের মানুষদের কথা বলছিলাম আমার প্রজেক্ট এর সাহায্য চাইছিলাম মানে বাংলাদেশের মানুষ কেমন সেটা জানতে চেয়েছিলাম।
ওও আচ্ছা সেটা বলো —ইয়ানা বলে।

– “সিরিয়াসলি বলছি।” – জ্যাইম এবার চোখে চোখ রেখে বলে আমায় সাহায্য করবে।
– “আচ্ছা… আমি রাজি। তবে একটা শর্ত আছে।”
– “কি শর্ত?”
– “তুমি আমার বন্ধু হতে হবে। শুধু অবজারভার হয়ে দূর থেকে নয়—আমার সাথে হাঁটতে হবে, কথা বলতে হবে, আমাকে জানাতে হবে তোমার অনুভূতি।”
জ্যাইম একটু চুপ করে, তারপর মাথা হেঁট করে বলে,
– “চেষ্টা করবো… যদিও আমার অনুভূতি খুব স্পষ্ট না।”
– “তাই নাকি?” – ইয়ানা চোখ টিপে বলে – “দেখো, একদিন না একদিন, এই বরফ গলা পানি হবেই।”
এরপর কিছুদিন…
ইয়ানা জ্যাইমকে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচয় করায়।
মাঝে মাঝে ক্যাফেতে বসে তাকে বাঙালির আচরণ, সম্পর্ক আর বন্ধুত্বের গল্প শোনায়।
জ্যাইম কম কথা বলে, কিন্তু গভীরভাবে শুনে। মাঝে মাঝে এমন প্রশ্ন করে, যেটা শুনে ইয়ানা থমকে যায়।
একবার জ্যাইম বলে,

– “তোমরা কি কাউকে ভালোবাসার পরেও তাকে আঘাত করতে পারো?”
– “ভালোবাসলে কেন করবো?
আর আমার মনে হয় না কোন দেশেই মানুষ ভালোবাসার মানুষকে আঘাত করে।
মাঝে মাঝে তুমি এমন কথা বলো যেন মনে হয় তুমি মানুষ না অন্য কোন প্রাণী।
জ্যাইম বলে না মানে অনেক মানুষ আছে যারা মানুষ হয়েও অন্য মানুষকে আঘাত করে নির্মমভাবে তাই আর কি আমি কথাটা বললাম।

Death or Alive part 3

– “সব মানুষ এক রকম না, জ্যাইম।” – ইয়ানা নিচু গলায় বলে – “কখনো কখনো কেউ ভালোবাসার জন্যই নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়।”
জ্যাইম চুপ করে থাকে, যেন কিছু খুঁজছে ওই কথার গভীরে।

Death or Alive part 5

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here