ডার্কসাইড গল্পের লিংক || জাবিন ফোরকান

ডার্কসাইড পর্ব ১
জাবিন ফোরকান

এক….দুই….তিন…চার….
খুবলে খুবলে উঠে আসছে দে*হাংশ।
পাঁচ….ছয়….সাত….আট….
ধমনী ফুঁ*ড়ে ছিটকে উঠছে উষ্ম র*ক্ত।
নয়….দশ….এগারো….বারো….
ছি*ন্ন বিচ্ছি*ন্ন হয়ে যাচ্ছে সম্পূর্ণ বুক।
তেরো….চৌদ্দ….পনেরো….ষোলো….
আর্তনাদ, র*ক্তস্রোত, বিভীষিকা, নৃশং*সতা।
সতেরো….আঠারো….উনিশ….. নাহ্!

আর গোণা সম্ভবপর হলোনা রোযার পক্ষে। ঠাস করে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে টাইলস বিছানো মেঝেতে ধপাস করে বসে পড়লো সে। বাইরের কক্ষ থেকে এখনো মানবদেহে চালনা করা ছু*রিকাঘা*তের শব্দ ভেসে আসছে,তার সঙ্গে চাপা গোঙানি।তৎক্ষণাৎ কানে হাতচাপা দিলো রোযা। শুনতে চায়না সে, আর নয়!
এবার একটু রেহাই দাও খোদা! এই কি কেয়ামত?

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

বক্ষপিঞ্জরের মাঝে অবস্থানরত দূর্বার হৃদযন্ত্র তার অদৃশ্যমান তেজস্বী অশ্বের সঙ্গে যেন দৌড়পাল্লায় নেমেছে। সম্পূর্ণ শরীরে বয়ে চলেছে ভূমিকম্প। আতঙ্কের শীতল ঘামে পরিধানের কামিজ শরীরের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্টে লেপ্টে গিয়েছে। বি*স্ফা*রিত নয়নজোড়ায় ভাসছে সাক্ষাৎ ন*রকদৃশ্য। নাহ, হয়ত নরকের শা*স্তিও এর তুলনায় নগণ্য! সহসাই পেটের মাঝে একটা মোচড় অনুভব করলো রোযা।তারপরই তার শরীর গুলিয়ে উঠলো। এক ছুটে সে পৌঁছলো বেসিনের কাছে, পাকস্থলী উ*গড়ে বেরিয়ে এলো সবকিছু। শারীরিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গিয়েছে বিভৎস সেই দৃশ্য চাক্ষুষ অবলোকন করায়।

সর্বশেষ খাদ্যকণাটিও শরীর পরিত্যাগ করার পর দাঁড়িয়ে থাকার সমস্ত শক্তি হারিয়ে রোযা বেসিনের পাশের দেয়াল ঘেঁষেই বসে পড়ল। একটুর জন্য তার মাথাটা বেসিনের কোণায় ঠুকে আঘা*ত পাওয়া হতে রক্ষা পেলো। কিন্তু নিজেকে নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তার অবকাশ সে পাচ্ছে না। কোনোক্রমেই ভুলতে পারছেনা মানুষের উপর মানুষের এক তীব্র আক্রোশের প্রতিফলন। আসলেই সে মানুষ তো? খাঁচা থেকে মুক্ত হওয়া কোনো হিংস্র জা*নো*য়ার নয়?
মস্তিষ্কের সকলপ্রকার চিন্তা লোপ পেয়েছে রোযার। মৃ*ত্যুআতঙ্কও এতটা তীব্র হয় কিনা সন্দেহ যতটা তীব্র আতঙ্ক সে এই মুহূর্তে অনুভব করছে। কোনোভাবেই স্বাভাবিক চিন্তা করা সম্ভব হচ্ছেনা। হবেই বা কি করে?এই বাথরুমের দরজার ওপাশেই যে কেয়ামত! আজকে প্রথমবারের মতন নিজের সম্মান বিক্রির মতন কদর্য কাজ করতে এসে যে এমন কোনো বিভীষিকার মুখোমুখি হতে হবে তা কি আদও কল্পনা করতে পেরেছিল রোযা?কোনোদিন না, আজকের সন্ধ্যা অবধিও নয়!

খুব প্রয়োজন ছিল টাকা নামক সুখপাখিটির। জগতের প্রত্যেক সফলতার দুয়ার যখন রোযার সামনে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, দেয়ালে এসে ঠেকেছিল তার পিঠ; ঠিক তখনি এক সকালে আয়নার সামনে দন্ডায়মান অবস্থায় নিজের লাস্যময়ী শরীরের দিকে চোখ যায় তার। আহামরি সুন্দরী নয় সে, নয় একেবারে চোখ ফিরিয়ে নেয়ার মতন কিম্ভুতকিমাকার। তার পক্ষেও হয়ত সম্ভব? নারীর শরীরে ভোলেনা এমন পুরুষ এই জগতে দূর্লভ।
সর্বপ্রথম আজকের দিনে এই বনিবনাটি হওয়া। ক্রেতার ফোনকলে সন্ধ্যার পরপরই এই রিসোর্টের ব্যক্তিগত কটেজে উপস্থিত হয় রোযা। উত্তেজক পানীয়ে মত্ত হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে রোযার উপর অমানবিক পশুর ন্যায় ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিল ক্রেতা। তার নয়ন উপচে প্রবাহিত হওয়া বিষাদ অশ্রুঝর্ণাকে উপেক্ষা করে ঠিক যেই মুহূর্তে কামিজের ওড়না ছুঁড়ে দূরে ফেলে দিয়েছিল লালায়িত পুরুষটি, ঠিক সেই মুহূর্তেই কটেজের দরজায় কড়াঘাত। একটি সুযোগ লাভ করে বাথরুমে যাওয়ার বাহানায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েছিল রোযা, অপরদিকে বিরস মুখে দরজা খুলে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ আরম্ভ করেছিল ক্রেতা।

রুম সার্ভিস এসেছিল। সাদা শার্ট এবং কালো ক্রপ স্যুট পরিহিত অবস্থায়। গলা থেকে চেহারার নাক পর্যন্ত আবৃত কালো মাস্কে। কোন রুম সার্ভিস স্টাফ এমন মাস্ক ব্যবহার করে?প্রশ্নটি নিজ হৃদয়ে উত্থাপিত হলেও বাথরুমে ঢুকে পড়ায় বিষয়টি এক প্রকার উপেক্ষার সিদ্ধান্তই নেয় রোযা। এরপর….একটি চাপা গোঙানির শব্দে বিচলিত হয়ে দরজা খোলার সাথে সাথে…..
জাহান্নাম!
খুট করে একটি শব্দে নিজের অশুভ ভাবনার জগৎ থেকে পুনরায় বাস্তবে পদার্পণ করতে বাধ্য হলো রোযা। তার নয়ন মুহূর্তেই সিক্ত হয়ে উঠল।নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বাঁধভাঙা বন্যার পানির ন্যায় বইতে আরম্ভ করলো অশ্রু। বাইরে থেকে আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছেনা কিন্তু….

বাথরুমের দরজার লকে খটখট করে মৃদু ধ্বনি উঠতেই কেঁপে উঠল রোযা।সম্পূর্ণ গুটিয়ে ফেলল নিজেকে।তার ব্যাতিব্যাস্ত দৃষ্টি সম্পূর্ণ বাথরুম ঘুরে এলো।কোথাও কোনপ্রকার আত্মরক্ষার সরঞ্জাম নেই।এই কি তাহলে রোযার জীবনের অন্তিম মুহূর্ত? এভাবে অনর্থক এক মৃ*ত্যু ঘটবে তার? হিংস্র জানো*য়ারটা তার উপরেও ঝাঁপিয়ে পড়বে? কিন্তু তার কি দোষ? অসহায়ত্বের সামনে আত্মসমর্পণ করাটা?
বাথরুমের কাচের তৈরী লক সিস্টেমের দরজাটি খুলে গেলো হঠাৎই। নিজের জায়গায় বরফখন্ডে পরিণত হলো রোযা। রীতিমত নিঃশ্বাস রুদ্ধ করে তাকিয়ে থাকলো দরজার ফাঁক হওয়া প্রান্তের দিকে। ধীরে ধীরে ভিতরে প্রবেশ করলো দানবটি।

সাদা শার্ট চেনার কোনো উপায় নেই।সম্পূর্ণ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে। পায়ের চেলসি বুটের উপরের ফরমাল প্যান্টের প্রান্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে র*ক্তবিন্দু।তাতে বাথরুমের সাদা টাইলস মুহূর্তেই সিক্ত হয়ে উঠছে রক্তিম প্রবাহে। শরীরের এমন কোনো অংশ অবশিষ্ট নেই যা র*ক্তের ছোঁয়া পায়নি। রোযার দৃষ্টি তার লম্বাটে পা থেকে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এলো। মুখমন্ডল এখনো আবৃত, মাথাটি নিম্নে ঝুলে রয়েছে খানিক ক্লান্ত ভঙ্গিতে।ঘামে ভেজা চকচকে কালো চুল কপালের চারিপাশে লেপ্টে রয়েছে, কিছু আবার মুক্তভাবে দুলছে।
একটি ঢোক রোযার কন্ঠ থেকে পাকস্থলীতে নেমে গেলো দানবের হাতের র*ক্তা*ক্ত ছু*রি*টি লক্ষ্য করে।এই অস্ত্রটি দিয়েই মাত্র কয়েক মিনিটে আগে…..

ভাবতে পারলোনা রোযা।শিহরিত হয়ে উঠলো।দ্বিতীয় দফায় গা গুলিয়ে উঠলো তার।মুখে হাতচাপা দিয়ে নিজেকে নিয়ন্ত্রণের অবিরাম প্রচেষ্টা চালালো সে।এই মুহূর্তে নড়াচড়া করা এবং ক*বরে পা রাখা সমান! অবশ্য এই মুহূর্তে সে চোরাবালিতে পড়ে গিয়েছে।যতই চেষ্টা করবে ততই আরো গভীরে পতিত হবে।
বাথরুমের মেঝেতে র*ক্তা*ক্ত ছাপ ফেলে অগ্রসর হলো দানবটি।তার ভারী পদক্ষেপের শব্দ আবদ্ধ দেয়ালের মাঝে প্রতিধ্বনিত হলো বারংবার। ক্রমেই সংকুচিত হতে থাকলো রোযা। তার মৃ*ত্যুদূত তার নিকট এগিয়ে আসছে! হাজার চেষ্টা সত্ত্বেও চোখ ঠিকরে অশ্রু নির্গত হচ্ছে, কন্ঠ চি*রে বেরিয়ে আসতে চাইছে আর্তচিৎকার।কিন্তু কিছুই সম্ভবপর হচ্ছেনা। সামনের অশরীরী দৃশ্য রোযাকে নিয়ন্ত্রণহীন করে তুলেছে।

– দ… দয়া করে…আমাকে খু*ন করবেন না!
কোন অলৌকিক শক্তির জোরে ভিক্ষাবাক্যটি রোযার কন্ঠ থেকে নির্গত হলো তা রোযা নিজেও অনুধাবন করলোনা।তবে তার কণ্ঠস্বরে কোনপ্রকার প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করলোনা দানব।যথারীতি নিজের অশুভ প্রভাব ছড়িয়ে সে এগোচ্ছে, এক পা….আরো এক পা। তার কাছে করজোড়ে মিনতি করেও কি লাভ আছে?
উনিশবার….! রোযা দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়ার পর না জানে আর কতবার সে পাশ*বিকতা প্রদর্শন করেছে! একটি মানুষের মস্তিষ্ক কতটা বিকৃত হলে এবং তার মনুষ্যত্বের কতটা অধঃপতন ঘটলে সে এমন কিছু সংঘটিত করতে সক্ষম হয়? তার মাঝে আদও মনুষ্যত্ব রয়েছে নাকি সবটুকুই বর্বরতায় পরিপূর্ণ?এমন পৈশা*চিক কোনো সত্তা কি মিনতির পরোয়া করবে? কোনোদিনও নয়।

হাল ছেড়ে দিয়ে হঠাৎই যেন নিজের ভাগ্যের পরিণতিকে মেনে নিলো রোযা। ঝাপসা দৃষ্টিতে মাথা নিচু করে তাকিয়ে রইলো মেঝের দিকে, পরাজিত সৈনিকের ভঙ্গিতে যে মনিবের যেকোনো প্রকার সিদ্ধান্ত মানতে প্রস্তুত। আর কয়েক পদক্ষেপ দূরেই মৃ*ত্যু!
রোযাকে দ্বিধান্বিত করে র*ক্তস্নাত অবয়বটি তাকে পাশ কাটিয়ে শাওয়ারের ঝর্ণার নিচে থামলো।কালো রাবারগ্লাভস পরিহিত বাম হাতে কল খুলতেই ঝমঝমিয়ে বর্ষণ আরম্ভ হলো পানির।তার সমস্ত শরীর ভিজে উঠলো মুহুর্তেই,র*ক্ত ধুয়ে স্রোত হয়ে বইতে থাকলো শোষণ গর্তের দিকে। দেয়ালে হাত ঠেকিয়ে মাথা কিঞ্চিৎ নুইয়ে নিশ্চল দন্ডায়মান রইলো সে। ডান হাতের ছু*রি*টিও নিজের কদর্যতা মুছে সাফ হচ্ছে।
মিনিট দুয়েক একদৃষ্টে সম্মোহিত ব্যক্তির মতন দৃশ্যটির দিকে চেয়ে থাকলো রোযা। অশুভ পশুটি হাতের ধাতব ছু*রি টাইলসে ফেলতেই ঝনঝন ধ্বনি উঠলো, তাতে সম্বিৎ ফিরলো রোযার। সে ডান হাতের রাবার গ্লাভস খুলে লম্বাটে আঙুলগুলো ভেজা চুলে বোলাতে বোলাতে হামাগুড়ি দিয়ে রোযা দরজার দিকে যাত্রা শুরু করলো। এই সুযোগ! তাকে পালাতে হবে, যেভাবেই হোক!

বাথরুমের দরজার অপর পাশে পৌঁছে কক্ষের বিভৎস দৃশ্য পুনরায় নজরে এলো রোযার। কিছুক্ষণ আগেও যে ক্রেতা তাকে রীতিমত গলাধঃকরণ করতে উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল, তারই ক্ষ*ত বিক্ষ*ত ছি*ন্ন বিচ্ছি*ন্ন শ*রীর পড়ে রয়েছে বিছানায়। তাকানোর মতন অবস্থায় নেই লা*শ*টি। পাঁজর ভা*ঙা, উন্মুক্ত বুকের অংশ এবং তাতে ঝুলন্ত…হৃদপি*ন্ড?না*ড়িভুঁ*ড়ি বেরিয়ে পড়েছে।র*ক্তসমুদ্রে ভাসছে সবকিছু।দৃশ্যটি নজরে পড়লেই যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ অসুস্থ বোধ করতে বাধ্য।

সহসাই বুজে এলো রোযার চোখ।সে তাকাতে সক্ষম নয়।বাথরুমের ভেতর থেকে এখনো পানির শব্দ আসছে। অতি দ্রুত এই স্থান ত্যাগ করতে হবে। হামাগুড়ি দিয়েই কক্ষের ভেতর প্রবেশ করলো সে।মেঝের এক পাশে নিজের ওড়নাটা পড়ে থাকতে দেখলো। সেটি সংগ্রহ করতে উঠে দাঁড়াতে যেতেই পায়ে হ্যাঁচকা টান অনুভব করলো রোযা।তাকে পিছন থেকে ধরে রেখেছে কেউ! মুখ ফিরিয়ে তাকাতেই রোযা খেয়াল করলো তার সালোয়ার দেয়ালের তীক্ষ্ণ অংশের সাথে আটকে গিয়েছে। একটি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে সেটি ছাড়িয়ে নিয়ে যেই না রোযা পিছন ঘুরবে, অমনি বাথরুমের দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পিশাচের হিং*স্র দৃষ্টি তাকে তৎক্ষণাৎ হিমবাহে পরিণত করলো।
ভেজা চুল কপাল পেরিয়ে চোখ পর্যন্ত ঢেকে ফেলেছে, টপটপ করে জলবিন্দু গড়াচ্ছে তা থেকে।মুখের মাস্কটি সরানোর প্রয়োজনবোধ করেনি সে।সম্পূর্ণ শরীর ভিজে চুপচুপ করছে।সুঠাম অবয়বটি বাদে আর কিছুই বোধগম্য সম্ভব নয়।বুকের উপর উভয় বাহু ভাঁজ করে রেখে দাঁড়িয়ে আছে, একদৃষ্টে দেখছে রোযাকে।

– কলগার্ল?
জীবনে এতটা ভারীক্কি কন্ঠস্বর এর আগে কোনোদিন শুনেছে বলে স্মরণ করতে পারলোনা রোযা। কণ্ঠটি গম্ভীর নয়, কিন্তু নিষ্প্রাণ এবং অনুভূতিশূন্য। কণ্ঠস্বরটির যেন একটি নির্দিষ্ট ওজন রয়েছে, শুনলেই হৃদয়ে কেমন চাপ অনুভূত হয়। ঝড়ের পূর্বমুহূর্তে আকাশ ছেয়ে ফেলা ঘন কালো মেঘপুঞ্জের একে অপরের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে যে গর্জন সৃষ্টি হয়,তার সঙ্গে কণ্ঠটির অদ্ভুত মিল রয়েছে।
পলায়নের চিন্তায় বিরতি দিয়ে নীরবে মাথা উপর নিচে দুলিয়ে সম্মতি জানালো রোযা।কোনো শব্দ উচ্চারণ সম্ভব নয়।তার দৃষ্টি একবার মেঝেতে নিজের ওড়না, এবং আরেকবার অশরীরী প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তিটির উপর আপতিত হচ্ছে।

কোমরে গুঁজে রাখা সাইলেন্সারযুক্ত রিভ*লভার বের করে রোযার দিকে এগোলো সে।তাতে হতচকিত হয়ে পড়ল রোযা।এর কাছে রিভ*লভার থাকা সত্ত্বেও ছু*রি কেনো ব্যবহার করলো?অধিক নৃশং*সতা প্রকাশের জন্য?অদ্ভুতুড়ে বিষয়টির চিন্তায় মগ্ন থাকতেই রোযার কপাল বরাবর তা*ক হলো রিভল*ভারটির দীর্ঘ নল।সেফটি লক খুলে ট্রি*গারে আঙুল বসানো হলো।
প্রথমবারের মতন নিজের সকল অনুভূতি নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে শব্দ করে কেঁদে উঠলো রোযা।কান্নার দমকে তার শরীর কাঁপতে থাকলো। দূর্বল চিত্তে ফিসফিসে কণ্ঠস্বরে মাথা ঝুঁকিয়ে সে বললো,
– দোহাই লাগে আমাকে খু*ন করবেন না! আমি কিছু করিনি,আমি কিছু জানিনা! আমি আজকের এই ঘটনা সম্পর্কে কোনোদিন মুখ খুলবো না!

ব্যক্তিটি কখন কাছে এসেছে ঝাপসা দৃষ্টিতে তা খেয়ালও করেনি রোযা।তার চোখের অশ্রু টপটপ করে অশুভ সত্তাটির পরনের চেলসি বুটের উপর পড়তে থাকলো।
– আমি আপনাকে চিনি না…. প্লিজ,আমাকে যেতে দিন!আপনাকে কথা দিচ্ছি আমার মুখ বন্ধ রাখবো।আমি শুধুমাত্র সার্ভিস দিতে এসেছিলাম আর….
উচ্চারণ করা সম্ভব হলোনা।রোযার মুখোমুখি হাঁটু গেড়ে বসলো সে।মুখ তুলতেই উভয়ের দৃষ্টি বিনিময় ঘটলো।এতটাই অসহনীয় এবং দুর্বিষহ মনে হলো সেই দৃষ্টি যে রোযা তৎক্ষণাৎ নিজের চোখ সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো।এই দানবের উপস্থিতির এতটাই প্রভাবশালী যে তাতে ক্রমশ দূর্বল হয়ে পড়ছে রোযা।
কপালে শীতল ধাতব স্পর্শটি অনুভব হতেই দুই হাত মেঝেতে ঠেকিয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস প্রশ্বাস নিতে লাগলো রোযা।বন্ধ করে ফেললো চোখ।এবার নিশ্চিত আর রেহাই নেই।এটিই সমাপ্তি!

– ডু…. অওর ডা*ই?
চমকে উঠলো রোযা।নিজের অজান্তেই তার বন্ধ চোখের পাতা খুলে গেলো।একদৃষ্টে চেয়ে রইলো সামনের অবয়বের দিকে। রোযার চোখের ভাসমান দ্বিধাদ্বন্দ্ব, অবিশ্বাস ও কৌতূহল।বিশ্লেষণ না করলেও সে বুঝতে সক্ষম যে ব্যক্তিটি তাকে দুইটি নির্বাচন করার সুযোগ দিয়েছে। করো…নাহয় ম*রো!কিন্তু এর অর্থ কি? কি করতে বলছে সে?
– ক…কি…করতে হবে আমাকে?
এই প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রোযার কপাল থেকে রিভ*লভার সরিয়ে নিলো সে।উঠে দাঁড়িয়ে সেটি পুনরায় কোমরে গুঁজে সামনে এগোল। রোযা আতঙ্কিত দৃষ্টিতে শুধু চেয়ে থাকল। একটু দূরে মেঝেতে পড়ে থাকা ওড়নাটা তুলে নিয়ে সেটি রোযার দিকে ছুঁড়ে দিয়ে সে বিড়বিড় করলো,
– পাঁচ লাখ যথেষ্ট নিশ্চয়ই?
ওড়নাটি নিজের শরীরে জড়াতে গিয়ে স্তম্ভিত হয়ে রইলো রোযা।অতঃপর অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো রহস্যময় বর্বর ব্যক্তিটির দিকে।সে কি ঠিক শুনেছে নাকি সবটাই তার মস্তিষ্কের সৃষ্টি করা কোনো কল্পনা, বিজ্ঞানের ভাষায় যাকে বলা হয়— হ্যালুসিনেশন?

অফিসের কেবিনরুমটি মৃদু সোনালী আভায় উদ্ভাসিত। অসীম আকাশের পশ্চিম প্রান্তে ধীরে ধীরে অস্তমিত হচ্ছে দিবাকর। তার রশ্মি আজ ধারণ করেছে রক্তিম আবহ। মেঘহীন আকাশকে যা ছেয়ে ফেলেছে এক অভূতপূর্ব বর্ণচ্ছটায়। গ্লাসে আচ্ছাদিত দেয়াল ভেদ করে চুঁইয়ে যেন ভেতরে প্রবেশ করছে সেই রশ্মিপাত। ডেস্কের উপর গ্রামোফোনে মৃদু গুঞ্জনে বাজতে থাকা ক্লাসিক্যাল ইউরোপীয় সঙ্গীতের সংমিশ্রণে মুহূর্তটুকু মনে হচ্ছে সদ্য কোনো “ভ্যাম্পায়ার” উপন্যাস থেকে বাস্তবে ফুটে ওঠা কোনো দৃশ্য।

পা দুটো অ্যান্টিক গ্রামোফোনটির পাশে তুলে দিয়ে শরীর হেলিয়ে আরামদায়ক চেয়ারে বসে রয়েছে নাবিল কায়সার। হাতে রেড ওয়াইন পূর্ণ গ্লাস, এবং তর্জনীতে ঝুলন্ত ইলেকট্রনিক সিগারেট। ডাগর ডাগর আঁখিজোড়ার নেশাক্ত দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত অস্তমিত সূর্যের দিকে, যার অদ্ভুত অশরীরী বর্ণরশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে সমস্ত শহরজুড়ে।ক্রমেই সন্ধ্যার আঁধারছায়া ধেয়ে আসছে এই শহরকে গ্রাস করতে।সুউচ্চ ভবনের নিজ কেবিনে বসে দৃশ্যটি উপভোগ করতে করতে ওয়াইনের স্বাদ আস্বাদন নাবিলের অশান্ত হৃদয়ে একটু হলেও প্রশান্তির ছোঁয়া দিতে সক্ষম হচ্ছে।
দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান “কে বি ইন্ডাস্ট্রিজ” এর কর্ণধার বাদশাহ কায়সারের কনিষ্ঠ পুত্র নাবিল কায়সার ঘণ্টাখানেক আগেই ফোনকলে সদ্য বিবাহিতা স্ত্রীর সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় লিপ্ত হয়েছে।যার দরুণ তার মেজাজ সপ্তম আসমানে গিয়ে পৌঁছেছে। লামিয়া মেয়েটাই একটা উটকো ঝামেলা। যদি না ব্যবসায়িক প্রতিপত্তি বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় হতো, তাহলে এমন মেয়ের দিকে কোনোদিন ফিরেও তাকাতোনা নাবিল। মেয়েমানুষের কি অভাব পড়েছে দুনিয়ায়?টাকা ছড়ালেই সুরসুর করে হাজীর হবে তার বিছানায়।

দাম্পত্য জীবনের কলহ এবং ব্যবসাসংক্রান্ত কাজকর্মে হাঁপিয়ে উঠেছে নাবিল।সামান্য আনন্দ স্ফূর্তির সুযোগও সে পায়নি যতদিন থেকে এই অফিসের দায়িত্ব তার উপর অর্পিত হয়েছে।এসব কি মানা সম্ভব? সারাদিন ক্লাব পার্টি এবং মেয়েবাজী করে বেড়ানো ছেলেটাকে একদিন হুট করে কোম্পানির ডিরেক্টরের আসনে বসিয়ে দেয়া হলো। তাতেও ক্ষান্ত না হয়ে সোজা কোথাকার কোন লামিয়া হাওলাদারকে ধরে কাবিন পড়িয়ে ফেলা হলো, যার কিনা আবার ভিন্ন এক পুরুষের সাথে অবৈধ প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। কি আশ্চর্য! এই মেয়ের এতই দুঃসাহস সে স্বামীর যাচ্ছে ওপেন ম্যারেজের দাবি করে!
ওপেন ম্যারেজ! ইলেক্ট্রনিক সিগারেটের প্রান্ত ঠোঁটে পুরে একরাশ ধোঁয়া নির্গত করে কাষ্ঠহাসি হাসলো নাবিল। ওপেন ম্যারেজ আবার কি?নিজের পরকীয়ার সম্পর্কে জায়েজ প্রমাণিত করার এক পাশ্চাত্য নামমাত্র। পুনরায় একটি দীর্ঘটান গ্রহণ করে নাবিল আধুনিক ইন্টেরিয়রের সিলিংয়ের দিকে তাকালো। ঠিক আছে। লামিয়া বানু যেমনভাবে খেলতে চাইছে তার সঙ্গে ঠিক তেমনভাবেই খেলা হবে। সে আন্দাজও করতে পারছেনা কত অভিজ্ঞ খেলোয়াড় এই নাবিল কায়সার!

– স্যার আসবো?
কেবিনের কাচের দরজার পাশের দেয়ালে অবস্থিত স্পিকারে যান্ত্রিক ধরণের কন্ঠস্বরটি বেজে উঠলো।বাইরের মাইক্রোফোনে কেউ ভেতরে প্রবেশের অনুমতি চাইছে। দূর থেকে এল ই ডি স্ক্রীনে সাদাকালো বর্ণে বাইরে অপেক্ষমান দুজনকে দেখতে পেলো নাবিল।একজন তার সেক্রেটারী আকাশ, অপরজন একজন রমণী।তবে কারোরই চেহারা কিংবা বেশভূষা দূর থেকে ঠিকমত বোধগম্য হচ্ছেনা।আকাশকে চেনার কারণ তার অবয়ব দেখে নাবিল অভ্যস্ত।এই মুহূর্তে চেয়ার থেকে উঠে কাছে গিয়ে দেখতে ইচ্ছা না হওয়ায় ঠোঁট থেকে সিগারেট সরিয়ে নাবিল অনুমতি প্রদান করলো।

– কাম ইন।
কাচের দরজা স্লাইড করে খুলে গেলো।ভেতরে প্রবেশ করলো আকাশ।তার সঙ্গে সেই অচেনা রমণী।সহসাই ডেস্ক থেকে পা নামিয়ে চেয়ারে সোজা হয়ে বসলো নাবিল। তার লোলুপ দৃষ্টি রমণীকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে আরম্ভ করলো। এমন সব স্থানে তা স্থির হলো যা স্বাভাবিক কোনো পুরুষ মানুষ সর্বদাই এড়িয়ে যায়।
হলুদ বর্ণের কাঠগোলাপ অঙ্কিত অরগাঞ্জা শাড়ী পরিহিত রমণী নাবিলের দিকে তাকালো।চোখে চোখ মিলতেই তার হালকা লাল লিপস্টিক এবং গ্লসে চিকচিক দ্যুতি ছড়ানো ওষ্ঠজোড়া মৃদু হাসির রেখায় বিস্তৃত হলো।একদৃষ্টে নির্লজ্জ ভঙ্গিতে সেই ঠোঁটের পানে তাকিয়ে থাকলো নাবিল।একটি ঢোক গিললো, ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিয়ে তীর্যক দৃষ্টিতে দেখতে থাকলো রমণীকে।

– আমি তাহলে আসলাম, স্যার।
না তাকিয়েই হাতের ইশারায় আকাশকে প্রস্থান করার আদেশ দিতেই সে চুপচাপ কেবিনের বাইরে চলে গেলো। কাচের স্লাইড ডোর মৃদু ঘড়ঘড় শব্দে বন্ধ হতে হতে রমণী কোনোপ্রকার অনুমতি ব্যাতিতই ডেস্কের অপর পাশের চেয়ার টেনে বসে পড়লো।নিজের হ্যান্ডব্যাগ তুলে রাখলো গ্রামোফোনের বিপরীতে।তাতে বিরক্ত নয় বরং সন্তুষ্টই হলো নাবিল।এমন নির্ভীক মেয়েই তার পছন্দ।
– নাম?
– সুমি।
কপালে নেমে আসা মসৃণ চুলের গুচ্ছ কানের পিছনে গুঁজে নিয়ে মধুমিশ্রিত কন্ঠে জবাব দিলো রমণী।তার শরীর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি একটি ঘ্রাণ যেন মুহূর্তেই নাবিলকে মোহিত করে তুললো।ব্যাপারটি ঠিক উত্তেজক নয়। এই রমণী কাছে থাকলে শরীরে উত্তেজনা নয় বরং প্রশান্তি সৃষ্টি হয়।যে প্রশান্তির আজ বড্ড দরকার নাবিলের।তাই সে সুমির প্রতি অধিক আকৃষ্ট অনুভব করলো।

– ওয়াইন?
নিজের গ্লাসটি নাড়িয়ে ইঙ্গিতে শুধালো নাবিল।তাতে যথারীতি হাসিটি ধরে রেখে মাথা নাড়লো সুমি।
– না ধন্যবাদ।আমি ড্রিংক করিনা।
– আই সি…. এথিকস! হাহ?
ওয়াইনের গ্লাস টেবিলে রেখে দিয়ে শুধুমাত্র সিগারেট হাতে উঠল নাবিল।সম্পূর্ণ ডেস্ক ঘুরে এসে দাঁড়ালো ঠিক সুমির পিছনে।বর্তমানে তার মিষ্টতাপূর্ণ ঘ্রাণটি আরো তীব্রভাবে নাকে এসে ঠেকছে।তার বিপরীতে নিজের সিগারেটের তামাটে গন্ধকে কেমন অপবিত্র মনে হচ্ছে। সেটি তাই ডেস্কে ছুঁড়ে দিয়ে ঝুঁকলো নাবিল।দুই হাতে স্পর্শ করলো সুমির কাধজোড়া। কিঞ্চিৎ চমকিত হলো সুমি,কিন্তু পরমুহুর্তেই নিজের কোমল হাসির আড়ালে সবকিছু আড়াল করে ফেললো।

সুমির পিঠ ভাসিয়ে কোমর অবধি নেমে যাওয়া মসৃণ চুলে মুখ ডুবিয়ে মোহনীয় ঘ্রাণটি অনুভব করলো নাবিল।তারপর ফিসফিস কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
– হুম….সুমি ডিয়ার! বলো তোমাকে কোন রূপকথার রাজ্যে নিয়ে যেতে পারি? প্যারিস, লন্ডন, কিংবা গ্রীস?তাজমহল দেখতে চাও, অথবা আইফেল টাওয়ার?জাস্ট সে দা ওয়ার্ড…..
– সাজেক।
উত্তরটি নাবিলকে তার মোহের দুনিয়া থেকে বাস্তবে টেনে আনলো যেন জোরপূর্বক।চোখ মেলে সে একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো সুমির দিকে। মায়াবতী রমণীটির আকর্ষণীয় অধরপল্লবে ভাসছে অমায়িক হাসির প্রবাহ।
– সাজেক ভ্যালি। কোনোদিন যাইনি,সেখানকার পাহাড় এবং প্রকৃতি দেখতে ইচ্ছুক।
চোখ পিটপিট করলো নাবিল,পরক্ষণেই সুমির হাসি যেন তার ঠোঁটেও সং*ক্রমিত হলো।ঝুঁকে রমণীর ব্লাশে উদ্ভাসিত গালে নিজের নাক ঘষে নাবিল জবাব দিলো,

– অ্যায ইউ উইশ।
উপভোগে ব্যাস্ত থাকায় সামনের কাচের তৈরি দেয়ালে প্রতিফলিত হওয়া সুমির অবয়বের চেহারায় অদ্ভুত অশুভ ভাবটি নাবিল কায়সারের দৃষ্টি সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলো।

ডার্কসাইড পর্ব ২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here