প্রেমের নীলকাব্য পর্ব ১
নওরিন কবির তিশা
অদূরের হিমেল বাতাসে যেন শীতের রুক্ষতা মেশে আছে। কুয়াশার ঘনঘোর তখনো কাটেনি।সকালের নরম রোদ্দুর খানিকটা আলস্যে ছড়িয়ে আছে প্রশস্ত সাদা কংক্রিটের পথের দুপাশে। হঠাৎই শব্দের ঝংকার তুলে খোলা হলো প্রধান গেটের সুবৃহৎ লৌহদণ্ড।মৃদু শব্দ করে এগিয়ে যাচ্ছে Rolls-Royce Phantom মডেলের গাড়িটির চাকা।
চারিধারে অশ্বত্থ, কৃষ্ণচূড়া শিউলিসহ নাম না জানা বহু বৃক্ষে সজ্জিত প্রশস্ত সাদা কংক্রিটের রাস্তা বেয়ে গাড়িটি এগিয়ে চলল ভেতরের দিকে। মুহূর্ত কয়েকের মাঝে সেটি এসে থামল সাদা মার্বেলের গম্বুজ আর নীলচে কাঁচের জানালায় সজ্জিত বিশালাকার প্রাসাদসম বাড়িটির সামনে।
গাড়ির দরজা খুলে ধীরে ধীরে নেমে এলো এই বাড়ির অর্থাৎ খান মহলের মধ্যমণি,এমপি ওয়ালিদ খানের একমাত্র পুত্র ওয়াহাজ খান নীল। এলাকার জনপ্রিয় নেতাসাহেব নীল খান। তার পরনে শুভ্র রঙা পাঞ্জাবি,যার ওপরে জড়ানো একখানা শ্বেত শুভ্র শাল,শালটির নিচে দৃশ্যমান সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারির কারচুপি।
তার মুখাবয়বে যেন এক শান্ত অথচ দৃঢ় প্রতিচ্ছবি,স্বচ্ছ নীলরঙা তার চোখের মণি,তীক্ষ্ণ জ-লাইনের অধিকারী পুরুষটির,সার্বক্ষণিক বিদ্যমান কপালের সূক্ষ্ম ভাঁজগুলো যেন তার আভিজাত্যকে দ্বিগুণ করে তোলে।
আজ প্রায় তিন দিন বাদে খান মহলে প্রবেশ করলো সে। গ্রামীন সম্পত্তির এক সমস্যা নিষ্পত্তির কাজে প্রায় দিন তিনেক শহরের বাইরে ছিল সে।নীল গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে আসলো প্রায় জন চারেক মেড।সে তাদের মধ্যে থাকা বৃদ্ধ করে একজনকে সালাম দিয়ে;প্রবেশ করল অন্দরমহলে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
নীলের রুমটা অতি যত্নে গোছাচ্ছে তারই ছোট ফুফুর একমাত্র মেয়ে নাম সানজিদা আফরা মুন্নি। নীলের রুমটা আকারে এই বাড়ির সবচেয়ে বড়।এ বাড়ির অন্যান্য রুম গুলোর থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন,একেবারে অত্যাধুনিক ধাঁচের সেই রুমটাতে প্রবেশের পূর্বে প্রথমেই অতিক্রম করতে হয় একটা বৃহৎ গলিপথ,যার চারিধার টা সাজানো বিভিন্ন নামিদামি লেখকের বইয়ে, অতঃপর রুমে ঢুকতেই চোখে পড়ে বিশাল কিং সাইজ বেড, বিলাসবহুল ড্রেসিং টেবিলের বৃহৎ আয়না,আর রুমের মাঝে থাকা সুবৃহৎ কাউচ।
তবে তার রুমের সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দন জায়গাটা হচ্ছে,তার দক্ষিণ পাশের সুবৃহৎ সুইমিং পুলটা। যেটা সজ্জিত নানা সবুজ লতাগুল্ম আর বিদেশি ফুলের টবে। বিশাল রুমটা একা হাতে গোছাতে গোছাতে একপ্রকার ক্লান্ত হয়ে পড়ল মুন্নি।তবুও তার মুখে মুচকি হাসির রেখা বিদ্যমান, কেননা এটা তার শখের পুরুষের কক্ষ। হ্যাঁ, নীলই তার শখের পুরুষ। কিন্তু সে কথা কি নীল জানে? হয়তো না..!
নীলের কথা মনে পড়তেই ফের আরেকবার আনমনে মুচকি হাসলো মুন্নি। বেড সাইড টেবিল থেকে নীলের একটা ফ্রেম বাঁধানো ছবি হাতে নিয়ে আদুরের স্পর্শে হাত বুলালো তাতে। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিছন থেকে কেউ একজন উৎফুল্ল কণ্ঠে বলে উঠলো,,
——“মুন্নু আপু, তুমি এইখানে? নিচে তো ভাইয়া আসছে!”
ভেসে আসা সেই কণ্ঠস্বরে চমকে পিছনে তাকালে মুন্নি। বুকের ভেতর চলমান হৃদপিণ্ডের অস্থির নিত্য শান্ত করতে পরপর দুইবার বুকে থাপ্পর দিল সে। পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে নীলের একমাত্র ছোট বোন ওয়াসফিয়া খান নাহা।নাহার এমন হঠাৎ ডাকে;তাকে ধমকাতে গেলেও তার বলা শেষ কথাটায় থমকালো মুন্নি। চিকচিক করে উঠলো তার আঁখি জোড়া। প্রফুল্ল কন্ঠে সে বলল,,
——“নীল ভাইয়া আসছে?”
নাহা:“হুম!”
আরেক মুহূর্ত দাঁড়ালো না মুন্নি,খুশিতে আত্মহারা হয়ে ছুটে বের হয়ে গেল রুম থেকে। মুচকি হেসে তার পিছন পিছন ছুটলো নাহা নিজেও।
খান মহলের সুবিশাল ড্রয়িংরুম আজ পূর্ণ খান মহলের লোকজনে।কারন একটাই,সবাইকে ডেকেছেন বাড়ির কর্তা ওয়ালিদ খান নিজেই।আজ বড্ড খুশি তিনি,সুগার প্রবলেমের জন্য যেখানে বাড়িতে মিষ্টির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন,সেখানে আজ নিজেই সবাইকে মিষ্টি বিলি করছেন তিনি।
তার পুত্র যেন বিশ্ব জয় করে ফেরেছে। অবশ্য সেটা বিশ্ব জয়ের থেকে কম কিছু নয় তার জন্য।যে জমির অংশীদারিত্ব নিয়ে দীর্ঘকালীন ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে তাকে সেই জমির সকল সমস্যার নিষ্পত্তি মাত্র দুই দিনে সম্পন্ন করতে পেরেছে তার একমাত্র পুত্র;খান বাড়ির সিংহ।ওয়াহাজ খান নীল।
সেই সুবাদেই এখানে সকলে।আসুন….সবার সাথে একটু পরিচয় পর্ব সারা যাক।
খান মহলের কর্তা বড় ওয়ালিদ খান, এলাকার জনপ্রিয় এমপি সঙ্গে একজন স্বনামধন্য ব্যাবসায়ী, এবং বড় কর্তী মির্জা সূচনা,তাদের দুই ছেলে মেয়ে, ওয়াহাজ খান নীল আর ওয়াসফিয়া খান নাহা।
ছোট কর্তা ওয়ালিজ্জামান খান,ভাইয়ের ব্যাবসার নিবিড় সঙ্গী,তার সহধর্মিণী মির্জা সায়মা,তাদেরও দুই ছেলে মেয়ে ওয়াহিদ খান নিহিত,আর মেয়ে ওয়ারিশা খান নিরা।খান বংশের বড় মেয়ে অর্থাৎ ওয়ালিদ খানের ছোট তবে বাড়ির সবার বড় বোন রৌশানারা খান,তার দুই ছেলেমেয়ে মাহমুদুল হক রাওফিন আর মেয়ে রাওফিয়া হক রাফা।আর ছোট বোন রুমিন আরার এক মেয়ে সানজিদা আফরা মুন্নি।
সবাইকে একে একে নিজ হাতে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন ওয়ালিদ খান। সবাই নিচে থাকলেও দুই তলার ঝুল বারান্দা দিয়ে নিচে নীলের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মুন্নি। অপেক্ষা কখন নীল একটিবার তার দিকে তাকাবে।
🎶যাও বলো তারে মেঘের ওপারে…
বৃষ্টি বন্দনা জুড়ে ধরণী তল…..🎶
🎶যাও বলো তারে শ্রাবণ আষাঢ়ে…
মেঘের শত জলে ছুঁয়েছে ভেজা জল….🎶
🎶মাতাল হওয়ার ধ্বনি বৃষ্টি কি শোনে না….
ময়ূর পেখম তোলে ধিন তানা ধেরে না…..🎶
শীতকালীন এমন অসময়ের বর্ষার বারিধারায় সিক্ত হচ্ছে চারিপাশ। শীতের শুষ্ক বাতাসে গাছের বর্ণহীন পাতাগুলো বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলবিন্দুরা।এরই মাঝে এমন সময়ের বৃষ্টি উপভোগ করছে,সদ্য ঢাকায় আগত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের প্রথম বর্ষের দুই অন্তরঙ্গ নিবিড় সঙ্গিনী নুরাইন হক তিহু,আর তাসফিয়া মাহা। একের পর এক কলি মিলিয়ে গান গেয়ে চলেছে তারা।
হঠাৎ তিহুর ফোন ভেজে উঠতেই ধ্যান ভাঙল তাদের। দ্রুত থেকে সরে গিয়ে একটা ছাউনির নিচে আশ্রয় নিয়ে ফোনটা ধরলো সে। সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে ভেসে আসলো একটা নারী কন্ঠ,,
——“আজকে কিন্তু ঢাকায় প্রচুর বৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা আছে তিহু, বৃষ্টিটা কিন্তু একদমই ভিজবি না! পরে সমস্যা হলে ওখানে তো আমি নেই কে সামলাবে তোকে?”
তিহু কণ্ঠস্বর শুনে চিনে ফেলল এটা তার মায়ের কন্ঠ। কৌতুক ভরা কন্ঠে সে বলে উঠলো,,
——“নো টেনশন ডু ফুর্তি আম্মু,আমার মাহু আছে না!”
——“ওইটাই তো আমার ভরসা!”
তিহু হেসে মাহার দিকে ফিরে মনে মনে বললো,,‘তোমার ভরসা কে নিয়ে একসাথেই বৃষ্টিতে ভিজছি আমি আম্মু!’অতঃপর মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,,
——“আচ্ছা আম্মু রাখো কালকে কোচিংয়ে একটা এক্সাম আছে পড়তে বসছিলাম!”
ঐপাশ ভেসে আসলো আসালো তিহুর মায়ের রাশভারীকন্ঠ,,
——“আচ্ছা পড়, তবে মনে থাকে যেন বৃষ্টিতে একদমই ভিজবি না!”
তিহু:“আচ্ছা!”
কলটা কেটে দিলো সে। মাহা তার দিকে এগিয়ে এসে বলল,,,
——“কে কল করেছিল রে?”
তিহু:“আমার যেহেতু বর বা বয়ফ্রেন্ড কেউ নেই, সেহেতু এই সময় আমাকে আমার মাদার ইন্ডিয়াই কল করেছিল!”
মাহা নাক শিটকিয়ে বলল,,
——“সোজা কথায় উত্তর দিতে পারিস না?”
তিহু:“ল নিয়ে পড়তেছি মামু, একটু তো ঘুরায় কথা বলতেই হবে!”
মাহা চোখ মুখ বিশ্রী ভাবে শিটকিয়ে বলল,,
——“ আই উইশ তুই কোনো একদিন ভালো হবি!”
তিহু:“তাহলে উইশটা পকেটে পুরে রাখ কেননা আমি কোনোদিন ভালো হবো না!”
হাতে থাকা গ্লাসটাতে ফলের রস নিয়ে গুটি গুটি পায়ে নীলের রুমে প্রবেশ করল মুন্নি। হাতে বিদ্যমান কাঁচের গ্লাসটা ঠকঠিয়ে কাঁপছে তার। সেটা কি শীতে তীব্রতায় নাকি নিজের মধ্যেকার ভীতচেতার দরুন, জানা নেই মুন্নির।তবে কেবল এটুকুই জানা,নীলের রুমের সামনে আসলেই হৃদস্পন্দনের এক অদ্ভুত রকম দ্বিগুণ সঞ্চালন অনুভূত হয় তার।
রুমে ঢুকেই মুন্নি দেখতে পায় কোথাও নেই নীল।তবে সে বেশ ভালো করেই জানে নীল কোথায়?জুসের গ্লাসটা বেড সাইড টেবিলে রেখে গ্লাস কভার দিয়ে সেটাকে ভালো করে ঢেকে, অতঃপর পা বাড়ালো নীলের রুমের পুবের দিকের বিশাল ব্যালকনিটার উদ্দেশ্যে।
এদিকে……………..
কক্ষে ঠিক পুব প্রান্ত যেখান থেকে প্রতিদিন সকালে দৃশ্যমান হয় সূর্যোদয়ের রক্তিম আভা। ছাদ খোলা সেই বিশাল ব্যালকেনিটার একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে ওয়াহাজ খান নীল। নিয়মিত জিমের দরুন ফুলে ওঠা পেশীবহুল শৈল্পিক দেহ তার আবৃত অফ হোয়াইট কালার শর্ট পাঞ্জাবিতে।
হাতে ধরে রাখা সিগারের ধোঁয়াগুলো মিলিয়ে যাচ্ছে ঘন কুয়াশার অন্তরালে। মুন্নি বিমোহিত দৃষ্টিতে চেয়ে থাকল তার পানে। এই পুরুষটার প্রত্যেকটা কার্যক্রমেই হৃদয় আনচান করে ওঠে তার। তাইতো সিগারের ধোঁয়া সহ্য করতে না পারলেও, প্রতিদিনই সে মুখে ওড়না চাপা দিয়ে এভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে নিজের প্রিয় পুরুষটাকে..
